তুমি নামক অনুভূতি পর্ব-৪৫+৪৬

0
936

#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:৪৫
#Lutful_Mehijabin (লেখা)
[কপি করা নিষেধ]

–কুল পুচকি। আমি কী বাগ না ভাল্লুক!

সমুদ্রের উত্তরে মেহের ঠোঁট জোড়া সংকুচিত করে নিম্ন কন্ঠে মিনমিন করে বলে উঠলো,

— না না। আমি ঠিক আছি তো।

মেহেরের উত্তর পেয়ে সমুদ্র হঠাৎ বলে উঠলো,

–তাই? ওকে, নাও আই নিড প্রুভ। সো ওড়নাটা খুলো তো!কুইক। আমার সামনে এভাবে মাথার সীমান্ত পর্যন্ত ঘোমটা দিয়ে থাকতে পারবে না। বিরক্ত লাগে।

সমুদ্রের গম্ভীর কন্ঠস্বর মেহেরের কর্ণকুহরে পৌঁছনো মাত্রই ঘাবড়ে গিয়েছে মেহের। তার মুখশ্রীতে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে! মেহের স্বাভাবিক হওয়ার পূর্বে সমুদ্র বিরক্তিকর কন্ঠস্বরে পুনরায় বলে উঠলো,

— আই নো, তোমার চুল গুলো ভিজে। ইনফ্যাক্ট এর জন্যে তোমার ওড়নাও ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছে । তাই ওড়নাটা মাথা থেকে খুলে ফেলো।

সমুদ্রের কথার প্রেক্ষিতে মেহের দ্রুত মাথায় হাত রাখলো। মুহূর্তেই তার অনুভব হলো, সত্যি তার ওড়নাটা ভিজে কাহিল। এতে করে খানিকটা শীত করছে তার। অথচ ওড়না খুলতে সে নরাজ! আরো ভালো করে ওড়নাটা মাথায় পেচিয়ে নিলো সে। অতঃপর মুচকি হেসে বলল,

–সমস্যা নেই তো।

মেহেরের উত্তর পেয়ে তৎক্ষণাৎ সমুদ্র গরম চাহনি নিক্ষেপ করলো মেহেরের ভীত মুখশ্রীতে। কফির মগটা শব্দ করে পার্শ্ববর্তী রেখে, কর্কশ কন্ঠে বলে উঠলো,

— টিচারের সামনে মাথা ওড়না দ্বারা আবৃত করে পড়তে বসবে। বিষয়টা বেশ ভালো, বাট আমার সামনেও! আমি কি বাইরের মানুষ? মানলাম তুমি ধার্মিক। কিন্তু তাই বলে নিজের হাজবেন্ড এর সামনে ঘোমটা দিয়ে থাকার কোন মানেই হয় না।

সমুদ্রের কর্কশ ভাষা মেহেরের কর্ণকুহরে পৌঁছনো মাত্রই স্বল্প কেঁপে উঠলো মেহের। সমুদ্রের মুখ হতে নির্গত হাজবেন্ড শব্দটার শরীর কম্পনিত করতে সক্ষম হয়েছে। তার শান্ত মনে ইতিমধ্যে অশান্ততার আবির্ভাব ঘটেছে। বাজে পরিস্থিতির স্বীকার সে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না! একরাশ জড়তা এসে জুড়েছে তার হৃদয় মনে। সমুদ্রের সামনে চুল ছেড়ে থাকবে! বিষয়টা তার কাছে অস্তিত্বকর লাগছে। এককথায় অনেকেটা লজ্জা লাগছে তার। সমুদ্র সামনে কী করে মাথায় ঘোমটা ব্যতীত থাকবে। ঘোমটা ছাড়া তো তার চুলগুলো অবাধ্য হয়ে পড়ে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে তাকে জ্বালিয়ে মারে। কিন্তু সমুদ্রের বাইরের মানুষ বক্তব্যটা বেশ ভাবনা তৈরী করেছে তার অন্তরালে।

মেহেরের কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে ক্ষুন্ন হলো সমুদ্র। অতঃপর নিজেকে শান্ত করার প্রয়াস চালালো। এখন তাকে রাগলে চলবে না। কারণ সে রাগলে যে তার পুচকি ভয় পাই। তাই তাকে শান্ত হতে হবে। নিজেকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে চোখ জোড়া বন্ধ রেখে জোরে জোরে নিশ্বাশ ত্যাগ করলো সমুদ্র। খানিকটা শান্ত হয়ে বলে উঠলো,

