#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:১৫
#Lutful_Mehijabin (লেখা)
[কপি করা নিষিদ্ধ]
সমুদ্র ক্লাসে প্রবেশ করতেই সর্বপ্রথম তার দৃষ্টি পড়ল মেহেরের উপর। সঙ্গে সঙ্গে তার শরীর রাগে গিরগির করে উঠল। আকস্মিক দাঁতে দাঁত চেপে ধমকের স্বরে চিৎকার করে বলে উঠল,
–মেহের, তিতাস, দিশানি স্টান্ড আপ! পুরো ক্লাস তোমরা তিনজন কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে।
মেহের, তিতাস, দিশানি সমুদ্রের কথামতোন দাঁড়িয়ে পড়ল। সমুদ্রের সামনে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, ভেবেই মেহেরের গাল দুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করে উঠল। কেন সমুদ্র তাকে কান ধরে দাঁড়াতে বলল তা মেহেরের ছোট মস্তিষ্কে বোধগম্য হলো না। মেহের বিব্রত মাখা মুখশ্রী নিয়ে নতজানু হয়ে রইল। সমুদ্রের দিকে দৃষ্টি দেবার মতো সাহস তার হৃদয়মনে হয়ে উঠল না। তৎক্ষণাৎ মেহেরের কর্ণপাত হলো সমুদ্রের আওয়াজ।
–এইটা যে ক্লাস রুম তা কী তোমরা ভুলে গিয়েছ! এখানে কী তোমরা পড়তে এসেছ নাকি আড্ডা দিতে এসেছ, স্টুপিড্স?
সমুদ্র বলা কথাগুলো কর্ণপাত হতেই মেহেরের ভ্রূ যুগল কুঁচকে এলো। সে তো কথা বলেনি। তাহলে কেন বিনা অপরাধে সমুদ্র তাকে শাস্তি দিচ্ছে! দিশানি, মেহের চুপচাপ জড়তা নিয়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে রইল। কোন কথা মুখ দিয়ে নির্গত করে নি তারা দুজন। শুধু মাত্র তিতাস সমুদ্রকে ‘সরি’ বলেছে। পরিশেষে সমুদ্র তাদেরকে শাস্তিরত অবস্থায় রেখে ক্লাস নিতে আরম্ভ করল।
______________
সমুদ্রের ক্লাস সমাপ্ত হয়েছে খানিক পূর্বে। পুরো ক্লাস সে গম্ভীর মুখ করে ছিল। মেহেরকে দেখে এমন ভাব করেছিল যে সে মেহেরকে চিনেই না। বিষয়টা মেহেরের মনকে বিষণ্ণ করে তুলেছে। বর্তমানে শাস্তি হতে মুক্তি পেয়ে চুপচাপ বসে আছে সে। ক্লান্তি ফুটে উঠেছে দিশানির মুখশ্রীতে। কিন্তু তিতাসের কোন পরিবর্তন হয় নি। সে বইয়ের দিকে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে নিশ্চিন্তে বসে আছে। তাদের মধ্যে পিনপিন নিরবতা বিরাজমান। হঠাৎ নিরবতা ভেঙে দিশানি ক্লান্তি মাখা সুরে বলে উঠল,
–মেহের রে আমার পা আজকে শেষ। খারাপ স্যার কোথাকার। দেখিস এই স্যারের কপালে বউ যুটবে না।
দিশানির বিরক্ত মাখা কথা কর্ণপাত হতে মেহেরের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল। খানিকের জন্য পুলকিত হয়ে উঠল তার অন্তরাল। মুচকি হেসে উঠল সে। পুনরায় দিশানি হাল্কা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–না না বউ কেন যুটবে না। সরি ভুল হয়ে গেছে, দোয়া করি স্যারের কপালে যেন একটা শাতচুন্নি বউ যুটে। যে একটা একটা করে স্যারের চুল ছিঁড়বে। কবুল কবুল তিনবার কুবল। আর হ্যাঁ আল্লাহ গো স্যারের বউ যেন কালো কিচকিচে হয়। একটা কুৎসিত বউ যেন তার কপালে যুটে।
দিশানির সম্পূর্ণ কথা শুনে তিতাস অট্টসরে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলতে লাগল,
–ওই স্যারের বউ তোর কী করছে? স্যারের বউকে নিয়ে তোর এত মাথাব্যাথা কেন, হুম? স্যারের বউকে যে এতক্ষণ আজেবাজে কথা বললি। ঠিক এমন করে স্যারের বউয়ের সামনে বলতে পারবি তো!
