তুমি থেকো দাঁড়িয়ে খোলা বারান্দায় পর্ব-১০+১১

0
5

#তুমি_থেকো_দাঁড়িয়ে_খোলা_বারান্দায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১০

“বাহারাজ কোথায় নিতে এসেছে আমায়? আমি যাব না মা।” আমার আবদারের কণ্ঠ। মা দৃষ্টি সরিয়ে বাহারাজের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওর শরীরটা ভালো নেই। যেতে চাইছে না।”

বাহারাজ নির্বিকার কণ্ঠে বলল, “ওর নামটা জমা করা হয়ে গেছে আন্টি। ও যদি উপস্থিত না হয়, সমস্যা হয়ে যাবে। ভার্সিটি থেকে বের করেও দিতে পারে। আমার দায়িত্বে ওকে দিন। আমি আপনার হাতে ওকে পৌঁছে দিব।”

বাহারাজের অনুরোধ মা ফেলতে পারছে না। আপু তার হবু দেবরের মান রাখতে আমার কাছে বিনীত অনুরোধ করল, “হানি, সোন বোন‌ আমার। প্লীজ বাহারাজের সাথে যা। ও তোর দায়িত্ব নিচ্ছে তো।”

আমি বিরক্ত হলাম। শরীরটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। ‘উঠে দাঁড়ানোই মুসকিল’ সেটা এতটা পথ যেয়ে নিজেকে ধাতস্থ রাখা চাট্টেখানি কথা নয়। আমি নিভু গলায় বললাম, “জাস্ট লিভ। তোর মনে চাইলে তুই যা।”

বলেই আমি বিছানায় পুনরায় শরীর এলিয়ে দিলাম। মা ও আপু দুজনেই হার মেনে নিয়েছে। বাহারাজ চাতুর্য্য দেখিয়ে মা ও আপুকে বলল, “আমাকে দু মিনিট সময় দিন। আমি কথা বলে দেখছি।”

মা ও আপু- বাহারাজকে আমার ঘরে রেখে চলে গেল। আমি ইচ্ছেকৃত এক চোখ মেলে বাহারাজকে দেখে পুনরায় চোখ বুজে নিলাম। তুমি দু মিনিট থাকো বা দু ঘণ্টা। হানিকে বিছানা থেকে তুলতে পারবে না। গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন এমন ভান করে শুয়ে রইলাম। বাহারাজ আমার উপর ঝুঁকে গেল। তার নিঃশ্বাসের সবটুকু হাওয়া আমার শরীরে পতিত হচ্ছে। নেভানো গলায় বলল, “তুমি যে অপরিচিত ছেলেদের চুমু থেরাপি দিয়ে বসো, সেটা কি তোমার পরিবারের লোকেরা জানে? দায়িত্বটা আমার কাঁধে নিচ্ছি।”

বাহারাজের কথা শুনে লাফিয়ে উঠে বসলাম। বাহারাজ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আমি অকপটে বললাম, “একদম বলবেন না। আপনিও তো আমাকে চুমু খেয়েছেন। আমি কিছু বলেছি? তা-ও আমার পেটে।”

“এনি প্রুফ?”

“নো।”

“আমার কাছে কিন্তু প্রুফ আছে। ভার্সিটির সবাই দেখেছে।” বাহারাজের কথায় বাক্য খুঁজে পেলাম না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। বাহারাজ খানিকটা এগিয়ে এলো। বামহাতটা ললাটে ঠেকিয়ে জ্বরের তীব্রতা পরিমাপ করার চেষ্টা করল। আমি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছি। চুলে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, “পাঁচ মিনিটের মধ্যে এসো। আমি নিচে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।”

ধৈর্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে গেলাম আমি। বালিশটা ছুটে ফেলে ফোঁস ফোঁস করলাম। আমি ভার্সিটিতে গেলে তোকে কী প্রমোশন করিয়ে পরীক্ষা ছাড়াই পার্স করিয়ে দিবে?

