#তুমি_আসবে_বলে
#হুমাইরা_হাসান
পর্ব: ৩০-৩১
নিঃস্তব্ধ রাতের গভীরতা ক্রমশ বেগবান হচ্ছে, টিমটিমে তারার মৃদু আলো আকাশের গম্ভীরতায় মুখ ডুবিয়েছে, আশপাশের গুমোট পরিবেশের শূন্যতায় বেজে উঠলো করুন এক আর্তি সুর। এমন স্তব্ধ পরিবেশে সেই করুন সুরের আর্জি তে যেনো কেও তার সমস্ত বেদনা, অপারগতা, ব্যাথা টুকুও ঢেলে দিয়েছে,,,
বারান্দার কাউচে বসে আনমনে হাতের যন্ত্রটায় কম্পিত স্বরতন্ত্রে শব্দের তরঙ্গ বাজিয়ে যাচ্ছে মেঘ।
খানিক পর থামিয়ে দিলো করুন সুরের আর্জি, হারমোনিকা টা হাত থেকে নামিয়ে রাখলো। অদ্ভুত এক বি’ষ ব্যা’থায় তার শরীর মন জর্জরিত হয়ে আছে। দীর্ঘ ২৭ বছরের জীবনে এই অনুভূতি যেনো প্রথম। বক্ষপিঞ্জরের এমন বেদনা কখনও তাকে অস্থির করেনি, বর্ষার শুরুতে এমন কড়া তপ্ততা তাকে কখনও পুড়াইনি, শুধুমাত্র এক রমণীকে ঘিরে তার এতোসব উৎকণ্ঠা, আবেগ,অনুভূতিরা তাকে আয়োজন করে জ্বালা’চ্ছে, পোড়া’চ্ছে।
সেই প্রথম দিনের ওই ঘামে ভেজা চেহারা, রান্নাঘরে তাকে আ’গুন থেকে বাচাতে বুকে টেনে নেওয়া, অ্যাক্সিডেন্টের পর হাজারো বার তাকে স্পর্শ, তার কান্নায় বুকের মধ্যিখান ভিজিয়ে নেওয়া,এতো সব অভিজ্ঞতার মাঝে সে কখন মেয়েটাকে ভালোবেসেছে নিজেও বুঝতে পারেনি। কখন মেয়েটা তার সমস্ত জুড়ে বিস্তার করেছে তার নূন্যতম খোঁজ সে পাইনি। শুধু এইটুকুই বুঝেছে মেয়েটার চেহারা নাহ দেখলে তার ভেতরে অদ্ভুত পীড়ন হয়। মেয়েটার কাছে থাকলে যে শান্তি লাগে তা কোথাও নেই। কি করে বোঝাবে মেঘ কতটা মিশিয়ে নিয়েছে নিজের মাঝে তার নূর কে। কি করে বোঝাবে কতটা জুড়ে ছেয়ে আছে মেয়েটা। এ জিনজিরায় বাধা অনুভূতি শব্দে বাক্যে প্রকাশে অক্ষম সে,তাই তো প্রিয়তমা বুঝলো নাহ, তার ব্যাথায় দগ্ধ হওয়া হৃদয় টা অনুভূতির মায়াজালে সিক্ত হলো নাহ
ছাদে পালক কে বুকে কতক্ষণ জড়িয়ে রেখেছিলো তার সময়-জ্ঞান নেই মেঘের, মেয়েটা নিঃশব্দে নোনাজলে ভিজিয়েছে মেঘের বুক। বুক থেকে তুলে হাতের ব্যান্ডেজ খুলে মেঘ নিজে আবারও করে দিয়েছে, শিমুর কাছে পালকের কথা শুনে সে ফার্স এইড বক্স টা নিয়েই গেছিলো। ব্যান্ডেজ শেষ করে পালক আর দাঁড়ায়নি। পুরোটা সময় মেয়েটা এক চুল পরিমাণ শব্দ করেনি। কারো নিঃস্তব্ধতা যে এতোটা পীড়নকারী হয় তা মেঘের জানা ছিলো নাহ। মেঘের সে আকুল আর্জিতে হ্যাঁ বা না কোনো উত্তর ই দেয়নি মেঘ। কোনো রূপ বাক্য হীনা স্থান ত্যাগ করার সময় মেঘ যখন পেছন থেকে ডেকে বলেছিলো
“আমাকে কি একটা সুযোগ দেবে না নূর? আমার ভালোবাসায় কি এতোটুকুও সায় দেবে নাহ?
