তুমি আছো মনের গহীনে পর্ব-২৪+২৫

0
2147

#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব- ২৪
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
প্রেগ্ন্যাসির সময়টায় মায়রার মতো কোনো মেয়েই চাইবে না, নিজের স্বামী তার প্রাক্তনকে নিয়ে ব্যস্ত থাকুক। অভ্র এখন মায়রাকে নিয়ে চিন্তা করার সময়, তা না করে অভ্র তার প্রাক্তন স্ত্রীর চিন্তায় চিন্তিত। মায়রা আর নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারছে না। তাই অভ্রের হাত ধরে, অভ্রের দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে বলে, ‘ আচ্ছা অভ্র কিসের এতো দরদ তোমার মেহেভীনের উপর? তুমিই তো একদিন বলেছিলে মেহেভীন শুধুমাত্র তোমার ব্যবহারের বস্তু মাত্র। তাহলে কেন তার জন্যে আজ তোমার এতো চিন্তা। আমি প্রেগন্যান্ট অভ্র। আমার গর্ভে আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন বেড়ে উঠছে প্রতিনিয়ত। তুমি তাকে নিয়ে, চিন্তা না করে মেহেভীনকে নিয়ে পড়ে আছো? তুমি ঠিক কি চাইছো বলো তো অভ্র? ‘

অভ্র মায়রার হাত নিজের থেকে ছাড়িয়ে, মায়রার বাহু শক্ত করে চেপে ধরে। এতে মায়রা ব্যাথায় কুকড়ে উঠলো। অভ্র তেজি গলায় বলে উঠলো,

‘ শুনতে চাও সত্যি কথা? তাহলে শুনে নাও। আমার পক্ষে তোমাকে কিংবা তোমার ন্যাকামি গুলো সহ্য করা পসিবল হচ্ছে না। আমি আমার প্রাক্তন স্ত্রীর চিন্তা করবো। কেননা একদিনের জন্যে হলেও, আমি তাকে নিজের বউ হিসেবে কবুল করে নিয়েছিলাম। তাই সে কোথায় থাকছে কিংবা কার সাথে থাকছে আমাকে তা জানতেই হবে। তুমি আমার সন্তানের মা হতে চলেছো তাই চুপচাপ তোমার কথামতো চট্টগ্রাম যাচ্ছি, কিন্তু ভূলেও ভাব্বে না আমি তোমার জন্যে যাচ্ছি।আমি আমার মায়ের অনুরোধ ফেলতে পারিনা,তাই যাচ্ছি।তুমি শুধু ততটুকুই অধিকার বিস্তার করবে আমার উপর,যতটুকু অধিকার আমি তোমাকে দিবো। ‘

অভ্র মায়রা একপ্রকার ধাক্কা দিয়েই, নিজের থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। মায়রা হাত শক্ত করে দাড়িয়ে থাকে তা পাশে থাকা ফুলের টবটা হাতে নিয়ে মাটিতে ছুড়ে ফেলে। যা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে যায়। যেমনটা আজ মায়রার মনটা অভ্র টুকরো টুকরো করে ভেঙ্গে দিয়েছে। মায়রার ইচ্ছে করছে এখন গিয়ে মেহেভীন নামক কাটাটাকে মেরে ফেলতে। মায়রার মনে হচ্ছে মেহেভীন হচ্ছে এখন তার জীবনের সবথেকে বড় কাটা। যাকে উপড়ে ফেলতে পারলে বোধহয় তার এবং অভ্রের জীবনটা আবারো সুখময় হয়ে উঠবে। মায়রা নীচে ধপ করে বসে পড়ে। চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে তার।

__________

মেহেভীনকে সম্পুর্ন সুপটা খায়িয়ে, আরহাম নিজের খাবারটুকুও শেষ করে ফেলে। অতঃপর আরহাম মেহেভীনকে আস্তে করে ধরে নিয়ে গিয়ে, খাটে শুয়িয়ে দেয়। আরহাম নরম কন্ঠে বলে,