— দেখো পুচকি, তোমার জড়তা আমার একদমই অপছন্দের। স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করো। নিজের জন্য নয় আমার জন্য প্লিজ। আমি অনুরোধ করছি ওড়না ফেলে ভেজা চুলগুলো ছেড়ে দাও। তাদের স্বাধীনতা দেও। আর তার চেয়ে বড় কথা এভাবে থাকলে তোমার জ্বর চলে আসবে। অসুস্থ হয়ে পড়বে তো তুমি।

সমুদ্রের কথা শুনেও ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো মেহের। লজ্জা লাগছে তার। এমনকি অযথা লজ্জয় তার মুখশ্রী রক্তিম বর্ণ ধারণ করে উঠেছে। অন্যদিকে সমুদ্র আর চোখে মেহেরকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। মেহেরকে দ্বিধা সংকোচের মাঝে ডুবে থাকতে দেখে বড্ড ব্যথিত হলো সে। মুহূর্তেই ব্যথিত স্বরে বলে উঠলো,

— কখন কী করতে হয় তা তো তোমার অজানা নয়। সবকিছুই বুঝো তুমি। শুধু আমার বেলায় তোমার অবুঝ মস্তিষ্কের কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। ছয় মাসের পুচকি হয়ে পড়ো তুমি। কেন, পুচকি? আমাকে কি তুমি ছোট হবার সুযোগ দিবে না?

শেষোক্ত বাক্যটা খুবই স্বল্প আওয়াজে বললো সমুদ্র। যা মেহের শুনেও বোধগম্য করতে ব্যর্থ হলো। কিন্তু যতটুকু সে শুনেছে ততটুকুই তার মস্তিষ্কে চেপে বসেছে। মেহের ফ্লোর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আরচোখে তাকালো সমুদ্রের মুখশ্রীতে!। সমুদ্র আকাশ পানে দৃষ্টি ফেলে মুখ ফিরিয়ে, দু হাত প্যান্টের পকেটে খুঁজে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মুখশ্রীতে নিত্যদিনের মতো গম্ভীরতা স্পষ্ট! কিন্তু চোখের কোণে রাগের চিরে ফোঁটাও নেই। চোখ দুটো যেন এক ভিন্ন বানী ইশারা করছে। তৎক্ষণাৎ মেহের দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। সে কিছু বলে উঠার পূর্বে সমুদ্র শীতল কন্ঠ বলল,

— মেহের! তুমি কী মাথার কাপড় ফেলবে? নাকি আমি ওড়নাটা নিয়ে বেলকনি থেকে ছুড়ে ফেলব? দেখো কি করতে চাও তুমি। জাস্ট পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে ডিসিশন নিবে, ওকে?

লহমায় মেহের না চাইতেই মাথা থেকে কাপড় ফেলে দিলো। অতঃপর ভীত কন্ঠে বলে উঠলো,

–আচ্ছা এবার আমি রুমে যায়?

মেহেরের অস্থিরতা দেখে সমুদ্র দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো। আকাশ পান হতে দৃষ্টি সরিয়ে তীর্যক চাহনি ফেললো মেহেরের উপর। অতঃপর ভ্রু যুগল কুঁচকে বলতে লাগলো,

— ওয়েট, আমি বুঝি না পুচকিদের এতো ভাব কেন! পুচকি পুচকির মতো থাকবে। চুপচাপ এখানে দাঁড়িয়ে থাকো। আর হ্যাঁ ম্যাম, খোপা খুলে ফেলেন। চুলগুলো শুকতে দিন। নাকি আমি,,,

সমুদ্রের বাক্য শেষ হওয়ার পূর্বে মেহের অনিশ্চিত কোন ঘটনার ভয়ে খোপা খুলে দিলো। চটজলদি মাথায় হাত দিতে গিয়ে ঘটে গেলো বিপত্তি! মেহেরের হাতের স্পর্শে তার চোখ জোড়া আবদ্ধ করে রাখা চশমাটা হুট করে ফ্লোরে পড়ে গেলো।

