#তুমি_আছো_মনের_গহীনে
#পর্ব- ৩০
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
সকলেই বেড়িয়ে যেতেই, রুশা আরহামের হাতজোড়া নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কেঁদে ফেলে। রুশার কান্নার মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে সময়ের সাথে সাথে। আরহামের অস্বস্হি হচ্ছে তার হাত এইভাবে ধরে রাখার কারণে। আরহাম অস্বস্হি নিয়েই বললো,
‘ কি করছেন কি মিস রুশা? কেউ দেখলে কি ভাব্বে?
হাত ছাড়ুন প্লিয। ‘
‘ স্যার আপনার হাতদুটো ধরারও কি অধিকার নেই আমার? জানি নেই তবুও একটু ধরতে দিন না। আপনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদার সাধ্যি তো নেই আমার। অন্তত হাতদুটো ধরতে দিন দয়া করে। ‘
আরহাম নিজের হাতজোড়া তৎক্ষনাক ছেড়ে দিয়ে, কাঠিন্য গলায় বললো,
‘ এইসব কি ছেলেমানুষী করছেন মিস রুশা? এখন আপনার আবেগীর বয়স নয়। যথেষ্ট ম্যাচুরেটি আছে আপনার মধ্যে যতটুকু আমি জানতাম। আমি আশা করবো,আপনি নিশ্চই আবেগী হয়ে এমন কিছু করবেন না যাতে, আমার চোখে আপনার প্রতি যে সম্মানটুকু আছে তা নিমিষেই দূর হয়ে যাবে। ‘
‘ স্যার কাউকে ভালোবেসেছেন কখনো? হ্যা ভালো তো বেসেছেনই তাইনা? আপনার স্ত্রীকে। কি নাম যেন মেহেভীন। হুম মেহেভীনকে আপনি খুব ভালোবাসেন তাইনা স্যার? ‘
রুশার প্রশ্নে আরহাম নিশ্চুপ হয়ে যায়। আরহামের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে। তার খুব করে একটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে, যা চাইলেও সে আপাতত বলতে পারছে না।
আরহামের থেকে কোনপ্রকার জবাব না পেয়ে, কান্নার বেগ দ্বিগুন করে রুশা বললো,
‘ স্যার জানেন? ভালোবাসার মানুষকে না পাওয়ার যন্ত্রনাটা একটা মানুষকে তীলে তীলে শেষ করে দেয়।আজ হয়তো সেই কষ্টটাকে আপনি উপলব্ধি করতে পারছেন না। আসলে আমরা তখনি অন্যজনের কষ্ট অনুভব করতে পারে,যখব তা আমাদের সাথে ঘটে।’
রুশার কথায় আরহামের অধরের কোণে বাঁকা হাসি ফোটে উঠে। আরহামের অদ্ভুদ হাসির মানে বুঝতে অক্ষম হলো রুশা। আরহাম ধীর গলায় বললো,
‘ আপনি এখন আসতে পারেন মিস রুশা। ‘
রুশা জানে শত সে কথা বললেও আরহাম তার কথা বুঝাতে পারবে না। তাই রুশা আর কথা বাড়ালো না। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে নিঃশব্দে বেড়িয়ে গেলো।
আরহাম জানালার কাছে ঘেষে দাড়িয়ে বিড়বিড় করে বললো,
