#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:৩১
#lutful_mehijabin (লেখা)
[কপি করা নিষেধ]
তিতাসকে লক্ষ্য করা মাত্রই ড্রাইং রুম প্রস্থান কারার জন্য সোফা থেকে উঠে পড়ল মেহের। অতঃপর আয়ানকে কোলে নিয়ে লোক চক্ষুর আড়াল হতে দ্রুত পা বাড়াল সে। কিন্তু মেহের যায়গা থেকে উঠেই যেন বড় ভুল করল। বাবার সঙ্গে নিরবের আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছে তিতাস। তারা যে অহনার বাড়িতে যাচ্ছে তা আগে থেকেই অবগত ছিল তার। তিতাসের বাবা তার সঙ্গে তিতাসকে আনতে চায় নি। কিন্তু ছেলের জবরদস্তির সঙ্গে বিজয়ী হতে পারেন নি। অনিচ্ছাকৃত ভাবে তিতাসকে নিজের সাথে করে নিয়ে এসেছেন।
বাবার নিকটবর্তী মাত্র বসেছিল তিতাস। মুহূর্তেই মেহেরকে দৃশ্যমান হলো তার। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল ! তিতাস মূলত মেহেরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। তার উদ্দেশ্য হলো যে করেই হোক সেদিন সমুদ্র মেহের কে থাপ্পড় মারার পিছনে কি রহস্য তা উদঘাটন করা। কিন্তু বাবার চোখের সামনে থেকে আড়াল হতে হবে তাকে। তাই পিয়াস রহমানের দৃষ্টির অগোচরে যাবার জন্যে কারণ খুঁজতে লাগল তিতাস। অবশেষে মিনিট পাঁচেক চিন্তা ভাবনা করার পর বুদ্ধি হাজির তার মস্তিষ্কে। সঙ্গে সঙ্গে বাবার গায়ের সঙ্গে চেপে বসল। তার মুখশ্রী পিয়াস রহমানের কানের নিকটবর্তী নিয়ে এলো অতঃপর ঠোঁট জোড়া সংকুচিত করে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
–বাবা ওয়াশরুমে যাব। অনেক দরকার। আমি যাই? ইমার্জেন্সি !
ছেলের কথা শুনে খানিকটা বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠল পিয়াস রহমানের মুখশ্রী। তিতাসকে ভরসৎনা সহিত নিম্ন কন্ঠে বললেন,
–এমন দরকারই যখন ছিল তাহলে আমার সাথে কেন? বাসা থেকে আসলেই তো পারতি। কোথাও যেন ঘুরাঘুরি করতে না! সোজা ওয়াশরুমে যাবি তারপর চুপচাপ এখানে চলে আসবি। জলদি যা , বিয়াদপ।
বাবার অনুমতি পেয়ে পুলকিত হয়ে উঠল তিতাসের হৃদয় গহীন। ভদ্র ছেলের মতো মাথা নিচু করে পা যুগল ধাবিত করল মেহেরকে খোঁজতে। কিছুটা দূর এগিয়ে গিয়েও মেহেরকে দেখতে পেল না সে।
আয়ান কে নিয়ে অহনার শাশুড়ির রুমের দিকে যাচ্ছিল মেহের। তার ধারণা সেখানে হয়তো সেখানে কোলাহল পূর্ণ পরিবেশ লক্ষিত হবে না। গুরুজনের ঘর হওয়ার সুবাদে শান্ততা বিরাজ করছে! তাই লোক চক্ষুর ভিতরে দ্রুত পা চালাচ্ছিল মেহের। আর দৃঢ় মনে প্রার্থনা করেছিল যেন তিতাসের সম্মুখে তাকে না যেতে হয়। কারণ তিতাসের প্রশ্নের জবাব নেই তার নিকট। তিতাসের হাত থেকে বাঁচতে মরিয়া হয়ে উঠেছে তার অন্তরাল! পরক্ষণেই মেয়েলি কন্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই থমকে দাঁড়ায়ি পড়ল সে।
–এই পিচ্চি মেয়ে দাঁড়াও তো।
মেয়েটার আদেশ পেয়ে চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো মেহের। তৎক্ষণাৎ মেয়েটি তার নিকটবর্তী এসে জিজ্ঞাসা করল,
–তোমার কোলে কী নিরব চৌধুরীর ছেলে?
