#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব: ৫৯
-কোথায় যাচ্ছিস তুই?
এড়িয়ে যেতে গিয়েও পারল না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও দাঁড়াতে হলো। তবে জবাব করল নাহ, ব্যস্ত ভঙ্গিতে ফোন চালাতে লাগল। সাদমান আবারও জিজ্ঞাসা করল
-কি হলো বল কোথায় যাচ্ছিস?
-বাইরে, একটু নিউমার্কেটের দিকে
-কেন?
-কেন আবার, মার্কেটে তো মানুষ কেনাকাটার জন্যেই যাই
ফারিহার দায়সারা জবাবে তুষ্ট হলো না সাদমান। ফারিহার সাথে আবারও সেই ছেলেটাকে দেখে গা পিত্তি জ্বলে উঠছে ওর। তবুও নিজেকে যথাযথ সংযত করার চেষ্টা করে বলল
-এই সন্ধ্যা বেলা করে কেন যাবি? তাও আবার ওই ছেলেটার সাথে?
ফোন থেকে মুখ তুলে সাদমানের থমথমে চেহারার দিকে তাকাল ফারিহা। তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে ঘুরাল। বেশ গম্ভীর গলায় বলল
-ওই ছেলেটা মানে কি? ওর নাম রবিন। আমার মামার বড় ছেলে, এর আগেও এসেছিল
-হ্যাঁ এর আগেও এসেছিল,আর তুই তার বাইকে করে সারা শহর টইটই করে চড়েছিস
ফারিহার কথা শেষ হতে না হতেই সাদমান কটমট করে বলল। ফারিহা কিছুক্ষণ কটাক্ষ করে তাকিয়ে থেকে বলল
-তো কি হয়েছে, আর তুই এখান থেকে যা, ও বাইক বের করতে গেছে চলে আসবে
ফারিহার কথায় যেন সাদমানের ক্ষোভ দরদর কয়েকাংশ বেড়ে গেল,কপালের রগ গুলো স্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হলো, তবুও নিজের অহেতুক ক্রোধ সংবরণ করে চাপা স্বরে বলল
-কেন? আমি থাকলে কি? তোর সাথে কথা বলতে দেখলে কি তোর সেই ভাই রেগে যাবে নাকি?
-দেখ ফাও কথা বলতে একেবারেই ইচ্ছে নেই। তুই যেই কাজে এসছিস যা, আমি চাইনা কোনো ঝামেলা হোক
এবার আর সাদমান নিজেকে সংযত রাখতে পারল নাহ, কিসব বলছে ফারিহা? ওর সাথে কথা বলতে দেখলে ছেলেটা ঝামেলা করবে কেন? সাদমান ফারিহার সাথে কথা বলবে এতে ওর কি!
-ঝামেলা কেন হবে?আমার সাথে কি এর আগে কথা বলিস নি তুই? আর আমার সাথে কথা বলবি তো ওর কি? কে হয় ও?
প্রায় এক প্রকার চিৎকার করে বলল সাদমান। ফারিগা স্তম্ভিত সাদমানের এহেন রূপে। এতটা উত্তেজিত ওকে আগে দেখেছে বলে মনে হয়না নিজের উৎকণ্ঠা ভেতরে দমিয়ে শান্ত গলায় বলল
-দেখ এটা বাড়ি, সবাই আছে। এভাবে চেঁচামেচি করবি নাহ। ও আমার যাই হোক সেটা আমার পারসোনাল ব্যাপার, তোকে তো আর জ্বালাচ্ছি না। তাহলে সমস্যা কোথায় তোর?
বলেই আর কিছু বলার বা শোনার প্রতীক্ষা না করে গেইটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ততক্ষণে ওর মামাতো ভাই গ্যারাজ থেকে বাইক বের করে এনেছে। স্টার্ট করতেই ফারিহা হাসিমুখে পেছনে উঠে বসে কিছু একটা বললে ছেলেটাও হাসতে হাসতে গিয়ার ঘুরিয়ে ধুলো উড়িয়ে চলে গেলো। সাদমান হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইল ওর যাওয়ার পানে। ফারিহা গত এক সপ্তাহ ধরেই কথা বলছে না ওর সাথে। যদিও তার কারণ সাদমানের নিজেরই উপেক্ষা। বারবার ফারিহাকে এড়িয়ে চলত পিছু ছাড়াতে চাইত কিন্তু এখন যখন ফারিহা নিজে থেকেই তাকে এড়িয়ে চলছে ব্যাপার টা একেবারেই সহ্য হচ্ছে না ওর। আর রবিন নামের ছেলেটার সাথে ফারিহার এমন মেলামেশা ও একেবারেই দেখতে পারছে নাহ।
খানিক স্থির দাঁড়িয়ে থেকে মন্থর পায়ে হাঁটা ধরল বাড়ির ভেতরে। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে, রিমঝিম কে আর এখন পড়ানোর একেবারেই ইচ্ছে নেই। কিন্তু কিছু করার ও নেই।
মৃদুমন্দ পদক্ষেপে বাড়ির ভেতরে গিয়ে বসল পড়াত ঘরটাতে রিমঝিম আগে থেকেই বই খুলে বসে আছে, মেয়েটা এখন আর আগের মতো জ্বালায় নাহ। খুব বেশি না হলেও লেখাপড়াতেও বেশ উন্নতি হয়েছে। সাদমান অতিরিক্ত কোনো শব্দ খরচ না করে চুপচাপ পড়ানো শুরু করল। ঘণ্টা খানেক সময় অতিবাহিত হলে রিমঝিম ওর চিকন কণ্ঠে প্রশ্ন করল
-স্যার আপনি কি অসুস্থ?
নিরবে মাথা নাড়িয়ে না সূচক জবাব দিল সাদমান। তবে রিমঝিম দমে গেল নাহ। আবারও বলল
-তাহলে কি কোনো ব্যাপারে চিন্তিত?
সাদমান নিরুত্তর রইল খানিক। অতঃপর বলল
-তোমার এমন মনে হওয়ার কারণ?