‘ নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের সামনেই অন্য কারো হতে দেখেছি। তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রন করে রেখেছিলাম,যেন সে সুখে থাকে। কেননা আমার ভালোবাসা আমাকে শেখায়, নিজের ভালোবাসা আমাকে শেখায়, নিজের ভালোবাসার মানুষের সুখেই প্রকৃত সুখ। থাকুক না সে অন্য কারো গল্পের নায়িকা হয়ে। তবুও তো সে সুখে আছে।
কিন্তু নিয়তি হয়তো অন্য কিছু চেয়েছিলো। ‘
আরহাম তার ফোনে কারো ছবি বের করে, প্রাপ্তির হাসি দেয়।
_________
আরহাম, আরিয়ান ও মেহেভীন আজ অভ্র এবং মায়রার সাথেই খাবে। মেহেভীন আজ ইচ্ছে করেই আরহামের পাশে বসে আছে। আরহাম বার বার মেহেভীনকে ধমকে ধমকে এইটা সেইটা খাওয়ার জন্যে বলছে। বেচারী মেহেভীন ও ধমক খেয়ে চুপচাপ খাওয়া শুরু করলো। আরহামের বকা না খেলে, তার তো আবার খাবার পেটেও যায়না। আরহামকে দেখেই বুঝা যায়, তার কতটা চিন্তা হচ্ছে মেহেভীনকে নিয়ে। মেহেভীন খেয়াল করছে, অভ্র বার বার আড়চোখে তাদের দিকে তাঁকাচ্ছে। অভ্রের এমন চাহনীতে মেহেভীনের মাথায় চট করে একটা শয়তানী বুদ্ধি চেপে বসলো। ওয়েটার টেবিলে মেহেভীনের জন্যে সুপ রেখে চলে যায়। মেহেভীন একপ্রকার ইচ্ছে করেই, গরম সুপটা খেতে গিয়ে, নিজের হাতে ফেলে দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে ব্যাথায় কুকড়ে উঠে। মেহেভীনের আওয়াজে সবার চোখ মেহেভীনের দিকে যায়। মেহেভীনের হাতে এইভাবে সুপ পড়ে যাওয়ায়,আরহাম তৎক্ষনাক ওয়েটারকে দিয়ে বরফ আনিয়ে নিয়ে, মেহেভীনের হাতে হাল্কা করে চাপ দেয়,যেন জায়গাটায় ফোসকা পড়ে না যায়। কেননা সুপটা বেশ গরম ছিলো। আরহাম রাগান্বিত সুরে বললো,
‘ দিনে একটা স্টুপিডের মতো কাজ না করলে তোমার কি হয়না? সুপটাও ঠিক মতো খেতে পারো না তুমি। ‘
মেহেভীন মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘ হুম খেতে পারি না তো। আপনি বরং খায়িয়ে দিন। ‘
মেহেভীনের এমন আবদারে অবাক হয় আরহাম। কেননা মেহেভীন নিজ থেকে কখনোই তার কাছে খেতে চাইনি। আরহাম কিছু না ভেবে মেহেভীনকে চামচ দিয়, সুপটুকু খায়িয়ে দেয়।
আরহাম ও মেহেভীনের কান্ড দেখে, আরিয়ান স্মিত হেসে বলে,
‘ ভাই কি মোহাব্বত নজর যেন লাগে। ‘
আরহাম উত্তর দিলো না,কেননা সে জানে আরিয়ান সবসময় তার মজা উড়াবেই। মেহেভীন খেতে খেতে খেয়াল করছে, অভ্র খাচ্ছে না। রাগে চোখজোড়া লাল হয়ে গেছে একপ্রকার। বেচারা না পারছে সহ্য করতে, না পারছে টেবিল ছেড়ে উঠে যেতে। আরহাম এবং মেহেভীনকে এইভাবে দেখে মন ক্ষুন্ন হলো মায়রার। আচ্ছা সে ও তো প্রেগন্যান্ট তাহলে অভ্র কেন তার আরহামের মতো যত্ন নেয়না? মায়রার নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে বসলো।
