তুমি আছো মনের গহীনে পর্ব-২২+২৩

0
2284

#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব- ২২
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
আরহাম রাতেই সবে মাত্র গোসল সেরে তোয়ালা দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে খালি গাঁয়ে বেড়িয়ে পড়লো। মেহেভীন সঙ্গে সঙ্গে পিছনে ঘুড়ে, নিজের চোখ বন্ধ করে ফেললো। আরহাম মেহেভীনের দিকে সুক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো, ‘এইভাবে পিছনে ঘুড়লে কেন? ‘
মেহেভীন নিজের চোখ জোড়া বন্ধ করেই বললো,
‘ আপনি বেশরম হতে পারেন আমি না। তাই পিছনে ঘুড়ে আছি। ‘

আরহাম ক্ষিপ্ত সুরে বললো, ‘ এই স্টুপিড মেয়ে একদম আমাকে বেশরম বলবে না। কি করেছি আমি?’

‘ঘরে একটা মেয়ে আছে অথচ তার সামনে আপনি খালি গাঁয়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছেন। লজ্জা করেনা?বেশরম লোক টা। ‘

‘বেশরম রাইট? ‘
কথাটি বলে, আরহাম কিছু একটা ভেবে,মেহেভীনের দিকে এগোতে লাগলো। মেহেভীন ভয়ে ঢুগ পিছাতে লাগলো। মেহেভীন পিছাতে পিছাতে পড়ে যেতে নিলে,আরহাম মেহেভীনের হাত খপ করে নিজের কাছে টেনে নিলো। আরহামের ফর্সা শরীর থেকে টপটপ করে পানি পানি মেহেভীনের হাতে গিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। মেহেভীনের দৃষ্টি নিচের দিকে। আরহামের দৃষ্টি মেহেভীনে সীমাবদ্ধ। আরহাম মিহি কন্ঠে বললো, ‘ তুমি আমার বউ। ‘

‘বউ ‘ ডাকটি শুনে মেহেভীনের বুকটা ধক করে উঠলো। মেহেভীন আরহামের দিকে তাকাতেই, আরহাম উচ্চস্বরে হেসে বললো, ‘ নকল বউ তুমি আমার। নকল বউ হলেও বউ শব্দটা তো আছে তোমার নামের সাথে। আমার মনে হয় না বউয়ের সামনে খালি গাঁয়ে বের হলে,সমস্যা হবে। ‘

আরহাম কথাটি বলেই নিজের কাবার্ডে নিজের টি-শার্ট খুঁজতে শুরু করলো। মেহেভীনের কানে এখনো ‘বউ ‘ ডাকটি বেজে চলেছে। কি সুন্দর একটা শব্দ। আরহামের মুখে বেশ লাগছিলো।

______

মেহেভীনের সকালে ঘুম থেকেই উঠে শুনতে পায় আরহামের বাবা ফিরে এসেছে। আরহামের বাবা এসেছে শুনে, মেহেভীন মাথায় ওড়না পেচিয়ে নীচে নেমে আসে। নীচে গিয়েই মেহেভীন আরহামের বাবা আকবর সাহেবকে দেখে, পা ধরে সালাম করতে নিলে,তাতে বাঁধা দেন তিনি। পত্রবধুকে দেখে মিষ্টি হেসে বললেন,

‘ একদম এইসময় ঝুঁকবে না বউমা। সব কিছুই শুনেছি আমি। সত্যি তুমি খুব মিষ্টি। আমার হাদারামটা প্রেম করতে না পারলেও, বিয়েটা করতে পেরেছে এইটাই অনেক। বিয়ে করে আমার ঘরে মিষ্টি একটা মেয়ে নিয়ে এসেছে।’

