তুমি ছুঁয়ে দিলে এ মন পর্ব-২২

0
30

#তুমি_ছুঁয়ে_দিলে_এ_মন

পর্ব ২২

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

মায়ের কল পেয়ে আহনাফের কন্ঠস্বর যেনো রোধ হয়ে এলো।
ত্রিশা জিজ্ঞেস করলে উত্তরটাও দিতে পারলো না যে, কি ঘটেছে সেখানে।
শায়লার কন্ঠস্বর এতটাই আ’তংকিত ছিলো যে, প্রিয়তমার হাতে রান্না করা খাবারও খাওয়া সম্ভব হলো না আহনাফের। বাইক নিয়ে দৌড়ে চলে গেলো বাসায়।

বাসায় এসে সবার থমথমে মুখ দেখে ভীষণই বিচলিত হয়ে গেলো আহনাফ। বাবা আশফিক সব খুলে বললো, দু’র্বৃত্তরা তাদের বাড়ি থেকে উৎখাত করার হু’মকি দিয়েছে। এমনকি সময়ও বেঁধে দিয়েছে শুধু সেদিনকার রাতটা। তাদের বাড়ির জমি কেনার সময় যে দলিল করা হয়েছে তাকে ভুয়া বলে নিজেদের দলিলকে তারা আসল দাবী করছে দু’র্বৃত্তরা। আর এদিক দিয়ে জমির মালিক দেশান্তরি। কোর্টে বহুদিন থেকেই মা’মলা ঝুলে আছে। তবে সেই পক্ষ কোর্টের সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ। তাই তারা আবার সেই বাড়িসুদ্ধ জমিই দখল কর‍তে চলে এসেছে।

“তারা ক্ষমতাসীন দলের বলেই তাদের এত দাপট, এর আগে রাহুল চৌধুরী নিজে ঐ জমির বিষয়টা সুরাহা করেছিলো দশ বছর আগে, ঐ পক্ষ মেনেও নিয়েছিলো, এখন আবার দশ বছর পর ঐ পক্ষ নিজেদের অপ্রতিষ্ঠিত দাবী নিয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। তবে মেইন কালপ্রিট হলো জমির মালিক। ঐ লোক এক জমি দু বার দু জনের কাছে বিক্রি করেছে! ওকে হাতে পেলে সব ঠিক হয়ে যেতো।”

আশফিক থমথমে মুখে এসব ছেলেকে বুঝিয়ে বললেন।

“লোকগুলো ক্ষমতাসীন দলের হওয়ায় ওদের এত দাপট আর এখন আবার রাহুল চৌধুরীর সাহায্যও বা কোন মুখে চাই? আফসোস! তার দেওয়া বিয়ের প্রস্তাব যে ফিরিয়ে দিয়েছি! সারা জীবনের সঞ্চিত টাকায় এ জমিটা কিনে বাড়িটা করেছিলাম, আর সেটাও ধরে রাখতে পারছি না!”

শায়লা চিন্তিত স্বরে ছেলেকে এসব বললো। বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ায় এখন যেনো তাকে অনুতাপ কুরে কুরে খাচ্ছে!

আহনাফ মায়ের এ ধরনের কথা শুনে বি’রক্তি নিয়ে বললো,

” কারো সাহায্য চাইতে হবে না মা, আমিই দেখছি”

একথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেকে থামালেন শায়লা,

” অনেক দেখেছিস, আর দেখতে হবে না। ছাত্র জীবনে একবার ক্ষমতাসীন দের মা’র খেয়ে হাত পা ভেঙ্গে বিছানা নিয়েছিলি না, মনে নেই? এটা নাটক সিনেমা না যে তুই একাই একশ জনকে মে’রে ভর্তা বানাবি আর তোর কিচ্ছুটি হবে না? ”

আহনাফ শুষ্ক মুখে বললো,

” তাহলে আমার সেই পি বি আই এর সেই বন্ধুকে ডাকি?”

” তোর মাথা কি খে’য়েছিস নাকি? পি বি আই এর সেই বন্ধু হলো, ইনভেস্টিগেশন অফিসার? বিভিন্ন তদন্ত ও গোয়েন্দা কার্যকলাপ চালায়, আর সে তো সরকারি লোক, সরকারের বিরুদ্ধে সে কি করবে?”

আশফিক ছেলেকে ধমকে একথা বললো।

” এখন উপায় কি?” আহনাফ উকিলকে কল দিতে চাইলো!