চিকন কণ্ঠে তৎক্ষনাৎ জবাব এলো
-আপনার চেহারা দেখেই কেমন একটা চিন্তিত এলোমেলো ভাব আসছে। আর আপনি একটা অংক ভুল ও করিয়েছেন,এই যে দেখুন
বলে খাতা এগিয়ে দেখাল সাদমানকে। ঘোলাটে দৃষ্টিতে খানিক থ মেরে থাকল সাদমান। আসলেই তার খারাপ লাগছে। মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠছে। রিমঝিমের বলায় যেন অস্বস্তি, ছটফটানি আরও দ্বিগুণ হলো। বেশ কিছু সময় চুপ থেকে বলল
-আজকে যদি এই পর্যন্তই শেষ করি তোমার কি প্রবলেম আছে? আসলে আমার শরীরটা একটু খারাপ লাগছে।
-ইটস ওকে স্যার, আপনি বরং কাল আবার পড়াবেন। যেটা আপনার ভালো মনে হয়
কিঞ্চিৎ মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিয়ে উঠে দাঁড়াল।দরজার দিকে পা বাড়াতে গেলেও কিছু একটা ভেবে ঘাড় ঘুরিয়ে রিমঝিমের দিকে তাকিয়ে বলল
-বাড়িতে কি কোনো অনুষ্ঠান হবে? না মানে এনভাইরনমেন্ট দেখে এমন মনে হচ্ছে
-কেনো স্যার আপনাকে আপু বলেনি? রবিন ভাই আর ফারিহা আপুর এঙ্গেজমেন্ট কাল
বলেই আবারও বই গুছাতে ব্যস্ত হয়ে পরল। কিন্তু সাদমানের পা আর এক চুল নড়াতে পারল নাহ। গলা থেকে শুরু করে সারা শরীরে তরতর করে প্রখর জ্বলন ছড়িয়ে গেল। প্রচণ্ড তৃষ্ণায় কাঠ কাঠ হয়ে এলো গলা। কিন্তু অদ্ভুতভাবে এমন রুক্ষ অনুভূতিতেও তার হাত পা কেমন জমে এলো।
বহু কষ্টে পা তুলে আস্তেধীরে আগালো। ঢুলু ঢুলু পায়ে সিড়ি বেয়ে নেমে রাস্তার সামনে দাঁড়াতে একটা রিকশা দাঁড় করাল। সে সবসময়ই হেটে যাতায়াত করে। কিন্তু আজকে যেন শরীরের সমস্ত শক্তি টুকুও ফুরিয়ে গেছে।
রিকশা চলতে শুরু করলে কি একটা মনে করে রিকশা চালককে নিউমার্কেটের সামনে দিয়ে যেতে বলল। আর হলোও তাই, ঠিক যেটার আশঙ্কা করেছিল। টপটপ করে কপাল বেয়ে ঘাম ঝরে পরল। তার সামনেই ফারিহা রবিনের হাত ধরে একটা শাড়ির দোকান থেকে বেরচ্ছে। মুখ জুড়ে অমায়িক হাসি।
এমনটাই তো চেয়েছিল সাদমান। তবুও বুকের ভেতর কেমন চিনচিনে ব্যথা শুরু হলো। আর এক মুহূর্ত অবলোকন করতে পারল না সে দৃশ্য। চালককে দ্রুত চালাতে বলল, বাড়ির সামনে আসতেই ভাড়া চুকিয়ে এগিয়ে গেল সিড়ির দিকে। কিন্তু শরীর যেন আর চলল নাহ, টলমলে পায়ে দু কদম বাড়াতেই শরীর ভার ছেড়ে দিল। ধপ করে পড়ে গেল সিড়ির মুখে
…………
-কি বলিস, শেষে কিনা আমাদের জায়মা আর মাহিদ! এটা তো কল্পনাতেও ভাবিনি রে
-তুমি এ কথা বলছ, আমি যেদিন প্রথম ওদের একসাথে দেখেছিলাম সেদিনই তো আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেছে। শেষে কি না বিলাতি ফিরিঙ্গি আর সিলেটিয়ান উপজাতি একসাথে, তাও আমার মাখোঁ মাখোঁ প্রেম
বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো তুরা,সাথে রাইমাও। হাসির দাপটে রাইমার উঁচু হওয়া পেট টাও নড়ছে। পেটের উপর হাত রেখে ক্লান্ত স্বরে রাইমা বলল
-তুই আর হাসাস না রে আমাকে, পেটের মধ্যে অলিম্পিক শুরু করে দিয়েছে এই বিচ্ছু
-নড়ছে বাবু?
উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল তুরা,রাইমা মাথা উপর নিচ করলে ও হুড়মুড়িয়ে এসে রাইমার পেটের সাথে কান পেতে ধরল। কিছুক্ষণ কান চেপে ধরে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল
-ওমা ছেলে কি বলল, যে মামি খিলখিল করে উঠল একেবারে?
-হুমম, সে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা আপু তোমাকে বলা যাবে নাহ। তাই না ঘাপুস?