মেয়েটির কথা শুনে মাথা উঁচু করে একপকল তার মুখশ্রীতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল মেহের। ফির আনমনে শুকনো একটা ঢোক গিলল সে। মেয়েটি অত্যধিক ফিটনেসের অধিকারী। যেমন লম্বা ঠিক তেমনি চাওড়া। মেয়েটাকে লক্ষ্য করতেই মেহেরের মনে হলো , মেয়েটা নিশ্চয়ই মারামারি সঙ্গে অতোপতো জড়িত। নতুবা মেয়েটা এতোটা সুঠাম দেহের অধিকারী হলো কীভাবে ! পরনে ট্রি শার্ট এবং জিন্স প্যান্ট। এ ধরনের পোশাক বরাবরই মেহেরের অপছন্দে। ফলে মেয়েটার প্রতি মুগ্ধতার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হলো সে। উল্টো কিঞ্চিত ভয় আবির্ভাব ঘটল তার অন্তরালে। অবশেষে মেয়েটার প্রশ্নের উত্তর নিম্ন কন্ঠে বলে উঠলো,
–হুম।
মেয়েটা মেহেরের উত্তর পেয়ে মুচকি হেসে বলল,
–তোমার নাম কী ?
–মেহের।
মেহেরের সংক্ষিপ্ত জবাব পেয়ে মেয়েটা বলে উঠলো,
–এতো আস্তে আস্তে কথা বলছ যে, ভয় পাচ্ছ! দেখ পিচ্চি ভয়ের কিছু নেই। তুমি অনেক মিষ্টি একট পিচ্চি তাই তোমার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু তুমি তো ভয় পাচ্ছ,,,,,
মেয়েটি সম্পূর্ণ কথা সমাপ্তি কারার পূবে তার ফোন বেজে উঠল। তৎক্ষণাৎ মেয়েটা ফোন হাতে নিয়ে চুপসে গেল। ভয়ের আবির্ভাব ঘটল তার অন্তরালে। কপাল কুঁচকে বিরতির করে বলে উঠলো,
–ওহহ নো। সমুদ্র স্যারের কল!
কথাটা বলেই মেহেরের হতে খানিকটা দূরবর্তী স্থানে চলে গেল মেয়েটা। মেহেরের মনোযোগ মেয়েটার উপর না থাকা সত্ত্বেও সমুদ্র নামটা তার কর্ণকুহরে পৌঁছেতে সক্ষম হলো। মুহূর্তেই তার ভেতরটা ধক করে উঠলো। আশ্চর্যের বিষয় হলো, শুধু মাত্র সমুদ্র নামটা শুনলেই মেহেরের বক্ষ পিঞ্জরের হৃদয় স্পন্দন তড়িৎ বেগে বৃদ্ধি পেল। আয়ানকে শক্ত করে আগলে ধরে দ্রুত পায়ে গন্তব্যর উদ্যেশে হাঁটতে আরম্ভ করলো।
________________
অনাবৃত ছাদে মুক্ত পাখির ন্যায় পায়চারিতে বিভোর আকাশ। মাত্র রিয়া নামের একজন জুনিয়র সিআইডি অফিসর তার কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ পেইনড্রাইভ দিয়ে গিয়েছে। অতিরিক্ত চিন্তায় বিভোর হয়ে রয়েছে সে। ঠিক তার নিকটবর্তী নিশ্চুপ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে সমুদ্র। তার মুখশ্রীতে ভাববিলাশী ভাব স্পষ্ট! গম্ভীর মুখ করে অপলক দৃষ্টিতে আকাশ পানে তাকিয়ে রয়েছে সে। বারংবার তার কল্পনাতে ভেসে উঠছে মেহেরের মুখশ্রী। মূলত তারা তদন্ত করতে এসেছে নিরববে অনুষ্ঠানে। বিষয়টা নিরবের নিকট অজানা। নিরব একজন সফল ব্যাবসায়ী। সমুদ্রের সঙ্গ তার পূর্ব পরিচিতি থাকার সুবাদে সমুদ্রের পুরো টিমের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তার। অবশ্য নিরবের বাবা একজন সিআইডি অফিসর ছিলেন। তাই অনুষ্ঠানে সাদরে সমুদ্রের পুরো টিমকে ইনভাইট করেছে সে। কিন্তু সিক্রেট মিশনে সমুদ্ররা উপস্থিত হয়েছে। তাই অত্যধিক চিন্তা গ্রস্ত হয়ে রয়েছে আকাশ। পায়চারি করতে করতে বিরবির করে বলছে,