সমুদ্র মেহেরের পরিস্থিতি দেখে বিস্মিত! আসলে কি একটা মেয়ে এমন স্বভাবের হতে পারে? সমুদ্র মেহেরকে যতো দেখছে ততোই অবাক হচ্ছে। মেয়েটার মধ্যে অত্যধিক জড়তা দিয়ে ভরপুর। সমুদ্র এটাই ভেবে পাচ্ছে না, মেয়েটা কেন তার সঙ্গে পরিবারের অন্য সব সদস্যদের মতো আচরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে? সবচেয়ে বড় ভাবনার বিষয় হচ্ছে, অচেনা অজানা মেয়েরা সমুদ্রকে দেখে কতো শত কান্ড করে বসে। কিন্তু এখানে এই মেয়েটা তার স্ত্রী হয়েও তাকে পাত্তাই দেয় না! এই নিয়ে সমুদ্রের চিন্তার শেষ নেই। এমনকি তার মনের মাঝে নানান নেগেটিভ মন্তব্য আবিষ্কৃত হয়েছে। সে না চাইতেও তার পুচকিকে সন্দেহ করেছে। কিন্তু সে অনেক পর্যবেক্ষণ করেও মেহেরের কোন অপরাধ খুঁজে পাইনি। সাধারণত কৈশোর কালে ছেলে মেয়েরা নতুন পৃথিবীতে পা রেখে নিজের ভালো মন্দের বিচার করতে পারে না। তখন তারা নিজেদেরকে বড় ভাবতে আরম্ভ করে। বয়সটা এতোটাই মারাত্মক যে ছেলে মেয়েরা নিজের বাবা, মাকে অপর ভাবতে শুরু করে। এই সময়ে তারা ক্রমশ পরিবার হতে দূরে যেতে থাকে। বাবা, মা যখন তাদের শাসন করে, ভালো মন্দ বিচার করে তাদের মন মতো কর্ম করতে নিষেধ করে। ঠিক তখনি তারা বাবা, মায়ের সঙ্গে বাজে আচরণে করতে মরিয়া হয়ে উঠে। জেগে ওঠে তাদের মধ্যেকার ভয়ঙ্কর হিংস্রতা। প্রায়ই সব ছেলে মেয়েরা আবেগে আপ্লুত হয়ে যুক্ত হয়ে পড়ে প্রেম নামক অপরাধে। যা প্রায় সময় তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বাঁধা হিসেবে কাজ করে। তখন তারা সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগে। অনেক ক্ষেত্রে তারা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। কিন্তু মেহের অন্য সব কিশোরী বয়সের মেয়েদের মতো নয়। মেয়েটার সম্পন্ন ভিন্ন প্রকৃতির। সবসময়ই ভাবনা চিন্তা করে প্রতিটি কর্ম সম্পূর্ণ করে। সবকিছুই ঠিক আছে কিন্ত মেয়েটার সময়ে অসময়ের ভয়, লজ্জা, সংকোচ সমুদ্রকে ব্যথিত করে তুলে। বর্তমানে সমুদ্র নিজেকে শান্তনা দেই, তাকে ঠিক হতে হবে। তার আচরণ পরিবর্তন করতে হবে। দরকার পড়লে তাকে বাঁচালে রুপান্তরিত হতে হবে। কিন্তু সমুদ্র চেষ্টা করেও ব্যর্থ।

তৎক্ষণাৎ ফ্লোর থেকে চশমা তুলে পড়ে নিলো। সংকোচ তাকে ঘিরে ধরেছে। সমুদ্রের সামনে এমন কর্ম ঘটিয়ে বেশ লজ্জিত সে। সমুদ্রের দৃশ্যমান হলো মেহের কাঁপছে। তার অধিক লম্বা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়েছে। এক অদ্ভুত মাধুর্যতা মেহেরের মাঝে উপস্থিত হয়েছে। সমুদ্র অবাক দৃষ্টিতে মেহেরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এই সামান্য পুচকি মেয়েটা তার হৃদয়ে অসম্ভব বাজে অবস্থা করে দিতে সক্ষম। নিজ অজান্তেই সমুদ্র বিবির করে বলে উঠলো,

–এই পুচকি, কি রয়েছে তোমার মাঝে! আই নো কিচ্ছু নেই। কিন্তু আমি যে পাগল হয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত তোমাতে। তুমি নামক অনুভূতি আমাকে অবুঝ করে তুলছে ক্রমশ!

