#তুমি_ছুঁয়ে_দিলে_এ_মন
পর্ব ২৮
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
ত্রিশাহীন আহনাফের একটা বছর পার হয়ে গেলো। প্রিয়তমাহীন একটি বছরের দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী পার করাকে যেনো তার কাছে কয়েক যুগ মনে হচ্ছিলো।
যে কাজই করুক না কেনো সে, কিছুক্ষণ পরপর শুধু একটা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে ত্রিশাকে স্মৃতিকে স্মরন করতো। মাঝে মাঝেই ত্রিশা ত্রিশা বলে চিৎকার করতো। কষ্টে বুকটা চৌচির হয়ে যেতো তার!
এই একটা বছরের প্রথম কয়েক মাস অস্বাভাবিকের ন্যায় আচরন করেছিলো আহনাফ।
প্রথমে হসপিটালাইজড, তারপর ঘুমের ঘোরে দু:স্বপ্ন দেখে লাফিয়ে উঠা, ডাক্তারি ভাষায় যাকে বলে অবসেসিসভ স্লিপিং ডিজ অর্ডার; যার ফলশ্রুতিতে ঘুমাতেই ভয় পেতো সে।
স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুমানোর অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো।
খাওয়া, নাওয়া সব বাদ দিয়ে নদীর তীরে এক জনমানবহীন শ্বসান ঘাটে গিয়ে সারাদিন বসে থাকতো। স্বাভাবিক হতে অনেক সময় লেগেছিলো তার।
যখন সে এটার প্রমাণ পেয়েছিলো যে, “ত্রিশার বিয়ের ছবিটা কোনো এডিটেড বা ফেইক ছবি নয়, এটা একটা রিয়েল ছবি।” তখন মূলত সে সত্যিকার ধাক্কাটা খেয়েছিলো। বহুদিন পাগলামী করে, ডিপ্রেশনে ভোগার পর সে মোটামুটি ঠিক হতেই এলাকাই ছেড়ে দেয়। যে শহর জুড়ে শুধু ত্রিশারই স্মৃতি সেখানে থাকা বিশাল কষ্টের ব্যাপার হয়ে গিয়েছিলো তার জন্য। তাই নিজের জেলা শহর ছেড়ে ঢাকায় এসে প্রথমে একটা মেসে উঠে সে।
ত্রিশার প্রতি তার আক্রোশ কোনো কালেই ছিলো না, তবে একটা প্রশ্ন শুধু করার ছিলো, ” আহনাফকে ছেড়ে সে এতদিন কেমন ছিলো?”
যদি সত্যিই ভালো থাকে তবে সে থাকনা তার সুখপাখিকে নিয়ে সুখের নীড়েই! শুধুশুধু কেনোই বা তাকে ফিরিয়ে আনা?
ওদিকে শুরুর দিকেই আহনাফের বিরুদ্ধে আনিত সকল অভিযোগও মিথ্যে প্রমানিত হয়েছে। মামলাটাও মিটে গিয়েছিলো।
এলাকায় নিজেদের মান সম্মান আবার ফিরে পেয়েছে আশফিক ও শায়লা। চাকরিতেও ফিরে যেতে পারতো, তার পরো শিক্ষকতার পেশা আহনাফকে আর টানছিলো না।
ঢাকায় এসে সে একটা সংবাদপত্রের সহ- সম্পাদকের দায়িত্ব নেয়। পাশাপাশি নিজের সংগঠনের সাধারন সম্পাদক। পাশাপাশি বহু কষ্টে নিজের গড়ে তোলা রাজনৈতিক দলটাও আবার পুনর্গঠন করেছে সে। দেশের ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে আগের মতো আর তাকে জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়নি। তারপরো আগের সব কর্মী- সদস্যদের সুসংগঠিত করা, তাদেরকে নিয়ে নতুন নতুন নিত্তনৈমিত্তিক কর্মপরিল্পনা করা এসব বেশ কষ্টকর ছিলো তার পক্ষে।
রাহুল চৌধুরীর সাথে শায়লা-আশফিক পরিবারের একটা ভালো সুসম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিলো এ কয়দিনে, যেহেতু রাহুল চৌধুরীই আহনাফকে ছাড়িয়ে এনে মামলা মিটে যাওয়ার জন্য বহু উকিল ও সাক্ষী যোগাড় করে।
এক্ষেত্রে রাহুল চৌধুরীর অবদান তারা কখনো অস্বীকার করে না!
ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর রাহুল চৌধুরী নিজের দলীয় সৌর্য্য- বির্য্য হারালেও, বিভা পালটায় নি। সে আগের সেই খামখেয়ালিপনা নিয়েই পড়ে আছে। রাহুল চৌধুরী নিজের একমাত্র মেয়ের খুশির জন্য নিজের সকল সম্পত্তির উইল করে দিয়েছে মেয়ের নামেই।
বাবার কাছে যে জিনিসের আবদার করে তা সে নিয়েই ছাড়ে। সেটা একজনের জানই হোক না কেনো!
আহনাফ ঢাকায় চলে যাওয়ার ছয় মাস পর বিভাও পরের ব্যাচের সাথে এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়ে ঢাকায় চলে গিয়েছে। একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে সেখানেই উঠেছে, আর ভর্তি হয়েছে একটা প্রাইভেট ভার্সিটি তে। মাঝে মাঝে সে পার্টি অফিসে ধন্না দেয় আর কখনো বা সম্পাদকের কার্যালয়ে। তবে আহনাফ ওর দিকে মুড়েও তাকায় নাহ! অন্যদের দিয়ে বিভাকে বুঝিয়ে সরিয়ে দেয়। জোর করে যে ভালোবাসা হয়না সেটা তখনো ওর আত্মপলব্ধি হয়নি। স্বাধীনচেতা পুরুষকে ভালোবাসার বলয় ছাড়া অন্য কোনো বলয়েই কোনো নারী কোনোক্রমেই বাঁধতে পারেনা এটাও বিভার জানা নেই, এটা জানা বিভার জ্ঞানের ত্রি-সীমায়ও পড়েও না।
শায়লার মনে আকাঙ্খা। ছেলেকে বিয়ে তো করাতে হবে?
কিন্তু আহনাফ ওসব কথা শুনতেই নারাজ।
” আগে নিজের দলকে একটা সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাই মা, তারপর অন্য কোনো কথা বলো মা!”
শায়লা তবুও নাছোড়বান্দা।
“এভাবে আর কতদিন? ত্রিশার খোঁজ তো কম নেওয়া হয়নি, আর না পাওয়া গেলে বিকল্প দেখতে হবে তো! ওর জন্য এত অপেক্ষা করতে হবে কেনো? ওর মুখ থেকেই সবটা শুনতে হবে কেনো? ওর বিয়ের ছবি দিয়ে মেয়ে ফুটেছে, তার মানে ও বিয়েই করে নিয়েছে। দশটা দিন শুধু জেলে ছিলি তাই ও বিয়ে করে ফেলতে পারে? আর বিয়ে করে লজ্জায় তোর সামনে আসতে পারেনি, তাই আসেনি। ঠকিয়েছে যে তোকে, কথা দিয়ে কথা যে রাখেনি সে! তাকে মনে করে আর কত কষ্ট পাবি? আর কত পুড়বি?”
একনাগাড়ে বলা শায়লার এসব কথা শুনে আহনাফের মেজাজ চড়ে গেলো। চেঁচিয়ে সে বলে উঠলো,
” স্টপ মা স্টপ! প্লিজ স্টপ! ”
আর মুখে একটা কথাও না বলে সে হনহন করে বের হয়ে যায়।
.
.
বিভা প্রায় প্রতিদিনই আহনাফের পার্টি অফিসে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। অন্যান্য নেতা কর্মী না থাকলে আহনাফের সাথে কথা বলার চেষ্ঠা করে।
” আপনার জীবনে কে আছে যে, আপনি আমাকে এভাবে এভয়েড করছেন? বেঈমান ত্রিশা তো সেই কবেই আপনাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে! আপনি নিজেকে কি প্রিন্স চার্লস মনে করেন ? এত ইগো কেনো আপনার?”
বিভার এতগুলো প্রশ্নে আহনাফ এবার ক্ষাণিক দাঁড়ালো! বিভাকে আশ্চর্য করে দিয়ে প্রাণ খুলে হেসে দিলো সে। বিভা আশ্চর্য হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলো। যে আহনাফ বিভার দিকে মুড়েও দেখতো না, সে ই তার চোখের দিকে গাঢ় দৃষ্টি রেখে বললো,
” আচ্ছা, বিভা! এতো রাগছো কেনো? আসলে আমি তোমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিচ্ছিলাম আই মিন তুমি আর কতদিন আমার পেছনে ঘুরতে পারো সেই পরীক্ষা! কষ্টের কষ্টি পাথরে তোমার ভালোবাসা যাচাই করে নিচ্ছিলাম! ”
বিভার মুখে হাসি ফুটে উঠলো, সে আশপাশ চিন্তা না করেই আহনাফকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো,
” দ্যাট মিন, আপনিও আমাকে লাইক করেন?”
