তুমি নামক অনুভূতি পর্ব-৪৭+৪৮

0
922

#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:৪৭
#Lutful_Mehijabin (লেখা)
[কপি করা নিষেধ]

— আমি ওয়েট করছি তোমার জন্য। তাড়াতাড়ি রেডি হও। আর হ্যাঁ তোমাকে যেন রান্না ঘরের আশেপাশে না দেখি। আর হ্যাঁ আমি যাচ্ছি গাড়ি বের করতে।

বাক্যগুলো অতিরিক্ত জড়তার সঙ্গে সমাপ্ত করলো সমুদ্র। এখন এই মুহূর্তে তাকে মেহেরের সামনে থেকে প্রস্থান করতে হবে। সমুদ্র বেশ আন্দাজ করতে পারছে তার পরিস্থিতি দিন দিন এমন হলে তো সে স্বাভাবিক থাকতে ব্যর্থ হবে। কই আগে কখনো তো কোন মেয়ের সামনে তার এমন অস্থির লাগে নি। তাহলে কেন এই সামান্য পুচকির সামনে তার পরিস্থিতি বেগতিক হয়ে উঠে! কেন পুচকির জন্য মরিয়া হয়ে উঠে সে? একেই হয়তো তুমি নামক অনুভূতি অদৃশ্য মায়াজাল বলে!
________

ঘড়ির কাঁটায় ছুঁই ছুঁই একটা। বিষন্ন হৃদয় নিয়ে পড়ার টেবিলে সামনে বসে রয়েছে মেহের। আজ বৃহস্পতিবার হওয়ার সুবাদে মেহেরের স্কুল বারোটা বাজাই ছুটি হয়ে গিয়েছে। কয়েকদিন পূর্বে এক রাত পড়ে সে যেই পরীক্ষা দিয়েছিল তার রেজাল্ট দিয়েছে আজকে। ক্লাসের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছে মেহের। এই নিয়ে যেন তার খুশীর অন্ত হবার কথা নয়। কিন্তু একটা বিশেষ কারণে মেহেরের মনটা ভীষণ খারাপ। তার প্রিয় বন্ধু দিশানি এবং তিতাস কেউই তার সঙ্গে একটা কথাও বলে নি। দিশানি পুরোটা ক্লাস আর চোখে তাকে পর্যবেক্ষণ করেছে। কিন্তু তার সঙ্গে একটা কথাও বলেনি। এই নিয়ে মেহেরের দুঃখের শেষ নেই। বারংবার তার কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনি তুলছে তিতাসের বলা কথাগুলো কথা। স্কুল শেষে তিতাস তাকে উপেক্ষা করে বলেছিল,

— আপনি আমাকে কোনদিনই ভাই ভাবেন নি মেহের। যদি কোনোদিন ভাই ভেবে থাকতেন থাকলে অবশ্যই স্যার এবং আপনার বিয়ের সম্পর্কে আমাকে জানাতেন। সরি আপনাকে বোন ভাবার জন্য। আর কোনদিন ও ভাইয়ের অধিকার নিয়ে আপনার সামনে আসব না।

তিতাসের অভিমান মাখা বাক্যগুলো মেহেরের হৃদয়ে গিয়ে বিঁধেছে। ঠিক তখন থেকেই আপনাআপনি তার চোখ জোড়া বেয়ে দুর্বোধ্য রহস্য অঝোরে ঝরছে। এখনো মেহেরের চোখে জল ছলছল করছে! পলকহীন দৃষ্টিতে বইয়ের পাতায় তাকিয়ে কী যে ভেবে চলছে মেহের। কিছু ভালো লাগেছে না তার নিকট। সমুদ্র তাকে বাসায় ফেলে কোথায় যেন উধাও হয়ে গিয়েছে! মেহের কিছুতেই পড়ায় মনোযোগী হতে পারছে না। তাই কলমের সাহায্যে হাতের তালুতে আঁকুবুকি করছিল মেহের। এমন অবস্থায় আকস্মিক তার কর্ণপাত হয় সমুদ্রে কন্ঠস্বর! সমুদ্র হঠাৎ রুমে প্রবেশ করে গম্ভীর কন্ঠে বলছে,

— পুচকি, শুনলাম আপনি নাকি পরীক্ষায় ফুল মার্কস পেয়েছেন! তাই আমি আপনাকে ছোট একটা উপহার দিতে চাই। আপনি সদরে গ্রহন করার জন্য প্রস্তুত তো?

সমুদ্রের কথাগুলো শুনে ধরফরিয়ে উঠে দাঁড়ালো মেহের। লোকটা বলা প্রতিটা বাক্যে যেন মিশে রয়েছে শ্রুতি মধুরতা। কিন্তু কন্ঠস্বরে গম্ভীর ভাব স্পষ্ট! নিমিষেই মেহের দৃষ্টি ফেললো সমুদ্রের মুখশ্রী। লোকটার মুখশ্রী হাসির চিরে ফোঁটাও নেই। এতো সুন্দর কথা গুলো একটু হাসির সহিত বললে বোধহয় ভীষণ ভালো হতো। মেহের আঁতকে উঠতো না!

মেহেরের অবাক মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত ফেলে সমুদ্র তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো,

— দিশানি এন্ড তিতাস কাম!

