তুমি রবে নীরবে পর্ব-১৯+২০

0
24
তুমি রবে নীরবে

#তুমি_রবে_নীরবে (১৯)
~নাদিয়া সাউদ


রুমে জ্বলছে গাঢ় সবুজ রঙা ডিম লাইট।বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে আছে রিশা।উপরে সিলিংফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে।রাতিম ভাইয়ের কথাগুলো ভীষণ ভাবাচ্ছে তাকে।সত্যিই তো,কেন নিজের ক্ষতি করবে ও?আশফিক ভাই তো জানেই না রিশার অনুভূতি!আর ক্ষনিকের এই আবেগটুকুর জন্য পরিবারের ভালবাসা,নিজের স্বপ্নটাকে কি করে বিসর্জন দেওয়ার কথা ভাবল সে?তবে একটা বিষয়ে রিশা নিশ্চিত!রাতিম ভাই টের পেয়ে গেছে তার মনের অবস্থা!বাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে যাওয়ার সময়ও বারবার বোঝাতে চেষ্টা করছিল কেমন!এতটা দূরের হয়েও লোকটা এক নিমেষে বুঝে নিয়েছে রিশার মন খারাপটুকু!অথচ কিছু কাছের মানুষকে আমরা চিৎকার করে বলেও মনের অবস্থা বোঝাতে সক্ষম হই না!বাসায় ফিরে ঘুমের ট্যাবলেটের পাতাটা বাবার ঔষধের বাক্সে সযত্নে রেখে এসেছে রিশা।এইটুকুতে হেরে গেলে চলবে না।জীবন চলার পথ এখনও অনেকটা বাকি!নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে হলেও তাকে হাসিমুখে বাঁচতে হবে।পরিবারের কথা তাকে ভাবতে হবে।কিছু জিনিস নিয়তিতে থাকে না।সেটা মেনে নিতে পারলেই জীবন সুন্দর!আশফিক ছিল না রিশার ভাগ্যে!সে ভাল থাকুক নিজের মানুষটা নিয়ে এটাই চায় রিশা।কথাটুকু ভাবতে ভাবতে চোখের কোণা বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো!চোখ বুজে প্রলম্বিত শ্বাস নিল রিশা।কখনো কখনো ভীষণ কষ্ট হলেও মন কে মানাতে হয়!রাতিম ভাইয়ের কথাগুলো যুক্তিযুক্ত ছিল।তাই হয়তো নিজেকে বোঝাবার সাহস পেয়েছে আজ।কাত হয়ে শুয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি রাখল সে।আকাশ আজ তারায় তারায় জ্বলমল হয়ে আছে!অর্ধ চাঁদটার দিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলল রিশা।মন বুঝি ঈষৎ হালকা হয়েছে!


কুহুর পায়ের এক্সরে করানো হয়েছে।বেকায়দায় পা মচকে গেলে অনেক সময় হাড় ভে’ঙ্গে বা টিস্যু ছি’ড়ে গিয়ে পা ফুলে যায়।ডাক্তার জানিয়েছে কুহুর তেমন ক্ষতি হয়নি।আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে রক্তের চলাচল বেড়ে যায়।তাই ফুলে উঠে।সেখানে ঠান্ডা সেঁক দিলে ব্যাথা দ্রুত নেমে যায়।গরম সেঁক দেওয়ার ফলে কুহুর পায়ের ব্যাথা উল্টো বেড়েছে।দুদিন বেডরেস্টে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে।নার্স বেশ যত্ন নিয়ে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল কুহুর পায়ে।পুরোটা সময় রওনক খুব বিচলিত ছিল!রিপোর্টের জন্য এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছিল।সবটাই দূর থেকে হুইল চেয়ারে বসে লক্ষ্য করছিল কুহু।নার্সরা ফিসফিস করে বলাবলি করছিল ‘বউ পাগল ছেলে’!কথাটা স্পষ্ট শুনেছে কুহু।কেন জানি কথাটা ভীষণ ভাল লেগেছে তার!হুইল চেয়ারে বসানোর সময়ও কুহুর পায়ের কাছে বসে রওনক বারবার জিগ্যেস করে যাচ্ছিল কষ্ট হচ্ছে কিনা?মাথা ঝাঁকিয়ে ‘না’ বলেছে কুহু।তবুও সন্তুষ্ট হতে পারেনি লোকটা!নার্সদের সামনে বলেই বসেছে,কোলে করে হাঁটতে তার কোনো সমস্যা হবে না।নার্সদের চেহারাটা তখন দেখার মতো হয়েছিল!কুহু যেন কুন্ঠায় জড়োসড়ো হয়ে যাচ্ছিল ক্রমেই!এতক্ষণ যাবৎ সর্ব মুখ জুড়ে চিন্তার ছাপ থাকলেও এখন অনেকটা শান্ত লাগছে রওনককে।হাসিমুখে কুহুর কাছাকাছি এগিয়ে আসলো সে।