তবে আশফিক তাও মানা করে দিলো।
” আমাদের উকিলকে বহুত টাকা খাইয়েছি, ও যে আর কি করতে পারবে তা বলাই বাহুল্য, তুই বরং রাহুল চৌধুরী কে একবার কল দে”

বাবার এ ধরনের কথা শুনে আহনাফ বাবার কথাকে স্পষ্ট ভাষায় নাকচ করে দিয়ে বললো,

” তোমার কি মাথা খা’রাপ হয়েছে বাবা? আমি রাহুল চৌধুরী কে কল দেই, আর সে এর বিনিময়ে আমাকে বলে বসবে যে, তার মেয়েকে যেনো বিয়ে করি, আমি কোনো ক্রমেই তাকে কল দিবো না, হারগিজ না! এ বাড়ি ঘর হারালেও তো তাকে আমি কল দিবো না!তোমার না বন্ধু হয় সে, তুমিই কল দাও? আর সে তোমার কেমন বন্ধু যে বন্ধুর একটা উপকার করলেই সে উপকারের প্রতিদান চায়?”

আশফিক ছেলের অবাধ্যতাকে যেনো মানতে পারলো না, তবে তার চেহারার রুক্ষতায় তা ফুটে উঠলো। আর শায়লার চেহারায় অজানা শংঙ্কা!

তবে আহনাফ বাবার রুক্ষতাকে গুরুত্ব দিলো না, সে এখন ভীষণ টায়ার্ড। নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ত্রিশাকে গভীর ভাবে অনুভব করতে থাকলো। মেয়েটা এই পরীক্ষার আগেও তার জন্য ইলিশ কোরমা রান্না করতে রান্নাঘরে ঢুকেছিলো, আর সে কিনা না খেয়েই চলে এলো? মেয়েটা না জানি কতটা কষ্ট পেয়েছে? ভীষণই কথা বলতে ইচ্ছে হলো ত্রিশার সাথে। তাই দ্রুত ফোন উঠিয়ে কনকচাপার নাম্বার ডায়াল করলো। ত্রিশা এখনো নিজের ফোন ব্যবহার করেনা। তাই আহনাফ মাঝে মাঝে কনকচাপার ফোনেই কল দেয়। তাও মাত্র এক দু মিনিটের বেশি কথা বলা হয়না ওদের মধ্যে। আহনাফ চায়না ত্রিশার গায়ে কোনো দোষ লাগে। কেননা এতদিনে এলাকার অনেকেই এটা বলে ফেলেছে যে, ত্রিশা নিজের টিচারের সাথে প্রেম পরিণয়ে আবদ্ধ হতে যাচ্ছে! ভালো মেয়ে হলে কি আর টিচারের সাথে প্রেম করে? অথচ ত্রিশা এ পর্যন্ত একবারো আহনাফের সাথে ডেইট এ যায়নি কিংবা লম্বা সময় গল্পগুজবও করেনি। এখনো দুজনের সম্পর্ক শুধু মাত্র ছাত্রী শিক্ষকেরই ন্যায়, যদিও মানুষের মুখের কথায় ত্রিশার বা আহনাফের তেমন যায় আসেনা, তবুও ত্রিশার রেজাল্ট ভালো না হলে, মানুষের দেওয়া খোঁচার প্রত্তুত্তর দেওয়া সম্ভব নয়।

সাত পাঁচ ভেবে আহনাফ ত্রিশাকে কল দিলো।

কনকচাপা রিসিভ করে প্রাথমিক কিছু কথাবার্তা বলে ত্রিশাকে দিয়ে দিলো।

” স্যরি, আমাকে না খেয়েই চলে আসতে হয়েছে! তুমি শুনছো ত্রিশা!”

ত্রিশা কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো,
” সমস্যা নেই, আপনার বাড়ির সমস্যা কেটেছে?”

” নাহ! ও সমস্যা কাটবার নয়, জানো? সমস্যামুক্ত হওয়ার শর্ত হলো বিভাকে বিয়ে করা, কারন আমার বাবা মায়ের বিশ্বাস একমাত্র রাহুল চৌধুরীই এ সমস্যা থেকে রক্ষা করতে পারে…হা হা হা!”

ত্রিশা একথা শুনে আর আহনাফের হাসি শুনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলো আর ভাবলো। তবে তার ক”লিজাটা যেনো কচকচ করে ছু’রিকাঘা’ত করা হলো।

বুঝতে পেরে স্তব্ধতা ভেঙ্গে আহনাফ নিজেই বলে উঠলো,

” ত্রিশা তুমি জানো না, তোমাকে ভালোবেসে আমি কতটা গভীরে চলে গিয়েছি। আমাকে ও বাড়ি থেকে কেনো দুনিয়া থেকেও উৎখাত করে দিলেও তোমাকে ছাড়া অন্য কারো হবো না আমি”

ত্রিশা হেসে দিলো।

আহনাফ বললো, তুমি খেয়েছিলে ত্রিশা? মানে, যা রান্না করেছিলে তা কি এখনো আছে?