বলেই আলতো ভাবে রাইমার পেটে হাত বুলিয়ে দিল। রাইমা তুরার কথা বলার ভঙ্গি দেখে আবারো হেসে দিল। কিন্তু বসার ঘরে ওদের দুজনের পাশে আরেকজন ও উপস্থিত, এতক্ষণে ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে তাকাল, তাও রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে
-হোয়াট রাবিশ,,ঘাপুস আবার কেমন নাম, যেমন ষ্টুপিড তেমন ষ্টুপিড টাইপ নাম তার
-শাট আপ, আমি ষ্টুপিড তো আপনার কি, মাস্টার গিরি করছেন সেটাই করুন। এদিকে মেয়েলী কথায় কান দিতে বলেছে কে আপনাকে
কটমট করে বলল তুরা, রাইমা মুখ টিপে হাসছে ওর কথা শুনে। আবারও দুজনের ফুসুরফাসুর গল্প শুরু হলো। ছোট ছোট চোখ করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল আহান তুরার দিকে।
বউটা তার খুব অবাধ্য হয়ে গেছে, একটা কথাও শোনে না। কিছু বলতে গেলে উল্টো দুটো শুনিয়ে দেয়। ঠিক করে খেতে চাইনা,কাছে আসতে চাইনা, তার সাথে ঘুমাতেও চাইনা, একটু আদর করতে গেলেও দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। হতাশা ভরা নিঃশ্বাস ছাড়ল আহান। এই যে বউয়ের জন্য ল্যাপটপ নিয়ে বসার ঘরে এসে বসে আছে কিন্তু তার বউ তো নিষ্ঠুর একবার তাকাচ্ছেও নাহ। রাইমা এসে থেকে সারাদিন ওর সাথেই পরে থাকে।
আরও বেশ কিছুক্ষণ সময় উঠে দাঁড়িয়ে বলল
-তুরা, একটু ঘরে আসো
-আমি? কেনি? যাব না আমি
পটপট করে মুখের উপর না বলে দিল। আহান রেষপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল, কি সাহস হচ্ছে মেয়েটার দিনদিন! তাকে গুণেই না এখন আর। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল
-দুই মিনিটের মধ্যে ঘরে আসো তুরা
বলে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। রাত বারোটা বাজতে চলল অথচ মেয়েটার ঘরে আসার নাম নেই, আবার মুখের উপর বলে যাব না। এখন তো কিছু বলাও যায় না,একটু কিছু বললেই কেঁদে দেয়,দূরে দূরে থাকে। আহানের ভীষণ আক্ষেপ হতে শুরু করল। বউটা তার পালটে গেছে। আগের মতো পিছে পিছে লেগে থাকে নাহ এমন তুরাকে একেবারেই ভাল্লাগছে নাহ আহানের। এতসব ভাবতে ভাবতে হুট করেই রাগ হলো আহানের ভীষণ। ল্যাপটপ টা সোফার উপর ছুড়ে মেরে গগণচুম্বি স্বরে চিৎকার করল
-তুরায়ায়া
অকস্মাৎ এমন চিৎকারে কেঁপে উঠলো তুরা, হকচকিয়ে উপরে তাকালে রাইমা বলল
-ভাই মনে হয় রেগে গেছে তুরা, তুই যা ওর তো কিছু দরকার ও হতে পারে তুই এক্ষুনি যা
তুরাও আর দ্বিমত করল নাহ। দ্রুতপায়ে হেঁটে ঘরে গেলেই আহানের অগ্নিদৃষ্টির শিকার হলো। কটমট চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। এবার বেশ ভয় ভয় হলো তুরার। মৃদু পায়ে এগিয়ে এসে বলল
-কি হয়েছে,কিছু লাগবে?
আহান ভীষণ শক্ত চোখে তাকিয়ে থেকে ওর হাতের কব্জি ধরে এক টান দিয়ে বসালো কোলের উপর। তুরার গাল চেপে ধরে বলল
-তোমাকে ডেকেছি না আমি? মুখের উপর না বলা শিখেছ খুব তাই না?
তুরা আহানের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারল না। বাঁধা গলায় বলল
-ছাড়ুন, লাগছে আমার
-আর নিজে যখন আমাকে রেখে দূরে দূরে থাক, কাছে ডাকলে আসো না। রাতেও ও ঘরে গিয়ে ঘুমাও তখন, তখন আমার লাগে না?
তুরা জবাব দিল না, আহানের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলে, এক পর্যায়ে আহান ছেড়েও দিল। তুরাকে কোল থেকে নামিয়ে অন্যপাশে গিয়ে উপর হয়ে শুয়ে পরল। আড়চোখে তাকাল তুরা আহানের দিকে। এবার সত্যিই খারাপ লাগছে তার। আহান যে কষ্ট পাবে এটা বুঝতে পারেনি। আস্তেধীরে উঠে দরজা লাগিয়ে দিল। খাটে এসে পাশে বসে আহানের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল
-শুনুন
জবাব এলো নাহ, তুরা আবারও ডাকল। কিন্তু আহানের নড়চড় নেই। তুরার ঠোঁট ভেঙে কান্না এলো। সে নিজে দূরে দূরে থাকলেও আহানের একটু এড়িয়ে যাওয়াও ওর সহ্য হয়না। এগিয়ে গিয়ে আহানের পিঠে হাত রাখল, ধরা গলায় বলল
-একটু তাকান না আমার দিকে?
তবুও আহান নড়ল নাহ। এবার তুরা কান্না আটকাতে পারল নাহ। চোখ বয়ে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলে হাতে উল্টো পিঠে মুছে আহানের পিঠের উপর শুয়ে মুখ গুঁজে দিল ঘাড়ের কাছে, কাঁদো কাঁদো গলায় বলল
-এমন করছেন কেন, আমার কান্না পাচ্ছে। আপনি আমার দিকে কেন তাকাচ্ছেন নাহ। আপনি আমাকে ভালোবাসেন নাহ আর
বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তুরার চোখের পানি আহানের ঘাড় বয়ে বুকে গিয়ে পরল। এক হাতে তুরার পিঠ চেপে ধরে ঘুরল আহান। তুরার অবস্থান ঠিক ওর বুকের উপর। এইটুকু সময়ে কেঁদে চোখ মুখ লাল করে ফেলেছে। গাল বয়ে টুপটুপ করে আহানের বুকে পরছে চোখের পানি। আহান নরম স্পর্শে তুরার গাল মুছিয়ে দিয়ে বলল
-কি করলাম আমি, কাঁদছ কেন?
-আপনি আমার সাথে কথা কেন বলছেন নাহ
-আমি বলছি না? নিজে যে এতদিন ধরে আমার থেকে দূরে দূরে থাক, তখন কিছু না আর আমি চুপ করে থাকলাম পাঁচ মিনিট হলো কি না আর কান্নাকাটি শুরু, এই জন্য মানুষকে উইকনেস দেখাতে নেই,সবাই সুযোগ নেই
-আপনি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করছেন
ঠোঁট ভেঙে বলল তুরা, আহান ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে বলল
-তো কি করব। যাও যেখানে ছিল সেখানেই যাও তাইলে কেও খারাপ ব্যবহার করবে নাহ। আমার কাছে তো আস না এখন কেন এসেছ?
-এই যে এখন এসেছি, এখন আদর করুন
বলেই আহানের গাল টুস করে একটা চুমু খেলো তুরা। আহান চাইলেও আর কপট রাগ ধরে থাকতে পারল নাহ। দুহাতে তুরাকে বুকের সাথে চেপে ধরে বলল
-এইবারই শেষ। এরপর যদি এমন করেছ তাহলে আমি আর একটাও কথা বলব না বলে দিচ্ছি
তুরা প্রত্যুত্তর করল নাহ। সাপের মতো দুহাতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল আহানকে। পরপর কয়েকবার ওর বুকে চুমু দিয়ে মুখ গুঁজে রইল।
~
দরজায় সশব্দে কয়েকবার করাঘাতে ঘুম ভেঙে গেল রুবি খাতুনের। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সকাল ছয়টা। এত সকালে কে এলো,তাও এভাবে!
