তুমি আছো মনের গহীনে পর্ব-৩২+৩৩

0
2154

#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব- ৩২
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
মেহেভীনের আর্তনাদ কানে আসতেই,আরহাম লাফিয়ে উঠে বসে। মেহেভীনের কাছে যেতেই, মেহেভীমের ঘুমের মাঝেই আরহামের হাতজোড়া খামচে ধরে, ব্যাথায় কুকড়ে উঠে।আরহাম বুঝতে পারছে না হঠাৎ মেহেভীনের কিসের ব্যাথা উঠলো? আরহাম আস্তে ধীরে মেহেভীনকে খাটের কিনারে হেলান দিয়ে, শুয়ায়। অতঃপর মেহেভীনের গালে হাত রেখে বলে, ‘ মেহেভীন হঠাৎ কি হলো তোমার? তুমি ঠিক আছো তো? ‘
মেহেভীন নিজের আখিঁজোড়া আস্তে আস্তে খুলে ধীর গলায় বললো,

‘ আরহাম সাহেব! ‘

‘হুম? ‘

‘বেবী আমার পেটে কিক করলো মনে হচ্ছে। বেবী নড়ছে আরহাম সাহেব। আমি অনুভব করতে পারছি। ‘

মেহেভীন ব্যাথা পেলেও, তার চোখ-মুখে খুশির আভাশ পাওয়া গেলো। মেহেভীনের কথা শুনে আরহাম মহানন্দনে বললো,

‘ সত্যি? বেবী নড়ছে? ‘

মেহেভীন খুশিতে মাথা নাড়ায়। আরহাম নিজের অজান্তেই তার কান পেতে দিলো মেহেভীনের দিকে ঝুঁকে, বেবীকে একটু অনুভব করার প্রচেস্টায়। মেহেভীনের থেকে কথাটি শুনে আরহামেরও বড্ড ইচ্ছে হলো, বেবীকে একটু অনুভব করার। মেহেভীন অদ্ভুদ পানে আরহামের দিকে তাকিয়ে থাকে। আরহাম মনোযোগ সহকারে মেহেভীনের পেটে তার কান পেতে রয়েছে একটুখানি বেবীটাকে অনুভব করার প্রচেস্টায়। মেহেভীনের পেটটাও ভারী হয়েছে আগের তুলনায়, যদিও বেশি নয়।আরহাম একটু হলেও বুঝতে পারছে, বেবী সত্যি নড়ছে। এই মুহুর্তটা যেন, তার কাছে সত্যি সবথেকে শ্রেষ্ট মুহুর্ত। আরহাম উঠে গিয়ে, মেহেভীনের হাত ধরে খুশিতে বলে,

‘ মেহভীন আমি অনুভব করতে পারছি। আমি সত্যি পারছি। বেবী তার ছোট ছোট হাত-পা দিয়ে কেমন করে নড়ছে। আমার পক্ষে তো অপেক্ষা করা যেন এখন থেকে অনেক কষ্টকর হয়ে যাবে। কবে বেবী আসবে, কবে আমি আমার হাতে তাকে একটু ছুঁয়ে দেখবো। সেইদিন কবে আসবে মেহেভীন?
চারটা মাসেও যেন আমার কাছে এখন চার যুগ মনে হচ্ছে। আচ্ছা বেবী যখন হবে তখন তার নাম কি রাখবো আমরা? ‘

আরহাম নিজের মনে কথাগুলো বলেই যাচ্ছে। বেবী পৃথিবীতে আসলে, কত প্ল্যান তার। আরহাম যেন ভুলেই গেছে সে বাচ্ছাটার আসল বাবা নয়। মেহেভীন বুঝতে পারছে আরহামের টান হয়ে গেছে বাচ্ছাটার প্রতি। আরহামকে থামাতে হবে,নাহলে আরহাম আরো অনেক ভেবে ফেলবে, যা পরবর্তিতে কষ্ট দিতে পারে আরহামকে,যা মেহেভীন কিছুতেই চায়না। আরহাম আবারোও বললো,

‘ আচ্ছা বেবী আমাকে কি নামে ডাকবে? আমি বরং বেবীকে বলবো আমাকে ভালো বাবা বলে ডাকতে। ভালো না নামটা? আমি বেবীর জন্যে সবকিছু এনে দিবো। বেবী যা যা চাইবে সব। ‘

