তুমি থেকো দাঁড়িয়ে খোলা বারান্দায় পর্ব-০৮

0
4

#তুমি_থেকো_দাঁড়িয়ে_খোলা_বারান্দায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৮

“তোমার নিষিদ্ধ শহরের অলিগলিতে কেবল আমার প্রবেশ ঘটুক মধুরানী।” ফোনের স্ক্রিনে এই একটি বাক্য দেখেই থমকে গেলাম আমি। চোখের পলক স্থির হয়ে রইল। আমি তার প্রোফাইলে ঢুকলাম। হাতেগোনা দুইটা ছবি দেখে উপলব্ধি করলাম, সদ্য খোলা হয়েছে এই ফেসবুক আইডিটা। আমি ছোটো করে মেসেজ করলাম, “কে আপনি?”

মিনিট তিনেক বাদে নামবিহীন প্রোফাইল থেকে মেসেজ এলো, “জেনে কি করবে, চিনবে?”

“চিনতেও তো পারি। পরিচয় দিন।” ওপাশ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া এলো না। আমি বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ অপেক্ষা করলাম ছোটো এক বার্তার। কিন্তু নিরাশ হলাম পরিশেষে। নিরাশ হয়ে ফেসবুকের নোটিফিকেশন চেক করলাম। ঋতু আমাকে ট্যাগ করে ফেসবুক গ্ৰুপে কিছু পোস্ট করেছে। নোটিফিকেশনে ক্লিক করতেই নিজের গাওয়া গানের ভিডিয়োটা এলো। ১০কে পেরিয়ে গেছে মেম্বারদের রিয়েকশনে। কৌতূহল নিয়ে কমেন্ট বক্স চেক করলাম। আমাকে উৎসাহিত করে কত কত মন্তব্য। প্রশংসাতে আমার মনে সুপ্ত দোল খেয়ে গেল। মেসেজ নোটিফিকেশন এলো। নাম বিহীন মানবটি লিখেছেন, “পরিচয় না দিলে কি কথা বলা নিষেধ?”

“যেটাতে আপনি কমফোর্ট ফিল করেন।”

“তাই? তোমার গানের গলা সুন্দর। সুরেলা কণ্ঠের জাদুতে আমি উন্মাদ।”

সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই করলাম, “আমার গান শুনেছেন? তারমানে আপনি আমাদের ভার্সিটিতে পড়েন নিশ্চয়ই।”

“হুঁ। গুড নাইট। রাত তো কম হলো না, এবার ঘুমাও। ভার্সিটিতে আবার প্রোগ্রাম আছে।” প্রোগ্রামের কথা শুনে চমকিত হলাম আমি। স্টুডেন্ট হয়ে এখনো আমি জানি না। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলাম, “কীসের প্রোগ্রাম?”

“আমাদের ভার্সিটির তেতাল্লিশ বছর পূর্তি হওয়াতে কতৃপক্ষের এই আয়োজন। আল্লাহ হাফেজ।”

আমি একটা লাভ রিয়েকশন দিয়ে ইন্টারনেট কানেকশন বন্ধ করে দিলাম। বাহারাজ নিশ্চয়ই এই গ্ৰুপে যুক্ত আছে? আমার গান কি ও শুনেছে? ওর ভালো লেগেছে? অন্ধকারের মাঝে আমাকে চিনেছে? ওর কোনো উত্তর আমার তরফ থেকে এলো না। পাশবালিশটা আঁকড়ে ধরে শুয়ে পড়লাম। খোলা জানালা ভেদ করে শীতল হাওয়া আমার দেহ কাঁপিয়ে দিল। তন্দ্রার রাজ্যে তখন প্রবেশ ঘটল বাহারাজের।

ভার্সিটিতে আজ উৎসব মুখর পরিবেশ বিরাজমান। আমি উজ্জ্বল হেসে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছি। একদল ক্যাম্পাসে বসে গান চর্চা করছে, আরেকদল শ্রেণিকক্ষে নাচ প্রেকটিস করছে। জয় বাদাম চিবুতে চিবুতে বলল, “আমি ভালো নাটক করতে পারি, লিস্টে নাম দিয়ে দেখব?”

