তুমি থেকো দাঁড়িয়ে খোলা বারান্দায় পর্ব-০৬

0
2

#তুমি_থেকো_দাঁড়িয়ে_খোলা_বারান্দায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৬

সময় সকাল নয়টা আঠারো। বৃষ্টি শেষে স্বচ্ছ পরিবেশ চারদিকে বিরাজমান। সারারাত ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফলে পথঘাট জনশূন্য। স্কুটিতে জানভির পেছনে বসে অগ্রসর হচ্ছি ভার্সিটির দিকে। প্রথমদিন ভার্সিটিতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পড়েছে জানভি। সাইকেল রাইড জানার ফলে স্কুটি রাইড করার সহজতর একটি বিষয়। তবুও চালানোর ফাঁকে আমাকে গাইড করছে জানভি। স্কুটি এসে থামল ভার্সিটির সামনে। অতি সাবধানে স্কুটি থেকে নেমে বললাম, “স্কুটি কি নিয়ে যাবে, নাকি রেখে যাবে?”

“স্কুটি মূলত মেয়েদের জন্য তৈরি। আমাদের জন্য বাইক। এটা আমি পার্কিং এড়িয়াতে রেখে যাব।”

“তুমি কীভাবে অফিসে যাবে?”

“রিকশা আছে।” বলে জানভি একটা চাবি খুলে নিজে রাখল। অতঃপর পুরো চাবি রিং আমাকে দিয়ে পার্কিং এড়িয়াতে চলে গেল। জানভির গমন পথের পানে চেয়ে দৃষ্টি সরালাম। অতঃপর ভার্সিটির ভেতরে প্রবেশ করলাম। পূর্বের তুলনায় আজকে শিক্ষার্থীদের আনাগোনা কম। ঠান্ডায় নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে তাঁরা। আমার বন্ধুমহলও সঙ্গ দিয়েছে তন্দ্রাকে। আমি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে ক্লাসের দিকে এগুলাম। যাত্রাপথে বাহারাজ ও তার দলবলের দেখাও জুটল না।
প্রথম দুটো ক্লাস সুন্দরভাবে সম্পন্ন করে ক্লাস ত্যাগ করলাম। এখন অন্য বিভাগের ক্লাস চলবে। আপাতত দুটো ক্লাস বিরতি। ভার্সিটি জীবনের প্রথম ক্লাস দুটো বিষন্নতায় পার হলো আমার। আজ আর ক্লাস করব না, এই চিন্তা নিয়ে ক্যাম্পাসের দিকে যেতেই আহাদকে দেখতে পেলাম। আশেপাশে দৃষ্টি মিলিয়ে উঁকিঝুঁকি দিতেই বাকিদের সন্ধান পেলাম। ফোনের স্ক্রিনে কিছু দেখছে আর আলোচনা চলছে তাদের। তাসফির কাঁধে চাপড় মেরে বললাম, “তোরা এখানে আর আমি নিরামিষ ক্লাস করে এসেছি।”

জয় হাসতে হাসতে বলল, “সারাজীবন পরীক্ষার আগে সারারাত পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিয়েছি আর ভার্সিটি এসে ক্লাস করব? হাউ ফানি।”

অতঃপর ওরা পুনরায় কোনো একটা বিষয় নিয়ে গুরুতর আলোচনা শুরু করল। খানিক্ষণ পর বুঝলাম, তার কেন্দ্রবিন্দু আমি। আমি যথেষ্ট বিরক্ত হলাম। ব্যাগটা কাঁধ থেকে খুলে বললাম, “ধুর কী শুরু করেছিস তোরা? আমি শ্রেয়া ঘোষাল নই যে নিখুঁতভাবে গান গাইব। আমার থেকে তোরা ভালো‌ গান করিস।”

তাসফি বিরোধিতা করে বলল, “তোর গাওয়া ভিডু গ্রুপে আপলোড দিয়েছি। ২k লাইক ১k কমেন্ট।”

আমি বিদ্রুপ করে বললাম, “শোন, গ্ৰুপে এক লক্ষ মেম্বার। সেখানে দুই হাজার লাইক আহামরি কিছু নয়, বিশ হাজার হলে বুঝতাম ভালো গেয়েছি।”

আহাদ বলল, “তুই কারো পোস্টে এক হাজার রেসপন্স দেখেছিস? সেখানে এক রাতের ব্যবধানে এক হাজার রেসপন্স অনেক কিছু।”

