তুমি রবে নীরবে পর্ব-১৭+১৮

0
22
তুমি রবে নীরবে

#তুমি_রবে_নীরবে (১৭)
~নাদিয়া সাউদ

কথাটা তবে দিব্যি মনে রেখেছে মেয়েটা!অথচ রওনক ভেবেছিল কালকের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেছে কুহু!সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ভালই জানে দেখা যাচ্ছে!চোখ ছোট ছোট করে কুহুর ভেজা মুখে তাকিয়ে আছে রওনক।চিকন নাকের ডগা বেয়ে পানির স্রোত নামছে অবলীলায়!ভীড় জমাতে চাচ্ছে পাতলা অধরযুগলে!গালে লেপ্টে আছে চুল!জলের তান্ডবে চোখ বারংবার বুজে আসতে চাইছে।অদ্ভুত এক মোহ নিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে রওনক!ঠিক যেন বর্ষার প্রথম কদম ফুটেছে!যার স্নিগ্ধতা ছড়িয়েছে রওনকের অন্তঃকরণে!অনেকটা সময় নিশ্চুপ অতিবাহিত হলো।আরো খানিকটা কুহুর দিকে ঝুঁকে গেল রওনক।দ্রুত পেছাতে গিয়ে টাইলসের মেঝেতে পা পিছলে গেল কুহুর!টাল সামলাতে পারলো না সে।পরে যাওয়ার আগ মুহূর্তে স্বীয় বলিষ্ঠ হাতে সামলে নিল রওনক!চোখমুখ খিঁচিয়ে নিয়েছিল কুহু!কটিদেশে শক্তপোক্ত স্পর্শ পেতেই মুহূর্তে চোখ মেলে তাকাল।সম্মুখে থাকা পুরুষের ভেজা শার্ট খামছে ধরে আছে সে!শুভ্র রঙা ভেজা শার্টে চওড়া বক্ষস্থল সুস্পষ্ট রওনকের!কুহুর মুখের উপর খানিকটা ঝুঁকে থাকার দরুন রওনকের থুতনি চুইয়ে জল পরছে কুহুর মুখাবয়বে!ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত রহস্যময় এক হাসি!এক ঝটকায় কুহুকে দাঁড় করিয়ে দিল রওনক।চারিদিকে পানির শব্দ বদ্ধ ওয়াশরুমে তরঙ্গের মতো বাজছে!কুহু বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই হাত চেপে ধরলো রওনক।ঘাড় ঘুরিয়ে হাতের উপর দৃষ্টিতে তাকাল কুহু।রওনকের ভেজা হাতে লেপ্টে আছে লোম!হ্যাচকা টানে কুহুকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিল রওনক!বেশ চমকে উঠলো কুহু!দৃষ্টি ফেলল রওনকের চোখে।কুহুর গালে লেপ্টে থাকা চুলগুচ্ছ কানের পেছনে গুঁজে দিল রওনক।অপ্রস্তুত হয়ে বার কয়েক চোখের পাতা ঝাপটালো কুহু।মেঝেতে দৃষ্টি রেখে রওনককে বলল ছেড়ে দিতে।তপ্ত শ্বাস ফেলে কুহুর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল রওনক,

“প্রতিশোধ নিতে চাইছ?তবে লড়াই টা সমানে সমানে হোক!যে কারণে আমাকে শাস্তি দিতে চাইছ তুমিও সেই একই কাজ করতে পারো!তাহলেই তো শোধবোধ!আমিও দেখি কতখানি প্রতিবাদী তুমি!এখানে একসপ্তাহ থাকার তো কোনো কারণ দেখছি না!

