তুমি থেকো দাঁড়িয়ে খোলা বারান্দায় পর্ব-২৭+২৮+২৯

0
12

#তুমি_থেকো_দাঁড়িয়ে_খোলা_বারান্দায়
#ইফা_আমহদ
পর্ব: ২৭

মোংলাঘাট থেকে বোটে করে রওনা হলাম কর্টেজের উদ্দেশ্যে। যাত্রাপথে আমাদের সঙ্গী হলো কয়েকজন দম্পতি ও বন্ধুবান্ধবের এক উচ্ছ্বসিত দল। পরশু নদীর দুই পাশ জুড়ে ছায়াঘেরা গাছগাছালি, পাখিদের কিচিরমিচির, আর শীতল হাওয়ার পরশ—সব মিলিয়ে এক অপূর্ব পরিবেশ। সুন্দরবনের কাছাকাছি পৌঁছানোর আগেই প্রকৃতি যেন আমাদের স্বাগত জানাতে ব্যস্ত।

আমি বোর্ডের এক কোণে বসে মুহূর্তগুলো গভীরভাবে উপভোগ করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু হঠাৎই সিএনজি-র সেই চিরচেনা ঝাঁকুনি যেন মনের গভীর থেকে উঠে এলো। গ্যাসে চালিত যেকোনো যানবাহনে উঠলে আমার এই দুরবস্থা হয়। বুকের ভেতরটা মোচড়াতে থাকে, যেন এখনই সব উল্টে ফেলব। এক হাতে চোখমুখ ঢেকে নিজেকে সামলে রাখার চেষ্টা করছি, অন্য হাতে বাহারাজের হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছি। কিছুদূর যেতেই আর সহ্য হলো না—জায়গা ছেড়ে বোটের একদম কিনারায় গিয়ে ঝুঁকে বমি করে দিলাম। বাহারাজ তৎক্ষণাৎ ছুটে এসে এক হাতে আমার শরীর ধরে, আরেক হাতে মাথাটা থামিয়ে রাখে। অসুস্থতায় শরীরটা একেবারে নিস্তেজ হয়ে এলো। তবুও বাহারাজের সেই নিঃশব্দ সঙ্গ যেন একটুখানি প্রশান্তি এনে দিল। তিনি ব্যথিত কণ্ঠে বলল, “কষ্ট হচ্ছে? আরেকটু পথ। তুমি যে বোটে উঠতে পারো না, আমাকে আগে কেন বলোনি?”

আমি দুর্বল কণ্ঠে বললাম, “সমস্যাটা বোটে না, সিএনজিতে। গ্যাস পেটে গেলে আমার খুব দুর্বল লাগে।”

তিনি নিঃশ্বাস ফেললেন। “আশা করি এবার একটু রিলিফ লাগছে।” বলেই বাহারাজ আমাকে নিয়ে পূর্বের জায়গায় এসে বসল।

এমন সময় এক দম্পতি আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, “ভাবি কি প্রেগন্যান্ট ভাই? দেখে তো বোঝা যায় না একদম, পিচ্চি লাগে। প্রেম করে বিয়ে করেছেন নিশ্চয়!”

হতভম্ব হয়ে বাহারাজের দিকে তাকালাম। চোখে তার নীলাভ সানগ্লাস, বাবরি চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছে। আত্মবিশ্বাসে ভরা গলায় বলল, “হ্যাঁ ভাই। হানিমুনেও যাওয়া হয়নি এখনো। ভাবলাম, স্ত্রীর এই সময়টা প্রকৃতির কাছে কাটুক। ‘মা আর বাচ্চা’— দুজনেই ভালো থাকবে।”

লোকটা সঙ্গে সঙ্গেই গালে হাত রেখে বলল, “বাহ্! দারুণ আইডিয়া। তবে বেবিটা কয়েক বছর পর নিলেই ভালো হতো।”

বাহারাজ এবার আমার দিকে তাকিয়ে একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বলল, “আমিও তাই বলেছিলাম, কিন্তু উনি বাচ্চার জন্য কাঁদছিলেন। ওর ধারণা, বাচ্চা হলেই সম্পর্কটা শক্ত হবে। নাহলে আমি নাকি একদিন ওকে ছেড়ে চলে যাবো। যেহেতু বাচ্চা নিতেই হবে, আমিও রাজি হয়ে গেলাম।”