আজ কেন মেহেভীনকে মায়রার থেকেও বেশি সুখী দেখাচ্ছে,যেখানে মায়রার সুখে থাকার কথা ছিলো। মায়রা কিছু একটা ভেবে বলে,
‘ আরহাম ভাইয়া তো মেহেভীন মানে ভাবির ভালোই খেয়াল রাখে। অভ্র ও ঢাকাতে আমার এইরকম খেয়াল রাখতো। এইসময়টা আমাকে তো অভ্র চোখেই হারাতে চাইতো না। ‘
অভ্র অবাক পানে মায়রার দিকে তাকায়, যার অর্থ হচ্ছে এতোগুলো মিথ্যে মায়রা কেন বললো? সবার আর বুঝতে বাকি রইলো না মায়রাও প্রেগন্যান্ট।
আরিয়ান অভ্রকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ বাহ ভাই তোর ঘরেও যে এইরকম সুখসংবাদ আসতে চলেছে,তা বললি না যে? এতোটাই পর আমরা? ‘
অভ্র কিছু বলতে চাইবে, তার আগেই মায়রা লজ্জামাখা কন্ঠে জবাব দিলো, ‘ আসলে অভ্র বরাবরই লাজুক। তাই আসলে বলতে পারেনি। ‘
মেহেভীন শক্ত করে নিজের জামা চেপে ধরে আছে। চোখ তার ছলছল করছে৷ হয়তো এখন আখিজোড়া থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়বে মেঝেতে। মেহেভীন কোনরকম উঠে দাড়িয়ে বললো,
‘ আমার খাওয়া হয়ে গেছে। আমি আসছি। ‘
মেহেভীনের দিকে অভ্র অপরাধীর ন্যায় তাকালো। মেহেভীন তা উপেক্ষা করে, নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। তখনি হুট করে অভ্রের ফোন বেজে উঠলো। অভ্র ‘ এক্সকিউজ মি ‘ বলে সাইডে চলে গেলো। অভ্র তাকিয়ে দেখে রাইসার ফোন।যে সম্পর্কে অভ্রের খুব কাছের বন্ধু হয় । রাইসা হঠাৎ ফোন করলো কেন? রাইসা মেহেভীন এবং অভ্রের ব্যাপারে সবকিছুই জানতো। এমনকি ক্লাবে রাতের ঘটনা সম্পর্কেও সে মোটামোটি জানে। রাইসা আপাতত তার কাজের জন্যে ক্যানাডা গিয়েছে। রাইসাকে এতোদিন পর, ফোন করতে দেখে অভ্র অবাক হয়ে ফোনটা রিসিভ করে বললো,
‘ রাইসা তুই? ‘
‘ মেহেভীন আর তোর সম্পর্কে সবাই শুনলাম। তুই মেহেভীনকে ইউস করেছিস অভ্র? ছিহ। আজকে আমি আমাদের আরেক বন্ধু কায়েফ এর থেকে সব জেনে, তোকে ফোনটা দিলাম। তুই এতোটা নিঁখুতভাবে কি করে অভিনয় করলি অভ্র? তোর অভিনয় দেখে মনে হতো তুই সত্যি ভালোবাসতি মেহেভীনকে। ‘
অভ্র উদাসীন গলায় বললো,
‘ হুম বুঝলাম। আমি খারাপ। আমি অভিনয় করি। কিন্তু মেহেভীন তো খুব সুখেই আছে। তুই জানিস মেহেভীন বিয়ে….’
বাকিটুকু বলার আগেই, রাইসা বললো,
‘ আমি এখন সেই প্রসঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছি না। তুই জানিস তুই ঠিক কতটা অপরাধ করেছিস মেহেভীনের সাথে? সে সম্পর্কে একটুও ধারনা আছে তোর? সেদিন হোটেলে কি হয়েছিলো জানিস? ‘
‘ কি বলতে চাচ্ছিস তুই? হোটেলে সেদিন কি হয়েছিলো? ‘
রাইসা কিছু বলতে পারলো না তার আগেই ফোন কেটে গেলো। অভ্র বুঝলো নেট প্রব্লেম এর জন্যে ফোনটা কেটে গেছে।