মেহেভীন থমথমে গলায় বললো,

‘ আরহাম সাহেব আপনি থামুন। আপনি কি ভূলে গেলেন? আমরা একটা চুক্তিতে ছিলাম। বেবীর জন্মের পরেই তো আমি এবং বেবী চলো যাবো। তাহলে শুধু শুধু মায়া কেন বাড়াচ্ছেন? সে তো অন্য কারো সন্তান। ‘

আরহাম কিছু একটা ভেবে রহস্যময় হাঁসি আস্তে করে বললো,

‘কিছু টান তো হুট করে অজান্তেই হয়ে যায়। আর ভবিষ্যৎ এর কথা কে বলতে পারে? ‘

‘ কি বললেন আপনি? ‘

‘ না মানে, আমার মনে হয় না যে তোমার সাথে প্রতারণা করেছে। সে কখনোই বেবীর কোনপ্রকার অধিকার পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। ‘

আরহামের গম্ভের কন্ঠে বলা কথাটি শুনে মেহেভীন চুপ হয়ে যায়। সত্যিই তো অভ্রের কোন অধিকার নেই তার সন্তানের উপর। জন্ম দিলেই তো কেউ বাবা হতে পারেনা।

আরহাম অধরের কোণে হাল্কা হাঁসি এনে বললো,
‘এই কয়দিনে আমি বুঝে গিয়েছি, আমি না চাইতেও বেবীর সাথে জড়িয়ে গিয়েছি। সে এখনো পৃথিবীতে আসেনি তাতেই তার প্রতি এতোটা মায়া জন্মে গেছে, সে যখন আসবে তখন তাকে ছাড়া কীভাবে থাকবো? এইটাই সব থেকে বড় প্রশ্ন। ‘

আরহামের কথা শুনে ভালো লাগা কাজ করে মেহেভীনের। মানুষটার এতোটা টান পড়ে গেলো? কখন কীভাবে? আচ্ছা আরহামের কি মেহেভীনের প্রতি কোন টান অনুভব হয়? মেহেভীনের কেন যেন
প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হলো, কিন্তু সে তা করলো না।

আরহাম বারান্দায় চলে গেলো। মেহেভীন গভীর ভাবনায় ডুব দিলো। এই মানুষটাকে একা করে সে কী করে তার সন্তানকে নিয়ে দূরে চলে আসবে? এই মানুষটা যে, নিজের অজান্তেই মায়াজালে জড়িয়ে ফেলেছে, নিজেকে। আচ্ছা অভ্র যখন জানতে পারবে এই সন্তানটি তার, তখন কি হবে? অভ্র কি সন্তানের অধিকার চাইবে মেহেভীনের থেকে? মেহেভীন তখন কি করবে? কথাটি ভেবেই শুকনো ঢুগ গিললো মেহেভীন। মেহেভীন গোলকা ধাঁধায় পড়ে যাচ্ছে।
মেহেভীনের আজ বড্ড তার মায়ের কথা মনে পড়ছে। তার মা নিশ্চয় তার পাশে থাকলে, তাকে এখন সঠিক পথ দেখিয়ে দিতো। সে তো কখনোই তার মাকে পাশে পাইনি। মেহেভীন বড্ড ইচ্ছে করছে, এখন তার মা ম্যাজেকের মতো চলে আসুক এবং তার সকল সমস্যা নিমিষেই দূর করুক। মায়ের একটু ঠায় পেলেই, একজন সন্তান তো সমস্ত কষ্ট ভূলে যায়। মেহেভীন এখন সেই ঠায়টুকু পেতে ইচ্ছে করছে।

________________

রুশা মন খারাপ করে চুপটি করে নিজের ঘরে বসে আছে। মনটা যে বেহায়া, কথা সে মানেনা। আরহামকে দেখে তার কষ্টে বুকটা জ্বলে উঠে। এই কষ্টের আদোও শেষ আছে কোথাও?