এই মুহূর্তে আমার কী বলা উচিত, আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। ভেতরে একরাশ লজ্জা, রাগ, বিস্ময় আর এক চিলতে হাসিও যেন কাঁপতে কাঁপতে একসাথে উঠে এলো। শুধু একটা কথা গলার কাছে এসে আটকে গেল—”এই লোকটা পা/গ/ল! কিন্তু এই পা/গ/লা/মি/র মাঝেই যেন আমার সবটা।”
দুই ঘণ্টা পর আমরা এসে পৌঁছালাম আমাদের রিসোর্টে। কাঠের তৈরি দেয়ালে একটা রাজকীয় ছোঁয়া, যেন ঠিক বনভূমির মাঝেও শহুরে আরাম মিশে আছে। সামনে খোলা বারান্দা, আর তাতে একটা দোলনা। যেটায় বসে নিরিবিলিতে প্রকৃতিকে কাছে টেনে নেওয়া যাবে। ঘরটা আমার বেশ মনে ধরল। উষ্ণ আলো, কাঠের মেঝে, আর জানালার ওপার থেকে ঢুকে আসা সবুজের ছায়া যেন ক্লান্ত চোখে শান্তির ছোঁয়া বুলিয়ে দিল। আমি একনজরে পুরো রিসোর্টটা ঘুরে এসে ধীরে ধীরে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। চোখে ক্লান্তি, কিন্তু মনে এখনো ঘোরাঘুরির রেশ।
আঙুল তুলে বাহারাজকে লক্ষ করে বললাম, “আমি প্রেগন্যান্ট?”

বাহারাজ ট্রাভেলিং ব্যাগ থেকে জামাকাপড় বের করছিল। থেমে না গিয়ে হেসে বলল, “তুমি যেভাবে বমি করছিলে, সবাই তাই ভেবেছে। মধুচন্দ্রিমার আগেই বাবা হয়ে গেলাম। বউকে ঠিক করে ধরলাম না, ছুঁলাম না। অথচ বাবা! কী সাংঘাতিক ব্যাপার, বলো দেখি!”
বলেই সে চঞ্চল পায়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল, যেন নিজের নাটকীয় সংলাপের জন্য নিজেই হেসে উধাও হয়ে গেল। আর আমি? আমি ঝিমঝিম করা মাথার নিচে নরম বালিশ গুঁজে ধীরে ধীরে ঘুমের দেশে এগিয়ে গেলাম।
___
গোসল করে গোলাপি রঙের থ্রিপিস পরে বেরিয়ে এলাম ওয়াশরুম থেকে। চুল ভেজা, শরীর জুড়ে গা-ছোঁয়া গন্ধ। বাহারাজ তখন বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে গেমস খেলছিল। মুখে একচিলতে হাসি, চোখে মনোযোগ। আমি ওর শান্তিকে একটু ঝাঁকি দিতে, ভেজা তোয়ালেটা ছুঁড়ে মারলাম ওর মুখের ওপর। বাহারাজ তোয়ালের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। ধীরে ধীরে তোয়ালেটা নামিয়ে বলল, “গোলাপী রঙে তোমাকে দারুণ লাগে মধু।”

আমি মুখ ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকালাম, যেন কিছুই হয়নি। অথচ ভেতরে হালকা একটা কম্পন বয়ে যাচ্ছিল।
বাহারাজ বিছানা থেকে উঠে এসে ধীরে ধীরে আমার পিঠের কাছে এসে দাঁড়ান। তার উপস্থিতি যেন একটি অদৃশ্য প্রভাবে আমার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে, এক অদ্ভুত উষ্ণতা আমার শরীরে অনুভূত হয়। তার নরম শ্বাস আমার কাঁধে যেন এক অদৃশ্য স্পর্শের মতো। খোলা চুল সরিয়ে একপাশে নিয়ে তার চোয়াল রাখল আমার কাঁধে। তার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি যেন আমার কাঁধে সুঁইয়ের মতো ঢুকে গেল। চোখ বন্ধ করে মৃদু আর্তনাদ করলাম, “আহ্!”

বাহারাজ হেসে বলল, “তোয়ালে আমাকে দিয়ে চুলগুলো কি গুনে গুনে শুকাকে মধুরানী?”
আমি দূরত্ব নিয়ে তার থেকে অনেকটা সরে এলাম। বাহারাজ সেই দূরত্বকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আমার হাত টেনে দূরত্ব নিল শূন্যের কোঠায়। অতঃপর হাতদুটো কাঠের দেয়ালে রেখে আমার গতিরোধ করে ফেলল। বাঁধা পড়লাম দুই বাহুর মাঝে। তার মস্তিষ্ক নিচের দিকে নেমে আসতেই দরজার কড়া নেড়ে দিল কেউ। বাহারাজ বিরক্তিতে ‘চ’ সদৃশ বাক্য ব্যবহার করতে নিয়েও গিলে ফেলল। আমাকে রেখে দরজার ছিটকিনি নামিয়ে খাবার নিল। অতঃপর তাকে বিদায় করে বিছানায় সাজিয়ে রাখল খাবারগুলো। চোখের সামনে খাবারগুলো দেখে পেটের ক্ষুধা তাড়া দিয়ে উঠল। সব কাজ ফেলে আসন পেতে বসলাম বিছানায়। গরম ভাত ও কলা পাতায় মোড়ানো কোনো খাবার‌। বাহারাজ পাশে খাবার বেড়ে দিল আমাকে। কলাপাতা খুলে পাতলা মাংস নিয়ে মুখে দিতেই স্বাদে আমার চোখ বন্ধ হয়ে এলো। আহা! কী অপূর্ব স্বাদ। আমি খেতে খেতে বলল, “কী মজা! নাম কী এই মাংসের?”