” বিলিভ মি, আমি এখনো ডাইনিং এ খাবার সামনে নিয়েই বসে আছি, ডাইনিং এ খাবারগুলোর সামনে বসেই পড়ছি, মা বহুবার খেয়ে নিতে বলেছে, তবে আপনাকে ছাড়া খাবার মুখে উঠলো না”

” ওয়েট ত্রিশা, আমি পাঁচ মিনিটেই আসছি”

বলেই আহনাফ ফোন রেখে দিলো।

আজ কি হয়েছে আহনাফের ত্রিশা বুঝে উঠতে পারলো না। সেই যে বিকেলে পড়িয়ে চলে যায়, আর তো এদিকে আসে না। বান্ধবীরা ওকে ভৎসনা করে,
” ঐ আহনাফটা একটা টিচার ম্যাটেরিয়াল, মোটেও লাভার ম্যাটেরিয়াল না! আর বেশি হ্যান্ডসাম পোলারা ভালো প্রেমিক হইতে পারে না, আর তুই ও তো একটা ফিলিং লেস তালগাছ! মিলছে ভালো, দুইটাই অকম্মা!”

রাত্রি আর ত্রিনা প্রায়ই ত্রিশাকে এভাবে খুঁচিয়ে বলে।

আর স্নিগ্ধা আর ঊষা দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
” ভাগ্যিস আমাদের কোনো প্রেমিক হলো না জীবনে, আর প্রেম বিষয়ক ফ্রি উপদেশ ও আমাদের ঘটে নাই!”

বান্ধবীদের কথাগুলো মাথায় আওড়াতে আওড়াতেই হাসতে হাসতে ত্রিশা ডাইনিং ছেড়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো।
একটা দোতলা বিল্ডিং এর একটা মাঝারি ফ্ল্যাটে ওরা ভাড়া থাকে।

আহনাফ আসতেই দাঁড়োয়ান গেইট খুলে দিলো। আহনাফের রেফারেন্সেই ওরা এ বাড়ি ভাড়া পেয়েছিলো। ত্রিশার হবু জামাই বলে এ বাড়িতে যখন তখন প্রবেশের অনুমতি আছে আহনাফের। তবুও দাঁড়োয়ান বা অন্যান্যদের কাছে এটা এখনো রহস্য যে, এটা ত্রিশার হবু জামাই নাকি শুধুই টিচার?পড়াশুনার বাইরে এদের আর কোনো কথাবার্তা নাই! তবে আজ রাতে চলে আসায় দাঁড়োয়ান সামান্য আশ্চর্য হলো।

দ্রুত গেইট খুলে দিতেই গটগট করে উপরে উঠে গেলো আহনাফ।

বিকেলে যখন পড়াতে এসেছিলো, তখন ত্রিশাকে খেয়াল করেনি সে। এখন একটা গোলাপি রং য়ের গোলজামা পড়ে আহনাফের সামনে দাঁড়ালো সে।
বাসায় এত বড় বিপদ আর আজই তার ত্রিশাকে বিয়ে করে ফেলতে মন চাইছে।

ত্রিশার হাতের আঙ্গুল কা’টা থাকায় নিজ হাতে খাইয়ে দিলো আহনাফ। বান্ধবীদের মনে মনে ভৎসনা করলো, ” কে বলে আহনাফ রোমাণ্টিক নয়?”

দুজনে খাওয়া শেষ করতেই লোড শেডিং হয়ে গেলো।

ছাদে তখন আকাশ ভর্তি ভরপুর তারা। চাঁদের আলোও জ্বাজল্যমান। ছাদে এসে রেলিং ধরে দাঁড়ালো দুজন। নির্বাক দুজনে দুজনার দিকে একদৃষ্টে বহুক্ষণ।

ঠিক তখনি মিরাক্কেলের মতো আহনাফের ফোনে রাহুল চৌধুরীর কল এলো।

আহনাফ রিসিভ করতে বেশ দ্বীধা করছিলো।
তবে ত্রিশা রিসিভ করার তাগাদা দেওয়ায় রিসিভ করলো।

“একসাথে আটটা স্লিপিং পিল খেয়ে বিভা ঘুমিয়েছিলো, স্টমাক ওয়াশ করানো হয়েছে, এখন জ্ঞান ফিরে শুধু তোমার নামই জপছে, দয়া করে একবার এভার কেয়ার হসপিটালে আসতে পারবে? আমি তোমার কাছে ভিক্ষা চাচ্ছি বাবা?”

আহনাফ সরাসরি বিনা বাক্যব্যয়ে ” না ” শব্দটা বলে ফোন কেটে দিলো।

(চলবে)