সমুদ্রের চাহনি দেখে ঠোঁট জোড়া জিহ্বা দ্বারা ভিজিয়ে নিলো মেহের। না চাইতেও সে অতিরিক্ত হারে কাঁপছে! নিজেকে ঠিক করার প্রয়াসে বারংবার চশমাতে স্পর্শ করছে সে। হঠাৎ সে মিনমিন করে বলে উঠলো,

— আমি কী এখন যেতে পারি?

মেহেরের কথার প্রত্যুত্তরে সমুদ্র স্পষ্ট জবাব দিলো,

–না যেতে পারবে না। আমি বুঝি পুচকি পুচকির মতো থাকতে পারো না। তোমাকে বড়ো হতে হবে না। নিজেকে দেখেছো কখনো? বড় বড় ভাব বয়সের অবার।

শেষ বাক্যটা দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো মেহের। প্রায় মিনিট পাঁচেক বাদে সমুদ্র শান্ত হলো। সে নিজেকে ঠিক রাখতে এবং মেহেরকে স্বাভাবিক করতে বলে উঠলো,

–বাই দ্য ওয়ে পুচকি, তোমরা কয় ভাই বোন? ওপস সরি পুচকি আমি জানি না।

সমুদ্র কথার প্রেক্ষিতে মেহেরের মন খারাপ হয়ে গেলো। নিজেকে ধাতস্থ রেখে বলল,

–আমার একটা বোন ছিলো। কিন্তু আপুর বিয়ে হয়ে গিয়েছে।

সমুদ্র কিছু বলল না। মেহেরের বোন আছে সে জানতো না ঠিকই কিন্তু মেহেরের মুখের পরিবর্তন দেখে তার অন্তরালে রহস্যের উদ্ভাবন ঘটেছে। সমুদ্র ফির বলল,

— ওহহ আচ্ছা। তোমার টিচারের কোনো পড়া বুঝতে অসুবিধা হলে আমাকে ইনফরম করবে। আর যা না বুঝো তা আমাকে বলবে।

সমুদ্রের কথার প্রত্যুত্তরে মেহের জড়তা কাটিয়ে আনমনে বলে উঠলো,

–আপনি তো আমাদের স্কুলের একজন শিক্ষক। তাহলে আপনিই তো পড়াতে পারেন।

মেহেরের কথার পরিপ্রেক্ষিতে সমুদ্র আফসোস স্বরে বলল,

–কতো বড় সুযোগটা মিস হলো। বাট পুচকি আমার টিউশনি করানো একদমই অপছন্দ। আমি যদি পারতাম তাহলে অবশ্যই বাইরের কাউকে বাসায় আনতাম না। বাচ্চা পড়ানোর মতো ধৈর্য নেই আমার।

সমুদ্রের কথাগুলোর অর্থ বুঝে একটু সময় ব্যয় হলো না মেহেরের। আসলেও তো যার কারনে অকারণে রাগের উদ্বোধন ঘটে। যে লোকের সামান্য থাপ্পড়ের ব্যথা এখনো অবধি সে উপলব্ধি করতে পারে। সে লোক সত্যিই শিক্ষক হবার কথা নয়। সমুদ্র যদি তাকে পড়াই তাহলে তো তার অবস্থা নাজেহাল। কোন পড়া তার মস্তিষ্কে ঢুকবে কি সন্দেহে! হয়তো দীর্ঘ সময় সমুদ্রের সামনে নতজানু হয়ে বসে থাকলে সে স্ট্রোক করে বসবে। কারণ সমুদ্র সামনে এলেই তার অন্তরালে অদ্ভুত অনুভূতি জাগ্রত হয়। তাই সমুদ্রের কাছে পড়তে পারবে না সে ঠিকি কিন্তু তাই বলে সাফাত স্যারের কাছে পড়তে তার মন মত দিচ্ছে না। সাফাত স্যারের চাহনি তার নিকট অস্বাভাবিক লাগে। কিন্তু বর্তমানে এ মত সমুদ্রের নিকট প্রকাশ করার মতো সাহস পাচ্ছে না। মেহের কিছু বলে উঠার পূর্বে মাগরিবের আযানের ধ্বনি এসে তাদের কর্ণপাত হলো। তৎক্ষণাৎ সমুদ্র হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,

