#তুমি_আসবে_বলে
#হুমাইরা_হাসান
পর্বঃ ২৩ (বোনাস)
ব্যস্ত নগরীর গাড়ি যানবাহন পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলেছে, গ্রীষ্ম কালের তপ্তটা একটু হেলে বৈরী হাওয়ায় আগাম যানাচ্ছে বর্ষার বারিধারাকে। আকাশ টা মেঘলা নয়,তবে পরিষ্কার ও নয়। সন্ধ্যা পার হয়ে টিমটিমে তারায় সজ্জিত হয়েছে আকাশের বুক।
দ্রুত পায়ে হাটার দরুন পাতলা গোলাপি রঙের ওড়না টা বাতাসের ধাক্কায় উড়াউড়ি করছে, চুলগুলো ছড়িয়ে পরছে কপাল আর মুখে।হাতে ব্যাগ নিয়ে হাটছি স্টেশনের রাস্তা ধরে। সামনেই আরশি আর শিমু হাটছে।
-দৌড়া আফু,না তো ট্রেন মিস করবো।
-আরে ট্রেন তো সাড়ে সাতটার,সবে মাত্র সাতটা বাজে, এখনি কেনো মিস করবি আজব
আমার কথায় রাফাত বোকা হেসে মাথা চুলকে বললো
-ওই একটু এক্সাইটমেন্ট আরকি
-হ ভাই,দেইখা চলা ফেরা করিস,তোর এক্সাইটমেন্ট এর ঠেলায় ট্রেনের জানালা দিয়ে ঝা’প দিস না আবার
-দেখ, আপদ। তুই আর তোর আপদ মার্কা কথা বার্তা দুইডাই সাইডে থাক,এমন শুভ যাত্রায় তোর মতো আজাইরার মুখ দেখবার চাইনাহ।
-তোর মুখ দেখার জন্যেও আমি টিকিট কেটে বসে নেই, চুপ মার।। আমি তো নিজের চিন্তায় আছি। আরাব ভাই তো এখনও এলো নাহ।
পানির বোতল খুলে এক ঢক পানি গিলে, নিবিড় মুখ টা বাকিয়ে বললো
-আবে আরাব খোর,তোর আরাব ভাই এসে যাবে ডোন্ট ওয়ারি
-এসে গেছে। সাইডে দেখ
আমার কথায় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সবাই
আরাব ভাই আর ধ্রুব ভাই দুজন একসাথে গল্প করতে করতে আসছে, সেদিন সারা রাত আড্ডা দিয়ে সবার মাঝের বন্ডিং টা বেশ জমেছে। আরাব,ধ্রুব আর উনি সবার বেশ খাতির হয়েছে, তাই আরাব ভাইকেও আমরা জোর করেছি আমাদের সাথে যেতে,যদিও আমরা শুধু বলেছি জোর তো করেছে আরশি।
মাঝখানে দুদিন সময় ছিলো সব প্রিপারেশন গোছগাছ করার জন্য।বাড়ির সকলেই অনুমতি নিয়ে সিলেটের উদ্দেশ্য বেরিয়েছি আজ, রুচি আপুকেও সাতগে আনার খুব ইচ্ছে ছিলো,কিন্তু মিষ্টির শরীর টা হুট করেই খারাপ করেছে,সিজন চেইঞ্জের দরুন ঠান্ডা আর জ্বরে পরেছে বাচ্চাটা,তাই আপু আর আসার নাম করেনি।
আজ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আমাদের ট্রেন। রাফাত আর আদ্রিশের জালায় আমরা আধ ঘন্টা আগেই এসে বসে আছি তাও নাকি ওরা ট্রেন মিস করবে।
হালকা ওলিভ রঙের টি-শার্টে ফর্সা গায়ের আরাব ভাইকে বেশ মানিয়েছে, লোকটা দারুন ফর্সা,শরীরের গঠন ও বেশ সুষ্ঠু। এক কথায় প্রথম দেখায় তাকে সুদর্শন পুরুষের তালিকায় প্রথম সারিতে রাখা যায়। পাশেই ধ্রুব ভাই ফোন কানে কথা বলছেন, উজ্জ্বল শ্যামলা গড়নে মাথার ঝাকড়া চুল আর বড়ো বড়ো আখিযুগলে তাকেও মন্দ লাগে নাহ। বেশ মায়া কাড়া চেহারা। আরাব ভাইকে দেখে তো আরশি টাসকি খেয়ে চিত হয়ে আছে সে জানি কিন্তু, শিমুর ওভাবে ধ্রুব ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকা দেখে বেশ অবাক হলাম। কেমন অপলক চেয়ে আছে। আমি ধীরে ধীরে ওর পাশে গিয়ে দাড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম
-কি রে বলদি, তু ভি গায়ি?
আমার কথায় হকচকিয়ে উঠে বললো
-কে গায়ি,কাহা গায়ি?