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে উঠে দরজা খুলতেই আহানের অবিন্যস্ত, এলোথেলো চেহারা দেখে আতকে উঠল রুবি। আহানকে কিছু জিজ্ঞাসা করবে তার আগেই ও অস্থির হয়ে বলল
-মা, মা শিগগিরী আসো, তুরা কেমন করছে মা।তুমি এক্ষুনি আস
রুবি সবেমাত্র ঘুম ভেঙে এমন কিছু একেবারেই প্রত্যাশা করেনি। রুবিকে ধাতস্থ হওয়ার সময় না দিয়েই ওর হাত ধরে হাঁটা শুরু করতে নিলে ইনসাফ মাহবুব বেড়িয়ে এসে বলল
-কি হয়েছে আহান, তুরার কি হয়েছে ও ঠিক আছে?
-বাবা তুরা কেমন করছে। ওর শরীর খুব খারাপ করেছে। তুমি এক্ষুনি ডক্টরকে কল করো বাবা। মা চলো না আমার তুরা কেমন করছে
রুবি, ইনসাফ আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল নাহ। ছুটে গেলেন আহানের ঘরের দিকে। ঘরে ঢুকেই আতকে উঠল সবাই। আহান এক ছুটে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে তুরাকে মেঝে থেকে কোলে তুলে নিলো
-মা দেখ না তুরার কি হলো। তুরা,তুরা ওঠ। তুরা তুমি তাকাচ্ছ না কেন?
চেঁচিয়ে উঠলো আহান।তুরার গালে আলতো কয়েকটা চাপড় দিল। রুবি ইনসাফ তুরার এহেন অবস্থা আর আহানের এমন অস্থিরতা দেখে প্রচন্ড বিচলিত হলো। রুবি এগিয়ে এসে দেখল তুরার সমস্ত মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, আহান পাগলের মতো তুরা হাত পা ঘষছে
……..
সকালের কড়া রোদ চোখে উপচে পরতেই ঘুম হালকা হলো, কুচকে এলো চোখ। কপাল ভাঁজ করতে গেলে তার উপর কিছু একটার উপস্তিতি অনুভব করতে পারল। সারা শরীরে ব্যথা,ঝিম ধরে আছে। কোনো মতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে চোখ টেনে খুলল সাদমান।
সব হালকা ঝাপসা দেখছে, তৎক্ষনাৎ তার মনে পরে গেল কাল রাতে সিড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে পরে গেছিল। কিন্তু তারপর কি হলো? এটা কোথায়? খানিক ঝাপসা দৃষ্টিতেই এদিক ওদিক তাকালে উপলব্ধি করল এটা তারই ঘর। কনুই এ ভর করে উঠতে গেলে অনুভব করল সামান্য উঠে বসার ও শক্তি নেই শরীরে। সারা গায়ে ঘাম জবজবে। চোখ টেনেও তাকাতে পারছে নাহ।
কিছুক্ষণ চোখ বুজে থেকে আবারও তাকানোর চেষ্টা করল। মুখের উপর হালকা, ঝাপসা একটা মেয়েলি অবয়ব দেখে বলল
-মা? মা আমি উঠতে পারছিনা কেন। কি হয়েছে আমার?
জবাব এলো নাহ। কিন্তু ঝাপসা চোখে হলেও সে স্পষ্ট বুঝতে পারল তার সামনেই বসা তার মা। কপালের উপর হাত রাখে লেপ্টে থাকা ভেজা একটা কাপড় তুলে সরাল। সারা শরীর কেমন জ্বলে উঠছে, সাদমান ক্লান্ত গলায় আবারও বলল
-মা এটা কি আমারই ঘর?
-হু
ক্ষীণ স্বরে জবাব এলো এবার। সাদমান উঠতে চেষ্টা করলে কড়া গলার ধমক শুনতে পেলো
-চুপ করে শুয়ে থাক। রাতে তো সিড়ির উপর পড়েছিলি, নিচ তলার ভাড়াটিয়া তুলে না আনলে তো ওখানেই চিত হয়ে থাকতি
মায়ের এমন রূঢ় আচরণ বোধগম্য হলো না সাদমানের। তবে কালকের কথা মনে হতেই ওর ফারিহার কথা মনে হলো। অজান্তেই চোখের কোণা ভিজে এলো। ক্ষীণ স্বরে বলল
-মা, ফারিহার বিয়ে
-হ্যাঁ তো বিয়ে তো হতেই পারে।
-ও বিয়ে করে নেবে মা? ও পরের বাড়ি চলে যাবে
-তো বিয়ে করলে তো পরের বাড়ি যাবেই। আর এসব দিয়ে তোর কি। তুই নিজেও তো চাইতিস ওর বিয়ে হয়ে দূরে চলে যাক
সাদমান অনেক্ষণ চুপ করে থাকল। অবশেষে চোখ টিপে বন্ধ করে বলল
-আমি চেয়েছি ও দূরে চলে যাক,কারো সাথে বিয়ে হয়ে যাক। কিন্তু আমি চাইনা ওর বিয়ে হোক
-কি যা তা বলছিস। জ্বরে পরে কি মাথার তার ছিড়েছে?মেয়েটাকে তো দূর ছাই করতিস
-দূর ছাই করতাম কারণ আমি ওকে ভালোবাসি
অপরপক্ষ থেকে উত্তর এলো নাহ।সাদমান অপেক্ষাও করল না উত্তরের। নিজে থেকেই বলতে শুরু করল
-আমি ওকে খুব ভালোবাসি মা, আর ভালোবাসি বলেই দূরে সরিয়ে রেখেছি। কারণ আমি চাইনি আমার মতো গরীব, বেকার ছেলের সাথে জুড়ে ওর জীবনটা নষ্ট হোক। ওর বাবা ওকে যতটা বিলাসিতা, আভিযাত্য দিয়ে বড় করেছে আমি তা কখনও দিতে পারব নাহ। ও আমার মতো দুপয়সার ছেলেকে না অনেক বড় ঘরের ছেলেকে ডিজার্ব করে। আমি তো নিজেই ওর বোনকে টিউশনি করিয়ে টাকা পাই,সেখানে আমার মতো ছোটলোক কি ওরে পাওয়ার যোগ্যতা রাখে
কথাগুলো শেষ হতে যতটুকু দেরি, সপাটে ঠাস করে একটা শব্দ হলো। বা গালের উপর জোরে একটা তামাশা পরতেই হকচকিয়ে উঠল সাদমান। চোখের হালকা ঝাপসা দৃষ্টি এক লহমায় ঝকঝকে হয়ে গেল