বাহারাজ আরেকটা কলাপাতা ছাড়িয়ে মাছের টুকরো আমার পাতে তুলে দিল। আমি তা মুখে দিয়ে যেন এক অমৃতের স্বাদ পেলাম। তৃপ্তি করে খেতে খেতে বললাম, “বলুন না এই খাবারের নাম কী?”

বাহারাজ আরেকটা কলাপাতা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, “এটা মাছ-মাংসের পাতুরি।”

শহরের মেয়ে হয়ে, এই ধরনের খাবার আমার আগে কখনো চেখে দেখা হয়নি। একনাগাড়ে খেতে খেতে হঠাৎ আমি অনুভব করলাম, আমি যেন সবই খেয়ে ফেলেছি। বাহারাজ তখন কেবল সাদা গরম ভাত নিয়ে বসে আছে। আমার চোখের সামনে থাকা প্লেটের অবস্থা দেখে, আমি নিচের ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে বললাম, “সব খেয়ে ফেললাম, এবার আপনি কী খাবেন? আবার অর্ডার করুন।”

বাহারাজ তখন প্লেট গোছাতে গোছাতে হেসে বলল, “খেতে হলে আগে অর্ডার করতে হবে। আমাদের অনুমান করে চারটা অর্ডার করেছি। অথচ আমাকে অনাহারে রেখে, আমার অর্ধাঙ্গিনী তৃপ্তি সহকারে সব খেয়ে ফেললেন।”

নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হলাম আমি। কীভাবে এমন কাজ করে বসলাম! কাল রাতে আমি খেয়েছি, বাহারাজ খায়নি। তিনি অনেকক্ষণ না খেয়ে আছেন, অথচ আমি খেতে খেতে তার ক্ষুধার কথা একটুও ভাবলাম না। কীভাবে এমন অমনোযোগী ও অবিবেচক হলাম! আচমকা ভেঙে কান্না আসল আমার। হৃদয়ের ভেতর একরাশ দুঃখ ও অপরাধবোধ জড়ো হয়ে গেল। বাহারাজ দ্রুত আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আরে পাগল, কাঁদছ কেন? আমার তেমন ক্ষুধা পাইনি।”

আমি তার দিকে হতাশাগ্রস্থ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, “আপনি মিথ্যা বলছেন, বাহারাজ। আপনার ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে।”

“একটু পেয়েছিল, কিন্তু চিন্তা করো না,” তিনি মৃদু হাসলেন, “আমরা একটু পর নৌকায় করে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট কাছ থেকে দেখতে বের হব। যাত্রাপথে কিছু খেয়ে নিব।”

আমি তড়িঘড়ি করে বললাম, “দুই মিনিট সময় দিন, আমি এখনই তৈরি হয়ে আসছি।”

ঘড়ির কাঁটায় দুই মিনিটের মধ্যেই আমি তৈরি হয়ে নিলাম, অদ্ভুত তাড়ায়। বাহারাজ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল, যেন আমাকে একটু বুঝতে চাইছিল, কেন এত দ্রুত সব কিছু করতে যাচ্ছি।

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

#তুমি_থেকো_দাঁড়িয়ে_খোলা_বারান্দায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৮