তাহসান রুশার রুমে কালকের প্রযেক্টের ফাইল নিয়ে এসে দেখে, রুশা চুপটি মেরে বসে আছে। তাহসান রুশার কাঁধে হাত রাখতেই, রুশা তাহসানের দিকে তাকায়। রুশার মুখখানি দেখে তাহসানের বুকের ভিতরে তলপার সৃষ্টি হয়। তাহসান রুশার অবস্হা দেখে বলল,

‘ রুশা তুমি এখন এইবার নিজেকে সামলাও? ‘

‘কীভাবে সামলাবো আমি নিজেকে? আমি যে পারছি না। আমার না মেহেভীন নামক মেয়েটার প্রতি অনেক হিংসা হয়। কি আছে ওই মেয়েটার মাঝে, যার জন্যে স্যার মেয়েটাকে এতোটা ভালোবাসে। আমার মাঝে কি সেই গুনগুলো নেই? কেন নেই আমার মাঝে।? ‘

তাহসান রুশার পাশে বসে বলে,

‘ রুপ-কিংবা গুন দেখে ভালোবাসা হয়না। ভালোবাসা তো এমন এক অনুভুতি যা হুট করে যে কারো প্রতি যখন-তখন চলে আসে। ভালোবাসার কোন নির্দিষ্ট কারণ থাকে না।’

রুশা ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। তাহসান রুশার দিকে টিস্যুর এগিয়ে বলে, ‘ রুশা তুমি অন্তত প্লিয় কেঁদো না। দেখো আল্লাহ নিশ্চয় সর্বশ্রেষ্ট পরিকল্পনাকারী। তিনি যখন আরহামের জন্যে তোমাকে রাখেননি, তাতে নিশ্চয় কিছু না কিছু ভালো হবেই। দেখবে আল্লাহ তোমার জন্যে উত্তম কিছুই নির্বাচন করেছেন। তুমি শুধু দৃঢ় মনোবল রাখো। ‘

তাহসানের্ কথায় কিছুটা ভরসা পায় রুশা।

_____

সকাল হতেই মেহেভীন বারান্দায় হাটতে বের হয়। আরহাম তার অফিসের কলিগদের সাথে অনেক আগেই,প্রযেক্টের কাজে বেড়িয়ে গেছে। তখনি একজন স্টাফ এসে,মেহেভীনের হাতে একটা পার্সেল দিয়ে বলে,

‘ ম্যাম আপনার নামে কে যেন কুড়িয়ারে পার্সেল পাঠিয়েছে৷ টেক ইট৷ ‘

।স্টাফের কথা শুনে, কিছুটা অবাক হয়ে মেহেভীন পার্সেলটা নেয়। পার্সেটা খুলেই দেখে ছোট্ট একটা চিরকুট। তার পাশেই অনেকগুলো লাল টকটকে গোলাপ ফুল। ফুলগুলো এতেটাই সুন্দর যে, মেহেভীনের মুখে অজান্তেই হাঁসি ফুটে উঠে, তা দেখে। মেহেভীন চিরকুট খুলে দেখে তাতে লেখা,

‘ লাল টকটকে গোলাপের মতো সবসময়ই তোমার মুখশ্রীতে যেন হাঁসিতে খুশির ঝলক ফুটে উঠে। ওগো প্রেয়সী সবসময় মনমরা হয়ে থাকো কেন? তুমি কি বুঝো না? তোমার কষ্টগুলো যে আমাকেও খুব করে পোড়ায়। ‘

মেহেভীন এইবার কেন যেন চিরকুট টা ছুড়ে ফেলে দিলো না। তার বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে কে এই চিরকুটের মালিক।

সঙ্গে সঙ্গে মেহেভীনের ফোনের মেসেজের টং টা বেজে উঠলো। মেহেভীন মেসেজ চেক করে দেখে, অচেনা নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে,

‘গোলাপ ফুল দেখে তোমার মুখে যেই হাঁসিটা লেগে ছিলো, তা যেন সর্বদা বিরাজমান থাকে। ‘

মেসেজটা দেখে আরেকদফা চমকে উঠে মেহেভীন। তার মানে যে এই চিরকুটটা দিয়েছে, সে এখানেই আছে। কথাটি ভেবেই মেহেভীন চারদিকে তাকাতে থাকে,কিন্তু আফসোস কেউ নেই। সঙ্গে সঙ্গে আরেকবার মেসেজ আসে। মেহেভীন মেসেজ টা পড়ে দেখে তাতে লিখা,