মুহুর্তেই দিশান এবং ভেতরে প্রবেশ করলো। দুজনের মুখশ্রীই হাস্যোজ্জ্বল! সকালের ন্যায় অভিমান মাখা মুখটি যেন বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। ভেতরে ঢুকেয় দু জন একই সঙ্গে বলে উঠলো,

— সরিররর মেহের ।

সঙ্গে সঙ্গে মেহেরের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। সমুদ্রের কাছে থেকে এমন উপহার তার নিকট বিষ্ময়জনক! সমুদ্রের সামনে চুপচাপ ভদ্র সেজে দাঁড়িয়ে রইলো তারা দু জন। খানিকটা ভয় তাদের মুখশ্রীতে ফুটে উঠেছে। সমুদ্র বিষয়টা পরিলক্ষিত করে বলে উঠলো,

–অনুগ্রহ করে আপনারা আমাকে ভয় পাবেন না।

সমুদ্রের কথা শুনে দিশানি বলে উঠলো,

–সরি স্যার।

দিশানির অদ্ভুত উত্তর পেয়ে সমুদ্র দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো। সে ব্যর্থ! মেয়েটা এখনো স্বাভাবিক হতে পারে নি। দিশানির উত্তর পেয়ে খানিকটা হেসে উঠলো তিতাস। কিছুক্ষণ পূর্বে সমুদ্র তাদের বাসায় গিয়ে নিজ দায়িত্বে তাদের নিয়ে এসেছে। তাদের ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে মেহেরের কোন দোষ নেই। মেহের নিরুপায় ছিলো।

সমুদ্র তাদের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে শীতল কন্ঠে বলে উঠলো,

–তোমরা এতো পিচ্চি কেন, হুম? নিজেরে ভাগ্যের উপর পরিহাস হচ্ছে আমার। ভাগ্য আমার কতোটা খারাপ! শালা, শালিদের সঙ্গে মন খুলে একটু কথাও বলতে পারব না। মনের দুঃখটাও তাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারব না।

কথাগুলো বলে কিছুটা থেমে সমুদ্র পুনরায় বলে উঠলো,

–ওকে তোমরা ইনজয় করো। আমি আসসি।
__
সমুদ্রে রুম হতে প্রস্থান করার সঙ্গে সঙ্গে দিশানি মেহেরের জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো,

–সরি দোস্ত তোকে ভুল বুঝার জন্যে। আমার ভাবতেই কান্না পাচ্ছে শেষে কিনা আমার বেস্ট ফ্রেন্ডটা এই ভয়ঙ্কর মানুষের বাড়িতে এসে পড়েলো! আমার বিশ্বাস হচ্ছে না তুই স্যারের বউ। আমি কি করবো বলতো সবকিছু কেমন যেন গোলমাল লাগছে!

তিতাস দিশানির কথায় পরিপ্রেক্ষিতে বলে উঠলো,

–ঢং,

কথাগুলো বলে দিশানি জোরে জোরে নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। অতঃপর মেহেরের চোখে চোখ রেখে উৎসাহের সহিত প্রশ্ন করো,

–আচ্ছা মেহের আমাকে একটা কথা বলতো। সত্যিই বলবি কিন্তু বলবি। স্যার কি রাতে তোর সঙ্গে ঘুমোন?
______________

চারপাশে অন্ধকার বিরাজমান। দিনের আলোতে বদ্ধ রুমের ভেতর মোম বাতি জ্বালিয়ে আগুন নিয়ে খেলায় মেতে উঠেছে রাফু। তার মস্তিষ্কে যখন ভীষণ চিন্তা প্রাদুর্ভাব ঘটলে সে এই খেলায় মত্ত থাকে। সেই ছোট বেলা থেকেই এই খেলা তাকে প্রশান্তি ময় শান্তনা দেয়। পরম শান্তিতে ভরিয়ে তুলে তার অন্তর। এই ভয়াবহ খেলাটা শুধু মাত্র ইয়াদের প্রতি একরাশ ক্রোধের চিহ্ন প্রমাণ করেছে! বিশেষ কিছু কারণে ইয়াদকে সে অত্যধিক ঘৃণা করে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো কারন হচ্ছে,ইয়াদ তার সমাবয়সী হওয়া সত্ত্বেও ছোট বেলা থেকে সবাই ইয়াদকে বেশি ভালোবাসতো। আদরের অভাবে ছেলেটার অন্তরে সেই ছোট বেলা থেকে ক্রোধের আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে! ইয়াদ তার থেকে মেধাবী ছাত্র হওয়ায় ফলে তাকে লোকলজ্জার সম্মুখীন হতে হয়েছে বারংবার! এর থেকে তার মনে জন্ম নিয়েছে একরাশ হিংসা।
অথচ সবসময় রাফু মুখ বুজে প্রতিনিয়ত সহ্য করে গিয়েছে। কখনোই ইয়াদকে বুঝতে দেয়নি তার জলন্ত হৃদয়ের বক্তব্য। সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু কিছুদিন পূর্বে রাফু একটা সংঘাত অপকর্ম করে বসে। একটা মেয়েকে হত্যা করার প্রয়াস চালাই। মেয়েটার আর কেউ ছিলো না বরং তার স্ত্রী ছিলো। ইয়াদ বিষয়টা বোধগম্য করতে সক্ষম হয়। রাফু একপর্যায়ে হাতে নাতে ধরা খাই। রাফুর স্ত্রী ইয়াদের নিকটবর্তী সাহায্য চাই। বিষয়টা অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করে, ইয়াদ প্রমাণ পাই রাফু সত্যিই দোষী। প্রমানের ভিত্তিতে ইয়াদ নিজে পুলিশ এনে রাফুকে আ্যরেস্ট করাই। সেদিন ইয়াদের হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা ভিক্ষা চেয়েছিলযরাফু। কিন্তু ইয়াদ রাফুকে সুযোগ দেইনি। অপরাধীকে অপরাধের শাস্তি দিতে সে পিছু পা হয় নি। রাফু সেদিন ইয়াদের বিরুদ্ধে একটা কথাও বলে নি। শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষায় সে চুপচাপ ছিলো। কারাগারে যাওয়ার পূর্বে রাফু ইয়াদের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেছিল, ভাই মাফ করে দিও,আমি ভালো হয়ে যাব।