‘ তুমি আপাতত ঘুমাও। আমি সোফায় ঘুমাচ্ছি। সমস্যা হলে আমাকে ডেকে তুলবে, স্টুপিডের মতো নিজে নিজে কিছু করতে যাবে না। ‘

মেহেভীন বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ায়। আরহাম তার বালিশটা নিয়ে, সোফায় ঘুমাতে চলে গেলো। আরহাম দেখলো আরহামের ফোন বেজে উঠছে।রুশা ফোন করেছে। আরহাম ফোনটা হাতে নিয়ে, সোফায় বসেই রিসিভ করলো। আরহাম বললো,

‘ এনিথিং রং রুশা? ‘

‘রুশা ‘ নামটি শুনে মেহেভীন তার চোখ খুলে ফেললো। কে এই রুশা? আরহামের সেই প্রেয়সী নয়তো? ফোনের অপরপাশ থেকে রুশা ক্লান্ত গলায় বললো,

‘ আজকে খুব ক্লান্ত লাগছিলো স্যার। তাই আপনাকে ফোন দিলাম। আপনার গলাটা শুনতে বড্ড শুনতে ইচ্ছে করলো।
জানেন স্যার? আমরা যখন আমাদের খুব কাছের কারো গলা একটু শুনি, তখন আমাদের ক্লান্তি নিমিষেই দূর হয়ে যায়। আপনি হয়তো নিজেই জানেন না আপনি আমার কতটা কাছের। কতটা আপন। স্যার কিছু বলছেন না কেন? একটু কথা বলুন না। ‘

আরহাম আর শুনলো না রুশার না বলা ব্যক্ত বানীগুলো। সঙ্গে সঙ্গে কেটে দিলো রুশার ফোন। রুশা তাতে বিন্দুমাত্র অবাক হলো না। আরহাম সবসময় রুশার অনুভুতিগুলো বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকে। রুশা মুচকি হেসে বললো,

‘স্যার আপনাকে অনুভুতি সম্পর্কে আর কি বলবো আমি? যে নিজেই অনুভুতিগুলো বুঝতে চায়না, তাকে বুঝানো শুধুমাত্র বৃথা ছাড়া আর কিছু না। ‘

আরহাম বারান্দায় চলে যায়। আরহাম জানে রুশার মনে আরহামের জন্যে অন্যরকম অনুভুতি আছে, যা আরহাম কখনো চায়না। এক তরফা তো সবকিছু হয়না।রাত বেশ গভীর হয়ে উঠেছে। শহরে রয়েছে একপ্রকার নিস্তব্ধতা। আরহাম এই মুহুর্তে খুব করে চায় কেউ তার পাশে থাকুক। নিজের পাশে কারো উপস্হিতি টের পেয়ে, আরহাম ঘাড় কাত করে দেখে মেহেভীন। মেহেভীনের দিকে তাকাতেই মেহেভীন নিচু গলায় বললো,

‘ আপনিই তো বলেছিলেন অনুভুতিগুলো সুন্দর হয়। তাহলে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কেন ভালোবাসার অনুভুতি থেকে। ‘

‘ রুশার অনুভুতি থেকে পালাচ্ছি। রুশার আমাকে পছন্দ করে আমি নয়। আমার কাছে তো অনুভুতি সর্বদা সুন্দর। ‘

আরহামের কথায় মেহেভীন আরহামের দিকে তাকায়। আরহাম মৃদ্যু হেসে বলে,

‘ জানো মেহেভীন? আমরা যখন অন্য কারো ভালোবাসার মায়াজালে নিজেদের জড়িয়ে ফেলি, তখন পৃথিবীর অন্য কোন অনুভুতি আমাদের মনটাকে স্পর্শ করতে পারেনা। আমিও হয়তো এমনই একজনের মায়াতে সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছে,সেই মায়া কাটিয়ে, অন্য কারো অনুভুতি অনুভব করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি কাটাতেও চাইনা সেই মায়া। ‘

মেহেভীনের বুকটা কেন যেন কেপে উঠে কথাগুলো শুনে। তারমানে তার ধারণা সঠিক। আরহামের জীবনেও কেউ আছে। কিন্তু কে সেই ভাগ্যবতী? বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে মেহেভীনের।