আহনাফ বিভাকে ছাড়িয়ে দিয়ে বললো,
” আরে! করছো টা কি, আশেপাশে মানুষ আছে!”
বিভা নিজেকে সংযত করে নিলো।
আহনাফ আস্তে করে বললো,
” এইতো বুঝে নিয়েছো, অনেক তো হলো পরীক্ষা নেওয়া! এখন স্যাটেল হওয়া উচিত! তাই নয় কি?”
তবুও বিভার মুখে অসন্তোষ! সে আরো বেশি কিছু শুনতে চায়। আহনাফ বিভার হাতে একটা এড্রেস কার্ড তুলে দিয়ে বললো,
” আজ সন্ধ্যা ঠিক ছয়টায় আমার বাসায় আসো, কথা আছে, এখানে বেশি কথা বললে সমস্যা! ”
বিভা চলে গেলো খুশিমনে।
এতদিন পর আহনাফ নিজে থেকে তাকে ডেইটের আমন্ত্রণ জানালো! বিভা আনন্দে যেনো উন্মাদ হয়ে যাচ্ছিলো।
বাসায় গিয়ে বিভা খুশিতে লাফাতে লাগলো।
ঠিক সে সময়ই আরোহীর কল এলো। একথা উল্লেখ্য যে আরোহীর পরিবারও এখন আশফিক শায়লার সাথে একটা সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছে। আর বিভার সাথে সাথে আরোহীও ঢাকায় এসে উঠেছে।
আরোহী বলে উঠলো,
” বিভা ও বিভা, তুমি আমার বিভা! আমি খুশিতে ম’রে যাচ্ছি রে বিভা!”
আরোহীকে একটা ধমক দিয়ে বিভা বললো,
” থাম! লেসবি* ন এর বাচ্চা! এত খুশি কেনো রে? একেবারে লাফাচ্ছিস যে? ”
আরোহী নাচতে নাচতে বললো,
” রেভলন পার্লারে আমি, ফেসিয়াল, পেডিকিউর, মেনিকিউর, স্পা করে জবরদস্ত মেইক আপ নিবো একটা, ঐ যে তওবা তওবা গানে তৃপ্তি দিমরি যে মেইক আপ নিয়েছিলো না, সেটা নিবো!”
বিভা ওকে আক্রমনাত্মক স্বরে বললো,
” কেনো, তোর বিয়ে লাগছে নাকি যে, এত মেইক আপ, সেইক আপ নিবি?”
আরোহী আরো দ্বীগুন খুশিতে লাফাতে লাফাতে বললো,
” হ্যাঁ রে! বিয়ে লাগছে রে, বিয়ে লাগছে আমার! আহনাফ আমাকে আজ সন্ধ্যায় ওর ফ্ল্যাটে থাকতে বলেছে, হি লাভস মি! আজ একটা জবরদস্ত ডেইট হবে আমাদের! লাভস বার্ড বেকারীতে কেক আর ক্যান্ডেল লাইটের অর্ডার দিলো আমার সামনেই!”
” হোয়াট!”
শুনে বিভার হাত থেকে ওর আইফোন ফোরটিন প্রোম্যাক্স ফ্লোরে পড়ে গেলো ধপাস করে!
.
.
সন্ধ্যায় আসলে কি হতে চলছে, আহনাফের ওখানে? আসলে আহনাফের প্ল্যান কি? সে কেনো আরোহীকেউ নিমন্ত্রন করেছে!
বিভার উর্বর মস্তিষ্কে এসব কিছু খেলছিলো না।
হয়তো মজা করার উদ্দ্যেশ্যে! আহনাফ কস্মিনকালেও ঐ মোটকি আরোহীকে পছন্দ করতে পারে না!