সেইদিন মুখে মিষ্টি কথা বললেও মনে মনে প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা করে রাখে সে। ঘটনাটা বছর চারেক আগে ঘটা। রাফু মাত্র বাইশ বছরে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল। কিন্তু তার বিয়েটা বছর খানিক ও ঠিকে নি। কারাগার থেকে বের হয়ে রাফু ইয়াদের পিছনে উঠে পড়ে লেগেছে। প্রথমে সে ভালো হওয়ার অভিনয় করে ইয়াদকে নিজের মায়াজালে ফাঁসিয়ে নেই। এরপর তার খেলা শুধু হয়ে যায়। জারা নামক এক অতি সুন্দরী রমণীর সাথে ইয়াদের যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দেয়। ইয়াদ সর্বপ্রথম জারা রুপে মত্ত হয়ে জারার প্রেমে পড়ে যায়। রাফুর প্লান অনুযায়ী সবকিছু ঠিকঠাক হচ্ছিল। সেবার সবে মাত্র এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল জারা। রেজাল্ট বেরুবার পূর্বে বাবার কাছে এন্ডোয়েট ফোন আবদার করে সে। কিছুদিনের মধ্যেই তার বাবা তার আবদার পূরণ করে দেন। ফোন পেয়েই নতুন ফেসবুক একাউন্ট খুলে জারা। রাফু তার বাবার বন্ধুর ছেলে হওয়ার সুবাদে বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো তাদের। জারার প্রতি ইয়াদের দুর্বলতা লক্ষ্য করে রাফু অন্যদিকে জারা মস্তিষ্ক‌ নিয়ে ভয়াবহ খেলাই মেতে ওঠে। জারাকে নিজের বোনের মতো ভালোবাসা দিয়ে তার বিস্বস্ত করে তুলে। জারা রাফুকে নিজের ভাইয়ের চেয়ে দ্বিগুণ ভালোবাসতো। মনের সব কথা রাফুকে শেয়ার করতো। এমনকি নানান বিপদের হাত থেকে রাফু জারাকে রক্ষা পর্যন্ত করেছে। এমন অভিনয় করেছে যে জারা তাকে বাবা মায়ের চেয়ে অধিক বিশ্বাস করতো।

জারার জীবন বেশ আনন্দময় ছিলো। বই প্রেমি বই পড়েই নিজের সময় অতিবাহিত করতো। কিন্তু একদিন তার মোবাইলে একটা নোটিফিকেশন এলো। সঙ্গে সঙ্গে জারা ফেসবুক অন করে দেখলো বর্ষণ বলে কোন এক ব্যক্তি তাকে ফেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছে। রাফুর সঙ্গে মিউচুয়াল দেখে তৎক্ষণাৎ রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করে নেই জারা। বর্ষণ নাম শুনেই তার বড্ড প্রয়াস জাগে লোকটাকে দেখতে। কিন্তু প্রোফাইল ঘুরেও কোন ছবির সন্ধান না পেয়ে সে হলো ক্ষুণ্ন! এভাবেই কয়েকদিন চলতে থাকে। হঠাৎ একদিন বর্ষণ নামের আইডি থেকে ছোট একটা মেসেজ আসে। জারা খানিকটা সংকোচের সহিত রিপ্লাই দেই। এরপর থেকেই শুরু হয় তাদের কথা বার্তা। জারা রাফুকে যখন জিজ্ঞাসা করে বর্ষণ কে, সেদিন রাফু উত্তর দেই তার বেস্ট ফেন্ড। শুধু তাই নয় বর্ষণে ভালো দিক গুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জারার কাছে পরিবেশন করে। রাফুর প্রশংসা শুনে জারা একতরফা বর্ষণকে ভালোবাসাতে আরম্ভ করে। দু মানবী দু নাকে না দেখেই ভালোবাসাতে আরম্ভ করে। এখানে দু জন বললে অবশ্য ভুল হবে। বর্ষণ অর্থাৎ ইয়াদ জারাকে দেখেই ভালবাসে। তাদের কথা বার্তা চলতে থাকে। ইয়াদ হঠাৎ একদিন অনেক গুলো চকলেট, চিরকুট,ফুল দিয়ে জারাকে প্রোফস করে! সেদিন সে রাফুর মাধ্যমে জারার ভার্সিটিতে জিনিসগুলো পাঠায়। নিজের ভালোবাসার মানুষটির কাছে থেকে এমন উপহার পেয়ে জারা খুশিতে ইচ্ছে মতো হাউমাউ করে কেঁদেছিলো সেই বিশেষ দিনে। ইয়াদের প্রপোজ একসেপ্ট করলেও জারা তাকে অদ্ভুত শর্ত দিয়ে বশে। আর তা হচ্ছে সে যতদিন না তাই ততোদিন কেউ কারো মুখ দর্শন করবে না। একে অপরকে না দেখেই ভালোবেসে যাবে অনন্তকাল। এ শর্তের পিছনেও রাফুর হাত ছিলো।