আরহামকে এইভাবে হাদারাম বলে সন্মোধন করায় আরহামের কপালে বিরক্তি ভাজ পড়ে যায়। যার মানে সে হাদারাম নামে যথেষ্ট অসন্তুষ্ট। তার ভাষ্যমতে, সে যথেষ্ট বুদ্ধিমান। মেহেভীনের মতো একদমই স্টুপিড নয় সে। তাহলে তাকে কেন দেওয়া হলো হাদারাম নামক উপাধি। মেহেভীন মুচকি হাসে আরহামের দিকে তাকায়। মেহেভীনের টিটরাকিমূলক হাসিতে আরহাম রাগ নাকের ঢগায় চলে আসে। তবুও সে চুপ থাকে। এই স্টুপিড মেয়েকে সেও সঠিক সময় এলে,মজা দেখাবে। আকবর সাহেব মেহেভীনের দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘ আমার হাদারাম টা একেবারের তর সইলো না। বিয়েও করে ফেললো আবার বাচ্ছাও। যাক বাচ্ছা হওয়ার পরে, না হয় আমরা বড় করে বউভাতের অনুষ্টানটা করে ফেলবো। আমার যে কি খুশি লাগছে। আরহামের মা তুমি বরং মিষ্টিগুলো রাহেলাকে দিয়ে বের করিয়ে নাও।তোমার কথামতো তিনশোর মতো প্যাকেট এনেছি।পরে লাগলে আরো আনবো। ‘

আরহামের বাবার কথা শুনে, মেহেভীন সামনের দিকে তাকায়। পুরো ড্রইং রুম জুড়ে মিষ্টির প্যাকেট দিয়ে ভর্তি৷ মনে হচ্ছে আরহামের বাবা
আস্ত মিষ্টির দোকান যেন তুলে এনেছে। মেহেভীন এতোকিছু দেখে বললেন,

‘আংকেল এইসব কি করেছেন? এতো মিষ্টের কি প্রয়োজন ছিলো? ‘

আকবর সাহেব নরম সুরে বললেন,

‘ একদম আমাকে আংকেল বলবে না। আমি কি তোমার আংকেল হই? আমাকে বাবা বলে ডাকবে। জানো আমার ছোটবেলা থেকেই একটা মিষ্টি মেয়ের খুব শখ ছিলো, কিন্তু আল্লাহ দিলেন দুই হাদারাম। কিন্তু এখন সমস্যা নেই। আমাদের ঘরে এখন আমাদের মিষ্টি মেয়ে এসে পড়েছে তাইনা রাজিয়া? ‘

আরহামের মা রাজিয়া সায় দিয়ে বললেন, ‘একদম।’

আরিয়ান কথাটি শুনে তেলে বেগুন জ্বলে বলে,

‘বাবা ইটস নট ফেয়ার। তুমি ভাইয়াকে বলেছো ঠিক আছে। বাট আমাকে একদম হাদারাম বলবে না। ‘

সবাই আরেকদফা হেসে উঠে। আরহাম মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে আছে। আকবর সাহেব আবারো বললেন,

‘ এখানে তো কম মিষ্টি মা। আমার তো উচিৎ ছিলো হাজারো মিষ্টি নিয়ে আসা। আমার নাতি-নাত্নি আসবে বলে কথা। আমি আমার নাতি-নাত্নির সাথে খেলবো ঘুড়বো আরো কত কিছু করবো। ‘

আরহামের বাবার কথা শুনে মেহেভীন চুপ হয়ে গেলো। সে আরহামের দিকে তাকালো। আরহামের দৃষ্টি এখনো ল্যাপটপেই রয়েছে। আরিয়ান হয়তো বুঝতে পারলো মেহেভীনের মনের অবস্হা।

আরহামের মা এগিয়ে এসে বললো, ‘ এইসব কিছু করার জন্যে ফিট থাকতে হবে না? তার জন্যে তো ঠিকমতো ওষুধ খেতে হবে। তুমি এখনো তোমার প্রেশারের ওষুধ টা খাও নেই। ডক্টর হয়ে যদি এমন অনিয়ম করো, তাহলে বাকিরা কি করবে? ‘

আকবর সাহেব মিহি হেসে বললেন,

‘ যথা আজ্ঞা মহারানী চলুন। এখুনি ওষুধ টা খেয়ে নেই। ‘

আরহাম মা হেসে উঠেন। আরহামের মা ও আরহামের বাবা উপরে চলে যান। তারা চলে যেতেই, মেহেভীন আরিয়ানের কাছে এসে বললো,

‘ এইবার আমার মনে হচ্ছে আমার এই বাড়িতে আর থাকার উচিৎ হবে না। ‘

মেহেভীনের কথা শুনে, আরহাম এবং আরিয়ান উভয়েই মেহেভীনের দিকে তাকায়। আরিয়ান মেহেভীনের কাধে হাত রেখে বলে,