রওনকের কথায় মৃদু কেঁপে উঠলো কুহু!সাংঘাতিক সব কথাবার্তা!রওনক ভাই চুমু খেয়েছে বলে তাকেও চুমু খেয়ে প্রতিশোধ নিতে হবে?কি বদমাইশি চিন্তাভাবনা!শক্তপোক্ত বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বেরিয়ে গেল কুহু!মুচকি হেসে উঠল রওনক!জব্দ ভালই হয়েছে মনে হলো।রুমে আসতেই কুহু খেয়াল করলো হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে তার।পায়ের রগে টান অনুভব হচ্ছে!বেকায়দায় পরে যাওয়ার সময় এমনটা হয়েছে বোধহয়!রাগে চোখমুখ বিশ্রিরকম কুঁচকে গেল কুহুর।সব হয়েছে রওনক ভাইয়ের জন্য।একটু আধটু জ্বালিয়ে তো মন ভরে না মহাশয়ের!এই জন্য কুহুকে সারাজীবনের জন্য বন্ধী করে নিয়েছে কয়লা বানিয়ে ফেলার জন্য!কোনোমতে পা খুঁড়িয়ে গিয়ে ওয়ারড্রব থেকে জামা বের করে নিল কুহু।এগিয়ে গিয়ে দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে দিল।পা মনে হচ্ছে অসহ্যরকম ব্যাথা করছে!কোনোরকম গা মুছে জামা পাল্টে নিয়ে ফ্যান ছেড়ে চুল খুলে বসল।আকাশ সম্পূর্ণ কালো চাদরে নিজেকে মুড়ে নিয়েছে।এই রাত্তিরে ভেজার ফলে ঈষৎ শীত ভাব চলে এসেছে শরীরে।ওয়াশরুম থেকে রওনকের ডাক আসছে অনবরত!বেশ জোড়াল স্বরে চেঁচাচ্ছে।কপালে আবারও রাগের সুক্ষ্ম ভাজ পরলো কুহুর।এই পা নিয়ে এখন এতদূর কি করে যাবে ও?ফোঁস করে দম ফেলে মেঝে থেকে ভেজা কাপড়চোপড় তুলে নিয়ে কোনোরকম খুঁড়িয়ে ওয়াশরুম অবধি আসল।কুহুর হাঁটা টা স্পষ্ট খেয়াল করল রওনক!ঘরে গিয়ে আবার পরে গেল নাকি মেয়েটা?কুহু দরজার কাছে এসেই দৃষ্টি তুলে তাকাল।শার্টের সবকয়টা বোতাম খোলা রওনকের।ভেজা লোমশ বক্ষস্থলে দৃষ্টি পরতেই কেমন অপ্রতিভ হলো কুহু।রওনক ভাই আসলেই একটা নির্লজ্জ!দাঁত কিরমিরিয়ে বলল,

“ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছেন কেন?

” পায়ে কি হয়েছে তোমার?

অকপটে প্রশ্ন রওনকের।নিজের পায়ের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল কুহু,

“তখন পরে যাওয়ার সময় মনে হয় ব্যাথা পেয়েছি।হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে।

রওনকের মুখ জুড়ে চিন্তার ছাপ!ভেজা শরীরে এগিয়ে এসে কুহুর হাত থেকে ভেজা জামাগুলো নিয়ে বাথরুমে ছুঁড়ে ফেলল।নরম গলায় বলল,

” আমি তো ডাকছিলাম তোয়ালে দিয়ে যাওয়ার জন্য।তুমি বললেই হতো পায়ে ব্যাথা!

“আপনি যেভাবে ডাকছিলেন না এসে উপায় ছিল না।

বাকি আর কথা বাড়াল না রওনক।কুহুর গলা থেকে একটানে সুতির ওড়নাটা খুলে নিল।আশ্চর্য হয়ে হতভম্ব হয়ে গেল কুহু!আচমকা শরীর কাটা কাটা করে তুলল তার!রওনক ভাই এরুপ কিছু করবে কল্পনাতীত ছিল!কুহু কাঠের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল!রওনকের অধরজুড়ে দুষ্টু এক হাসি।কুহুর ওড়না দিয়ে নিজের চুল মোছায় ব্যস্ত সে।

” রওনক কি শাওয়ার নিয়েছ নাকি?

তোহার কথায় চমকে গেল কুহু!ঘুরে তাকাবার সাহস করল না।ভাবী আর মা কখন আসলো?সদর দরজা তো খোলাই ছিল।চোখমুখ খিঁচে নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য দ্রুত পা ফেলল সে।পায়ে টান অনুভব হতেই ধপাস করে বসে পরল!বিচলিত হয়ে বড়ো বড়ো পা ফেলে কুহুর সম্মুখে গিয়ে বসল রওনক।তোহা বুঝতে পারলো না কিছুই!কুহুকে আরো চারদফা অবাক করে দিয়ে তোহার সামনেই কোলে তুলে নিয়ে বলল রওনক,

“ব্যাথা নিয়ে হাঁটতে গেলে কেন?

