তুমি থেকো দাঁড়িয়ে খোলা বারান্দায় পর্ব-৩৯ এবং শেষ পর্ব

0
2

#তুমি_থেকো_দাঁড়িয়ে_খোলা_বারান্দায়
#ইফা_আমহৃদ
অন্তিম পাতা

দিনের সূচনাটা আজ ভিন্নভাবে শুরু হয়েছে। এই পৃথিবীটা দেখব, তার কোনো আশাই আমার ছিল না। তবুও দেখেছি। কিছুক্ষণ আগে বাড়িতে পৌঁছেছি। আমার দুই সন্তান আপু ও নিবিড় ভাই নিয়ে গেছে। জ্ঞান ফেরার পর‌ মায়ের অজস্র কান্না আমার দু চোখে ধরা পড়েছে। এখনো সমানতালে কেঁদে চলেছে। আমি মায়ের কাঁধে হাত রেখে বললাম, “এভাবে কাঁদছ কেন? আমি তো বেঁচে আছি।”

“এখন তুইও মা হয়েছিস, আস্তে আস্তে বুঝবি মা আসলে কী? সন্তানের কিছু হলে মায়ের কেমন লাগে।”
আমি ক্লান্ত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালাম। সে আবার বলল, “হানি বাহারাজ তোকে সত্য খুব ভালোবাসে।”

আমি মুখ ভেংচি দিয়ে বললাম, “কচু বাসে। ভেবেছে আমি মরে যাব। মা মরে গেলে বাচ্চা কি বেঁচে থাকে? তাই সিজারিয়ান করেছে।”

মা হেসে বলল, “এছাড়া কোনো অপশন ছিল না। তুই জানিস কত দিন তুই বেহুঁশ ছিলিস?”

আমি ভ্রু কুঁচকে ফেললাম। চোখ কামড়ে বললাম, “কতদিন আবার কী? দুই তিন ঘণ্টা!”

“তিনদিন।”
মায়ের বলা এই শব্দটা আমার কানে বারবার বাড়ি খেল! তিনদিন! আমার কণ্ঠনালী দিয়ে একটা শব্দও প্রকাশ পেল না। আমতা-আমতা করার পূর্বেই মা বলল, “তিনদিনে বাচ্চাদের পুষ্টি ব্যাহত হচ্ছিল। এতে তাদের লাইফ রিস্ক ছিল। অন্যদিকে তোর জ্ঞান ফেরানোর জন্য কোনো ইনজেকশন পুশ করাও সম্ভব হচ্ছিল না। সে মুহুর্তে দাঁড়িয়ে একটাই অপশন ছিল তোর ডেলিভারি। এতে ওরাও সুস্থ থাকবে এবং তোকেও প্রপার চিকিৎসা করানো যাবে। যেহুতু ওদের বয়স প্রায় আট মাস, তাই ডেলিভারির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”

সত্যি তো যে মানুষটা বেঁচে থেকেও মৃতের মতো পড়ে ছিল, সেখানে সিজারিয়ান ছিল বেস্ট অপশন। বেশ কৌতূহল নিয়ে বললাম, “এর সাথে বাহারাজের ভালোবাসার কী সম্পর্ক?”

“ভার্সিটি থেকে খবর পেয়ে বাহারাজ সোজা হাসপাতালে চলে গিয়েছিল। ও আমাকে ফোন করেছিল ঠিকই, কিন্তু একটা কথাও বলতে পারেনি। সারাক্ষণ তোর পাশে বসে ছিল। এই বুঝি তোর জ্ঞান ফিরে এলো। ফাঁকা কেবিনে কত কেঁদেছে ছেলেটা। নার্স তোর জ্ঞান ফেরার খবর দেওয়ার সাথে সাথে ও ছুটে তোর কেবিনে চলে গেছে। তোর মনে কী চলছে আমি জানি না, তবে সম্পর্কটাকে এত সহজে শেষ করে দিস না।”
মা আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর আপু এসে আদ্রকে বিছানায় রেখে চলে গেল। কী ফুটফুটে হয়েছে দেখতে! মা ওকে দেখে বলেছে, আদ্র না আমার কপি। ছোট্ট আমি। তবে মেয়েটা খুব শান্তশিষ্ট। এদের মুখের দিকে তাকালে ছেড়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ আমার হাতে নেই।

রাত গভীর। বাহারাজ আদ্রিতাকে নিয়ে হাঁটছে ঘরের মধ্যে। একজনকে ঘুম পাড়ালে অন্য একজন উঠে যায়। তার কান্নায় বাকিজনও উঠে যায়। দুইজনকে একসাথে সামলাতে আমাকে প্রচুর হিমশিম খেতে হয়। বাহারাজ আদ্রিতাকে ঘুম পাড়িয়েও কোলে নিয়ে হাঁটছে। মেয়ের ঘুম যাতে না ভাঙ্গে তাই খুব আস্তে করে বলল, “এবার কী করবে হানি?”

আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, “ঘুমাব।”

“আমি এখনকার কথা জানতে চাইনি। ভবিষ্যতে কথা জানতে চেয়েছি। তুমি সিদ্ধান্তে যদি অটলই থাকো, তবে আর বাধা দিব না। এখন আর তোমাকে আটকে রাখার উপায় নেই।”
বাহারাজের কথাটা প্রথমবার ধরতে না পারলেও এবার ঠিকই ধরতে পারলাম। তার প্রত্যুত্তরে আর কোনো কথা মুখ ফুটে বের হলো না। মেয়েকে আস্তে করে বিছানায় রেখে বাহারাজও শুয়ে পড়ল। একটু পরপর হাত দিয়ে হাওয়া করে দেখছে, মশায় কামরাচ্ছে কি-না। ঘরের আলো জ্বলছে। আমার মনে বাহারাজের কথাটা বারবার ঘুরছে। উপায় নেই মানে? কে বলেছে উপায় নেই। ও চাইলেই তো আমাকে আটকে রাখতে পারে। পারে না? আমি উঠে আস্তে আস্তে বারান্দায় গেলাম। আজ কতদিন পর এই বারান্দায় এসেছি ভাবা যায়? শুনেছি ফাইনাল পরীক্ষা আরও দুটো চলে গেছে ইতোমধ্যে। এই অবস্থায় পরীক্ষার কথা মাথায় আনা অসম্ভব। বারান্দার গ্ৰিল ধরে হাঁটাহাঁটি করতেই বাহারাজ এসে দাঁড়াল পেছনে। নেভানো গলায় বলল, “হানি, ঘরে এসো। ঠান্ডা লেগে যাবে।”

“লাগুক আপনি গিয়ে ঘুমান।”

“বাচ্চামো করছ কেন? রুমে এসো। তোমার ঠান্ডা লাগলে বাচ্চাদেরও লাগবে। ভেতরে এসো।”

আমি একবারও পেছনে ফিরে তাকালাম না। বেশ অভিমান নিয়ে বললাম, “ঠিকই তো। আমার ঠান্ডা লাগুক, না লাগুক। তাতে আপনার কী?”

বাহারাজ আমার পেছনে এসে দাঁড়াল। হাত দুটো আমার ছাড়িয়ে গ্ৰিল দুহাতে ধরল। একটু নেভানো গলায় বলল, “কী হয়েছে, মন খারাপ?”

আমি জবাব দিলাম না। আমার চোখ থেকে অজস্র পানি গড়িয়ে পড়ছিল তখন। ঠোঁট চেপে বললাম, “মা বলল আপনি নাকি আমাকে ভালোবাসেন। আপনার ভালোবাসাটা আমি দেখতে পারছি না। আমাকে একটু দেখাবেন? যখন দূরে যেতে চেয়েছি, আপনি আমাকে কাছে টেনে নিয়েছেন। অথচ এখন আপনার কাছে থেকেও দূরে যেতে বলছেন।”

“কাছে রাখার চেষ্টা করেও কাছে তো রাখতে পারছি না। এবার তোমাকে মুক্ত বাতাসে উড়িয়ে দিলাম। দেখি গিয়ে ফিরে আসতে পারো কি-না!”

বেশ অভিমান হলো আমার। কালো মেঘের আড়ালে নিজের মুখশ্রী আড়াল করে বললাম, “তারমানে আপনি চান, আমি দূরে যাই? তাহলে আর কী করার? কাল সকালেই দুজনকে নিয়ে চলে যাব।”

বলে সরে আসার চেষ্টা করতেই বাহারাজ আমাকে টেনে ধরল। পেছন থেকে হালকা করে জড়িয়ে ধরে বলল, “এর থেকে বেশি দূরে যেও না হানি। আমার বুকটা উথালপাথাল করে তোমার দেওয়া আঘাতে।”

“যাব না। কিঞ্চিৎ পরিমাণ দূরেও যাব না।” বাহারাজের হাতটা শক্ত করে ধরে তাকিয়ে রইলাম বাইরের দিকে।

পরিশিষ্ট

আজ নিবিড় ভাই ও আপুর শুভ বিবাহ। আমি কনেপক্ষের কারণে বাড়িতে এসেছি। বাহারাজ বরযাত্রী হয়ে আসবে। আদ্র ও আদ্রিতার বয়স এখন তিন বছর। ও দৌড়ঝাঁপ করছে। বয়সে আপুর থেকে আট বছরের ছোটো হয়েও আমি এগিয়ে, তা কি কল্পনা করা যায়? শ্বশুরবাড়ির ছায়াতলে থাকতে থাকতে যতটুকু কাজ জানতাম না, সেগুলোও জেনে গেছি। কী সুন্দর পাকা হাতে হলুদ বাটছি! হলুদ বাটতে বাটতে খেয়াল হলো আপু কারো সাথে ফোনে কথা বলছে। মা উত্তেজিত হয়ে বলল, “জানভি কল করেছে। ছেলেটার কী এমন ব্যস্ততা বোনের বিয়েতে আসতে পারল না?”