‘কি হয়েছে মেহু? তুই হঠাৎ এইরকম কথা বলছিস কেন? ‘

মেহেভীন নিজের চোখের জলটুকু মুছে বলে,

‘ আসলে আমার ভিতরে এক অপরাধবোধ কাজ করছে। এই মানুষগুলো কত সরল-সোজা। কতটা ভালো। বিনা প্রশ্নে আমাকে ও আমার সন্তানকে নিজেদের পরিবারের অংশ বানিয়ে দিলো। এমনকি আমার সন্তানকে নিয়ে ভবিষ্যৎ এ কত স্বপ্ন। যখন তারা সত্যটি জানবে তখন কি হবে আরিয়ান? তাদের সব স্বপ্ন তো এক নিমিষেই ভেঙ্গে যাবে। আমি কী করে পারবো তাদের সাথে এইরকম বিশ্বাসঘাতকতা করবো? আমি তো জানি কেউ বিশ্বাসঘাতকা করলে, ঠিক কতটা কষ্ট পেতে হবে। ‘

আরহাম শান্ত সুরে বললো,

‘ আরিয়ান তোর স্টুপিড ফ্রেন্ডকে চুপ করতে বল। সেকেন্ডলি অনেকময় ভালো কিছুর সূচনার জন্যে কিছু মিথ্যে সত্যের থেকেও অনেক বেশি মূল্যবান।’

মেহেভীন থেমে যায়। আরহাম আবারোও বলে,
‘একজন নিষ্পাপ শিশু সুষ্টুভাবে নিরাপত্তার সাথে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করবে। এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে? নিউ বেবীর ভালোর জন্যে এইটুকু মিথ্যেটা আমাদের বলতেই হবে। ‘

আরহামের ফোন বেজে উঠলো। অফিস থেকে ফোন করেছে। আরহাম সবাইকে বিদায় জানিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

______

আরহাম অফিসে ঢুকতেই, রুশা তার সামনে এসে বলে,

‘গুড মর্নিং স্যার। ‘

‘মিস রুশা আপনি হঠাৎ পথ আটকে দাড়ালেন যে, কোন সমস্যা? ‘

রুশা মাথা চুলকে বললো, ‘স্যার আসলে আপনি বলেছেন আমাদের চট্টগ্রামের প্রযেক্টের কথা। প্রযেক্টটার জন্যে আমাদের ২-৩ দিনের মাঝেই চলে যেতে হবে। আপনি যদি আমার সাথে একটু আমার কেবিনে গিয়ে, প্রযেক্টটা বুঝিয়ে দিতেন তাহলে খুব ভালো হতো। ‘

আরহাম রুশাকে এড়িয়ে বললো, ‘হুম। আপনি এই বিষয়ে তাহসানের সাথে কথা বলে নিয়েন, আমি ওকে সব বুঝিয়ে দিয়েছি। আমি আসছি। আমার একটু কাজ আছে। এক্সকিউজ মি। ‘

আরহাম নিজের কেবিনে চলে যায়। রুশা তাচ্ছিল্যের হাসি হাঁসে। সে খুব ভালো করেই জানে আরহাম তাকে এড়িয়ে চলার জন্যে কথাগুলো বলেছে।

_____
অভ্র নীচে নেমে দেখে মায়রার বাবা এসেছেন।মায়রার বাবাকে দেখেই, মায়রার বাবাকে অভ্র সালাম দেয়। মায়রার বাবা বললেন,

‘ এতো ভালো সুখবরটা পেয়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। একেবারে মিষ্টি নিয়েই চলে এসেছি দেখা করতে। ‘

ইশরা বেগম হাসিমুখে বললেন, ‘ বেশ করেছেন। এইরকম একটা সুখবর না পেয়ে কি থাকা যায়? ‘

মায়রার বাবা তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘ আমার মেয়েটা কত্ত বড় হয়ে গেছে ভাবতেই অবাক লাগে। সেদিনই তো আমার মেয়েটা কত বায়না করতো। আজ সে নিজেই এখন মা হতে চলেছে। আচ্ছা মা তুই ভালো আছিস তো? ‘