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ
#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ৬০
কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে জীর্ণ শীর্ণ অবস্থা। বিছানার সাথে পাতলা শরীর টা যেন লেপ্টে আছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলার ফোস ফোস শব্দ ছাড়া শুধুমাত্র ঘড়ির টিকটিক শব্দটাই কর্ণগোচরে পৌঁছানোর মতো।
ঘুমের রেশ কাটার সাথে সাথে নেত্রপল্লবের মৃদু কম্পন দৃশ্যমান। ঘমটা হালকা হতেই আস্তে আস্তে ক্লান্ত চোখ খুলে তাকাল তুরা। মাথাটা প্রচন্ড ভারি লাগছে, সারা শরীরে ব্যথার উপস্থিতি টের পাচ্ছে খুব কড়াভাবে। হালকা ঝাপসা চাহনি খুলল বেশ আস্তেধীরে। প্রশস্ত চাহনিতে তাকালে নিজের একদম সামনেই আহানকে দেখতে পেল। চেয়ারে বসে মাথা এলিয়ে পড়ে আছে। ঘুমাচ্ছে কিনা স্পষ্ট বুঝতে পারল না তুরা। ভ্রু যুগল আপনা আপনি কুচকে এলো। কনুইয়ে ভর করে উঠতে গেলেই বা হাতে তীক্ষ্ণ যন্ত্রণাভূত হতেই চোখ মুখ খিঁচিয়ে কিঞ্চিৎ আর্তনাদ করে উঠল।
তুরার অস্পষ্ট শব্দে আহানের সবেমাত্র লেগে আসা চোখ খুলে যেতেই তুরাকে আধশোয়া অবস্থায় দেখে তড়িৎ ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে আগলে ধরে বলল
-লেগেছে তুরা? তুমি উঠতে কেন গেলে। স্যালাইন চলছে তো।
-আ আমার কি হয়েছে? এটা কেন লাগিয়েছেন আমার হাতে?
আধো আধো গলায় বলল তুরা, আহান একহাতে খুব সাবধানে তুরাকে শুইয়ে দিয়ে পাশে বসে বলল
-কিছু লাগবে তোমার?
মাথা নাড়িয়ে না বলল তুরা, ছলছল চোখে আহানের দিকে তাকিয়ে আবারও বলল
-এটা কেন লাগিয়েছেন বলুন না, খুলে দিন আমার ব্যথা করছে
ভীষণ ক্লান্ত গলায় বলল তুরা, কথার সাথে কণ্ঠনালী কেঁপে উঠল। কয়েকদিন ধরেই অসুস্থতার দরুন আগে থেকেই শরীর ভীষণ দূর্বল ছিল। আর কাল রাতের মধ্যে আরও কয়েক ধাপ মিইয়ে গেছে যেন।
তুরা নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলেও আহান প্রত্যুত্তর করল না। খুব যত্নসহকারে তুরার হাতের নিচে একটা বালিশ রেখে বলল
-নড়াচড়া করবে না, এটা কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।
-এক্ষুনি খুলে দিন। আমার লাগছে,এটা রাখব না আমি
আহান লাল হয়ে আসা ক্লান্ত চোখে তাকাল তুরার দিকে। বেশ খানিক সময় নিয়ে তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল
-আর একটু পরেই খুলে দিচ্ছি
তুরার অভিমান হলো, কিঞ্চিৎ ভয় কাজ করল অন্তস্থলে। ওর হাতে সেলাইন কেন লাগিয়েছে? কি হলো ওর? বেশ অনেক দিন ধরেই শরীরটা তার খারাপ, কাল রাতে হুট করে ঘুমের মাঝেই গা গুলিয়ে উঠল, ঘুম ভেঙে ছুটে ওয়াশরুমে ঢুকতেই গড়গড় করে বমি করে ফেলল। আহান টের পেলে এগিয়ে এসে ওকে ধরে ঘরে আনলে মাথাটা ঘুরিয়ে উঠল, সারা শরীরে কেমন কাঁপন ধরেছিল। পরপর তিনবার বমি করে শরীরের সমস্ত শক্তিটুকুও যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে, গা এলিয়ে পড়ে যেতে নিলে আহান ওকে বসিয়ে রুবিকে ডাকতে গেলে তুরার আবারও মুখ ভরে বমি আসে, কোনো মতে শরীর টাকে এগিয়ে ওয়াশরুম পর্যন্ত নিলেও বিছানা অব্দি ফিরতে পারেনি,,মাথাটা কেমন ঝিম ধরে সারা শরীর অবশ করে দিল।
এরপর আর কিছুই মনে পরছে না তুরার, ঘুম ভেঙেই নিজেকে বিছানাতে হাতে স্যালাইনের সুচ বিদ্ধ অবস্থায় পেল। আহানের চোখ মুখ শুকিয়ে আছে, ও কিছু বলছে না কেন? কি হয়েছে তুরার? অযাচিত ভয়ে ভেতরটা গুমরে আসলেই বুদ্ধিহীনের মতো বলল
-আপনি কথা বলছেন না কেন? কি হয়েছে আমার! আমার কি কঠিন কোনো অসুখ করেছে? আমি কি মরে যাব? বলুন নাহ,চুপ করে আছেন কেন?
তুরার ক্লান্ত গলাটাও যেন বেশ জোরালো শোনালো আহানের কানে। কিন্তু ওর এ প্রশ্নের উত্তর কি দেবে ওর মাথায় আসছে নাহ। বিভ্রান্তের মতো স্থির দাঁড়িয়ে রইল খানিক, কোনো উত্তর না দিয়েই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল গটগট করে । তুরা আহানের যাওয়ার পানে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল।বুক ফেটে কান্না আসছে হাজারো বেহিসাবি চিন্তা মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে অনিচ্ছা সত্ত্বেও, ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠল খুব!