বিনিময়ে পালক নিস্তেজ হেসে বলেছিলো
” আগে বুঝতে শিখুন,ভালোবাসা তো শুধু দুটো মানুষে নাহ, বিশ্বাস ভরসা আর সম্মানেও হয়”
ব্যাস আর কোনো শব্দ আসেনি, তার চাঁদ মুখখানা আর দেখা যায়নি। ওই শূন্য ছাদে মেঘ কতক্ষণ একা দাঁড়িয়ে ছিলো তা জানা নেই, এসে থেকে বসে আছে বেলকনিতে। আজ পালকের ঘরের প্রতিচ্ছবি টাও আসছে নাহ,লাইট জ্বালানো নেই। মেয়েটা কি খুব অসুস্থ হয়ে গেলো? মেঘের জন্যেই? নাহহ আর ভাবতে পারছে না মেঘ মাথার প্রতিটি রগে রগে আন্দোলন শুরু হয়েছে, যন্ত্রনায় চোখ মুখে আধার নামছে
~
-আর খাবো নাহ প্লিজ
-কোনো কথা শুনবো নাহ,নিজের চেহারা টা দেখেছিস? এক রাতের মধ্যে কি করে ফেলেছিস?
পালকের অসুস্থতা শুনে সকাল বেলায় হাজির হয়েছে আরশি। শিমু জোর করে খাইয়ে দিচ্ছে পালককে।
সারা টা রাত দু চোখের পাতা এক করেনি পালক। নোনাজলে ভিজিয়েছে তার সমস্ত কপোল। ঘরে অন্ধকার করে সে বারান্দার দরজা টাতেই দাঁড়িয়ে ছিলো। মেঘ কে সারা রাত বারান্দায় তার অপেক্ষা করতে দিয়ে সে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেনি,পারেনি ঘুমাতে। সেও দাঁড়িয়ে ছিলো বারান্দায়, তবে লোকটার চক্ষুর অগোচরেই। পালক দেখাতে চাইনি তার উৎকণ্ঠা, তার ব্যাকুলতাকে। থাক না গোপনে, ক্ষতি কি। মনের গহীনে যখন ছুঁয়ে যেতে পারবে তখন প্রকাশ হীনায় সে বুঝতে পারবে সবটা। বিষাক্ত অনুভূতিতে দগ্ধ শুধু সে একাই নয়,অপর পাশের মানুষটার ও হয়।
“সত্যি করে বল তো আফু, তোর এ বিধ্বস্ত চেহারা কি শুধু শরীরের অসুস্থতার জন্যেই?”
আরশির কথায় এক পলক তাকালো তার দিকে, শুরু থেকেই তাদের কাছে কোনো কথা গোপন করেনি সে, শুধু নিজ মন গহীনে একান্তে কিছু শব্দ সে প্রকাশ করতে পারেনি, সে তো নিজেই সেই অনুভূতির নাম দিতে পারেনি। এই প্রথম সে নিজেকে চিনতে ব্যার্থ।
“শরীরের ব্যাথা না হয় আজ নয় কাল সেরে যাবে, মনের ব্যাথার কি করবি আফু?”
আরশির প্রশ্নে স্মিত হেসে বললাম
“সময় সবকিছুই ঠিক করে দেয় আরু”
আরশি কাছে এসে আমার হাতে হাত রেখে বললো
“কেনো সেরে যাবে, সয়ে যাবি কেনো আফু? তোকে চিনতে এতটাও অপারগ নয় আমরা, তুই কি সত্যিই ভালোবাসিস নাহ মেঘ ভাইকে?”