বাবার প্রশ্নে মায়রা তার শাশুড়ি মায়ের দিকে তাকায়। তার শাশুড়ি তাকে কিছু একটা বুঝায় চোখের ইশারায়। মায়রা নিচু স্বরে বলে,

‘ আমি একদম ভালো আছি বাবা। খুব সুখে আছি। ‘

মায়রার বাবা তার মেয়ের কথা শুনে প্রশান্তি হাসির দিলেন। নিজের কথাতে নিজেই অবাক হলো মায়রা। সে কতটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। যে মেয়ে বিয়ের আগে অব্দি সামান্য ব্যাথা পেলে পুরো বাড়ি জুড়ে চিৎকার করতো। সে কিনা এখন অভ্রের দেওয়া প্রতিটা আঘাত সহ্য করে, হাসিমুখে বলে দিচ্ছে সে সুখি। একেই হয়তো বলে,বিয়ের পরে মেয়েদের পরিবর্তন। অভ্র নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,

‘ আমাকে এখুনি অফিসে যেতে হবে। আম গেটিং লেট। সো বায়। ‘

অভ্র কথাটি বলে, চলে যেতে নিলে মায়রার বাবা উঠে দাড়িয়ে, অভ্রের হাতে একটা খাম ধরিয়ে বললো,

‘ অভ্র মায়রা এখন প্রেগনেন্ট। মায়রা আমার কাছে আবদার করেছে যেন, তুমি মায়রাকে নিয়ে চট্টগ্রামের ট্রিপে নিয়ে যাও। আমি চাইলে বিদেশের ট্য্যুরের ব্যবস্হা করে দিতে পারতাম,কিন্তু এখন মায়রার অবস্হা যা তাতে বিদেশে যাওয়া ঠিক হবেনা। আমি ট্রিপের সব ব্যাবস্হা করে দিয়েছে। ‘

‘কিন্তু…..’

অভ্রের কথার মাঝেই মায়রার বাবা বললেন,

‘ দেখো অভ্র এইসময় একটু ট্যুরে গেলে মনটাও ভালো থাকে। মায়রারও এখন মন ভালো করাটা খুব দরকার তুমি প্লিয না করো না। ‘

অভ্র মায়রার সাথে আপাতত না যেতে চাইলেও, মায়রার বাবা ও ইশরা বেগমের জোড়ের জন্যে একপ্রকার বাধ্য হয়েই সে রাজি হলো চট্টগ্রামের জন্যে।

_______

আরহাম অফিস থেকে কিছুটা দেরী করেই আজ ফিরেছে। সে তার রুমে ঢুকেই দেখে, মেহেভীন বিছানায় বসে আছে মাথা নিচু করে। আরহাম তার কাঁধের ব্যাগটা রেখে, মেহেভীনের কাছে এসে বললো,

‘ এনি প্রব্লেম? ‘

মেহেভীন কোনরকম মাথা উচু করে বললো,

‘সকল থেকেই প্রচন্ড বমি করেছি। খেতে পারছি না কিছু। আরিয়ানের দেওয়া ওষুধ টা খেয়েছি,তবুও ঘুম আসছে না। একটু ঘুম হলে ভালো লাগতো। ‘

আরহাম মেহেভীনের পাশে বসে বললো,

‘শুয়ে পড়ো। ‘

‘মানে? ‘

আরহাম কথা না বাড়িয়ে, মেহেভীনের মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে, আস্তে করে মেহেভীনের মাথাটা টিপে দিতে থাকে,যেন মেহেভীনের ঘুম আসে। মেহেভীন আরহামের কান্ড দেখে বলে,

‘কি করছেন কি? আপনি এখন আমার মাথা টিপে দিবেন? সবে মাত্র অফিস থেকে এলেন। কিছু তো খেলেও না। ‘

আরহাম ধমক দিয়ে বলে,

‘ স্টুপিড একটা। বেশি কথা বলো। চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ো। ‘

কথাটি বলেই, আরহাম মেহেভীনের চুলে বিলি কেটে দিতে থাকে। মেহেভীন আরহামের ধমক শুনে চুপ হয়ে গেলো। মাথাটা তার সত্যিই ব্যাথা করছিলো, এখন কিছুটা শান্তি লাগছে। মেহেভীন চোখ বন্ধ করে ফেলে।