–মেহের আমাকে একটু বাইরে যেতে হবে। তুমি পড়তে বসো। ভয় পেও না।

বলেই মুহূর্তেই বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো সমুদ্র। সকিনা বেগম তার মেয়েকে নিয়ে থানায় পৌঁছে গিয়েছে কিয়ৎক্ষণ পূর্বে। তাই এখন সমুদ্র গিয়ে তাদের থারার ব্যবস্থা করে দিবে। প্রথমে নিজের ফ্লাটে তাদের আনতে চেয়েছিল। কিন্তু পরে কী যেন ভেবে আকাশের পার্শ্ববর্তী ফ্লাট তাদের থাকার জন্য নিযুক্ত করেছে।
______________

সোফার উপর বসে নিকোনিটের ধোঁয়া উঠতে ব্যস্ত শোয়াইব খান। আজ তার চরম আনন্দের দিন। সত্যিই সে খুব আনন্দিত। পুরো চব্বিশ ঘণ্টা নিদ্রা ত্যাগ করে মেহেরের সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করেছেন তিনি। পরিশেষে তার সন্দেহটাই সঠিক। মেহের কার কেউ নয়। তার স্ত্রীর শেষ চিহ্ন! তার একমাত্র মেয়ে। ভাবতেই তার বুকটা ভরে উঠেছে সেও একজন সন্তানের বাবা! মেহের তার একটা নিজের অংশ। খবরটা জানতে পেরে পূর্বের তুলনায় অত্যধিক মেহেরের সঙ্গে দেখা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে সে। তার মেয়ে! অদ্ভুত এক মায়াজাল জাগ্রত হয়েছে তার অন্তরালে! মেহেরকে এক পলক দেখার জন্য তার চোখ জোড়া তৃষ্ণাক্ত হয়ে উঠেছে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সমুদ্রের কাছে থেকে সে তার মেয়েকে কেড়ে নিবে। তার কাছে রেখে আদর যত্নে বড় করবে। বারংবার নিজের উপর ক্রোধের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে সে। কেন সে তার মেয়েকে নিজের কাছে এনে রাখলো না। কেন সে ভুলে গেলো তার মেয়ের অস্তিত্ব সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে। তার তো উচিত ছিলো কল্পনা নামক অসহায় নারীর বেঁচে আছে কিনা তা সম্পূর্ণ ধারণা নেওয়া। শোয়াইব খান কল্পনার মৃত্যুর খবর পেয়ে যতটুকু ব্যথিত না হয়েছে তার চেয়ে দ্বিগুণ ব্যথিত হয়েছে তার মেয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের খরব পেয়ে। কই সে তো নিষ্ঠুর সন্তানের মতো নিজের মাকেও বৃদ্ধ আশ্রমের বন্দি করে দিতে একবারও পিছপা হয়ননি। তিনি একজন কঠোর মানবী যে কীনা জীবনের উন্নতির উদ্দেশ্যে পরিবার পরিজনের কথা একবারও ভাবে না। কিন্তু এখন তার মধ্যে পিতৃত্ব বোধ এলে কোথায় থেকে? তার মনে হচ্ছে সে তার মেয়েকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না। দম আটকে মরে যাবে। সবকিছু ভেবে শোয়াইব খান সিদ্ধান্ত নিয়েছে মেহেরকে সমুদ্রের সঙ্গে ডিভোর্স করিয়ে দিবে। এতে যদি সমুদ্রের প্রতি তার অন্যায় আচরণ করতে হয় তাহলেও সে করবে। অতঃপর মেয়েকে নিয়ে এক নির্জন স্থানে বসবাস শুরু করবে। যেখানে সমুদ্র নামক কোন ব্যক্তির ছায়া ও পরতে দেবে না। সমুদ্র স্ব ইচ্ছায় মেহেরের ছেড়ে দিলে তো ভালোই না হলে সে অন্য পথ অবলম্বন করবে।

(চলবে)

#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:৪৬
#Lutful_Mehijabin
[কপি করা নিষেধ]