তাসফি খানিক প্রিঞ্চ করে বলল, “তুই আর নাটক! তুই মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করতে ভালো পারবি।”

ঋতু বলল, “হানি তুই কিন্তু গানে অংশগ্রহণ করতে পারিস। গ্ৰুপে তোর গানের রিয়েক্ট আকাশ ছুঁইছুঁই।”

আমার গান‌ গাওয়া নিয়ে সবার বেশ কৌতূহল, আগ্রহ। তবে কোলাহলময় এলাকায় গান গাওয়া আমার পক্ষে বহু কষ্টকর। আমি নাকোচ করলাম, “আমি এত ভালো গাই না। তাছাড়া সন্ধ্যায় আমার আসার কোনো ইচ্ছে নেই। এসির টেম্পারেচার বাড়িয়ে কম্বল নিয়ে গভীর একটা ঘুম দিব।”

তাসফি বলল, “তুই আসবি না দোস্ত?”

প্রত্যুত্তরে বললাম, “টনিকে নিয়ে বের হওয়া হয়না অনেকদিন। ও বেশ বোরিং ফিল করছে। ওকে একটু সময় দিতে চাইছি।”

আহাদ ফের বলল, “বর্ষপূর্তি উদযাপনে না থাকলে মার্ক কাটা হয়, জানিস?” আহাদের কথায় চমকে উঠলাম। চোখের দেখায় কারো মুখমণ্ডল মনে রেখে নাম্বার কাটা অসম্ভব একটি বিষয়। আমি দ্বিমত করে বললাম, “আমি এখনো এত ফেমাস হয়ে যাইনি যে আমার নাম মনে রেখে পরীক্ষার সময় মার্ক কা/টবে। এইসব ভুয়া।”

আহাদ বলল, “আমরা খবর নিয়ে এসেছি। অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রতিটা ক্লাসের একটা করে বক্স রাখা হবে। যে যার নাম চিরকুটে লিখে ভাঁজ করে সেই বক্সে ফেলে রাখবে। পরবর্তীতে প্রতিটি ক্লাসের জন্য একজন স্যার বরাদ্দ থাকবেন। সে ওই বক্সের মধ্যে থেকে একটা কাগজ তুলবেন। যার নাম উঠবে সে পারফর্ম করবে। বাকি নামগুলো পরীক্ষার সময় তুলে মার্ক যুক্ত করবে অথবা বাদ দিবে।”

আমার মস্তিষ্কে কথাগুলো সম্পূর্ণ না পৌঁছালেও বুঝতে সক্ষম হলাম কিছু। বিরক্ত হলাম সেই মহাশয়ের ওপর, যে বানিয়েছে এই নিয়ম খানা। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, “কী আর করার। চল স্টেজ থেকে ঘুরে আসি। আমাদের উচিত ওদের সাহায্য করা।”

দলবল নিয়ে চললাম সিনিয়রদের সাহায্য করতে। এলোমেলো করে স্টেজ পরিপাটি করে সাজাতে ব্যস্ত তারা। প্রিয়া নামের মেয়েটা গহীন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। প্রকাশ পেল বিরক্ত ভাব। মুখ বাঁকিয়ে বলল, “ফেসবুক গ্ৰুপে তুমি গান গাওয়া ভিডিয়ো আপলোড করেছিলে?”

কিঞ্চিৎ ফাঁক করে জবাব দেওয়ার পূর্বেই ঋতু বলে উঠল, “হ্যাঁ। গানটা হানি গেয়েছে। ও খুব ভালো গায়।”

মেয়েটা নাক কুঁচকে বলল, “ওতটা ভালোও গায়নি। গিটার হাতে থাকলে ‘ক খ গ ঘ ঙ’- বললেই একটা গান হয়ে যায়।”

তীব্র ট্যাপের আঠারো অংশকে তিন ইঞ্চি পরিমাণ কা/ট/তে কা/ট/তে বলল, “তাহলে তুই একটু গেয়ে শোনা।”

প্রিয়া ফের বিরক্তির সাথে বলল, “মেয়েটার গলা নয় ওটা, ও শুধু লিপ্রিড করেছে।”