–এসিপি স্যার এবার বোধহয় আমাকে শেষ করে ফেলবেন। আমি আজকে ও ভুল করেছি। দেখ সমুদ্র আমার মনে হয় তোর ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আমার হুদাই ক্রিমিনালকে ধরতে এখানে এসেছি। তোর কি মনে হয় নিরব চোধুরীর এই ঘরোয়া পার্টিতে ক্রিমিনাল আসবে?
আকাশের বাগযন্ত হতে নির্গত একটি বাক্য ও প্রাধান্য দিলো না সমুদ্র। সে নিজের মতো প্রকৃতি বিশাল করতে ব্যস্ত। সমুদ্রের পরিস্থিতি পরিলক্ষিত হতেই বিরক্ত হয়ে উঠল আকাশ। অতঃপর পা জোড়া স্থির করে ফেলল সে। সমুদ্রের নিকটবর্তী এসে ঠোঁট কামড়ে ধরে বলে উঠলো,
–ওই আমার কথা কি তোর কানে যাচ্ছে না? কি ভাবনায় ডুবে আছিস তুই? তোর কি চিন্তা হচ্ছে না ! আমাদের এই মিশনের ফলে এই পরিবারের সকল সদস্যে রিকছের মধ্যে। ওই সমুদ্র,,,
শেষোক্ত ডাকটা একটু জোরে বলে উঠলো আকাশ। তৎক্ষণাৎ সমুদ্র মুখশ্রীতে কঠোরতার আবির্ভাব ঘটিয়ে কিটমিট করে আকাশের দিকে তাকাল। শক্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আকাশের মুখশ্রীতে। অতিরিক্ত বিরক্তির সঙ্গে আকাশের উদ্দেশ্য দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
–তোকে এতো চিন্তা করতে বলেছি কী আমি? বিয়াদপ, তোর জন্যে আমার কল্প,,,
সম্পূর্ণ কথা শেষ করল না সমুদ্র। বাক্য অসম্পূর্ণ রেখে ফির আকাশ পানে দৃষ্টি মেলল। আকাশ সমুদ্রের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে স্তম্ভিত হয়ে উঠল। সমুদ্রের কী হয়েছে কিছুই ধারণা করতে পারছে না সে! এদিনিং সমুদ্রের ব্যাবহার তাকে স্তব করে তুলেছে। সমুদ্রের আকস্মিক পরবর্তী বাকরুদ্ধ সে। আকাশ নিম্ন কন্ঠে মনমরা হয়ে বলল,
–দেখ সমুদ্র পরনারী কথা চিন্তা করা তোর একদমই উচিত নয়। কি যেন নাম মেয়েটার, মনে পড়েছে সাকিলা ওর কথা চিন্তা করলে তোর পাপ হবে। তুই মেহেরকে ঠকাতে পারিস না।
আকাশের জ্ঞান মূলক কথা শুনে আকাশ পান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল সমুদ্র। পুরনায় কটমট দৃষ্টিতে তাকাল আকাশের দিকে। এবার যেন তোর চোখ যুগল হতে ক্রোধের আগুন জ্বলছে। আকাশের কথাই অতিরিক্ত রাগে ফুঁসছে সমুদ্র। কিন্তু আকাশের কিছু বলল না। প্রায় মিনিট পাঁচেক নিরব থেকে মুখে গম্ভীর ভাব বিদ্যামান রেখে আকাশকে অবাক করে আস্তে করে বলে উঠলো,
–যা তো তোর পুচকি ভাবিকে ডেকে নিয়ে আয়।
আকাশ সমুদ্রের মুখে ভাবি শব্দটা শুনে স্তব্ধ হয়ে উঠল। স্তম্ভিত হয়ে মুখ গহ্বর তিন ইঞ্চি ফাঁক করে দাঁড়িয়ে রইল। তার মস্তিষ্ক যেন কর্ম ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। আকাশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেই সমুদ্র বিরক্ত হয়ে উঠল। তৎক্ষণাৎ তার মস্তিষ্ক আকাশকে পাঠাতে নিষেধ করে উঠলো। অতঃপর সমুদ্র এক মূহুর্ত অপেক্ষা না করে দ্রুত ছাদ থেকে প্রস্থান করল। যাওয়ার পূর্বে আকাশে বলে গেল,
–ইডিয়েট!