চলবে….ইনশা-আল্লাহ।

#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব- ২৩
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
আরহাম মেহেভীনের মাথা বুলাতে বুলাতে, খাটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। মেহেভীন আরহামের হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে।ঘুমের মাঝে হঠাৎ করেই মেহেভীন উঠে পড়ে, এতে আরহামের ও ঘুম ভেঙ্গে যায়। আরহাম মেহেভীনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আর ইউ অকে? এনিথিং রং? ‘
মেহেভীন মুখ চেপে ওয়াশরুমে চলে যায়। আরহাম বুঝতে পারছে মেহেভীনের বমি আসছে। মেয়েটাও সকাল থেকে কিচ্ছু খায়নি, তার মধ্যে বমির জন্যে আরো দূর্বল হয়ে যাবে। মেহেভীন ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে যায়। আরহাম উঠে গিয়ে, মেহেভীনের হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে, মেহেভীনের দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। মেহেভীন পানিটা আস্তে করে খেয়ে নিয়ে, বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ে। প্রচন্ড দূর্বল লাগছে তার শরীরটা। আরহাম মেহেভীনের দিকে প্রশ্ন নিক্ষেপ করে বলে,

‘বেশি খারাপ লাগছে? আমি কি আরিয়ানকে ডেকে আনবো? ‘

মেহেভীন কোনরকম বলে,
‘তার প্রয়োজন নেই। আরিয়ান কেবলমাত্র ওটি করে ফিরেছে। একটু ঘুমাচ্ছে এখন। শুধু শুধু বিরক্ত করার প্রয়োজন নেই। আপনিও তো সেই কখন এসেছেন কিছু তো খেলেন না। আপনি বরং খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। ‘

কথাটা বলার সাথে সাথে মেহেভীনের বমি চলে আসে। এইবার মেহেভীন আরহামের শার্টের উপরেই বমি করে ফেলে। আরহাম পুরো শার্ট নষ্ট হয়ে গেছে। মেহেভীনের অপরাধের চোখে তাকিয়ে থাকে আরহামের দিকে। মেহেভীনের বিড়বিড় করে বলে,

‘মেহেভীন এইবার তুই একেবারে গেলি রে। এমনিতেই মানুষটা মাত্র অফিস থেকে এলো তারমধ্যে আবার তার নষ্ট করে ফেললি তুই। ‘

মেহেভীন ভাবলো আরহাম বোধহয় তাকে অনেক বকাবকি করবে, এইভাবে বমি করে তার শার্টটা নষ্ট করে ফেলায়। কিন্তু আরহাম এইসব কিছুই করলো না। আরহাম চমৎকার হাসি দিয়ে বলে,

‘ডোন্ট বি প্যানিকড ওকে? প্রেগ্ন্যাসির সময় এইসব কিছুই নরমাল। ঘন-ঘন বমিও হয়। এইসব নিয়ে এতো চিন্তার কিছুই নেই। তাই তুমি একটু বসো। আমি এখুনি চেঞ্জ করে নিয়ে আসছি। ‘

আরহাম উঠে ওয়াশরুমে চলে যায়। মেহেভীন অবাক পানে আরহামের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। সে শুধু ভাবছে আরহাম কীভাবে সহ্য করলো? অন্য একটা মেয়ে তার গায়ে বমি করে ফেললো, সে ঘৃণায় মুখ ছিটকে নিয়ে যাবে। বকাবকি করবে। তা না করে উল্টো হেসে দিয়ে মেহেভীনকে ভালো করে বুঝিয়ে, চেঞ্জ করতে চলে গেলো। কেমন অদ্ভুদ ভালো মানুষ আরহাম। আচ্ছা অভ্র যদি এখন এইসময় এইরকম পরিস্হিতিতে থাকতো? তাহলে কী করতো? নিশ্চই আরহাম যা করেছে, তার উল্টোটা করতো। এইরকম একটা বাজে পরিস্হিতিতে আরহামের মতো দায়িত্ববান মানুষটাকে পেয়ে, মেহেভীন সত্যি নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করছে।

