তুমি থেকো দাঁড়িয়ে খোলা বারান্দায় পর্ব-০৫

0
2

#তুমি_থেকো_দাঁড়িয়ে_খোলা_বারান্দায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৫

ট্রেইনার বাহারাজের পানে চেয়ে আছে। বাহারাজ কৌতূহল নিয়ে বলল, “কেন? এক্সারসাইজ করবে না?”

“আমার আর কাউকে বকা খাওয়ানোর চেষ্টা নেই।” মুখ ফ্যাকাসে করে বললাম। বাহারাজ সবাইকে চোখের ইশারায় প্রস্থানের নির্দেশ দিল। আমি ব্যাগের কাছাকাছি যেতেই বলল, “এসো, তোমাকে আমি হেল্প করছি।”

আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। জিমে অবস্থানরত সবাই তখন সরঞ্জাম নিয়ে ব্যায়াম করতে ব্যস্ত। নিজেকে প্রিন্সেস ডায়ানা মনে হলো। বাহ্! বাহারাজ আমাকে ব্যায়াম করানোর প্রপোজাল দিয়েছে। সামনের ছোটো ছোটো চুলগুলো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে বললাম, “আপনি যেহুতু আমার জন্য সময় নষ্ট করেছেন। তবে নিশ্চয়ই আমি সুন্দরী।”

বাহারাজ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। তিন কেজির ডাম্বেল তুলে বলল, “এটা আমার জিমনেসিয়াম মধুর মা। তাই তোমাদের ছোটোখাটো সেবা আমি করতেই পারি, তাই নয় কী?”

নিমেষেই আমার থোতা মুখটা ভোঁতা হয়ে এলো। সুন্দরী ভেবে সে আকাশে পাখির ন্যায় উড়ছিলাম। সে ডানা খুয়িয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছি যথারীতি। চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো বললাম, “আপনি এখানকার অরনার?”

“হুঁ। সেই হিসেবে তোমাকে একটু সার্ভিস দিতেই পারি। ধরো।” বলেই বাহারাজ হাত বাড়িয়ে দিল। আমি দুহাতে ধরে আপ-ডাউন করছি। খোলা চুলগুলো পুনঃপুনঃ সমুখে চলে আসার কারণে ডাম্বেল দেখাই মুশকিল হয়ে গেছে। বাহারাজ বিদ্রুপ হেসে বলল, “খোলা চুলে এখানে কাউকে আসতে দেখেছ?”

“আমি তো স্কুটি কিনতে এসেছি। কাকতালীয় ভাবে চলে এসেছি।”

“স্কুটি! কতজন অ্যাক্সিডেন্ট করলে?”

“আমি এখনো রাইড করিনি।”

“তাইতো! নাহলে এতক্ষণে হাসপাতালে থাকার কথা ছিল।”

“হেই ইউ! আপনি কি কখনো গাইড করেছেন কাউকে? ট্রেইনার দের প্রথম কাজ, ক্লাইন্টের প্রশংসা করে তাকে খুশি করা। তবেই তো ভালোই টিপস পাওয়া যায়।” আমি বললাম। বাহারাজ ভ্রু কুঁচকালো। আজ তার মিশুক ব্যবহার ‘ভার্সিটির ব্যবহারের থেকে শতগুণ ভালো।’ অরনার- বলে কথা। ক্লাইন্টদের সাথে হাসিমুখে কথা বলাই তাদের রক্তে বহমান। বাহারাজ আমার খোলা চুলগুলো হাতখোঁপা করতে করতে বলল, “খোঁপা করতে পারো?”