ঘরের কাঁটা বিকাল তিনটার ঘরে। সূর্যটা প্রখর রোদে নদীর জলে তার সোনালি আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। নৌকাটা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে – চারপাশে শুধু জল, আর দূরে দেখা যাচ্ছে গাছের মাথা। এ যেন অন্য এক পৃথিবী। শব্দ নেই, কোলাহল নেই—শুধু প্রকৃতি আর আমরা। নৌকা ঢুকে পড়ল ঘন ম্যানগ্রোভ জঙ্গলে। গাছগুলোর শ্বাসমূল পানির ওপর থেকে বেরিয়ে এসে যেন বলছে, “আমরা আছি, আমরা শ্বাস নিচ্ছি।” চারপাশে এত ঘন সবুজ যে, রোদও ফাঁক খুঁজে নিচ্ছে ঢোকার জন্য। হঠাৎ একটা হালকা শব্দ—মনে হলো কোথাও হরিণ দৌড় দিল। চোখ আটকে গেল বনভূমির গভীরে, কুয়াশার মধ্যে যেন কিছু একটা নড়ল… বাঘ? হয়তো! হয়তো নয়। সুন্দরবনের সৌন্দর্য এখানেই—অদেখার মধ্যেই রহস্য। পাখিদের ডাক চারপাশে বেজে উঠছে, যেন তারা কথা বলছে একে অপরের সঙ্গে। একটি জলপাই রঙের পাখি হঠাৎ নৌকার পাশ দিয়ে উড়ে গেল, তার ডানায় রোদের ঝিলিক। মনটা এক অদ্ভুত শান্তিতে ভরে গেল। এখানে আসলে বুঝি, প্রকৃতি আসলে কথা বলে—তাকে শুধু মন দিয়ে শুনতে হয়। নৌকাটাতে আমরা তিনজন আছি কেবল। আমি ও বাহারাজ সামনে বসে উপভোগ করছি ও মাঝি দাঁড় ঠেলে আমাদের উপভোগ করতে সাহায্য করছে। আমি বাহরাজের হাতটা জড়িয়ে ওর কাঁধে মাথা রেখে বললাম, “এত কাছ থেকে কখনো সৌন্দর্য দেখা হয়নি। ভয়টাও করছে একটু একটু। আমি বরাবর একটা বিলাসবহুল হোটেলে গিয়ে উঠেছি, পার্কে ঘুরেছি।”

বাহারাজ আমার ললাটে আলতো করে একটা চুমু খেল। আমি লজ্জায় মাথা নামাতেই ও বলল, “ভয়টা দূর করে ফেলো দেখি। তোমার পাশে তোমার রাজ আছে।”

হঠাৎ এক জায়গায় নদীটা সরু হয়ে এল। গাছের শেকড়গুলো পানিতে যেন একে অপরকে জড়িয়ে আছে, ভালোবাসার বন্ধনে। ঠিক যেমন আমরা একে অপরকে জড়িয়ে রেখেছি। মাঝি বলল, “ওই জায়গাটার নাম বুড়ো খাঁড়ি। ওখানে বাঘের পায়ের ছাপ দেখা গিয়েছিল গত সপ্তাহে।”

আমি বাহারাজের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলাম। নড়তে নড়তে উঠে গেলাম একদম ওর কোলে। ধুক করে বুক কেঁপে উঠল ভয়ে। যদি হঠাৎ করে গাছগাছালি ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে ওরা বলে, “হানি কেমন আছো?”
তখন ওই দমবন্ধ পরিবেশে আমি এক ফোঁটাও অক্সিজেন পাবো না। তখনই দেখা গেল একটা হরিণ। সে দাঁড়িয়ে, জঙ্গলের পাশে। আমাদের দিকে একবার তাকিয়ে আবার চলে গেল। মুহূর্তটা যেন ধরা দিল, আবার মিলিয়ে গেল। এরপর একটা বানরের দল, কিছু কাঁকড়া, আর অনেক নাম না জানা পাখি। নৌকা থামল কটকার ঘাটে। চারপাশে কাদার গন্ধ, কিন্তু বাতাসে হালকা লবণের টান। দূর থেকে কটকা রেঞ্জার স্টেশনের ছায়া দেখা যায়, পাশে টিনের ছাউনির ঘর, পেছনে শুরু বন। আমরা কাঠের পাটাতনে নামতেই মাঝি সতর্ক করল, “সতর্ক থাকবেন—এখানে সব হরিণ নিরীহ না, আর সব ছায়া গাছের না।”

বাহারাজ ফিসফিস করে বলল, “ভালোমন্দ মিলিয়ে আমাদের এই প্রকৃতি। তাকে কাছ থেকে উপভোগ করা ভাগ্যের ব্যাপার।”
একটা দমকা হাওয়া আমাকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে তুলল। আমার প্রথম চোখে পড়ে বিস্তীর্ণ খোলা প্রান্তর। ঝাউগাছের ছায়া, ঘাসের ঢেউ, আর মাঝে মাঝে দৌড়ে যাওয়া হরিণের দল। বাহারাজ আমাকে নিয়ে নিঃশব্দে পা এগোয় সেদিকে। কাঁদার মতো জুতা আটকে গেলে চুস চুস করে শব্দ হচ্ছে। বাহারাজ জুতা খুলে হাতে নিয়ে বলল, “পায়ে শক্ত একটা আস্তরণ থাকলে ঠিক ফিল করতে পারি না।”

“পায়ে কিছু ফুটে গেলে?”