____________
ফাঁকা কোলাহল হীন রুমের সন্ধানে হেঁটে চলছে মেহের । এতক্ষণ আয়ানকে কোলে রেখে খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে মেহের। তার কোলেই ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু খানিক পূর্বে জাগ্রত হয়েই খেলতে মেতে উঠেছে আয়ান। মেহের ধীরগতিতে হেঁটে চলছে এবং সমুদ্রের কথা ভেবে চলছে। ইশ লোকটাকে আর দেখতে পাইনি সে! এমন সময় আচমকা হাতে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠল মেহের। লোকটাকে অনুভব করার সময় পেল না। মেহেরের হাতে আলতো স্পর্শ করে একটা ফাঁকা রুমের ভেতর টেনে নিয়ে এলো সমুদ্র। আকস্মিক সমুদ্রের উপস্থিতি বিশ্বাস করতে পারছেনা মেহের। তার হাত পা ব্যাপকভাবে কাঁপছে! অস্তিত্ব দেখা দিয়েছে তার অন্তরালে!
লহমায় সমুদ্র মেহেরকে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিলো। অতঃপর আসেপাশে পর্যবেক্ষণ না করে মেহেরের নিকটবর্তী ধাবিত হতে লাগল। সমুদ্রের মস্তিষ্ক এতোটাই কেয়ারলেস রূপ ধারণ করেছে যে ওয়াশরুমে কেউ অবস্থান করছে বিষয়টা বোধগম্য হলো না তার।
(চলবে)
#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব :৩২
#Lutful_Mehijabin (লেখা)
[কপি করা নিষিদ্ধ]
মেহেরের হাতে আলতো স্পর্শ করে একটা ফাঁকা রুমের ভেতর টেনে নিয়ে এলো সমুদ্র। আকস্মিক সমুদ্রের উপস্থিতি বিশ্বাস করতে পারছেনা মেহের। তার হাত পা ব্যাপকভাবে কাঁপছে! অস্তিত্ব দেখা দিয়েছে তার অন্তরালে!
লহমায় সমুদ্র মেহেরকে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে, দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিলো। অতঃপর আসেপাশে পর্যবেক্ষণ না করে মেহেরের নিকটবর্তী ধাবিত হতে লাগল। সমুদ্রের মস্তিষ্ক এতোটাই কেয়ারলেস রূপ ধারণ করেছে যে ওয়াশরুমে কেউ অবস্থান করছে বিষয়টা বোধগম্য হলো না তার।
একপর্যায়ে সমুদ্র মেহেরের অত্যধিক কাছে চলে এলো। এমন পরিস্থিতিতে স্বীকার হতে হবে তা মেহের কখনো কল্পনাতেও আনে নি। ফলে অস্বাভাবিক লাগছে তার। প্রচন্ড ভয় হচ্ছে অকারণেই। সমুদ্র মেহেরের মুখশ্রীতে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। তার চোখে মুখে গম্ভীর ভাব স্পষ্ট! এক কথায় অনেকেটা রেগে আছে সমুদ্র। চোখ জোড়া ক্রোধের আগুনে জ্বলজ্বল করছে! অথচ নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে ব্যস্ত সে। মিনিট পাঁচেক মেহেরের ভীতি মুখশ্রীতে কঠোর দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে রইল সমুদ্র। মেহের অতিরিক্ত হারে কাঁপছে! তৎক্ষণাৎ সমুদ্র নিজ মস্তিষ্ক শীতল করার প্রয়াসে স্নিগ্ধ, শীতল বায়ু টেনে নিলো। নিজেকে কিছুটা শান্ত করে, গম্ভীর গলায় নিম্ন স্বরে বলে উঠল,
–আমাকে রাগাতে আপনার খুব ভালো লাগে! তাই তো ম্যাম?