‘ শুয়ে পড়ো। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। ‘

মেহেভীন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।

[লেখিকাঃ জান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি]

ফারিয়া আরিয়ানকে ফোন দিয়েই বললো,
‘এইযে মিঃ ডক্টর সকালে যে এতো ভাষন ছাড়লেন কই গেলো আপনার সেই ভাষন? চিকিৎসা শুরু না করে আপনি ঘুমাচ্ছেন? এদিকে আমার মা আমার জন্যে জুতো নিয়ে বসে আছে। আজকে যদি আমি জুতোর বাড়ি খায় আই প্রমিস এর দায়ে আপনাকে আমি জেলে ঢুকাবো। ‘
আরিয়ান এইবার নড়েচড়ে বসলো। অতঃপর গলাটা পরিষ্কার করে বললো,

‘ আর ইউ সিরিয়াস? মানে এখানে আমার দোষটা কোথায়? নিজে ফেল করবেন আবার তার জন্যে জুতার পেটানো খেলে সেই দোষ আমার? এখানে তো বলা যায় যত দোষ নন্দ ঘোষ। ‘

ফারিয়া সঙ্গে সঙ্গে ধমক দিয়ে বললো, ‘চুপ করুন আপনি। আপনার প্রবাদ বাক্য শুনতে আমার ফোনের টাকা খরচ করে আপনাকে ফোন দেইনি।
আগে বলুন কী করলে আমার মাথায় একটু ঘিলু হবে? ‘

আরিয়ান কিছু একটা ভাবলো। এই বজ্জাত মেয়েকে উচিৎ শিক্ষা দিবে সে। তার রাতের ঘুম হারাম করেছে। আরহাম কিছুক্ষন পরে বললো,

‘আমাকে এখন ভিডিও কল করুন। ‘

‘ ওয়াট? ‘

‘ ওয়াট ফোয়াট না করে, ভিডিও কল করুন। চিকিৎসা করবো আপনার। ‘

ফারিয়া আরিয়ানের নাম্বারে ভিডিও কল করে। ভিডিও কল করার সঙ্গে সঙ্গে আরিয়ান তাকিয়ে দেখে, ফারিয়া বাইরে আছে। আরিয়ান বললো,

‘ আপনি বাইরে কেন এতো রাতে? বাসায় যাননি এখনো? ‘

‘ আরে ভাই বললাম না? বাসায় গেলেই আজ মায়ের জুতোর বাড়ি খেতে হবে। তাইতো রাস্তায় দাড়িয়ে আছি। ‘

আরিয়ান কিছু একটা ভেবে বাকা হেসে বললো,

‘ পারফেক্ট। এখানেই হবে। ‘

‘কি হবে? ‘

‘ আপনার চিকিৎসা। এখুনি একশোবার কান ধরে উঠবশ করুন। ‘

ফারিয়া চিৎকার করে বলো, ‘ এমা! একদম না। আমি কিছুতেই করবো না। ‘

আরিয়ান মুখে হাত দিয়ে বলে,

‘ ওকে তাহলে রাখছি। আমি আপনার চিকিৎসা করবো না। যান বাড়ি গিয়ে মায়ের জুতোর বাড়ি খান। ‘

আরিয়ান ফোনটা কাটতে নিলে, ফারিয়া তাতে বাঁধা দিয়ে বলো,

‘ এমা! না প্লিয কাটবেন না। আচ্ছা আপনি যা বলছেন। সেইটাই করবো আমি। ‘

কথাটি বলে ফারিয়া ফোনটার ক্যামেরায় বেঞ্চে সেট করে, কান ধরে উঠবশ করতে থাকে। আরিয়ান তো বেশ মজা নিচ্ছে ভিডিও কল দিয়ে। মেয়েটা সত্যি খুব বোকা।ফারিয়া কানে ধরে উঠবশ করছে আর আরিয়ানের পুরো গোষ্টি ধুয়ে দিচ্ছে। ফারিয়া বিড়বিড় করে বলে,