_______<
মেহেভীন রুমে ঢুকেই মেঝেতে বসে, ঢুকড়ে কেঁদে উঠলো। মায়রা অভ্রের সন্তানের মা হতে চলেছে। ভাবতেই মেহেভীনের শরীরে কাটা দিয়ে উঠে। আচ্ছা মেহেভীন ও তো অভ্রের সন্তানের মা হতে চলেছে, তাহলে তার নিয়তিটা এমন কেন হলো? সে কেন পেল না তার সন্তানের মর্যাদা? মেহেভীন কান্নামিশ্রিত গলায় বললো,
' অভ্র! তুমি আজ বড্ড সুখি তাইনা? নতুন অতিথি আসতে চলেছে তোমার। সেই অতিথিকে নিয়ে তোমার কত্ত আয়োজন। তোমার এবং মায়রার সন্তান তোমার পরিচয়ে হেঁসে খেলে জীবন পার করে দিবে,কিন্তু আমার সন্তান কি করবে? আজ না হয় সে আরহাম সাহেবের সন্তানের পরিচয়ে ধীরে ধীরে আমার গর্ভে বেড়ে উঠছে, কিন্তু যখন সে এই পৃথিবীতে আসবে,তখন তো সবাই সব কিছু জেনে যাবে। সবাই জানবে আমার সন্তানের কোন বাবার পরিচয় নেই। কেউ তো আসল সত্যটা জানতে চাইবে না অভ্র। এই সমাজটা তো আমার এবং আমার সন্তানের দিকে আঙ্গুল তুলবে। নিষ্ঠুর এই সমাজে আমার সন্তানের উপাধি হবে, সে অবৈধ সন্তান। আমি কী করে তা সহ্য করবো? '
মেহেভীনের চোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়লো।
আরহাম ' মেহেভীন ' বলে রুমে ঢুকতেই, মেহেভীন পিছনে ঘুড়ে গেলো। আরহাম দুধের গ্লাস টা রেখে বললো,
' নীচে তো খেলে না। এখন এই দুধটা চুপচাপ খেয়ে নাও। '
মেহেভীন ভেজা গলায় বললো,
' আমি এখন খাবো না। প্লিয আমাকে জোড় করবেন না। '
কথাটি বলেই মেহেভীন তার চোখের জল আরহামের থেকে আড়াল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো, যদিও আরহামের চোখে তা এড়ায়নি। আরহামের মনে প্রশ্ন জাগে মেহেভীন কাঁদছিলো? কেন কাঁদছিলো? তাহলে কি মেহেভীনের মন খারাপ। আরহাম কিছু একটা ভেবে,মেহেভীনের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
' ওকে দুধ খেতে হবে না। চলো আমার সাথে। '
' কোথায়?'
' একটা জায়গায়। '
'কিন্তু কোন জায়গায়? '
সঙ্গে সঙ্গে আরহাম মেহেভীনের ঠোটে আঙ্গুল দিয়ে, নিচু গলায় বললো,
' হুশ কোন কথা নয়। চলো আমার সাথে। নো কুয়েশচেন। '
আরহাম মেহেভীনের হাত ধরে, বাইরের দিকে নিয়ে যায়। মেহেভীন বুঝতে পারছে না আরহাম তাকে হঠাৎ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? মেহেভীনকে অবাক করে দিয়ে, আরহাম......
চলবে....কী?
[লেখিকাঃ জান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি]
#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব-৩১
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
