#তুমি_থেকো_দাঁড়িয়ে_খোলা_বারান্দায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৩
বাড়ির দরজায় পা রাখতেই হঠাৎ একটা ফুলদানি এসে সজোরে আঘাত করল আমার কপালে। এত দ্রুত ঘটে গেল ঘটনাটা যে আমি কয়েক কদম পিছিয়ে গেলাম। দুহাত রাখলাম বুকে, মাথাটা যেন ঝাঁকি খেয়ে গেল।
ড্রয়িংরুমে সবাই বসা। আমাকে দেখে মা ছুটে এলেন। ভাবলাম, আমাকে না পেয়ে হয়তো উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। কিন্তু না!তার মুখে উদ্বেগ নয়, ছিল জ্বালাময়ী ক্রোধ।
ডান গালে সপাটে কয়েকটা চড় বসিয়ে মা চিৎকার করে উঠলেন, “কেন ফোন করেছিস নিবিড়কে? কেন গেলি বাহারাজের কাছে? আমার মেয়ের জীবনটা শেষ না করে তুই শান্ত হবি না?”
আমি মাথা নিচু করলাম আলতো করে, যেন স্বীকার করছি সবকিছু। বাহারাজ ও নিবিড় ভাই সব বলে দিয়েছে সবাইকে! দূর থেকে আপু বলল, “তোর জায়গায় আমি থাকলে গলায় দড়ি দিতাম। তুই এতটাই নির্লজ্জ যে এখনো বাইরে ঘুরছিস? আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে তোর কাণ্ড দেখে!”
চোখের কোনা ভিজে গেল। পানি ঝরে পড়ল বিনা শব্দে। জানভি আমার হাতটা ধরে বলল, “কাল যা ঘটেছে, তার পরদিনই তোর বাইরে যাওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত, হানি? অন্তত এই পরিবারের কথাটা একটু ভাবিস।”
ভাইয়া এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল দূরে। এবার সবার ভেতর দিয়ে এগিয়ে এল আমার সামনে। আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
“চল। অ্যাবশন করাবো। এই মুহূর্তে।”
আমি থমকে গেলাম। বুকটা ধকধক করতে লাগল। যে অনাগত শিশুটার জন্য আজ আমি দাগী, দুঃচরিত্রা, কলঙ্কিনী। সেই শিশুটিকেই মুছে দিতে বলছে সবাই। অথচ ওর কথা ভাবতেই দম আটকে আসে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে যায়। আমি নিভু নিভু কণ্ঠে বললাম, “আমি অ্যাবশন করব না ভাইয়া। কোনো মা তার সন্তানকে ফেলতে পারে না।”
ভাইয়া ঝাঁঝালো গলায় বলল, “মা? কীসের মা?” এই সন্তান জন্ম নিলে তোকে সমাজ ঘৃণা করবে। এমনকি এই সন্তানও একদিন তোকে দোষ দেবে। আর একটাও কথা না।”
আমার খুব বলতে ইচ্ছে করল, ও আসার আগেই সব ঠিক করে ফেলব। শুধু একটু সময় চাই। আমি ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লাম। তখনই শুনি বাবার কণ্ঠ,
“হানি, তুই আমার মেয়ে। বাবা হয়ে নিজের মেয়েকে ত্যাগ, তা আমি পারব না। কিন্তু আজকের দিনটাই তোকে দিচ্ছি। আজই সিদ্ধান্ত নে। হয় সন্তানের বাবাকে আমার সামনে আনবি, নয়তো অ্যাবশন করবি। এর ব্যতিক্রম হলে আমার মুখ আর দেখতে পাবি না।”
আমি স্তব্ধ চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম। চারপাশটা হঠাৎ করেই নীরব হয়ে গেল। কারও মুখে কোনো শব্দ নেই। একে একে সবাই উঠে গেল। ড্রয়িংরুম খালি হয়ে গেল। আমি ছুটে চলে গেলাম নিজের ঘরে। দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে মেঝেতে বসে পড়লাম। ঘরের নিস্তব্ধতায় শুধুই কাঁপছিল আমার নিঃশ্বাস। আজকের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে? কাঁপা আঙুলে ফোনটা হাতে নিলাম।
‘বাহারাজ’ নামটা স্ক্রিনে ভাসে। ডায়াল করলাম। বারবার চেষ্টা করলাম। ওপাশ থেকে কেবল একটাই উত্তর, ‘এই নাম্বারটি বন্ধ রয়েছে।’