এই বলদের মতো ভুলভাল বকা দেখলে আমার মন চাই এক লাত্থি দিয়ে উগান্ডায় পাঠায়। নাক কুচকে খুব বিশ্রী কিছু বলতে নেবো তখনই আদ্রিশ বললো।
-মেঘ ভাই কই,এখনো আসলো নাহ যে
-এসে পরবে,ওর সাথেই কথা বলছিলাম একটু কাজে আটকা পরেছিলো।
কালো রঙের টি-শার্ট আর জিন্স পরিহিত লোকটার কথার উত্তরে রাফাত বললো
-আরে ধ্রুব ভাই,তোমার বন্ধু কি সবসময়ই এমন সিরিয়াস মুডে থাকে,আগে পড়াশোনা আর এখন কাজ।এসব বাদে ওর মাথায় কিছুই আসেনাহ,বিয়ের দিন ও বলবে আমার প্রজেক্ট টা কমপ্লিট করে নেই তারপর কবুল বলছি।
রাফাতের কথায় ধ্রুব ভাই সহ সকলে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। তখনি হুইসিল বাজিয়ে মাটি কাপিয়ে আগমন ঘটলো ট্রেন টির। এই সময় ট্রেন যাত্রি নামাতে যতটুকু সময় নেয়,তার বেশিক্ষণ দাঁড়াবে নাহ,তাই ট্রেন থামতেই উঠে পরতে হবে।
ট্রেন টা লোহার পাতে ঘর্ষণ করে বিকট ভাবে ক্যাচ শব্দে থামলো।
-নিবিড় শিগগির উঠে পর
বলেই এগিয়ে গেলো রাফাত,একে একে উঠতে লাগলো সবাই। কিন্তু আমার দৃষ্টি স্টেশনের ফটকের দিকে। লোকটা এখনও আসলো নাহ? কি কাজ আছে বলে দুপুরে বেরিয়েছিলো সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলো,ট্রেন ও তো এসে গেলো উনি বলেছিলেন সময় মতো পৌঁছে যাবেন কিন্তু এখনো আসলো নাহ?
শিমু, আরশি,নিবিড়, আদ্রিশ একে একে সবাই উঠে গেছে। আমার সেদিকে খেয়াল নেই। ট্রেন টা আবারও হুইসিল দিয়ে জানান দিলো মুহূর্তেই আবার গতিশীল হতে যাচ্ছে, আমি এখনো নির্লিপ্ত দাঁড়িয়ে, কেমন বিষাদে ভরে গেলো মনটা।তাহলে কি উনি আসবেন নাহ?
মানুষের প্রতিযোগিতা লেগে গেলো ভীড় ঠেলে ট্রেনে উঠার জন্য। আমার ভাবনার মাঝেই হঠাৎ এক যাত্রির ট্রেনে উঠার পারাপারিতে ধাক্কা দিয়ে গেলো, মুখ থুবড়ে পরতে নিলেই শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো কেও!
আদ্রিশ পালককেই সাহায্য করতে এগিয়ে আসছিলো,কিন্তু ওকে আঁকড়ে ধরা মানুষ টাকে দেখে আর আগালো নাহ,মুচকি হেসে চলে গেলো।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি এখনো ভীত হয়ে আছি, ট্রেনে উঠার অভিজ্ঞতা আমার খুব কম দেখলেই ভয় লাগে। ভয়ে আঁতকে আছি এখানো। হাতের বন্ধন টা আরও দৃঢ় হলো। চোখ মেলে তাকানোর আগেই কেও কোমর আকঁরে ধরে এক ঝটকায় উঠিয়ে দিলো ট্রেনে।
নেত্রপল্লব খুলতেই সামনে আসলো অতিমাত্রায় সুদর্শন চেহারা টা।। সাদা রঙের টি-শার্ট এর উপরে হালকা নীল আর ধুসর বর্ণের মিশ্রনের একটা চেক শার্ট পরনে।পায়ে সাদা কেটস আর গলায় ঝুলানো কালো রঙের সানগ্লাস। আমি এখনো ভ্যাবলাকান্তের মতো তাকিয়ে, মেঘালয় ও ঝটপট উঠে পরলো ট্রেনে। নিমিষেই আবারও শুরু হলো বুকের ভেতরের কাঁপুনি।
-এখানেই দাঁড়িয়ে থাকার ইচ্ছে আছে? করলে বলো ধা’ক্কা দিয়ে ফে’লে দেবো।
মেঘের কথায় হুস ফিরলো। লোকটা সবসময়ই হুমকি ধমকি দিতেই থাকে,জীবনে মুখ থেকে ভালো কথা বেরোবে নাহ। উনার কথায় ভ্রুকুটি করে বড়ো বড়ো পা ফেলে এগোতে লাগলাম আগে আগে। কিন্তু তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো নাহ। হাজারো মানুষের ভীড়ে পা ফেলা দায় হয়ে গেছে। মানুষের ঠেলাঠেলি ধাক্কায় পি’ষে যাচ্ছি যেনো। এই জন্য আমার লোকাল ট্রেন পছন্দ নাহ একদম।কিন্তু কি করবো কতগুলো অ’মানুষের সাথে থাকি,তাদের শখ করেছে এমন ট্রেনেই চড়বে। এতে নাকি বেশি ইঞ্জয় করা যায়।
নিজের গায়ে অন্য মানুষের ধাক্কায় ভীষণ বাজে লাগছে, আশেপাশের মানুষ যেনো গায়ের সাথে চিপকে যাচ্ছে। ট্রেন চলতে শুরু করেছে,ঝাকুনিতে বারবার বেসামাল হয়ে যাচ্ছি।
হঠাৎ পেছন থেকে কেও এক হাতে কোমড় আঁকড়ে নিজের কাছে টেনে নিলো। লোকটা গম্ভীর মুখ করে বললো
-সব জাগায় বেশি পাকনামি করতে গেলে তুলে আছা’ড় দেবো,
বলেই এক হাতে আমার কোমর আঁকড়ে ধরে আরেক হাতে ভীড় ঠেলে দ্রুত এসে গেলাম নিজেদের কেবিনে। সবাই সিটে বসে পরেছে। আমি কোমর থেকে উনার হাত সরাতে নিলেও আরও শক্ত করে চেপে ধরলো। সবাই দেখেও না দেখার ভান করে অন্যদিকে চেয়ে রইলো। সকলের মুখেই মিটিমিটি হাসি স্পষ্ট, লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে আমার,লোকটা সবার সামনেও এমন বেহায়াপনা করবেন ভাবতেও পারিনি আমি। মেঘালয়ের হাত আলগা হতেই আমি ছিটকে সরে গেলাম।
কিন্তু ওমাহ,গিয়ে দেখি সবাই যার যার মতো বসে পরেছে। সামনা সামনি বসা সিটে ওরা পাচজন আর আরাব ভাই বসেছে,বাকি তিনটা সিট পরেছে বাম পাশের দিকে, যার একটাই ধ্রুব ভাই বসেছে। বাকি রইলো পাশাপাশি দুটো সিট। আর অবশিষ্ট আছি আমি আর মেঘালয়। তার মানে আমাকে উনার সাথে বসতে হবে? অসম্ভব!