……………..
তীব্র জ্বরের তোপে লাল হয়ে আসা চোখ মুখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে সাদমান। বার কয়েক পলক ঝাপটাল,কিন্তু সামনের দৃশ্যের কোনো পরিবর্তন নেই, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সাদমান ওর সামনে বসে থাকা ফারিহাকে। কিন্তু ও এখানে? কিভাবে? এত সকালে ও কি করে এলো? আর সে নিজেও বা এখানে কি করে এলো। কিছুই বুঝতে পারছে না, পুরো মাথা টা গুলিয়ে জগাখিচুরি হয়ে গেছে।
ফারিহা কোনো নড়চড় হীনা স্থির তাকিয়ে আছে সাদমানের দিকে, বিব্রতকর চেহারায় নিজের গালে হাত রাখল সাদমান। বা পাশের গালটা এখনও জ্বলছে। তার মানে থাপ্পড় টা সত্যিই খেয়েছে, স্বপ্ন নয়। আগামাথা কিছু বুঝত্র না পেরে সাদমান গলা উচিয়ে চেঁচিয়ে বলল
-মা,আমার ঘরে আসো, ভয় করছে আমার
সাদমানের কথা শেষ হতে যতটুকু দেরি, ফারিহা ঝড়ের বেগে উঠে এসে পাশ থেকে একটা খাতা তুকে ধুপধাপ কয়েকটা পিঠের উপর বসিয়ে ঝাঝালো গলায় বলল
-আরেকবার ম্যা ম্যা করবি তো ছাগলের সাথে বেঁধে রেখে ঘাস খাওয়াব তোরে। সা লা অকম্মা, খাইসটার বংশধর
-সকাল বেলা করে এসে রিলিফের মালের মতো কয়েক ঘা বসায় দিলি,আমার আমার গুষ্টি তুলে যা তা বলছিস।
এক হাত দিয়ে গা ডলতে ডলতে মুখ খানা ফুলিয়ে ফুসকা বানিয়ে বলল সাদমান। আরও কিছু বলতে গেলেও ফারিহার অগ্নিশর্মা চোখ দেখে কিছু বলার সাহস করল নাহ।
-রাত করে সিড়ির উপর চিত হয়েছিলি কেন? ম’রে পরে থাকতে ইচ্ছে করেছিল?
খাটের এক কোণায় পরে থাকা ভেজা জলপট্টি দেওয়া কাপড় টা তুলতে তুলতে বলল ফারিহা। সাদমান গম্ভীরমুখে বলল
-সেটা আমার ব্যাপার, তোকে ভাবতে হবে নাহ। তুই সাত সকাল করে আমার বাড়িতে আমার ঘরে কেন এসেছিস। তোর নাকি বিয়ে?
-হ্যাঁ তো বিয়ে হবে বলে কি আমি বাড়ি থেকে বেরোতে পারব না?
ফারিহার দায়সারা উত্তরে সাদমানের ভীষণ রাগ হলো। সে তো আশা করেছিল ফারিহা হয়তো বলবে এ খবর মিথ্যে,কোনো বিয়ে ঠিক হয়নি তার। সাদমানের রুষ্ঠতা আরও বাড়িয়ে দিয়ে ফারিহা ওর হাতটা সামনে ধরে বলল
-এই দেখ আমার এঙ্গেজমেন্টের রিং, সুন্দর নাহ?
-বাড়ি যা তোর রবিন ভাই তো দেখলে উল্টা পালটা ভাববে তাই না? বর হতে চলেছে
খোঁচা দেওয়ার মত করে বলল সাদমান। ফারিহা সেদিকে ধ্যান না দিয়ে বলল
-হ্যাঁ তাও ঠিক, কিন্তু যতই হোক তুই তো বন্ধু। বিয়ে করব অথচ তোকে দাওয়াত দেব না তা তো হতে পারেনা। তাই তোকে বলতে এসেছিলাম। কিন্তু এসে দেখি তুই ঘুমের ঘোরে কিসব আবল তাবল বকছিস তাই তো ধ্যান ভাঙাতে কানের নিচে গরম বাতাস করলাম।
সাদমানের মেজাজ তড়তড় করে বেড়ে উঠল। ধপ করে বিছানা থেকে নেমে চোখ মুছে চশমা টা চোখে পরে বলল
-বলা শেষ? এবার আসতে পারিস
-আজব তো! তুই এভাবে বলছিস কেন। আমি আসব কি যাব তোর কি তাতে। আসলে আমারই দোষ আন্টি যখন বলল রাতে জ্বরে মাথা ঘুরে সিড়িতে পরেছিলি তখন দয়া হয়েছিল বলেই দেখতে এসেছিলাম। কিন্তু তুই তার যোগ্যই না
-হ্যাঁ তাই তো। আমি কেন যোগ্য হবো যত যোগ্যমান যোগ্যধারী তো তোর ওই ছ্যাছড়া রবিন তাই তো?
-দেখ কথা তোর আর আমার মাঝে হচ্ছে। এসবে উনাকে আনবি না বলে দিলাম।
-কেন খুব লাগছে? দরদ উতলে পরছে তাই না? কি করেছে ও যে এত পেয়ার মহব্বত উতলে আসছে তোর! বলব আমি একশ বার বলব।
-তোর সাথে কথা বলাটাই ভুল হয়েছে আমার। তুই আসলেই জঘন্য ফালতু একটা ছেলে। থাক,আমি যাচ্ছি। তোর সামনে থাকার নূন্যতম ইচ্ছে আমার নেই
বলেই সাদমান কে পাশ কাটিয়ে যেতে লাগল ফারিহা। সাদমানের মাথায় যেন রক্ত চড়ে গেল এবার। কাল ওদের দুজনকে একসাথে দেখার পর থেকে মাথা গরম হয়ে আছে ওর। তার উপর ওই রবিন নামের ছেলেটার নাম ফারিহার মুখে শুনে গা পিত্তি জ্বলে উঠছে সাদমানের। হুট করে পেছন থেকে ফারিহার হাত চেপে ধরে এক টানে নিজের সামনে দাঁড় করাল, হিসহিসিয়ে বলল
-কোথায় যাচ্ছিস, ওই রবিনের কাছে যাচ্ছিস তাই তো?
