#তুমি_থেকো_দাঁড়িয়ে_খোলা_বারান্দায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০২
“আমার গোলাপটা ফেরত দিবেন না?” প্যাকেট সবে বাড়িয়ে দিয়েছিল বাহারাজ। কণ্ঠের উৎস খুঁজতে চোখ মেলাল আমার পানে। আলগোছে প্যাকেটটা ফিরিয়ে নিল অন্য একজনকে দিয়ে দিল। হতভম্ব হয়ে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হলাম। এ কী নিয়তি! দুকদম তার পিছু হেঁটে বললাম, “আপনি প্যাকেটটা নিলেন কেন?”
“গোলাপ দিয়েছি তাই চুমু দিয়েছ, প্যাকেটের বদলে যদি অন্য কিছু দিয়ে বসো। এটা আমার মানসম্মানের প্রশ্ন তাই রিস্ক নিলাম না।”
উঁচু গলায় বলার কারণে আশেপাশের দৃষ্টি এসে পড়ল আমার চেতন মুখে। লজ্জাবনত হলো মস্তিষ্ক। পিছিয়ে আসতেই ফের বলল, “অনুষ্ঠান শেষে আমার জন্য অপেক্ষা করো। তোমাকে একটা চড়া শাস্তি দিব।”
শুরু হলো যক্ষ্মা রোগীদের মতো কাশি। এক কাশি থামানো এক কথায় অসম্ভব। ওষ্ঠদ্বয় রুদ্ধ করে তবুও বৃথা চেষ্টা করলাম। উপায় শূন্য হয়ে ভার্সিটি থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। অপেক্ষা মানেই তো স্পেশাল ক্লাস।
__
প্রবেশদ্বারের বাইরে দাঁড়িয়ে ঋতুর ফোনে ডায়াল করলাম। ভার্সিটিতে এলাম তিনদিন পর। আজ আসার বিন্দুমাত্র স্পৃহা ছিল না। একপ্রকার বাধ্য হয়েই আসা। আপু জোর করে পাঠিয়েছে। তাকে খুলে বলতে দ্বিধাবোধ করছিলাম। এই তিনদিনে ওদের বহু কল এসেছে। কিন্তু রিসিভ করিনি। দুইবার ভায়োলেট হওয়ার পর রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে ঋতু বলল, “তাহলে এতদিনে ফোন করার সময় হয়েছে তোর?”
“তোর জন্য ভার্সিটিতে আসা বন্ধ হয়েছে আমার। তোকে কল ব্যাক করেছি এটাই তোর চৌদ্দ কপালের ভাগ্য।” বিরাগী গলা আমার।
“তারমানে হানি সব পারে না।” ঋতুর বিদ্রুপ করা গলা শোনামাত্র মন মস্তিস্ক যেন রাগে রুষ্ট হয়ে উঠল। ঝড়ের বেগে বললাম, “হানি সব পারে, হানি সবার সেরা। বাইরে অপেক্ষা করছি, এসে নিয়ে যা। নতুবা সেকেন্ড টাইমার হয়ে অন্য কোথাও ভর্তি হয়ে যাব।”
“দাঁড়া, আসছি।” সংক্ষেপে বলে লাইন কাটল। তার তিন মিনিট পর দেখা মিলল চার মহাশয়ের। কদমের সাথে হার্টবিটটা বেড়ে যাচ্ছে ইদানীং। মনে হচ্ছে কখন যেন হার্ট অ্যাটাক করে ফেলি। সতর্কতার সহিত প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকতে গিয়ে চোখে পড়ল বাহারাজকে। সাদা শার্টটা ফরসা গায়ে একটু বেশিই ফুটে উঠেছে। বাবরিগুলোকে বাঁধা দিতে মাথায় ঠেকিয়েছে নীল সানগ্লাস। গালে ওয়ান টাইম লাগিয়েছে। আইডি কার্ডটা আজও গলায় ঝুলছে। নবীন শিক্ষার্থীদের থেকে কিছু একটু শুনে খাতায় লিখছে। পাশে