দিশানি এবং তিতাসের কথোপকথন শুনে মেহের স্তম্ভিত হয়ে পড়ল। তার ঠোঁট যুগল আপনা আপনি কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে উঠল। একরাশ বিব্রতা, দ্বিধা, সংশয়ের উদ্ভাবন ঘটল তার হৃদয় গহীনে। বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। ওয়াশরুমে যাওয়া উদ্দেশ্য বেন্চ হতে বের হওয়ার জন্য ধাবিত হলো। মুহূর্তে আচমকা দিশানি মেহেরের হাত খপ্প ধরে বলে উঠল,
–মেহের তোর হাতে বেন্ডেজ করা কেন? কি হয়েছে তোর হাতে?
মেহের তৎক্ষণাৎ হাতের দিকে একপলক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল, দিশানির মুখশ্রীতে চোখ যুগল আবদ্ধ করে নিম্ন সুরে বলে উঠল,
–কিছু হয়। সামান্য ছুরির আঘাতে হাত কেটে গেছে।
দিশানি ভ্রূ যুগল কুঁচকে মেহেরের দিকে তাকাল। মেহেরের কথা তিতাসের কর্ণপাত হতেই, সে শক্ত দৃষ্টিপাত নিবন্ধ করল মেহেরের চোখ যুগলে। স্বল্প রাগী কন্ঠস্বরে বলে উঠল,
–এই মেয়ে তুই নিজের খেয়াল রাখতে পারিস না? আশ্চর্য ! কী এমন কর্ম করতে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিস?
তিতাসের শাসন মাখা বাক্যগুলো শুনে মেহেরের নয়নে অশ্রু এসে আশ্রয় নিল। তার হৃদয়ে একরাশ ভালোলাগার অনুভূতি বইয়ে গেল। কোনদিনও এভাবে এতোটা আদর, অধিকার কেউ তার উপর দেখাই নি। একেই বুঝি ভাইয়ের আদায় মাখা তিক্ত শাসন বলে! এই পরিস্থিতিতে মেহের নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি মনে করছে। কে বলছে তার ভাই নেই। তিতাসের ন্যায় ভাই পাওয়া সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার। সে তিতাসের কাছ হতে হাত কাটার আসল ঘটনা এড়িয়ে গেল। বলল না সত্যি কথা। কারণ বললে তো তারা জেনে যেত সমুদ্র তার স্বামী।
______________
ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য মেহের ক্লাস রুম হতে প্রস্থান করার উদ্দেশ্যে ধীর পদে ধাবিত হলো। দিশানি আর তিতাস মেহেরকে রেখে কিছুক্ষণ পূর্বে ক্লাস থেকে বের হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার তাই হাফ ক্লাস। তাই মেহের এখন ওয়াশরুম যাবে তারপর সমুদ্রের অপেক্ষায় ক্লাসের ভেতর বসে থাকবে। মুহূর্তে দিশানির উল্টো পাল্টে বাক্যগুলো তার মনে হলো। তখন খানিকটা বিরক্ত হলেও এখন কথাগুলো মনে পড়তেই প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে তার। মুচকি মুচকি হেসে নতজানু হয়ে ধীর পায়ে হাটতে লাগল সে। হঠাৎ হাতে হাল্কা টান অনুভব করতেই তার পা যুগল থেমে গেল। নত দৃষ্টি সরিয়ে সামনের দিকে দৃষ্টিপাত ফেলল সে। আদিবা নামের মেয়েটা মেহেরের হাত ধরে বলে উঠল,
–এই মেয়ে আমার কলমটা উঠিয়ে দেও।