“গানটা আমিও শুনেছি। ও দারুণ গেয়েছে। তোমরা মেয়েরা অন্য মেয়ের প্রশংসা সহ্য করতে পারো না।” রুদ্র বলল। বাহারাজ পাশে দাঁড়িয়ে নিজের মতো কাজ করছিল। ‘ভালো ও মন্দ’ পক্ষের মতামতের রায় দিতে ফোনটা রুদ্রকে দিয়ে সেই গানটা বের করতে বলল। অবাক হলাম বাহারাজের কথা ভেবে, সবাই আমার গান শুনে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অথচ সে শুনে অবধি নি। বাহারাজ বিচারকদের ন্যায় সম্পূর্ণ মনযোগ দিয়ে ভিডিয়োটি দেখছে। উদ্বিগ্ন হয়ে সবাই অপেক্ষারত তার রায়ে। একদলকে নিরাশ করে রায় দিল, “মোটামুটি।”

এক শব্দেই গানের বিশ্লেষণ করে ফেললেন তিনি। আমার সুপ্ত হৃদয়টা তার কথায় চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেছে। আমি নীরব দর্শকের মতো পা ফেলতেই বাহারাজ ফের বলল, “তুমি সন্ধ্যাবেলা গান গাইতে পারো।”

“এই মোটামুটি গলা নিয়ে গান গাওয়া ঠিক হবে না।” মৃদু গলায় বলে দোতলার দিকে অগ্রসর হলাম। আমি জানি না, বাহারাজ আমার দিকে তাকিয়ে আছে কিনা। তবে আমি চাই সে তাকিয়ে থাকুক। কেবল মোটামুটি! ভালো নয় কেন? দু লাইনে বিশ্লেষণ করলে কী ক্ষতি হতো, শুনি? মন ভার করে ক্লাস রুমের দিকে পা ফেললাম। ক্লাসরুমে কেউ নেই। বাইরে থেকে ছিটকিনি তুলে রাখা হয়েছে। গতি পথ পরিবর্তন করে বিপরীত পথে অগ্রসর হলাম। বই কেনা হয়নি। লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে একটু পড়ব -এই আশায় গন্তব্য লাইব্রেরীতে স্থির। লাইব্রেরিতে আজ কেউ নেই। উৎসবের দিনে কে আমার মতো বই নিয়ে বসে?
লাইব্রেরিটা একদম শুনশান জায়গায় অবস্থিত। ভবনের থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত। তাই সহজেই পড়াশোনায় মনস্থির করা যায়। আমি প্রসন্ন হয়ে বইয়ের পাতা উল্টে দেখতে লাগলাম। এরমধ্যে বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটল। পুরো ঘর অন্ধকারে তলিয়ে গেল। জানালা না থাকার ফলে মূল দরজা খুঁজে পেতে বেগ পেতে হচ্ছে আমাকে। কিছুটা সামনে এগুতেই আলোর দেখা পেলাম। তবে সম্পূর্ণ পৌঁছানোর পূর্বেই আলোর রেখা অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। কপালের মাঝে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝমতে আরম্ভ করেছে। অপরিচিত একটা স্পর্শ সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল। মনে হলো, কেউ খুব শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। ভয়ে জমে আসছে শরীর। কথা বলার শক্তিটুকুও নেই। বিপরীত দেহ থেকে ভেসে আসছে তীব্র সুগন্ধ। স্নায়ুতন্ত্র সঠিক কাজ করছে কি-না জানতে হাত দিয়ে দিয়ে বুক স্পর্শ করতে চাইলাম, কিন্তু ছোঁয়া লাগল অপর একটি শরীরে। কাঁপতে কাঁপতে বললাম, “প্লীজ আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আর কখনো এখানে আসব না।”

“এত শত মেয়ের ভীড়ে তোমাকে আমার মনে ধরেছে মেয়ে। তুমি না আসলে চলবে?” না ছেড়েই বলল।

আমি বললাম, “কে আপনি?”

“তোমার অপ্রিয় কেউ।”

চলবে… ইন শা আল্লাহ