আমি নির্বিশেষে মনোযোগী হয়ে ওদের কথা শ্রবণ করে চলেছি। আচমকা দেহটা উষ্ণ হয়ে উঠছে। মাথাটা ভার হয়ে নুয়ে পড়ছে। গতকাল বৃষ্টির দু চার ফোঁটা পানি মাথায় লাগার ফলে এই অসুস্থতা। আমি দাঁড়িয়ে পোশাক ঝেড়ে বললাম, “শরীরটা ভালো লাগছে না, আমি আজ আসছি। শেষের পিরিয়ড করে ইমপ্রটেন্ট টপিকগুলো নোট করে রাখিস। কালকে কালেক্ট করে নিব।”

অতঃপর পার্কিং এড়িয়ার দিকে অগ্রসর হলাম। পার্কিং এড়িয়া সম্পূর্ণ পর্যবেক্ষণ করেও নব্য কেনা স্কুটির সন্ধান পেলাম না। উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন বের করতেই একটা স্কুটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো। যার সিটগুলো কেউ ইচ্ছাকৃত কেটে কুটিকুটি করে ফেলেছে। আমি ছুটে গিয়ে হাত বুলালাম স্কুটিতে। এটা তো আমার স্কুটি। অতি প্রিয় স্কুটিটার এই বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে চোখে পানি চলে এসেছে। ভেতরের কান্না আটকে রাখতে ব্যর্থ হয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। তৎক্ষণাৎ পায়ের শব্দ শ্রবণ হলো। শব্দের উৎস খুঁজতে সেদিক তাকাতেই বাহারাজকে চোখে পড়ল। দ্রুত চোখ মুছে দৃষ্টি সরাতেই তিনি বললেন, “মধুর মা, কাঁদছ কেন?”

“কাঁদছি না।”

“এটা কার স্কুটি? এমন অবস্থা কীভাবে হয়েছে?”

“আমার। কে করেছে জানি না। গতকাল এটা জান কিনে দিয়েছে।” বলেই হেঁচকি তুললাম আমি‌। বাহারাজ পকেট থেকে সেন্টারফ্রুট বের করে মুখে দিল। চোখে পড়ল বাহারাজের বামহাতে একটা ব্যান্ডেজ। চিবুতে চিবুতে বলল, “তোমার পেয়ারের জানকে বলো, আরও একটা কিনে দিতে। ও তো তোমার জন্য জান উৎস করতে এক পায়ে রাজি।” থেমে পরপর বলল, “তোমরা যে রাতবিরেতে ঘোরাঘুরি করো, তোমার পরিবার কিছু বলে না।”

“কী বলবে?” ভ্রু কুঁচকে বললাম।

“হোটেল ভাড়া নিয়েছে বুঝি?” বাহারাজের দেওয়া লাঞ্ছনায় শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল এক স্রোত নেমে গেল। চোখজোড়া ক্ষোভে কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। দুহাতে বাহারাজের কলার টেনে নিকটে এনে বললাম, “একদম চুপ। জানের নামে একটা বাজে কথা বলবেন না।”

“এত প্রেম? বাহ্! রেট কত?”

“আমাকে কেনার মতো রেট আপনি দিতে পারবেন না।”

“তোমার মতো মেয়ের প্রতি আমার ইন্টারেস্ট নেই।” বলেই সর্বশক্তি প্রয়োগ করে আমাকে ধাক্কা দিল। অকস্মাৎ ঠ্যালায় হুমড়ি খেয়ে পড়লাম দেয়ালের সাথে। কপালের এক কোনে ধাড়াম করে আঘাত লাগল। পুরো দেহটা এক মিলি সেকেন্ডে জিম দিয়ে উঠল। আমি মাথা ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। চারপাশে অন্ধকারের এক আস্তরণ পড়েছে। আমি ফোন বের করে ডায়াল করলাম জানভির ফোনে। দুবার রিং হতেই জানভি রিসিভ করল। অতঃপর বলল, ” হ্যালো হানি, কিছু হয়েছে?”

কান্নার আর্ত চিৎকার গলায় এসে থেমে আছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বহু কষ্টে বললাম, “আমার স্কুটি।”

“কী হয়েছে স্কুটির। তুই ঠিক আছিস? কাঁদছিস কেন পাখি?”