“আমি খোঁপা করতে পারিনা।”

“তুমি আদৌ কিছু পারো- কিনা আমার সন্দেহ আছে।” বলেই বাহারাজ নিকটে এলো। পেছনে দাঁড়িয়ে হাত বাড়াল। ডাম্বেলের প্রতিটি স্টেপ আমাকে হাতে ধরে শেখাচ্ছে। তার প্রতিটি নিঃশ্বাস নির্গত হচ্ছে আমার ঘাড়ে ও কাঁধে। শক্তি টুকু খোয়া গেল। হাত ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসছে। ঠান্ডার মাঝেও বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝমতে শুরু করেছে ললাটে। বাহারাজের দেহ থেকে কড়া পারফিউমের স্মেলটা নাকের কড়া নেড়ে যাচ্ছে অনবরত। আমার শ্বাস-প্রশ্বাস ভারি হয়ে আসছে। দেহের প্রতিটি লোমকূপ জানান দিচ্ছে, পুরুষের স্পর্শের সতর্কবার্তা। গালে গেঁথে যাচ্ছে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। আমার অস্বস্তি ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। আমার অস্বস্তির ষোলো কলা পূর্ণ করতে তখনই নিভে গেল সেখানকার প্রতিটি বাতি। পর মুহুর্তে শোনা গেল অদূর থেকে বয়ে আসা তীব্র বাজ পড়ার শব্দ। এক দফা কেঁপে উঠে পিছু ফিরে আলিঙ্গন করে নিলাম বাহারাজকে। মনে হচ্ছে চারপাশ দিয়ে কেউ এসে ঘিরে রেখেছে আমায়। অন্ধকারে আমার ফোবিয়া। সাথে এই বিদ্যু চমকানো আমার ভেতরের সাহসের খুঁটি নাড়িয়ে দিয়েছে। সেন্টো গেঞ্জিটা বোধ হয় আমার চোখাল নখের আঁচড়ে ছিঁড়ে গেছে। বাহারাজ অনুভূতি পূর্ণ গলায় বলল, “মধু, এই মধু, ভয় করছে?”

“দেখুন না, আমার পেছনে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতের নখগুলো তীক্ষ্ণ। আমাকে আঁচড়ে দিবে।”

আমার উন্মাদনা কমার বিপরীতে তড়তড় করে বেড়ে গেল। বাহারাজ তার হাতটা আলতো করে পিঠে রেখে আশ্বাস দিল, “মধু, চোখ বন্ধ রাখো। তোমার চারপাশে কেবল আমি। ভয় পেয়ো না তুমি।”

আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। এতক্ষণ চোখের সামনে কাউকে স্পষ্ট দেখেছি। এখন একটু ভয় কমেছে‌। বিদ্যুৎ এলো না ফিরে। তবে একটা তীক্ষ্ণ আলো এসে পড়ল চোখে। ভয় নামিয়ে চোখ মেলে ঘাড় ফিরালাম। চোখে পড়ল জানভিকে। নিজের প্রিয় একজনকে দেখে ভয় নেমে গেল নিমেষে। আমি এক চিলতে এসে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম জানভিকে। জানভি পিঠে আলতো হাত বুলিয়ে বলতে লাগল, “মিষ্টি, ঠিক আছিস তুই?”

“এতক্ষণে আমার খোঁজ নিতে এসেছ, আমি তো ম/রেই যাচ্ছিলাম জান।”

“অফিসে গিয়েও যাইনি, কিছুটা পথ গিয়ে ফিরে এসেছি। বাইরে বৃষ্টি ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। আজ আর জিম করতে হবেনা, কাল আসবি।”

আমি মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম। আলো জ্বলে উঠল। জানভিকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। জানভি এগিয়ে গিয়ে বাহারাজের সাথে হাত মেলাল। আমি ওর পাশে দাঁড়াতেই বলল, “ওকে একটু দেখে রাখবেন, ওর কিছু হয়ে গেলে আমি নিঃস্ব।”

আমি অবাক হলাম, মামাতো বোনের কিছু হলে ফুফাতো ভাই নিঃস্ব হয় কীভাবে? কৌতূহল নিয়ে বললাম, “সত্যি নিঃস্ব হবে জান?”

