তুমি ছুঁয়ে দিলে এ মন পর্ব-১২

0
35

#তুমি_ছুঁয়ে_দিলে_এ_মন

পর্ব ১২

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

বিয়ের পাত্রি হিসেবে রাহুল তালুকদারের একমাত্র মেয়ে বিভার নাম শুনে আহনাফের হাসি যেনো আর থামছেই না। হাসতে হাসতে পেট হাত দিয়ে চেপে ধরে বিছানায় গড়াগড়ি দিতে থাকলো সে।
নিজের ছেলেকে এভাবে শাকিলা কোনোদিন হাসতে দেখেনি। পরিবারের সবাই মিস্টার বিন বা থ্রি স্টুজেজ দেখে যখন একযোগে গড়াগড়ি দিয়ে হাসে, আহনাফ তখনো হাসি চাপিয়ে রাখে। নিজের মধ্যে বরাবরই একটা ভারবাত্তিক ভাব বজায় রাখে আহনাফ। তবে আজ সে এমন হাসির কি বলেছে যে, ছেলে তার হেসে একেবারে বিছানায় লুটুপুটি খাচ্ছে! রাগে তার গা জ্বলে যাচ্ছে আহনাফকে এভাবে হাসতে দেখে।

শাকিলা চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

” থামবি তুই? আমি এমন হাসির কি বললাম? থাম বলছি!”

মায়ের ধমক খেয়ে আহনাফ থামলো বটে! তবে তার রেশ এখনো রয়েই গিয়েছে। হিঁচকি উঠে গিয়েছে তার। হিঁচকি দিতে দিতেই সে বললো,

” মা তুমি আজ মিস্টার বিন কেউ হার মানালে! তো, কে পাঠিয়েছে তোমার কাছে এই বিয়ের প্রস্তাব?”

শাকিলা খেসারতের স্বরে বললো,
” কে আবার? রাহুল তালুকদারের আবার ঘটক পাঠানো লাগে? বন্ধু মানুষ! ফোন করেই তোর বাবাকে বলেছে, আর তোর বাবা আমাকে, আর আমি তোকে।”

আহনাফ আবার বি’কট ভঙ্গিমায় হাসতে লাগলো।

শাকিলা ক্ষেপে গিয়ে বললো,

” আমার কথায় তোর হাসি লাগে, তোকে দেবো এক থাপ্পড়! বড় হয়েছিস দেখেই মায়ের সাথে বেয়াদবি করিস? মা কে মা মানিস কিন্তু নইলে আমি ছেলে মানবো না!”

আহনাফ বুঝতে পারলো তার মা বেশ সিরিয়াস হয়ে গিয়েছে এবার। মা বেশি ক্ষ্যা’পলে আবার মানানো দায়, তাই নিজের মুখেও সিরিয়াস ভাব এনে বললো,

” মা, তুমি জানো না। মেয়েটা আমার কলেজের স্টুডেন্ট! ঐ মেয়েকে আমি প্রতিদিন ক্লাশে কান ধরাই, পানিশ করি। ভীষণ শয়তান, দুষ্ট আর গর্দভ! ম্যাথের কিচ্ছু বুঝে না, আবার বুঝিয়ে দিতে গেলেও না বুঝেই আমার দিকে হা করে চেয়ে থাকে আর নখ দিয়ে খোঁচা দেয়, আজব ক্যারেক্টার!”

শায়লা হেসে বললো,

” হুম, মেয়েটা তোকে ভীষণই পছন্দ করে, তাই এমন করে, মেয়েটা কিন্তু অনেক লক্ষী, সব গুণই আছে, রান্না বান্না, সেলাই সব পারে!”

আহনাফ হেসে বললো,

” ওয়েট ওয়েট মা, আই থিংক কচু পারে! যার এত বড় বড় নখ! তার সারাদিনই তো যায় ঐ নখের যত্ন নিতে, তুমি বিশ্বাস করবা না মা, একেক নখে একেক রংয়ের নেইলপলিশ। চোখে লেন্স পড়ে বিলাই চোখ বানায়া রাখে, চুলে কালার করে ঘোড়ার লেজের মতো বানিয়ে রেখেছে, গত ক্লাশ পরীক্ষায় মাত্র পাঁচ পেয়েছে তাও আরেকজনের টা দেখে, তুমি কিভাবে ওর সাথে আমাকে মেলাও? আমি কেমন স্টুডেন্ট ছিলাম বলো? একটা লেভেল আছে না মা?”