এভাবেই দীর্ঘ দু বছর অতিক্রান্ত হয়ে যায়। ইয়াদ আর জারার মুখশ্রী কখনোই দর্শন করেনি। তাদের রিলেশন চলা কালীন কখনো আগে থেকে জারাকে দেখার কথাটা সে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। তাদের সম্পর্ক আহামরি কোন কিছুই ছিলো না। প্রতিদিন তাদের প্রায়ই কথাবার্তা হতে। জারা এবং ইয়াদ একটা সময় একে অপরকে অতিরিক্ত ভালোবাসে ফেলে। না দেখেও ইয়াদকে ভালোবাসার একমাত্র কারণ হচ্ছে রাফু। জারা বড্ড গর্ব বোধ করতো তার বর্ষণকে নিয়ে। সে ভাবতো তার বর্ষণর তার রুপকে নয় বরং তার ভেতরে উপস্থিত আত্মাকে ভালোবাসে। সে ভাবতো রুপ তো অতি স্বল্প সময়ের। কিন্তু ভালোবাসা দীর্ঘ সময়ের। যে তাকে না দেখেই এতোটাই ভালোবাসতে পারে সেই লোকটা নিশ্চিত ভবিষ্যতে তাকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসে।

সবকিছু ঠিকঠাক চললেও রাফু তাদের সাক্ষাত হওয়ার আগেই নিজের প্লান ভালোভাবে প্রয়োগ করে। যখন সে আন্দাজ করতে পারে যে ইয়াদ জারাকে ভীষণ ভাবে ভালোবাসে ফেলেছে। তখন রাফুর ভেতরকর হিংস প্রাণী জেগে উঠে। জারা সঙ্গে কথা না বলে ইয়াদ এক মুহুর্ত ও অতিবাহিত করতে পারতো না। এক রাত জারার কন্ঠস্বর কর্ণপাত না করলে সারা রাত ছটফট করতো ইয়াদ। যা দেখে পৈশাচিক আনন্দে মেতে উঠতো রাফু। এমন সময় রাফুর ইয়াদকে ভুল বুঝাই । জারা তাকে ঠকাচ্ছে তা প্রমাণ করতে মেতে উঠে রাফু। অন্যদিকে জারাকে ইয়াদের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ তুলে। এমনকি জারা কে বলে ইয়াদ তার সঙ্গে ছলনায় মত্ত। ইয়াদ অনেক গুলো মেয়ের জীবন নিয়ে খেলা করে। সেদিন জারাকে কল দিয়ে সে বলে,

— সরি বোন। আমি তোমার ভাই হয়েও তোমার ক্ষতি করে দিলাম। বর্ষণের সঙ্গে থেকেও বর্ষণকে চিনতে পারি নি আমি। ও শুধু তোর সঙ্গে নয় অনেক মেয়ের সঙ্গে প্রেম নামক খেলায় মেতে উঠেছে। ওর বিবাহিত তা আমার অজানা ছিলো। বর্ষণ তোমাকে কোনদিনই ভালোবাসে নি। ওর ওয়াইফা সহ ও তোমাকে ঠকিয়েছে।

কথাগুলো শুনে জারা স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল জারা। অস্থির হয়ে থরথর করে কাঁপতে আরম্ভ করে ছিলো সে। গলা ফেটে চিৎকার করে কাঁদতে চেয়ে ও কাঁদেনি সে। শুধু কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছিল,

–আমি বিশ্বাস করে না ভাইয়া। আমার বর্ষণ আমাকে ঠকাতে পারে না। তুমি মিথ্যা বলছো।

রাফুর জারার প্রত্যুত্তরে দাঁত দাঁত চেপে বলেছিল,

— ওকে ফাইন। তুমি তোমার ভাইকে বিশ্বাস করলে না? ওয়েট, এই নেও বর্ষণের ওয়াইফের সঙ্গে কথা বলো।

রাফু আগে থেকে সম্পূর্ণ প্লান সাজিয়ে রেখেছিল। জারার সঙ্গে কথা বলার পূর্বে একটা মেয়েকে তার পাশ্ববর্তী রেখেছিলো। যাতে প্রমাণ স্বরুপ মেয়েটা ইয়াদের বিরুদ্ধে বানী প্রদান করে। মেয়েটা টাকার বিনিময়ে জারাকে মিথ্যা বক্তব্য দিয়েছিল। সে বলেছিল,

— আপু আমি বর্ষণে স্ত্রী। আপু ও খুব বাজে ছেলে। সবাইকে বলে বেরাই ও আর্মি। কিন্তু ও কোন চাকুরী করে না। ঘুরে ফিরে খাই আর মেয়েদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। তুমি ওকে বিশ্বাস করো না আপু।

মেয়েটার হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলা কথাগুলো শুনে জারার হাত থেকে মোবাইল ফোন পরে যায় । মুহুর্তেই তার চোখ জোড়া থেকে সমুদ্রের জল ঝড়নার স্রোতের ন্যায় গড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করে। জারা চেয়ে নিজেকে কন্ট্রোল রাখতে পারে নি সেদিন। জারা মেয়েটার সাথে কোন কথা বলার শক্তিই পাইনি। বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল সে। সত্যটা সহ্য করতে না পেরে মুহূর্তেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলো সে।