“এক্ষুনি বিল পরিশোধ করে চলে যাব আমরা।

কথাটুকু বলেই পকেটে হাত রাখতে গেল রওনক।তক্ষুনি খেয়াল হলো লুঙ্গি পরে আছে সে!বড়োসরো এক ধাক্কা খেল যেন!এতক্ষণ মাথাতেই ছিল না এই কথা!যাক লুঙ্গি যে এতক্ষণ অক্ষত ছিল এটাই বেশি!কুহুর দিকে তাকিয়ে বলল,

“আমি যে লুঙ্গি পরেই বেরিয়ে এসেছি একবারও বলবে না আমাকে?সব তোমার জন্য হয়েছে!ওয়ালেট,ফোন কিছুই তো নিয়ে আসিনি!

বোকার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল কুহু,

“পা কি আমি ভেঙ্গেছিলাম?নিজে অপরাধ করেছেন তাই হসপিটালে নিয়ে এসেছেন।নয়তো আসতেন নাকি?দোষ করবেন নিজে,ভুলও করবেন নিজে আর দোষারোপ করবেন আরেক জনকে?এ কেমন বিচার?

পাল্টা আর কিছু বলল না রওনক।কুহুকে বসিয়ে রেখে বেরিয়ে গেল বাড়ির উদ্দেশ্যে।কুহু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল!রওনক ভাইয়ের চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তি প্রকাশ পাচ্ছিল যেন!এই লোককে বোঝা সত্যিই মুশকিল!এতক্ষণ কেবল দায়িত্বের কারণেই কুহুকে নিয়ে এভাবে ছুটেছে?অথচ বোকা কুহু কত কিছু ভেবে বসে আছে!

,

সকালের নাশতা তৈরিতে ব্যস্ত শারমিন বেগম।ডাইনিংয়ে অপেক্ষা করছেন রাশেদ জামাল আর রিশা।মেয়ের সঙ্গে টুকিটাকি আলাপ করছেন রাশেদ জামাল।বেশিরভাগটা রওনকের বিষয় নিয়ে।ছেলেকে এভাবে বিয়ে করিয়ে যে বাবা-মা খুশি নয় সেটা বেশ বুঝতে পারছে রিশা।আগে প্রায়ই এই বিষয়টা নিয়ে ভীত থাকত সে!রওনক কিভাবে সামলিয়ে নিবে পরিবারকে?অথচ কত সহজে তাদের বিয়েটা হয়ে গেল!একদম অবাস্তব,অকল্পনীয় ভাবে!তবুও রিশার কোথাও একটা সন্দেহ কাজ করে।এর পেছনে রওনকের হাত নেই তো?নয়তো বিয়ের দিনই কেন বর উপস্থিত হবে না?ভাইয়া কি আবার ছেলেটাকে গুম করে দিল?কুহুর জন্যে সে সবই করতে পারে।এতে সন্দেহ নেই!যদিও এমন কিছু হয় তাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে।ভালবাসা এভাবে জয়ের পক্ষে নয় রিশা।সুযোগ পেলে অবশ্যই রওনককে জিগ্যেস করবে সে।টেবিলের উপর গরম গরম পরোটা আর আলু ভাজি রাখলেন শারমিন বেগম।অর্ধ বয়সী নারীর কপাল চুইয়ে পড়ছে ঘাম।পাশের চেয়ারে বসলেন তিনি।মায়ের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে পরোটার প্লেট টেনে নিল রিশা।বাবার পাতে তুলে দিল।আজকে ঘুম থেকে জাগতে একটু দেরিই হয়ে গেছে তার।সকাল সকাল উঠলে হয়তো মাকে সাহায্য করতে পারতো।অবশ্য শারমিন বেগম কোনো কাজে হাত দিতে দেন না মেয়েকে।পরোটা ছিঁড়ে খানিকটা মুখে পুরে বললেন রাশেদ জামাল,