তোহা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে!রওনকের গলায় কুহুর ওড়না দেখে মিটিমিটি হাসছে।কুহু লজ্জায় কুটিকুটি হয়ে গেল।ক্রমেই মুখ লুকালো রওনকের চওড়া বুকে!সম্ভব হলে এক্ষুনি এই রওনক ভাইকে জ্যা’ন্ত পু’তে দিত!এতটুকু বয়সে কখনো এরকম লজ্জাকর পরিস্থিতি পরেনি কুহু!রওনক তোহার দিকে তাকিয়ে বলল,

“ভার্সিটি থেকে সোজা এখানে চলে এসেছি।ফ্রেশ হওয়ার পর খেয়াল হলো আমি এক্সট্রা ড্রেস আনিনি।ফুয়াদ ভাইয়ের থেকে একটা ম্যানেজ করে দিন ভাবী।

কুহু সেই যে ঘাপটি মেরেছে।মাথা তুলবার খবর নেই।তোহা বেশ বুঝতে পারলো কুহুর লাজুক অবস্থা!শব্দ করে হাসতে হাসতে চলে গেল সে।রুমে এসে খাটের উপর কুহুকে নামিয়ে দিল রওনক।মুহূর্তেই কেমন অগ্নিমূর্তির রূপ নিল কুহু।তেড়ে এসে রওনকের গলায় থাকা ওড়না ধরে বলল,

” কি করলেন এটা ভাবীর সামনে?উপরওয়ালা কি একটুও লাজলজ্জা দেয়নি আপনকে?কি ভাবছে এখন ভাবী?

ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলল রওনক,

“আমি সিউর তোহা ভাবী আরো অনেক কিছু ভেবে নিয়েছে!অবশ্য ওসব ব্যাপার না।আমরা নবদম্পতি সেটা সে জানেই।

” জানে মানে?কি সব উল্টাপাল্টা কথা বলছেন!আর ওড়না কেন টেনে নিলেন?

“কোনো পরপুরুষ তো নেয়নি!আমার সামনে ওভাবে থাকাটা কোনো অসস্থিকর কিছু না সেটাই বোঝাতে নিয়েছি।তবুও মোটা মাথায় যদি একটু বুদ্ধির উদয় হয়!

গলার ওড়না বেশ শক্ত করে টেনে ধরে বলল কুহু,

” মে’রে ফেলবো!এক্ষুনি খু’ন ফেলব আপনাকে!

“ওইটুকু চড়ুইয়ের শক্তিতে আর যাই হোক আমার শ্বাস’রো’ধ করতে পারবে না।একবার যদি আমি শক্তি খাটাই তাহলে কি হবে ভাবতে পারছ?

কুহু যেন হালকা মিইয়ে গেল।তবে রাগের তেজ একটুখানিও কমলো না!পুরুষ শক্তির কাছে অবশ্যই পরাজিত হবে সে।মনে হচ্ছে রাগানো ঠিক হবে না।এই লোক কি করতে কি করে ফেলে ঠিক নেই!দু’হাতেে কুহুর কোমড়ে জড়িয়ে ধরে বলল রওনক,

” মা’রছো না কেন?মে’রে ফেলো!আমি হাসতে হাসতে প্রাণ দিয়ে দিব!দেখো তখন কিন্তু আবার বলো না,আমি আপনাকে হারাতে পারবা না রওনক ভাই!কুহু অস্তিত্বহীন আপনি ছাড়া!

দরজায় টোকা পরলো।তোহা ডেকে উঠলো।কুহুকে ছেড়ে দিয়ে দরজার কাছে গেল রওনক।হাতে টিশার্ট আর লুঙ্গি নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে তোহা।হাত বাড়িয়ে নিতে গিয়ে থমকে গেল রওনক!লুঙ্গি আগে কখনো পড়া হয়নি তার।বাসায় ট্রাউজার নয়তো থ্রি-কোয়ার্টার পরে অভ্যস্ত!কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল রওনক।একটা দিনেরই তো ব্যাপার!ম্যানেজ করে নিবে কোনোমতে!