‘ব্যাটা খাটাশ ডাক্তারের ঘরে ডাক্তার যদি আমার মাথায় ঘিলু না আসে, তাইলে তোর আমি পিন্ডি চটকামো। আমারে দিয়া কান ধরে উঠবশ করানোর শখ জন্মের মতো মিটিয়ে দিবো। ‘
°__________

মেহেভীন ঘুম থেকে উঠে দেখে পুরো রুমটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। আরহাম সত্যি পুরো ঘরটাকে অনাগত বাচ্ছার জন্যে সুন্দর করে সাজিয়েছে। যেমনটি মেহেভীন চেয়েছিলো। মেহেভীন উঠে গিয়ে, বাচ্ছার জন্যে নিয়ে আসা ছোট্ট বিছানায় হাত বুলায়। এই ছোট্ট বিছানায় যখন তার ছোট্ট সোনা ঘুমিয়ে থাকবে, তখন কিন্তু বেশ লাগবে। মেহেভীন মুচকি হাসে। তখনি আরহাম অনেকগুলো প্যাকেট হাতে নিয়ে, রুমে ঢুকে। এতোগুলো প্যাকেট দেখে ভ্রু কুচকায় মেহেভীন। আরহাম প্যাকেটগুলো রেখে বলে, ‘ দেখো তো কেমন হয়েছে?’
মেহেভীন প্যাকেটগুলো খুলে দেখে প্যাকেটে সব ছোট্ট ছোট্ট বাচ্ছাদের পোষাক। প্রায় দশটার মতো প্যাকেট আছে। মেহেভীন এইসব দেখে বলে,

‘ এইগুলো কার জন্যে? ‘

আরহাম হাসিমুখে বিছানায় বসে বলে,

‘ কেন? নিউ বেবীর জন্যে। যে আসছে। আর মাত্র ছয়টা মাস তারপরই নিউ বেবী চলে আসবে। পছন্দ হয়েছে? আমি শুধু আপাতত কিছু কিনে রাখলাম। আমি ভাবছি বেবীর জন্যে আরো ড্রেস কিনবো এবং একটা ছোট্ট মিনি সাইজের কাবার্ডও কিনবো। যেখান শুধু নিউ বেবীর সব ড্রেস থাকবে। ‘

আরহাম বেবীর জন্যে নিয়ে আসা ড্রেসগুলো বের করে, মেহেভীনকে দেখাচ্ছে। মেহেভীন শুধু আরহামকে দেখেই যাচ্ছে মানুষটা কতটা খুশি। মানুষটা কি ভূলে গেলো বাচ্ছাটার জন্ম হয়ে গেলেই মেহেভীন ও তার সন্তান এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। হয়তো ভূলে গেছে। মেহেভীন একবার ভাবলো আরহামকে এইসব করতে মানা করবে, কিন্তু পরক্ষনেই ভাবলো মানুষটা কত খুশি। শুধু শুধু মানা করে ,মানুষটার মুখের হাসিটাকে বিলপ্ত করার কোন মানেই হয়। মানুষটা হাসছে হাসুক একটু। বড্ড সুন্দর লাগে মানুষটাকে হাসলে। আরহামের হাসি দেখে মেহেভীন নিজেও হাসলো।

চলবে….ইনশা-আল্লাহ।

#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব- ২৫
#Jannnatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
মেহেভীন আরহামের হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে ভাবলো লোকটার এই হাসিমুখটাকে দেখে,যেকোন রমনী সারাটাজীবন পার করে দিতে পারবে। আচ্ছা অভ্রের আগে যদি আরহাম মেহেভীনের জীবনে আসতো,তাহলে হয়তো মেহেভীনের জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো। আরহামের ভালোবাসায় জীবনটা অন্যরকম সুন্দর হতে পারতো।
নিজের মাথায় এইরকম উদ্ভুট ভাবনা চলে আসায়, মেহেভীন নিজের মাথায় নিজেই টুকা মারে। এইসব কি ভাবছে সে? তার কি এতো ভাগ্য আছে যে, আরহামের মতো মানুষ তাকে ভালোবাসবে। আরহাম তো অন্য কাউকে ভালোবাসে। সেই ভাগ্যবতী রমনীকে একটিবার চোখের দেখা দেখতে চায় মেহেভীন। আরহামের তো চমৎকার মানুষ যাকে ভালোবাসে, সে নিশ্চয় খুব বিশেষ কেউ হবে। মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই, আরহাম বিঘ্ন ঘটিয়ে বলে,