রিকশা চলছে তার গন্তব্যে। রাস্তাটা কোলাহল পূর্ণ। মেঘহীন রাতের নীল আকাশ মনে ভীষণ দোলা দিয়ে যাচ্ছে। নীল রঙের পাঞ্জাবিতে দারুন লাগছে বাহারাজকে দেখতে। চোখে সুরমা ও গা থেকে ভেসে আসছে মনােমুগ্ধকর আতরের গন্ধ। ‌আতরেও যে এমন সুন্দর গন্ধ থাকে, বাহারাজ আতর না দিলে জানতাম না। আমার পরনে নীল রঙের টু পিস। বাহারাজের সাথে কথা বলার তীব্র বাসনায় আনচান করছে আমার মন মস্তিষ্ক। ফোনে অনবরত টাইপ করে চলেছে কিছু। কাকে টাইপ করছে? গার্লফ্রেন্ড! এমন সুদর্শন ছেলের গার্লফ্রেন্ড থাকবে, তা অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। না থাকাই বরং অস্বাভাবিক। আমি কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম, “আচ্ছা আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে? আমাকে বলতে পারেন। আমি কাউকে বলবো না। টেইক ইট ইজি।”

ফোনে টাইপ করতে করতেই বলল, “নেই।”

“আমি জানি আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে। এত অভিনয় করার কিছু নেই। বলব না কাউকে।”

বাহারাজ জবাব না দিয়ে ফোনেই মগ্ন হয়ে রইল। দ্বিতীয়বার একই প্রশ্ন করার স্পৃহা নেই। ততক্ষণে রিকশা এসেছে তার গন্তব্যে। বাহারাজ রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে বিদায় করল মামাকে। শিক্ষার্থীদের ঢল নেমেছে ভার্সিটিতে। আমি বাহারাজের পেছনে পেছনে ভার্সিটিতে প্রবেশ করলাম। ততক্ষণে অনুষ্ঠান মধ্যম অংশে প্রবেশ করছে। আমি বাহারাজের হাত টেনে বললাম, “পেছনে দাঁড়াতে পারব না। বসতে হবে।”

বাহারাজ আমার হাত ধরে সন্তর্পনে আমাকে সামনে নিয়ে গেল। দ্বিতীয় শাড়ির মাঝে তিন নাম্বার চেয়ারে বসে থাকা ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আকাশ এখানে বসে আছিস কেন? ওই পাশে গিয়ে দাঁড়া।”

আকাশ চলে যেতেই আমাকে বলল, “এখান থেকে উঠবে না কিন্তু। আমি কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর এসে তোমার খোঁজ নিয়ে যাব।”

“আচ্ছা।”
বাহারাজ অতঃপর ভীড়ের মাঝে মিলিয়ে গেল। আমি সামনের দিকে তাকিয়ে মনোযোগী হলাম অনুষ্ঠান দেখছে। মনটা আমার চার বন্ধুকে দেখার জন্য আকুল হচ্ছে। কিন্তু উঠে গিয়ে ভীড়ের মাঝে খুঁজতে ইচ্ছে করছে না। সব শিক্ষকেরা চিরকুট তুলে শিক্ষার্থীদের প্রতিভা অনুযায়ী পারফরমেন্স করতে বলছে। শিক্ষার্থীরাও অংশ নিচ্ছে তাতে। অনুষ্ঠান শেষ পর্যায়ে পৌঁছাতে তখন কিছুক্ষণ বাকি। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে দশটার ঘরে পৌঁছেছে। বাহারাজ ইতোমধ্যে ছয়বার এসে আমাকে দেখে গেছে। হঠাৎ করে একজন স্যার বলে উঠলেন, “আমাদের ভার্সিটিতে একজন নতুন শিক্ষার্থী আছে। যার গান শুনে গতকাল আমি মুগ্ধ হয়েছি। মূলত ফেসবুক থেকেই শুনেছি। তখনই আমি ঠিক করে রেখেছি, আজ তার মুখোমুখি বসে গান শুনব। মেয়ের নাম সম্ভবত হানি। গানটি ছিল আমারো পরানো যাহা চায়। হানি তুমি স্টেজে চলে এসো।”

‘অসুস্থ শরীর ও শিক্ষককের ডাক’ এই দুয়ের একটি বেছে নেওয়া বড়ই কঠিন কাজ। আমাকে দোটানা থেকে মুক্তি দিতে বাহারাজ হাজির হলো সমীপে। অত্যন্ত নরম গলায় বলল, “হানি, স্যার ডাকছেন। যাও।”