শায়লা আগের সেই ক্ষ্যাপা দৃষ্টি অব্যাহত রেখেই বললো,

” হ্যাঁ, মানলাম তুই তুই গনিতে মাস্টার! একটা লেভেল তো অবশ্যই আছে, তোর বাবা আর আমি সারাজীবন প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করে আর কি উপার্জন করেছি, আর কি জমিয়েছি? সবই তো তোদের পড়াশুনা, সংসার খরচ, খাওয়া দাওয়া আর আমাদের ঔষধেই শেষ হয়ে গিয়েছে, শ্বসুর শাশুড়ীকে আমৃত্যু দেখেছি। এই বাড়িটা কোনোক্রমে করেছি, আর জমি কেনার সময় কত ঝক্কি ঝামেলা করে জমিটা কিনেছি! রাজনৈতিক নেতাদের দাপটে ছাদ দেওয়ার পরো জমিটার দলিল ভুয়া বলে নিম্ন আদালত রায় দেয়, একতলা বাড়ি সহ জমিটা প্রায় হারাতে বসেছিলাম, যখম সবাই মিলে প্রায় গাছতলায় রাত কাটাতে ধরেছিলাম, ঠিক তখনি ঐ রাহুল তালুকদারই এগিয়ে এলো। রাহুল তালুকদার বড় রাজনৈতিক নেতা! তার জন্যই আমরা এই বাড়িটা ফিরে পেলাম। এখন তুই ই বল ওদের সাথে আমাদের অর্থবিত্তের কি কোনই লেভেল আছে? ”

আহনাফ বিরক্তি নিয়ে বললো,

” ওহ! রাহুল তালুকদারের প্রতি তোমাদের প্রতিদান তো তোমরা অন্যভাবেও শোধাতে পারো, আমাকেই সওদা করে কেনো?”

শায়লা বজ্রকন্ঠে বললো,

” তোকে আমরা সওদা করছি? এত বড় কথা তুই বলতে পারলি? ”

আহনাফ মুখ ত্যাড়িয়ে বললো,

” সওদা নয় তো কি? না হলে আমার অমতে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলো তুমি? ”

” আমরা তোর মা বাবা, সামান্য বিয়ের ব্যাপারে একটা মতামতও কি আমরা দিতে পারি না তোর?”

আহনাফ মৃদু হেসে বললো,

” একবার তো জিজ্ঞেস করতে পারতে আমার কোনো পছন্দ আছে কিনা?”

শায়লা বললো,
” আমাদের পরিবারে কেউ নিজেদের পছন্দমতো বিয়ে করে না, সবাই বাবা মায়ের পছন্দমতোই বিয়ে করে, তা তোর জানাই ছিলো, তবুও?”

আহনাফ মায়ের দিক থেকে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো,

” আচ্ছা, তোমরা তোমাদের পছন্দ নিয়ে থাকো, আমি আজীবন কুমারই থাকবো, তবুও ঐ মেয়েকে বিয়ে করবোনা! এটাই আমার ফাইনাল কথা! এখন তুমি আসতে পারো, আমি ঘুমাবো, সকালে কলেজে ক্লাশ আছে”

শায়লার চোখ মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো ছেলের কথা শুনে। সে কাঁদতে কাঁদতেই আহনাফের রুম থেকে বের হলো।

বের হওয়ার আগে বললো,

” তবে আমি রাহুল তালুকদারকে কথা দিয়ে দিয়েছি, সেই কথা আর আমি ঘুরাতে পারবোনা, এখন সিদ্ধান্ত তোর! তুই তোর মা বাবাকে ডুবাবি নাকি ভাসাবি?”

এ কথার উত্তরে মি.লি.আহনাফ চুপ করে রইলো।
.
.