রয়েছে তার বন্ধুরা। রুদ্র ও তীব্র ছাড়া একটা ছেলে ও মেয়ে রয়েছে বাহারাজের বন্ধুমহলে। দৃষ্টি ফিরিয়ে দ্বিগুণ সতর্কতা নিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতেই শুরু হলো কাশি। দুহাতে ওষ্ঠদ্বয় রুদ্ধ করেও এই কাশির সমাপ্তি হচ্ছে না। আমি করুণ হাসলাম। পরক্ষণেই কানের এলো বাহারাজের বানী, “এই যক্ষ্মা রোগী এদিকে এসো। তোমার রোগের চিকিৎসা তো আমার কাছে।”
দূর হতেই তেজস্রী গলায় বললাম, “আমার চিকিৎসা লাগবে না, আ’ম ফিট।”
“সিনিয়রদের মুখের ওপর কথা বলার ফলাফল জানো? সানি লিওনের মতো নাচাব, তা-ও উইদাউট মিউজিক।” রুদ্র তুড়ি বাজিয়ে বলল। “কুল হানি! কুল! সারাজীবন তুই সবাইকে নাচিয়েছিস, তোকে এরা নাচাতে পারবে না।” নিজেকে যথাসম্ভব ধাতস্থ করে ক-কদম এগিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ালাম বাহারাজের। আমতা-আমতা করে বললাম, “আমি পড়াশোনায় যথেষ্ট ভালো, আমার এক্সট্রা ক্লাসের দরকার নেই। সেদিনের বিহেবিয়ারের জন্য আ’ম সরি।”
“হোয়াট’স ইউর নেইম?”
যথেষ্ট কনফিডেন্ট জ্ঞাপন করে বললাম, “হানি।”
“মধু? অনলি মধু? আগেপিছে কিছু নেই?” বাহারাজের কনফিউসান আমার অন্তরে প্রবেশ করল। ওভার কনফিডেন্টের লেভেলটা নেমে গেল তলানিতে। আমতা-আমতা করে বলল, “মি..মি..য়া মা..হা..তো হা..নি।”
“অ্যা! মি মি য়া মা হা তো হা নি। এগুলো নাম নাকি কার চিহ্নের ব্যবহার শিখাচ্ছ বলো তো? বাহারাজের ব্যঙ্গাত্মক কথায় অকপটে বললাম, “মি মি য়া মা হা তো হা নি নাতো মিমিয়া মাহাতো হানি।”
“মি-মি-য়া।” টেনে ফের বলল, “আমি আমি হা। নট ব্যাড। ফাস্ট ইয়ার। আমরা তোমাদের সিনিয়র। প্রতিদিন ঢোকার সময় আমাদের সালাম দিয়ে ঢুকবে, ওকে? নাহলে…
বলেই চোখের ইশারা করল। ইশারা অনুসরণ করে ৩০° কাত করতেই একদল ছেলেমেয়েরা কান ধরে ওঠবস নজরে এলো। কাঠফাঁটা রোদ্দুরে এমন শাস্তি দিচ্ছে। হতভম্ব হয়ে দৃষ্টি ফেরাতে বিস্মৃতি হলাম। পাশ থেকে ঋতু বলে উঠল, “ওরা পড়া পারেনি বলে স্যার ওঠবস করাচ্ছে? আমি যে শুনেছি, ভার্সিটির পড়া না পারার জন্য মা/রে না। এগুলো কি ভুল শুনেছি?”
তীব্র ছেলেটা তীব্র প্রতিবাদ করে বলল, “সঠিক। ওদের র্যাগিং চলছে। তোমাদেরও এখন শুরু হবে। যাও বাচ্চারা শুরু করে দাও।”
“দেখুন। র্যাগিং এক ধরনের ক্রাইম। এসব ঠিক নয়।” উঁচু গলায় বললাম। বাহারাজ রুষ্ট হলো। একপা একপা করে এগিয়ে এসে নিকটে। দ্বিগুণ গলা তুলে বলল, “ভার্সিটিতে বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ঢোকা বুঝি ক্রাইম নয়? দুজন বয়ফ্রেন্ডের তিনজন গার্লফ্রেন্ড। তুমি কি ফ্রি? ওদের অনুপস্থিতে কাজ করো?”