“ছেলের বউ তো এসেই গেছে।এখন আর কোনো কষ্ট করতে হবে না তোমাকে।কিছুটা দায়িত্ব কুহুকে বুঝিয়ে দিয়ো।

স্বামীর কথার প্রতিত্তোরে কিছু বলল না শারমিন বেগম।মনে শান্তি,আনন্দ থাকলে খুশিমনেই তিনি সংসারের ভার ছেলের বউয়ের হাতে অর্পণ করতেন।কেন জানি কুহুকে তিনি পুত্রবধূর স্থানে ভাবতেই পারেন না।রওনক যদি সবটা মানতে পারে তাহলে এখানে আর বলার কিছু থাকে না।শোভা পায় না।অবশ্য কুহুর সঙ্গে ছেলেটাও যেভাবে ও বাড়িতে পরে আছে।এতে বোঝা যায় এই বিয়েতে রওনকের কোনো আপত্তি ছিল না।সব যেন স্বাভাবিক!রিশা নিশ্চুপ খাওয়ায় মনোযোগী হলো।


রাতে আফসানা বেগমের রুমটায় রওনক আর কুহুকে থাকতে দেওয়া হয়েছে।এই রুমের খাটটা মোটামুটি চওড়া।তবে লম্বায় কম।আগেকার দিনের খাট।কুহু ঠিকঠাক ঘুমাতে পারলেও রওনকের পা মেলতে কষ্ট হয়ে গেছে।সারারাত একটুখানির জন্যও ঘুমায়নি সে।সর্বক্ষণ কুহুকে নজরে রেখেছিল।নিজে ব্যাথা পেলেও বোধহয় এতটা কষ্ট হতো না রওনকের।গোটা এক রাত্র পাড় করেছে ঘুমন্ত কুহুর দিকে তাকিয়ে!সকাল হয়ে গেছে সেই কখন।এখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা।জানালার পর্দা টেনে রুম অন্ধকার করে রেখেছে রওনক।পাছে কুহুর ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে যায়!খানিকটা উবু হয়ে কুহুর কপালে পরে থাকা এলোমেলো চুলগুলো আলগোছে সরিয়ে দিল রওনক!ভারী নিশ্বাস পরছে কুহুর।ঘুমের অতল সায়রে সে।বেশ ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে রইল রওনক!এই মেয়েটাকে ভালবাসার নির্দিষ্ট কোনো ব্যাখা আজও দিতে পারেনি তার মন!কি ছিল কুহুর মাঝে?সরলতা?পাগলামো?কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটলো।

হঠাৎই ভীষণ অবাধ্যের মতো একটা কাজ করে বসল রওনক।কুহুর ঘুমের সুযোগ নিয়ে অধরোষ্ঠে আলত চুমু খেল।কিঞ্চিৎ নড়েচড়ে উঠল কুহু!দ্রুত উঠে বসল রওনক।ঘড়িতে তাকাতেই দেখল আটটা বাজে।ভার্সিটিতে যেতে হবে তাকে।ঘুমন্ত কুহুর দিকে শেষ বারের মতো তাকিয়ে উঠে বেরিয়ে গেল সে।তোহা অনেক্ক্ষণ আগেই নাশতা তৈরি করে নিয়েছে।রওনকে দেখেই ডাকল।রওনক জানাল সে বাড়িতে গিয়েই খেয়ে নিবে।এখন একদম সময় নেই তার।কালকের ভেজা কাপড় গুলো শুকিয়ে গেছে।সেগুলো কোনোরকম পাল্টে নিল রওনক।যাবার আগে তোহাকে বলে গেল কুহুর যেন খেয়াল রাখে।আফসানা বেগম তোহার সঙ্গে খানিকটা রাগ হলেন।রওনককে না খাইয়ে ছাড়ার জন্য।