জারা হঠাৎ অজ্ঞান হওয়াতে ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল তার পরিবারের সবাই। খানিকক্ষণের জন্য পুরো বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গিয়েছিল। ওইদিন জারার অসুস্থতার খবর পেয়ে দ্রুত ছুটে আসে রাফু। জারা জ্ঞান ফিরার পর পরই রাফুকে লক্ষ্য করে। রাহুল প্রায় তিন ঘন্টা জারার সঙ্গে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করে। অবশেষে পরিবারের সদস্যরা যখন জারার রুমে একা করে যায়। ঠিক সেই সুযোগে রাফু জারার ব্রেন ওয়াশ করতে চলে আসে।
বিছানার উপর হেলান দিয়ে বসে অপলক নয়নে জল বিসর্জন দিচ্ছিল জারা। রাফুকে দৃশ্যমান হতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে জারা। রাফু জারার কান্না বেগ দেখে বলতে আরম্ভ করে,

— বোন সরি। আমাকে ক্ষমা করে দেও। আমি জানি আমার বোনটা অনেক স্টং। সে এমন কোন পদক্ষেপ নিবে না যে তার পরিবার কষ্ট পাই। ‌দেখো বর্ষণকে ভুলে যাও। ওর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে একবারে চিরতরে। একটু কষ্ট হবে কিন্তু খুব শীঘ্রই তুমি ভুলে যাবে। একজন মিথ্যাবাদীর সঙ্গে কথা বলাও অপরাধ। আর বর্ষণ তো শুধু মিথ্যাবাদী নয় ও একজন বিশ্বাস ঘাতক। তাই ওকে ভুলে যাওয়াটাই মঙ্গল। তুমি চিন্তা করো না তোমার ভাই তোমার বিশ্বাস ঘাতককে ঠিকই শাস্তি দেবে। আমি এর প্রতিশোধ নিবোই।

রাফুর কথাগুলো যেন তীরের ন্যায় বিঁধছে তার অন্তলারে। শুধু বিঁধছে নয় তার হৃদয় ক্ষত বিক্ষত করে তুলেছে। চোখ অশ্রুজলে তার মুখশ্রী ফুলে উঠেছে। রক্ত ক্ষরণ আরম্ভ হয়েছে তার হৃদয়ে। একপর্যায়ে জারা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো রাফুর সামনে। কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো,

— কিন্তু ভাইয়া, আমার পক্ষে এতো কঠিন কাজ কীভাবে সম্পূর্ণ করা সম্ভব! আমি পারবো না।

–না তোমাকে পারতেই হবে। আমি যেমন তোমাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছি ঠিক তেমনি ভাবে আমি তোমাকে উদ্ধার করব।

অতঃপর রাফু জারার কাছে থেকে তার ফেসবুক একাউন্ট এবং যে সিম দিয়ে ইয়াদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিলো সেই সিমটা নিয়ে নেই। জারাকে কিছুটা শান্ত করে পৈশাচিক আনন্দ মেতে ওঠে রাফু। তার প্লান অনুযায়ী সবকিছু ঠিকঠাক হচ্ছিল। এরপর রাফু ওই সিমে জারার চরিত্রে ইয়াদের সঙ্গে কথা। একদিন হঠাৎ মেসেজ আদান-প্রদানে‌ সে ইয়াদকে বলে,

–সরি বর্ষণ। আমি এতো দিন সম্পর্কটা সিরিয়াস নেই নি। আমি সময় কাটাতে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আমি অন্য একজনকে ভালবাসি। আমি দয়া করে আমাকে আর কোনদিন বিরক্ত করবেন না।

ইয়াদ জারার আকস্মিক এমন বক্তব্য শুনে বিষন্ন হয়ে পড়ে। অস্থির হয়ে পড়ে সে। অতঃপর ইয়াদ সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেসা করলো,

–কী হয়েছে জেবু ! আমি কি কোন ভুল করে ফেলেছি? মিথ্যা বলছো কেন?

বাক্যগুলো রাফুর দৃশ্যমান হতেই পুলকিত হয়ে উঠলো তার হৃদয় গহীন। অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সে। তার ইচ্ছে পূরণ হয়ে গিয়েছে। রাফু সেইদিন ইয়াদের কাছে জারাকে বাজে ভাবে উপস্থাপন করে। পারভেজ নামের ছেলেটার ছবি ইয়াদকে সেন্ড করে বলে, ‘এই দেখো আমার ভালোবাসার মানুষ’। জারার তিক্ত কথাগুলো শুনে ইয়াদ অঝোরে চোখের পানি ফেলে। ছেলেরা বুঝি সহজে কাঁদে। যখন তারা সহ্যের সীমা অতিক্রম করে , তারপর তা ধরনীর বুকে লোক চক্ষুর আড়ালে বিসর্জন করে। ইয়াদ সহ্য করেতে না পেরে জারার ন্যায় দুর্বোধ্য রহস্য ফেলতে আরম্ভ করে। পৃথিবীর দু প্রান্তে দুই ব্যক্তি বুকের ব্যাথায় অঝোরে এঁকে অপরকে ভুল বুঝে তিলে তিলে মারা যাবার শপথ গ্রহন করে। তাদের পরিস্থিতি অতিরিক্ত খারাপ হয়ে পড়ে। ইয়াদ সবচেয়ে বেশি দুঃখ পাই এটা ভেবে যে তার ভালোবাসা মিথ্যা, ছলনাময় ছিলো। তাই হয়তো তার প্রেমের পূর্ণতা পেল না। তার ভালোবাসার শক্তি এতোটাই কম ছিলো যে পারভেজ জারার জীবনে তার পরে প্রবেশ করে । তার ভালোবাসা সত্যি থাকলে জারা কখনোই অন্যকারো প্রেমে পড়তে পারতো না। একেই হয়তো ব্যর্থতা বলে। ভীষণ ব্যর্থতা! এরপর দু জন দুজনকে ভুল বুঝে কখনোই যোগাযোগ রাখে নি। রাফু তার সম্পূর্ণ পরিকল্পনায় সফলতা অর্জন করে। ইয়াদ অভিপ্রায় থাকা সত্ত্বেও জারার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেই। প্রচুর ঘৃণা সৃষ্টি হয় তার জেবুর প্রতি। সময় যতো অতিবাহিত হতে থাকে ঘৃণার পরিমাণ যেন দ্বিগুন থেকে দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। একটা সময় ইয়াদ সহ্য করতে না পেরে নেশা গ্রস্থ হয়ে পরে বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। পরিবারের সকলের সঙ্গে উম্মাদ পাগলের ন্যায় আচরণ করে। সেই সময়ে সমুদ্র ইয়াদকে সুস্থ করার প্রয়াস চালালেও ব্যর্থ হয় সে। ইয়াদের অবস্থা মেনে নিতে পারেনি নি ইসরাত বেগম। সুস্থ অর্থাৎ কথা বলতে পারে এমন ব্যক্তি স্ট্রোক করে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে। সমুদ্র মায়ের পরিস্থিতির জন্য ইয়াদকে দায়ী ভাবে এবং ইয়াদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা একদম বন্ধ করে দেই। দু ভাইয়ের সম্পর্কে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মায়ের বেগতিক দেখে পরিস্থিতিতে ইয়াদের মস্তিষ্ক ফির সঠিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হয়। মাস খানিকের মধ্যে ইয়াদ সুস্থ হয়ে পড়ে। সুস্থ হয়ে জারার বিশ্বাস ঘাতকতার শাস্তি দেবার পরিকল্পনা আঁটে। সে জারাকে তিলে তিলে শেষ করার উদ্দেশ্যে নিজের সঙ্গে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ করতে পরিশ্রম করতে আরম্ভ করে।
(চলবে)