আমার মনটা বারবার একটা কথাই বলছে- তুমি এত নিষ্ঠুর হতে পারো না বাহারাজ, তুমি আমাকে ধোঁকা দিতে পারো না, আমাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি মিথ্যা ছিল না! কপাল থেকে ঝরে পড়া রক্তের বেদনার থেকে মনের বেদনা বড্ড বেশি আজ।
শহরে নেমে এসেছে রাত। বিদ্যুৎ চলে গেছে অনেক আগেই। আমাদের বাড়িতে জেনারেটর আছে, তাই বৈদ্যুতিক উজ্জ্বলতা আছে। কিন্তু আমার ভেতরের আলো যেন নিভে গেছে। মন বেছে নিয়েছে অন্ধকারের পথ।
বাবা তিনবার ভাইয়াকে খবর পাঠিয়েছে,’নিয়ে আয় ওকে।’ ভাইয়া এসে বলল, বাবা নাকি বি/ষের কৌটা কিনে এনেছেন। আমার কথার ওপর নির্ভর করবে সিদ্ধান্ত। বাঁচবে বাবা, নাকি এই অনাগত সন্তান। আমার বুক ভেসে যাচ্ছে কান্নায়। মনে হলো আমি দুনিয়ার সবচেয়ে অ/প/রা/ধী, সবচেয়ে হতভাগা এক মেয়ে। যেন আমার জীবনটার কোনো মূল্য নেই। ভবিষ্যত বলে কিছু নেই, আত্মমর্যাদা বলে কিছু নেই, শুধু কষ্ট, কষ্ট, কষ্ট।
চোখ তুলে তাকালাম বন্ধ সিলিং ফ্যানের দিকে। চেয়ারে উঠলাম ধীরে ধীরে। ওড়না খুলে গিঁট বাঁধলাম ফ্যানে। গলার কাছে প্যাঁচিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। চোখের পাতায় ভেসে উঠল বাহারাজের সাথে কাটানো রঙিন মুহূর্তগুলো। প্রেম! প্রতিশ্রুতি! তার কোমল ছোঁয়া! নিজেকে শক্ত করলাম, ধাক্কা দিলাম চেয়ারে।
শুধু গলায় একটা টান। শ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। গলার ভেতর একটা ছেঁড়া চিৎকার আটকে আছে। চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। শরীর কাঁপছে, নিঃশ্বাস বন্ধ। সব শেষ! ঠিক সেই মুহূর্তে কেউ আমার পা ধরে ফেলল। একটু বাতাস, একটু শ্বাস ফেরত এলো। চোখ খুলে নিচে তাকাতেই দেখি জানভি। চোখে আগুন, মুখে তীব্র ব্যথা। ও দ্রুত দড়ি খুলে ফেলল। আমাকে নিচে নামাল। পরক্ষণেই আমার গাল পুড়ে গেল ওর হাতের তীব্রতায়। জীবনে প্রথম জানভির এই আঘাত। আমি নীরবে বললাম, “তুমিই বাকি ছিলে, এবার ষোলোকলা পূর্ণ হলো।”
জানভির গলা কাঁপছিল। ও চিৎকার করে বলল, “এই কাজ করার পরেও কি ভেবেছিলি তোকে আমরা মাথায় তুলে রাখব?
আরেকটু দেরি হলে তুই আমার হাতের বাইরে চলে যেতি! এই দড়ি গলায় দেওয়ার আগে একবারও কি ভাবলি না, এই পরিবারের কথা?”
আমি ফ্যাকাশে হাসলাম। ঠোঁটে তাচ্ছিল্য লেগে রইল। “ভেবেছি বলেই তো এই পথ বেছে নিলাম, জান। আমি মায়ের ভালো মেয়ে হতে পারিনি। বাবার সম্মান রাখতে পারিনি। এই পরিবারে আমি এক কলঙ্কের নাম। এইটাই আমার একমাত্র মুক্তির রাস্তা।”
জানভির চোখ ছলছল করছিল, কিন্তু গলায় অদ্ভুত দৃঢ়তা, “আমাকে একটা সুযোগ দিবি হানি? আমি তোর সব কলঙ্ক মুছে দিব। পুতুলের মতো রাখব তোকে।”
অবুঝের মতো প্রশ্ন করলাম, “মানে?”
“বিয়ে করবি আমাকে? সবাই জানবে এই সন্তান আমাদের।”
জানভির কথা শুনে থমকে গেলাম আমি। এক পুরুষ কলঙ্কিত করে চলে গেল, অন্য একজন কলঙ্ক থেকে মুক্ত দিতে চাইছে। আমি নিজের শান্তি হিসেবে জানভির বুকটাকে বেছে নিলাম। এর থেকে সুখকর জায়গা এই পৃথিবীতে নেই।
জানভি আমার হাত ধরে ড্রয়িংরুমে নিয়ে এলো। উপস্থিত ছিল বাড়ির প্রতিটি সদস্য। একটা ছোটো শিশি টেবিলের ওপর রাখা। বাবা একবার সেদিকে তাকিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তূই কী করতে চাস এখন?”