,

বসার ঘরে খবরের কাগজ নিয়ে বসেছেন শারমিন বেগম।কলিং বাজতেই রিশাকে ডেকে বললেন খুলে দিতে।নিজের রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসল রিশা।দরজা খুলে রওনককে দেখে খানিক যেন অবাকই হলো।পাশ কাটিয়ে ভেতরে চলে গেল রওনক।শারমিন বেগম নিশ্চুপ তাকিয়ে রইলেন।ছেলে একবার তাকানোর প্রয়োজনটুকু মনে করলো না!রিশা ছুটে গেল রওনকের পেছন পেছন।রুমের কাছে আসতেই রিশা প্রশ্ন ছুঁড়লো,

“ভাইয়া তোকে কিছু জিগ্যেস করার আছে।

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল রওনক।পরক্ষণে জানাল এখন বেরোবে সে।কথা পরে শুনবে।রিশার চট করেই মনে হলো ভাইয়ার তো ভার্সিটি আছে।বেমালুম ভুলে গিয়েছিল সে!পরের ইয়ারের জন্য আজকে বই কিনতে বের হবে রিশা।রওনককে বলল বিকেলে একটু সময় দিতে তাকে।আজকে কোচিং নেই রওনকের।সপ্তাহে তিনদিন থাকে।এটা খুব ভাল করেই জানে রিশা।রওনক জানাল বিকাল পাঁচটায় ফ্রি হয়ে কল দিবে রিশাকে।অগত্যা সায় জানিয়ে চলে গেল রিশা।প্রশ্ন গুলো বিকেলের জন্য তোলা রাখল।


সকাল দশটা নাগাদ ঘুম ভাঙ্গলো কুহুর।পাশে তাকাতেই দেখলো রওনক নেই!কিছুটা যেন চমকে উঠলো!কাল রাতে এ ঘরে যে লোকটার ঘুমাতে কষ্ট হয়েছিল সেটা বেশ বুঝতে পেরেছিল সে।কুহুর পায়ের জন্য কোণায় এইটুকু জায়গা নিয়ে কোনোরকম শুয়ে ছিল!আফসানা বেগম নাশতা হাতে মেয়ের রুমে আসলেন।চোখেমুখে এক তৃপ্তির হাসি লেপ্টে আছে।বিয়ের পর মেয়েকে সুখী থাকতে দেখলে বোধহয় সকল মায়েরই ভাল লাগে।কালকে থেকে আজকে পায়ের ফোলা ভাবটা অনেকটা কমে গেছে।তবুও ডাক্তার বলেছে সম্পূর্ণ রেস্টে থাকতে।ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমে যেতে চাইল কুহু।আফসানা বেগম জানালেন মুখ ধোঁয়ার জন্য পানি আর ব্রাশ এনে দিবেন।কুহু যেন পড়লো মহা বিপত্তিতে!সে তো বাথরুমেও যাবে।হুট করেই তার মনে হলো রওনক ভাই থাকলে এক্ষুনি কোলে তুলে নিয়ে যেত!কোনো সমস্যাই হতো না!এখন একা যাবে কি করে সে?পরক্ষণে চোখমুখ খিঁচিয়ে নিয়ে স্বগোতক্তি করল,ছিঃ কুহু!এসব নির্লজ্জের মতো কি ভাবছিস?বেশরম লোকটার সঙ্গে থাকতে থাকতে তুই ও লাজহীন হয়ে যাচ্ছিস!ছেলে আয়াশকে কোলে নিয়ে কুহুর রুমে আসলো তোহা।ঠোঁটের কোণে মিটিমিটি হাসি।খানিকটা গলা ঝেড়ে বলল,

“কি ননদী?মুখটা শুকনো চিন্তিত লাগছে কেন?জামাইকে মিস করছো?