-আমার হাত ছাড় সাদমান
-ছাড়ব না,কাল তো ঠিকই ওই ছেলের সাথে চিপকে যাচ্ছিলি। আজ আমি ধরেছি তো কি ফোস্কা পরে যাচ্ছে?
-ও ধরতেই পারে, কারণ ও আমার..
-আর আমি? আমি কে তাইলে?
ফারিহাকে সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই বলল সাদমান। এ পর্যায়ে এসে ফারিহা এক ঝটকায় ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল
-তোর সাহস কি করে হলো আমার সাথে এভাবে কথা বলার, তুই কে? কেন এমন বিহেভিয়ার করছিস তুই।
-আমি সাদমান, আমি তোকে ভালোবাসি, আর তোর সাথে অন্য কাওকে আমি সহ্য করব নাহ। তাই এমন করছি
চেঁচিয়ে উঠে বলল সাদমান। ফারিহা মুহুর্তেই স্থির হয়ে গেলো। অপলক তাকিয়ে রইল সাদমানের রাগান্বিত টকটকে চেহারার দিকে। ও কি ঠিক শুনল? এটা সাদমান বলল? সত্যিই বলল! মাথা গুলিয়ে গেল ফারিহার। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে পা পিছিয়ে নিতে লাগলে সাদমান আবারও এগিয়ে এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলল
-শুনতে পেয়েছিস এবার? আই লাভ ইউ। আর ওই রবিনকে আমি তোর ছায়াও পারাতে দেব নাহ বিয়ে তো দূর, ওকে বলে দিবি এখান থেকে চলে যেতে না তো..
সামনে আর বলতে পারল না সাদমান। তার আগেই ফারিহা চলে গেছে। সাদমানের মুখ থেকে প্রথম দুটো বাক্য শোনার সাথে সাথেই এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। সাদমান কয়েক মুহূর্ত হতভম্বিত হয়ে তাকিয়ে ওর পিছু নিতে গেলেও পারল নাহ। ততক্ষণে ও গাড়িতে উঠে চলে গেছে অনেক খানি দূরে। সাদমানের নিজেকে কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। কি হলো এটা? হুট করেই কিভাবে ও ফারিহাকে কিসব বলল। কিভাবে বলল? কিন্তু পরমুহূর্তেই রবিনের সাথে ফারিহার এঙ্গেরজমেন্টের কথা মনে পরতেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো৷ আর যাই হোক বলে যখন দিয়েছেই ফারিহাকে ও ছাড়বে নাহ আর। যাই হয়ে যাক ওই রবিন কেন অন্য কোনো ছেলের সাথেই ফারিহাকে ও সহ্য করবে না!
…………..
একটা মেয়ে যখন বুঝতে পারে তার গর্ভে আরও একটি প্রাণ বেড়ে উঠছে, তখন এর থেকে সুখকর কিছু আর দুনিয়াতে আছে বলে মনে হয়না! একটি জীবন, ছোট্ট শরীর আষ্টেপৃষ্টে মিশে আছে তার গর্ভে অবিচ্ছেদ্য অংশের মতো। এই অনুভূতিতা কতটা প্রখর আর পবিত্র তা একজন মা ই বুঝতে পারে যখন তার গর্ভে লালিত হয় ছোট্ট একটা জীবন
তুরা কিরকম অভিব্যক্তি করবে সেটা নিজেও বুঝতে পারছে না। খবরটা শোনার পর থেকে থ মেরে আছে। আনন্দানুভূতি, আবেগ,পুলকে আপ্লূত হয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে। কাঁপা কাঁপা হাতটা নিজের পেটের উপর রাখল। যেন ছোট্ট শরীরের একটা অস্তিত্ব খুব গাঢ় ভাবে উপলব্ধি করতে পারল তুরা, চোখ মুদে এলেই কোণা বেয়ে গরম জল গড়িয়ে পরল। ওর গর্ভে যে আহানেরই একটা অংশ বেড়ে উঠছে! এটা ভাবতেও কি প্রতিক্রিয়া দেওয়া উচিত তুরা বুঝে উঠতে পারছে না। একটা মেয়ের কাছে মা হওয়ার চেয়ে বড় প্রাপ্তি, উপহার আর কি হতে পারে!
আজ সকালেই আহান যখন তুরাকে ঘরে রেখে বেরিয়ে গেল তখন ওর ভীষণ কষ্ট লেগেছিল। অজানা ভয় আশংকায় ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠছিল। খানিক বাদেই রাইমা এসেছিল ওর ঘরে, একে একে রুবি, আমেনা ও এলো। সকলের আচরণ হতভম্ব তুরার ঘোর ভাংলো যখন রাইমা ওর প্রাণোচ্ছল কণ্ঠে বলল
-এবার আমার ঘাপুসের সাথে তোরও তো একটা ঘুপুস আসছে রে তুরা। এ বাড়ির প্রথম সন্তান। আমার আরও একটা পিচ্চি আসছে। এত খুশি কোথায় রাখব বল তো?