আরশির এহেন প্রশ্নে বেশ কিছুক্ষণ থ হয়ে রইলাম। মাথায় ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে প্রশ্ন টা। এই প্রশ্ন তো আজ অব্দি আমি নিজেও করিনি নিজেকে। আমি কি আসলেই উনাকে ভালোবাসি? তাই কি উনার এতোটুকুও রাগ আমার মনে এতো বড়ো অভিমানের জন্ম দিলো। সত্যিই তো! আমাকে আঘাত করাই আমি মোটেও রাগ করিনি,একটুও না বরং অভিমান হয়েছে, পাহাড় সমান অভিযোগ হয়েছে উনার প্রতি।
“আফু,মেঘ ভাই তোকে কতটা কেয়ার করে, তোর জন্য কতটা উদ্বিগ্ন সেটা কিন্তু আমরা সবাই দেখেছি। উনার দ্বায়িত্ববোধ টা যে দ্বায়িত্বের গন্ডি পেরিয়ে অধিকারে পৌঁছেছে সেটা তুই আমি সকলেই বুঝি তাই তোকে নিয়ে এতোটা পসেসিভ উনি, আর এই ব্যাপার টা কিন্তু শুধু মেঘ ভাইয়ের ক্ষেত্রেই নয়, কথা তো তোর চোখ ও বলে, আর তা পড়তে পারার ক্ষমতা আমাদের একটু বেশিই আছে”
এবার শিমু ও বললো। ওদের কথায় বেশ কিছুকাল চুপ করে থেকে বললাম
-আজ তো অ্যাসাইনমেন্টে সাইন করাতে হবে, যাবি নাহ তোরা?
পালক যে ব্যাপার টা এড়িয়ে গেলো তা আরশি আর শিমু ভালোই বুঝতে পেরেছে,পালক কে তাদের ঢেড় বেশি চেনা। সে যদি একটু সময় চায় তবে নিক। নিরবতা ভেঙে আরশি বললো
-হ্যাঁ যেতে তো হবে, কিন্তু তুই এ অবস্থায় কি করে যাবি।
-ও প্লিজ ইয়ার,শুধু হাতটাই খানিকটা কেটেছে,ভে’ঙে যায়নি। আর এখন ব্যাথাটা আগের চেয়ে অনেকটা কম। বাড়ি বসে শুধু বোর ই হবো
-চল তাইলে,আজ টিএসসির মোড়ে জমপেশ একটা আড্ডা হবে, অনেক দিন হয়না
আরশি বেশ প্রফুল্লচিত্তে বললো।
আমি মুচকি হেসে ওদের একটু অপেক্ষা করতে বলে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নিলাম
গাঢ় খয়েরী রঙের একটা টপসের সাথে জিন্স পরে চুলগুলো পোনিটেল করে বাধলাম, পায়ে সাদা রঙের স্নিকার্স পরে পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে বেরোলাম তিনজনে। রিকশা নিয়ে তিনজনে ভার্সিটিতে এসে পরলাম। ক্লাসে গিয়ে দেখি রাফাত নিবিড় আদ্রিশ এখনো আসেনি। কাল তিনজন খেলতে গিয়ে আর বাড়ি ফেরেনি, সারারাত নিবিড়ের বাড়িতেই ছিলো। রাতভর আড্ডা দিয়ে নিশ্চিত এখনো পরে পরে ঘুমাচ্ছে।
আমরা গিয়ে নিজেদের বরাদ্দকৃত জায়গায় বসে পরলাম। মাহফুজ স্যার কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে অথচ তিন গন্ডমূর্খের আসার সময় হলো নাহ।
আমরা তিনজনে বসে পকপক করতেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকলো তিনটা ক্লাসে, এসেই ধপ করে বসলো আমাদের পাশের বেঞ্চিতে৷
-সা’লার মাহফুইজ্জার লেগা ঘুমটাও ঠিক মতো হয়না। সা’লার ফজর না পোহাতেই ক্লাসে হাজির হওয়া লাগে
বেঞ্চে বসেই নিবিড় শুরু করলো,আর এদের এই গালা’গাল ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলবে। শিমু ভ্রু কুচকে বললো
-লাইক সিরিয়াসলি! বেলা আট টার সময় ও তোদের ফজরের পর মনে হয়।
-আবে থাম ভুটকি,তোর মতো কি রাইতে দশটা না বাজতেই ভেটকাইয়া বিছানায় পরি নাকি, আমাগো রাত ই হয় বারোটাই।
আদ্রিশ বেশ ভাব নিয়ে বললো।
-আহা রাত ই হয় বারোটাই তাহলে তোদের জন্য এখন রাত দুইটা ক্লাসে আইছোস ক্যান,যা না যা রাত্রিযাপন কর গা
আরশির কথায় রাফাত পেছন থেকে ঠা’স করে এম চা’পড় বসাই দিয়ে বলে
-তুই চুপ থাক ছেমরি। আমরা না আসলে যে অ্যাসাইনমেন্ট সাইন করিয়ে দেওয়ার মতো লক্ষী বান্ধবী তোরা নাহ,সবগুলার খালি গাইগুই
আমি বেশ ক্রুর হয়ে বললাম
-ওহ আচ্ছা? অ্যাসাইনমেন্ট গুলা যে আমাদের তিনটাকে দিয়ে লিখিয়ে নিস তখন?লিখেও আমরা দেবো সাইন ও আমরাই করিয়ে দেবো তাইলে তোরা করিস টা কি , এক একটা আমড়া কাঠের ঢেকি
-আমরা কিছু করিনা মানে, আমরা খাই,ঘুমাই,খেলি আড্ডা দেই আরও কতো কাজ জানিস?