মেহের উন্মুক্ত নয়নে পর্যবেক্ষণ করল আদিবাকে। পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে ক্লাস রুম হতে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মেহের কিছুটা বিরক্ত হলেও আদিবার কথামতো কলমটা উঠিয়ে দিল। অতঃপর আদিবা সহ তার কয়েকজন ক্লাসমেট অট্টসরে হেসে উঠল। মেয়েটাকে দিয়ে তাদের হুকুম পালন করাতে পেরে তারা খুব খুশি। এককথাই মেহেরকে উপেক্ষা করার জন্যই তারা এই পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। সবকিছু বুঝেও অবুঝের ন্যায় মেহের মুচকি হেসে, বই ভর্তি ব্যাগ হাতে নিয়ে ক্লাসরুম হতে বেরিয়ে এলো।
_______
পড়ন্ত বিকেল। চারপাশে সূর্যের লালভ আলোকচ্ছটা কিরণ দিচ্ছে। পরিবেশ স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। আকাশ পানে দৃষ্টি মেললেই, আল্লাহ সৃষ্টি প্রকৃতির সিন্ধতায় মন গহীন তৃপ্ত হয়ে উঠবে। প্রকৃতির যেন জাঁমজমক রুপে সেঁজে উঠেছে। আহা! কতোই না সুন্দর এই প্রকৃতির সুমধুর সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্যেল প্রেমে পড়েতে যে কোন মানুষ বাধ্য। গাড়ির জানালা দিয়ে দৃষ্টি ভেদ করে স্বচ্ছ আকাশের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে মেহের। কিন্তু আজ ভিন্ন দিনগুলোর মতো প্রকৃতির প্রতি প্রেম সৃষ্টি হচ্ছে না। এই সুন্দর প্রকৃতিকেও তার বিরক্ত লাগছে। সবকিছু তার নিকট বিষাদময় লাগছে। তার সামনে সমুদ্র বসে মনোযোগ সহকারে গাড়ি ড্রাইভ করছে। মেজাজ তার অতিরিক্ত তিক্ত। মেহেরের উপর প্রচন্ড খেপে আছে সে। সমুদ্রের ক্রোধের কারণ মেহেরের নিকট অজানা। কোন এক কারণে সমুদ্র দাঁত দাঁত চেপে চোয়াল শক্ত করে ড্রাইভ করছে। এতে অত্যধিক বিরক্তি আষ্টেপৃষ্টে ধরে রয়েছে মেহেরের অন্তরালে। স্কুল ছুটির পর একটিবারের জন্যই মেহের সমুদ্রের আওয়াজ শুনতে পাইনি। মূহুর্তেই এপার্টমেন্টের সামনে এসে গাড়ি থামাল সমুদ্র। মেহেরকে না নিয়েই সে গটগট করে লিফ্টে উঠে পড়ল। আজ সত্যিই সমুদ্রের আচরণ অস্বাভাবিক লাগলে মেহেরের নিকট। সমুদ্রের খিটখিটে মেজাজের ধমক আজকে তার কপালে যুটেনি। সমুদ্রের এমন অদ্ভুত ব্যবহার তাকে প্রচন্ড রূপে ব্যথিত করে তুলছে। সমুদ্রে কেন বুঝে না, ছোট মেয়েটির হৃদয় যে মেঘের ন্যায় বিষাদ জমে অগুনিত।
________
বাসায় এসেই মেহের ওয়াশরুমে ঢুকেছে। প্রায় আধ ঘণ্টা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে সে। তিনদিন হলো তার শরীরের জলের ছিটে ফোটা ও পড়ে না। মাত্র শাওয়ার নিয়ে ফ্যান হাল্কা স্ফিডে অন করে টাওয়ায় দিয়ে চুল মুছতে আরম্ভ করল মেহের। এই শীতেও তার উষ্ণ পোশাক পড়ে নি সে। শুধু মাত্র হোয়াইট রংয়ের থ্রি পিস পড়ে রয়েছে। শীতল বাতাসে তার অবাধ্য আগলা চুল গুলো ইচ্ছেমতো উড়ছে। শীতল পরিবেশ হওয়ার ফলে খানিক পর পর কেঁপে উঠছে সে।