পরের দিন কলেজের ক্লাশে রাত্রি এলো, এতদিন পর! এতদিন বোনের বিয়ে শেষ করতে করতে সে পড়াশোনাও চাঙ্গে তুলে দিয়েছে। এতদিন পর কাছে পেয়ে বাকি চারজন অর্থাৎ ত্রিশা, ঊষা, ত্রিণা আর স্নিগ্ধা ওকে জড়িয়ে ধরে উল্লাস করলো। তারপর ক্লাশে বসেই ত্রিশা ওকে যে সকল ক্লাশ করতে পারেনি সেগুলো বুঝিয়ে দিচ্ছিলো। কিন্তু রাত্রি সবকয়টা বিষয়ই প্রাইভেট পড়ে বিধায় এই পিছিয়ে পড়া ওর তেমন ক্ষতি করতে পারবে না। ত্রিশা রাত্রির সব পড়া বুঝিয়ে দেওয়া শেষ করলে রাত্রি ওকে জড়িয়ে ধরলো,

” তোর মতো বান্ধবী হয় না রে ত্রিশা, এত নি:স্বার্থভাবে তুই আমাদের কথা ভাবিস! তোর মতো স্বার্থহীন মানুষ এ জামানায় পাওয়া দায়! ”

ত্রিশা হেসে বললো,

” আমি কিছুই করি না বরং তোরাই আমার জন্য যা করিস তার ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারবোনা রে! ”

কারন এ পর্যন্ত ত্রিশার পড়াশোনায় যত ধরনের সমস্যা হয়েছে, সব বান্ধবীরাই সমাধান করে দিয়েছে। ওদের প্রাইভেট টিচার হতে প্রাপ্ত সব নোটই ওরা প্রিয় বান্ধবী ত্রিশাকে দিয়েই পড়তো। আর জামা, জুতা, কসমেটিকস যে যা পারে ইচ্ছেমতো গিফট করতো সবাই। জন্মদিনের দিন স্কুলেই বড় কেক কেকে বান্ধবীরাই ত্রিশার জন্মদিন সেলিব্রেট করতো। ওদিকে সংসারের কাজের চাপে কনকাচাপার স্মরণই থাকতো না নিজের মেয়ের জন্মদিনের কথা। যদিও ত্রিশা কোনোদিন কোনো বান্ধবীর জন্মদিনেও কাউকে কিছু দেওয়ার সামর্থ রাখতো না।

বান্ধবীদের সাথে ত্রিশা যখন এরকম আলাপচারিতায় ব্যস্ত ছিলো ঠিক তখনি বিভা এলো ওদের কাছে। নিজের মাথার বিদঘুটে বাদামী চুলগুলো উড়াতে উড়াতে সে বললো,

” এই যে! স্টার জলসা পার্টি! তোমরা মেয়েতে মেয়েতে এতো জড়াজড়ি করছো কেনো? নাকি সামথিং রং?”

ঊষা চটে গিয়ে বললো,

” ঐ মুখ সামলে কথা বল বিভার বাচ্চা!”

বিভা ওর নেইলপালিশ রাঙ্গানো নখগুলোতে ফুঁক দিয়ে বললো,

” তাহলে তোদের ফ্রেন্ড গ্রুপে কোনো ছেলে নেই কেনো? তোরা মেয়েতে মেয়েতে কি করিস, এত ফস্টিনস্টি? আবার সেদিন দেখি ঊষা ত্রিশাকে চুম্মা দিচ্ছে, ব্যাপারটা কি?”

এবার রাত্রি বলা শুরু করলো,

” মুখ সামলে কথা বলিস! ছেলে দেখলে তো তোর হুস থাকে না। আর আমরা তো তোর মতো কুত্তা না! আহনাফ স্যারকে দেখলে তোর মুখ দিয়ে কুত্তার মতো লালা পড়ে কেনরে?”