মেহেভীনকে সম্পুর্ন অবাক করে দিয়ে, আরহাম মেহেভীনকে নিয়ে হোটেলের পাশের সাইডের পুলের দিকে নিয়ে আসে।এই সাইডে তেমন কেউ আসেনা। আরহাম জায়গাটা কিছুক্ষন এর জন্যে ভাড়া করে নিয়েছে।ছোট্ট ছোট্ট ক্যান্ডেল পুলের পানিতে ভেঁসে চলেছে। সবমিলিয়ে মনোরম একটা পরিবশ তৈরি হয়ে গেছে মুহুর্তেই।তার পাশে একজন লোক হাতে দুইশোর মতো গ্যাসের বেলুন একসাথে রশিতে বেঁধে নিজের হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবগুলো বেলুনে ছোট্ট করে লেখা রয়েছে, ' New baby is Coming, only after 4 months. just waiting. '
লেখাটা পড়ে মেহেভীন তার পেটে হাত রাখে। দেখতে দেখতে পাঁচটা মাস কেটে গেছে তার সন্তান,তার গর্ভে বেড়ে উঠেছ। আর মাত্র ৪ মাস পরেই, সে পৃথিবীতে চলে আসবে। কথাটি ভাবতে গিয়ে, মেহেভীনের চোখে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। মেহেভীনের চোখ অশ্রুটুকু আরহাম সযত্নে মুছে দিয়ে, বলে,
' কাঁদছো কেন স্টুপিড মেয়ে? সবাইকে কাঁদলে মানায় না। কিছু কিছু মানুষকে হাসলেই শুধু মানায়। তারা কাঁদলে, বুকের ভিতর ধক করে উঠে। তাদের মধ্যে তুমিও অন্যতম। জানো মেহেভীন আমার কি মনে হয়? আমার কাছে যদি এখন ক্ষমতা থাকতো, তাহলে তোমার কান্না করাটা আমি দন্ডনীয় অপরাধ করা দিতাম। '
আরহামের কথা শুনে, ভরকে যায় মেহেভীন নামক রমনী। যুবক প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্যে বলে,
' তুমি জানো না? এখন যদি তুমি মন খারাপ করো থাকো,তাহলে ভিতরে যে ছোট্ট একটা প্রান বেড়ে উঠছে, তার কতটা ক্ষতি হবে? জানো তো? '
মেহেভীন মাথা নাড়ায়। আরহাম বেলুনওয়ালা লোকটার থেকে, সবগুলো বেলুন নিয়ে নিজের হাতে নিয়ে আসে। অতঃপর মেহেভীনের কাছে গিয়ে বলে,
' এখন এই বেলুনগুলো আকাশে তুমি উড়িয়ে দাও। '
মেহেভীন অবাকের সুরেই বললো, ' আমি কেন? '
।
আরহাম ঠোটের কোণে চমৎকার হাঁসি ঝুলিয়ে বলে,
' এই বেলুনগুলোর সাথে তোমার সমস্ত দুঃখ কষ্ট আকাশের কাছে বিলিন করে দাও। আকাশ তো বিশাল। এই বিশাল আকাশে দেখবে তোমার এক মুঠো দুঃখ-কষ্ট মুহুর্তেই বিলিন হয়ে যাবে। জীবনটা অতি ক্ষুদ্র। এই ছোট্ট জীবনে ছোট ছোট আনন্দগুলোকে আকড়ে ধরে আমাদের বাঁচতে হবে। দুঃখ কষ্টকে সাথি করলে জীববটা নরকে পরিনত হয়ে যায়। '
আরহামের কথা শুনে মেহেভীনের ঠোটেও হাসির রেশ ধরা দেয়। মেহেভীন আরহামের থেকে বেলুনগুলো নিয়ে, একসাথে তা আকাশে ছেড়ে দেয়। বেলুনগুলো আকাশের ঠিকানায় উড়ে চলেছে। মেহেভীন জোড়ে চিল্লিয়ে বলে,
' বেবী তোমার মা তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে। তাড়াতাড়ি করে চলে আসো তোমার মায়ের কাছে। '