ঘড়ির কাঁটায় ছুঁই ছুঁই বরোটা। ক্ষুদ্র পরিসরের বদ্ধ একটা রুমের ভেতর থেকে কারো নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার রুমে চোখ যেন ধোঁয়াশা হয়ে উঠেছে! স্বল্প ভাঁপসা পচা দুর্গন্ধ রুমটার চারদেয়ালে প্রতিফলিত হচ্ছে। হবেই বা না কেন! এই ছোট রুমটাতে তিন দিন যাবত একটা ছেলেকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। ছেলেটা চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় ঝিমুচ্ছে। এই কয়ে কদিনের শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন তাকে কাহিল। প্রতি ক্ষনে ক্ষনে সে মৃত্যুর সংস্পর্শে গিয়ে ও বেঁচে আছে সে। কঠোর নির্যাতন তাকে মৃত্যুর সম্মুখীন করালেও মুখ দিয়ে একটি বাক্য ও নির্গত করছে না। ব্যথায় আর্তনাদ তুলছে কিন্তু তার মুখ টু শব্দ বের করতে নারাজ!

হঠাৎ দরজা চাপানোর মৃদু আওয়াজে কেঁপে উঠলো ছেলাটি। এখন তাকে পুনরায় আবার নির্যাতন সহ্য করতে হবে। এতো গুলো দিন রিমান্ডে থেকে ও মুখ দিয়ে টু শব্দ ও নির্গত করে নি ছেলেটি। কারো পায়ের আওয়াজ ক্রমশ ছেলেটার হৃদয় স্পন্দন বৃদ্ধি করে তুলছে। আচমকা ডিম লাইটের আলোতে পুরো রুম খানিক আলোকিত হয়ে উঠলো। ছেলেটি পুনরায় চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলল। তিনদিন যাবত অন্ধকার অবস্থান করে তার চোখ যেন ঘোলাটে হয়ে এসেছে। চোখ মেলে তাকাতে প্রয়াস চালালো সে। কিন্তু চোখ যেন তার ব্যাথায় টনটন করছে। অনুভব হচ্ছে কোন আঠালো বস্তু তার চোখে আষ্টেপিষ্টে জায়গা করে নিয়েছে। মুহুর্তেই ছেলেটা স্বল্প কেঁপে উঠলো। কলিজা কাঁপানো কন্ঠস্বর ভেসে উঠলো তার কুর্ণকুরে,

— মিস্টার পারভেজ, এখনো সমাই আছে আপনি জবাব বন্ধি দিন। সত্যিটা বলুন। আপনি কেন আমাকে খুন করতে চান?

গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনেও ছেলেটার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠলো। ভয় পেয়েও সে একরাশ শাহস বজায় রাখার কর্মে ব্যস্ত! ভয়ে জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ত্যাগ করছে সে।

প্রায় মিনিট পাঁচেক ছেলেটাকে পর্যবেক্ষণ করলো ইয়াদ। একজন আর্মি অফিসার হওয়ার সুবাদে রিমান্ডে কোন দায়িত্ব না থাকা সত্ত্বেও ছেলেটার জবানবন্দী নিতে সে এসেছে! এখানে অবশ্যই তার স্বার্থ রয়েছে। কিন্তু ছেলেটার কোন হেলদোল না দেখে ক্রোধ চেপে বসেছে ইয়াদের মস্তিষ্কে। অতঃপর নিজেকে ধাতস্থ রাখার প্রয়াস চালালো সে। হঠাৎ পাশে থেকে লাঠি নিয়ে ছেলেটার চোয়াল স্পর্শ করে দাঁত দাঁত চেপে বলে উঠলো,

–এই কুত্তা, তুই নিজে মরলে মরবি তাই বলে আমার জেবুকে কেন ফাঁসাতে চায়ছিস?আই নো তোর প্রাক্তন প্রেমিকা ছিলো জেবু। তোরা দু জন মিলে আমাকে ঠকিয়েছিস। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না আমার জেবু তোর অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত। সত্যি বল তোর পিছনে কার হাত রয়েছে?