-তোরা সবাই তো বসে পরলি আগে আগে, এখন আমি কোথায় বসবো।
-কেনো তুই মেঘ ভাইয়ের সাথে বস
রাফাতের কথার বিরোধিতা করে বললাম
-অসম্ভব উনার সাথে আমি কিছুতেই বসবো নাহ,
-তাহলে দাঁড়িয়েই থাক। কারণ আর সিট নেই। আর আমরাও এখান থেকে এক চুল নড়তে পারছি নাহ।
-তোরা সবগুলো বেইমান,ইতর প্রজাতির। এমন করবি জানলে কখনোই আসতাম না তোদের সাথে
-এখন এসেই যখন পরেছিস, কি আর করার চুপচাপ গিয়ে বসে পর৷ নাতো ট্রেনের ঝাকিতে পুতুলের মতো শরীর নিয়ে জানালা দিয়ে উড়েও যেতে পারিস
আদ্রিশের কথায়,মুখ কুচকে,গটগট করে চলে আসলাম।কিন্তু চলে তো আসলাম বসবো কোথায়, আড়চোখে তাকাতে দেখি বেহায়া লোকটা জানালার পাশের সিট ফাঁকা রেখে এপাশের টায় বসে আরামে কানে হেডফোন লাগিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে, যেনো এদিকের কোনো ধ্যান ই নেই। বার কয়েক মুখ ভেংচি দিয়ে ধীরে ধীরে পাশে গিয়ে দাড়ালাম। আজব লোকটা তাকাচ্ছে পর্যন্ত নাহ,উনি না বেরোলে আমি বসবো কি করে। পাশে গিয়ে বললাম
-আমি বসবো
আমার কথায় ও কোনো হেলদোল নেই লোকটার,আপন মনে ফোন টিপেই যাচ্ছে,এবার বেশ জোরেই বললাম
-আমি বসবো,শুনতে পাচ্ছেন নাহ
কান থেকে হেডফোন সরিয়ে আমার দিকে চেয়ে বললো
-হ্যাঁ পাচ্ছি তো।
-তাহলে এমন সং হয়ে বসে আছেন কেনো,না বেরলে আমি ঢুকবো কি করে
-ওহহ বসবে তুমি? আমি ভাবলাম আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে এক্সপ্রেসন দিবে, তা আর কয়েকটা ভেংচি দিলে নাহ?
লোকটার কথায় আমি হা করে চেয়ে রইলাম কিছুকাল। ছিলো তো ফোনের মধ্যে ডুবে,দেখলো কি করে। সাত পাচ ভেবে গিয়ে থপ করে বসলাম জানালার পাশের সিট টাতে।
ঝড়ের বেগে ট্রেন ছুটছে। বাতাসের দাপটে চুলগুলো এলোমেলো উড়ে চলেছে, আমি থামাচ্ছি নাহ। বেশ ভালোই লাগছে।
পালকের চুলগুলো আছড়ে পরছে মেঘের মুখে,সিটে মাথা এলিয়ে আনমনে পালকের চুলের সুবাস নিচ্ছে মেঘ। কেমন ঘোর লেগে আসছে এমন সুবাসে। নিজেকে হারিয়ে ফেলছে যেনো
সামনের সিট হতে রাফাত আর নিবিড়ের হাসির শব্দ ভেসে আসছে সাথে অন্য সবার ও। পালকের বেশ রাগ হলো৷ কতো বড়ো হারামি সবগুলো, নিজেরা সব একসাথে বসে আমাকে পাঠিয়েছে রা’ক্ষস টার সাথে, বসে থেকে উতপাত শুরু করেছে পালক। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আর নড়াচড়া করছে,এক দন্ড স্থির হচ্ছে নাহ।
-নড়াচড়া করে ওড়না উড়াতে খুব ভাল্লাগছে?ওড়না সরে গিয়ে যে সেখানের তিল দেখা যাচ্ছে সেখেয়াল আছে?
মেঘের এহেন কথায় চোখ বড়ো করে তাকালো পালক। নিজের দিকে চেয়ে ওড়না ঠিক করেই বললো
-আপনাকে আমি ভালো ভেবেছিলাম,আপনার নজর এতো খারাপ ছিহ্, অসভ্য
পালকের কথায়,মেঘ ঝুকে চাপা স্বরে বলে
-অসভ্যতার কি পেলে এখানে, শুধু তো বলেছি দেখা যাচ্ছে, আমি কি সেখানে চুমু দিয়েছি নাকি কামড় দিয়েছি যে অসভ্য বলছো
মেঘের কথায় পালক লজ্জায় মুছরে যাচ্ছে,লোকটার মুখে কোনো লাগাম নেই
-আপনি শুধু অসভ্যই নন,প্রচন্ড বেহায়া,আর লুচ্চা ও,ছিহ আমি ভাবতেও পারিনি
পালকের কথাত কোনো হেলদোল নেই মেঘের,আগের মতোই দায়সারা ভাবে বললো
-এতো ভাবাভাবির কি আছে, আমি কি বিয়ের আগেই তোমার সাথে ফুলসয্যা করতে চেয়েছি যে এতো ভাবতে হবে।
পালক কোনো উত্তর দেওয়া তো দূর চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারলো নাহ। মেঘের এরূপ কথায় ওর ভেতরে দামামা শুরু হয়েছে, প্রতিটি শিরায় শিরায় শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। লোকটা কি বুঝে না কোথায় কি বলতে হয়,এখন যদি পালকের হার্ট অ্যা’টাক হয় সেই দায়ভার কি উনি নিবেন?