“আমার শরীরটা…

“আমি তো আছি, চিন্তা করো না। বেশি গাইতে হবে না। চার লাইন গেয়ে চলে এসো।”

“হুঁ।” বাহারাজ আমাকে ধরে স্টেজে নিয়ে গেল। চোখ পড়ল পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা চারজন প্রিয় মানুষের দিকে। ওরা আমাকে দেখেই হাত বাড়াল। আমি বিনীত সুরে শিক্ষকদের সালাম দিয়ে বললাম, “আমি মিমিয়া মাহাতো হানি। ফাস্ট ইয়ার।”

স্যার উৎফুল্ল হয়ে বলল, “তোমার গান আমার ভালো লেগেছে। তাই একটা গান শোনানোর অনুরোধ করছি।”

আমি মৃদু হেসে বললাম, “স্যার আপনি আমাকে অনুরোধ করবেন না, আদেশ করবেন। আমার শরীরটা অসুস্থ। আমি একটুখানি গাইছি আজ। অন্যদিন পুরোটা শোনাব।”

স্যার বিচলিত হয়ে বললেন, “চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। দাঁড়াও তোমার সাথে গলা মেলাতে একজনকে ডাকছি। এতে তোমার গাওয়াটা সহজ হয়ে যাবে।” পরপর সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, “ফাইনাল ইয়ারের তাহসান, স্টেজে এসো।”

মিনিট তিন বাদে গিটার কাঁধে ঝুলিয়ে তাহসান হাজির হলো। স্যার তাহসানকে যুগলবন্দি গানের আদেশ করলেন। তাহসানও সেই আদেশ মেনে নিল। তবে প্রথমবার যুগলবন্দি গানে অস্বস্তি হচ্ছে আমার। তিরিক্ষি মেজাজে বাহারাজের দিকে দেখলাম, সে বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে। আলোগুলো নিভে গেল। গিটারের টুংটাং শব্দ শুনে শ্রোতারা মনোযোগী হলো গানে। তাহসান গান ধরল,
সে মানুষ চেয়ে চেয়ে
ফিরিতেছি পাগল হয়ে
মরমে জ্বলছে আগুন
আর নিভে না

আমায় বলে বলুক লোকে মন্দ
বিরহে তার প্রাণ বাঁচে না
বলে বলুক লোকে মন্দ
বিরহে তার প্রাণ বাঁচে না

দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা
দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা

তাহসান থামতেই হাত বাড়িয়ে গিটার চাইলাম। নিজের হাতে গিটারের শব্দ তুলে গাইলাম, পথিক কয় ভেবোনা রে
ডুবে যাও রূপসাগরে
পথিক কয় ভেবোনা রে
ডুবে যাও রূপসাগরে
বিরলে বসে করো যোগ-সাধনা

একবার ধরতে পেলে মনের মানুষ
ছেড়ে যেতে আর দিও না
ধরতে পেলে মনের মানুষ
ছেড়ে যেতে আর দিও না

দেখেছি, দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা
দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা….

গিটার সুর থামিয়ে শ্রোতাদের দিকে তাকালাম। সবাই নীরব! স্থির! নিশ্চল! কানের মাঝে কোনো শব্দ পৌঁছাচ্ছে না।‌ আচ্ছা আমার গান কি তাদের মনে ধরেনি? বাহারাজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তো তার আভাসই আমাকে দিচ্ছে।

চলবে… ইন শা আল্লাহ

#তুমি_থেকো_দাঁড়িয়ে_খোলা_বারান্দায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১১

পরমুহূর্তেই করতালির আওয়াজে মুখরিত হলো জায়গাটা। আমার ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটে উঠল। শিক্ষকেরাও সন্তুষ্ট আমাদের গানে। আড়চোখে তাহসানের দিকে তাকিয়ে দেখি, সেও করতালিতে ব্যস্ত। হাসির রেখাটা বেশ চড়া হয়েই তাহসান বলে উঠল, “বাহ্! দারুন গাও তো তুমি।”