‘ এইযে মেয়ে তখন থেকে কি এতো ভাবছে বলো তো? ‘

‘ আরহাম সাহেব আমার মাঝে মাঝে মনে হয় কিছু কিছু মানুষ যদি আমাদের জীবন একটু আগে আসতো, তাহলে বোধহয় কিছু পরিনতি সুখময় হতো। ‘

মেহেভীনের কি হলো কে জানে মেহেভীন কথাটি বলেই উঠে বারান্দায় চলে গেলো। সে আরহামকে নিয়ে এতোক্ষন ধরে যা ভাবছিলো, যা ভাবতে গেলেই মেহেভীনের মুখে লজ্জা এসে ভীর করে। সে কীভাবে আরহামকে নিয়ে ভালোবাসার কথা ভাবলো? তার মনে কী নতুন কোন অনুভুতি উঁকি দিচ্ছে? যাকে বলে ভালোবাসার অনুভুতি। আরহাম মেহেভীনের পিছনে এসে বলে, ‘ কি হলো এইভাবে উঠে চলে এলে কেন?’

আরহামের সামনে মেহেভীনের কেন যেন দাড়াতে ইচ্ছে করছে না, মেহেভীন দৌড়ে রুমের বাইরে চলে যায়। আরহাম তাজ্জব বনে যায়। মেয়েটার হঠাৎ কি হলো?

আরিয়ান কাল রাতে একপ্রকার ঘুমায়নি বলতে গেলে। কিছুক্ষন পরেই, আরিয়ানকে হসপিটালে চলে যেতে হবে। আরিয়ান বাগানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কফি খাচ্ছিলো, তখনি তার চোখ যায় বাগানে থাকা দুই প্রেমিক-প্রেমিকার দিকে। যারা আর কেউ নয় বাড়ির কাজের মহিলারাহেলা এবং ড্রাইভার মজনু। মজনু কিছুটা ভাব নিয়ে রাহেলাকে বলছে,

‘ বুঝছো নি রাহেলা? আমাগো গ্রেরামে মাইনষে আমারে আবার অনেক সম্মান করে। তোমার যখন আমার বউ কইরা গ্রেরামে লইয়া যামু। সবাই খালি তোমার দিকে চাইয়া থাকবো। তুমি তো চাইয়া থাকার মতোই সুন্দরী। ‘

রাহেলাকে ‘ সুন্দরী ‘ বলে সন্মোধন করায় লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নেয় রাহেলা। মজনু রাহেলার আরেকটু কাছে গিয়ে বলে,

‘ রাহেলা সুন্দরী তোমার হাত টা একটু দাও তো দেখি। ওইদিন তো কুদ্দুস আইসা পড়ছিলো। শালাডা আইসা সব শেষ করে দিছিলো। ‘

রাহেলা লজ্জা নিয়েই, মজনুর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। আরিয়ান নিজের চোখ বন্ধ করে ধমকে বলে,

‘ এই তোমরা থামো ভাই। আমি এখনো সিংগাল। এইসব প্রেম-ভালোবাসা আমার সামনে একদমই এলাও না। ‘

সঙ্গে সঙ্গে রাহেলা নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। তার ইচ্ছে করছে মাটি ফাক করে ঢুকে যেতে। ছোট সাহেব তাকে এখন কি ভাব্বে? মজনু তো পারলে এখন চিৎকার করে কাঁদতো। তার রোমান্সের সময়েই শুধু সবাই এসে বাঁধা দেয়। রাহেলা লজ্জায় দৌড় দেয়।
মেহেভীন দৌড়ে নীচে নেমে বাগানে আসতেই, রাহেলার সাথে ধাক্কা খায়। মেহেভীন কোনরকম ‘সরি’ বলে। রাহেলাকে পায় কে? সে তো দৌড়। মজনুও দুঃখে বাগান থেকে চলে গেলো। আরহাম বারান্দায় দাড়িয়ে সব কান্ড দেখছে। আরহাম বললো,

‘ বুঝলাম না। সবার হচ্ছে টা কি? সবাই এতো লজ্জা পাচ্ছে কেন?’