মেহেরের উপর শতাধিক ক্রোধ নিয়ে, মেহেরের রুমে যাওয়া জন্য দ্রুত পায়ে হেঁটে চলছে সমুদ্র। অত্যধিক রাগ হচ্ছে তার। মেয়েটার সাহস হয় কী করে, ছেলেদের গায়ে পড়ে ঢলাঢলি করার? বিষয়টা না চাইতেই সমুদ্রের মস্তিষ্কে চেপে বসেছে। সে চাইতেও নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে ব্যর্থ। অবশেষে ফ্রেশ হয়ে এসেই মেহেরকে ইচ্ছা মতো বকা দেওয়া প্রস্তুতি নিয়েছে সে।
তৎক্ষণাৎ মেহের রুমে এসে উপস্থিত হলো সমুদ্র। অগ্নি দৃষ্টি তার। ক্রোধের বশে তার নয়ন যুগল হতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। ইতিমধ্যেই রাগে মোবাইল ফোন সজোরে ফেলে দিয়েছে সে। এতো রাগ হয়তো তার এই জীবনে হয়ছে কি সন্দেহ ! রুমে ঢুকেই সর্বপ্রথম সমুদ্রের দৃষ্টিপাত পড়ল মেহেরের উপর। সাদা ড্রেস পরিহিত অবস্থায় মেয়েটা পিছন ফিরে চুল আচড়াতে ব্যস্ত। এই প্রথম মেহেরকে মাথায় ঘোমটা দেওয়া ব্যতীত অবস্থায় দেখল সমুদ্র। মেয়েটা তাকে দেখলেই অতি দ্রুত ওড়না টেনে ঘোমটা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এর আগেও একবার মেহেরকে আগলা চুলে দেখেছিল সে। কিন্তু সেদিন ভালো মতো লক্ষ্য করে নি। মেহের যে এতো পুঁচকি হওয়ার সত্বেও অতিরিক্ত বড় চুল বিদ্যমান তা সমুদ্রের নিকট অত্যধিক বিষ্ময়কর লাগছে! সমুদ্র অগ্নি দৃষ্টিতে খানিকটা সময় মনোযোগ সহকারে মেহেরকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। আকস্মিক সমুদ্রের অচন্চল চোখ যুলগ স্থির হয়ে পড়ল মেহেরের ওড়নার ফাঁকের অনাবৃত শুভ্র স্বচ্ছ গলার উপর। মেয়েটা এলোমেলো করে ওড়না পড়ে রয়েছে! মুহূর্তেই সমুদ্রের বুকের ভেতর খানিকটা ধ্বক করে উঠল,,
(চলবে)
#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:১৬
#Lutful_Mehijabin (লেখা)
[কপি করা নিষিদ্ধ]
মেহের যে এতো পুঁচকি হওয়ার সত্বেও তার অতিরিক্ত বড় চুল বিদ্যমান তা সমুদ্রের নিকট অত্যধিক বিষ্ময়কর লাগছে! সমুদ্র অগ্নি দৃষ্টিতে খানিকটা সময় মনোযোগ সহকারে মেহেরকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। আকস্মিক সমুদ্রের অচন্চল চোখ যুলগ স্থির হয়ে পড়ল মেহেরের ওড়নার ফাঁকের অনাবৃত শুভ্র স্বচ্ছ গলার উপর। মেয়েটা এলোমেলো করে ওড়না পড়ে রয়েছে! মুহূর্তেই সমুদ্রের বুকের ভেতর খানিকটা ধ্বক করে উঠল।মেহেরের সাদা ফর্সা গলার বাম পাশে বৃত্তাকার আকারে বাজে ভাবে ক্ষত হয়ে রয়েছে। তৎক্ষণাৎ মেহের ঘুরে সমুদ্রের দিকে দৃষ্টিপাত ফেলল। সমুদ্রের উপস্থিতি মটেও আশা করেনি মেহের। খানিকটা বিচলিত হয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে সে নিজের অনাবৃত ফর্সা গলা আঁচল দিয়ে আবৃত করে ফেলল। নিত্যদিনের ন্যায় নিজের সীমান্ত পর্যন্ত ঘোমটা টেনে নতজানু হয়ে দাঁড়ায়ে পড়ল সমুদ্রের সামনে। কিঞ্চিৎ ইতস্তত কন্ঠে নিম্ন স্বরে বলে উঠল,
–কিছু লাগবে আপনার?