“তোর সাথে আমার হার্ট কানেকশন। হার্ট থেমে গেলে দেহেটা চলবে কীভাবে? এইচএসসি পরীক্ষার সময় যখন স্কুটি কেনার জন্য বায়না করেছিলি, তখনই তো ঠিক করে রেখেছি তোকে স্কুটি আমি কিনে দেব। তাই আজ কিনে দেওয়া।” আমি ভ্রু কুঁচকালাম। জান সবসময় আমার প্রতি কেয়ারিং। তার ওয়াইফ নিঃসন্দেহে একজন ভালো মনের মানুষ পাবে। জানভির হাত টেনে বললাম, “হয়েছে, এবার চলেন স্যার, আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

সৌজন্য হেসে বাহারাজের পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই তার রাগান্বিত মুখশ্রী চোখে পড়ল। জানভি বায় বলে হাত ধরে বেরিয়ে এলো। আমি পেছন ফিরে তাকালাম। বাহারাজ এখনো আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে ঘরে। বিদ্যুৎ নেই কোথাও। আলো ছাড়া আমার ঘুম হয়না। আজ স্কুটি কিনলাম। অথচ একবার চালাতে পারলাম না। এখনো বিরতিহীন ধারায় বৃষ্টি কণা পতিত হচ্ছে ভূপৃষ্ঠে। আগামীকালের অপেক্ষায় থেমে শুয়ে পড়লাম। চোখের পাতা বন্ধ করলেই বাহারাজের সাথে অতিবাহিত করা সেই মুহুর্তটির দৃশ্য ভেসে উঠল চোখের তারায়। আমি চোখ মেলে ফেললাম। এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে পারছি না। প্রথমবার মনের ভেতরে একটা নাম বারবার দোলা দিয়ে যাচ্ছে। আমি দুহাতে লজ্জায় মুখ ঢাকলাম। লাজুক! চোখ পড়ল গিটারের দিকে। গিটার নামিয়ে বসলাম। মুঠোফোন বের করে ‘রেকর্ড’ অন করলাম। নিজের অতি প্রিয় গিটার হাতে তুলে নিলাম। সুর তুললাম গলায়। চোখ বন্ধ করে সেই মুহূর্তে পৌঁছে গেলাম।

আমারো পরানো যাহা চায়
তুমি তাই তুমি তাই গো,
আমারো পরানো যাহা চায়।

তোমা ছারা আর এ জগতে
মোর কেহ নাই কিছু নাই গো
আমারো পরানো যাহা চায়।

তুমি তাই,তুমি তাই গো।
আমারো পরানো যাহা চায়…

গান শেষ করে ‘রেকর্ড’ অফ করলাম। পাঠিয়ে দিলাম আমাদের চিরচেনা গ্রুপে। ছোটো করে মেসেজ লিখলাম, “ঘুম আসছেনা, তাই একটু গাইলাম।”

সিন হলো সাথে সাথে। তিন মিনিট পর রিপ্লাই করল আহাদ, “দোস্ত, তুই তো ফাটিয়ে দিয়েছিস। বিশ্বাস হচ্ছে না, তুই গেয়েছিস এটা।”

তাসফি বলল, “মা/রাত্মক দোস্ত। এটা আমার বয়ফ্রেন্ডকে পাঠিয়ে বলল আমি গেয়েছি, ও বেচারা উন্মাদ হয়ে যাবে।”

সাথে সাথে জয় মেসেজ করল, “খবরদার, এটা হানির গাওয়া। নিজে ক্রেডিট নিবি না।”

তাসফি বলল, “আরে আমি তো প্রশংসা করতে এমন বলেছি। হানি তোর ভিডু আমি কিন্তু ফেসবুকে আপলোড করব।”

আমি লিখলাম, “না। যা গলা। সবাই হাসবে।”

তাসফি লিখল, “তোর কথা শুনব না।”

“আচ্ছা, তবে ফেইস হাইড করে নিস।” লিখে নেট অফ করে শুয়ে পড়লাম।

চলবে… ইন শা আল্লাহ