আরহামের মা এইসব দেখে বললেন,

‘ কিরে আরিয়ান রাহেলার আবার কি হলো? ‘

আরিয়ান হাসতে হাসতে এসে বললো,

‘ লজ্জা পেয়েছে মা। প্রেম করতে গিয়ে, লজ্জা পেয়েছে। তুমি বরং এইবার রাহেলা মজনুর বিয়েটা দিয়েই দাও। ‘

আরহামের মা হাসেন। আরিয়ান খেয়াল করলো, মেহেভীনের মুখেও লজ্জায় ভাব। আরিয়ান মেহেভীনের কাঁধে হাত রেখে বললো,

‘রাহেলার লজ্জার কারণটা বুঝলাম,কিন্তু তুই এতো লজ্জা পাচ্ছিস কেন বইন? ‘

আরিয়ানের প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় মেহেভীন। মেহেভীন আরহামের দিকে তাকাতেই খেয়াল করলো, আরহামের দৃষ্টি মেহেভীনের মাঝেই সীমাবদ্ধ। আরহামের এমন দৃষ্টিতে আরেকদফা লজ্জা পেলো মেহেভীন। মেহেভীনর আচরণ সব কিছুই আরিয়ানের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।

________________
ইশরা বেগম মায়রার ঘরে এসে দেখে,মায়রা ঘরের এক কোনে চুপটি মেরে বসে আছে। ইশরা বেগম মায়রার দিকে এগিয়ে গিয়ে, মায়রার পাশে বসে বললেন,
‘ তোমার মুখটা এমন শুকনো লাগছে কেন মায়রা? ‘
মায়রা চুপ হয়ে রইলো। ইশরা বেগম জানেন মায়রার কি হয়েছে। অভ্রের আওয়াজ তিনি নীচ থেকেই শুনেছেন। অভ্রের মাথায় মেহেভীনের ভূত খুব ভালো করেই ঢুকেছে,তিনি তা বুঝতে পারছেন। মায়রা নিরবতা ভেঙ্গে বললো,
‘ আমি বোধহয় অভ্রকে ধরে রাখতে পারলাম না। অভ্র মেহেভীনকে ভূলতেই পারছে না। ‘

ইশরা বেগম মায়রার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘ মায়রা তুমি এইভাবে ভেঙ্গে পড়ো না। তুমি তো এখন একা নও। তোমার সাথে এখন আমার বংশের প্রদীপ আমার অভ্রের সন্তান ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে। তাই বলছি একটু শান্ত হও। চট্টগ্রামে ট্রিপে তো পরশু যাচ্ছো। সেখানে তুমি এবং অভ্র থাকবে শুধু। সেখানে মেহেভীন নামক কোন ছায়া থাকবে না তোমাদের জীবনে। দেখবে অভ্র আবারো তোমাকে ভালোবাসবে। ‘

নিজের শাশুড়ির কথায় নিশ্চিন্ত হয় মায়রা।

___________

অভ্র প্রতিদিনই অফিস থেকে এসেই প্রথমে মেহেভীনের রুমে ঢুকে। একটু শান্তির জন্যে। মেহেভীনের ঘরে প্রতিটা কোণায় কোণায় মেহেভীনের স্মৃতি জমে আছে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অভ্র আজকেও অফিস থেকে এসে,প্র‍থমে মেহেভীনের রুমে ঢুকে,কিন্তু রুমে ঢুকেই সে হতবাক। মেহেভীনের জিনিস সব ফেলে দিচ্ছে জবেদা। জবেদা হচ্ছে অভ্রদের বাড়ির কাজের লোক। এইভাবে মেহেভীনের জিনিস ফেলে দেওয়ায়, অভ্রের মাথায় আগুন ধরে যায়। অভ্র জবেদার থেকে জিনিসগুলো নিয়ে বলে,