কিছুক্ষণ নীরবে পার হলো। জোৎস্না রাতের চাঁদের আলোয় কেবিনের ভেতর টাই ও জ্বলজ্বল করছে, লাইট নিভিয়ে দিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। ছুটন্ত ট্রেনের দমকা বাতাসে বেশ শীত শীত করছে পালকের,জানালার পাশ থেকে একটু একটু করে সরে এলো।
গায়ের জামাটা বেশ পাতলা হওয়ায় যেনো জামা ভেদ করে বাতাস ঢুকছে।
পালকের এমন জড়ো সরো হওয়া দেখে মেঘ এক হাত বাড়িয়ে পালকের কোমর ধরে কাছে টেনে নিলো। মেঘের এমন কাজে পালক বেশ হতবাগ হলো,বার কয়েক সরে আসতে নিলেও মেঘের হাতের বন্ধন আলগা হলো নাহ, তাই নিজেই দমে গেলো, মেঘের গায়ের উষ্ণতায় যেনো অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করলো শরীর জুড়ে। ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাসে এমন নিমগ্ন উষ্ণতা আর নাসারন্ধ্র ভেদ করে আসা পুরুষালি মিষ্টি সুবাস মাত্রাতিরিক্ত মোহনীয় ঠেকছে। যেনো হুস হারাচ্ছে পালক। প্রচন্ড আবেগের বশীভূত হয়ে দূরত্ব আরও ঘুচিয়ে নিলো,মেঘের বুকের ভেতর টাই মিশে গেলো।
পালকের এভাবে কাছে আসায় মেঘের বুকের ভেতর তোলপাড় মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো,নিজেকে সামলে রাখা ভীষণ দায় হয়ে যাচ্ছে, কম্পন মাত্রা বুকের বামপাশ ছাড়িয়ে সারা শরীরে বয়ে যাচ্ছে,কাপা কাপা হাতের বন্ধন আরও দৃঢ় করলো চেপে ধরলো পালককে বুকের মাঝে,,দু’হাতের বাহুডোর আরও ঘনিষ্ঠ হলো।
প্রচন্ড আবেশে পালক দু’হাতে আঁকড়ে ধরলো মেঘে শার্ট।
সারা শরীর জুড়ে অস্থিরতার মাত্রায় মেঘ ব্যকুল হয়ে উঠেছে, জোরে জোরে শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছুতেই পারছে নাহ বুকের জিরি জিরি অনুভূতি গুলো বড্ড বেহায়াপনা করছে। এতো আবেগ,এতো মোহনীয়তা কোথায় ছিলো,কোথায় ছিলো এতোদিন! নিজেকে সামলানোর প্রচেষ্টা চরম ভাবে ব্যার্থ হলো। ঠোঁট গোল করে ঝড়ের বেগে নিঃশ্বাস টেনে নিলো।
হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে মুখ ডুবালো পালকের গলায়। তড়াৎ গতিতে বিদ্যুৎ খেলে গেলো পালকের কায়া জুড়ে,নিজের গলায় খোচা খোচা দাড়ির ঘষা আর আছড়ে পরা তপ্ত গরম নিঃশ্বাসে সারা শরীর অবশ হয়ে গেলো। হৃদপিন্ডের অস্বাভাবিক কম্পন ছাড়িয়ে অস্ফুটে শব্দ বেরিয়ে এলো মুখ থেকে।
মেঘের বুকের কাছটাই নখ দিয়ে খামচে ধরলো।
মেঘের এই গাঢ় আলিঙ্গন ছাড়ানোর মতো শক্তি ইচ্ছে কোনোটাই পাচ্ছে নাহ। চরম আবেশে নেত্রকোনা থেকে এক ফোটা জলবিন্দু গড়িয়ে পরলো। কানের পেছনে ছোট্ট উষ্ণ চুম্বন দিয়ে দু’হাতে মিশিয়ে নিলো পালক কে বুকের সাথে।
দুজনের মাঝে এক সূচ সমান দূরত্ব অবশিষ্ট নেই। গভীর অন্ধকারের চাঁদের মৃদু আলোয় মিশে গেলো দুটো মানুষের হৃদস্পন্দন,প্রগাঢ় অনুভব, ভেতরে তোলপাড়, ঘন ঘন আছড়ে পরা উষ্ণশ্বাস।
রন্ধ্রে রন্ধ্রের শিহরণ, শিরায় শিরায় অসহ্য অনুভূতি নিয়েই মিশে রইলো দুটো বুক। তাদের অজান্তেই ডানা ঝাপটালো অন্যরকম, অনুভূতি, তাদের নিস্তব্ধতায় ব্যক্ত হলো কিছু অব্যক্ত বাক্য, আর হৃদয়ের ছন্দ
.
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ
#তুমি_আসবে_বলে
#হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ২৪
-কিরে ছেমরি,ওঠ সারারাত মেঘালয় ভাইয়ের বুকে ঘুমিয়েও হয়নি এখন বিছানায় পরে পরে ঘুমাচ্ছিস।
আরশির কথায় চোখ খুলে তাকালাম,উঠে বসে বললাম
-একদম ফালতু বকবি নাহ বেয়াদব
-ও তাই? সত্যি বললেই ফালতু হয়ে গেলো না?
তুই কি মেঘালয় ভাইয়ার বুকে শুয়ে ছিলি নাহ?
