তুমি থেকো দাঁড়িয়ে খোলা বারান্দায় পর্ব-০৯

0
4

#তুমি_থেকো_দাঁড়িয়ে_খোলা_বারান্দায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৯

অচেনা মানবটির দেহের লোম আমার দেহের সাথে মিলেছে। সুড়সুড়ি দিয়ে উঠছে শরীর। আমি ছাড়ানোর চেষ্টা করে দুকদম পিছিয়ে গেলাম। বুকশেলফের সাথে ধাক্কা খেয়ে জবুথবু হয়ে রইলাম। সূচ পরিমাণ জায়গাও অবশিষ্ট নেই। আমি হাঁসফাঁস করে উঠলাম। এই বুঝি মট করে ঘাড়টা মটকে দেয়। মোটা স্বরের মানবটি বলে উঠল, “প্রতিদিন একবার এখানে এসে হাজিরা দিয়ে যাবে, নাহলে মধ্যরাতে তোমার বাড়িতে গিয়ে…

বলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। আমি আমতা-আমতা করে জবাব দিলাম, “আপনি আমার বাড়ি চিনেন?”

“চিনি তো! তোমার সবকিছু আমার নখদর্পণে।”

আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। আগন্তুকের শ্বাস-প্রশ্বাস আমার দেহে ক্রমাগত আঁচড়ে পড়ছে! আচ্ছা তানারা কি অক্সিজেন গ্রহণ করে? নিশ্চয়ই গ্ৰহণ করে। আচমকা আমার অধরে সূচ ফোটানোর মতো ব্যথা লাগল। আমি দৃঢ় করে তাকে আকড়ে ধরতেই সে থেমে গেল। ধীরে ধীরে পতিত হওয়া উষ্ণ হাওয়াও মিলিয়ে গেল। খট করে শব্দ হলো ছিটকিনি নামানোর। পরক্ষণেই আলোর একটা রেখায় চোখ ধাঁধিয়ে গেল। আমি হন্যে হয়ে তাকে পুরো লাইব্রেরি খুঁজলাম। একজন শিক্ষার্থীও নেই সেখানে। ব্যাগের বেল্টটা শক্ত করে ধরে এক লাফে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এলাম।

ক্যাম্পাসে আয়োজন চলছে। সেই আয়োজনে অংশ নিতে বেঞ্চ ও চেয়ার ঠিক করে সাজাচ্ছে আমার চার বন্ধু। কাজের মাঝে তাসফি আমার দিকে চেয়ে বলল, “কীরে তোর ঠোঁটের এই অবস্থা হয়েছে কীভাবে? রক্ত ঝরছে তো?”

ওরা সহ বাকি কয়েকজনও তাকাল। আমি ওষ্ঠদ্বয় স্পর্শ করে টুকটকে রক্তের হদিস পেলাম। টিসু দিয়ে মুছতেই প্রিয়া মেয়েটা ব্যঙ্গ করে বলল, “ফাঁকা ক্লাসরুম পেয়ে বয়ফ্রেন্ড ছেড়ে দেয়নি। তা- টক নাকি মিষ্টি এ স্বাদ?”

শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল এক স্রোত নেমে গেল। মেয়ে হয়ে মেয়ের নামে এমন কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করতে পারে – ভেবেই ঘৃণা এলো। আমি গমগম করে বললাম, “তিতা। অনেক তিতা। তুমি ট্রাই করতে চাও?”

“আমার চরিত্র তোমার মতো থার্ড ক্লাস নয়। তুমিই বরং তিতা পান করো।”

“মুখ সামলে কথা বলুন।”