কথাটি বলেই মেহেভীন হাত তালি দিতে থাকে। আরহাম ও মুচকি হেসে মেহেভীনের সাথে হাতে তালি দেয়।
সঙ্গে সঙ্গে মেঘের গর্জন করে উঠে। নভেম্বর মাস এখন। শীত প্রায় চলে এসেছে বলতে গেলে। এইসময় হঠাৎ বৃষ্টি আশাজনক নয়। বৃষ্টি ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করে দেয়। মেহেভীন বৃষ্টি দেখে পুলের দিকে গিয়ে, দাঁড়িয়ে বৃষ্টিবিলাস করতে থাকে। মেহেভীনের বরাবরই বৃষ্টি পছন্দ, তবে এতোদিন কষ্টের ভেড়াজালে সে তা প্রকাশ করতো না। আজ আরহামের কথা শুনে, তার বৃষ্টিতে বড্ড ভিজতে ইচ্ছে করছে। আরহাম মেহেভীনকে এইভাবে ভিজতে দেখে বলে,
' মেহেভীন? চলো এখন হোটেলে। অসময়ের বৃষ্টি। জ্বর-ঠান্ডা লেগে যাবে তো। লেটস গো। তাড়াতাড়ি চলো। '
আরহাম কথাটি বলে এগোতে নিলে, মেহেভীন আরহামের হাতজোড়া ধরে ফেলে। মেহেভীন এইভাবে হাত ধরে রাখায়, আরহাম মেহেভীনের দিকে তাকাতেই, মেহেভীন বললো,
' একটু বৃষ্টিবিলাশ করলে ক্ষতি কি আরহাম সাহেব? বড্ড ভালো লাগে আমার বৃষ্টি। আপনার বুঝি ভালো লাগেনা? আপনিই তো বললেন ছোট ছোট আনন্দকে পুজি করে জীবনকে উপভোগ করতে হয়। ধরে নিন আমার আনন্দ এই বৃষ্টির মাঝেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। '
মেহেভীনের কথা শুনে আরহাম মেহেভীনকে বাঁধা দিলো না। বরং স্মিত হেসে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে রইলো। আরহামের থেকে সায় পেয়ে, মেহেভীন খুশিতে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে,বৃষ্টি বিলাশ করতে থাকে। নিজের আখিজোড়া বন্ধ করে ফেলে। ঠোটের কোণে মিষ্টি হাঁসি লেগে আছে। মেহেভীনের এইরকম মিষ্টি হাঁসি দেখে আরহাম আস্তে করে বলে,
' ওগো বৃষ্টিবিলাশিনী দেখতে পাচ্ছো? হাসলে কিন্তু তোমার মুখে অদ্ভুদ মায়া এসে ভীর করে। এই অদ্ভুদ মায়ার ভীরে যেকোন যুবক হারিয়ে যাবে, তাহলে সবসময় হাঁসো না কেন? স্টুপিড মেয়ে একটা। '
আরহাম গুন গুন করে গেঁয়ে উঠে,
রাতেরই এ আঁধারে
অজানা ছোঁয়া
মায়াবী চোখে কি মায়া
যেন গোধূলি আবীর মাখা
রাতেরই এ আঁধারে
অজানা ছোঁয়া
মায়াবী চোখে কি মায়া
যেন গোধূলি আবীর মাখা
কি নেশা ছড়ালে!
কি মায়ায় জড়ালে?
কি নেশা ছড়ালে!
কি মায়ায় জড়ালে?
আরহামের গানে মেহেভীন আরহামের দিকে তাকায়। আরহামের সুরে অদ্ভদ ভালো লাগা কাজ করছে মেহেভীনের। আরহামও সম্পুর্ন ভিজে যাচ্ছে। আরহাম মেহেভীনের দিকে এগোতেই, মেহেভীন পিছাতে গিয়ে, ধপ করে পড়ে যেতে নিলে, আরহাম মেহেভীনকে নিজের দিকে টেনে নেয়। মেহেভীনের ভেজা চুল আরহামের মুখে আচড়ে পড়ছে। আরহাম আস্তে আস্তে চুলগুলো ধীরে ধীরে মেহেভীনের কানের কাছে গুজে দিতে থাকে। আরহামের