এসব ভাবনা বিভার মাথায় খেলে গেলো।
ফোনের স্ক্রিনটা নষ্ট হয়ে গেছে। কাউকে কল করারও উপায় নেই। আর এদিকে বিকেল হয়ে এসেছে। তাই উপায়ান্তর না দেখে বিভা সাজতে শুরু করলো।
স্লিভলেস ব্লাউজের সাথে পাতলা ফিনফিনে জর্জেটের শাড়ি পড়ে সে নিজেকে বেশ আকর্ষণীয় অনুভব করলো। মুখে গর্জিয়াস মেইক আপ মেখে নিজেদের পাজারো নিয়ে ছুটলো আহনাফের দেওয়া ঠিকানার উদ্দ্যেশ্যে।
ড্রাইভার ঢাকা শহরের জ্যাম ঠেলে ঠিকানানুযায়ী পৌঁছাতে রাত আটটা বাজিয়ে দিলো।
আহনাফ গেইটেই অপেক্ষা করছিলো। ক্রমাগত ঘড়ি দেখছিলো সে।
বিভা গাড়ি হতে নামতেই অবাক! একটা বড় ফুলের তোড়া এগিয়ে দিলো আহনাফ ওর দিকে।
বিভা সুললিত কন্ঠে বলে উঠলো ” থ্যাংক ইউ”
আহনাফ দারুন আকর্ষণীয় একটা শেরওয়ানি পড়েছে।
বিভার মনে হলো, হয়তো বিভার উদ্দ্যেশ্যেই আহনাফ এ ধরনের ড্রেস পড়েছে।
ভিতরে যেতেই সে আরোহীকে দেখে যার পর নাই ক্ষেপে গেলো।
” এই আরোহী? তুই এখানে কি করছিস? আহনাফ লাভস মি, নট ইউ!! ব্লাডি বা*স্টার্ড ! বিশ্বাস না হয়, তুই নিজেই জিজ্ঞেস কর আহনাফকে?”
বলেই আরোহীর দিকে আক্রমাত্মক ভাবে ক্ষেপে এলো সে।
আহনাফ দুজনকে হাসিমুখেই থামিয়ে দিলো।
হাসিমুখে দুজনে দু হাত ধরে সে টেনে নিয়ে চললো ভেতরে।
দুজনেই জানে না কি বিস্ময় সেখানে ওদের জন্য অপেক্ষা করছে।
গোটা রেস্টুরেন্ট ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে।
ওখানে শায়লা, আশফিক আর অহনাকেউ দেখতে পেলো বিভা।
মানে কি এসব? উনারা এখানে কি করছে?
বিভা ও আরোহী দুজনকেই চমকে দিয়ে আহনাফ বললো,
” আজ আমার বিয়ে বুঝলে রমনীরা?”
বিভা ও অহনা একে অপরের মুখের পানে চাওয়া চাউয়ি করলো স্ববিস্ময়ে।
“আসলে হচ্ছে টা কি? ”
আরেকটু ভেতরে যেতেই বিভা ও আরোহী বঁধু বেশে ত্রিশাকে বসে থাকতে দেখে ভুত দেখার মতোই চমকে উঠলো।
ত্রিশা সুন্দর লেহেঙ্গা পড়ে রাজকীয় ভাবে বসে আছে।
আহনাফের খুশি তার চোখ মুখ উপচে পড়ছে।
বিভা আর আরোহী কিছু বুঝে উঠার আগেই একদল মহিলা পুলিশ এসে ওদেরকে আটকে ফেললো।
ইন্সপেক্টর অর্ডার দিলো, ” এরেস্ট দেম!”
আহনাফ ইন্সপেক্টরের দিকে ব্যাঙ্গাত্মক অনুনয় করে বললো,
” ইন্সপেক্টর, আফটার অল আজ আমার বিয়ে, এই দুজনকে পেট পুরে খাইয়ে তারপর নিয়ে যান!”
একথা শুনে পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা আহনাফের বন্ধুসকল হেসে দিলো।
ত্রিশার বান্ধবী রাত্রি, ঊষা, স্নিগ্ধা ও ত্রিনাও সেখানেই ছিলো। ওদের মুখেও হাসি।
আহনাফের পি বি আই এর সিনিয়র ইনভেস্টিগেটর বন্ধু বিশালও সেখানে প্রবেশ করলো।
বিশাল আসা মাত্রই ত্রিশার সব বান্ধবীরা ওর দিকে দৌড়ে এলো।
“বিশাল ভাইয়া, কেমনে কি? এদেরকে পেলেন কিভাবে?”
বিশাল হেসে বললো,
” এদেরকে পাওয়া তো তুড়ির ব্যাপার ছিলো, আহনাফের এক ঈশারাতেই এরা এখানে ঝাঁপিয়ে এসেছে, যেমন করে পাখাযুক্ত পিপিলিকা ম’রিবার তরে আগুনের পানে ঝাপিয়ে পড়ে!”