‘ আমাকে শত খুঁজেও তুমি পাবে না প্রেয়সী। আর শুধু কিছুটা প্রহরের অপেক্ষা, তারপরেই আমি তোমার কাছে নিজেকে ধরা দিবো। ‘

মেহেভীন মেসেজটা পড়ে, আশ্চর্যের চরম সীমায় পৌঁছে যায়। তার মানে যে এসব করছে, সে এইবার নিজেকে সামনে আনবে, কিন্তু কীভাবে? মেহেভীন যেই নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছিলো, সেই নাম্বারে ফোন করে, কিন্তু বরাবরের মতো সে আশাহত হয়। নাম্বার বন্ধ! তখনি একটা গাড়ি গেট দিয়ে প্রবেশ করে। মেহেভীন বুঝতে পারলো আরহাম চলে এসেছে। আরহাম গাড়ি থেকে ফরমাল লুকে বেড়িয়ে, তাহসানের সাথে কথা বলতে বলতে হাটছে। আরহামকে দেখে মেহেভীনের চোখ যেন আটকে যায়। লোকটাকে ফরলাম ড্রেসাপে যে কারো চোখ আটকে যাবে। মেহেভীনকে এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে, আরিয়ান মেহেভীনের কাছে এসে বলে,

‘ বইন রে চোখটা নামা এইবার। তোরই তো নকল বর। যখন-তখন দেখতে পারবি। ‘

মেহেভীন কথাটি শুনে আরিয়ানকে মারতে শুরু করে দেয়। আরিয়ান হু হা করে হেঁসে উঠে।

________

আরহাম যেহুতু দুপুরের মাঝেই মিটিং টা শেষ করে, ফিরেছে তাই সবাই মিলে ঠিক করেছে, আজকে সবাই পার্বত্য অঞ্চলটা ঘুড়ে দেখবে।

আরহাম নোয়া গাড়ি ভাড়া করে নেয়। ফ্রন্ট সিটে আরহাম ও মেহেভীন একসাথে বসেছে। তার পরের সিটে মায়রা এবং অভ্র বসেছে।
অভ্র ও মায়রাও মেহেভীনদের সাথে যাচ্ছে। তার পিছনে আরিয়ান ও মজনু বসেছে। তাহসান ও রুশাও যাচ্ছে। রুশা যদিও আসতে চাইছিলো না তবুও তাহসান জোড় করায় এসেছে। গাড়ি তার আপনগতিতে চলতে শুরু করে দেয়।

অভ্র আজ নিষ্চুপ, তার মনে আজ এক্টাই প্রশ্ন উঁকি দেয় সে কি ভালোবাসে মেহেভীনকে? অভ্র নিষ্পলকভাবে মেহেভীনের দিকে তাকিয়ে থাকে। মায়রার নজরে তা ঠিকই পড়েছে,তবুও সে চুপ থাকে। মেহেভীন তো অভ্রকে বার বার এড়িয়ে চলার চেস্টা করছে। মেহেভীন আরহামের দিকে তাকায়। মানুষটা নিজের মতো ড্রাইভিং করছে।
কালকের পর থেকে মেহেভীনের শুধু একটা কথায় মনে পড়ছে,

‘ আরহাম সাহেব! জীবনটা বড্ড এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কি করবো আমি এখন? ‘

গাড়ি চলছে আপন গতিতে, আরিয়ান কিছুক্ষন পরেই বলল,

‘ ভাই বড্ড বোরিং লাগছে জার্নিটা। পরিবেশ কেমন থমথমে একটা গান তো প্লে কর। ‘

আরিয়ানের কথা শুনে, আরহাম গান ছেড়ে দেয়,

কিছু কথার পিঠে কথা

তুমি ছুঁয়ে দিলেই মুখরতা

হাসি বিনিময় চোখে চোখে

মনে মনে রয় ব্যাকুলতা

আমায় ডেকো একা বিকেলে

কখনো কোনো ব্যথা পেলে

আমায় রেখো প্রিয় প্রহরে

যখনই মন ক্যামন করে

কোনো এক রূপকথার জগতে

তুমি তো এসেছো আমারই হতে

কোনো এক রূপকথার জগতে

তুমি চিরসাথী আমার, জীবনের এই পথে।।

মুহুর্তেই পরিবেশটা মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠে।

গানটা শুনে মেহেভীন আরহামে দিকে তাকাতেই,আরহাম চমৎকার মুচকি হাঁসি উপহার দেয়। মেহেভীনও তালি মিলিয়ে হাঁসে। যা নজর এরায় না অভ্রের।