[রিচেক দেই নি। ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:৪৮
#Lutful_Mehijabin (লেখা)

— আচ্ছা মেহের একটা কথা বলতো। সত্যি করে বলবি কিন্তু। স্যার কি রাতে তোর সঙ্গে ঘুমান?

দিশানির এহেন প্রশ্নে বিব্রত বোধ করলো মেহের। লজ্জায় মেয়েটার গাল যুগলে রক্তিম ধারণ করে উঠেছে ইতিমধ্যে! প্রায় মিনিট খানিক পার হয়ে গিয়েছে দিশানি এখনো প্রত্যুত্তরে অপেক্ষায় মেহেরের মুখশ্রীতে দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। এমন পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে তিতাস বিরক্তের চরমে পৌঁছে গিয়েছে। তৎক্ষণাৎ সেবিরক্তের চোখ মুখ কুঁচকে দিশানির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

— ওই মেয়ে চুপ থাক। তোদের এই মেয়েলি প্যাঁচাল আমার সামনে করবি না। দূর হ এইখান থেকে।

তিতাসের কথা শুনে দিশানের মুখশ্রী প্যংশুটে বর্ণ ধারণ করে উঠলো নিমিষেই। অতঃপর তিতাসের নিকটবর্তী এসে চিৎকার করে বলে উঠলো,

— তোর সমস্যা হলে তুই কান বন্ধ করে রাখ। আমাকে কিছু বলবি না। একবারে মেরে ফেলবো তোকে।

দিশানির কথার প্রেক্ষিতে তিতাস ক্রোধের সহিত বলে উঠলো,

— ফাল্তু পোলাপান!

তিতাসের কথাই অত্যধিক চোটে গেলো দিশানি। এরপর আরম্ভ হয়ে গেলো নিত্যদিনের ন্যায় তাদের বিখ্যাত তর্ক বিতর্ক। বিষয়টা পরিলক্ষিত করে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো মেহের। আজ ভীষণ আনন্দিত তার হৃদয়মন। খানিক পূর্বে দিশানির প্রশ্নে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তিতাসের উপকার পেয়ে হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। বর্তমানে তিতাস এবং দিশানির ঝড়গা দেখে হাসি চেপে রাখতে ব্যর্থ হলো মেহের। তার প্রাণচ্ছল হাসির ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলছে! কতোদিন পরে মন খুলে হাসছে সে!

অন্যদিকে কেউ যে আড়াল থেকে তার পুচকিকে হাসি দেখছে তা মেহেরের অজানা! দরজার সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সমুদ্র। বাচ্চাদের মতো খিলখিল করে হাসতে দেখে তার হৃদয় পুলকিত হয়ে উঠেছে। মেহের হাস্যরত অবস্থায় দেখে তার বুকের ভেতর হিম শীতল হাওয়া বইছে। পরম শান্তিতে মেহেরের দিকে দৃষ্টিপাত আবদ্ধ করে রেখেছে সমুদ্র। মেহেরকে হাসতে দেখে তার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। ইশ,তার পুচকিটাও খিলখিলিয়ে হাসতে জানে! এতো দিনে সমুদ্রের অপেক্ষার প্রহরের সমাপ্তি ঘটলো। লোকে বলে স্বামীর প্রতিচ্ছবি স্ত্রীর মাঝের স্পষ্ট ফুটে উঠে। কথাটা চিরন্তন সত্য। স্বামী যেমন চরিত্রের অধিকারী হবে স্ত্রী ঠিক একই চরিত্রের অধিকারী হবে। তা ভালো হোক বা মন্দ। সমুদ্রের প্রতিচ্ছবি যেন মেহেরের মধ্যে স্পষ্ট! সমুদ্র কখনো মেহেরকে তার সমবয়সী মেয়েদের মতো মন খুলে হাসতে দেখে নি। সমুদ্রের ধারণা মেহের প্রাণচাঞ্চল্য নয় বরং গম্ভীর প্রকৃতির। একদমই হাসতে জানে না। কিন্তু সমুদ্রকে ভুল প্রমাণিত দিলো মেহের। তার খিলখিল হাসি যেন একদম সমুদ্রের বুকে গিয়ে বিঁধছে।