বলেই বিশাল হাসতে লাগলো।
সে আরো যোগ করলো,
” আসলে এদেরকে দোষী প্রমাণ করাই অনেক বড় ব্যাপার ছিলো, এ প্রসেস টা ছিলো একটা লেংদী প্রসেস। এরা এতটা চালাকির সাথে সব কাজ করেছিলো যে একটাও প্রমাণ মেলেনি। তবে আন্টি( শায়লার) ক্লু ধরে আমরা এগিয়েছিলাম, কারন আহনাফ ফোন বাসায় রেখে যেতো কোনো এক ছাত্রির হয়রানি থেকে বাঁচতে। যে ছাত্রী ছিলো আরোহী। আর বাসায় বাইরের শুধু বিভাই আসতো। তার মানে বিভাই আহনাফের ফোন থেকে সব কারসাজী করেছিলো, আহনাফের ফোনের সব ডেটা কেউ মুছে দিয়েছিলো স্থায়ীভাবে, সেক্ষেত্রে আমাদের আই সিটি ইউনিট ও ফরেনসিক ইউনিট অনেক দক্ষতার সাথে কাজ করে সবটা ধরেছিলো। আর আগের ফ্যাসিস্ট সরকার এখনো থাকলে ওদের ধরা সম্ভব হতো না, রাহুল চৌধুরীর জন্য। কিন্তু রাহুলের দল এখন আর নেই, তাই এদের ধরা আরো সহজ হয়েছে! ”
সবাই বিশাল কে করতালির সাথে বিশাল করে ধন্যবাদ দিলো।
বিয়ে পড়ানো শেষে কনকচাপা মেয়েকে তুলে দিলো আহনাফের হাতে। নিজের ষোলোকলা পূরণ হয়েছে আজ কনকচাপার। ত্রিশা বুয়েটে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ চান্স পেয়েছে৷ বিভার থ্রেট পেয়ে পরীক্ষাগুলো কোনোক্রমে শেষ করে ঢাকায় এসে উঠেছিলো। তারপর একদিন আহনাফকে পেয়ে যায় ত্রিশা। তারপর দুজন মিলে বিশালের সহায়তায় প্ল্যান করে আজ বিভা আর আরোহীকে আটক করলো।
.
.
বাসর ঘরে ত্রিশা আহনাফের জন্য অপেক্ষা করছিলো। অহনা আর ত্রিশার বান্ধবীরা আহনাফকে আটকে রেখেছিলো চাতুরী করে। কিন্তু এত বছরের প্রতিক্ষিত সে রজনীতে বিলম্ব করাতে পারেনি তারা। বোনকে ও ত্রিশার বান্ধবীদের চতুরতার সাথে এড়িয়ে ঢুকে পড়ে বাসর ঘরে।
আহনাফ আসতেই দুজনে ব্যাকুল হয়ে দুজনার পানে চাইলো পরম ব্যাকুলতায়।
আহনাফ আস্তে করে ত্রিশাকে বললো,
” তোমাকে আমার করে নিতে ছুঁয়ে নিতে পারি? ”
ত্রিশা মুখের হাসিটা বর্ধিত করে বললো,
” মন তো কবেই ছুঁয়েছিলে তুমি! এখন তো তোমার ই আমি…”
বলেই আহনাফের বাহুডোরে নিজেকে আবদ্ধ করে নিলো সে আজীবনের জন্য।
(সমাপ্ত)
#তুমি_ছুঁয়ে_দিলো_এ_মন
(সারপ্রাইজ পর্ব)
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
ভালোবাসায় থাকা যুগলের জীবনে বাসর রাত বহু কাংখিত বাসনার রাত। আর সেটা যদি পাওয়া হয় বহু ঝড়- ঝাপ্টা, ঘাত-প্রতিঘাত আর প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জেতার পর? তাহলে সেটার মূল্যমান হয়তো পার্থিব কোনোকিছু দ্বারা বিচার করা সম্ভব নয়। আহনাফ ত্রিশা যুগলের তেমনি মনে হচ্ছিলো।
দুজনের দুজনের প্রতি মহাকর্ষ সম আকর্ষণ, আবার দুজনের কাছে আসার বিপক্ষে আলোকর্ষ ব্যাপী বাধা!
মজার ছলে বান্ধবীরা আর ননদিনী মিলে কিছুক্ষণ আহনাফকে আটকে রেখেছিলো উটকো ফ্যাসাদে। তাই আসতে সামান্য দেরি হওয়াটাকে ত্রিশার শ্বাসরুদ্ধকর লাগছিলো। তবে মনে মনে এখন ভীষণ শান্তি। পরম কাম্য এ মানুষটা তার হয়ে গিয়েছে আজীবনের জন্য। আজীবনের জন্য সে তার জীবনসঙ্গিনী, অর্ধাঙ্গিনী!