বাসায় আসার পর দুপুরের খাবার খায়নি রিশা।খাটের এককোনায় পরে ছিল।মেয়ের মন খারাপটুকু বোধহয় কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছেন শারমিন বেগম।মায়ের মন।সন্তানের কিছু হলে সবার আগে টের পায়।মাথায় হাত বুলিয়ে মেয়ের মনের অবস্থা জানতে চাইলেন।মাথা ব্যাথা আর অসুস্থতার দোহাই দিল রিশা।ছোট থেকে মেয়েটা বড্ড চাপা স্বভাবের আর শান্ত।কখনো মুখ ফুটে কিছু বলে না।পছন্দের খাবার,পোশাক যাই হোক কখনো মন খুলে আবদার করেনি।মা,বাবা যেটা পছন্দ করে দিয়েছে তাতেই রাজ্যের খুশি খুঁজে নিয়েছে।এটা ভাল নাকি মন্দ গুন বুঝতে পারলেন না শারমিন বেগম!সবকিছু চেপে রাখা অনুচিত!রিশার মুখ থেকে কোনো কথা বের করতে না পেরে ওঠে চলে গেলেন শারমিন বেগম।ঘড়িতে রাত আটটা।মনটা প্রচন্ড খারাপ লাগছে রিশার।ওঠে ব্যাগ হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল।যাওয়ার আগে মাকে বলে গেল ফুচকা খেতে বেরিয়েছে।অগত্যা আর কিছু বললেন না শারমিন বেগম।

,

ফার্মেসির দোকানে দাঁড়িয়ে আছে রিশা।তার বন্ধুর বাবার ফার্মেসি।এখান থেকে সহজেই ঘুমের ঔষধ কিনে নিতে পারবে সে।বাকি কাস্টমার বিদায় হতেই হাসিমুখে রিশার সামনে এসে দাঁড়াল আরিয়ান।এখান থেকেই প্রয়োজনীয় সব মেডিসিন নিয়ে যায় রিশার বাবা।একটুখানি হাসি ফিরিয়ে দিয়ে এক পাতা ঘুমের ট্যাবলেট চাইল রিশা।আরিয়ান খুব ভাল করেই জানে কোন ঔষধ টা রিশার বাবা খায়।সেটাই দিয়ে দিল সে।ছোট্ট একটা হাসি ফিরিয়ে দিয়ে টাকা দিয়ে চলে আসলো রিশা।রাস্তার ফুটপাত ধরে আনমনে হাটতে লাগল।বারংবার চোখে ভেসে উঠছে আশফিক ভাই আর ওই বিদেশিনীর মুখটা!যতবার মানস্পটে ভেসে উঠছে ততবার অন্তঃকরণে র’ক্তক্ষ’রণ বইয়ে দিচ্ছে!এইটুকু ভোলার জন্যও আজকে একগাদা ঘুমের ঔষধ গিলতে হবে রিশার।এই মুহূর্তে ম’রে গেলেও মনে হচ্ছে যন্ত্র’ণা কম হতো!যেটা আমাদের ভাগ্য নেই কেন সেটার জন্য মন পুড়বে?বিধাতা কেন মন নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দেননি মানুষকে?তাহলেই তো কষ্ট থাকতো না কোনো!

“আইরিশ?

পুরুষসুলভ কন্ঠস্বর পেয়ে ভাবনার ঘোর কাটলো রিশার।পাশে তাকাতেই দেখল হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে রাতিম ভাই।নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো রিশা।ততক্ষণে হাসিমুখে এগিয়ে আসলো রাতিম।

” আজকেই তো দেখলাম হাতভর্তি কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরলে!আরো কিছু বাকি আছে নাকি?এই রাতে বের হলে!

রাতিমের কথার ঠিক কি জবাব দেবে বুঝতে পারলো না রিশা।অপ্রতিভ হয়ে কোনোরকম বলল বাবার জন্য ঔষধ কিনতে বেরিয়েছে সে।রাতিম খানিকটা ভাবুক ভঙ্গিতে রিশাকে পর্যবেক্ষণ করলো।কোথাও একটা মনে হলো রিশা তাকে মিথ্যে বলেছে!চাপা কিছু একটা লুকিয়ে আছে তার মাঝে।নিয়ন বাতির হলদে আলোয় রিশার মলিন মুখখানা সুস্পষ্ট দেখতে পেল রাতিম।কপালে সুক্ষ্ম ভাজ পরলো।কেন জানি মনে হলো মেয়েটা কেঁদেছে!ভীষণ মন খারাপ তার!কিন্তু কারণ কি?চট করেই রাতিম বলল,

“আমার মন টা আজ খুব খারাপ আইরিশ।হাইওয়ের সাইডে একটু হাঁটবো।তুমি কি আমায় সঙ্গ দিবে?