“বলব না, কী করবে তুমি? আউট। এখানে তোমার ছায়াও দেখতে চাই না।” প্রিয়ার করা অপমানে মস্তিস্ক নত হয়ে এলো। আমি দাঁতে দাঁত চেপে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আওড়ালাম, আমার ভূত প্রেমিককে দিয়ে তোকে শায়েস্তা করব। বিরবির করে বেরিয়ে এলাম ভার্সিটি থেকে। প্রবেশদ্বারের বাইরে ফুচকা ওয়ালা দেখে মুখে জমল নোনা জল। গতি পরিবর্তন করে ফুচকা ওয়ালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঝটপট দু প্লেট ফুচকার অর্ডার করে চেয়ারে বসে হাতে পাওয়ার অপেক্ষার প্রহর গুনছি। এক প্লেট হাতে পেতেই আরামসে খেতে লাগলাম। মনপ্রাণ শান্ত হলো অবশেষে। আমি তৃপ্তিকরে খেয়ে পরবর্তী প্লেটে ঝাল বাড়িয়ে দেওয়া নির্দেশ দিলাম। দ্বিতীয় প্লেট থেকে ফুচকা তুলে মুখে দিতেই কান থেকে ধোঁয়া উঠতে শুরু করেছে। চোখের কোনে পানি এসে ভীড় করেছে। কিঞ্চিৎ হা করে ঝাল কমানোর চেষ্টা করলাম। আশেপাশে পানি পাওয়ার মতো দোকান চোখে পড়ল না। রাস্তার ওপাশে একটা চায়ের দোকান চোখে পড়ল। দ্রুত গতিতে ফুচকার প্লেট শেষ করতে লাগলাম। শেষ ফুচকাটা মুখে দিতেই চোখ থেকে আপনাআপনি পানি গড়িয়ে পড়ল‌। চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করেছি। আমি মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম চেয়ারে। ঝাপসা চোখে বিল মিটিয়ে রিকশা ডেকে বাড়ির পথে রওনা হলাম।

চোখের পাতা উন্মুক্ত করতেই মাকে দেখলাম শিউরে বসে আছে। ক্লান্ত দৃষ্টিতে আশেপাশে চেয়ে অনুধাবন করলাম, আমি তো রিকশায় বসে ছিলাম। বাড়িতে এলাম কীভাবে? মাকে আস্তে ধাক্কা দিতেই সে ফিরে চাইল। তীক্ষ্ণ সেই দৃষ্টি। আমাকে বুকে আগলে নিয়ে বলল, “তুই ঠিক আছিস মা? কী হয়েছিল তোর?”

“কি হয়েছিল আমি ঠিক জানি না মা। শুধু এইটুকু মনে আছে, মাথাটা একটু ঘুরে গিয়েছিল। তোমরা রিকশা ওয়ালা মামার ভাড়া দিয়েছ তো?”

“হ্যাঁ। দিয়েছি। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তুই আমাদের সাথে মিথ্যা বলছিস। এমনি এমনি কখনো তুই অজ্ঞান হোসনি। সত্যি করে বল, কী করেছিস।”

আমি আমতা-আমতা করে বললাম, “ফুচকা খেয়েছিলাম একটু ঝাল দিয়ে।”

মাথা তুললাম না। ঝাল খাওয়া আমার জন্য দুঃস্বপ্নের মতো। মা রেগে বলল, “বাঁচতে চাস নাকি ম/রতে চাস? তোকে ডাক্তার কতদিন বলেছে, ঝাল খাবি না। তবুও খাচ্ছিস। তুই আসলে কী চাস?”

“ঝাল ছাড়া কিছু ভালো লাগে নাকি?”

আমার কথায় মা কেঁদে ফেলল। আমি মায়ের চোখের পানি মুছে দিলাম। তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “সরি। আর খাবো না।”

“তুই তো প্রতিবার খাস আর বলিস খাব না।” মায়ের অভিমানী গলায় আমি নেতিয়ে গেলাম। আপুর এর মধ্যে খাবার সাজিয়ে নিয়ে এলো। আমি দুহাতের দিকে চেয়ে বললাম, “আমার শরীরের অবস্থা দেখেছ? একটু ফ্রেশ হয়ে আসি।”

মা সায় দিলেন আমার কথায়। কাবার্ড থেকে টি শার্ট আর প্ল্যাজু বের করে ওয়াশ রুমে ঢুকলাম। পানির স্পর্শ লাগলে দেহে অপনোদন অনুভব হচ্ছে। আমি বাথটাব পানিতে পূর্ণ করে শুয়ে রইলাম। কী শান্তি লাগছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজায় নক করে মা। উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “ভরসন্ধ্যায় আর ভিজিস না। ঠান্ডা লেগে যাবে!”