মেহেরের কন্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই সমুদ্র অল্প অপ্রতিভ হয়ে পড়ল। কারণ তখনও তার দৃষ্টিপাত মেহেরের গলাতে নিবন্ধ ছিল। তৎক্ষণাৎ সমুদ্র দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল। মেহেরকে বকার পরিকল্পনা করে সমুদ্র এসেছে ঠিকি কিন্তু বর্তমানে তার রাগে বাতাসে মিশে গিয়েছে। অদ্ভুত তার মনেও ঠাই নিয়েছে অস্বস্তি, অশান্ততা এবং অস্থিরতা। অতঃপর সমুদ্র নিজের কপাল কুঁচকে মেহেরের মুখশ্রী হতে ভিন্ন দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। কন্ঠে গম্ভীরতা এনে বলে উঠল,
–তোমার কী কোন কাপড় অথবা কোন কিছুর প্রয়োজন আছে?
মেহের বুঝে উঠতে পারল না হঠাৎ এ কথা কেন সমুদ্র তাকে জিজ্ঞেস করল। ইতস্তত হয়ে বোকার মতোন বলে উঠল,
–আমার তো কিছু দরকার নেই। কেন?
সমুদ্র মেহেরের কথার প্রত্যুত্তরে তিক্ত কন্ঠে বলল,
–দু একদিনের মধ্যে তোমাকে তোমার বাড়িতে দিয়ে আসব। তাই বললাম যদি কোন জিনিস পত্রের দরকার হয় তাহলে আমাকে বল। আমি কিনে দিব। আফ্টারল আমার ও তো কিছু দায়িত্ব আছে। তাছাড়া এখন থেকে তোমার সব খরচ আমি বহন করব।
সমুদ্রের বলা কথাগুলো শুনে মেহেরের অজান্তেই বুকের ভেতরে অস্থিরতার আবির্ভাব ঘটল। অন্তরাল ফেঁটে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে উঠল। তাকে চলে যেতে হবে সমুদ্রের কাছ থেকে। বিদায় নিতে হবে দিশানি, তিতাসদের মধ্য হতে। আসলে কী মেহেরের কোথাও আশ্রয় পাওয়া মতোন জায়গা নেই!
মেহের নিরবতা পালন করল। সমুদ্র পুনরায় কঠিন সুরে বলে উঠল,
— ব্যাগ গুছিয়ে রেখো। আমি সময় পেলেই তোমাকে দিয়ে আসব। আপাতত আমি একটু বিজি আছি। তাই দু এক দিন পর তোমাকে তোমার আসল গন্তব্যে পৌঁছে দিব।
কথাগুলো একেবারে শেষ করে পরাপর দুটো স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করল সমুদ্র। রুম হতে বের হওয়ার উদ্দেশ্য ধীর পদে কিছুদূর হাঁটতে পুনরায় থেমে গেল সে। ঠোঁট যুগল জিহ্বা দ্বারা ভিজিয়ে নিয়ে শান্ত সুরে মেহেরকে বলল,
–আর হ্যাঁ, আমি এখন বাইরে যাচ্ছি। তোমার খাবার ফ্রিজে রাখা আছে। আমার আসতে লেইট হবে। আজকে রাতে না ও ফিরতে পারি। সো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়। যদি দরকার হয় তাহলে আমার ড্রয়ারে ফোন আছে কল কর। কিন্তু বিনা কারনে আমাকে কল করে ডিস্টাব করবে না। আই হোপ ইউ আর আন্ডারস্ট্যান্ড!