বিভা ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,

” আমাকে কুত্তা বলিশ লে’জবিয়ান কোথাকার! আহনাফ ইজ মাইন, মনে রাখিস, কয়েক মাস পরেই ওর সাথে আমার বিয়ে, তখন দেখবি, আহনাফ আমার হাত বগলে নিয়ে হাঁটবে, সেই দিন আর বেশি দেরি নাই”

এ কথা শুনে স্টার জলসা পার্টির সবাই একযোগে হেসে দিলো। আর হাসতে হাসতে বললো,

” ঐ যা যা! আহনাফকে বিয়ে করে আসিস আমাদের বাসায়! তোর আগাম দাওয়াত রইলো, যা ভাগ এখন! ”

তাড়িয়ে দেওয়ার পরো বিভা যখন নড়লো না, তখন বিভাকে আরো রাগাতে স্নিগ্ধা বলে উঠলো,

” আরে! আজই তো আবার তোর আহনাফ জামাই তোরে গোটা ক্লাশ কান ধরায়া বাইরে দাঁড় করায়া রাখবে দেখিস, তখন বলিস আসো রোমান্স করি বেইব, আসো আসো! তারপর দেখিস কি হাল করে তোর! ”

এসব বলেই ওরা বিভার সামনে দিয়ে একযোগে হাসতে হাসতে সামনে দিয়ে ক্লাশে চলে গেলো।

বিভা দাঁত কটমট করে করে বললো,

” আমাকে অপমান! দেখে নেবো সব কয়টাকে!”

কিন্তু ওর কথা কেউ কানেও তুললো না।
.
.

ক্লাশ শেষ করে ত্রিশা আবার ছুটলো আহনাফের কাছে পড়তে।

” সব হোমওয়ার্ক করে এনেছো ত্রিশা?”

ত্রিশা হ্যাঁ বলে ওর খাতা বের করে দিলো। খাতা খুলতে খুলতে আহনাফ বললো,

” দারুন! দারুন! তোমাকে পড়ানো আমার অনেক সুবিধা হবে, তুমিতো বেশ রেসপনসেবল ত্রিশা, ভালো গাইডিং পেলে তুমিও ক্লাশে প্রথম হতে পারবে!”

ত্রিশা খুবই খুশি হলো। স্যারের মুখে এত সহজে প্রশংসা বের হয় না, কিন্তু পরপর দুইদিন আহনাফ ওর প্রশংসা করলো। ত্রিশা হেসে দিলো। আহনাফ ওর হাসির দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললো,

” তোমার হাসি এতই সুন্দর যে তোমাকে সুহাসিনি বললে ভুল হবে না, আমি কি তোমাকে সুহাসিনি বলে ডাকতে পারি?”

ত্রিশা ভীষণই লজ্জা পেলো। এত বেশি যে, লজ্জা যেনো ওর চোখ মুখ ঠিকরে পড়ছিলো।
তাই একটা কথাও ওর মুখ দিয়ে বের হলো না। তাই নিশ্চুপ থাকলো।

পড়া শেষ করে আহনাফ আর ত্রিশা একসাথে হেঁটে রাস্তায় যাওয়ার সময় বেশ খানিকটা পথ এলো গল্প করতে করতে।
আহনাফ বুঝতে পারলো, ত্রিশা লজ্জা পাচ্ছে। লজ্জা পেলেও তো মেয়েটাকে বেশ লাগে! আহনাফ ওকে আরো লজ্জা পাইয়ে দেওয়ার উদ্দ্যেশ্যে বললো,

” ত্রিশা একটা আবদার করি তোমাকে? ভয় হচ্ছে, তুমি আবার ভাববে কিনা যে, অন্যায় আবদার! ”

ত্রিশা মাথা নিচু করে রিমরিম করে বললো,

” জ্বী, করুন?”

” মাথার স্কার্ফটা সরিয়ে চুলগুলো একটু ছেড়ে দিবে প্লিজ?”

ত্রিশা স্যারের এ আবদার শুনে আহনাফের ঠিক চোখের পানে চাইলো, আহনাফের চোখে মুখে ত্রিশার জন্য ভালোবাসা ও আবেগের তৃষ্ণা!

ত্রিশা স্কার্ফ খুলে ওর কোমড় ছাড়িয়ে যাওয়া কালো কোঁকড়া চুলগুলো পিঠের উপর ছড়িয়ে দিলো।

এক ঝাপটা বাতাস এসে উড়িয়ে নিয়ে গেলো চুলগুলোকে। আহনাফের চোখে ত্রিশাকে এক কেশপরীই মনে হচ্ছিলো। যা সে বলবে না বলে ভেবেছিলো তাও তার মুখ থেকে বের হয়ে এলো,

” আ’ম ইন লাভ উইথ ইউ ত্রিশা!”

(চলবে)