ভরসন্ধ্যার কথা শুনে চমকিত হলাম আমি। আমি ভার্সিটি থেকে বারোটা নাগাদ রওনা দিয়েছি। এতক্ষণ অজ্ঞান ছিলাম ভাবতে গলা শুকিয়ে গেল।
মিনিট পাঁচেকের মাথায় বেরিয়ে এলাম ওয়াশ রুম থেকে। খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরে আকাশে তাকিয়ে সন্ধ্যার আকাশ দেখলাম। নিরাশ হয়ে ঘরে ফিরে ফোনটা তুলতেই দেখলাম ‘ঋতুর’ নাম্বার থেকে তুমুল মিসড্ কল। ফোনটা সাইলেন্ট মুডে রয়েছে। চুল ঝেড়ে বললাম, “তোমরা ফোনটা সাইলেন্ট করেছ কেন? আমার ভার্সিটিতে যেতে হবে। ঋতু অনেকবার কল করেছে।”

আপু বিদ্রুপ করে বলল, বারবার কল করছিল তাই কেটে দিয়েছি। তাছাড়া এই শরীর নিয়ে অনুষ্ঠানে গেলে ফিরে আসতে পারবি?”

আপুর কথায় সায় দিয়ে বিছানায় বসে ঋতুর নাম্বারে ডায়াল করলাম। মা ইতোমধ্যে লোকমা করে মুখে তুলে দিলেন। আমার কল পেয়ে তৎক্ষণাৎ রিসিভ করল ঋতু। উত্তেজিত হয়ে বলল, “ঠিক আছিস তুই? কতবার কল করেছি তোকে?”

খাবার চিবুতে চিবুতে আবছা গলায় বললাম, “আরে শরীরটা ভালো নেই। ভার্সিটি থেকে ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তোরা কোথায়?”

“আমরা ফাংশানে, তুই কোথায়?”

“সন্ধ্যায় লাঞ্চ করছি।”

“তুই আসবি না?”

“না-রে। এই অসুস্থ শরীর নিয়ে যাব না। মার্ক কা/টে কা/টুক।”

আমার কথা শুনে দম দিয়ে গেল ঋতু। অতঃপর করুন গলায় বলল, “দোস্ত তুই আসবি এই আশায় তোর নাম লিখে বক্সে জমা করে দিয়েছি। এবার যদি চিরকুটে তোর নাম উঠে আর তুই যদি উপস্থিত না থাকিস, তবে সিসিটিভি ফুটেজে আমার নাম দেখে নির্ঘাত টিসি ধরিয়ে দিবে। প্লীজ আয়।”

“আমি অনেক অসুস্থ দোস্ত। তুই চিন্তা করিস না, আমার নাম উঠবে না। যদি উঠেও যায়, তুই স্টেজে চলে যাস। আমার হয়ে কোনো একটাতে অংশগ্রহণ করিস। সবাই নিশ্চয়ই তোর নাম জানে না।” বলেই ফোন রেখে দিলাম। মন ভরে খাবার খেয়ে ঔষধ সেবন করলাম। মা ও আপু চলে গেল। আমি কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে ফোন নিলাম। ইন্টারনেট কানেকশন অন করতেই কয়েকটা মেসেজ এলো সেই নামহীন আইডি থেকে।

‘তুমি কোথায় আছ? আজকে কী আসবে না? অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল প্রায়।’

আমি হালকা হেসে রিপ্লাই করলাম, ‘শরীরটা ভালো নেই। এলার্জি জনিত সমস্যায় দীর্ঘক্ষণ চেতনা হীন ছিলাম। এই শরীর নিয়ে এতটা পথ গিয়ে ফিরে আসা সম্ভব নয়।’

সঙ্গে সঙ্গে বার্তা এলো, ‘আমি আছি তো। তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।’

‘না। আমি যাচ্ছি না। গুড নাইট।’ বার্তা পাঠিয়ে ফোনটা সাইলেন্ট করে বালিশের পাশে রেখে চোখ গ্ৰথন করলাম। সবে চোখের পাতায় ঘুম ধরা দিল, ঠিক তখনই কেউ ডেকে উঠল। চোখ মেলে দেখলাম আপু ও মায়ের পাশে বাহারাজ দাঁড়িয়ে আছে। ভূত দেখার মতো চমকে উঠে বললাম, “একি আপনি এখানে কেন?”

মা বলল, “বাহারাজ তোকে নিতে এসেছে। উঠ।”

চলবে.. ইন শা আল্লাহ