চলবে…

#তুমি_আছো_মনের_গহীনে
#পর্ব- ৩৩
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
চোখের সামনে নিজের প্রাক্তন স্ত্রীর সাথে নিজের ভাইয়ের এতো চোখাচোখি অভ্রের কাছে অতিরিক্ত মাত্রায় বিরক্তির কারণ হয়ে উঠছে। অভ্র জানে মেহেভীন এখন আরহামের স্ত্রী,তবুও প্রাক্তন স্ত্রীকে অন্য কারো সাথে দেখলে অভ্রের বুকে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হয়। এই ব্যাথা উৎস কি তবে ভালোবাসা? গাড়ি প্রায় পার্বত্য চট্টগ্রামে অঞ্চলে প্রবেশ করলো। এই অঞ্চলে একটা ঝর্না রয়েছে। ঝর্নাটা প্রায় সবার কাছেই বেশ পরিচিত এবং জনপ্রিয়। আরহামদের গাড়ি পাহাড়ের কাছে আসতেই, মেহেভীন চিল্লিয়ে গাড়িটা থামাতে বলে। মেহেভীনের চিল্লানাতো সবাই কিছুটা অবাক হয়। আরহাম গাড়ি থামিয়ে দেয়। গাড়ি থামাতেই, মেহেভীন গাড়ি থেকে কিছুটা হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে যায়। মেহেভীনকে এইভানে বেড়োতে দেখে, আরহাম মেহেভীনকে থামাতে রাগান্বিত গলায় বলে,

‘ স্টুপিড মেয়ে, এইভাবে দৌড়াচ্ছো কেন? পড়ে যাবে তো। ‘

মেহেভীন থামে না। সে ঝর্নার দিকে ছুটে যেতে থাকে। আরহাম ও মেহেভীনের পিছনে পিছনে যেতে থাকে। মেহেভীন ও আরহাম ঝর্নার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। প্রকৃতির অপরুপ মুগ্ধতায় তারা যেন একপ্রকার ঢুবে গেছে।ঝর্ণার জলরাশি উঁচু পাহাড় থেকে আছড়ে পড়ছে। জলধারা নীচে নেমে যাচ্ছে উচু পাহাড় গড়িয়ে। ঝর্ণার কাছে দাড়ালেই দেহ মন ভরে উঠছে পবিত্র স্নিগদ্ধতায়। মেহেভীনের কাছে ঝর্ণার সৌন্দর্য সম্পর্কে যতটুকু কল্পনা ছিলো তার থেকেও অধিক সুন্দর ঝর্নাটি। ঝর্নাটির কাছা-কাছি অনেকগুলো পাহাড় রয়েছে।
মেহেভীন কছর্ণা পর্যন্ত যাতায়াতের উচুনিচু রাস্তা আর পাশের তাকালেই সে বুঝতে পারে, পাহাড় তাকে যেন এনে দিচ্ছে রোমাঞ্চকর অনুভুতি। বাকিরাও চলে আসে ততক্ষনে। সকলেই পরিবেশটা বেশ উপভোগ করছে। আরিয়ান ক্যামেরা নিয়ে চারদিকে ছবি তুলছে। রুশা ও তাহসান নিজেদের মাঝে কথা বলছে। যদিও রুশা চুপ। তাহসানই কথা বলে রুশার মন ভালো করার চেস্টা করছে। এতো সুন্দর পরিবেশ দেখে, মায়রা নিজেকে সামলাতো পারলো না, অভ্রের হাত ধরে মহান্দনের সাথে বললো,

‘ অভ্র তোমার কিছু মনে পড়ে? আমরা যখন বিদেশে ছিলাম,তখন এইরকম কত সুন্দর জায়গায় আমরা একা একা বেড়িয়ে পড়তাম। আজ যেন সবকিছুই অতীত। ‘