সমুদ্রের কথাগুলো কর্ণপাত হতেই চমকে উঠল মেহের। সমুদ্রের মুখে ‘আপনি’ সম্বোধন মেহেরকে বিব্রত করে তুলেছে। অপ্রতিভ হয়ে পড়েছে সে। কন্ঠস্বরে রাগের উপস্থিত স্পষ্ট! দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। মেহের হৃদয় গহীনের অদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দাঁত দাঁত চেপে চোখ জোড়া খিঁচে বন্ধ করে রেখেছে। ঝড় উঠেছে তার অন্তরালে, এ যেন কালবৈশাখীর তুমুল ঝড়! কী আছে ওই কন্ঠস্বরে? যা মেহেরের হৃদয়ে অদ্ভুত এক নাম না জানা অনুভূতির উৎপত্তি ঘটিয়েছে! অস্তিত্ব হচ্ছে খুব। সমুদ্র মেহেরের অবস্থা খানিকটা আন্দাজ করতে পারল। অতঃপর কন্ঠস্বরে গম্ভীর ভাবটা বজায় রেখে বলে উঠল,
–ওপেন ইউয়ার আইছ, পুচকি।
মেহের চোখ জোড়া উন্মুক্ত করতে পারল না। ফির সমুদ্র তাকে চোখ খোলার জন্য আদেশ করল। অবশেষে ভয়ে চোখ জোড়া উন্মুক্ত করল সে। নত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শুভ্র স্বচ্ছ ফ্লোরে দিকে। সমুদ্র কটমট দৃষ্টি ফেলল মেহেরের মুখশ্রীতে। তপ্তশ্বাস ছেড়ে দাঁত দাঁত চেপে কর্কশ গলায় বলে উঠল,
–তোমাকে এভাবে সেজে গুঁজে ঘুরে বেড়ানোর অধিকার কে দিয়েছে? আমাকে রাগাতে তোমার ভালোলাগে বুঝি?
সমুদ্রের কথাগুলো মেহেরের কর্ণকুহরে পৌঁছনো মাত্রই বিচলিত হয়ে পড়ল মেহের। আশ্চর্য! সে তো সাজেনি তাহলে সমুদ্র এ কথা কেন বলল? তৎক্ষণাৎ মেহের ইতস্ততের সহিত মিনমিন কন্ঠে বলে উঠল,
–আমি তো সাজি নি।
মেহেরের কন্ঠস্বর হতে নির্গত কম্পনিত বাক্যটা শুনে ভ্রূ যুগল কুঁচকে ফেলল সমুদ্র। মুহূর্তেই গভীর দৃষ্টিতে মেহেরকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। মেহের মিথ্যা বলেছে, নাকি সত্যি! সমুদ্র কিছুই আন্দাজ করতে পারল না। সমুদ্রের কিছু বলে উঠার পূর্বে ওয়াশরুমে দরজা খোলার শব্দ পেয়ে স্বল্প সময়ের জন্য বিব্রত বোধ করল সে। বিরক্তিতে তার চোখ মুখ পাংশুটে বর্ণ ধারণ করল! আচ্ছা এই পৃথিবীর সবাই কী তাকে বিরক্ত করে শান্তি পায়। পরক্ষণেই তার মনে হলো ওয়াশরুমে যদি অহনা বা তার টিমের কেউ হয়? ভেবেই সজোরে নিজের চুলগুলো টেনে ধরল সমুদ্র। অতঃপর রুম থেকে প্রস্থান করতে পা বাড়ল সে। কিন্তু তার যাওয়ার পূর্বে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো আদিবা।
মেহের এবং সমুদ্রের মুখশ্রীতে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আদিবা। মোটেও মেহেরকে এখানে প্রত্যাশা করে নি সে। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দেখল, তাকে দেখে কোন প্রকার অস্বস্তি হচ্ছে না সমুদ্রের। অবশ্য আদিবা কে দেখে সমুদ্র একপ্রকার স্বস্তির নিশ্বাস ত্যাগ করল। সমুদ্রকে লক্ষ করে মুচকি হেসে উঠল আদিবা। বর্তমানে মেহেরের অবস্থান তার নিকট গুরুত্বহীন। মেহেরকে উপেক্ষা করে সমুদ্রের উদ্দেশ্য বলে উঠল,
–স্যার, কেমন আছেন? তিন দিন হলো স্কুলে আসেন না কেন?