“আমরা হচ্ছি এমন জাতি, যারা রাস্তাঘাটে অনেককিছু ফেলি। কিন্তু অবলা প্রাণীরা তাদের বসবাসের স্থানকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখে।” বাহারাজের কথায় আমি মাটির দিকে তাকালাম। পায়ের নিচে তাজা রক্ত দেখে অবিলম্বে পিছিয়ে গেলাম দুপা। গলা শুকিয়ে আসতেই বাহারাজ বলল, “এটা সকালে হয়েছে। কাছেই আছে হয়তো।”
বাহারাজ আচমকা আমার চোখ বেঁধে সামনের দিকে নিয়ে গেল। হাঁটার সময় অনুভব করলাম আমরা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছি। আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে বাহারাজ আমার চোখ ছেড়ে দিল। এখান থেকে সুন্দরবনকে একনজরে দেখা যায়। পাশাপাশি সুন্দরবনের মাঝে এমন একটি স্থান থেকে বিস্মিত হলাম আমি। আমার চোখের কোনে পানি চলে এলো। বাহারাজ জেনেও না জানার ভান করে বলল, “কাঁদছ কেন?”

পিঠটা বাহারাজের পিঠে ঠেকিয়ে বললাম,‌ “এত সুন্দর করে কেউ আমাকে সারপ্রাইজ দেয়নি বাহারাজ। বিলাসিতা ছেড়েও যে প্রকৃতিকে অনুভব করা যায়, আপনার হাত ধরে আমি শিখলাম।”

উপর থেকে আরও কয়েক জোড়া কপোত কপোতীদের দেখলাম। সবাই প্রিয় মানুষকে নিয়ে মেতেছে প্রকৃতির প্রেমে। বাহারাজ আমার চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দিয়ে বলল, “এখান থেকে প্রকৃতির সাথে তোমার যাত্রা শুরু হলো মধু। ধন্যবাদগুলো তুলে রাখো। একসাথে দিও।”

সময় তখন পেছন থেকে তাড়া করছে আমাদের। সূর্যটা একটু একটু করে পশ্চিমের দিকে হেলে পড়ছে, আর আমরা টক্কর দিচ্ছি সময়ের সাথে। কাটকা থেকে পা বাড়ালাম জমতলা সমুদ্র সৈকতের দিকে। প্রথম দেখা, অথচ মনে হলো—এ যেন কক্সবাজারের কোনো হারানো খণ্ডচিত্র! জল অনেকটাই সরে গেছে, ভাটার কারণে সৈকতের বুকে জন্ম নিয়েছে বিস্তীর্ণ বালুর প্রান্তর।

আমি বাহারাজের হাত ধরে ধীরে ধীরে নেমে গেলাম বালুর মাঝে। মাঝে মাঝে ঢেউ এসে পায়ের পাতায় নিঃশব্দ চুমু দিয়ে যাচ্ছে—মেঘলা ভালোবাসার মতো। হঠাৎ বাহারাজ আমার হাত ছেড়ে কাঁধে রাখল আলতো করে। চোখে ছিল নরম এক হাসি, গলায় হালকা আক্ষেপ, “যদি জামাকাপড় আনতাম, পানিতে নামা যেত। বিচে গোসল করাটা আমার খুব প্রিয়।”

আমি তখন আবদার জুড়ে দিলাম শিশুর মতো,
“চলুন না, একবারই তো।”

বাহারাজ হাসল, চোখে আদর রেখে বলল, “সম্ভব নয়। এখন ভিজলে ঠান্ডা লেগে যাবে। তাছাড়া আমাদের হাতে সময় নেই। অন্ধকার নামার আগেই রিসোর্টে ফিরতে হবে।”

ঢেউ তখনো আসছে। পায়ের কাছে গিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমার অপেক্ষা, আমার অনিচ্ছা। আর আমি দাঁড়িয়ে আছি, কিছু না পাওয়ার তৃপ্তি নিয়েই। বাহারাজ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর হেসে বলল, “তুমি চাইলে, পৃথিবীও বদলাতে বাধ্য!”
আমরা দুজনেই হাত ধরে এগিয়ে গেলাম জলের দিকে। ঢেউ তখন আমাদের পা ছুঁয়ে ফিরে যাচ্ছিল, আর আমরা ধীরে ধীরে কোমর সমান জলে দাঁড়ালাম। সাঁতার না জানার কারণে বাহারাজের হাতটা ধরে রাখলাম। ও আমার এই হাতটা কখনো ছাড়বে না – এটা আমার বিশ্বাস।
পানি ঠান্ডা ছিল, কিন্তু সেই ঠান্ডার মধ্যেও ছিল একরকম উষ্ণতা—ভেতরের আনন্দের উষ্ণতা। বাহারাজ আমার দিকে পানি ছুঁড়ে দিল। আমি হেসে পাল্টা ছুঁড়লাম। কিছুক্ষণ পরে দুজনেই একসাথে ঢেউয়ের সাথে খেলতে লাগলাম। আমাদের হাসির শব্দ, পানির ছিটে, চোখে মুখে লেগে থাকা সূর্যরশ্মি—সব মিলে যেন একটা ছোটখাটো সিনেমার দৃশ্য। একটা ঢেউ এসে হঠাৎ করে আমাদের দুজনকে আরও কাছে এনে দিল। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে বাহারজের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারলাম না। বাহারাজ দু আঙুলে আমার থুতনি ওপরে তুলে বলল, “এই মুহূর্তটা আমি কোনোদিন ভুলতে চাই না।”