আমার আগেই অপরাধীর মতো জানভি বলল, “হানির গর্ভে আমার সন্তান মামা। একদিন রাতে আমি ওর সাথে…
কীভাবে যেন হয়ে গিয়েছিল বিষয়টা। পরদিন যখন আমি বিষয়টা বুঝতে পারি, তখন হানিকে বারণ করেছি যাতে কাউকে কিছু না বলে। তাই হানি চুপ করে ছিল।”
পরিস্তিতি শান্ত হয়ে গেল। সবার চোখে অবিশ্বাসের চাহনি। ভাইয়া ছুটে এসে জানের কলার টেনে ঘুষি দিল গালে। চ্যাঁচিয়ে বলতে লাগল, “কীভাবে হয়েছে মানে? আমার বোনের এতবড় স/র্ব/না/শ করে চুপ করে ছিলি। দেখছ বাবা, এতদিন দুধ কলা দিয়ে কাল সাপ পুষেছ ঘরে।”
ভাইয়া জানভিকে এলোপাথাড়ি মা/র/তে লাগল। জানভি এক পর্যায়ে মাটিতে পড়ে গেল। তবুও ও আমার হাত ছাড়ল না। মুঠো করে ধরে রাখল। আমি দুহাতে ওকে আড়াল করে বললাম, “ভাইয়া থামো, প্লীজ ওকে মে/রো না।”
মা উত্তেজিত হয়ে বলল, “তোমার ভাগিনার জন্য সবকিছু হয়েছে। ভালোবেসে এই বাড়িতে ঠাঁই দিলাম আর তুই আমার মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়েছিস?”
বাবা উঠে দাঁড়ালেন। জানভির কাছে হাঁটু গেড়ে বসলেন। জানভি আস্তে মাথা নিচু করে নিল। বাবা ভাঙা গলায় বললেন, “তোকে আমার বাকি সন্তানদের মতো আগলে রেখেছিলাম, ভালোবেসে ছিলাম। আমার কি এটাই প্রাপ্য ছিল জান?”
জানভি নীরবে চোখের পানি ফেলল। ফুফু লজ্জায় বাবার দিকে তাকালেন না। রান্নাঘর থেকে দা* এনে বাবার হাতে দিয়ে বললেন, “এটা দিয়ে ওকে টুকরো টুকরো করুন ভাইজান। আমি একবারও ফিরে দেখব না।”
চলবে.. ইন শা আল্লাহ
#তুমি_থেকো_দাঁড়িয়ে_খোলা_বারান্দায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৪
সবাই চুপ। পরিবেশ থমথমে। জানভিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে পরিবারের লোকজন। বাবা রাগে কাঁপছেন, হাতে একটা দা। হঠাৎ তিনি সেটা মাটিতে ফেলে দেন। হাঁটু গেড়ে বসে পড়েন। বাবা বিষণ্ণ গলায় বললেন, “আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না, জানভি, তুই এমন করবি?”
জানভি ধীরে ধীরে বাবার কাছে গিয়ে নতজানু হয়। দুহাতে বাবার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদে। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে জানভি বলল, “আমি আপনার অপরাধী, মামা। আপনি যে শাস্তি দেবেন, মাথা পেতে নেব।
তবে আমার সন্তানের মুখের দিকে আর আপনার সম্মানের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েন।”
বাবা স্থির। তার চোখে দ্বন্দ্ব। তিনি কিছু ভেবে ফুফুর দিকে তাকান। তারপরে বললেন, “ছেলেমেয়েরা ভুল করেছে। ভুল শুধরানো আমাদের কর্তব্য।
আমি ওদের বিয়ে দিতে চাই। তুই কি বলিস, বোন?”
মা হঠাৎ চিৎকার করে বলল, “তুমি ওকে জামাই বানাতে চাও? যে ছেলের জন্য আজ এই বিপদ? সব ওর সম্পত্তির লোভ! তুমি ওর ফাঁদে পা দিও না!”
ফুফু মাথা নিচু করে বলল, “তোমরা যা ইচ্ছে করো। এই বিষয়ে আমি কিছু জানি না।”
বিদ্রুপ করে মা বলল, “জানবেই বা কী করে! সব তো তোমার কথাতেই হয়েছে!”