-দেখ লাস্ট বার বলছি, এসব ফালতু বকলে তোর মুখ কাই’টা কাউরা রে খাওয়াই দিম ছেমরি
বলেই এক মুহূর্ত আর অপেক্ষা না করে উঠে গটগট করে ওয়াসরুমে ঢুকে পরলাম।
দরজা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছি চুপ করে, ও যে মিথ্যা বলেনি তা আমিও জানি,কিন্তু কি করবো ও কথা মনে পরলেও আমার গায়ে কাটা দিচ্ছে।
রাতে ওভাবে ঝাপটে থেকেই কখন যে উনার বুকে ঘুমিয়ে গেছি বুঝতেই পারিনি। দীর্ঘ ছয় ঘন্টা উনার বুকে লেপ্টে থেকেই সুদূর প্রায় দুইশত চৌত্রিশ কিলোমিটার পথ কিভাবে পার হয়ে গেছে যানা নেই। ট্রেন সিলেট এসে থেমেছে প্রায় রাত দুইটা, রিসোর্ট এসে পৌঁছাতে আরও আধ ঘন্টা। সব মিলিয়ে সবার ঘরে গিয়ে ঘুমাতে তিনটা বেজে গেছে, কিন্ত সবাই ঘুমালেও আমার চোখে এক ফোটা ঘুম নামেনি। সারাক্ষণই মাথায় ট্রেনের ওই ঘটনা ঘুরপাক খাচ্ছে, সারা শরীর কেমন ঝমঝমিয়ে উঠছে।
তার উপর সকাল করেই আরশির এমন লাগাম ছাড়া কথা, ট্রেন থামলেও আমার ঘুম ভাঙ্গেনি, আরশি উঠে আমাকে ডাকতে এসেই দেখেছে আমি মেঘের বুকে ঘুমিয়ে, সেই থেকে ও শুরু করেছে, এখন কই থেকে কি কাহিনি করবে আল্লাহ মালুম
নিজের মন মস্তিষ্ক খুব পীড়া দিচ্ছে,তার উপর ওর কথায় বারবার ওই ঘটনা মনে পরে যাচ্ছে,নিজের শরীরে প্রথম কোনো পুরুষের স্পর্শ পেয়ে স্নায়ুতন্ত্রেও যেনো যুদ্ধ লেগেছে। রগে রগে বিদ্রোহ করেছে। আর তার ফলে আকাশ সমান অস্থিরতায় ছেয়ে আছে মন মন্দির।
নিজেকে সামলে এগিয়ে গেলাম বেসিনের দিকে,পরপর কয়েক বার মুখে পানির ঝাপটা দিলাম। এসে ফ্রেশ হয়েই শুয়ে পরেছি এখন গোসল না করলে সারাদিন শরীর ম্যাচম্যাচ করবে। নিজের ওড়না টা খুলতে গেলেই সেই চেনা সুবাস টা নাকে লাগলো। হাতের ওড়না টা নাকে চেপে ধরলাম, আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে গেলো,, কড়া পুরুষালি গন্ধ টা আমায় ভীষণ বিমোহিত করে, দীর্ঘ সময় উনার গায়ের সাথে মিশে থাকায় আমার জামা কাপড়েও উনার সুবাস টা মিশে গেছে, নিজেকে উন্মাদ, পাগল লাগছে। বেহায়া অনুভূতি গুলোর ডানা ঝাপটানোর প্রখরতা অঙ্গে অঙ্গে ছড়িয়ে যাচ্ছে, ইদানিং লোকটার হুটহাট কাছে আসা আর ছুয়ে দেওয়া যেনো আমায় শে’ষ করে দেবে
~
দীর্ঘ এক ঘন্টা ধরে শাওয়ার নিয়ে বেরোলাম। শিমু আর আরশি আগেই বেরিয়ে গেছে, বেলা ঠিক নয়টা বাজে। সাদা রঙের একটা সালোয়ার কামিজ আর জরজেট এর ওড়না টা গায়ে দিয়ে চুল গুলো আচড়ে বেরোলাম। বাইরে বেরিয়ে আশপাশ টা দেখছি,রিসোর্ট টা অসম্ভব সুন্দর, মেঘালয় চৌধুরী আগেই বুক করে রেখেছিলো। একটু এগোতেই দেখি নিবিড় এদিকেই আসছে।
-আফু,চল তোর জন্যই অপেক্ষা করছে সবাই টেবিলে।
নিবিড়ের সাথে কিছুদূর যেতেই দেখলাম খাবার টেবিলে সবাই উপস্থিত। আমি গিয়ে বসলাম নিবিড়ের পাশের চেয়ারটায়।
-এতোক্ষণে ঘুম ভাঙলো পালক?