__________

মায়রা খুশিমনে নিজের লাগেজ গুছিয়ে ফেলছে। বাবাকে বলে সে অভ্রকে চট্টগ্রামের ট্যাুরের জন্যে রাজি করিয়ে ফেলেছে। মায়রার ধারণামতে অফিসের এতো কাজের চাপে বোধহয় অভ্রের মেজাজ সবসময় উগ্র থাকে,তাই এইভাবে মায়রার সাথে খারাপ আচরণ করে ফেলে,কিন্তু একটিবার দুজনে মিলে কোথাও ঘুড়তে চলে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ট্যাুরে শুধু অভ্র এবং মায়রা থাকবে। দুজন একা বেশ আনন্দ নিয়ে ঘুড়ে বেড়াবে পুরো চট্টগ্রাম জুড়ে। এই বেড়ানোর ছলে, মায়রা তার এবং অভ্রের মাঝে সব দূরত্ব মিটিয়ে ফেলবে,তাদের মাঝে কোন মেহেভীন নামক কাটা থাকবে না। মায়রা তার পেটে হাত রাখে। এই সন্তানের ভবিষ্যৎ এর জন্যে হলেও সব ঠিক হতে হবেই। মেহেভীনকে কিছুতেই মায়রা অভ্রের জীবনে ফিরে আসতে দিবে। মায়রা বারান্দায় গিয়ে দেখে, অভ্র কোথাও নেই। অভ্র আবার কোথায় গেলো? অভ্রকে খুঁজতে খুঁজতে মায়রা ড্রইং রুমের কিনারা গিয়ে শুনতে পেলো অভ্রের গলা। অভ্র ফোনে কাউকে কিছু বলছে।

________

আরহাম ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে আরেকটা শার্টটা পড়ে,সোজা রুম থেকে বেড়িয়ে পড়ে। মেহেভীন বুঝতে পারলো না আরহাম হঠাৎ কোথায় গেলো?
মেহেভীন আরহামের পিছন পিছন নীচে চলে গেলো।
এখন প্রায় গভীর রাত। বাড়িতে সবাই এখন ঘুমিয়ে আছে।আরহাম রান্নাঘরে গিয়ে, সুপ বানানো শুরু করলো মেহেভীনের জন্যে। মেহেভীন তা দেখে,আরহামের কাছে গিয়ে বললো,

‘ কি করছেন কি? আপনি তো এখনো ও কিছুই খাননি। নিজে না খেয়ে, আমার জন্যে সুপ বানাচ্ছেন কেন? আমি এখন সুপ খাবো না। ‘

আরহাম মেহেভীনের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ একদম স্টুপিডের মতো কথা বলবে না। সকাল থেকে না খেয়ে, শুধু বমি করছো। এইভাবে চলতে থাকলে তো অসুস্হ হয়ে পড়বে। চুপচাপ টেবিলে বসো। ‘
মেহেভীন কিছু বলার আগেই আরহাম আরেকদফা মেহেভীনকে রামদমক দিলো। মেহেভীন ধমক খেয়ে চুপচাপ বসো পড়লো। লোকটা এমনভাবে ধমক দেয়, যেন কোন সুস্হ মস্তিষ্কের মানুষ অজ্ঞান হয়ে যাবে। মেহেভীনের তো এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।
আরহাম সুপটা বানিয়ে, টেবিলে রেখে মেহেভীনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

‘চুপচাপ সুপটা খেয়ে নাও। নো মোর টক।’

মেহেভীন মাথা নাড়িয়ে খাওয়া শুরু করলো। আরহাম নিজের জন্যে লুডুস বানাতে চলে গেলো। আজকের রাতটা লুডুস খেয়েই, সে কাটিয়ে দিবে।
আরহাম মেহেভীনের দিকে কড়া নজর রেখে রান্না করছে,যেন মেহেভীন পুরোপুরি সুপটা খায়। মেহেভীনের আরহামের দিকে মুচকি হেসে খাওয়া শুরু করলো। এই মুচকি হাঁসির মানে বুঝতে পারলো না আরহাম। মেহেভীম মুচকি হাসার সঠিক কারণ হচ্ছে আরহামের এই ছোট্ট ছোট্ট যত্নগুলো। সব মেয়েই হয়তো এইরকম একজন স্বামী পাওয়ার জন্যে প্রতিক্ষা করে। আরহামের প্রেয়সী যে হবে, সে নিশ্চই খুব ভাগ্যবতী হবে,কিন্তু কে সেই ভাগ্যবতী? আচ্ছা তার মতো ভাগ্য যদি মেহেভীনের হতো তাহলে কী খুব খারাপ হতো? অভ্র ও যদি আরহামের মতো হতো তাহলে মন্দ হতো না। মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই,আরহাম লুডুসটা নিয়ে এসে বসে পড়লো।
আরহাম ভ্রু কুচকে বললো,