শেষের কথাটি বলতে গিয়ে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো মায়রার। অভ্রের সেদিকে খেয়াল নেই, সে তো অন্য চিন্তায় মগ্ন, তার দৃষ্টি বরাবরের মতো সামনের দিকে মিষ্টি কপোতির দিকে। মেহেভীন বার বার ঝর্না থেকে বার বার পানি নিয়ে আরহামের মুখে ছিটাচ্ছে আরহামকে জ্বালানোর জন্যে এবং আরহাম বার বার স্টুপিড বলছে মেহেভীনকে। মেহেভীন তা শুনে খিলখিল করে হাঁসতে থাকে, মেহেভীনের সাথে তাল মিলিয়ে মৃদ্যু হাঁসে আরহাম। মেহেভীনকে এতোদিন পরে এতেটা প্রানবন্তভাবে হাসতে দেখে অভ্রের ভালালাগা কাজ করে। তার মনে শুধু একটাই কথা বলে, তার একটা ভূলের জন্যে মেয়েটার এই মায়বী হাসিটা হারিয়ে গেয়েছিলো, সে যদি মেহেভীনের সাথে ভালোবাসার নাটক না করতো,তাহলে তো আজ আরহামের জায়গায় সে থাকতো। মেহেভীন সব হাসি -খুশি থাকার কারণ অভ্র হলে কি খুব ক্ষতি হতো? অভ্রের ধ্যান ভাঙ্গে আরহামের কর্কষ গলা শুনে। আরহাম এইবার কিছুটা রেগে গেছে মনে হয়। বার বার মেহেভীনকে মানা করছে, তবুও মেহেভীন শুনে কার কথা? সে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে আরহামের উপর।

‘ মেহেভীনের স্টুপিডের মতো এইভাবে পানি ছিটাচ্ছো কেন? আমি একদম ভিজে গেছি। ‘

মেহেভীন আরহামের কথা না শুনে খিলখিল করে হেসে আরহামকে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে। এইবার আরহাম ও পানি নিয়ে, মেহেভীনকে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে। মেহেভীন হেসে উঠে। আরিয়ান এইরকম সুন্দর মুহুর্তাটাকে ক্যামেরাবন্দী করে ফেললো।

অভ্রকে এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে, মজনু অভ্র এবং মায়রার কাছে এসে মায়রাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘ভাবি গো? অভ্র ভাইজানের কি জ্বীনের আচর লাগছে নি? ‘

মজনুর এমন কথা শুনে, অভ্র ও মায়রা ভরকে যায়। অভ্র ধমকে বলে,

‘ এই তুমি বলতে চাইছো কি? ‘

মজনু তার ৩২টা দাঁত বের করে বলে,

‘ আসলে আপ্নারে যখনি দেখি তখনি খেয়াল করি আপনি খালি চাইয়া থাকেন আমার বড় ভাইজান আর ভাবির দিকে। আমাগো গ্রেরামে এক বেডা আছিলো বুঝছেন নি? নাম আছিলো মদন। দেখতে কি কালার কালা। দাঁত তো একেবারে নাই বলতে গেলে চলে। একবারে আপনার মতো।

‘ মানে কি বলতে চাইছো তুমি? আমি দেখতে কালো? আমার দাঁত নেই?

অভ্রের রাগান্বিত গলায় বলা প্রশ্নের জবাবে, মজনু বলে,

‘ আরে ভাইজান আফনে আবার উল্টা বুঝেন কেন?
আফনে তো মাশা-আল্লাহ হিরোর মতো দেখতে।
আমি তো কইতাছি যে আপনার ওর মতো অভ্যাস।
মদন সারাদিন খালি চাইয়া থাকতো হুদাই।পরে সবাই জানতে পারলাম আসলে ওর জ্বীনের আচর লাগছিলো। পরে অনেক ঝাড়া–ঝাড়ির পরে ওইডা ঠিক হয়। আমাকো গ্রেরামে কাব্লা বাবা ঠিক করে দিছিলো। ভাবি আপনার কি কাব্লা বাবার নাম্বার লাগবো? ‘