তোহার কথায় চোখ তুলে তাকাল কুহু।কোনো উত্তর দিল না।শব্দ করে হেসে বলল তোহা,

” হুম বুঝতে পারছি তোমার কষ্ট!ইশশ তোমার সুপার হিরো হাসবেন্ড এখানে থাকলে এক্ষুনি কোলে তুলে ওয়াশরুমে নিয়ে যেত!আমাদের গায়ে বাপু অত জোড় নেই।

“আ..আমার কি পা নেই?আমি একাই কত যেতে পারি!

নাক ফুলিয়ে বলল কুহু।ততক্ষণে পানি আর ব্রাশ নিয়ে চলে এসেছেন আফসানা বেগম।ছেলেকে শাশুড়ির কোলে দিয়ে বেরিয়ে গেল তোহা।পরক্ষণে এলবো সাপোর্ট হ্যান্ড স্টিক নিয়ে আসলো।কুহু হা করে তাকিয়ে আছে!এটা তো পঙ্গু মানুষরা ব্যবহার করে!তোহা জানাল ফুয়াদ এটা কিনে দিয়ে গেছে।রওনকের অবর্তমানে তো আর কুহুকে কোলে তোলার কেউ নেই!কুহু যেন খুশিই হলো খুব!স্টিক দু’টো হাতে নিয়ে নেমে গেল খাট থেকে।

,

বিকেল নাগাদ রওনককে নিয়ে বই কিনলো রিশা।বাড়িতে যাওয়ার জন্য বারংবার তাড়া দিচ্ছিল রওনক।বাড়িতে কুহুর চিন্তা হচ্ছে তার।ও বাড়ির কারো ফোন নম্বর নেই যে জিগ্যেস করবে।রিশা বায়না ধরলো বার্গার খাবে।না খেয়ে কোনোমতে যাবে না সে।বোনের আবদার পূরণ করতে রাজি হলো রওনক।রিশার উদ্দেশ্য প্রশ্নের উত্তর জানা।রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করে বার্গার অর্ডার করলো রওনক।আর চারটা পার্সেল করতে বলল।রিশা বসলেও রওনক দাঁড়িয়ে রইল।হাত ঘড়ি দেখছিল বারবার।রিশা বুঝতে পারছে ভাই তার খুব তাড়া নিয়ে আছে।নতুন বউকে চোখে হারাচ্ছে!

” আমি তোর বিয়ের রহস্য জানতে চাই ভাইয়া!এখন তুই কাকতালীয় বলে চালিয়ে দিতে পারবি না।সত্যি করে বলতো ছেলেটাকে কি করেছিস তুই?কোনো ক্ষতি করিসনি তো?

সোজা প্রশ্ন রিশার।পাশ ফিরে তাকাল রওনক।ভেবেছিল রিশা বোধহয় ভুলেই গেছে বিষয়টা!ভাইয়ের চমকিত মুখের দিকে তাকিয়ে ফের বলল রিশা,

“তুই হয়তো এমন কিছুই ঘটিয়েছিস ভাইয়া!এটা না হয় বাবা-মা কে রাজি করাতে পারবি না বলে করেছিস।কিন্তু কুহু?ও কি মন থেকে মেনে তোকে বিয়ে করেছে?তুই তাকে ভালোবাসিস এটা তো জানালিও না!আমার মনে হয় দু’টো মানুষ মন থেকে রাজি না হয়ে বিয়ের মতো সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়া উচিৎ নয়!বলতে গেলে তুই ছলচাতুরী করেছিস!বিয়ের দিনও কুহুর মুখে ভয়ানক চিন্তার ছাপ ছিল।তোকে বিয়ে করতে ভয় পাচ্ছিল মেয়েটা!সব শেষে বিয়ে করে কি মনে হচ্ছে সার্থক তুই?এটাকে আদৌ পূর্ণতা বলে ভাইয়া?