শিমু মুখ ভেংচি কেটে বললো
-এগুলো কাজ..
শেষ করার আগেই আগমন ঘটলো মাহফুইজ্জার। একদম চুপচাপ হয়ে গেলাম। আজ তো আমি কেয়ামত হইলেও ওদের দিক তাকাম নাহ, ওদের ফেস টা দেখলেই আমার হাসি পাবে, আর আমি হাসি শুরু করলে সবগুলো শুরু করবে।
দীর্ঘ পয়তাল্লিশ মিনিট ক্লাস করার পর,লাইন দিয়ে আরও বিশ মিনিট অপেক্ষা করে, অ্যাসাইনমেন্ট গুলা সাইন করিয়ে বাইরে আসলাম। রাফাত নিবিড় আদ্রিশ তিনিটা মিলে আমাদের সরিয়ে নিজেরা সাইন করিয়ে আগে আগে বেরিয়ে গেছে, গরু গুলার ক্ষুধা লেগেছে নাকি। আমরাও বেরিয়ে ক্যান্টিনে হাঁটা ধরলাম। গিয়ে দেখি ক্যান্টিনের অর্ধেক খাবার সাবার করে ফেলেছে অলরেডি। তিনটা স্যান্ডউইচ দুটো এগ রোল, তিনবাটি হালিম আর পরটা সব সাবার করে বসে কোক গিলতেছে তিনটা মিলে,প্যাকেট গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা।
-বাহহ বাহহ বাহহ,, জানতাম,জানতাম গয়েল গুলো সব খাবার একাই সাবার করেছে। বলি তোদের গন্ডার পানা কবে যাবে হ্যাঁ, খাদকের ঘরের খাদক। আমাদের জন্য একটু রাখলিও নাহ, এই তগো বলে টাকা নাই। তে এতো সব গিল্লি কি করে বল
আরশি একাই বকবক করে চলেছে, ওদের তিনটার গায়ে লাগা তো দূর কানেও ঢুকছে না।
-ম্যাডাম বিল
এর মাঝেই ক্যান্টিনের স্টাফ এসে বিলের কাগজ আরশির হাতে ধরিয়ে দিলো।
-যা বাবা,খাবার তো ওরা খেয়েছে বিল আমাকে কেনো দিচ্ছেন
-ম্যাডাম খাবার গুলো আপনার নামেই অর্ডার করা হয়েছে
-আজব তো,আপনার চোখের সামনে বসে যে তিনটাই গপাগপ গিললো, আর আপনি বলছেন আমার নামে, নাকি চোখে টিনের চশমা পরে রাখেন
-ম্যাডাম অর্ডার টা যার নামে করা হয় বিল তো তার কাছেই চাইবো। এখানে আপনার ই নাম লিখা।
আরশি খপ করে স্টাফের হাত থেকে বিলের কাগজ নিয়ে দেখলো ওখানে জ্বলজ্বল করছে আরশি তৈয়ব ইনতেহা নামটা।
বিলের কাগজ টা ধরিয়ে স্টাফ হাঁটা ধরলো।
-এই খচ্চ’রের দল, নিজেরা গিলে আমার নামে অর্ডার দিছিস কোন সাহসে হ্যাঁ, আমি তোদের কখনও নিজের টাকাই গিলাবো নাহ।
-তোর মতো ফকিন্নির টাকাই গিলতে চাইনি, আমরা তোর কাছে যা টাকা পাই সেটাই শোধ করবি বিল দিয়ে।
নিবিড়ের কথায় অবাক হয়ে আরশি জিগাসা করলো
-তোরা কিসের টাকা পাস আমার থেকে।
-পাই না মানে,সেকেন্ড ইয়ারে উঠার পর তোরে তিনদিন করে আমার বাইকে বাড়ি রেখে এসেছি। সেটার টাকা কি তোর খালু দিবে।
রাফাতের কথায় আরশি তেতে বলে
-তো বাইকে যাওয়ার ভাড়া কিসের।
-অবশ্যই ভাড়া আছে, রিকশা বা অটো তে গেলে ভাড়া দিতিস নাহ? তাইলে আমাদের বেলায় দিবি নাহ কেনো।আগের গুলো মাফ করলাম কিন্তু এইগুলা দিতেই হবে
-তো তিনদিনের ভাড়া কি সাড়ে পাঁচশো?