‘ হাও ডেয়ার ইউ? কার পারমিশনে তুমি মেহুর জিনিসে হাত দিয়েছো? ‘

‘ আমার পারমিশনে। ‘

ইশরা বেগম কথাটি বলে রুমে ঢুকেন। অভ্র অবাক হয়ে বলে,

‘ মা তুমি এইসব কেন করতে বলেছো? ‘

‘ কেন আবার? শুধু শুধু এইসব জিনিস রেখে কি লাভ? ঘরটা খালি করে দেওয়ায় ভালো। ‘

অভ্র ক্ষিপ্ত গলায় বললো,

‘ ব্যাস মা। তোমার অনেক কথা শুনেছি আমি। এই কথাটি আমি শুনতে পারবো না। এখান থেকে মেহুর একটা জিনিসও সরানো হবে না। যদি তা করা হয়,তাহলে এর ফল খারাপ হবে। ‘

অভ্র গটগট করে রুমে চলে গেলো। ইশরা বেগম হতভম্ভ হয়ে গেলেন। যে ছেলে তার মুখের উপর কথা বলতে সাহস দেখাতো না,সে ছেলে কিনা তাকে একপ্রকার শাসিয়ে চলে গেলো। এইসব হচ্ছে টা কি?
___________________ [লেখিকা জান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি]
ড্রইং রুমে আরিয়ান ও আরহামের বাবা বসে আছেন। আরহামের মা বার বার মেহেভীনকে খেতে বলছে, কিন্তু মেহেভীন কী খাওয়ার মতো মেয়ে? সে কিছুতেই খেতে চাচ্ছে না। আরিয়ান টিভি দেখতে দেখতে বলে,

‘ ভাবি তুমি এখন ভালোমতো খেয়ে নাও, নাহলে ভাই এসে ধমকে তোমাকে খাওয়াবে। ‘

আরিয়ান বলতে দেরী হলেও,আরহাম তা কাজে করে দেখাতে দেরী করালো না। আরহাম অফিস থেকে এসেই মেহেভীনের কান্ড দেখে রামধমক দিয়ে বললো,

‘ এই স্টুপিড! তুমি খাচ্ছো না কেন? তোমাকে ঠিক কি বললে তুমি একটু ঠিক হবে?’

মেহেভীন ঠোট উল্টিয়ে বলে,

‘ আমার খেতে ইচ্ছে না করলে কি করবো আমি? ‘

আরহামের মা বললেন,

‘ আহা আরহাম মেয়েটাকে এইভাবে বকিস না। ‘

আরহামের বাবা খবরের কাগজ ভাজ করে বললেন,

‘ আমার মেয়েটাকে একদম বকবে না এইভাবে আরহাম। প্রেগন্যান্সির সময় মেয়েদের রুচি থাকে না। একটু ভালো করে বুঝিয়ে খাওয়াতে হয়। ‘

আরহাম তার কাঁধের ব্যাগটা রেখে, বললো,

‘ তোমাদের কি মনে হয়? আমি বলেনি? এই স্টুপিড মেয়ে ভালো কথা শুনার মেয়ে না। ওকে ধমকিয়েই খাওয়াতে হবে। আমি যে কি করবো আমি জানি না।
পরশু আমি চট্টগ্রাম যাচ্ছি কাজে। এই কয়দিন তো এই স্টুপিড টা তার সব আজগুবি কাজ করবে। ‘

আরিয়ান কিছু একটা ভেবে বললো,

‘ ভাই আমার কাছে একটা প্ল্যান আছে? ‘

‘কি? ‘

‘ আমি, ভাবি আর তুই একসাথে চট্টগ্রাম যাই। তুই কাজ করবি আর আমরা ঘুড়বো। তুই ভাবির উপর নজর ও রাখতে পারবি। ‘