আহনাফের বাহুডোরে আবদ্ধ থাকা অবস্থাতেই, ত্রিশা মুখটাকে সামান্য বাঁকিয়ে বললো,
“তো, দেরি করেছো কেনো শুনি? আমাকে এখানে একা বসিয়ে রেখে কোথায় ছিলে? দেখেছো?রাত একটা বাজে!”
আহনাফ ত্রিশার লজ্জানত বদনে এত রা’গী ভাষা শুনে কনফিউশন দূর করার জন্য ত্রিশার থুতনীটা তুলে মুখটা উঁচিয়ে চোখের পানে গাঢ় দৃষ্টি দিলো।
” বাহ! হাউ ড্রামাটিক ইউ আর! চেহারাটা দেখতে লাগছে লজ্জাকাতুর! আর ভাষাটা এত রুক্ষ বের হলো কিভাবে? একই মানুষ একই সাথে দুই রকম অভিব্যক্তি কিভাবে দেখাতে জানে? কোয়াইট ইমপসেবল ফর মি!”
এসব শুনে ত্রিশা রিনরিন করে হেসে দিলো। আহনাফ মুগ্ধতার সাথে চাইলো ওর দিকে।
” আপনার পক্ষে ইমপসেবল হলেও আমার পক্ষে নয়, রাত তো একটা, বড়জোর সাতটা পর্যন্ত আমরা একসাথে থাকবো, তারপর সকাল হলেই আপনার আবার পার্টি অফিসে যাওয়ার জন্য হুলস্থুল পড়ে যাবে! আ ত্ম ত্যাগী নেতা মশায়! তাই নয় কি?”
আহনাফ ভ্রু নাচিয়ে সুধালো,
” তাহলে তুমি কি বলতে চাচ্ছো, যা করার তা তাড়াতাড়ি করতে হবে, চলো চলো…”
বলেই ত্রিশাকে আর সামান্য কথা বলারও সুযোগ না দিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট গলিয়ে মুখ তালাবন্ধ করে দিলো। ত্রিশাকে নিয়ে বিছানার উষ্ণতায় শরীর মিশিয়ে দিলো। আর অমৃত সুধা পান করতে লাগলো পরম সুখে। ত্রিশা চোখ বন্ধ করে দিলো স্বর্গীয় স্পর্শে। চোখ দিয়ে বের হতে লাগলো আনন্দাশ্রু।
.
.
পরদিন ভোর হলো কখন তা আহনাফ বা ত্রিশা কেউই বুঝলো না। এলোমেলো ভূষণে দুজনেই শুয়ে ছিলো হয়ে। দুজনের একসাথে ঘুম ভাঙ্গলেই দেখে ঘড়িতে সময় নয়টা! এত বেলা গড়িয়েছে, আর টেরই পায়নি?
ত্রিশা দ্রুত বাথরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে, ডাইনিং রুমের উদ্দ্যেশ্যে বের হতেই অহনা এগিয়ে এলো মেইক আপ নিয়ে।
কাঁপাকাঁপা কন্ঠে তড়িঘড়ি করে বলতে লাগলো,
” স্টপ ভাবি স্টপ! ওদিকে যাইয়ো না ভাবি, ইজ্জত পাংচার হয়ে যাবে, চলো চলো, আগে ভেতরে চলো! ”
ত্রিশা কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। তার আগেই ধাক্কা দিয়ে আবার বেডরুমে ঢুকিয়ে দিলো অহনা।
অহনা দ্রুত একটা স্কিন কারেক্টার দিয়ে ত্রিশার গালে ও গলায় লাল হয়ে থাকা অংশটুকুতে ওসব
লাগাতে ব্যস্ত হয়ে গেল।
ত্রিশা ভীষণ ই লজ্জায় পড়ে গেলো। গত রাতের আদরের আধিক্য যে এত বেশি হয়ে গেছে তা ও দেখেছি।
গোসলের সময় সে খেয়াল ই করেনি যে গত রাতে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সময় আহনাফ ওর এ হাল করেছে৷
স্কিন কারেক্ট করে অহনা দ্রুত ঠোঁটে লাল টকটকে লিপস্টিক লাগিয়ে দিলো।
আর আলমারি হতে একটা লাল টুকটুকে শাড়ী বের করে পড়িয়ে দিলো। আহনাফ ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে এলো।
ত্রিশাকে লাল টুকটুকে পরীর বেশে দেখে আবার মাথা ঘুরে গেলো তার।
অহনা তাড়া দিয়ে বললো,
” ভাইয়া, ড্রয়িং রুমে তোমার সব নেতা কর্মীরা এসেছে, অন্তত গোটা পঞ্চাশ! তোমাদের দুইজনকে শুভেচ্ছা জানাতে, তারপর আমার মা বাবা, তোমার মা ভাই, তোমার বান্ধবীরা সহ গোটা পঞ্চাশ জন মানুষ ঐ রুমে। দ্রুত আসো! রোমান্স রাতে কইরো, এখন না! ”
” বোন টা না আমার এত পাকা হইছে!”