বাক্যটা বলে কথার সমাপ্তি ঘটাল সমুদ্র। আঙুলের ডগাগুলি কপালে স্পর্শ করতে করতে বেরিয়ে এলো মেহেরের রুম হতে। মেহেরের কোন বক্তব্য শোনার প্রয়োজন বোধ করল না। বারংবারের ন্যায় মেহেরকে উপেক্ষা করে নিজের রুমে চলে এলো। ডাগর ডাগর চোখে পলকহীন চোখে স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রয়েছে মেহের। সমুদ্র থেকে তাকে দূরে চলে যেতে হবে ভাবলেই তার বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে। চিৎকার করে ধরণীর বুকে নিজের দুঃখ কষ্ট বিসর্জন দিতে ইচ্ছে জাগছে। ইচ্ছে করছে গলা ফাটিয়ে কান্না করতে। মুহূর্তেই হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল শীতল শুভ্র ফ্লোরে। আশ্চর্যের বিষয় এতো কষ্টেও তার কান্না পাচ্ছে না। শুধু নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মেহেরের মস্তিষ্ক বলে উঠছে আজ বুঝি বাতাসের অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গিয়েছে। নিশ্বাস নিতে এতোটা কষ্ট হচ্ছে যে তার হৃদয় স্পন্দন ছুটে চলছে দ্রুত বেগে। বুকের বা পাশে প্রচন্ড ব্যথা করছে। তার হৃদয়মনে অস্থিরতা তীব্র হতে তীব্রতর হয়ে উঠছে। এ যেন অদ্ভুত ব্যথিত বাজে অনুভূতি। এই বাজে অনুভূতি ধীরে ধীরে মেহেরের হৃদয় গ্রাস করে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মেহের সহ্য করতে পারছে না। সে মনে মনে প্রার্থনা করছে এই অনুভূতিটা যেন তার বদ্ধ মায়াজাল হতে তাকে মুক্তি দেয়। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে তার। কিন্তু সে বুঝতে পারছে এতো কষ্ট কেন হচ্ছে? হাল্কা কাঁপুনি ধরেছে তার শরীররে। এতো শীতের কাঁপুনি নয়! মেহের ড্রেসিং টেবল ধরে উঠে দাঁড়াল। ধীর পায়ে উঠে পড়ল বিছানার উপর। চোখ যুগল বন্ধ করে উষ্ণ চাদরে আবৃত করে নিল নিজেকে। দু হাত মুটো করে শক্ত করে চেপে ধরে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগল। বারংবার শুকনো ঢোক গিলতে লাগল। চোখ যুগল খিচে বন্ধ করে সমুদ্রের কথা ভাবতে লাগল।
________
নানান রকমের খাবার রান্না করেছে জারা। ইয়াদ আজকে তাকে দিয়ে অনেক গুলো খাবারের আইটেম রান্না করিয়াছে। অত্যধিক পরিমাণে ক্লান্ত সে। মাত্র বিছানাতে ক্লান্তিমাখা শরীর এলিয়ে দিয়েছিল। ঠিক তখনি ইয়াদের আওয়াজে কর্ণপাত হলো তার। অবশেষে নিরুপায় হয়ে বিছানা হতে উঠে পড়ল সে। কুণ্ঠিত পদে উপস্থিত হলো ড্রইং রুমে। সঙ্গে সঙ্গে জারা সামনের দিকে বিষ্ময়ে উন্মুক্ত নয়নের তাকিয়ে রইলো। একরাশ সংকোচের আবির্ভাব ঘটেছে তার মুখশ্রীতে। আকস্মিক শাশুড়ি মায়ের উপস্থিতি দেখে জারা প্রচন্ড অবাক হয়ে পড়েছে। তার চেয়ে বড় কথা শাশুড়ির সঙ্গে উপস্থিত যুবকে দেখে সে যেন আবাকের চরম পর্যায়ে! তারমানে এতোদিন যাকে খুঁজে এসেছে সেই লোকটা ইয়াদের পরিবারের কেউ একজন!