“কেউ আমার স্কুটির সিট নষ্ট করে ফেলেছে জান। তুমি প্লীজ আমাকে নিয়ে যাও।”

“হানি কুল ডাউন। তুই ঠিক আছিস?”

“শরীরটা ভালো নেই। মাথা ঘুরছে।”

“তুই বাড়িতে চলে যা। আমি যাওয়ার সময় স্কুটি নিয়ে যাব। কান্না করিস না।” আমি জানভির কথায় ছোটো করে হ্যাঁ বললাম। কলের সমাপ্তি টেনে রিকশা ডেকে বাড়ির দিকে রওনা হলাম।

কম্বল ও এসির ঠান্ডা হাওয়াতে ঘুমটা প্রগাঢ় হয়ে এসেছে। বাড়ি ফিরে আরামে ঘুমের যে দেশে পাড়ি জমিয়েছি, তা থেকে ফিরে আসা কেবল দুষ্করও নয়, এক কথায় অসম্ভব। ইতোমধ্যে চারজন এসে উঠার পাঁয়তারা করে গেছে। কিন্তু আমি ঘুমে বদ্ধপরিকর। আমার ঘুমের ইতি টানতে হাজির হলো জানভি। কম্বলটা একটানে দেহে থেকে টেনে নিচে ফেলে দিল। আমি হাই তুলে জানভির পানে চেয়ে নিভু নিভু গলায় বললাম, “একটু ঘুমাতে দাও প্লীজ।”

“না খেয়ে কীসের ঘুম হ্যাঁ? গোসলও তো করিসনি মনে হয়। আজ হিয়াকে দেখতে আসবে। গোসল করে তৈরি হয়ে নে। তুই নাকি হিয়ার ওপর কী প্রতিশোধ নিবি!” জানের কথায় ঘুম ছুটে গেল। লাফিয়ে উঠে বললাম, “নিবিড় ভাই কি চলে এসেছে?”

“না। ওরা রাস্তায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।”

উদাসীন হয়ে গেলাম। বিছানা ছেড়ে কাবার্ড থেকে টিয়া রঙের শাড়ি বের করে বিছানার ওপর রেখে বললাম, “ঘরটা একটু গুছিয়ে ফেলো, আমি দুই মিনিটের মধ্যে আসছি।”

“এটা না হিয়ার হারিয়ে যাওয়া শাড়িটা, তোর ঘরে কী করছে?”

“আপুকে আমার ঘরে পাঠিয়ে দাও।” বলেই ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। পেটিকোট ও ব্লাউজ পরিহিতা অবস্থায় বের হয়ে দেখলাম আপু বসে আছে বিছানায়। রাগে কটমট করে চেয়ে বলল, “এই শাড়িটা তুই লুকিয়েছিলিস?”

“হুঁ। কারণ তুই নিবিড় ভাইয়ের সাথে আমার দেখা করাসনি।” আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছতে মুছতে আমার স্পষ্ট গলা। আপু রাগান্বিত গলায় বলল, “এটা আমি একদিনও পড়িনি।”

“তো! কথা না বলে চুপচাপ শাড়িটা আমাকে পরিয়ে দে। নিবিড় ভাইয়াকে একটা কড়া শাস্তি দিয়ে আসি।” বলেই মৃদু হাসলাম।

“আমি পারব না।”

“আমি কিন্তু তাহলে এভাবেই যাব। তোর হবু শ্বশুর শাশুড়ি কিন্তু আমাকে দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়লে, আমি কিন্তু কিছু জানব না। বিয়েটা বরংচ ভেঙে যেতে পারে।”

“হানি।” দুষ্টু গলায় বলে আপুর খানিকটা আঁচ করতে পেয়ে হাসল। আপু পরিপাটি করে শাড়ি পরিয়ে লম্বা একটা ঘোমটা তুলে দিল মাথায়।
নিবিড় ভাই তার বাবা, মা ও ছোটো ভাইকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছে। ড্রয়িং রুমে তুমুল আড্ডা চলছে তাদের। দোতলার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছি আমরা। ভীষণ চমকে উঠলাম তাদের মাঝে বাহারাজকে দেখে। আমার জানামতে নিবিড়ের ছোটো ভাইয়ের নাম আবির। তখন বোরিং বাহারাজের দৃষ্টিও তখন আশপাশ খুঁজতে খুঁজতে আমার কাছে থামল। মিলিত হলো দুজনের দৃষ্টি। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দটা সমানতালে বেজে চলছে।

চলবে… ইন শা আল্লাহ