মায়রা হেসে দিলো।

অভ্র এইসব সহ্য করতে না পেরে, বললো,

‘ হেই ইউ ইডিয়েট। জাস্ট গেট লস! ‘

‘ এমন করেন কে? আজ-কাল কারো ভালোও করতে নাই। ‘

মজনু মুখ বেকিয়ে চলে যায়।

______ [লেখিকা ঃজান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি]

আরিয়ান নিজের হাতের ক্যামেরাটা নিয়ে, ছবি তুলতে থাকে। তখনি কেউ এসে তাকে খপ করে জড়িয়ে ধরে। এইভাবে কেউ হুট করে জড়িয়ে ধরায়, আরিয়ান চমকে পিছনে তাকাতেই দেখে ফারিয়া। ফারিয়াও আরিয়ানকে দেখে একপ্রকার শকড হয়ে যায়। সে এই মুহুর্তে আশা করেনি আরিয়ানকে।

‘ ডাক্তার সাহেব! আপনি এখানে? ‘

‘ আমারও একি প্রশ্ন! আপনি এখানে কি করে? ‘

ফারিয়া এদিকে সেদিকে তাকিয়ে শুকনো মুখে বললো,

‘ আসলে আপনাকে বলেছিলাম না? আমি ট্যাুরে যাচ্ছি বান্ধুবিদের সাথে। আমি আমার বান্ধুবিদের সাথে চট্টগ্রামে এসেছিলাম, আজ আমাদের এখানে শেষ দিন ছিলো। আমার ফ্রেন্ডগুলো এতো হারামি আমাকে ছেড়েই কই যেন হারিয়ে গেলো। এখন ওদের পাচ্ছিও না। আমার ফোনটাও নষ্ট হয়ে গেছে।
ওরা এখন কোথায় কীভাবে আছে কে জানে? ‘

‘ আমি যে যদি ভূল না হই,তাহলে ওরা নয় আপনি হারিয়ে গেছেন তাইতো? আপনি পথটা হারিয়ে ফেলেছেন? ‘

আরিয়ানের প্রশ্নে মাথা নিচু করে, ফারিয়া জবাব দেয়,

‘ আসলে ওদের হোটেলে রেখেই, আমি চট্টগ্রাম ঘুড়তে বেডিয়েছিলাম সকাল-সকাল। এখন পথটাও হারিয়ে ফেলেছি। তার মধ্যে কয়েকজন বাজে লোক আমার পিছন নিচ্ছিলো, তাই দৌড়ে এসে আপনাকে দেখে জড়িয়ে ধরলাম।’

আরিয়ান নিজের চশমাটা পড়ে বললো,

‘ এইরকম বাদরামী করলে, হারিয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক।’

ফারিয়া কিছুটা রেগে বললো,

‘ কি বললেন? আমি বাদরামী করি? ‘

‘ সত্যিই তো বললাম। এখন ভাবুন আপনি কিকরে নিজের হোটেলে ফিরবেন? ‘

ফারিয়াও চুপ হয়ে যায়। সে আসলে বুঝতে পারছে না, সে কি করবে? আরিয়ান এইবার টেডি স্মাইল দিয়ে বলে,

‘ আমি আমার ফ্যামেলির সাথেই এখানে এসেছি।চাইলে আজকে তুমি আমাদের সাথে জয়েন করতে পারো, কালকে তোমার ফ্রেন্ডদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিবো। ‘

ফারিয়া কিছু একটা ভেবে সম্মতি জানায়। এমনিতেও এখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখন আরিয়ানের কথাটাতেই সায় দেওয়া ঠিক মনে করলো ফারিয়া। আরিয়ান ফারিয়াকে নিয়ে, সবার কাছে গিয়ে ফারিয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দে, ফ্রেন্ড বলে। ফারিয়ার সাথেও সবাই হাঁসিমুখে মিশে যায়।

_________

সবাই মিলে অনেক্ষন ঘুরাঘুরিও করলো।মায়রাও আজ প্রচন্ডভাবে সবকিছু উপভোগ করেছে, যদিও অভ্র শুধুমাত্র নিরব দর্শকের মতোই ছিলো।
এখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। সবাই ঠিক করেছে, এখন হোটলে ফিরবে,কিন্তু পাশে নাঁচগানের আওয়াজ শুনে, মেহেভীনের খুব ইচ্ছে ছিলো একটিবার দেখার,কিন্তু আরহাম তাতে ব্যাঘাত ঘটিয়ে বললো,