বিনিময়ে বললাম, “আপনিও ভালো গেয়েছেন।”

তাহসান কেবল মাথা নেড়ে গেল। পরবর্তী দৃষ্টি শিক্ষকদের দিকে নিবদ্ধ করলাম। স্যার বললেন, “আমি জানতাম তুমি দারুন গাও। কিন্তু এত সুন্দর, তা জানা ছিল না।”

সনাতন ধর্মের শিক্ষক বললেন, “তোমায় কী দক্ষিণা দেব জানি না। মনে হলো, মা বুঝি নিজের হাতে তোমার গলায় সুর তুলে দিয়েছে। তোমার হাত ধরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ছড়িয়ে যাক।”

সংক্ষিপ্ত পরিসরে ধন্যবাদ জানিয়ে নেমে এলাম স্টেজ থেকে। নামতেই তাসফি, আহাদ, ঋতু ও জয় ঘিরে ধরল আমাকে। মৃদু আঘাতে চাপড় মে’রে বলল, “আসবি না? ঠিকই তো বলেছিলি আসবি না। এখন এসে একদম ফাটিয়ে দিয়েছিস।”

জয় বলল, “ও সন্ধ্যার আগে এসেছে। দেখলি না সামনে বসেছে।”

আহাদ প্রশংসায় পঞ্চমুখ, “দারুন গেয়েছিস। তোর জন্য আমার গর্ব হচ্ছে।”

“হয়েছে অনেক প্রশংসা। চল ওদিকে যাই।” চার বন্ধুকে নিয়ে ভার্সিটির নির্জন দিকটায় আসলাম। নির্জন হলেও অন্ধকারে কপোত কপোতীদের দখলে রয়েছে। জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন। শিক্ষার্থী ছাড়াও অনুষ্ঠানে উপস্থিত তার অভিভাবক ও অন্যান্য মানুষ। জমে উঠেছিল আমাদের আড্ডার আয়োজন, তখনই হাজির তাহসান। তাকে দেখে বিস্মিত হয়েও নিবৃত্ত থাকার প্রয়াস করে শুধালাম, “কিছু বলবেন?”

“বলার ছিল অনেক কথাই। তবে ব্যক্তিগত। সবার সামনে বলা যাবে না। আমাকে দুমিনিট সময় দেওয়া যাবে?” তাহসানের সময় চাওয়ার জ্ঞাপনে আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললাম, “আপাতত সময় নেই। অন্য একদিন শুনব।”

তাহসানের পুনরায় অনুরোধে পূর্বেই বাহারাজের আগমন ঘটল। মাত্রাতিরিক্ত ধমকে বলল, “এখানে কী চলছে? অনুষ্ঠান শেষ তোমরা এখনো কী করছ? গো হোম।”

ধুলো উড়িয়ে পাঁচ জোড়া পা এলোপাথাড়ি কদম ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে শূন্য হয়ে শুরু করেছে ভার্সিটি। হাতেগোনা কয়েকটা রিকশা যাত্রীদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। রাত হওয়ার কারণে যাদের ভাড়া আকাশ ছোঁয়া। চারজন এক রিকশায় করে যাচ্ছে। ওদের গন্তব্য থেকে আমার গন্তব্য বিপরীত রাস্তায় হওয়ার দরুন দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। বিরক্ত হয়ে চড়া দামেই রিকশা ভাড়া করলাম। উঠার পূর্বেই বাহারাজ এসে বলল, “হানি তোমাদের বাড়িতে কেউ নেই। আন্টি ফোন করে বলেছে, তোমাকে যাতে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাই।”

কপালে ভাঁজ পড়ল কয়েকটা। ঘণ্টা দু আগেও বাড়িতে ছিল- এখন নেই! মানে? পা নামিয়ে একটু এগিয়ে যেতে যেতে বললাম, “গেছে কোথায়? আমাকে তো কিছু বলেনি।”