তপ্ত নিঃশ্বাস মেহেভীনের গলায় উপচে পড়ছে। মেহেভীনের মনে হচ্ছে এই নিঃশ্বাস সে আগেও তার গলায় অনুভব করেছিলো,কিন্থ তা কীভাবে সম্ভব? আরহামের কেন যেন ঘোরের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির বেগ সময়ের সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আরহাম মেহেভীনের ঠোটের দিকে এগোচ্ছে। মেহেভীন সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে ফেললো। তার৷ চিকন ঠোটজোড়া কাঁপছে অনাবরত। মেহেভীন ঠোট দিয়ে টু শব্দও করতে পারছে না। শরীরে যেন কোনপ্রকার শক্তি সে পাচ্ছে না। আরহাম কিছু একটা ভেবে, নিজেকে সামলিয়ে নেয়। আরহাম মেহেভীনের থেকে দূরে সরে গিয়ে বলে,
' অনেক ভেঁজা হয়েছে। এইবার রুমে চলো,নাহলে ঠান্ডা লেগে যাবে। '
আরহাম কথাটি বলেই দ্রুত রুমের দিকে যেতে থাকে। মেহেভীনের লজ্জ যেমন হচ্ছে, তেমন অস্বস্হিও হচ্ছে। সে নিজেকে বার বার বকা দিতে থাকে। সে কেন আরহামকে বাঁধা দেয়নি? মেহেভীনের এক মুহুর্তের জন্যে মনে কি আরহামের জন্যে অনুভুতি জন্ম নিয়েছিলো? মেহেভীন নিজের মনকে বুঝিয়ে বলে,
' এইসব কি ভাবছিস তুই মেহু? ছিহ। এইসব ভাবাও পাপ। আরহাম সাহেবের জন্যে কোনপ্রকার অনুভুতি জন্ম নিতে পারে না আমার। আমি আমার জীবনে আর কখনো কাউকে জড়াবো না। সবথেকে বড় কথা আরহামের সাহেবের মনে অন্য কেউ আছে। '
মেহেভীন নিজের মনকে শত বুঝালেও,সে একটু হলেও বুঝতে পারছে তার মনে অন্যরকম করে সুপ্ত অনুভুতির আগমন ঘটছে, যা মেহেভীনকে আবারোও কষ্ট দিবে। মেহেভীন কাঁপা গলায় বললো,
' মানুষ ভূল জীবনে একবারই করে। আমার কাছে ভালোবাসা তেমনই একটা ভূল। আমি জেনে বুঝে কিছুতেই পুনরায় ভূল করবো না। '
মেহেভীন ও আস্তে আস্তে করে রুমের দিকে পা বাড়ালো। অভ্র এতোক্ষন নিজের রুমের জানালা দিয়ে, সবকিছুই দেখছিলো। আরহাম এবং মেহেভীনের কাছে আসার প্রতিটা মুহুর্তেই অভ্রের নজরে ভালো করেই এসেছে। অভ্র নিজের মাথাটা ঠিক রাখতে পারছে না। তার মাথায় যেন আগুন ধরে গেছে। মেহেভীন তো একদিন তার ও এতোটা কাছে এসেছিলো। মেহেভীন তার স্ত্রীও ছিলো বটে, সে আজ অন্য কারো সাথে ঢলাঢলি করছে, তা কিছুতেই সে দেখতে পারছে না। অভ্র তার হাতে থাকা ফুলদানীর বাস্কটা সপাটে ছুড়ে ফেলে।
এদিকে মায়রা ঘুমিয়ে ছিলো, কিছু পড়ার আওয়াজে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। মায়রা ঘুম থেকে উঠে দেখে অভ্রের হাত থেকে ফিংকি রক্ত মেঝেতে গড়িয়ে পড়ছে। অভ্রের চোখ-জোড়া লালাটে আকাড় ধারণ করেছে। অভ্র কেমন একটা হিংস্র মনে হচ্ছে। মায়রা থমথমে গলায় বললো,
' অভ্র...'