ইয়াদের প্রত্যুত্তরে ভয়ঙ্কর পৈশাচিক হাসি হেসে উঠলো পারভেজ। তার গায়ে শক্তি অভাব। এতোটা নির্যাতন সহ্য করেও মুখ দিয়ে টু শব্দ বের করছে না পারভেজ। ইয়াদের সহ্যের সীমা অতিক্রম হয়ে উঠেছে। মুহুর্তেই সে লাঠি দিয়ে ইচ্ছে মতো সজোরে আঘাত করতে আরম্ভ করলো পারভেজ কে। ইয়াদের হুংকার যেন রুম জুড়ে প্রতিধ্বনি তুলছে। সে চিৎকার করে বলছে,

–কুত্তা। তুই আমার জীবনে প্রবেশ করেছিস কেন? কেন আমার জেবুকে তুই কেড়ে নিয়েছিস। ভালোবাসার নামে তোরা দু জন আমাকে ঠকিয়েছিস। কান খুলে শুনে রাখ জেবু শুধু মাত্র বর্ষণের। হ্যাঁ আমি ঘৃণা করি আমার জেবুকে। খুব ঘৃণা করি যে ঘৃণার কোন অন্ত নেই। যা বিশাল ওই আকাশের সঙ্গে তুলনা করলেও অপরাধ হবে। কিন্তু তাই বলে আমি জেবুর কোন ক্ষতি সহ্য করতে পারব না। ওকে কোনদিনই ভালোবাসাতে পারব না ঠিকই কিন্তু ওকে কষ্ট দেবার একমাত্র অধিকার আমার।
____________

সূর্যের তীক্ষ্ণ আলোকরশ্মি প্রতিফলিত হচ্ছে মেহের মুখশ্রীতে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে। বেলা যে অনেক হয়েছে তা তার অজানা। ইতিমধ্যে ঘুমে মধ্যে প্রচন্ড বিরক্ত বোধ করছে সে। সমুদ্রের কন্ঠস্বর মেহেরের কর্ণকুহরে পৌঁছানোর ফলে তার নিদ্রা হাল্ক হয়ে এসেছে।
চোখ জোড়া বন্ধ রাখার প্রয়াস চালিয়েও ব্যর্থ হলো সে। একপর্যায়ে ধরফরিয়ে উঠে বসে পড়লো সে। তৎক্ষণাৎ তার লক্ষ্য হলো সমুদ্র তাকে ডাকছে। প্রায় মিনিট খানিক লাগলো তার ঘুমের রেশ কাটতে। অতঃপর দেয়াল ঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত ফেলল সে। ঘড়ির কাঁটা গোটা গোটা নয় নামক সংখ্যায় এসে থেমেছে। ঘুম থেকে জাগ্রত হতে ব্যাপক দেরি হয়ে গিয়েছে মেহেরের। অবশ্য দেরি হওয়া স্বাভাবিক। সারা রাত সমুদ্রের অপেক্ষায় ঘুমতে পারে নি মেহের। অবশেষে ফজরের সালাত আদায় করে সকালের দিকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল সে। বর্তমানে সমুদ্র সম্পর্কে নানান চিন্তার আবির্ভাব ঘটেছে তার হৃদয় মনে। লোকটা প্রায়ই প্রতিদিন রাতে বেলা কোথায় যায় তাকে ফেলে? তার মস্তিষ্কেও নেগেটিভ মন্তব্যের উদ্ভাবন ঘটেছে! অযথা মনের মাঝে সমুদ্রকে হারানোর সুপ্ত ভয় জাগ্রত হয়েছে। সে তো চাই সমুদ্রকে ভয় না পেতে। কিন্তু পূর্বের তুলনায় সমুদ্রকে দেখে ব্যাপক ভয় পাই সে। কিছুদিন যাবত সমুদ্রের দুর্বলতা বুঝেও চুপচাপ রয়েছে সে। তার একমাত্র কারণ হচ্ছে কোনদিনই সমুদ্রের নির্ঝর হাসির দেখতে পাই নি সে। লোকটা এক অদ্ভুত প্রকৃতির মানব! মানুষ এতোটা গম্ভীর হয় কীভাবে তা তার নিকট অজানা। মেহেরে অন্তরালে শুধু মাত্র সমুদ্রের গম্ভীর মুখশ্রীর দৃশ্য ভেসে উঠে। লোকটা কি কখনোই মিষ্টি করে কথা বলতে পারে না। মেহেরের বড্ড অভিপ্রায় জেগেছে সমুদ্রের খিলখিলিয়ে হাসি দেখবে সে। কিন্তু লোকটা যে হাসির নামই নেই না। মেহের ভাবে সে যদি একবার বলে সমুদ্রকে হাসতে। বিষয়টা বোধহয় বোকামি বৈকি অন্য কিছু নয়। আবার উল্টো বকা খাবার আশংকা রয়েছে! সমুদ্র মেহেরকে গভীর চিন্তায় মত্ত দেখে বিরক্ত হয়ে উঠলো। অতঃপর গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,