‘ এইযে স্টুপিড মেয়ে। সুপটা যে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে খেয়াল আছে তোমার? সত্যি স্টুপিড এর কত প্রকার
কাজ আছে তা তোমাকে না দেখলে বুঝা যাবে না। ‘

আরহাম কথাটি বলেই, নিজের খাওয়া বাদ দিয়ে মেহেভীনের সুপের বাটি নিয়ে মেহেভীনকে খায়িয়ে দিচ্ছে। আরহামের কান্ডে মেহেভীন আনমনে হাসে আরেকবার। সত্যি তার ধারণা ভূল। অভ্র চাইলেও আরহামের মতো হতে পারবে না।মেহেভীন আনমনে বললো,

‘ আরহাম হাসান তালুকদার একজনই আছে। সবাই আরহাম হাসান তালুকদার হতে পারেনা। ‘

_____

ফারিয়া পুরো পাড়া জুড়ে আজ সবার বাড়িতে ঘুড়েছে। বাড়িতে আজ সে কিছুতেই যাবে না। বাড়িতে গেলে নিশ্চিত জুতোর বাড়ি খেতেই হবে। ফারিয়ার স্যার আজ তার মানে বাড়িতে বিচার দিয়েছে। গনিত পরীক্ষায় আবারো ফেল করেছে সে।
ফারিয়া ভাবে তার মাথায় গবর থাকলে, কি সে করবে? সব করার তো ওই ডক্টরের করতে হবে। আচ্ছা ওই ডক্টর তো কল করলো না? ফারিয়া নিজ থেকেই আরিয়ানকে ফোন করলো। আরিয়ান ঘুমাচ্ছিলো, ফোনের আওয়াজ পেয়ে সে ধরফরিয়ে উঠে বসে। সে ভেবেছে হয়তো হসপিটাল থেকে ফোন করেছে, তাই সেই দ্রুত ফোন রিসিভ করে। ফোন রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে তেজি গলায় মেয়ের কন্ঠে বলে,

‘ এইযে ডক্টর সাহেব শুনছেন? ‘

‘সরি কে আপনি? আমার এখন ডিউটি নেই। আমি ঘুমাচ্ছি। সো বায়। ‘

‘একদম কাটবেন না। আপনি আমাকে ফারিয়া।চিনেছেন? যার নাম্বার আজ সকালে নিয়েছেন। আপনার চিকিৎসার কি হলো?আমি বাড়িতে ঢুকতে পারছি না আর এদিকে আপনি শান্তিতে ঘুমাচ্ছেন?কেমন ডক্টর আপনি?’

আরিয়ান মাথায় হাত দিয়ে দিলো। আজ এই মেয়ের জন্যে তার ঘুম আজ হারাম হয়ে যাবে।

________

মায়রা আরেকটু কাছে গিয়েই শুনতে অভ্র কাউকে ফোনে বলছে,

‘একপ্রকার বাধ্য হয়েই আমাকে চট্টগ্রাম যেতে হচ্ছে। আমি যত দিন থাকবো না ততদিন তোকেই মেহেভীনের সব খবর আমাকে দিতে হবে। তোর যত টাকা লাগে আমি দিবো।কিন্তু যে করেই হোক মেহেভীন কোথায় আছে ঠিক কার সাথে সব ইনফরমেশন আমার লাগবে। যতক্ষন পর্যন্ত মেহুর খবর পাচ্ছি না ততক্ষন পর্যন্ত আমি শান্তি পাচ্ছি না রে। ‘

কথাটি বলেই অভ্র ফোনটা কেটে দেখে,মায়রা তার দিকে অশ্রুমাখা চোখে তাকিয়ে আছে। অভ্র সেই চোখের চাহনীকে গুরুত্ব না দিয়ে চলে যেতে নিলে,মায়রা অভ্রের হাত ধরে ফেলে।

চলবে…ইনশা-আল্লাহ।

[কেমন হয়েছে জানাবেন কিন্তু]