আরহামের বাবা সঙ্গে সঙ্গে বললেন,

‘ ইহা সত্যিই উত্তম প্রস্তাব। আমার মনে হয় মেহু মায়ের এইসময় একটু ঘুড়াঘুড়ি করলে,মনটাও ভালো থাকবে। তুই কি বলিস আরহাম? ‘

আরহাম মাথা নাড়িয়ে বলে,

‘ আমার কোন আপত্তি নেই।’

মেহেভীনের মুখে হাসি ফুটে উঠলো এতোদিন পর সে কোথাও ঘুড়তে যাবে।

তৎক্ষনাক আরিয়ানের ফোনটা বেজে উঠলো। আরিয়ান তাকিয়ে দেখে ফারিয়া ভিডিও কল করেছে। আরিয়ান উঠে বাগানের দিকে চলে যায়।

আরিয়ান ফোন রিসিভ করতেই তার চোখ যায় ক্লান্তিতে মিয়ি যাওয়া মেয়েটার দিকে। চোখ-মুখে একরাশ ক্লান্তি তবুও মেয়েটাকে ভালো দেখাচ্ছে।

ফারিয়া ক্লান্তিমাখা গলায় বললো,

‘ এইযে ডাক্তার সাহেব আপনার কথামতো এক কিলোমিটার রাস্তা আমি দৌড়িয়েছি। আমার তো অবস্হা বেহাল। এখন একটু ঘিলু আসবে তো মাথায়? ‘

আরিয়ান মুচকি হেসে বললো,

‘ সবে তো শুরু মাত্র। এখনো আর কিছু করতে হবে আপনাকে তবেই আপনার বুদ্ধি বৃদ্ধি পাবে। ‘

আরিয়ানের কান্ড পিছন থেকে মজনু দেখে ফেললো। আরিয়ান ভিডিও কলে একটা মেয়ের সাথে মুচকি মুচকি হাসছে। নিশ্চই এই মেয়েটা আরিয়ানের প্রেমিকা হবে। তাহলে তো কথাটা জানাতে হবে সবাইকে। আজ আরিয়ান মজনুর সাধের রোমান্সের বারোটা বাজিয়েছে, সেও আজকে দেখাবে মজা। কথাটি ভেবে, মজনু দৌড়ে বাড়িতে এসে হাপাতে হাপাতে বললো,

‘ আপনারা এহানে খাড়াইয়া আছেন? ওইদিকে আরিয়ান ভাইজানতো প্রেম- পেরেতি করতাছে। ‘

কথাটি শুনার সাথে সাথেই আরহাম কেঁশে উঠে। আরহাম বাবার মুখ থেকে চা বেড়িয়ে যায়। আরিয়ানের মা দাড়িয়ে পড়ে। মেহেভীনের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সব। আরহামের বাবা ধমক দিয়ে বলে,

‘ কি বললি? আমার হাদারাম টা কি করছে? ‘

‘ আরিয়ান ভাইজান প্রেম-ভালোবাসা করতাছে হাইসা হাইসা একটা মাইয়ার লগে। ‘

আরিয়ান যা করেছে তার থেকেও দ্বিগুন বানিয়ে বানিয়ে মজনু বলছে সবাইকে। আরহামের মা ঝাটা হাতে নিয়ে বলে,

‘ হতচ্ছাড়া। কই সে? আজ ওর খবর আমি নিচ্ছি। ‘

কথাটি বলেই আরহামের মা বাগানে চলে যায়। আরহামের মায়ের পিছন পিছন বাকি সবাইও যায়। আরিয়ান আর কিছু বলতে চাচ্ছিলো ফারিয়াকে, তখনি সে খেয়াল করে তার মা ঝাড়ু হাতে নিয়ে এগিয়ে আসছে। আরিয়ান কি বুঝলো কে জানে? সে কট করে ফোনটা কেটে দৌড়ানো শুরু করলো। ফারিয়াও বুঝতে পারলো না আরিয়ান হঠাৎ এইভাবে কেটে দাওয়ার মানে কি?

চলবে…….ইনশা-আল্লাহ 😁

[লেখিকাঃ জান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি]