#তুমি_আমার_প্রেয়সী
#পর্ব_৩০
#তাসনিম_জাহান_রিয়া
বিকালের দিকে আমরা সবাই কলাংক পাহাড় যাই। পাহাড়ে ওঠার জন্য স্যার-মেমরা বাঁশ নিতে বলে। আমরা বাঁশের সাহায্যে ওঠছিলাম। আমার পা কিছুতে আটকে যায়। তাকিয়ে দেখি একটা গর্তে আমার পা পড়ে গেছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি দেখে অহিও দাঁড়িয়ে যায়। অহি আমাকে জিঙ্গেস করে,
কী হয়ছে?
গর্তে পা পড়ে গেছে।
আটকে যায়নি তো?
না। গর্তের সাইজ আমার পা থেকে অনেকটা বড়।
আমি গর্ত থেকে পা তুলে আবার হাঁটা শুরু করলাম। আমি আর অহি দাঁড়িয়ে যাওয়ায় সবার থেকে অনেকটা পিছনে পড়ে যাই। অবশেষে আমরা পাহাড়ের ওপরে এসে পৌছায়। আমি আর অহি সবার পিছনে।
হঠাৎ করে কেউ আমাকে পিছন থেকে ধাক্কা দেয়।আমি অহির সাথে থাকায় অহির হাত চেপে ধরি। আচমকা এভাবে ধরায় অহি টাল সামলাতে পারে না। টাল সামলাতে না পেরে দুজনই পাহাড় থেকে পড়ে যেতে নিলে আমি অহির হাত ছেড়ে দেই। অহিকে ধাক্কা দিয়ে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দেই। আমি একা পাহাড় থেকে পড়ে গেলাম। কণা অহির হাত ছেড়ে দিয়ে ধাক্কা দেওয়ায় অহি পাহাড় থেকে না পড়লেও অহির মাথা গিয়ে পড়ে একটা পাথরের ওপর।
আআআআআয়া
অহির চিৎকার শুনে সবাই পিছনে তাকায়। পিছনে তাকিয়ে সবাই থমকে যায়। অহির মাথা পাথরে পড়ায় মাথা ফেটে গেছে। অহির রক্তে পাথরটা লাল হয়ে গেছে। এমনকি জায়গাটাও রক্তে লাল হয়ে গেছে। অহির এমন অবস্থা দেখে সাফাতের পৃথিবী থমকে যায়। আভিয়ান দৌড়ে তার বোনের কাছে যায়। আভিয়ানের পিছনে সবাই ছুটে যায় অহির কাছে। ততক্ষণে অহি ঙ্গান হারিয়ে ফেলছে। সবাই অহিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কণার কথা সবাই বেমালুম ভুলে গেছে।
সবাই অহির কাছে ছুটে গেলেও সাফাত নিজের জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর পা চলছে না। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা দেখছে। মাথা ঘুরে পড়ে যায় সাফাত। সাফাত চোখের সামনে রক্ত দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না। সাফাতের ভয়ংকর ফোবিয়া আছে। রক্ত দেখলেই ভয়ে অঙ্গান হয়ে যায়।
নোমান খেয়াল করে দেখে অহির কাছে সবাই আসলেও সাফাত আসেনি। নোমানের একটা কথা মনে পড়তেই তাড়াতাড়ি পিছনে তাকায়। পিছনে তাকিয়ে দেখে সাফাত অঙ্গান হয়ে পড়ে আছে।
৬৮
অহির অপারেশন চলছে। অপারেশন থ্রিয়েটারের সামনে বসে আছে ভার্সিটির কিছু স্যার, মেম, কিছু সিনিয়র স্টুডেন্ট, নোমান, বন্যা ছোঁয়া এবং আভিয়ান। সাফাত একটা কেবিনে ঘুমুচ্ছে। ডক্টর ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছে।নাহলে সাফাত আবার পাগলামি শুরু করে দিবে। ঙ্গান ফেরার পর অনেক পাগলামু করছে অপারেশন থ্রিয়েটারের ভিতরে ঢোকার জন্য। সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিল সাফাতের এমন পাগলামু দেখে। সাফাতকে আটকে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না তাই ডক্টর ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছে।
আভিয়ান চোখ বন্ধ করে হসপিটালে সারিবদ্ধ ভাবে রাখা চেয়ারগুলোতে বসে আছে। চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে। তার সাদা শার্টটা অহির রক্তে লাল হয়ে আছে। সে কিছুতেই অহির এই অবস্থা মেনে নিতে পারছে না। বুকের ভিতরে খালি খালি লাগছে। তার বোনটা আদো বাঁচবে নাকি সে জানে না। অপারেশন থ্রিয়েটারের ভিতরে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে তার ছোট বোনটা। তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করতে পারছে না। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি অক্ষম মনে হচ্ছে তার।
অহিকে সে কখন সামান্যতম আঘাত পেতে দেয়নি ছোটবেলা থেকে। আর তার বোন আজকে এত কষ্ট পাচ্ছে। আভিয়ান মনে মনে প্রতিঙ্গা করছে যার জন্য তার বোনের এই অবস্থা তাকে সে কিছুতেই ছাড়বে না। তার বোন যতটুকু কষ্ট পাচ্ছে তার থেকে হাজারগুন বেশি কষ্ট তাকে পেতে হবে। তার পায়ে ধরে মৃত্যু ভিক্ষা চাইবে কিন্তু সে দিবে না। তিলে তিলে মরতে হবে তাকে। আভিয়ানের প্যান্টের পকেটে থাকা ফোনটা বেজে ওঠে। ফোনের স্কিনের নামটা দেখে তার বুকের ভিতর ধুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।
কীভাবে বলবে তার মাকে অহির কথা? অহির ফোন বন্ধ পেয়েই হয়তো তাকে কল দিয়েছে। কারণ তার সাথে ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট আগে তার মায়ের সাথে কথা হয়েছে। ফোন রিসিভ করতেই যদি তার মা জিঙ্গাস করে, অহি কোথায়? অহি কেমন আছে? অহির ফোন বন্ধ কেনো? তখন সে কী উত্তর দিবে। মা-বাবা নাকি সন্তানের বিপদ আগে থেকে আঁচ করতে পারে। সন্তান কোনো বিপদ হলে তারা বুঝতে পারে। আভিয়ান কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করে।
হ্যালো আভিয়ান! অহি কোথায়? আর কণা কোথায়? দুজনের ফোন বন্ধ কেনো? বল না ওরা কোথায়? আমার টেনশন হচ্ছে তো। মনটা কেমন কু ডাকছে। তুই তো বড় ওরা তো ছোট এতো দূরে কী করছে কে জানে?
আভিয়ান কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে, মা অহির একটা এক্সিডেন্ট হয়ছে।
ঐ পাশ থেকে আর কোনো শব্দ আভিয়ানের কানে এলো না। নোমান এসে আভিয়ানের কাধে হাত রাখে। আভিয়ান নোমানকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে দেয়। হয়ত এতক্ষণ ধরে এমন একটা আশ্রয় খুঁজছিল কাঁদার জন্য। নোমান আভিয়ানকে বাধা দেয় না। মাঝে মাঝে কাঁদা ভালো। মন হালকা হয়। ভিতরে জমে থাকা কষ্ট কমে।
৬৯
সাফাতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আনোয়ার চৌধুরী ( সাফাতের বাবা )। উনার চোখের কোণে পানি চিক চিক করছে। সাঁজেক এসেছিলেন একটা কাজে। নোমান খবর দেওয়ার সাথে সাথে ছুটে চলে আসেন। নিজের চোখে অহির জন্য পাগলামি করতে দেখেছে সাফাতকে। সে জানত তার ছেলে অহিকে ভালোবাসে। কিন্তু এতটা ভালোবাসেন সেটা উনি বুঝতে পারেননি। আজ যদি অহির কিছু হয়ে যায় তাহলে তার ছেলের কী হবে? সাফাত তো পাগল হয়ে যাবে।
সাফাত আনোয়ার চৌধুরী সম্পর্ক বাবা ছেলের মত নই বেস্টফ্রেন্ডের মত। প্রথম দেখায় কেউ চট করে বলে দিতে পারবে না উনারা বাবা ছেলে। আনোয়ার চৌধুরী অল্প বয়সে বিয়ে করায় সাফাত আর তার বাবার এইজ ডিফারেন্স বেশি না। আনোয়ার চৌধুরীর চেহারায় এখন বয়সের ছাপ পড়ে নাই। সাফাত তার বাবার কাছে সবকিছু শেয়ার করে।
সাফাত যখন ৮ বছরের তখন তার মা একটা এক্সিডেন্টে মারা যায়। সাফাতের মা যখন এক্সিডেন্ট করে তখন সে নিজের চোখে সেই এক্সিডেন্ট দেখে। নিজের মায়ের রক্তে মাখা লাস। নিজের মায়ের এই ভয়ংকর মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি। ভয়ে অঙ্গান হয়ে যায়।
ঙ্গান ফেরার পর থেকে কারো সাথে কথা বলত না। সারাদিন রুম থেকে বের হত না। নিজের মায়ের একটা ছবি বুকে জড়িয়ে বসে থাকত। ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করত না। আনোয়ার চৌধুরীর সময় ছিল না ছেলের খোঁজ নেওয়ার। কারণ তিনি নিজেও ভেঙে পড়েছিলেন স্ত্রীর মৃত্যু। নিজের স্ত্রী মৃত্যু সুখে এতোটাই কাতর ছিলেন যে ছেলের খোঁজ নেওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন।
তাদের সামলানোর মত কেউ ছিল না। আনোয়ার চৌধুরী প্রেম করে বিয়ে করায় উনার ফেমিলি সাফাতের মাকে মেনে নেই নি। মেনে না নেওয়ার আরেকটা কারণ ছিল। সাফাতের মা এতিম ছিলেন। আনোয়ার চৌধুরীর বাবা-মা একটা এতিম মেয়েকে তাদের ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিবেন নাহ। তাই আনোয়ার চৌধুরী নিজের বাড়ি নিজের আপন জনদের ছেড়ে চলে আসেন।
৭০
আভিয়ান গিয়ে বন্যাকে জিঙ্গেস করে, বন্যা কণা কোথায়?
অহির এমন অবস্থা অন্য কোথাও তো যাবে না। এখানে হয়তো কোথাও আছে। ( কথাটা বলতে বলতে বন্যা চারপাশে একবার চোখ বুলায়। কিন্তু কণাকে কোথাও দেখতে পায় নাহ। ) কণা এখানে নাই তো কোথায় গেলো?
তোমরা তো একসাথে থাক। তুমি জানো না কণা কোথায়? ( কিছুটা রেগে চিৎকার করে )
নোমান কিছু একটা ভেবে বলে, কণাকে আমি পাহাড়েও দেখি নাই। কণা যখন পাহাড়ে ওঠছিল তখন একবার দেখছিলাম। কিন্তু পাহাড়ের ওঠার পর বা অহির এক্সিডেন্টের সময় আর দেখি নাই।
আল্লাহ আমি এখন কী করব? বাড়ির সবাইকে আমি এখন কী বলব? আম্মু আসার সময় আমাকে বার বার বলছিল কণা আর অহির যেনো খেয়াল রাখি। আমি দুজনের থেকে একজনেরও খেয়াল রাখতে পারি নাই। একজন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে আরেক জন নিখোঁজ। আল্লাব জানে কণা কেমন আছে? কোনো বিপদ হয়ছে কী না?
আভিয়ান ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে। তখনি অপারেশন থ্রিয়েটারের লাইট অফ হয়ে যায়। ভিতর থেকে একজন ডক্টর বের হয়ে আসে। সবাই ছুটে ডক্টরের কাছে যায়। আভিয়ান সবার আগে প্রশ্ন করে,
ডক্টর অহি কেমন আছে?
অপারেশন সাকসেসফুল তবে…
বন্যা ভীত গলায় বলে, তবে কী ডক্টর?
৪৮ ঘন্টার আগে আমরা কিছু বলতে পারব না। ৪৮ ঘন্টার আগে ঙ্গান না ফিরলে লাইফ রিস্ক আছে এমনকি কোমায় চলে যেতে পারে। আর এখন সেন্স ফিরে আসলে কথা বলতে পারবে না।
চলবে…..