আমি চুপ করে রইলাম, শুধু মনে মনে বললাম, “এই রোদ, এই ঢেউ, আর তুমি- এটাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতা।”

আমাদের পানিতে নামতে দেখে আরও কয়েক দলও সাহস করে সমুদ্রের কাছে এগিয়ে এল। তারা কাছ থেকে ঢেউয়ের আহ্বান অনুভব করতে লাগল, উপভোগ করতে লাগল বিশাল জলরাশির ছোঁয়া।হঠাৎ করেই বাহারাজ আমাকে কোলে তুলে নিল। পায়ের নিচ থেকে বালুর শক্ত ভরটা যেন হারিয়ে ফেললাম, আর স্বাভাবিকভাবেই আমি দ্রু করে ওর কাঁধ আঁকড়ে ধরলাম। বাহারাজ আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে আমাকে পানির ঠিক উপরে এমনভাবে ধরে রাখল, যেন আমি জলে ভাসমান একটি পদ্মফুল। নির্ভার, নিঃশব্দ, অথচ নিখুঁতভাবে সজীব।

ওর বাহুতে ভর দিয়ে আমি ঢেউগুলোর পূর্ণ স্পর্শ পেতে লাগলাম। পানির কণা গায়ে এসে পড়ছিল, আর আমি সেই মুহূর্তে প্রকৃতির, ভালোবাসার আর বাহারাজের মাঝে এক অপার আনন্দে ভেসে যাচ্ছিলাম। আমার অশ্রুধারা মিশে যাচ্ছিল নোনাজলে।

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

#তুমি_থেকো_দাঁড়িয়ে_খোলা_বারান্দায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৯

সমুদ্রের গাঢ় জলে দীর্ঘক্ষণ ভেসে থাকার পর মাথাটা ভারী হয়ে উঠেছিল। রিসোর্টে ফিরে গিয়ে আরেকবার গোসল সেরে এলাম। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখি, বাহারাজ আমার জন্য চুপচাপ অপেক্ষা করছে।
চুল মুছতে মুছতে হাসিমুখে বললাম, “আমার হয়ে গেছে। আপনি এবার যান।”

আমি জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম, মুখ সমুদ্রের দিকে। বাহারাজের জামাকাপড় তো নৌকাতেই শুকিয়ে গিয়েছিল, তাই সে ওয়াশরুমের দিকে এগোল না। বরং, চুপচাপ এসে আমার একদম পিঠ ঘেঁষে দাঁড়াল।
আমি চমকে উঠে বললাম, “আপনি গোসল করতে না যান, অন্তত পোশাকটা তো পালটে নিন, জনাব।”

কিন্তু সে কিছু বলল না। হঠাৎ বাহারাজ আমার হাত ধরে আমাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিল। কোমরের দুই পাশে তার হাত রেখে টেনে নিল একদম কাছে। তোয়ালে ছেড়ে আমি বাহু জড়িয়ে ধরলাম। তিনি খানিক ঝুঁকে প্রেমভরা কণ্ঠে বলল, “হানি, আজ আমি নিজেকে তোমাতে হারাতে চাই। আমাকে অনুমতি দাও?”

আমি মাথা নিচু করে চাপা একটা হাসি হাসলাম। বাহারাজ নিশ্চুপ হয়ে আমার উত্তরের সমস্ত ভাষা পড়ে নিল। তর্জনী দিয়ে আমার মুখমণ্ডল উপরে তুলে নিল। তার সাথে চোখাচোখি হতেই লজ্জায় আমি চোখজোড়া বন্ধ করে ফেললাম। তার হাত দুটো আমার ঘাড়ে এসে থামল। নাকটা এসে থামল আমার নাকের ডগায়। ওষ্ঠদ্বয় আমার ওষ্ঠদ্বয় চাপা দিতেই দেয়ালের সাথে হেলে পড়লাম আমি। বিচ্ছেদ ঘটল সাময়িক সময়ের জন্য। আমি চোখ মেলে তাকালাম। অবিলম্বে দূরত্ব শূন্যের কোঠায় নামিয়ে লেপ্টে গেল আমার সাথে। সুখের সময়ে আমার মধ্যে এসে জড়োসড়ো হলো এক বিশাল অপরাধবোধ। চোখ থেকে ঝরে পড়ল দুফোঁটা অশ্রু। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। বাহারাজ চমকে ছেড়ে দাঁড়াল। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “হানি ব্যথা পেয়েছ? কাঁদছ কেন?”