এ কথা টা শোনার পর তুরা ঠিক কতখানি সময় বাকরুদ্ধ হয়ে ছিল ওর ও জানা নেই। তবে ওর এই হতবিহবলতাকে সবাই স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে। বরং তারা তো আনন্দ উল্লাসে মত্ত। ইনসাফ উচ্ছ্বসিত হয়ে আর গাড়ি ভরে মিষ্টি এনেছে, মাহিদ, তহমিনা ও এসেছিল। সকলের সামনে অদ্ভুত একটা জড়তা আড়ষ্টতা জাপটে ধরেছিল তুরাকে। ও কল্পনাও করেনি এমন কিছু। বেশ কয়েকদিন ধরেই ওর শরীরের কন্ডিশন ভালো ছিল না।ঘন ঘন জ্বর আসতো, ঠিক মতো খেতে পারত নাহ,রাতে ঘুম হত না বারবার গা গুলিয়ে আসতো। কিন্তু এগুলোকে স্বাভাবিক অসুস্থতা ভেবে আমলে নেয়নি তুরা।
কিন্তু আজ ওর সমস্ত ঘোর কেটে গেল, নিজে কিসব উদ্ভট কথা ভেবেছিল সেসব ভাবতেই হাসি পেল।
সকলে মিলে প্রাণভরে দোয়া করেছে তুরাকে, রাইমা তো খুশিতে বাক-বাকুম। কিন্তু এত সবের মাঝেও তুরা নির্বিকার কারণ আহান সেই সকালে বেড়িয়েছে এখনো ফেরেছি। আর তুরা সকালে ওতবার জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও আহান উত্তর দেয়নি,কেন? তাহলে কি আহান খুশি না? ও চাই না এই বাচ্চাটাকে? আহানের সকালের ব্যবহার তুরা সারাদিনে কিছুতেই ভুলতে পারল নাহ।
ঘড়িতে এগারোটা বেজে গেছে, একটু আগেই রাইমা আর রুবি গেল ঘর থেকে। সারাটা দিন তুরার সাথে সাথেই ছিল সকলে। কিন্তু এখন এই ঘরে তুরার বুক ফাটিয়ে কান্না আসছে। আহান কি তবে খুশি হয়নি?
বেশ অনেকটা সময় অতিবাহিত হলে দরজার নব মোচড়ানোর শব্দে সজাগ হলো তুরা, এতক্ষনেও ঘুমাইনি, বিছানায় গা এলিয়ে পরে আছে চুপচাপ।
পায়ের শব্দটা আস্তে আস্তে কাছাকাছি এলেও চোখ খুলে তাকাল না তুরা। হুট করেই ভারি একটা শরীর আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল তুরাকে, চোখ খুলে তাকাতেই আহানকে নিজের খুব কাছে আবিষ্কার করলো। আহানের হাতের চাপ আরও গাঢ় হলো ক্রমশই। সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরল তুরাকে, গলায় মুখ গুঁজে দিয়ে বেসামাল ভাবে নিঃশ্বাস ছাড়ছে। তুরার দম বন্ধ হয়ে আসলেও কোনো শব্দ করল নাহ
আহান আস্তে আস্তে আরও গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরল তুরাকে,প্রচন্ড শক্ত বাহুবন্ধনীতে আবদ্ধ হয়ে ওর পিষে যাওয়ার জো। আহান নিজের ঠোঁট দুটো গাঢ়ভাবে চেপে ধরলো তুরার গলায় কাঁধে। জড়ানো কণ্ঠে বলল
-তুরা, তুরা আমাদের একটা বাবু হবে, ছোট্ট একটা শরীর আসবে, এই যে এইখানে, এইখানে আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠবে ও
বলে তুরার পেটের উপর হাত রেখে বলল
-এখানে একটা বাবু আছে তুরা, তোমার আর আমার, আমাদের বাচ্চা। আমাদের মাঝে আরও একটা ছোট্ট প্রাণ আসছে তুরা। আমি কিভাবে সামলাবো, কিভাবে বলব কি চলছে আমার ভেতরে! অগোছালো অনুভূতি গুলোর জন্যে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি
অভিমানের পাল্লা তড়তড় করে বেড়ে উঠল তুরার, এতক্ষণ কোথায় ছিল লোকটা, সারাদিনেও আসল না!
-সরে যান,ছাড়ুন আমাকে। এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? আমার কাছে আসতে মন চাইনি? এখনও চলে যান আপনি
আহান কানে নিল না তুরার কথা।বরং ওর গলায়, ঘাড়ে অসংখ্য চুমু দিয়ে ভরিয়ে দিল। গভীর আবেশে উষ্ণ হয়ে আসল তুরার শরীর। আহান ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে তুরার মুখের কাছে মুখ এনে ওর গলায় কপালে থুতনিতে আবারও কয়েকবার ঠোঁট ছোঁয়ালো। সম্মোহনী গলায় বলল
-সকালে ডক্টর যখন তোমায় চেকাপ করে বলল তুমি প্রেগন্যান্ট তখন আমি ঠিক কত বড় শক খেয়েছি বোঝাতেও পারব না। ঠিক কি বলব কিরকম অভিব্যক্তি করব আমি বুঝছিলাম নাহ। সকালে তুমি যখন বারবার আমাকে প্রশ্ন করছিলে ততবার আমার বুকের মাঝে ঝড় উঠছিল। কিছুতেই মুখ ভেদ করে কিছু বলতে পারছিলাম নাহ। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আমি বাবা হবো তুরা, ছোট্ট একটা বাবু আমাকে আধো আধো বুলিতে বাবা ডাকবে,আমার কোলে উঠবে। তোমার আর আমার ভালোবাসার চিহ্ন দুহাতের অস্তিত্বে আসবে। আমি কিছুতেই সামলাতে পারছিনা নিজেকে তুরা,এত সুখ এই অনুভব আমি কি করে সামলাবো বলোনা
শরীর জুড়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো তুরার, গলার কাছে উষ্ণ পানির অস্তিত্ব অনুভব করল।তবে কি আহান কাঁদছে?
তুরা নিজের প্রবল আবেগে উন্মাদ হয়ে জড়িয়ে ধরলো আহানকে। এতক্ষণের সুপ্ত আবেগ সম্বেদন আহানের হৃদয়স্পর্শী বাক্যে আরও উতলে পরলো। দু’হাতে আহানকে বুকের মাঝে ঝাপটে ধরে কয়েকবার ঠোঁট ছোঁয়ালো। আনন্দ, সুখে চরমভাবে বেশামাল হয়ে কান্নামিশ্রিত গলায় বলল
-ভালোবাসি মাস্টার মশাই, আপনার মত ব’জ্জাত গোমড়ামুখো লোকটাকে অসম্ভব ভালোবাসি আমি।
হেসে ফেলল আহান। তুরার ঠোঁটে গভীর একটা চুম্বন এঁকে আবারও বুকের মধ্যে মিশে রইলো। অদ্ভুত সম্মোহনী ভালো লাগা কাজ করছে দুজনের মাঝে, ক্রমেই আরও শীতল হয়ে উঠছে দুজনের বন্ধন, দুজন মানুষ তাদের ভালোবাসার প্রণয়ের সিক্ত অনুভূতির বেড়াজালে জর্জরিত হয়ে মিশে গেল।
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ
#Humu_❤️