আহনাফ এই বলতে বলতে দ্রুত একটা সাদা পাঞ্জাবি পড়ে ড্রয়িং রুমে চলে এলো।
পার্টির সাধারন সম্পাদক তার লম্বা বুলি আওড়াতে লাগলেন,
” সুধী, আসসালামু আলাইকুম, আজ আমরা সবাই আমাদের পরম শ্রদ্ধার আহনাফ ভাইয়ের বিবাহ পরবর্তী শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছি। যদিও গতকালের অনুষ্ঠান তেমন জাঁকালো আয়োজনের মাধ্যমে হয়নি। দেশে চলমান বন্যা পরুস্থিতির কথা চিন্তা করে আমাদের যোগ্য নেতা তার অনুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত সম্পূর্ণ খরচটাই বন্যা কবলিতদের জন্য ত্রান হিসেবে পাঠিয়ে দিয়েছেন, সেজন্য আমরা তাকে স্যালুট জানাই। গত একটা বছর তিনি দিন নাই রাত নাই আমাদের দেশের জন্য কাজ করেছেন, জনগনের জন্য কাজ করেছেন। বয়সে অনেক তরুণ হলেও তিনি গত একটা বছরে যত কাজ করেছেন তা অনেকেই তার আশি বছরের জীবনেও করতে পারে না, এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। বহু ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করে তিনি আজ এই অবস্থানে। আর আমাদের দল এই সুযোগ্য অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। আমরা খুবই খুশি যে উনি তার কাং্খিত মনের মানুষ কে স্ত্রী হিসেবে পেয়েছেন, এজন্য আমরা অনেক উচ্ছ্বসিত। তবে আমরা চাচ্ছি, কয়েকদিনের জন্য আপনি আপনার ভালোবাসার মানুষের সাথে একান্তে সময় অতিবাহিত করুন। একটু প্রাণখুলে শ্বাস নিন। এজন্য আমরা নেতা কর্মীরা মিলিতভাবে আপনার একটা হানিমুনের ব্যাবস্থা করেছি, মালদ্বীপে! আশা করি আপনাদের যুগল চিরসুখী হোক! চিরঞ্জীব হোক!”
সবাই একযোগে করতালি দিয়ে আহনাফের হাতে একটা ঢাকা-মালদ্বীপ-ঢাকা এয়ার টিকেট ধরিয়ে দিলো।
নেতা কর্মীরা সবাই বিদায় হলে এলো আহনাফের সেই পিবি আই এর সিনিয়র ইনভেস্টিগেটর অফিসার বন্ধু বিশাল।
ত্রিশার বান্ধবীরা এতদিনে সবাই বিশালের বিরাট ফ্যান হয়ে গিয়েছে। যেহেতু বিয়ের রাতে সব বান্ধবীরা আহনাফের বাসাতেই ছিলো অহনার সাথে, তাই বিশাল আসার সাথে সাথেই সবাই আগের মতো বিশালের কাছে দৌড়ে গেলো।
ত্রিনা সরাসরি প্রশ্ন করলো,
” আপনি কি ভাইয়া জেমস বন্ডের শ্যালক লাগেন নাকি? যতবার এরা দুজনে সমস্যায় পড়লো আপনি এসেই তুড়ি মেরে সব রহস্য উদঘাটন করে ফেলেন? ক্যামনে পারেন এতো?”
বিশাল হেসে বললো,
” আমি আর কি করলাম? বিভা আর আরোহীকে আহনাফ আগেই সন্দেহ করেছিলো, কিন্তু বিভার বাবা বড় নেতা আর আরোহীর বাবা অনেক বড় সন্ত্রাসী হওয়ায় ওদের বিরুদ্ধে কিছুই করা যাচ্ছিলো না। ক্ষমতা অনেক কিছুই ম্যাটার করে! আর ত্রিনা এখানে অনেক বড় অবদান তোমার সেই প্রেমিক পুরুষ রবির!”
রবির নাম বলতেই রবি সেখানে প্রবেশ করলো।
আগের মতোই রবি প্রবেশের সাথে সবাই ” রবি ভাই জিন্দাবাদ, রবি ভাই জিন্দাবাদ” বলে উঠলো।
ত্রিনা হেসে বললো,
” রবি? কিভাবে?”