চলবে……

#তুমি_রবে_নীরবে (১৮)
~নাদিয়া সাউদ

দৃষ্টি তুলে রাতিমের চোখের দিকে তাকাল রিশা।যাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও মুখে সেটা উচ্চারণ করতে পারছে না সে।মনখারাপ ঠিক কতটা অস্থির করে তোলে সেটা রিশার চেয়ে ভাল কেউ জানে না।তার একটুখানি সঙ্গ পেয়ে একটা ছেলের মন ভাল হলে ক্ষতি কি!মাথা কাত করে সায় জানাল সে।মুখে হাসি ফুটলো রাতিমের।একদৌড়ে টং দোকানে ছুট লাগাল সে।দুইকাপ চা অর্ডার করল।সেদিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রিশা।সে তো ঠিকই অন্যের মন খারাপের সঙ্গী হতে রাজী হলো তার মন খারাপের সঙ্গ দিবে কে?রাতিম কয়েক হাত দূরেই দাঁড়িয়ে আছে।দৃষ্টি রিশার উপর।এই রাস্তা দিয়ে প্রায়ই যাতায়াত করে রাতিম।রিশার বেলকনির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে কোনো কোনো দিন।তবে দেখা মেলেনা কখনো।খানিক্ষন আগেই এই টং দোকানে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিল সে।কাকতালীয় ভাবে রিশার সঙ্গে কেমন দেখা হয়ে গেল!এ যে মেঘ না চাইতে বৃষ্টি পাওয়ার মতো অবস্থা!গরম ধোঁয়া উঠা চা হাতে রিশার সামনে আসলো রাতিম।বাড়িয়ে ধরল ওয়ানটাইম কাপ।হাতে তুলে নিয়ে হাঁটা ধরলো রিশা।ভেবেছিল বাড়ি গিয়ে কোনোরকম ঘুমের ঔষধ গিলে শুয়ে পরবে অথচ এখানে সে এখন চা খাচ্ছে!চারিদিকে বেশ কোলাহল।ফুটপাত ধরে হাঁটছে অগণিত লোক।ব্যস্ত শহরের পাশাপাশি হেঁটে চলছে দু’জন যুগল।একজনের ভেতর পাহারসম প্রেম অপর জনের ভেতর কেবল কষ্ট আর হাহাকার!বেশ অনেকক্ষণ নীরবতায় কাটলো।ভীড় ছাড়িয়ে হাইওয়ের রাস্তায় চলে এসেছে দু’জন।পাশ ফিরে তাকিয়ে বলল রিশা,

“তা আপনার মন খারাপ কেন রাতিম ভাই?

চা শেষ হতেই কাপটা ছুঁড়ে ফেলল রাতিম।দু-হাত পকেটে পুরে নিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,

“আসলে মনের উপর আমাদের হাত থাকে না।হুট করেই মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে।কারণ বুঝতে পারছি না।মানব জীবন বড়োই অদ্ভুত!

প্রতিত্তোরে কোনো জবাব দিল না রিশা।কারণহীন মন খারাপ সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই।মনে হচ্ছে এখানে অহেতুক সময় নষ্ট না করে বাড়ি চলে যাওয়াই ভাল।

” আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তোমার মন খুব খারাপ আইরিশ।সেটা আমার মতো হুটহাট করা মন খারাপ নয়।অনেকদিনের।

রাতিমের কথায় চমকে উঠলো রিশা!মুখের আদলে কি কিছু ভেসে উঠলো নাকি!যতেষ্ট স্বাভাবিক হয়ে বলল সম্পূর্ণ ঠিক আছে সে।কথাটা বিশ্বাস হলো না রাতিমের উল্টো সন্দেহ বাড়ল!আচমকাই কেমন অপ্রতিভ হয়ে গেল রিশা!এই পর্যন্ত রিশার সম্পর্কে যতটুকু জানে খুবই শান্ত স্বভাবের মেয়ে!দূরে দূরে থাকলেও রিশার সমস্ত খবর রেখেছে রাতিম!এখন জোড়ালো ভাবে রিশার মন খারাপটুকু জিগ্যেস করতে পারছে না।সে অধিকারটুকু নেই!আচমকাই ভেতর মরিয়া হয়ে উঠলো রাতিমের।কৌশল খাটালো সে।