-এইতো,ফ্রেশ হতে একটু দেরি হয়ে গেছে আরকি
ধ্রুব ভাইয়ের কথাত স্মিত হেসে উত্তর দিলাম। বাকি সবার সাথে টুকটাক কথা বলেই খাওয়া শুরু করলাম।
খেতে খেতে চোখ গেলো আমার সামনের চেয়ারটাতে। শুভ্র রঙের শার্ট পরিহিত লোকটা চুপচাপ কোনো দিক না তাকিয়ে খেয়ে যাচ্ছে, শার্টের হাতা টা গুটিয়ে রাখা কনুই পর্যন্ত, বুকের কাছের বোতাম গুলো সম্পূর্ণ খোলা,যার ভেতরে কালো রঙের টি-শার্ট টা দৃশ্যমান।
মেঘ কে সবসময় ফরমাল লুকেই দেখা যায়, এমন ক্যাসুয়াল স্টাইলে উনাকে দেখলে কতো
মেয়ের যে হার্ট ব্রেক হবে যানা নেই। সাদা রঙের পোশাকে উনার চোখ দু’টোর নীলাভ গভীরতা যেনো আরেক ধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি খাওয়া ছেড়ে তাকিয়ে আছি উনার দিকে, খাবার মাঝেই উনি হঠাৎ চোখ তুলে তাকালেই চোখাচোখি হলো দুজনের। আমায় এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি দুই ভ্রু উচিয়ে প্রশ্নসূচক ইশারা করলো। আমি ফট করে ঘাড় নামিয়ে নিলাম। ওই চোখ দু’টো দেখলে মন আমার কোথায় তলিয়ে যাই যানা নেই।
-আমি কিন্তু স্পষ্ট দেখতাছি ব্রো, ওগো লাইন ঘাট একদম রেইললাইনের মতো পরিষ্কার, কুনো যানযট নাই
খাবার মাঝেই কনুই দিয়ে গুতায়ে আদ্রিশ নিবিড় কে বললো।
-হ আমিও দেখতেছি তো, রাতে ট্রেনে বুকে নিয়ে ঘুমাচ্ছিলো আর এখন চোখে চোখে ইশারা, ওহহো বাত বান গায়ি
আরশি কথার মাঝে ফোড়ন কেটে বলে, আরশির কথায় রাফাত অবাক হয়ে বলে।
-হোয়াট? বুকে নিয়ে ঘুমাচ্ছিলো মানে? কখন,কিভাবে,কোথায়
-তোর মাথায় সা’লা টিউবলাইট। কইতাছি তো ট্রেনে, স্টেশনে থামার পর যখন আমি আফুরে ডাকতে গেছিলাম তখন দেখি মেঘ ভাই ওরে এক হাতে জড়িয়ে রেখেছে,আর আমাগো আফু ফিল্মের হিরোইন এর মতো বুকে ঘুমিয়ে আছে,হায়ে আমিতো ফটাফট ওখানে নিজেকে আরাব ভাইয়ের সাথে কল্পনা করে ফেলেছি
-থাম ছেমরি আরাব খোর। তোর কাহিনি কমা। আমিতো এখনো অবাক কাহিনি এতোদূর আমি জানিই নাহ।
-তুই জানবি ক্যামনে,তোর তো খালি খাওয়া। ট্রেনের মধ্যেও তোর মুখটা বন্ধ যায়নি
-প্ল্যান তাহলে একদম টিপটপ কাজে দিতাসে ভাই,এবার ওদের মাঝে দূরত্ব কমাতে আরও একটা কাজ করতে হবে শোন
আদ্রিশ কে থামিয়ে আরশি বললো
-তুই থাম বেডা, আমার কাছে একটা ধুম ধারাক্কা প্ল্যান আছে, এক্কেরে সুপারস্টার টাইপ প্ল্যান
-আমাকেও বলো তোমাদের সুপারস্টার প্ল্যান আমিও ধুম ধারাক্কা প্ল্যানে পার্টিসিপ্যান্ট করতে চাই
ওদের মাঝে হঠাৎ আরাব এসে ওদের মতোই ফিসফিসিয়ে বললো কথাটা। সবাই বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। মাথা গুলো সরিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বসলো নিবিড় আদ্রিশ রাফাত আরশি।
চারটা মিলে খাবার টেবিলে বসেও ওদের ফুসুরফাসুর লাগিয়েছে। বেশ অনেকক্ষণ ধরেই আরাব খেয়াল করছিলো তাই দুষ্টামি করে ওউ ওদের ভিতর ঢুকে পরলো।
-আরে আরাব ভাই আমরা তো ঘুরা নিয়ে প্ল্যানিং করছি। একেবারে ধুম ধারাক্কা ঘুরা ঘুরবো আজ। সারাদিন ই ঘুরার উপর থাকবো
রাফাতের কথায় আরশি মুখ ভেংচি দিয়ে বলে
-হ্যাঁ দেখির ঘুরার উপর থাকতে গিয়ে নিজেই ঘুরে যাস না, শেষে এতো ঘুরাঘুরি করে তোর জীবন টাই ঘুরে যাবে
আরশির এমন পাগল পাগল কথায় আরাব সহ বাকিরা হাহা করে হেসে দেয়। এদিকে শিমু কোনো দিক তাকানো বাদেই খেয়ে যাচ্ছে। হুট করে কাটা চামচ টা হাত থেকে পরে ঠাস করে পরে গেলো। ঝুকে গিয়ে তুলতে নিলেই করো মাথার সাথে সজোরে ধাক্কা লাগলো
-আউচচ
মাথায় হাত দিয়ে আর্তনাদ করে উঠলো শিমু।
-সরি সরি,আসলে আমিও চামচ টাই তুলতে যাচ্ছিলাম।
ধ্রুব মাথায় হাত ঘষে বললো। শিমুর হাত থেকে চামচ টা পরে যাওয়ায় ধ্রুব তুলতে গেছিলো।দুজন পাশাপাশি বসাই আর একসাথে নিচে ঝুকার কারণে বারি লেগেছে।