জারার উদ্ভ্রান্ত চাউনি দেখে ইয়াদ ভ্রূ যুগল কুঁচকে ফেলল। জারার দিকে একপলক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার ফুপাত ভাই রাফুর দিকে তাকাল। তৎক্ষণাৎ রাফূ এক গাল হেসে দিয়ে জারাকে বলে উঠল,
–জারা! ওয়াও তারমানে তুমিই আমার ভাবি? কেমন আছো?
রাফুর কথা শুনে জারা মুচকে হেসে বলে উঠল,
–এইতো ভালো । আপনি কেমন আছেন ভাইয়া?
–সবসময় ভালো থাকি এখনও অনেক ভালো আছি। তোমাদের বিয়ের সময় আমি বিদেশে ছিলাম তাই এটেন্ড করতে পারি নি। তা তোমাদের কী লাভ মেরেজ?
রাফুর কথাগুলো শুনে জারা এবার অতিমাত্রায় বিব্রত হয়ে পড়ল। কথাটা এড়িয়ে যেতে হেসে দিয়ে বলল,
–ভাইয়া আপনারা তো অনেক দূর থেকে এসেছেন। এখন বরং রেস্ট নিন। পরে নাহয় কথা হবে।
বলেই জারা তার শাশুড়ির মাকে একবার জড়িয়ে ধরল। অতঃপর শাশুড়ি মাকে নিয়ে নিজের রুমে চলে এলো।
জারা ড্রইং রুম ত্যাগ করার পরেই ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠল রাফু। ইয়াদের গম্ভীর মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে হাসতে হাসতে বলে উঠল,
–দেখ ভাই তোর বউ লজ্জা পেয়েছে !
ইয়াদের মুখশ্রীতে গম্ভীর ভাবটা বজায় রেখে, রাফুকে বলে উঠল,
–এসব বাদ দে। খবর কী তোর।
–বললাম তো অনেক ভালো আছি। তোদের কি খবর। ভবিষ্যতের কী প্লেন করেছিস? আর আমাকে আরজেন্ট মামিকে নিয়ে আসতে বললি কেন?
ইয়াদ খানিকটা বিরক্তি মাখা কন্ঠে বলল,
–আমাকে কয়েক দিন পর ট্রেনিং এ যেতে হবে। তাই তোকে মাকে নিয়ে আসতে বলেছি। জারা বাসায় একা থাকবে তা আমি চাই না।
ইয়াদের কথা শুনে রাফুর চোখ যুগল ছোট্ট করে ফেলল। ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসির রেখা টেনে উপহাস করে বলে উঠল,
–ওয়াও, হাউ রোমান্টিক! তুই তো আসল হিরো।
রাফুর কথা শুনে ইয়াদ এক মূহুর্তের জন্যেও ড্রইং রুমে দাঁড়াল না। দাঁতে দাঁত চেপে বিররির করতে করতে নিজের রুমের দিকে ধাবিত হলো।
_______________
মাথা নিচু করে নতজানু হয়ে বসে আছে সমুদ্র। তার পাশে থতমত মুখশ্রী নিয়ে বসে আছে আকাশ। তাদের মধ্যে একরাশ ব্যর্থতা ফুটে উঠেছে। পিনপন নিরবতা বিরাজ করছে তাদের মধ্যে। তাদের সামনে অতি নিকটে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছেন এসিপি শোয়াইব খান। হঠাৎ নিরবতা ভেঙে শোয়াইব খান সমুদ্রের দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করে কিঞ্চিৎ ভর্ৎসনা কন্ঠে বলে উঠলেন,
–সমুদ্র, তুমি এতো কেয়ারলেস কী করে হলে? আকাশকে দিয়ে আমি যতটুকু সাহস না পাই তার চেয়ে তোমাকে দিয়ে আমি নিশ্চিতে থাকি। আর তুমি কী না বিষয়টা লক্ষ্যে রাখলে না!