‘ একদম না। এখন আমাদের হোটেলে যাওয়া দরকার,এতোক্ষন বাইরে থাকা তোমার পক্ষে ঠিক নয় মেহেভীন। ‘

মেহেভীন মনটা খারাপ করে ফেলে।

ফারিয়াও মেহেভীনের সাথে তাল মিলিয়ে বললো,
‘ শুনেছি এই অঞ্চলে অনেক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী থাকেন। হয়তো তারাই নাঁচ গান করছেন। আমার কিন্তু দেখার খুব শখ। আমিও যাবো মেহেভীন আপুর সাথে। ‘

মেহেভীন ফারিয়ার কথা শুনে হাসিমুখে আরহামের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ দেখলেন? ফারিয়াও যেতে চায়। আচ্ছা আমিও যাই কেমন? ‘
মেহেভীন ও ফারিয়া একে -অপরের হাত ধরে সামনের দিকে যেতে থাকে।
এক কয়েক ঘন্টায় ফারিয়া এবং মেহেভীনের ভালোই বন্ধত্ব হয়ে গেছে। ফারিয়া ও মেহেভীনকে যেতে দেখে, বাকিরাও তাদের সাথে যায়। তাদের দেখে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীরা তাদেরকে নিজেদের অনুষ্টানে যোগ দেওয়ার জন্যে আমন্ত্রন জানায়। তারা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী হলেও, তারা শুদ্ধ ভাষাতেই কথা বলে। তারাও যোগ দেয়। মেহেভীন খেয়াল করছে, অনেক মেয়েরা আরহামের দিকে নিজেদের সাথে ফিসফিস করে বলছে,

‘ দেখ শহর থেকে ছেলেগুলো আসছে, কি সুন্দর দেখতে তাইনা? ‘

‘ হু সব গুলোই সুন্দর,কিন্তু মাঝখানের টা দেখ একেবারে রাজপুত্র যেন। ‘

মেহেভীন খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে, তারা আরহামকে উদ্দেশ্য করেই বলছে। মেহেভীনের কেন যেন ভালো লাগছে না শুনতে।

কয়েকজন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মেয়েরা নাঁচতে নাঁচতে আরহাম ও আরিয়ানকে ঘিড়ে ধরে নাঁচতে থাকে। ফারিয়া কি মনে করে যেন আরিয়ানকে টেনে নিয়ে, আরিয়ানের সাথে নাঁচতে থাকে। তার ভাষ্যমতে তার ডাক্তার সাহেবের সাথে অন্য কেউ নাঁচতে পারেনা। ফারিয়ার এমন কান্ডে আরিয়ান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। তাহসান ও রুশা বসে আছে নিজেদের মতো। অভ্র ও বেশ খানিক দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মায়রাও অভ্রের পাশে দাড়িয়ে আছে। আরহাম বেচারা পড়েছে বিপাকে। এতোগুলো মেয়ের মাঝে সে বড্ড অস্বস্হিতে ভোগছে। আরহান স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মেহেভীন কেমন একটা আগুনরুপী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে,ভিতরের রাগটা ঠিক প্রকাশ করতে পারছে না। মেহেভীন নিজেও জানে না কেন তার এতো রাগ হচ্ছে মেয়েগুলোর প্রতি। শুধু অসহ্য লাগছে তার কীভাবে আরহামের সাথে চিপকে নাঁচানাচি করছে। আরহাম কিছু একটা ভেবে নাঁচে যোগ দিলো। মেহেভীনের রাগ তো নাকের ঢগায় চলে আসলো, তখনি কিছু বৃদ্ধ মহিলারা এসে, মেহেভীনকে কিছু একটা বলে তাদের সাথে নিয়ে গেলো। মেহেভীনকে হঠাৎ গাঁয়েব হয়ে যেতে দেখে আরহাম নাঁচ বন্ধ করে দিলো। মেহেভীন কোথায় গেলো?

চলবে……কী?