এবার আহনাফ বলা শুরু করলো,
” রবিই প্রথম বুয়েট ক্যাম্পাসে ত্রিশাকে খুঁজে বের করে, কারন কেনো জানি ওর বিশ্বাস ছিলো ত্রিশা বুয়েটে চান্স পাবেই পাবে! তারপর ত্রিশাকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে একান্ত গোপনে আমার সামনে আনে, ওর বিশ্বাসের জোরেই আমি ত্রিশাকে খুঁজে পেয়েছি। ”
” তারপর?” ত্রিশার সব বান্ধবীদের মুখে রাজ্যের কৌতুহল।
স্নিগ্ধা বলে উঠলো,
” তার মানে রবি বহু আগেই ত্রিশাকে খুঁজে পেয়েছিলো, কিন্তু আমাদের বলেনি? ”
বিশাল বললো,
” হুউম, আমিই জানাতে মানা করেছিলাম, তাছাড়া ইনভেস্টিগেশনে অসুবিধা হবে বলে। তাছাড়া আরোহীর ভাইয়েরা উৎ পেতে ছিলো, কোনো ব্যতিক্রম পেলেই ওরা ত্রিশার অনেক বড় ক্ষতি করে ফেলতো তারা! সেজন্যই সব গোপন রাখা হয়েছিলো। ”
রাত্রি প্রশ্ন করলো,
” আর ত্রিশার বিয়ের ছবির বিষয়টা কি?”
এটা ত্রিশাই নিজের মুখে বলা শুরু করলো।
” ভয় দেখিয়ে ওরা আমাকে এক অচেনা মানুষের বউ সাজিয়ে জোর করে ছবি তোলায়…”
বলেই সে কেঁদে দিলো। আহনাফ ওর কাঁধে হাত রাখলো,
” তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই ত্রিশা, তুমি পরিস্থিতির স্বীকার! তার থেকে বড়, তুমি বোকাও আছো! ”
কনকচাপাও বলে উঠলো,
” আমরা ঢাকায় চলে আসার পর আমাদের জীবন যে কি কঠিন ছিলো, তা আর ভাষায় প্রকাশ করার মতো ছিলো না। অচেনা একটা শহরে তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে আমি কি করুন অবস্থায় যে দিন কাটিয়েছি! বিভা আর আরোহী গুন্ডা দিয়ে সবসময় আমাদের থ্রেটের উপর রাখতো। জীবন আমাদের আর জীবন ছিলো না, আমরা যেনো জেলখানার বন্দি! ”
ঠিক তখনি রবি বলে উঠলো,
” যা হয়েছে ভাইয়া ভালোর জন্যই হয়েছে, নইলে কি ত্রিশা কোনোদিন জানতো, তাকে ভালোবেসে কেউ পাগলের মতো হয়ে যেতে পারে? হসপিটালাইজড হতে হয়? আর বিরহ ভালোবাসা কমায় না ভাইয়া, বরং বহুগুণ বাড়ায়, বিরহ ছাড়া কোনো প্রেম সম্পন্ন হয়না, এই বিপদের উছিলায় আপনিও আপনার আশেপাশের মানুষগুলোকে চিনেছেন, সেই সাথে ত্রিশাও মানুষ চিনেছে, দুনিয়া চিনেছে, ক্ষত বিক্ষত হয়েও আবার বেঁচে ফিরেছে, বোকা থেকে চালাক হয়েছে, সাহসী হয়েছে, একা বাঁচতে শিখেছে! আর সবচেয়ে বড় কথা নিজের স্বপ্নকে অর্জন করে নিয়েছে সে! ”
আহনাফ ওর সাথে একমত হলো।
কনকচাপা মেয়ে জামাই কে আশীর্বাদ করে চলে গেলো।
ধীরে ধীরে সবাই ওদের বাসা থেকে একে একে বিদায় নিলো।
ত্রিশা ভেবেছিলো সকাল সকাল উঠেই আগে শ্বসুর শাশুড়ী কে সালাম করবে। কিন্তু এবার সালাম করতে গেলেই শায়লা ও আশফিক ওকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরলো।
” তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি মা, আমার দোষে তোমরা দুজনই অনেক কষ্ট পেয়েছো, ক্ষমা করো আমাকে!”
শায়লার চোখে পানি চলে এলো।
পরের দিনই দুজনে হানিমুনে গিয়ে একটা একান্ত সুন্দর সময় কাটানোর উদ্দ্যেশ্যে রওনা হলো।
( সমাপ্তি)