“আমার খুব ভয় করছে। প্রথমবার পরিবারের থেকে এতবড় সত্যিটা লুকিয়ে রেখেছি।”

“হানি আমার ওপরে একটু বিশ্বাস রাখো। আমি থাকতে কীসের ভয়? আমি সবকিছু ঠিক করে দিব, প্রমিস।” বাহারাজের কথায় ভেতরে ভেতরে একটু জোর পেলাম। তবুও বললাম, “যদি বড় কোনো ঝামেলা হয়!”

“সেই ঝামেলার সমাধান আমি করব হানি। তোমার একটু বিশ্বাস চাই।”

“করি বিশ্বাস।”
বলেই বাহারাজকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। বাহারাজ আমাকে কোলে তুলে নিল। ধীর কদমে বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, “আজ আমাদের ভালোবাসার বিশেষ একটা নাম হবে। বাহানি।”
বাহারাজের কণ্ঠের উত্তাপ যেন আমার শরীরের প্রতিটি স্নায়ুতে ছড়িয়ে পড়ল।আমি চোখ নামিয়ে নিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারিনি। ওর দৃষ্টি আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছিল। তার দু’হাত আমার মুখের দুই পাশে এসে থেমে গেল।

“তুমি জানো, অন্তরালে শুধু তুমি থাকবে।আমার অস্তিত্বের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত।
‘তোমার কান্না, তোমার হাসি, তোমার সমস্ত অপরাধবোধ’- সব কিছুই আমি আপন করে নেব। কোনো ভয় থাকবে না, কোনো লজ্জা থাকবে না, কোনো ছদ্মবেশ থাকবে না।
শুধু তুমি আর আমি! হৃদয়ে! আত্মায়।”

গলার ভেতর দলা পাকিয়ে আসা কান্না চাপতে পারলাম না। আলতো কাঁপতে কাঁপতে বাহারাজের বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে দিলাম। ওর বাহু জড়িয়ে ধরল আমাকে, এমন করে, যেন চিরকাল কোনো ঝড়-ঝঞ্ঝা আমাদের ছুঁতে পারবে না। একমাত্র এই মানুষটাকেই আজ, চুপচাপ, নিঃশর্তভাবে আমি আমার সমস্ত ভেতর দিতে চাই।
চোখ খুলে দেখি, বাহারাজও আমায় গভীরভাবে দেখছে। এক মুহূর্তের জন্য যেন সময় স্তব্ধ হয়ে গেল। তারপর, দুজন মিলে হারিয়ে গেলাম সেই নামে। বাহানি!
সেই রাতে, সমুদ্র সাক্ষী রইল আমাদের প্রেমের।
__

সূর্য তার নির্দিষ্ট নিয়মে উদিত হয়েছে।
তবে আমাদের রোজকার নিয়মে ঘটেছে এক অদ্ভুত পরিবর্তন। ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরেও কাঁথার ভেতর থেকে মাথা বের করছি না। শরীরে মৃদু ব্যথার শ্বাস ছড়িয়ে আছে। মাথা ভার, সমস্ত শরীর অদ্ভুত ক্লান্তিতে জড়িয়ে। এই অসুস্থ, অবসন্ন শরীর নিয়ে গোসল করা আমার পক্ষে এখন অসম্ভব। কাঁথার ভেতর গুটিশুটি মে/রে পড়ে আছি। চোখের কোণ দিয়ে দেখি, বাহারাজ ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসেছে। পরনে শুধু শুভ্র তোয়ালে, চুলগুলো ভেজা, জল টপটপ করে পড়ছে ঘাড় বেয়ে। হাত দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে সে হাসিমুখে বলল, “এখনো কি এভাবে শুয়েই থাকবে?”

আমি কাঁথার মধ্যে মুখ গুঁজে বিরক্তির সাথে বললাম, “তো কী করব? সারাদিন শুধু গোসলই করব নাকি?”

বাহারাজ হালকা হেসে কাঁথার ওপর ঝুঁকে এলো। কণ্ঠ মিষ্টি, “আদর করলাম একবার অথচ তুমি গোসল করবে তিনবার, এর দায় কী আমার?”

আমি ঠোঁট কামড়ে রাগ চেপে রাখলাম।
তারপর চাপা রাগ দেখিয়ে কাঁথার ভেতরেই আরেকটু গুটিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রইলাম। ধীরে ধীরে বললাম,
“আমি কি বলেছি একবার করতে?”