সমুদ্র নত দৃষ্টি সরিয়ে এসিপির দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করে বলে উঠল,
–সরি স্যার।
এসিপি পুনরায় গম্ভীর কন্ঠস্বরে বলে উঠলেন,
— অনেক বিশ্বাস করে তোমাকে কেসটা দিয়েছি। আমার অন্ধ বিশ্বাস ছিল একমাসের মধ্যে তুমি কেসটা সল্ভ করে ফেলবে।
সমুদ্র এবার অনুরোধ কন্ঠে বলল,
–স্যার আর কয়েকটা দিন সময় দিন। আমি বুঝতে পারি নি সকিনা আন্টির হাসবেন্টের খুনের পিছনে এই কেসটার সম্পর্ক থাকবে।
সমুদ্রের কথা প্রেক্ষিতে আকাশ নিম্ন স্বরে বলে উঠল,
–সরি স্যার। আমিও বিষয়টা আন্দাজ করতে পারি নি। কেসটা যে ধীরে ধীরে জটিল হয়ে পড়েছে।
এসিপি সমুদ্রের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠল,
–আমার তোমার প্রতি বিশ্বাস আছে সমুদ্র। কিন্তু কেসটা আমাদের সাথে জড়িত তাই আমার রাগ হয়েছে তোমার উপর। যাইহোক আই আন্ডারট্যাস্ট ইউ।
এসিপির কথা শুনে আকাশ এবং সমুদ্রের মুখশ্রীতে একরাশ খুশীর ঝলক দেখা দিল। সমুদ্র বলে উঠল,
–ধন্যবাদ স্যার।
এসিপি সমুদ্রে কাঁধে হাত রেখে মুচকি হেসে বলে উঠল,
–তা শুনলাম তুমি নাকি বিয়ে করেছ?
এসিপির কথা কর্ণপাত হতেই সমুদ্র স্তম্ভিত হয়ে গেল। থতমত মুখ করে আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল। আকাশ ফ্যালফ্যাল করে সমুদ্রের চোখ যুগল দৃষ্টি আবদ্ধ রেখে চোখের ইশারাতে বলল, ‘আমি বলি না’।
সমুদ্র আর আকাশের মুখের অবস্থা দেখে অট্টসরে হেসে উঠল এসিপি। হাসিমাখা কন্ঠে স্বরে বলে উঠল,
–আরে বাবা ভয় পেলে কেন? আমি তো মজা করছিলাম। সমুদ্র আমার একটা বিষয় নিয়ে তোমার সাথে আলোচনা করার ছিল। আমি ডিরেক্ট কথা বলতে পছন্দ করি। আমি তোমার জন্য একটা মেয়ে পছন্দ করেছি। সমস্যা নেই তো?
এসিপির কথা শুনে সমুদ্রের চেয়ে আকাশ বেশি অবাক হয়ে গেলো। সমুদ্রের কী বলে তা শোনার জন্যে তার মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে রইল। এসিপির কথার প্রত্যুত্তরে সমুদ্র বিব্রত মাখা কন্ঠে বলে উঠল,
–না স্যার। কিন্তু আপাতত থাক।
সমুদ্রের নেগেটিভ উত্তর পেয়ে আকাশ বিরক্ত হয়ে উঠল। নিজের চুল টানতে টানতে এসিপির রুম থেকে বিদায় নিল সে।
____________________
ঘরির কাটাতে রাত দুটো ছুঁইছুঁই। উষ্ণ চাদর গায়ে জড়িয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মেহের। মধ্যরাত পর্যন্ত সে জেগেছিল সমুদ্রের উপেক্ষয়। সমুদ্র বলেছিল সে রাতে ফিরবে কিন্তু সে ফিরেনি। অবশেষে কিছুক্ষণ পূর্বে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। হঠাৎ ঘুমের মাঝে অস্বস্তি অনুভব হলো তার। স্বল্প নড়েচড়ে উঠল সে। গলায় কারো উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে কেঁপে উঠল সে। তার অনুভব হলো কেউ তাকে গভীর,,,,,,
(চলবে)