তুমি থেকো দাঁড়িয়ে খোলা বারান্দায় পর্ব-০৪

0
2

#তুমি_থেকো_দাঁড়িয়ে_খোলা_বারান্দায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৪

“দোস্ত আমি কি সুন্দর না? আমার সাথে প্রেম করা‌ যায় না?”
কাতর দৃষ্টিতে ওদের দিকে চেয়ে রইলাম। শতচেষ্টা করেও আমাকে তুলতে পারছে না ওরা। আহাদ‌ এক গাল হেসে বলল, “তুই তো সুন্দরী নস, তুই হুর। কে বলেছে তুই প্রেম করতে পারিস না?”

“তাহলে আমার বয়ফ্রেন্ড নেই কেন দোস্ত?” আমার একরোখা প্রশ্ন।

তাসফি কিঞ্চিৎ হাসল। হাসতে হাসতে বলল, “কারণ তুই প্রেম করতে চাস না।” থেমে বলল, “হঠাৎ তোর হলো কি, বল তো? তোর সেই কনফিডেন্ট লেভেলটা কোথায়?”

আশ্চর্য হলাম। যে আমি সবসময় বলতাম, হানি চাইলেই ছেলেদের লাইন লাগিয়ে দিতে পারে। সে আজ ছেলেদের নিয়ে ভাবছি। কপালে ভাঁজ ফেলে উঠে দাঁড়ালাম। তিনদিন ভার্সিটিতে এলাম, অথচ এখনো ক্লাসে যোগদান করিনি। কেন জানি ক্লাস করার পুরনো আগ্রহ খুঁজে পাচ্ছি না। এদের সবাইকে নিয়ে ক্লাসে উপস্থিত হলাম। স্যার বোর্ডে লিখে লিখে সহজ করে লেকচার দিচ্ছেন। ভার্সিটির একেক শিক্ষকের মন মানসিকতা এক রকমের হয়। কেউ তার ক্লাসে অনুমতি ব্যতীত প্রবেশ পছন্দ করে না, কেউ বা লেকচারের মাঝে তাকে বিরক্ত করা পছন্দ করে না। করিডোরে পদচারণা করতে করতে বাহারাজের কথাগুলো ভাবছি। নিজেকে দেখার কৌতূহল দমাতে না পেরে ওয়াশরুমে গেলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে গভীর দৃষ্টিতে দেখছি। বাহারাজের প্রতিটি কথা সত্য। তবে এই অসুন্দরের মাঝেও দ্বিগুণ সুন্দর লাগছে। তবে বাহারাজের কাছে নয় কেন? দৃষ্টি ফিরিয়ে দেয়ালে তাকাতেই চোখে এলো কিছু আপত্তিকর লেখা। প্লাস চিহ্ন এটে কপোত কপোতীদের নাম লেখা। ব্যাগ হাতরে বলপেন পেলাম না। ছোটো পকেটে একটা মেরুন রঙের লিপস্টিক পেলাম। সেটা দিয়ে দেয়ালে লিখলাম, ‘বাহারাজ+ হানি’
পায়ের শব্দে চেতনা ফিরে পেলাম। লেখাটা দেখে চমকে গেলাম। কী করে ফেললাম এটা। লিপিস্টিক লেপ্টে ‘নি’ কা/টতে পারলেও পুরোটা কা/টা সম্ভব হয়নি। ততক্ষণে দুইজন মেয়ে ঢুকে পড়েছে ওয়াশরুমে। ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলাম ওয়াশরুম থেকে।

শেষের দুই ক্লাস টানা করে বাড়িতে ফিরতে আড়াইটা বাজল। ক্লান্ত শরীর নিয়ে ড্রয়িং রুম অতিক্রম করতেই জানভিকে দেখলাম ডাইনিং এ বসে খাচ্ছে। ব্যাগটা সোফায় ফেলে জানভির কাছে গিয়ে পিঠে দিলাম দুই চাপড়। জানভি উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, “মধু, মা/র/ছি/স কেন? ব্যথা পাচ্ছি কিন্তু।”

“ব্যথা পাওয়ার জন্যই তো দিয়েছি। ফা/জি/ল ছেলে গ্ৰামে গিয়েছিস, একবারও বলেছিস আমাকে?” অনবরত চাপড় দিতে দিতে বললাম। জানভি আমার হাত ধরে ফেলল। চেয়ার টেনে আমাকে জোর করে বসিয়ে বলল, “আমার যাওয়া না যাওয়াতে তোর বুঝি কোনো যায় আসে?”