“একটা কথা কি জানো আইরিশ।মন খারাপ যত নিজের মাঝে চেপে রাখা হয় ততই সেটা ভয়ংকর রূপ নেয়।আর একসময় ডিপ্রেশনে পরিনত হয়।এই যে আমাকে দেখো যখনই একটু মন খারাপ হয় আমি তখনই মন ভাল করার উপায় খুঁজতে থাকি!কিসে আমার আনন্দ,শান্তি খোঁজার চেষ্টা করি।এই যে একটু আগে মন খারাপ ছিল।এখন খোলা আকাশের নিচে হাঁটছি সঙ্গে তোমায় পেলাম সঙ্গী হিসেবে।দেখ আর একটুও মন খারাপ নেই আমার!তেমনি তুমি চাইলে আমাকে মন খারাপের কারণ টা শেয়ার করতে পারো।আমার আরেকটা দারুণ পরিচয় আছে।মন ভাল করে দেবার স্পেশালিষ্ট!একবার শুধু মন খারাপের কারণটুকু বলো আমি ভাল করার উপায় বলে দিচ্ছি মেয়ে!

কথাটুকু বলেই শার্টের কলার ঝাঁকিয়ে একটুখানি ভাব নিল রাতিম।দৃশ্যটা দেখে কেন জানি হেঁসে ফেলল রিশা।রাতিম ভাইয়ের এই রূপ তার কাছে নব্য!লোকটার কথায় যুক্তি আছে ঠিক।তবে কিছু সমস্যার সমাধান সহজে হয় না।হঠাৎই ক্ষনিকের হাসি মিলিয়ে গেল রিশার।তপ্ত শ্বাস ফেলে দূরে চলন্ত গাড়ির দিকে তাকিয়ে বলল সে,

“মাঝেমধ্যে এমন কিছুর জন্য আমাদের মন খারাপ হয় যেটা কখনো পাওয়া সম্ভব নয়।কল্পনাও করা যায় না!সে জিনিসটা ছাড়া বেঁচে থাকা অর্থহীন মনে হয়!যার কোনো বিকল্প হয় না!তখন কি ভাবে মন ভাল করার উপায় খুঁজি?

রাতিম আশ্চর্য হয়ে গেল!যে ভয়টা পেয়েছিল তাই হলো!রিশার মনে চলে এসেছে কেউ!হঠাৎই ভেতর অশান্ত হয়ে উঠল তার!ভালবাসলেও সেটা কখনো প্রকাশ করতে পারেনি রাতিম।বন্ধুত্বের সম্পর্ক মাঝে দেওয়াল হয়ে ছিল!অপেক্ষায় ছিল রাতিম।সোজা রিশার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবে!সম্মুখে থাকা মেয়েটাকে নিয়ে মনে কতশত স্বপ্ন বুনেছে সেটা কি সে জানে?এই মুহূর্তে রাতিমের ঠিক কতখানি কষ্ট হচ্ছে সেটা কি উপলব্ধি করতে পারছে আইরিশ?মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমলো রাতিমের।কাঁপা স্বরে কোনোরকম বলল,

” আমি যদি ভুল না হই তুমি ব্যাক্তিগত জীবনকে ইঙ্গিত করছো!মানে কাউকে ভালবাসো তুমি?

চমকে উঠলো রিশা!আনমনা হয়ে এরকম কথা বলে ফেলা মোটেও উচিৎ হয়নি তার।রাতিম হচ্ছে রওনক ভাইয়ের বন্ধু।এত কথা বলা শোভা পায় না।বার কয়েক চোখের পাতা ঝাপটে নিয়ে কাপ টা ছুঁড়ে ফেলল রিশা।পরক্ষণে বাড়িতে যাওয়ার জন্য তাড়া দিল।গম্ভীর স্বরে বলল রাতিম,

“তোমার যদি মনে হয় আমাকে কিছু বললে সেটা রওনকের কান অব্ধি পৌঁছে যাবে তাহলে তুমি খুব বোকা,মেয়ে।যাকে পাওনি বলে জীবন অর্থহীন মনে হচ্ছে,একবার ভাবো তার কাছে তোমার মূল্য ঠিক কতখানি?কেন নিজেকে তুচ্ছ করে ভাবছ?সবকিছুর অবশ্যই বিকল্প হয়!হতে পারে কেউ তোমাকে অবহেলা করছে!আবার সেই তোমাকেই অন্য কেউ মনপ্রাণ উজার করে ভালবাসছে!জীবন কারো জন্যে থেমে থাকে না মেয়ে!ভাল থাকা খুশি আর আনন্দের পথ নিজেকেই খুঁজে নিতে হয়!যে তোমাকে মূল্য দিবে অবশ্যই সেখানে সবই পাবে তুমি।শুধু মনের চোখ দিয়ে খুঁজতে হয়।