আরও কিছুক্ষণ কথা বার্তা বলে খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে পরে সবাই।
মালনীছড়া চা বাগান সর্বপ্রতিষ্ঠিত চা বাগান বাংলাদেশের, শুধু বাংলাদেশেই নয় পুরো উপমহাদেশ জুড়ে এর খ্যাতি, একে উপমহাদেশের সবচেয়ে বড়ো চা বাগান ধরা হয়। সৌন্দর্য, সৌহার্দপূর্ণ সজীব সবুজে ভরা এ প্রান্তর যেকোনো মানুষের ঘুরতে যাওয়ার বিশেষ আকর্ষণ। প্রতি বছর দেশ বিদেশের হাজারো মানুষ ছুটে আসে এ চিরসবুজ সৌন্দর্যের চাক্ষুষ প্রদর্শন করতে। যেনো প্রকৃতি তার সৌন্দর্যের ডালি সযত্নে বিছিয়ে রেখেছে, সৃষ্টিকর্তার সেরা কারুকার্যের এমন ছোট ছোট প্রদর্শনে মন চোখ দু’টোই ভরে আসে সকলের।
গাড়ি থেকে নেমেই একছুটে এগিয়ে গেলো পালক। এমন প্রকৃতির বিনয়ী রূপ দেখে যেনো খুশিরা বাধ ছাড়া হয়ে গেছে। খিলখিলিয়ে হেসে লাফিয়ে উঠলো। পালকের মতো অন্যেরাও যেনো এমন দৃশ্য দেখে আত্মহারা হলো। গাড়ি থেকে নেমেই এক ছুটে আরশি রাফাত নিবিড় আদ্রিশ এদিক ওদিক ছুটে গেলো। আরাব ওর ক্যামেরা দিয়ে এক একটা করে দৃশ্য আবদ্ধ করছে। শিমুর গাড়ি থেকে নামার সময় ধ্রুব ওর হাত ধরে নামিয়ে দিলো,ওতে ও বেশ অপ্রস্তুত হলেও ছোট্ট ধন্যবাদ দিয়ে ছুটে গেলো আরশির পিছনে।
পালকের এমন প্রফুল্ল চেহারা দেখে সবাই খুশি হয়ে গেলো,মেঘের মুখেও মৃদু হাসির রেখা দেখা গেলো, সবাই এক এক করে ভাগ হয়ে আলাদা আলাদা ঘুরতে লাগলো। পালক আপন মনেই একা একা ঘুরছে আর সবুজ সমারোহ গুলোকে ফোনের ক্যামেরাই বন্দী করছে। সামনের দিকে আরেকটু এগোতেই পেছন থেকে কেও হাত ধরে টান দিয়ে সরিয়ে নিলো
-ওদিকটাই বড়ো খাদ আছে, পরে গেলে তোমার মতো পিচ্চিকে বাইনোকুলার দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে নাহ
মেঘালয়ের এরূপ কথায় বেশ চটে গেলো পালক। মানছে সে খাটো তা বলে এভাবে অপমান করবে
-শুনুন আমি মোটেও এতোটাও ছোট নই৷ আমি যথেষ্ট লম্বা
-আচ্ছা? তাই নাকি
বলেই মেঘ এগিয়ে এসে একেবারে সামনে এসে দাড়ালো পালকের
পালকের মাথা টা একেবারে বুক বরাবর ঠেকছে মেঘের। ফর্সা অতি সুদর্শন চেহারার লোকটার উচ্চতা ছয় ফুটের ও বেশি। ওর সামনে পালক কে নিজেকে আরও বেশিই খাটো মনে হলো, বেশ লজ্জা পেয়ে সরে গেলো।
পালকের মুখটা এইটুখানি হওয়া দেখে মেঘ মুচকি হেসে,একদম পিছে এসে দাড়ালো। একটু ঝুকে কানের কাছে মুখ দিয়ে বললো
-সামনে তাকাও
মেঘের কথায় সামনে তাকাতেই দেখলো ঝাঁক বেঁধে পাখিরা উড়ে চলেছে, উপরে নীলাভ শুভ্র আকাশ আর নিচে সাজানো সবুজের মেলার মাঝে এমন রঙ বেরঙের পাখিদের ছন্দ মিলিয়ে চলায় যেনো পালক আর স্থীর থাকতে পারলো নাহ। এই অপরূপ সৌন্দর্য্য তাকে খুব টানছে। এক ছুটে চলে গেলো সামনের দিকে
পেছন থেকে মেঘের গলা আসছে
-ছুটো না নূর পরে যাবে তো
মেঘের কথা শেষ হতে যতটুকু দেরি, থপ করে কিছু একটাতে বেধে পরে গেলাম। পরে গিয়েও চুপ করে বসে আছি। উঠতে ইচ্ছে করছে নাহ। লোকটা ভীষণ খারাপ।উনি বললো বলেই তো পরে গেলাম। মেঘ ছুটে এসে হাটু গেড়ে বসলো
-ঠিক আছো তুমি? কোথায় লেগেছে
মেঘের কথায় যেনো আহ্লাদী হয়ে গেলো পালক। পরে গিয়ে খুব না লাগলেও মেঘের এমন বিচলিত দেখে ওর বেশ আদর আদর লাগলো। চোখ ছলছল করে উঠলো। ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিলো।
-আরে আরে কাঁদেনা,দেখি কোথায় লেগেছে
বলেই পা টেনে ধরে এপাশ ওপাশ করে দেখতে লাগলো
-দেখলে তো,বললাম ছুটতে নাহ এখন কতোটা ব্যাথা পেলে। ইসস চামড়া ছেরে গেছে কতোখানি
মেঘের সারা মুখে নিজের জন্য এমন ব্যাকুলতা দেখে পালকের মনে যেনো প্রজাপতিরা ডানা মেলছে, মস্তিষ্ক বলছে মুহূর্ত টা এভাবেই থেমে যাক। শুভ্র পুরুষের মুখে নিজের জন্য এমন বিচললের ছায়া দেখতে মন্দ লাগছে নাহ
-ব্যাথা করছে খুব? হাটতে পারবে?