এবার আদ্রিশ বললো
-তিনদিন মানে, তুই সেদিন ও জোর করে আমার সাথে রিকশায় বসে তোর বাড়ির গলির সামনে এসে ভাড়া না দিয়ে দৌড় দিয়েছিস,শুধু এক দিন নাহ এই কাজ পরপর অগণিত বার করেছিস।
সেসবের অর্ধেক ও না এই টাকা
-আমার কাছে কোনো টাকা নেই,পারবো নাহ
-তাইলে আর কি,ক্যান্টিনের এটো থালা বাসন ধুবি। কারণ বিল যখন তোর নামে দিতে তো হবেই, তোরে রাইখা এখনি বেরোইতাছি আমরা।
আদিশের কথায় কিছুক্ষণ পেঁচার মতো মুখ করে নিজের ব্যাগ থেকে তিনশো টাকা বের করে খপ করে আমার হাতের ব্যাগ টা কেড়ে বাকি টাকা নিয়ে থপথপ করে গিয়ে বিল দিয়ে আসলো।
-তোরা আসলেই ব’জ্জাত, বেচারির টাকা গুলো শুধু শুধু শেষ করলি
আমার কথায় নিবিড় বললো
-বেচারা? কিসের বেচারা,আস্ত ধান্দাবাজ মহিলা ও, দেখ কোনদিন চকবাজারে দোকান খুইল্লা বসে ভেজালের।
-রাফাইত্তা তোরে আমি আস্ত রাখুম নাহ।
বলেই দু হাতে ওর চুল টে’নে ধরলো, আদ্রিশ ছাড়াতে গেলে এক হাতে আদ্রিশের আরেক হাতে রাফাতের চুল টে’নে ধরলো। এ দৃশ্য দেখে নিবিড় আগেই আমার পেছনে এসে দাড়িয়েছে।
-ভূতনি ক্ষেইপ্পা গেছে ভাই, থামা এইডারে, ঝাটা জুতা আন। আমাগো অকালে টাইকলা বানাই ছাড়বো
আমি আর শিমু উঠে আরশি কে জোর করে ছাড়িয়ে আনলাম।
-বাবারে,, মাথার ঘিলু উল্টাই দিছে শাকচুন্নি
-এরেকটু হইলে আমার খুপরি উইঠঠা আইতো ভাই, এইডারে হেমায়েতপুর পার্সেল কর,নয়তো কোনদিন আমাদের ন্যাড়া করে দিবো।
রাফাত আর আদ্রিশ মিলে হায় হুতাশ করা শুরু করেছে মাথায় হাত দিয়ে। শিমু আর আমি হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছি, আরশি তো চিল মুডে আছে ওদের কেলানি দিয়ে।
এর মাঝে হঠাৎ করেই নিবিড় আমার ডান হাত ধরে বললো
-আফু? তোর হাতে ব্যান্ডেজ করা কেনো, কাল দুপুরেও তো ঠিক দেখলাম, কি হয়েছে?