এক উক্তিতে মেজাজ উঁচু অবস্থানে পৌঁছেছে। এ-সময়ে আমার হাত দ্রুত গতিতে চলে। তার জিরাফের মতো উচ্চতায় আমি যেন পেঙ্গুইন। তীব্র ক্ষোভে হাত বাড়ালাম। হাতটা বাহারাজের শার্টের কলারে যেয়ে থামল। অতঃপর খ্যাত করে ছিঁড়ে গেল শার্ট। ডামপাশের আরমোল ছিঁড়ে দুই টুকরো হয়ে গেল। আচমকা এই পরিস্থিতিতে থমকে বাহারাজের মুখের দিকে অবলোকন করলাম। তিরতিরিয়ে ঘামের কণাগুলো ফুটে উঠছে ললাটে। হাতটা ফিরিয়ে নিয়ে এলাম নিজের জায়গায়। বাহারাজ একবার নিজের শার্ট আরেকবার আমার দিকে তাকাতে। ঘনঘন শ্বাস নিয়ে প্রমাণ করতে চাইল যথেষ্ট রেগে আছে সে। ‘তোমাকে তো..” বাক্য অসমাপ্ত রেখে ডামহাত চালিয়ে আমার বাম পাশের জামাটা ছিঁড়ে ফেলল। নগ্ন হয়ে গেল ঘাড়, কাঁধ। ঋতু থেকে শুরু করে আশেপাশের নবীন প্রবীণেরা চোখ দিয়ে দৃশ্যটি গিলে খাচ্ছে। নিজেকে ঘোর থেকে বের করে আনতে অক্ষম আমি। নিজের পানে না চেয়ে ডানহাত বাড়িয়ে স্পর্শ করলাম কাঁধ। আঁখি জোড়া গ্ৰথন করে কয়েক দফা কেঁপে উঠলাম। অনুতাপের জায়গায় রেগে বললাম, “আপনি আমার জামা ছিঁড়ে ফেললেন?”
“তুমিও তো ছিঁড়েছ! তুমি আগে ছিঁড়েছ। বাহারাজের শার্টের কলার ধরে পার পেয়ে যাবে ভেবেছিলে? কাল যেটা করেছ, সেটা ভুল ভেবে ক্ষমা করেছি’- তার মানে এই নয়, তোমার সাত খু/ন মাফ। এই ভার্সিটিতে কতদিন থাকো তুমি, আমিও দেখে নিব।” ছেঁড়া শার্ট মুখের ওপর ছুড়ে ধপাধপ পা ফেলে চলে গেল। আমি পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেলাম। পা দুটো কেউ শিকল দিয়ে আটকে রেখেছে। লজ্জা, অসম্মান, লাঞ্ছনায় দৃষ্টি তুলতে পারছি না। তাসফি শার্টটা নিয়ে আমাকে ডেকে বলল, “এখন এখান থেকে চল।”
গাল বেয়ে ঝরে পড়ল অশ্রুধারা। নিজেকে যথাসম্ভব সামলানো চেষ্টা করে বললাম, “কেন জড়িয়েছিস এটা? ওর শার্ট আমি ছুঁয়েও দেখতে চাইনি।”
জয় সান্ত্বনা দিল, “আশেপাশের মানুষ দেখছে, এটা ফেলিস না।”
“আমাকে অযথা জ্ঞান দিস না। সেই ছোটো থেকে তোদের কিছু হলে আমি ঝাঁপিয়ে পড়ি। আজ ‘ও’ বাজে কথা বলছিল, তোরা প্রতিবাদ করতে পারিসনি?”
“ওরা সিনিয়র। ওদের সাথে লাগা উচিত নয়। আমরা যখন সিনিয়র হব, আমরাও দাদাগিরি দেখাব।” আহাদ বলল।
“আমার মতো অবস্থা করবি জুনিয়রদের।ভালো লাগছেনা আমাকে দেখতে?” তেড়ে গলায় কথা বলে বেরিয়ে এলাম ভার্সিটি থেকে। বারবার আমাকে অনুরোধ করছিল, যাতে ড্রেস কিনে বাড়িতে যাই। আজ যা অসম্মান পেয়েছি, তারপরও এখানে থাকা আমার দ্বারা অসম্ভব। এই অবস্থায় বাড়িতে গিয়েই বা কী জবাব দিব।
আমার একমাত্র পোষ্য কুকুর টনি আমায় দেখামাত্র ছুটে এলো। চো/রে ভয়ে মানুষ কুকুর পোষে আর আমরা কু/কু/র চুরির ভয়ে মানুষ রাখি। টনিকে আদর না করে আড়ালে বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম।
চলবে… ইন শা আল্লাহ