সঙ্গে সঙ্গে অভ্র চিৎকার করে বলে,
' কেন? আজ কেন মেহেভীন আমার থেকে দূরে? আমি যে সহ্য করতে পারছি না। একদমই করতে পারছি না। আমি পারছি না আমার প্রাক্তন স্ত্রী আজ অন্য কারো এতোটা কাছে। আমি পারছি না মায়রা? আমার এতোটা অসহায় কোনদিন ও লাগেনি। '
অভ্র ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে কথাটি বলে। মায়রা মুখ চেপে কান্না করে। সে কিছুতেই ভাবতে পারেনি,অভ্র মেহেভীনের প্রতি এতোটা দূর্বল হয়ে যাবে।
______
রাইসা নিজের রুমে বসে গভীর ভাবনায় ঢুবে আছে।
অভ্র এবং মেহেভীনকে সে অনেকটা কাছ থেকে দেখেছিলো। অভ্র শুধুমাত্র মায়রাকে জেলাস ফিল করানোর জন্যে, মেহেভীনকে শুধুমাত্র ব্যবহার করেছে, এই বিষয়টা সম্পুর্নভাবে রহস্যজনক লাগছে তার। তাছাডা রাইসার কাছে মনে হচ্ছে অভ্র যা করছে কিংবা ভবিষ্যৎ এ করবে,তা সত্যি ভয়ংকর। রাইসা সেদিন হোটেল রুমের সম্পুর্ন কাহিনী জানে। মেহেভীন এবং অভ্র সেদিন নেশার ঘোরে কাছাকাছি এসেছিলো, তা অভ্র নেশার ঘোরে ভূলে গেলেও, মেহেভীন রাইসাকে ঠিকই কথাটি জানিয়েছিলো। রাইসা বুঝতে পারছে, মেহেভীনের সাথে বড় অন্যায় করা হয়েছে। মেয়েটার মুখ ভেসে উঠলেই, রাইসার বড্ড খারাপ লাগে। রাইসা অভ্রকে পুনরায় ফোন করে।
_____
মায়রা উঠে দাঁড়িয়ে, অভ্রের কলার চেপে ধরে বলে,
' তুমি এই কথা বলছো অভ্র? তুমি কী করে বলতে পারলে অভ্র? তোমার এখন তোমার প্রাক্তনের প্রতি এতোটাই দরদ উতলে পড়ছে যে, তার সাথে অন্য কাউকে সহ্য করতে পারছো না তুমি?কিন্তু কেন অভ্র? জবাব দাও অভ্র? আচ্ছা তুমি কি মেহেভীনকে ভালোবাসো? '
মায়রার কথায় মুহুর্তেই অভ্র শান্ত হয়ে যায়। তার মুখে নেমে আসে অন্ধকার। অভ্রকে চুপ থাকতে দেখে,মায়রার মেজাজটাই বিঘড়ে যায়। মায়রা অভ্রের শার্ট শক্ত করে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,
' কি হলো অভ্র? তুমি কথা বলছো না কেন? আমাকে জবাব দাও। দেখো আমি অনেক সহ্য করেছি আর পারছি না। তুমি কী মেহেভীনকে ভালোবাসো? '
অভ্র কী জবাব দিবে এখন? এই প্রশ্নের উত্তর তো সে নিজেও জানে না। অভ্রকে চুপ থাকতে দেখে মায়রা আশাহত হয়। বুক ফেটে কান্না আসে তার। তার এখন সব রাগ -ক্ষোভ উতলে উঠছে মেহেভীনের উপর। মেহেভীন নামক কাটাটাই তার জীবনের সব সুখ নিমিষেই শেষ করে দিচ্ছে।
মায়রা গটগট করে বেড়িয়ে যায় রুম থেকে।
মায়রা বেডিয়ে যেতেই,অভ্রের ফোন বেজে উঠে। অভ্র তাকিয়ে দেখে রাইসার ফোন। অভ্র রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে, রাইসা হতদন্ত হয়ে বললো,
' অভ্র আমি কাল বা পরশুর মধ্যে দেশে ফিরছি৷ তোর সাথে জরুরী কথা আছে আমার। '
'কি এমন জরুরী কথা? '
'সেসব বলার সময় আমার নেই। শুধু এইটুকু জেনে রাখ। অনেক বড় কথা তোকে বলার আছে,যা সামনাসামনিই বলতে হবে। '
রাইসা কথাটি বলেই ফোন কেটে দেয়। অভ্র বুঝতে পারছে না রাইসা হঠাৎ কি বলতে চায়?
______
আরহাম সোফায় গড়াগড়ি করছে। তার চোখে ঘুম যেন ধরাই দিচ্ছে না। মেহেভীন রুমে এসেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
আরহামের কেমন যেন অস্বস্হি কাজ করছে। মেহেভীনকে তাকে কোনভাবে ভূল বুঝেছে? তখনি আরহামের কানে মেহেভীনের আর্তনাদ ভেঁসে আসে।
চলবে...কী?
[একটু বড় + ছোট খাটো স্পেশাল পার্ট দিলাম 🥰।]