নিবিড়ের কথায় আদ্রিশ আর রাফাতের ও নজরে আসলো আমার হাতের শুভ্র ব্যান্ডেজ টা। ক্লাসে আরশি আর শিমুর মাঝে বসাই আর এতোক্ষণ মারামারি করার তালে ওরা খেয়াল ই করেনি
-তাই তো, আফু তোর হাত কা’টলো কি করে, কখন হলো এসব,আমায় বলিস নি কেনো তুই।
রাফাতের কথা শেষ হবার আগেই আদ্রিশ হাত ধরে টেনে দেখে বললো,
-দেখে তো মনে হচ্ছে অনেক খানি কেটেছে, চুপ করে আছিস কেনো আফু, বল কি করে হলো
আমি জানতাম ওরা জানতে পারলেই এমন অস্থির হয়ে যাবে, তাই আমি আগেই বলিনি।
-তোরা থাম,শান্ত হ। আমি বলছি
আমার কথার সাথে আরশি ও বললো
-এইটাই তো বলতে চাচ্ছি, কিন্তু তোরা গিলা, ভন্ডামি করা নিয়েই ঘন্টা পার করে দিলি৷ বলতে দিলি কই
-তোরা বলবি কি হয়েছে,তোদের কথা শুনে তো মনে হচ্ছেনা যে স্বাভাবিক কিছু,
-থাম, বলবো তবে এখানে নাহ। এটা ঠিক জায়গা হবে নাহ, টিএসসির মোড়ে চল। অনেক দিন যাইনা। আড্ডা ও দেওয়া হবে পুরো কাহিনি ও বলা হবে
ব্যাস,সবাই ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে পরলাম টিএসসির উদ্দেশ্যে। ঘন্টা খানেকের মধ্যে পৌছেও গেলাম। কোলাহল পূর্ণ রাস্তার পাশের চায়ের দোকান টায় দুটো বেঞ্চ দখল করে বসে আছি ছয়জন। হাতে গরম শিঙারা আর চায়ের কাপ। আরশি এসে একে একে সব ঘটনাই খুলে বলেছে, সব শুনে ওরা তিনটা একদম ভিডিওর মতো পজ হয়ে আছে, যেনো অবাকের শেষ নেই। রাফাত একটা ঢক গিলে বললো
-ভাই খুব রাগী, তবে সেটার প্রকাশ হতে খুব কমই দেখেছি৷ সবসময় ঠান্ডা মেজাজে থাকে,কিন্তু একবার রেগে গেলে তুফান তুলে।
-রাগী তা নাহয় মানলাম।তা বলে আফুকে এইভাবে কষ্ট দিলো। হাত টা কেটে কি অবস্থা। আমার একটুও ভাল্লাগলো নাহ ব্যাপার টা।
আদ্রিশ বেশ গোমড়া মুখ করে বললো
-ভাই, মানুষ এমনি। নিজের খুব পছন্দের জিনিস সে কখনও অন্যের কাছে দেখতে পারবে নাহ, হয় যত্ন করে আগলে রাখবে নয়তো ধ্বং’স করে দিবে,কিন্তু অন্যের কাছে কিছুতেই নাহ।
নিবিড়ের কথায়, শিমু টেনে টেনে বললো
-শুধু আরাব ভাইয়ের সাথে ফিরেছিস বলে এতো রাগ, তাও তো উনি চেনা জানা, অন্য কোনো ছেলেকে যদি তোর সাথে দেখে তাহলে তো খু’ন করে ফেলবে ভাই।
শিমুর কথা থামিয়ে রাফাত বললো
-আফু, ভাই তোরে প্রপোজ করেছে? আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে নাহ, মেঘ ভাইরে আমি জীবনে কখনো একটা রোমান্টিক ফিল্ম ও দেখতে দেখিনি, সেই ভাই আমার তোরে এইভাবে ঠা’স কইরা প্রপোজ কইরা দিলো। তুই কি যাদু করলি বইন রে
রাফাতের এহেন কথায় বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম,সবাই আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। ঘুরতে যাওয়ায় সময় টায় ট্রেনে ওভাবে আমার কোমর ধরে উঠানো,নৌকার ঘটনা সবাই কম বেশি দেখেছে, বেশ লজ্জা লজ্জা লাগলো। এদের সামনে লজ্জা পেতেও তো লজ্জা লাগে,ধুরর।
আরও দুই ঘন্টা ধরে চললো আমাদের আড্ডা, তারপর বাড়ি ফিরতে প্রায় দুপুর হলো। শিমু আর আরশি একসাথে বেরিয়ে গেলো৷ আমার হাজার বারণ সত্ত্বেও রাফাত ওর বাইকে করে নিয়ে আমার হাত ড্রেসিং করিয়ে তবেই ফিরলো।
~