“আসে তো, অবশ্যই আসে।” আমি স্থির গলায় বললাম। জানভি সম্পর্কে আমার ফুফুতো ভাই। পড়াশোনার সুবাদে গ্ৰাম থেকে আমাদের বাড়িতে থাকা শুরু করে। পরবর্তীতে ভাই হিয়ানের সাথে আমাদের কোম্পানিতে যোগদান করেছে।
মা রান্নাঘর থেকে এসে বলল, “যা, ফ্রেশ হয়ে আয়। নাহলে খেয়ে গোসল কর। জানভি তোকে নিয়ে কোথায় একটা যাবে।”

আমি উৎফুল্ল হলাম। ভেতরে আবেগ ধরে রাখতে না পেরে বললাম, “জান, কোথায় যাবে আমাকে নিয়ে?”

“স্কুটির শোরুমে। ভার্সিটিতে উঠে তোর নাকি স্কুটি লাগবে।” জানভির কথায় আমি খুশি হলাম। পরক্ষণে সন্দিহান গলায় বললাম, “স্কুটি তো পাপার কিনে দেওয়ার কথা ছিল। তুমি কেন দিবে?”

“ইচ্ছে হলো তাই। তুই নিবি কি-না বল।” বলেই পরবর্তী লোকমা মুখে তুলে নিল। আমি জানভির গাল দুটো টেনে দিয়ে বললাম, “নিব না মানে। অবশ্যই নিব। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

অতঃপর ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। কাবার্ড থেকে টপস্ ও জিন্স বের করে ওয়াশরুমে ঢুকলাম।

অন্ধকারে চারদিক ঘিরে আছে। ঝিরিঝিরি ধারায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। স্কুটি সাইড করে রেখে একটা দোকানের নিচে আশ্রয় নিলাম। সাদা কালোর কম্বিনেশনে একটা স্কুটি পছন্দ হয়েছে। জানভি সেটাই কিনে দিয়েছে। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই ওকে দেখে, আমার সব আবদার সবার আগে ও পূরণ করে। আমি আলতো হেসে বাইরে হাত বাড়ালাম। জানভি হাতটা ভেতরে এনে বলল, “হুটহাট বৃষ্টিতে ভিজো না মধু, জ্বর চলে আসবে।”

বলে আমাকে আড়াল করে সামনে এসে দাঁড়াল। মাটিতে লেগে গায়ে ছিটে আসা বৃষ্টির ফোঁটাও এবার আর এলো না। আমি মনখারাপ করে আশেপাশে দেখতে লাগলাম। চোখে পড়ল উপরের সাইনবোর্ডের লেখাটা। জিমনেসিয়াম। মনের অন্দরমহলে হানা দিল, বাহারাজের সেই কথাটা ‘আমার ফিগার দিপিকা পাড়ুকোনের মতো নয়।’ সাতপাঁচ না ভেবে বললাম, “জান চলো ওখান থেকে ঘুরে আসি।”

জানভি তাকাল সেদিক। ফিক করে হেসে বলল, “তুই জিম করবি? হা! হা! হা! ডাম্বেলের নিচে চাপা পড়ে ম/র/বি।”

আমি বিরাগী দৃষ্টিতে তাকালাম। জানভির হাসি থামছে না। আচমকা আসা ক্ষোভে এগিয়ে যেতে যেতে বললাম, “থাকো তুমি। আমি গেলাম।”

উপায় শূন্য হয়ে জানভি পেছনে পেছনে এলো। জিরো ফিগার তৈরি করা আমার মূল লক্ষ্য। আমার অভিমানের কাছে বিড়াল ছানা হয়ে সবটা সামলে নিল। অতঃপর দেড় ঘণ্টার জন্য আমাকে একা রেখে অফিসের দিকে গেল। অফিস থেকে ফেরার সময় নিয়ে যাবে। অভিজ্ঞ ট্রেইনার আমাকে প্রতিটি যত্নপাতি বুঝিয়ে দিতে লাগল। আশেপাশের বহু মানুষ জিম করার পাশাপাশি আমাকে দেখছে। আমরা একটু সামনে এগুতেই ট্রেইনার বলল, “এটা ডাম্বেল। আজ ডাম্বেল দিয়ে শুরু করো।”