“তোমাকে ফোন করেছিল, রিসিভ করো নি।” বাহারাজের কথায় পার্স থেকে মুঠোফোন বের করে চেক করলাম। হ্যাঁ! পাঁচটা মিসড করল। আকাল-পাতাল চিন্তার মাঝে বাহারাজ বলল, “কালকে ক্লাস আছে। গুছিয়ে না গেলে কালকে ক্লাস করা সম্ভব হবে না। তুমি পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করো, আমি সবকিছু ওদের বুঝিয়ে দিয়ে আসছি।”

বাধ্য মেয়ের মতো বাহারাজের পেছনে পেছনে এগুচ্ছি। অন্তিম মুহূর্তে আনন্দে মেতেছে সিনিয়ররা। গান বাজিয়ে উড়ুম ধুড়ুম নাচের তালে রং মাখছে। বাহারাজকে ধরে রংএ ভূত করে ফেলেছে। রুদ্র ও তীব্র যথারীতি মাটিতে শুয়ে নাগিন ড্যান্স করছে। হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা আমার। পাক্কা পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বাহারাজদের বাড়িতে উদ্দেশ্য রওনা দিলাম। যানবাহনের দেখা নেই পথঘাটে। ফাঁকা রাস্তায় ফিক করে হেসে বললাম, “বাহারাজ ভাই, আপনি যদি এখানে কাকতাড়ুয়া মতো দাঁড়িয়ে থাকেন। বিশ্বাস করেন, সবাই আপনাকে এলিয়েন ভেবে ভিন গ্ৰহে চালান করে দিবে?”

বাহারাজ হাঁটা থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। থমথমে মুখমণ্ডলে আমি চুপসানো বেলুনের মতো চুপসে গেলাম। পাঞ্জাবির পকেট থেকে রং বের করে আচমকাই আমাকে মেখে দিল। বোকাকান্তর ন্যায় চেয়ে রইলাম। পরিস্থিতি বোধগম্য হতেই ছুটতে লাগলাম। বাহারাজ দমে না গিয়ে আমার পেছনে ছুটল। তার লম্বা লম্বা কদমে আমাকে আয়ত্ত করতে মিনিট দুয়ের বেশি লাগল না। আমার দুহাত একসাথে তার ডান হাত দিয়ে চেপে ধরল। পেছনে গুটিয়ে রংগুলো ছিটিয়ে দিল সর্বাঙ্গে। পরিত্রাণ হলো না অবলা চুলগুলোর। কিছুক্ষণ পেঁচা মুখ করে থেকে হেসে ফেললাম। বাহারাজও আমার সাথে তাল মিলিয়ে হাসল। এত কাছ থেকে বাহারাজকে দেখে নিজেকে ছন্নছাড়া অনুভব করছি। হার্টবিট বেড়ে যাওয়ার ক্রমশ। কিছুক্ষণ পর বাহারাজ ছেড়ে দিল। আমি রাস্তায় বসে ঘনঘন শ্বাস নিলাম। আমাকে সঙ্গ দিতে বাহারাজও বসল। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “হাঁটতে কষ্ট লাগছে ওয়াটার?”

“কে ওয়াটার?”

“তুমি! হানি থেকে পানি। পানি থেকে ওয়াটার।”
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বাহারাজকে রেখেই হাঁটা দিলাম। পায়ের শব্দ শুনে বুঝলাম, বাহারাজ পেছনে পেছনে আসছে। কিছুক্ষণ পরেই তিন রাস্তার মোড় এলো। কোন পথ ধরতে হবে, তাই দাঁড়িয়ে গেলাম। বাহারাজ হাসতে হাসতে বলল, “দম শেষ? তোমার ভাবসাব দেখে ভেবেছি শ্বশুর বাড়ি চেনো।”

“কার শ্বশুরবাড়ি?”

“কার আর? তোমার বোনের! তোমারও কি বিয়ের শখ জেগেছে?”