আদিবা বলা প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে সমুদ্র গম্ভীর কন্ঠ বলে উঠল,
–ভালো। ব্যস্ত আছি তাই স্কুলে যাওয়া হয় নি। তুমি এখন রুম থেকে যেতে পারো।
সমুদ্রের আকস্মিক রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা বলাতে নিমিষেই আদিবার মনটা খারাপ হয়ে এলো। মুহূর্তেই তার ঠোঁটের কোণের ফুটে ওঠা মিষ্টি হাসিটা গ্রাস করে নিলো মন খারাপের কালো মেঘ। কেন জানি না চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো তার। এতো বড় অপমান! মন খারাপের সহিত বলে উঠল,
–কেন স্যার? এখানে তো মেহের ও আছে! তাহলে আমি থাকলে সমস্যা কোথায়?
আদিবার কথাগুলো শুনে ধবক করে উঠল মেহেরের অন্তরাল! আদম্য আগ্রহ জাগল সমুদ্র প্রত্যুত্তর জানার। নত দৃষ্টি উঠিয়ে দৃঢ় দৃষ্টিপাত ফেলল সমুদ্রের মুখশ্রীতে। মেহেরকে অবাক করে দিয়ে সমুদ্র বলে উঠল,
–তুমি যাও। মেহেরকে আমার একটু দরকার আছে।
সমুদ্রের বলা বাক্যগুলো শুনে আদিবা দ্রুত বলে উঠল,
–আমি করে দেই। কি কাজ আমাকে বলুন?
সমুদ্রের অগ্নি দৃষ্টিতে আদিবা দিকে তাকাল। বিরক্তি তার কপালে সুক্ষ্ম ভাজের আবির্ভাব ঘটল। অতঃপর কন্ঠে শীতলতা বজায় রেখে বলল,
–তুমি পারবে না। মেহের ছাড়া পৃথিবীতে বুকে কারো সাধ্য নেই আমার কাজটা সম্পূর্ন করার। তাই তুমি যাও। আর হ্যাঁ, এখন জিজ্ঞেস করবে না কী কাজ। আমি তোমাকে বলতে বাধ্য নই। সো গেট আউট।
সমুদ্রের তিক্ত ভাষা শুনে বিষণ্ণ হয়ে উঠল আদিবা। সন্দেহ দানা বাঁধল তার হৃদয়মনে। কী এমন কাজ সমুদ্র মেহেরকে দিয়ে করাবে! অত্যধিক অপমানিত বোধ করল সে। মেহেরের সামনে সমুদ্রের অবহেলিত ব্যবহার তাকে লজ্জয় ফেলেছে। তৎক্ষণাৎ আদিবা রুম থেকে অনিচ্ছুক এবং বাধ্য হয়ে বেরিয়ে গেলো। কিন্তু মনে মনে তাদের উপর নজর রাখার পরিকল্পনা করল। যে করেই হোক তাকে সমুদ্র আর মেহেরের সম্পর্কে জানতে হবে। একরাশ সন্দেহের উদ্ভাবন ঘটেছে তার মনে!