আমাকে ছোটো ছোটো তিন কেজি ওজনের দুটো ডাম্বেল দিল। ডাম্বেল উঠিয়ে প্রেস দিতে গিয়ে নিজেকে বহু শক্তিশালী মনে হলো। ট্রেইনার সঠিক পদক্ষেপ দেখিয়ে বলল, “এভাবে করতে থাকো, আমি পানি খেয়ে আসছি।”

আমি মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিতেই তিনি প্রস্থান করলেন। আমার খানিক দূরে একটি মেয়ে দশ কেজি ওজনের ডাম্বেল দিয়ে পুশ নিচ্ছে। আমি তাকাতেই ব্যঙ্গাত্মক হাসি দিয়ে ভাব নিচ্ছে। চাপা ক্ষোভে দশ কেজি ডাম্বেল দিয়ে পুশ নিয়ে খানিক ভাব নিলাম। মেয়েটা হাসল। ত্রিশ কেজি ডাম্বেল অনায়াসে তুলে পুনরায় হাসল। যে কি জানে, হানি সবার সেরা? আমি পঞ্চাশ কেজি ডাম্বেল তোলার চেষ্টা করছি। সাহসা আমার ওজন হবে ৪৮ কেজি। সেখানে পঞ্চাশ কেজি তোলা দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিছু নয়। এক ইঞ্চি উঁচু করা আমার কাছে আকাশ ছোঁয়ার মতো। তবুও প্রচুর প্রচেষ্টা করে দুই মিটারের মতো উঠাতে সক্ষম হলাম। কিন্তু ধরে রাখতে অক্ষম। হাত ফসকে গেল। ছুটে গেল ডাম্বেল। পায়ের আঙুল ছুঁতেই কেউ একজন ধরে ফেলল সেটা। বুকের ভেতরের ডিপডিপ হাওয়াজটা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। ডাম্বেলটা দুহাতে কেচ করে ওপরে উঠাতে থতমত খেলাম। বাহারাজ সম্পূর্ণরূপে আয়ত্তে নিয়েছে। দুবার আপ-ডাউন করে বলল, “তুমি এখানে? এই শরীর নিয়ে জিমও করো?”

আমি খকখক করে কেশে উঠলাম। দুপা পিছিয়ে বললাম, “আপনি এখানে?”

অতঃপর চোখ গেল তার দেহের পানে। দেহের প্রতিটি ভাঁজ জানান দিচ্ছে সে এখানকার সদস্য। পরনে সেন্টো গেঞ্জি, চুলগুলো হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে সরিয়ে রেখেছে। বৃষ্টির মাঝেও কপালে জমে আছে দারুণ ঘাম। বাহারাজ আশেপাশে তাকিয়ে চ্যাঁচিয়ে বলল, “কে আছেন? এদিকে আসুন।”

বাহারাজের চিৎকার শুনে চারজন কর্মী হাজির হলো। ম্যানেজার উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, “স্যার, কোনো সমস্যা?”

“ইয়েস। আপনাদের সাহস হয় কীভাবে একজন ট্রেনিকে পরিপক্ক না করে এভাবে একা ছেড়ে রেখেছেন। তাও হাতে এত ভারী ডাম্বেল। আরেকটু হলে কী হতো, আন্সার মি।” বাহারাজ ডাম্বেল পাশে রেখে বলল। ম্যানেজার উত্তেজিত হয়ে সেই ট্রেইনারকে ডেকে বললেন, “হোয়াট ইজ দিস? আজ তোমার জন্য বড়োসড়ো কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেত।”

“সরি স্যার। আমি তাকে তিন কেজি ওজনের ডাম্বেল দিয়ে, একটু পানি খেতে গিয়েছিলাম। এরমধ্যে এমন কিছু হয়ে যাবে, বুঝতে পারিনি।”

চলবে…