বাহারাজ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল।
তারপর গলা ঝেড়ে ফিসফিস করে বলল,
“তুমি না বললেও, তোমার চোখ তো অনেক কিছু বলেছিল, হানি।”

আমি কাঁথার ভেতরে গুটিয়ে থাকা অবস্থায় মৃদু হাসলাম, যদিও বাহারাজ তা টের পেল না। হঠাৎ সে আমাকে টেনে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিল। কাঁথা সরিয়ে আমার মুখোমণ্ডল দু’হাতে তুলে ধরে বলল, “তুমি তোমার সবটুকু যেমন আমার হাতে তুলে দিয়েছ, আমিও ঠিক তেমনি করে গচ্ছিত রাখব, হানি।”

আমি নিঃশব্দে হাসি মেখে ওর গলা জড়িয়ে ধরলাম। বাহারাজ আদরভরা হাতে আমাকে কোলে তুলে নিল এবং ধীরে ধীরে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেল। ভেতরে রেখে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দেখি, বাহারাজের ভালোবাসার চিহ্নগুলো স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে আমার দেহে। একদিকে এক অদ্ভুত ভালোলাগা, অন্যদিকে
অপরাধবোধে কেঁপে উঠছিল মন।নিজেকে গোছাতে গোসল সেরে নিলাম। তারপর ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে আবার বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। ব্যথাটা যেন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিল সমস্ত শরীরে। লজ্জায় বাহারাজকে কিছু বলতে সাহস পাচ্ছিলাম না। কেবল চুপচাপ ধুঁকে ধুঁকে সহ্য করছিলাম।

কিছুক্ষণ পরে বাহারাজ ফিরে এলো। হাতে খাবারের ট্রে। ভাজা রুটি, নারকেলের দুধে ভেজানো কেক, মধু সহযোগে প্যানকেক আর দুই কাপ ঘন লাল চা। সে খুব যত্ন করে বিছানার পাশে খাবারগুলো রাখল। তারপর কোমল কণ্ঠে বলল, “ওঠো হানি। এগুলো খাও। শুয়ে থাকলে আরও খারাপ লাগবে। খুব যদি খারাপ লাগে, তাহলে চলো, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।”

আমি লোভাতুর দৃষ্টিতে খাবারের দিকে তাকিয়ে একটু উঠে বসলাম। রুটির একটা টুকরো ছিঁড়ে মুখে দিতে দিতে মুখ ফুলিয়ে বললাম, “ডাক্তারের কাছে গিয়ে কী বলব শুনি, একটু বলে দিন না! আমি তো উকিলের কাছে গিয়ে মামলা ঠুকে দিব!”

বাহারাজ হাসতে হাসতে আমার দিকে ঝুঁকে এলো। চোখ মে/রে বলল, “শাস্তিস্বরূপ একটা চুমু নাকি দশটা চুমু দিতে হবে?”

আমি লজ্জানত হয়ে ফিসফিস করে বললাম,
“ধ্যাত!”

সে হেসে বলল, “আচ্ছা রাগ করো না, হানি। আগে এগুলো খেয়ে দেখো। আশা করি এরকম মজার স্বাদ এর আগে কখনো পাওনি।”

আমি শান্তভাবে হাসলাম। বাহারাজের হাতে সাজানো খাবারের সাথে যেন ভালোবাসার মিষ্টি স্বাদও মিশে ছিল। আমি চুপচাপ খাবার খাচ্ছিলাম। কিন্তু বাহারাজ থেমে থাকল না। সে আমার পাশে এসে বসে পড়ল। এক হাতে আমার ভেজা চুলগুলো আলতো করে সরিয়ে দিল কপাল থেকে। তারপর তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বলল, “তুমি জানো? ভেজা চুলে তোমাকে আরও বেশি সুন্দর লাগে, হানি।”

আমি কিছু বললাম না, শুধু মুখ নামিয়ে রাখলাম। হঠাৎ সে আমার হাত থেকে রুটির টুকরো নিয়ে নিজের হাতে খাওয়াতে লাগল। প্রথমে লজ্জা পেলাম, তারপর ধীরে ধীরে সঁপে দিলাম নিজেকে। এরপর বাহারাজ নিজের হাতে চা-এর কাপ এগিয়ে দিল আমার ঠোঁটের কাছে। আমি দু’হাতে চা ধরতে গেলাম, কিন্তু বাহারাজ বলল, “না, আজ শুধু আমার উপর ভরসা করো। সব কিছু আমার হাত দিয়ে হবে।”

আমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও হেসে ফেললাম।
চা-এর উষ্ণতা আর বাহারাজের স্পর্শের উষ্ণতা মিলেমিশে এক মধুর আবেশে ভরে উঠল আমার সকালটা। আমাকে চতুর্থ গোসল ও তীব্র শরীর ব্যথার জন্য তৈরি হতে হবে এবার।

চলবে ইন শা আল্লাহ