নিশ্চুপ হয়ে রাতিমের কথা শুনল রিশা।স্কুল,কলেজে পড়াকালীন কতশত ছেলের প্রেম নিবেদন পেয়েছে।কোথাও তো মন বসেনি!অবাধ্য বেয়াড়া মনটা কৈশোর থেকেই একজনের জন্যই গুমরে মরছে!যার কাছে রিশার ভালবাসার কোনো মূল্যই নেই!রিশার আঁধার মুখে তাকিয়ে বলল রাতিম,

“প্রশ্নের উত্তরটা পেলাম না।তুমি কি কাউকে ভালবাস আইরিশ?আমাকে নির্দিধায় বলতে পারো।হতে পারে এতে তোমার লাভই হলো!

রিশা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে।রাতিম রুদ্ধশ্বাসে চাতকের মতো তাকিয়ে আছে।বুকে প্রলয়ঙ্কারী ঝড় বইছে!কি উত্তর দেবে আইরিশ?মস্তিষ্ক এলোমেলো লাগছে রিশার।ভাবনাগুলো তাল কেটে গেল।অসস্থি এক ভাব ঝেকে বসলো তনুময় জুড়ে!প্রলম্ভিত শ্বাস নিয়ে চোখ বুজে বলল সে,

” নাহ!কাউকে ভালবাসি না আমি।

এই প্রথম বোধহয় লুঙ্গি পরা অবস্থায় রওনক ভাইকে দেখল কুহু।হাসি চেপে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে।সামলিয়েছে দারুণ ভাবে!আড় চোখে কুহুকে খেয়াল করছিল রওনক।মেয়েটা দিব্যি মজা নিচ্ছে!এক্ষুনি খুশি বের করে দিবে!খানিক কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল রওনক,

“আজকে তো তোমার পায়ে ব্যাথা!খাটেই ঘুমাতে হবে।আমার কিন্তু মেঝেতে শুয়ে অভ্যেস নেই একদম।এখন তো দুশ্চিন্তা হচ্ছে রাতে তোমাকে সামলাব নাকি এই লুঙ্গি?

রওনকের কথা শুনে মুখ চুপসে গেল কুহুর!মিটিমিটি হাসছে রওনক।আমতাআমতা করে বলল কুহু,

” আমি মায়ের রুমে ঘুমাব আজকে।এমনিতেও আজকে আপনার প্রাইভেসির প্রয়োজন আছে।

“এই পা নিয়ে হেঁটে যেতে পারবে?সেই তো আমাকেই কোলে তুলে নিয়ে যেতে হবে!তুমিই আমাকে নির্লজ্জ বানিয়ে ছাড়ছো!আবার উল্টো আমাকেই রাগ দেখাচ্ছ!আমার কোনো ইচ্ছে ছিল না ওসব আটার বস্তা তোলার!