মায়ের অপমানজনক কথায় আপু রেগে গেল। বিরক্তকর কণ্ঠে বলল, “মা! প্লিজ থামো! আর অপমান করো না।”
ফুফুর চোখে জল জমেছে। তিনি কাঁপা কণ্ঠে বলে, “আমারও সম্মান আছে।আমিও মানুষ।”
বাবা সব কথা চুপচাপ শুনেন। অতঃপর কঠিন সিদ্ধান্তটা নিয়েই নিল, “কাল বিকেলের আগেই বিয়েতে যা লাগে কিনে রাখিস।
সন্ধ্যায় কাজি এসে বিয়ে পড়াবে।”
সবার মুখ থমথমে। আমি মাথা নিচু করে ক্লান্ত পায়ে ঘরের দিকে যাই। কীভাবে সবকিছু মেনে নেব আমি? যে দেহে আমি বাহারাজের সন্তান নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, সেখানে জানভিকে বিয়ে করে কীভাবে সুখী হব? পরিবারকে দেওয়া দ্বিতীয় ধোঁকা! আমার পেছনে পেছনে জানভিও এসে বিছানায়। আমি ওর মুখের তাজা রক্তগুলোর দিকে তাকিয়ে বললাম, “একটু বসো। আমি ফার্স্ট এইড বক্স আনছি।”
ধীরে ধীরে জানভির ক্ষতে স্যাভলন লাগিয়ে দিচ্ছি। সে চোখ খিঁচে খিঁচে সহ্য করছে। ইতস্তত করে বলেই ফেললাম, “তুমি একটা হেল্প করবে?”
জানভি ছোট করে বলল, “কী হেল্প?”
আমি চোখ নিচু করে বললাম, “একটা ডিভোর্স পেপার এনে দিতে পারবে?”
জানভি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। যে এখন থেকে আমার জীবনে জড়িয়ে যাবে, তার থেকে সত্যিটা লুকিয়ে ধোঁকা দিতে চাই না। আমার সাথে ঘটা বিগত দিনের ঘটনাগুলো ওকে বলে দিলাম। সবটা শুনে জানভির রাগে ক্রমশ ফুঁসে উঠল। বিছানা থেকে উঠে বলল, “ওকে আজ আমি..
জানভিকে বাধা দিয়ে বললাম, “ওকে তুমি কিছু বলবে না জান। আমার জন্য আপুর জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে। আমি আপুর জীবনটা গুছিয়ে দিতে চাই।”
জানভি ছোটো করে বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু প্রেগন্যান্ট অবস্থা বিয়ে বা ডিভোর্স কোনোটাই কার্যকর হয় না।”
আমি হেসে ফেললাম। যে সম্পর্কটা থেকেও না থাকার মতো, সেটা কার্যকর হলেই বা কী? না হলেই বা কী?
___
আমাদের বিয়েটা একবারে ঘরোয়াভাবে হবে। তাই আয়োজনও তেমন সাদামাটা। ইচ্ছে না থাকার সত্ত্বেও মা সকালবেলা ডেকে নিবিড়ের পরিবারকে বিয়ের জন্য দাওয়াত করতে পাঠাল। যদি এতে তাদের মন কোনোভাবে গলানো যায়। আমি সেই একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম ওই বাড়িতে যাওয়ার। শপিংয়ের আগেই আমি, জানভি, আপু ও ভাইয়া চারজনে মিলে আহমেদ বাড়িতে গেলাম। আমাদের বাড়ির ভেতরে পা রাখতে দেখেই আন্টি দূর থেকে গজগজ করে উঠলেন, “তোমরা এই বাড়িতে কেন এসেছ? বেরিয়ে যাও এখান থেকে।”
নিবিড় ভাইয়ের বাবা তখন সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। নিবিড় ভাইও পিঁড়ি পেরিয়ে নিচে নামছিলেন। আমাদের যাওয়ার বিষয়টা নিবিড় ভাইকে আগেই জানিয়েছিল আপু।
আঙ্কেল তার সহধর্মিণীকে কড়া গলায় বললেন, “এমন করছ কেন? দরকারেও তো আসতে পারে।”
আন্টি মানলেন না। সাথে সাথে বাজখাঁই গলায় বললেন, “ওদের সাথে আমাদের কোনো দরকার নেই। ওদের ছায়াও আমাদের বাড়িতে না পড়ুক।”
অপমানে পানসে হয়ে এলো আমার মুখ। যে কাজ করেছি, তাতে এটাই আমার প্রাপ্য। নিবিড় ভাই তার মাকে বলল, “হানির বিয়ের দাওয়াত দিতে এসেছে।”
তার মুখটা সরু হয়ে গেল। ব্যঙ্গাত্মক হেসে বলল, “এই মেয়েকেও কেউ বিয়ে করে? জেনেশুনে করছে নাকি না জেনে?”
আমার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। জানভি আমার হাতে আলতো চাপ দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, “ওদের কথা গায়ে মাখিস না।”
আমি আস্তে হুঁ বলে সবার সাথে সোফায় বসলাম। যে চোখে আমি ভালোবাসা দেখেছিলাম, আজ সে চোখে ঘৃণা। ভাইয়া মিষ্টির প্যাকেটটা টেবিলে রেখে বলতে লাগল, “আমরা হানির প্রেগন্যান্সির বিষয়টা আগেই জানতাম। কিন্তু আপুর বিয়ের কারণে কোনো পদক্ষেপ নেইনি। ভেবেছিলাম আপুর বিয়ের পর ওর জানভি ও হানির বিয়েটা দিয়ে দিব।”
আঙ্কেল বলল, “হানির সাথে জানভির সম্পর্ক ছিল?”