— বাহ্ পুচকি দেখি এক দিনে বড়ো হয়ে গিয়েছে! আমার বকা তার মানে কাজে এসেছে।

সমুদ্রের কথা কর্ণপাত হতেই মেহের থতমত খেয়ে গেলো। বাক্যের গুলো দ্বারা সমুদ্র কি বুঝিয়েছে তা বুঝতে খানিকটা সময় লাগলো মেহেরের। মুহুর্তেই মেহের লজ্জায় লজ্জিত হয়ে উঠলো। রাতে সে চুল গুলো না বেঁধেয় ঘুমিয়েছিল। ফলে চুলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাকার। তার উপর মাথায় ঘোমটা দেয় নি সে‌। তৎক্ষণাৎ মাথায় ঘোমটা দেবার উদ্দেশ্যে চুল গুলো বেঁধে নিলো সে। কিন্তু ঘোমটা দেওয়া পূর্বে সমুদ্র ভারী কন্ঠে বলে উঠলো,

— বলেছি না আমার সামনে আমি যেভাবে বলল ঠিক সেই ভাবেই থাকতে হবে তোমাকে। আমার সামনে যে ওড়নাটা দিয়ে তুমি মাথায় কাপড় দিবে। আমি ঠিক সেই ওড়নাটা ছুড়ে ফেলে দিবো। সো নিশ্চয়ই তুমি তোমার ওড়না হারাতে চাও না। আই হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড। নাও গো টু বাত। স্কুলের জন্য তৈরি হও।

সমুদ্রের কথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে রইলো। চশমাটা মুঠোয় করে রেখেছে সে। চোখে দেওয়ার সাহস হচ্ছে না। কারন চশমা পড়লেই সমুদ্রকে স্পষ্ট দেখতে পারবে সে। কিন্তু এখন সে সমুদ্রকে দেখতে চাই না।

মেহেরের অবস্থা পরিলক্ষিত করেই শুকনো ঢোক গিললো সমুদ্র। মেহেরের সদ্য ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে উঠা মুখশ্রী তার হৃদয়ে অশান্ততার আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। সামান্য পিচ্চির ঘুম মাখা মুখশ্রী তার হৃদয় স্পন্দন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে! অদ্ভুত হলেও বিষয়টা চিরন্তন সত্য। সমুদ্র মতো একজন সাহসী সিআইডি অফিসার এখন অস্থির হয়ে উঠেছে ক্ষণে ক্ষণে। মাঝে মাঝে নিজের উপর বড্ড হাসি পাই তার। পৃথিবীতে কতো মানুষ। অথচ পুচকিকে ছেড়ে সে বাঁচার কথা ভাবলেই তার বুকটা ব্যথা করে উঠে। স্বল্প ব্যথা নয় বরং ব্যাপক ব্যথা। নিজেকে একজন নিষ্ঠুর ব্যক্তি ভাবে সমুদ্র । কারন সে নিজকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ। তারচেয়ে বড়ো কথা এই ধরনীর বুকে সে ব্যতীত তার পুচকিটার আর কেউ নেই। এই পরিস্থিতিতে জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপ ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ভাবলেই তার নিশ্বাস ভারী হয়ে উঠে। সত্যিই তো তার পুচকিটা তাকে হীনা ভীষণ অসহায়। প্রায় মিনিট পাঁচেক মেহের তীর্যক চাহনিতে পর্যবেক্ষণ করলো সমুদ্র। দিন দিন মেহের নামক অনুভূতিতে অতিরিক্ত দুর্বল হয়ে পড়ছে সমুদ্র!পরিশেষে নিজেকে ধাতস্থ রাখার প্রয়াসে রুম থেকে প্রস্থান করাটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করলো সে। সেই অনুযায়ী পা জোড়া ধাবিত করলো। যাওয়ার পূর্বে মেহেরকে উদ্দেশ্যে করে বলল,

— তোমার জন্যে আমি ওয়েট করছি। তাড়াতাড়ি রেডি হও। আর হ্যাঁ রান্না ঘরের আশেপাশে ও তোমাকে যেন ঘেঁসতে না দেখি। আর হ্যাঁ,,,,

(চলবে)
[রিচেক দেইনি। ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]