তিতাস এবং দিশানি ঝগড়া করতে এতোটাই বিভোর যে মেহেরের হাসি তাদের পরিলক্ষিত হলো না। কিন্তু আচমকা স্তব্ধ হয়ে পড়লো তিতাস। দিশানি তার মতো বকবক করতে ব্যস্ত। একটা সময়ে তিতাস নানান অঙ্গভঙ্গি করে দিশানিকে থামতে বলো। কিন্তু দিশিনি চুপ হবার মেয়ে না। তিতাসের নিরবতা দেখে হাল্কা হেসে বলে উঠলো,

— ওই চুপ করে আছিস কেন? জানিস আমার সাথে তুই তর্কে জিততে পারবি না। তাহলে কেন শুধু শুধু আমার মুড খারাপ করতে আসিস?

দিশানির কথার শুনে শুকনো ঢোক গিললো তিতাস। খানিক পূর্বে সমুদ্রের উপস্থিতি টের পেয়েছে সে। এমনত অবস্থায় ভীষণ ভয় পাচ্ছে সে। অতঃপর পরিবেশের প্রেক্ষিতে তিতাস ভদ্রতার সহিত সমুদ্রকে বলে উঠলো,

–স্যার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভেতরে আসুন।

হঠাৎ সমুদ্র নামটা মেহেরের কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্রই মেহেরের হাসি উধাও হয়ে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে হাসি থামিয়ে দরজার দিকে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করলো সে। তৎক্ষণাৎ দিশানিও থতমত খেয়ে গেলো। মুহূর্তেই তার মুখশ্রীতে চিন্তার প্রাদুর্ভাব ঘটলো। মাথা নিচু করে চোখ বুজে প্রতিনিয়ত বিরবির করে দোয়া পড়তে লাগলো।‌

আকস্মিক তিতাসের ডাকে বিরক্তি ভাঁজ দেখা দিলো সমুদ্রের মুখশ্রীতে। তিতাসের প্রতি অতিরিক্ত বিরক্ত সে! ফলে তার মুখ হতে বিরক্তির ‘চ’ শব্দ নির্গত হলো আপনি আপনি। বিরক্তি হাওয়াটাই স্বাভাবিক। আজ তিতাসের জন্য তার পুচকিটা হাসি বন্ধ করে ফেলছে। অতঃপর সমুদ্র নিজের ধাতস্থ রাখার প্রয়াসে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এখন তার নিজকে নিয়ন্ত্রণ রাখা বড্ড প্রয়োজন। তাই চোখ জোড়া এক সেকেন্ডের জন্য বন্ধ করে নিজকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে প্রয়াস চালালো সমুদ্র। লহমায় সে দ্রুত প্যান্টের পকেটে দু হাত হাত গুজে সোফায় উপর এসে আয়েশ করে বসলো। অতঃপর দিশানি এবং তিতাসকে বসতে বলে মেহেরের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

— গো পুচকি। দেখো, টেবিলে উপর খাবারের প্যাকেট রাখা আছে। যাও গিয়ে খাবার সার্ভ করো। একটু পর আমরা আসছি।

সমুদ্রের আদেশ পেয়ে এক মুহুর্তের জন্যও অপেক্ষা করলো না । মাথা নিচু করে রুম হতে প্রস্থান করলো। যাওয়া পূর্বে তিতাস এবং দিশানির দিকে একপল তাকিয়ে পা জোড়া ধাবিত করলো। বরাবরের ন্যায় সমুদ্রের কথা শুনে তার হৃদয় গহীন অশান্ত হয়ে উঠেছে। বারংবার তার কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনি তুলছে দিশিনির বলা অদ্ভুত বাক্যে! এতে করে বেশ দ্বিধা,সংকোচ,সংশোয় আবির্ভাব ঘটেছে তার অন্তরালে। দিশানিকে কি উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছে না মেহের।

___

সোফার উপর বসে আকস্মিক সমুদ্র দিশানিকে উদ্দেশ্যে করে বলে উঠলো,

— দিশানি, কাম হেয়ার।

তৎক্ষণাৎ দিশানি চমকে উঠলো। তিতাস বসে পড়েছে ঠিকই কিন্তু দিশানি এখন অবধি ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়েছে। দিশানির পরিস্থিতি লক্ষ্য করে সমুদ্র বলে উঠলো,

–আজব তো! আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছো কেন?

সমুদ্রের প্রত্যুত্তরে দিশানি ঝটপট জবাব দিলো,

— সরি স্যার।

দিশিনির কথা শুনে তপ্ত শ্বাস ত্যাগ করলো সমুদ্র। অতঃপর হেঁয়ালি না করে বলল,

— তোমার আম্মু তোমাকে বাসায় ড্রফ করে দিয়ে আসতে বলেছে। তোমার নানু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাই তোমাকে যেতে হবে।

সমুদ্রের কথা শুনে নিমিষেই দিশানির মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো,

— ঠিক আছে চলুন স্যার।

— তিতাস তুমি কি থাকবে?