আপু আলতো হেসে বলল, “বিয়ে ঠিক হয়েছিল। আপনাদের থেকে বিষয়টা লুকানোর জন্য দুঃখিত।”
আন্টি বোধ হয় ভেতরে একটু নরম হলো। নিবিড় ভাই ও আপুর দিকে চাওয়াচাওয়ি করে বলল, “বিষয়টা বিয়ের আগেই ঠিক করা উচিত ছিল তোমাদের। তাহলে দুই পরিবারের মানসম্মানে আঘাত লাগতো না।
বসো নাস্তা নিয়ে আসি।”
আন্টি চলে যেতেই সবাই একসাথে হাসল। আমার চোখ পড়ল সিঁড়ির দিকে। বাহারাজ সবার নিচের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখলে এতদিন আমার শরীরটা কেঁপে উঠত ভালোবাসায়, আজও কেঁপে উঠেছি কিন্তু রাগে।
আন্টি চা নিয়ে এলো। জানভি চায়ের কাপ তুলতে গিয়ে অসাবধানতায় চা ফেলে দিল আমার গায়ে। হকচকিয়ে উঠলাম আমি। জানভি বিচলিত হয়ে বলল, “তুই ঠিক আছিস তো?”
“হুঁ। তোমরা খাও, আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি। বাহারাজ ভাই ওয়াশরুমটা একটু দেখিয়ে দিবেন?”
বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে উঠলাম। বাহারাজ আমার পেছনে পেছনে এলো। তার ঘরে ঢুকে ব্যাগ থেকে কাগজটা বের করে এগিয়ে দিলাম। কাগজের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, “কী এটা?”
“আপনি দেখুন, আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি।”
ছোটো করে বলে ওয়াশরুমে ঢুকলাম আমি। দরজার ছিটকিনি তুলে আয়নার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। অতঃপর ওড়না ধুয়ে বের হলাম ওয়াশ রুম থেকে। বাহারাজ দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “এটা কী?”
“বাংলা পড়তে পারেন না? পড়ে সাইন করে দিন।”
বলেই কলমটা ব্যাগ থেকে বের করে এগিয়ে দিলাম। বাহারাজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কলমটা ছুড়ে ফেলে দিল। ঝাঁজালো গলায় বলল, “আমি পড়তেও পারি, সাইনও করতে পারি। কিন্তু তোমার কতটা সাহস, সেটা বুঝতে পারছি না। আমার অনুমতি না নিয়ে ফরম লিখে নিয়ে এসে, আমাকেই বলছ সাইন করতে?”
“আমার সাহস বরাবরই ছিল। শুধু আপনার প্রতি দুর্বল ছিলাম বলেই তা প্রকাশ করিনি। কিন্তু লড়াইটা যেহেতু আমাকে একাই লড়তে হবে, তাই আপনার ছায়াটুকুও আমি রাখতে চাই না। সাইন করুন।”
কলমটা কুড়িয়ে ওর দিকে বাড়িয়ে দিলাম। বাহারাজ কলম ধরল না। দুহাতে আমার হাত শক্ত করে ধরে আলমিরার সাথে চেপে ধরল। গলায় কাছের নীল শিরাগুলো শরীর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিল রাগে। আমি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই সে বলল, “নতুন প্রেমিক পেয়ে গেছ, এখন পুরান প্রেমিকের দরকার নেই, তাই না?”
সর্বশক্তি দিয়ে বাহারাজকে ধাক্কা দিতে দুকদম পিছিয়ে গেল সে। কলমটা বিছানায় রেখে বললাম, “জনসম্মুখে স্ত্রী ও সন্তানকে পরিচয় দিতে যে পারে না, তার স্বামী হওয়ার কোনো অধিকার নেই। আর যাকে আপনি প্রেমিক বলছেন, সে নির্দোষ হয়েও সবার চোখে দোষী সেজেছে। তাই প্রেমিক শব্দটা ব্যবহারের আগে ভেবে বলবেন।
কাগজটা রেখে গেলাম। সাইন করে সন্ধ্যায় নিয়ে আসবেন। পুরোনো সম্পর্ক আমি চুকিয়ে ফেলতে চাই।”
বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। পাষাণ মানুষটার জন্য আমার চোখ থেকে এক ফোঁটাও পানি ঝরল না আজ।
চলবে.. ইন শা আল্লাহ
#তুমি_থেকো_দাঁড়িয়ে_খোলা_বারান্দায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৫
বধূবেশে আয়নার সামনে বসে কয়েকবার নিজেকে দেখলাম। এই কয়দিন নিজেকে যেন অচেনা মনে হচ্ছিল। আজ হঠাৎ করে নিজেকে হানির মতো লাগছে।
শুধু ঠোঁটের কোণে পরিচিত সেই হাসিটা নেই। পার্লারের মেয়েটা আজ বাড়িতে এসেই আমাকে সাজিয়ে দিল। সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “দেখুন, আর কিছু লাগবে কি না?”