“আমাদের দেশের কাজের সাথে ভিন্ন দেশের কাজের কোনো তুলনা হয়? হয় না? ওর কত ব্যস্ততা।” ফুফু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল। আমি বেশ মজা করে বললাম, “দেখো, তোমার ছেলে গিয়ে নির্ঘাত রূপসি লালনায় ডুব দিয়েছে। দেশে ফিরলে প্রকাশ পেয়ে যাবে, তাই লুকিয়ে রেখেছে।”

মা হাসতে হাসতে বলল, “বাবা মা চায়, তার ছেলেমেয়েরা সুখে থাকুক। জানভি যদি কাউকে বিয়ে করে সুখী হয়, তাহলে আমাদের আপত্তি কোথায়?”

ফুফুর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। জানভিকে দিন ধরে দেখি না। ওর সাথে মন খুলে ঝগড়া করতে পারিনা। নিজের আবদারগুলো প্রকাশ করতে পারি না। আজ বডড ইচ্ছে করছে জানভির সাথে কথা বলতে। আমাকে সরি বলার সুযোগ না দিয়েই বহু দূরে চলে গেছে। হলুদ রেখে স্টেজের কাছে গেলাম। আপু বেশ জমিয়ে জানভির সাথে কথা বলছিল। আমার গলা শুনতেই জানভি ওপাশ থেকে কল কেটে দিল। আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। চোখের কোণায় অশ্রু এসে ভীড় জমালো। আপু আমাকে শান্ত করতে বলল, “জানভির একটা দরকার কাজ আছে, ও কাজ শেষ করে চোর সাথে যোগাযোগ করবে।”

আমি ফ্যাকাসে হাসি দিয়ে বললাম, “তাই? আগে ওর সমস্ত দরকার ছিল আমার পরে, এখন যে কীভাবে আমার আগে এসে পড়ল।”

আমি চোখ মুছে ঘরে চলে এলাম। দরজাটা আলতো ভিড়িয়ে মন ভরে কাঁদলাম। জীবনে বহু বড়ো বড়ো ভুল করেছি, তা জানভি নিমেষে ভুলে গেছে। অথচ এই ভুলটাকে সে আঁকড়ে ধরে বসে আছে। হঠাৎ দরজা খুলে ভেতরে এলো বাহারাজ। আমার দুই মণি তার কোলে। ওদের বিছানার ওপর বসিয়ে দিয়ে রাগান্বিত গলায় বলল, “ওদের বাইরে রেখে তুমি এখানে বসে আছো কেন? একজন লোক ওদের চকলেটের লোভ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। ভাগ্যিস সঠিক সময় এসেছি, নাহলে…

আমার শরীর শিউরে উঠল। দুহাতে ওদের আঁকড়ে ধরে ভরাট গলায় বললাম, “কী বলছেন?”

“ঠিকই বলছি। একটু হলেই ওদের ধরে নিয়ে যেত।”
শরীরটা আমার নেতিয়ে গেল। অপরাধীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললাম, “আর এমন হবে না।”

বাহারাজ বোধ হয় এতক্ষণে আমার দৃষ্টি অনুসরণ করল। অবিলম্বে উদ্বিগ্ন গলায় বলে ফেলল, “কী হয়েছে তোমার? কাঁদছ কেন?”

“কিছু না।”

“কিছু তো অবশ্যই হয়েছে। নাহলে মানুষ কাঁদে না।” বাহারাজের জেদের কাছে আমাকে হার মানতে হলো। সবকিছু বলার পরে সে শান্ত কণ্ঠে বলল, “এজন্য কাঁদছে হয়?”

“তো! ও আমার সাথে একটা কথাও বলে না। সবসময় এড়িয়ে যায়।”

“এজন্য কান্না করা লাগে? ভাইয়ের বিয়ের পর আমরা সবাই মিলে ট্যুরে জানভির কাছে যাব। দেখবে তখন ও কোথায় পালায়?”
বাহারাজের কথায় আমি খুশি হয়ে গেলাম। ও দুজনের মাঝে দূরত্ব ঘুচিয়ে ঠোঁটে স্পর্শ করতেই আমি উল্কার বেগে সরে গেলাম। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম, “বাচ্চারা আছে।”

আদ্র বাহারাজের কাছে এসে বলল, “তোমলা কী করত্ত?”

বাহারাজ পেঁচা মুখে জবাব দিল, “খেলছিলাম। পুতুল পুতুল খেলা।”

আদ্রিতা কোমরে হাত দিয়ে বাবার কাছে গিয়ে বলল, “কীভ কেলটে হয়?”

আমি হেসে আসতে করে বেরিয়ে এলাম। ও যেভাবে পারুক পরিস্থিতি সামলে নিক।

চলবে ইন শা আল্লাহ

অন্তিম পর্ব ২য় অংশ পরবর্তীতে এখানে যোগ করে দেওয়া হবে।