সময় যেমন বহমান, তার সাথে মানুষ ও তার সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটনাও বয়ে যায় সময়ের তালে। সেদিনের পর তিনদিন পেরিয়ে গেছে। এখন আমার হাতের ক্ষতটাও শুকিয়ে এসেছে। এর মাঝে মেঘের সাথে আমার বার কয়েক দেখা হয়েছে, উনি প্রত্যেক বার ই কথা বলার চেষ্টা করেছেন আমিই এড়িয়ে গেছি। রোজ ই অফিস যাওয়ার পথে আমার সাথে চোখাচোখি হয়,যদিও উনি আমি নিচে নামা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন,তা আমার খুব ভালো করেই জানা। তবুও নিঃশব্দে এড়িয়ে যায় আমি। তাতে উনার ভেতরে কতটা আ’ঘাত লাগে সেটা উনার চোখ দেখেই স্পষ্ট বুঝা যায়।
হঠাৎ করে কলিং বেল বাজার শব্দে শুয়া থেকে উঠে গেলাম, ভার্সিটিতে যেতে হবে খানিক বাদেই। শিমু গোসলে গেছে, আমি কোনো কাজ না পেয়ে শুয়ে আছি।
দরজা খুলেই দেখি হালকা মিষ্টি কালারের প্রায় তিনফুট সমান একটা টেডি। টেডিবিয়ার টা ওর রঙের মতোই মিষ্টি, দেখেই আনন্দে আমি লাফিয়ে উঠেছি, নিশ্চয়ই শিমু অর্ডার করেছে, দু হাতে কোলে নিয়েই চুমু দিলাম কয়েকটা। টেডি আমার অন্যরকম দূর্বলতা। যতই রেগে থাকি আমায় টেডি দিলেই আমি বরফের মতো গলে যায়।
টেডি টার গলার দিকে চোখ যেতেই দেখি লাল ফিতার সাথে নীল রঙের একটা চিরকুট লাগানো
ওটা দেখে বেশ কৌতূহল নিয়ে খুললাম
“প্রিয়দর্শিনী
কি বলে সম্বোধন করবো বলো তোহ?
প্রাণহারীনি নাকি হৃদয়হারীনি!
দুটোরই হরণকারীনি তুমিই শুভ্রলতা
আমার বাধাহীন মনে ঝড়ো হাওয়ায় প্রবণ
তাই তো সদ্য আষাঢেও মনে নেমেছে শ্রাবণ
কি বলে সম্বোধন করবো বলো তোহ?
প্রিয়তমা নাকি অবাধ্য অনুভূতি
দুটোরই তোমাকে ঘিরেই পূর্ণতা
এই যে আমায় দেখে মুখ ফিরিয়ে নাও, রিনিঝিনি কণ্ঠের হাসি গুলো আমায় দেখলেই চাপিয়ে নাও, এতে আঘাত টা ঠিক কোথায় লাগে জানো? ঠিক কতটা লাগে বোঝো?
পাগল করেছো আমায়, মে’রেছো আমায়, তোমার প্রেমে প্রতিটি ক্ষণে ডুবিয়ে শত’ঘাতে মার’ছো মেয়ে তুমি আমায়।
আমাকে নাহয় ফিরিয়ে দিলে নিঃশব্দে, আমার দেওয়া প্রথম উপহার টাকেও কি একইভাবে ত্যাজ্য করবে নূর?
শুনেছি এই জিনিসটা নাকি তোমার ভীষণ পছন্দের, আমি যেমন পারিনা নিজের প্রিয় জিনিসটাকে ছেড়ে থাকতে, তুমি কি পারবে ফিরিয়ে দিতে?
আমি নাহয় পেলাম না ঠাঁই, আমি হতে পাঠানো উপহার টাই নাহয় রাখলে”
অজান্তেই অধর জুড়ে প্রজ্জ্বলিত হলো হাসির রেখা। চিরকুট নয় ছোটো খাটো একটা চিঠিই বলা যায়, প্রেরকের নাম উহ্য রাখলেও আমার চিনতে যে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয়নি তা প্রেরকের ও জানা। সিরিয়াস মুখ করে রাখা লোকটাও চিঠি লিখতে যানে? বেশ অদ্ভুত ভালো লাগায় ছেয়ে গেলো অন্তঃস্থল , যেনো অদৃশ্য হৃদয়াঙ্গমে মিলে গেলো। লেখা গুলোকে আকঁরে ধরেই আনমনে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম।
আনমেই কিছু অব্যক্ত শব্দগুচ্ছ মনে মনে আওড়ালাম
“ইন্দ্রনীলের গহীনে হৃদস্পন্দনের শব্দে, অচিন দমকা হাওয়ায় হারানো ভূবণ আমার
জুড়িয়েছে শরীরে আপনিময় মৃত্যু’রোগ, আদও নিরাময় সম্ভব কি তার!!”
.
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