আমি ফ্যাকাশে গলায় বললাম,”আর কিছু লাগবে না।”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে আবার জানতে চাইলো, “সাজ আপনার পছন্দ হয়েছে, আপু?”
আমি আয়না থেকে চোখ সরিয়ে,
নরম স্বরে শুধু বললাম, “হুঁ।”
ওর জিনিসপত্র গুছিয়ে নেওয়ার সময়,
দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল আপু। মেয়েটাকে সব টাকা বুঝিয়ে দিতেই হালকা হাসি দিয়ে চলে গেল। আপু দরজাটা একটু ভিড়িয়ে দিয়ে আমার পাশে এসে বসল। হাতটা ধরে আদুরে গলায় বলল, “রাগ করেছিস?”
চেষ্টা করেও আপুর চোখে চোখ রাখতে পারলাম না। চোখে যেন জমে আছে এক বেদনার নদী। আপু আমার চিবুক ধরে মুখটা তুলল। চোখে চোখ পড়তেই আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। আপু তখন আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “কাঁদছিস কেন পাগলি? আজ তো তোর জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিন। এই দিনে কেউ কাঁদে?”
আমি ফুঁপিয়ে উঠলাম,”আমার জন্য তোর বিয়েটা ভেঙে গেছে, আপু। আমাকে ক্ষমা করে দিস।”
আপু আমার মুখটা তুলে বলল, “ওটা আমার কপালে ছিল বলেই ভেঙেছে। এখন সব ঠিক আছে আমাদের মাঝে। তুই এসব ভাবিস না। জানভির সঙ্গে মন দিয়ে সংসার কর। ছেলেটা খুব ভালো।”
আমি মৃদু হাসলাম। ভালোবাসে কি না জানি না, তবে ভালো রাখতে চায়। এটুকু বোঝা যায়। ঠিক তখনই দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল ভাইয়া। আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার দেখে কটাক্ষ করল, “পুরো পেতনি লাগছে! বিয়ের সাজেও তোকে ভালো লাগছে না।”
অন্য কোনো দিন হলে হয়তো কান্নায় ভেঙে পড়তাম। কিন্তু আজ? আজ আমি শুধু আলতো করে হাসলাম। এই বিয়েতে আমার কোনো ইচ্ছেই নেই। পেতনি লাগুক বা রাজকন্যা— সবই আজ আমার কাছে নিস্তব্ধ।
ভাইয়ার ঠাট্টায় আপু হালকা কণ্ঠে বলল, “আজ অন্তত ওর পিছু ছেড়ে দে।”
ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে বলল, “আচ্ছা। ছেড়ে দিলাম। এখন ওকে নিয়ে চল। কাজি এসেছে।”
আপু আর ভাইয়া আমার হাত ধরে ড্রয়িংরুমে নিয়ে গেল। সেখানে সোফায় বসে আছে জানভি। আজ তার পরনে শেরওয়ানি। আজ ওকে দেখে মনে হলো সে সত্যিই সুন্দর, পরিপাটি, এক সুপুরুষ।
এতদিন ওকে ভাইয়ের দৃষ্টিতে দেখেছি, কখনো এভাবে তাকাইনি। আমাকে তার পাশে বসানো হলো। কাজি সাহেব খাতা খুলে বিয়ে পড়াতে শুরু করলেন। আমি শুধু মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
চোখের দৃষ্টি ঝাপসা, বুকের ভেতর কাঁপন। হঠাৎ আপু হালকা ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস করে বলল, “কবুল বল।”
ঘোর ভাঙল। দেখলাম, জানভি কবুল বলে ফেলেছে। এবার আমার পালা।
আমি বারবার ঠোঁট ফাঁক করলাম,
সেই একটি শব্দ, ‘কবুল’ উচ্চারণ করার জন্য। কিন্তু কণ্ঠ যেন শুকিয়ে গেছে, কণ্ঠনালী শক্ত হয়ে গেছে। কোনো শব্দই বেরোলো না। আমি চেষ্টা করলাম।
অবশেষে “ক…” শব্দটা বেরোনোর সাথে সাথেই একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর বাতাস কাঁপিয়ে উঠল, “হানি!”