আদিবা প্রস্থান করার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র দ্রুত গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। অতঃপর ফির এগিয়ে এলো মেহেরের নিকটবর্তী। মেহের তো ভয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে। কী কাজ সমুদ্র তাকে করতে দিবে? ভেবেই ভয়ে তার হাত পা ব্যাপকভাবে কাঁপছে। অকারণেই অতিরিক্ত অস্তিত্ব হচ্ছে তার। সে জানে, আর যাই হোক সমুদ্র তাকে মারবে না। কিন্তু বকা দিতে পারে! লোকটা সত্যিই অত্যধিক নিষ্ঠুর।
মেহেরকে দ্বিগুণ অস্বস্তি গ্রস্ত করার লক্ষ্যে সমুদ্র মুহূর্তেই বলে উঠল,
–দুপুরে কী কিছু খেয়েছেন?
মেহেরের সঙ্গে সঙ্গে দ্বিধা গ্রস্ত হয়ে উঠল। হঠাৎ তার অন্তরে লজ্জর আবির্ভাব ঘটেল। আবার খানিকটা ভয়ও হলো ভবিষ্যতে তার সঙ্গে কী হতে চলেছে ভেবে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠ অস্কুটস্বরে বলল,
–খাই নি। আসলে,,,
মেহেরকে কথা বলতে না দিয়েই সমুদ্র ভর্ৎসনা স্বরে বলে উঠল,
–তা খাবে কেন? তুমি তো ডায়েট করছ!
মেহের স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সমুদ্র ফির মেহেরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–ওয়েট, আজ তোমার ডায়েটের একদিন কী আমার একদিন।
বলেই সমুদ্র পকেট থেকে মোবাইল বের করে আকাশকে কল করল।
–শোন, দু প্লেট খাবার নিয়ে এক্ষুনি দক্ষিণ দিকের সিরির পাশের রুমটা আই। জাস্ট পাঁচ মিনিটের মধ্যে তোকে দেখতে চায়।
________
প্রায় মিনিট পাঁচেকের মধ্য দুটো প্লেট খাবার নিয়ে উপস্থিত হলো আকাশ। দরজা বাইরে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত নক করতে লাগল। আকাশে উপস্থিতি আন্দাজ করতে পেরেই দ্রুত গতিতে দরজা খুলে দিলো সমুদ্র। মুহূর্তেই তার কানে ভেসে উঠল তার আন্ডারে কর্মরত অফিসার রিয়ার কন্ঠস্বর,
–স্যার, এই নিন খাবার।
রিয়া দ্রুত সমুদ্রকে স্যালুট জানিয়ে রুমের ভেতর প্রবেশ করে। টেবিলের উপর প্লেট রেখে স্টাচু ন্যায় সমুদ্রের সামনে দাঁড়ায়। অবশেষে কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করে মেহেরকে। অনেকটা সন্দেহ হয় রিয়ার হৃদয় গহীনে। সমুদ্রের কী হয় মেয়েটি? পরক্ষণেই ভাবল, হয়তো সমুদ্রের ছোট বোন হবে হয়তো।
রিয়ার পরিস্থিতি দেখে মেহের স্তম্ভিত। একটু আগে যেই মেয়েকে দেখে তার ভয় হচ্ছিল সেই মেয়ে এখন ভয়ে চুপসে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মেহেরের ভাবতেই অবাক লাগছে, শক্তিশালী মেয়েটাও বুঝি ভয় পাই!
তৎক্ষণাৎ রুমের মধ্যে উপস্থিত হলো আকাশ। বাইরে থেকে তড়িঘড়ি এসেই সমুদ্রের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
–ভাবির জন্য এনেছিস বুঝি? ভাবি খাইনি?
আকাশের বলা কথাগুলো শুনে রিয়ার চোখ জোড়া আপনা আপনি বৃহত্তর আকার ধারণ করে উঠল।
(চলবে)
[ ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]