“জাগতেই পারে। বিয়ে করা ফরজ।” আমি ভেংচি দিয়ে বললাম। বাহারাজ এক পলক চেয়ে এগিয়ে গেল। বাড়ির নাম ‘আদ্রিয়ান মহল’। দোতলা বাড়িটার চারদিকে তাকিয়ে আভিজাত্যর ছোঁয়া পেলাম। শুভ্র রং প্রকাশ করছে তার ঐতিহ্য। নিঃসন্দেহে নিপুণা মিসেস আদ্রিয়ান। ভেতরটা ভীষণ পরিপাটি। আমি মুগ্ধ হয়ে আদ্রিয়ান মহল দেখছি। বাহারাজ তখন দোতলায় উঠে গেছে। নিজের কক্ষের দিকে অগ্রসর হতে হতে বলল, “আমি শাওয়ার নিতে যাচ্ছি, তুমিও শাওয়ার নাও।”

চমকে উঠলাম আমি। শাওয়ার নিব পোশাক কোথায়? চ্যাঁচিয়ে বললাম, “শাওয়ার নিয়ে কি পরব, আপনার মাথা?”

বাহারাজ দাঁড়িয়ে গেল। আমি ছুটে যেয়ে ওর সমুখে দাঁড়ালাম। ভীষণ চিন্তিত দেখা গেল ওকে। গম্ভীর দৃষ্টিতে আমাকে পর্যবেক্ষণ করে বলল, “হানি, মায়ের শাড়িতে তোমার হবে?”

“রাতে কেউ শাড়ি পরে ঘুমায়? তাছাড়া আন্টির ব্লাউজে আমার হবে?”

“কত তোমার? থার্টি টু নাকি থার্টি সিক্স!” বাহারাজের গলায় লজ্জায় মুখ কুঁচকে এলো আমার। পেছনে ফিরে বললাম, “আন্টি কোথায়, তাকে ডাকুন! তার ছেলে কতটা অসভ্য একটু বলি।”

“হাউ ফানি! তাকে বলার কী আছে? আমাকে বলো।”

“তাকেই বলল।”

“বাবা মা ঘরে নেই, তারাও তোমার বাবা মায়ের সাথে গেছে!”

“কোথায় গেছে? কেন গেছে একটু বলবেন?”
বাহারাজের পেছনে পেছনে তার ঘরে গেলাম। তার কক্ষটি নজরকাড়া সুন্দর। প্রতিটি আসবাবপত্র তার নির্দিষ্ট জায়গায় রেখেছে। জানালাগুলো যথেষ্ট বড়ো। দুপাশে কাপড়ের লম্বা আচ্ছাদন। খাট ঘরের মধ্যে রাখা। দুপাশে ছোটো দুটো টেবিল। বিছানার উপরের দেয়ালে বাহারাজের বাঁধাই করা ছবি। বাবড়ি চুলগুলো খোলা রাখায় সুশ্রী মুখটা নজর কেড়েছে। আমার চোখ এক মুহুর্তের জন্যও সরেনি। বাহারাজ আলমারি থেকে ট্রাউজার ও টিশার্ট বের করে তখনকার প্রশ্নের জবাব দিল,

“আমি ঠিক জানি না। তুমি কল করে জেনে নিও। আর হ্যাঁ। আমার আলমারি চেক করে দেখো, পরনের কিছু পাও কিনা।”
বাহারাজ চঞ্চল পায়ে ওয়াশ রুমে চলে গেল। হাতল টেনে আলমারি খুলতে আশ্চর্যান্বিত হলাম। ছেলেদের আলমারি এত গোছানো হয়? খুঁজে খুঁজে সাদা টিশার্ট ও সবুজ রঙের ট্রাউজার বের করলাম। বিছানায় রেখে মায়ের নাম্বারে ডায়াল করলাম। পনেরো মিনিট বত্রিশ সেকেন্ড কথা হলেও জানাল না তারা কোথায় আছে, কেন গিয়েছে? আমি বিছানায় এসে বাহারাজের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। বাহারাজের ওয়াশ রুম থেকে বের হওয়ার নাম নেই। বেশ সময় নিয়ে গোসল শেষে বেরিয়ে এলো বাহারাজ। তাকে দেখে নির্বাক হয়ে গেলাম। বাবড়ি চুলগুলো ছড়িয়ে আছে পুরো মাথায়। বিন্দু বিন্দু পানি ঝরছে তার চুল থেকে। গোসলের পরে সুদর্শন রূপটা শতগুণ বেড়ে গেছে। তুরি বাজিয়ে বলল, “হোয়ার্ট হ্যাপেন্ড? ওয়াশ রুমে যাও।”

চলবে… ইন শা আল্লাহ