আমি চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম।
দেখি, দরজায় দাঁড়িয়ে আছে বাহারাজ আর তার পরিবার। ওকে দেখে দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কাঁপুনি উঠল। প্রিয় মানুষের সামনে অন্য কাউকে বিয়ে করা…
হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ।
মা খুশির সুরে এগিয়ে গিয়ে বলল, “আপনারা ভালো সময়ে এসেছেন। আসুন আসুন! আমি তো ভেবেছিলাম, আর আসবেন না।”
নিবিড় ভাইয়ের মা গম্ভীর গলায় বললেন, “আমরা না এলে বিয়েটা হতো কাদের মধ্যে?”
বাহারাজ সকলকে পেরিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। একটানে সামনের টেবিলটা দূরে ঠেলে দিল, পায়াতে চাকা না থাকলেও টেবিলটা গড়াতে গড়াতে দূরে হারিয়ে গেল। সে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তার হাতদুটি আমার গাল ছুঁয়ে বলল, “আমি এসেছি, মধু।”
আমার বুকের ভেতরটা যেন ফেটে যাচ্ছিল। চোখে জল নেই, তবু গলার ভিতর দিয়ে উঠে এল হেঁচকি। সে আরও শক্ত করে আমার মুখ ছুঁয়ে বলল, “হানি, আমি এসেছি।”
তার কণ্ঠে এমন কিছু ছিল, যা ভুলে যাওয়া পুরোনো দিনগুলোর খাতা একে একে খুলে এলো চোখের সামনে। আমি তীব্র শক্তিতে নিজেকে সামলে নিলাম। মাথা পেছনে হেলিয়ে দৃঢ় গলায় বললাম, “প্লিজ, সরুন।”
ঠিক তখনই বাহারাজের বাবা এগিয়ে এসে কাজি সাহেবকে বললেন, “আজ এখানে কোনো বিয়ে হবে না। আপনি চলে যান।”
কাজি সাহেব এক দৃষ্টিতে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমার বাবা যেন কিছু বুঝে উঠতে পারছিলেন না। মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “বিয়ে কেন হবে না, বেয়াই?”
বাহারাজের বাবার গলা ঠান্ডা,”আপনাকে কিছু বলার আছে, যা এখানে সবার সামনে বলা উচিত না।”
বাবা যেন কিছুটা গলে গেলেন কথার সুরে। কাজিকে বিদায় দেওয়া হলো।
ঘরটা এবার হয়ে উঠল নিঃশব্দ। শুধু মুঠো গোনা কিছু মানুষের নিঃশ্বাসে ভরা। বাহারাজ এবার বাবার দিকে দুইটি কাগজ এগিয়ে দিল। আমি যেন বজ্রবিদ্যুৎ ছুটে আসতে দেখলাম। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে বাবার আগে কাগজগুলো কেড়ে নিলাম।
সাহস করে বললাম, “বাবা কোনো কাগজ দেখবে না। বলুন, কেন এসেছেন?”
বাহারাজের মা একদম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, “এগুলো না দেখলে সবাই তোমাকে কলঙ্কিনী ভাববে, মা।”
আমি তীক্ষ্ণ চোখে সবার দিকে তাকিয়ে বললাম, “ভাববে? আমি তো অনেক আগেই সবার চোখে দুষ্চরিত্রা। নতুন করে কেউ আর কিছু ভাববে না।”
ঘরে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। কেউ যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিয়েছে। হঠাৎ বাবার কঠোর, গম্ভীর গলা শোনা গেল, “হানি, কাগজগুলো দাও।”
আমি এক পা পেছনে সরে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম, “বাবা।”
“কাগজগুলো চেয়েছি আমি।”
বাবার কণ্ঠটা পাথরের মতো শক্ত। আমার আঙুল থেকে ধীরে ধীরে কাগজ দুটো বাবার দিকে এগিয়ে গেল। হাত-পা কাঁপছিল, আঙুল ঠান্ডা বরফের মতো।
যেন সমস্ত ঘরে আমার নিঃশ্বাস থেমে গেছে। তাদের চোখে আমি অনেক আগেই বিষ হয়ে উঠেছি, আজ হয়তো পুরোপুরি অবিশ্বাসের সীলটাও পড়ে যাবে!
বাবা কাগজ দুটো টেবিলের ওপর রাখলেন। চোখে এক ধরনের হিমশীতল শূন্যতা। তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “বিয়ে করেছ, ডিভোর্স পেপার তৈরি করেছ,
আর আমাদের জানানোর প্রয়োজন মনে করোনি?”