সমুদ্রের কথার প্রত্যুত্তরে তিতাস বলল,

— স্যার আজ নাহয় আমি ও আসি।

___________

অন্যদিকে ভীষণ চিন্তা গ্রস্থ হয়ে পরেছে রাফু। তার চিন্তার যেন শেষ। এবার খুব করে প্লান করেছিল জারাকে ফাঁসিয়ে ইয়াদকে পুনরায় ছটফট করে দেখবে। সেই অনুযায়ী পারভেজকে দিয়ে ইয়াদকে মারার চেষ্টা করছে সে। কিন্তু পারভেজ আটক হওয়াতে ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে সে! ভয় করছে তার যদি পারভেজ ভুল বশত সত্যিটা ইয়াদকে বলে দেই। তাহলে তো জারা সবকিছু জেনে যাবে। সেও তার বর্ষণের খোঁজ পাবে। বর্ষণ আর ইয়াদ যে একই ব্যক্তি বিষয়টা বিয়ের পরেও ইয়াদ গোপন করেছে জারার কাছে থেকে। হয়তোবা জারা যদি জানতে পারে ইয়াদই তার অতীতের প্রেমিক বর্ষণ তাহলে সে কোনদিনই ইয়াদকে ক্ষমা করতে পারবোনা। কারন ইয়াদ একজন স্পষ্ট মিথ্যাবাদী। ইয়াদের উচিত ছিলো জারাকে খুলে বলা। কিন্তু সে বলে নি।

পারভেজ সত্যি বলে দিলে ইয়াদ ঠিকি বুঝে যাবে তিন বছর পূর্বে যে ম্যাসেজ গুলো তাকে জারা পাঠিয়েছিল , সেগুলো যে জারা নয় বরং রাফু টাইপিং করেছিল তাও ইয়াদ স্পষ্ট বুঝে যাবে! এই চিন্তায় রাফু পাগলপ্রায়। জারা আর ইয়াদ সত্যটা জানতে পারলে নিজেদেরকে মধ্যে বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা দূর করতে উঠে পড়ে লাগবে। জারা কিছু করুক আর না করুক ইয়াদ নিজের চোখের জল বিসর্জন দিয়ে হলেও জারার মনে ফির জায়গা করে নিবে। তাছাড়া ইয়াদ রাফুর শাস্তির ব্যবস্থা করবে নিশ্চিত। বিষয়টা খানিকক্ষণ যাবত ভাবছে রাফু। আর বিরবির করে নিজে নিজেকে বলছে,

— পজেটিভ ভাব রাফু। কিছু হবে না তোর। পারভেজ মরে গেলেও কিছু স্বীকার করবে না। কারন ওর দুর্বলতা আমার কাছে। কিছু হবে না। নো টেনশন রাফু।
_______________________

ঘড়ির কাঁটায় ছুঁই ছুঁই আটটা। মাত্র পড়ার সমাপ্তি ঘটিয়ে ড্রইং রুমে খাবার সার্ভ করতে ব্যস্ত মেহের। সমুদ্র কেয়ারে বসে কারো সঙ্গে দরকারি বিষয়ে আলোচনা করছে। দিশানিরা বিদায় দিয়ে সেই দুপুর বেলা লান্স করে। মেহেরের মনটা ভীষণ বিষাদময় হয়ে রয়েছে। একে তো দিশানিরা চলে গিয়েছে দ্বিতীয়ত বিকেলে সাফাত স্যার এসেছিল। স্যারের অঙ্গভঙ্গি তার নিকট অত্যধিক বিরক্তিকর লেগেছে। অবশ্য আজও বেলকনিতে বসে লেপটপ নিয়ে কাজ করছিলো সমুদ্র। এতে করে মেহের নিজেকে ঠিক রাখতে সক্ষম হয়েছে।
___
খাবার প্লেটে দিকে দৃষ্টিপাত আবদ্ধ করে বসে রয়েছে সমুদ্র। খানিক পূর্বে মেহেরের খাবার খেয়ে হাত পরিস্কার করে বসে রয়েছে। কিন্তু সমুদ্র খাবার না খেয়ে নিশ্চুপ হয়ে বসে রয়েছে। খাবার মুখে নিতে নারাজ সমুদ্র। তার মুখশ্রীতে গম্ভীর ভাব স্পষ্ট। সে ভেবে চলছে, মেহেরের কি বোধগম্য হচ্ছে না তার মনের অবস্থা! সে তো অভিমান করে রয়েছে। তা কেন মেহের আন্দাজ করতে সক্ষম হচ্ছে না।

একপর্যায়ে প্লেট থেকে চোখ সরিয়ে মেহেরের দিকে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করলো সমুদ্র। অতঃপর ঠোঁট যুগল প্রসারিত করে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,

— পুচকি, আমি খাবো না।

মেহের সমুদ্রের কথা শুনে থতমত হয়ে পড়লো। পরিস্থিতি মেহেরের বোধগম্য হওয়ার পূর্বে আচমকা কলিং বেল ধ্বনি পেয়ে সমুদ্র চেয়ার থেকে উঠে মেইন ড্রোরের দিকে ধাবিত হলো। যে ব্যক্তি কলিং বেল বাজিয়েছে তার উপর ভীষণ বিরক্ত হলো। লোকটার জন্য সে মেহেরের সঙ্গে একটুও অভিমান করতে পারলো না।

তৎক্ষণাৎ ড্রোর খুলে দিলো সমুদ্র। অপর প্রান্তে শোয়াইব খানকে দৃশ্যমান হতেই পুলকিত হয়ে উঠলো তার হৃদয় গহীন।
(চলবে)

[দুঃখিত,রিচেক দিতে পারিনি। ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]