মেঘের প্রশ্নেও কোন নড়চড় করলো নাহ পালক। স্থীর তাকিয়ে আছে সামনে ছলছল চোখে। মেঘ দু’হাতে পালকের চোখের পানি মুছিয়ে দিলো।
উঠে দাঁড়িয়ে পালক কে দু’হাতে কোলে তুলে নিলো।
-আম আমি ফিরে যাবো নাহ, এখানে ঘুরবো
মিনমিন করে বললাম।লোকটা আমার কথায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে, বেশ ভয় করলো। একটুও বিশ্বাস নেই যদি থা’পড়ে দেই? ভয়ে মুখ গুজে দিলাম বুকে। কিছুক্ষণ বাদে মুখ তুলে দেখি বাগানটার আরও ভেতরের দিকে নিয়ে এসেছে। এদিকটার দুপাশে সারি সারি বাগান মাঝখান দিয়ে রাস্তা করা। আশে পাশের উপজাতিদের দল মাথায় কাপড় বেধে পাতা তুলছে। কেও কেও আমাদের দেখে মিটমিটিয়ে হাসছে আবার ইশারা করে একে অপরকে দেখাচ্ছে। ওদের এহেন কান্ডে বেশ লজ্জা পেলাম আস্তে করে বললাম
-নামিয়ে দিন আমায় আমি একাই হাটতে পারবো
-বেশি কথা বললে ঠা’স করে ফেলে কোমর টাও ভে’ঙে দিয়ে কোলে তুলে হাটবো
উনার এমন কথায় বেশ চুপসে গেলাম। উনিকি কখনও ভালো করে কথা বলতে পারে না,সবসময় এমন হুমকি ধমকি করার কি আছে। চুপচাপ ভ্রু জড়ো করে রইলাম
কিছুদূর এসেই আমায় একটা বড় পাথরের উপর বসিয়ে দিয়ে নিজেও পাশে বসলেন
এখান থেকে দূরের পাহাড় গুলোর মাথা উচিয়ে দাম্ভিকতার সাথে দাঁড়িয়ে থাকা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, দূর থেকে ঝর্ণার কলকল ধ্বনি ভেসে আসছে, আহ কি মনোরম দৃশ্য, নয়নাভিরাম এ দৃশ্য দেখে নিজের ভেতরের উচ্ছাস কিছুতেই দমাতে পারলাম নাহ। খলখলিয়ে হেসে দু হাতে মেঘালয়ের বাহু ঝাপটে ধরলাম। আমার এহেন কান্ডে উনিও হেসে দিলেন। উনার হাসির শব্দে পাশ ফিরে তাকালাম। সচরাচর উনাকে হাসতে দেখা যায় নাহ৷ খুব বেশি হলে মুচকি হাসেন। এতো কাছ থেকে দেখা উনার মৃদু শব্দের হাসিটা যেনো ভেতর পর্যন্ত নাড়িয়ে দিলো আমার, অপলক চেয়ে আছি। আমায় এভাবে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চেয়ে থাকতে দেখে খানিকটা কাছে এসে বসলো,দূরত্ব ঘুচিয়ে মৃদু কণ্ঠে জিগাসা করলো
-কি দেখো এভাবে?
আমি এখনো অপলক চেয়ে,যেনো বাস্তব থেকে বহু দূরে, ওভাবে তাকিয়ে থেকেই ঘোর লাগা কণ্ঠে উত্তর দিলাম
-আপনাকে
-আমায় কি দেখো
আমি আলতো করে কাঁপা কাঁপা হাতটা উনার গালে রাখলাম,খোচা খোচা দাড়ির ঘষার সারা বদনে তরঙ্গ ছেয়ে গেলো,আগেরই ন্যায় উত্তর দিলাম
-আপনি ভীষণ সুন্দর মেঘ
এভাবে হুট করে গালে হাত রাখায় মেঘের ভেতরের পেলব অনুভূতি গুলো তীব্রতর হতে লাগলো। চোখ বন্ধ করে সময় নিয়ে খুলে তাকালো,চোখ জুড়ে মাদকতা বিরাজমান।
কণ্ঠের খাদ আরও নামিয়ে বললো
-কতোটা?
-একদম মেঘের মতোই, শান্ত স্নিগ্ধ সুদর্শন, যার দিকে তাকালে চোখেও যেনো স্তব্ধতা ছেয়ে যায়,অপলক চেয়ে থাকতে মন চাই
আনমনেই কথা গুলো বললো পালক। হুট করেই ওর মনে হলো ও কতো বড়ো সর্বনাশা কাজ করে ফেলেছে। তড়াৎ গতিতে হাত নামিয়ে নিলো।দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। হাতে যেনো পুরুষালি গালের ছোয়া এখনো লেগে আছে, দু’হাতে জামা খামচে ধরলো। মনের গহীনের অযাচিত অনুভূতি গুলোর এমন বেহায়া রূপে বেশ অতিষ্ঠ লাগলো পালকের, কি করে করলো এমন কাজটা, লোকটা কি খুব রেগে যাবে?
নিজের ভাবনার মাঝেই বলিষ্ঠ হাতটা পালকের হাত টা কোল থেকে নিয়ে হাতের মুঠোয় নিলো, মুষ্ঠিবদ্ধ করা হাতের ছোট ছোট আঙুল ছাড়িয়ে নিলো। পালক হতভম্বের মতো তাকিয়ে,মেঘের শান্ত চাহনি তার দিকেই নিবন্ধ। কিন্তু এ চাহনিতে আজ অন্যকিছু দেখতে পাচ্ছে পালক, নিজের ভেতরে চলমান দামামা বেপরোয়া অনুভূতি গুলোর প্রতিফলন স্পষ্ট সামনের পুরুষের চোখে। ভেতর টা বিকট ভাবে মুষড়ে উঠলো, চোখের কার্ণিশে ফুটে উঠলো লজ্জার প্রগাঢ় ছাপ
মেঘ পালকের হাত টা আস্তে ধীরে নিয়ে আবারও রাখলো নিজের গালে। সারা বদনে ঝংকার দিয়ে উঠলো পালকের, দীর্ঘ তপ্ত শ্বাস ঝড়ের বেগে বেরিয়ে আসলো ওষ্ঠ ফাঁক থেকে। ওই চোখের অবাধ্য দৃষ্টিতে কিছুতেই চোখ রাখা যাচ্ছে না কিছুতেই নাহ, ফট করে চোখ সরিয়ে নিলো পালক
-দৃষ্টি সরিও নাহ মেয়ে,আমার নীলাভ চোখের গহ্বরে যে তুমিও হারিয়েছো তা কিন্তু আমার অজানা নয়
এমন হৃদয়বিদারক শব্দগুচ্ছ কর্ণকুহর হতেই চট করে তাকালো পালক তখনি সামনের মানুষটা
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