আমি ঠোঁট কাঁপিয়ে শাড়ির আঁচল মুঠোয় চেপে ধরলাম। ঠিক তখন বাহারাজ আমার পাশে এসে দাঁড়াল। আমি সরে যেতে চাইলাম, কিন্তু সে আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরল। সে অপরাধী স্বরে বলল, “আমাদের বিয়েটা হুট করে হয়ে গিয়েছিল। আপনাদের জানানোর মতো অবস্থা ছিল না। তারপর সব কিছু খুব দ্রুত ঘটে গেল।”
মা এবার টেবিল থেকে কাগজ তুলে নিয়ে পড়তে লাগলেন। ভাইয়া, আপু, ফুফু, ফুফা সবাই একে একে ঘিরে দাঁড়াল। একটা কথার পেছনে সবাই ছুটছে। বাবা এবার আমার দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়ালেন। তবু তাঁর কণ্ঠ তীক্ষ্ণভাবে ছুঁয়ে গেল আমার হৃৎপিণ্ডে।
“বাচ্চাটা কার, হানি? বাহারাজের, না জানভির?”
প্রশ্নটা যেন পুরো শরীরের উপর এক বল্লম ছুঁড়ে মারল। বাবা হয়ে এমন প্রশ্ন.. আমি চোখ বন্ধ করলাম। এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে কাঁপা কণ্ঠে বললাম, “বাহারাজের।”
চারদিকে নিঃশব্দ বিস্ফোরণ। নীরবতা এমন যে, শব্দও যেন গলা শুকিয়ে গেছে।
ফুফু উত্তেজিত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন, “এ কী হচ্ছে এসব? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না! হানি আর বাহারাজের বিয়ের কাগজ এই! এদিকে জানভি বলছে বাচ্চা ওর। বাহারাজ বলছে ওর। হচ্ছে টা কী বলো তো!”
সব দৃষ্টি এখন আমার দিকে, আমি যেন কোনো কাঠগড়ার আসামি। বাহারাজ এবার সামনের দিকে এগিয়ে এসে স্পষ্ট স্বরে বলল, “এই প্রশ্নগুলোর উত্তর শুধু হানি দিতে পারবে।”
বাহারাজের কথা শেষ হওয়ার আগেই
আমি চ/ড় বসিয়ে দিলাম ওর গালে। একটা নয়, পরপর দুটো। চড়ের তীব্রতায় আমার নিজের হাতটা যেন ফেটে যাচ্ছিল, তবুও বাহারাজ একটুও নড়ল না। সে চুপ, কিন্তু আমি আগুন।
আপু ছুটে এসে আমাকে সরিয়ে নিল।আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম, “সব প্রশ্নের উত্তর তো আমাকেই দিতে হয়!
আপনাকে কে বলেছে এখানে আসতে? কে?”
কিছুক্ষণ নীরব হয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিলাম। তারপর পুরো ঘটনাগুলো, বিগত দিনের প্রতিটা সত্য, প্রতিটা তিক্ততা,
সবকিছু বললাম।
ঘর নিস্তব্ধ। বাবা ধীরে এগিয়ে গিয়ে জানভিকে জড়িয়ে ধরলেন। কপালে চুমু দিয়ে বললেন, “ক্ষমা করে দিস, বাবা।
হানির সম্মান বাঁচাতে যে বলিদান তুই দিচ্ছিস, তা কজন পারে দিতে?”
জানভি নিঃশব্দে হাসল। ভাইয়া ছুটে গিয়ে ওর দুই হাত ধরে বলল, “এসব শুনে মাথা ঠিক রাখতে পারিনি, তাই তোকে… মে/রে/ছিলাম। ক্ষমা করে দিস, প্লিজ।”
ওর চোখে জল নেই। মুখে শুধু সেই পরিচিত মলিন হাসি। ঠিক তখন বাহারাজের মা সামনে এলো । অলঙ্কারজড়ানো মুখে একগাল পলিটিক্যাল হাসি, “বিয়েটা যেহেতু হয়ে গেছে, আর হানি অন্তঃসত্ত্বা। তাই আমরা ওকে এখনই বাড়ি নিয়ে যেতে চাই।”
আমি দৃঢ় কণ্ঠে বললাম, “বিয়েটা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমি এই বিয়ে মানি না।
আমি কিছুতেই বাহারাজের সঙ্গে থাকব না।”
ঘরে আবার হিম নেমে এলো। নিবিড় এবার সামনে এসে বলল, “তুমি এখন আইনগতভাবে বাহারাজের স্ত্রী। বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে না বিয়ে বাতিল হবে, না তালাক কার্যকর হবে। হানি ভুল যা হয়েছে, তা ঠিক করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।”
আমি কোনো যুক্তিতে ভাঙলাম না। আমি জানভির দিকে এগিয়ে গেলাম। ও আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখল। আমি শুধু মনে মনে বললাম, “যে ভুল আমি একবার করেছি, তা আর দ্বিতীয়বার করব না।”
চলবে.. ইন শা আল্লাহ