রওনকের এই খোঁচানো কথা ভাল লাগে না কুহুর।বরাবরের মতো রাগ ধরায়।পায়ের অবস্থা বেগতিক না হলে এক্ষুনি এখান থেকে চলে যেত।তোহা খানিকক্ষণ আগে হট ব্যাগ দিয়ে গেছে।পায়ের অবস্থা খুবই নাজুক!গোড়ালি ফুলে গেছে একদম।কেমন এক চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে।তোহা আসল রাতের খাবারের জন্য ডাকতে।ফুয়াদ অপেক্ষা করছে রওনকের জন্য।কুহুর খাবারটা হাতে করে রুমেই নিয়ে আসলো তোহা।অগত্যা আর কিছু বলল না রওনক।ডাইনিংয়ে চলে গেল।হাত ধুঁয়ে এসে কুহুর মুখোমুখি বসে ভাত মাখাতে থাকল তোহা।একটুও খেতে ইচ্ছে করছে না কুহুর।মাথা বড্ড ভার হয়ে আছে!চোখও জ্বালা করছে!রাগ দেখিয়ে জোরপূর্বক কয়েক লোকমা ভাত খাইয়ে দিল তোহা।বারণ করতে পারেনি কুহু।পায়ে কি করে ব্যাথা পেল জিগ্যেস করল তোহা।আচমকা খাওয়ার মাঝে কেশে উঠল কুহু।মাথার তালু জ্বলে উঠল!গুছিয়ে মিথ্যা বলতে অভ্যস্ত নয় কুহু!কাশি লাগাতার হতে লাগল!পাশ থেকেই পানির গ্লাস এগিয়ে দিল তোহা।মেয়েটার চলাফেরা বড্ড অগোছালো!এই জন্যই এমন ব্যাথা পেয়ে বসে আছে।কুহুর কাশির শব্দে ছুটে আসল রওনক!কেমন বিচলিত লাগছে তাকে।তোহা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে!এগিয়ে এসে বা হাত কুহুর মাথায় বুলিয়ে যাচ্ছে রওনক।তোহা বিস্ময়ে কথা বলতে পারল না।তাকিয়ে রইল রওনকের এঁটো হাতে!একটা ছেলে ঠিক কতখানি ভালবাসলে তার আচরণে সেটা প্রকাশ পায়?তোহার সামনে রওনকের আচরণ কিছুটা লজ্জায় ফেলে দিল কুহুকে।খুক খুক করে আরো কয়েকবার কাশলো সে।

“আমি তো এখানে আছি রওনক!খাবার রেখে চলে আসতে হবে তোমাকে?আমি বুঝি খেয়াল রাখতে পারব না?নাকি ভরসা করো না কোনটা?যাও খাবার শেষ করে এসো।

শান্ত গলায় কেবল বলল রওনক,

” খাওয়া শেষ।

পাল্টা আর কিছু বলল না তোহা।এঁটো বাসনকোসন নিয়ে চলে গেল।হাত ধুঁয়ে এগিয়ে আসল রওনক।কুহুর সর্ব মুখে যেন র’ক্ত জমে আছে!বিষম ভালই খেয়েছে।হুট করেই কুহুর পায়ের দিকে দৃষ্টি থমকে গেল রওনকের।অনেকটা ফুলে গেছে!রগ ভেসে আছে।অথচ এতক্ষণ সে খেয়ালই করেনি!আলতো হাতে পায়ে স্পর্শ করতেই মৃদু আর্তনাদ করে উঠল কুহু।ব্যাথাটা মনে হচ্ছে অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে!কুহুর দিকে তাকিয়ে শুধাল রওনক,

“ব্যাথা করছে বেশি?এতখানি ফুলে গেছে নির্বোধের মতো চুপ করে বসে আছ কেন?রোবট তুমি?

কিছুটা রেগেই কথাগুলো বলল রওনক।ব্যাথার কারণে কিছু বলতে পারল না কুহু।ধীরে ধীরে পুরো পায়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে ব্যাথা।করুণ চোখে রওনকের পানে তাকাল সে।কালবিলম্ব না করে কুহুকে কোলে তুলে নিল রওনক।বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।কাঁপা স্বরে কোনোরকম জিগ্যেস করলো কুহু,কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাঁকে?কোনোরকমে জবাব দিল না রওনক।বসার ঘরে আফসানা বেগম আর ফুয়াদ বসে আছে।তোহা রুমে গেছে ছেলেকে ঘুম পাড়ানোর জন্য।আচমকা বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল ফুয়াদ।ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন আফসানা বেগম।রওনক জানাল কুহুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছে।পায়ের ব্যাথা কমেনি।আফসানা বেগম বিচলিত হয়ে গেলেন।এতখানি চোট পাওয়ার কথা তো তিনি শোনেননি!যার জন্য হসপিটাল যাওয়ার প্রয়োজন পরে গেল!এগিয়ে আসতে গিয়েও থমকে গেলেন তিনি।ফুয়াদ সঙ্গে যেতে চাইলে রওনক জানাল সে একাই নিয়ে যেতে পারবে।কুহু বরফের মতো রওনকের বুকে লেগে রইল।লজ্জা,ব্যাথা,অসস্থি মিলেমিশে এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তার!ইচ্ছে করছে এক্ষুনি মাটির তলায় চলে যাক!দৃষ্টি তুলে তাকাতে পারল না।পা টা একবার সেরে যাক এই সবকিছুর হিসেব কড়ায়-গণ্ডায় নিবে কুহু!

চলবে….