চলবে……

#তুমি_রবে_নীরবে (২০)
~নাদিয়া সাউদ

রিশার কথার মাঝে ওয়েটার বার্গার দিয়ে গেল।চেয়ার টেনে রিশার মুখোমুখি বসল রওনক।তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,
“কুহুর ভালবাসা না পাওয়া অবধি এই সম্পর্কটাকে পরিপূর্ণ বলবো না আমি।হ্যা এটা সত্যি আমি কৌশল খাটিয়ে বিয়ে করেছি।তবে অন্যায় ভাবে কিছু নয়।কুহুকে আমার মনের কথা জানানোর মতো পরিস্থিতি ছিল না।কুহু যদি আমাকে প্রত্যাখান করতো?আর বাকি হচ্ছে বাবা,মা।আমি তাদের একমাত্র ছেলে।তাদের বিরুদ্ধে যাওয়া আমার জন্য মোটেও সহজ হতো না রিশ!আমি আমৃত্যু অপেক্ষা করে থাকব কুহুর ভালবাসা পাবার জন্য!শুধু মাত্র হারিয়ে ফেলার ভয় থেকে আমি এত নাটক সাজিয়ে বিয়ে করেছি!কুহুর প্রতি আমার অনুভূতি এখনো প্রকাশ করিনি।নীরবেই বয়ে বেড়াচ্ছি!ও একদিন নিজে থেকেই আমাকে ভালবাসি বলবে।যেদিন মেয়েটা নিজ থেকে ভালবাসা উপলব্ধি করবে,সেদিন আমার অনুভূতির মূল্য বুঝবে।এখন বললে হয়তো ভাববে বিয়ে হয়ে গেছে বলে আমি তার সাথে সমঝোতায় আসতে চাইছি!আমাকে বোঝার জন্য কুহুকে আমি অফুরন্ত সময় দিয়ে দিয়েছি।চলছে চলুক না এভাবেই!

ভাইয়ের কথার প্রতিত্তোরে কিছু বলল না রিশা।তপ্ত শ্বাস ফেলে বার্গারে কামড় বসাল।মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের ভালবাসা,ক্ষমতা বেশিই হয়।একটা ছেলে চাইলেই তার ভালবাসার মানুষটাকে বিয়ে করে নিতে পারে।যেটা হয়তো একটা মেয়ের ক্ষেত্রে অতটা সহজ হয় না!কুহু নিসন্দেহে ভাগ্যবতী!এমন ভালবাসা কয়জনের কপালে জোটে?রওনকের দিকে তাকিয়ে বলল রিশা,

” তা কি এমন নাটক সাজালি তুই?

রওনক হাত ঘড়ি দেখছিল।মুখ তুলে তাকিয়ে বলল,

“নাটক বলতে বিয়েটা শুরু থেকে আমার সঙ্গেই ঠিক ছিল।কুহুর বিয়ের শাড়ি কেনা থেকে শুরু করে গহনা সব আমার টাকায় আর পছন্দে।শুধু বরটা বদলেছে!সেটাও প্ল্যান মাফিক।এখানে অপরাধ কিছুই হয়নি।

ভাইয়ের প্ল্যানের কথা শুনে কিছুক্ষণ তব্দা খেয়ে তাকিয়ে রইল রিশা।প্রেমে পড়লে বোধহয় কতরকম চমৎকার সব চিন্তা ভাবনার উদয় হয় মাথায়!কি জানি অতকিছু বুঝতে পারল না রিশা।খাওয়া শেষ হতেই তাড়া দিল রওনককে।বিল মিটিয়ে বেরিয়ে গেল দু’জন।


আকাশে ভেসে থাকা শুভ্র মেঘগুলো ক্রমেই ছাই রঙা হয়ে যাচ্ছে।সন্ধ্যের প্রস্তুতি নিচ্ছে আকাশ।জানালার গ্রিল ধরে অম্বর দেখায় মত্ত কুহু!সারাদিন আজ অন্যরকম এক চিন্তায় মন খচখচে হয়ে আছে তার।রওনক ভাই বোধহয় কুহুকে নিয়ে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে!কেনই বা সেদিন দায় নিতে গেলেন তিনি?লোকে যা বলার কুহুকে বলতো!তার তো কোনো সমস্যা ছিল না!কুহুর সঙ্গে পূর্নাঙ্গ সংসার করতে আরও সময় চাই রওনক ভাইয়ের!আদৌ এই সম্পর্কের শেষ পরিণতি কি জানে না কুহু।রওনক ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ের কথা উঠতেই আশ্চর্যের শেষ সীমানায় পৌঁছে গিয়েছিল সে!ভেবেছিল নাম মাত্র বা লোকদেখানো বিয়ে করছেন রওনক ভাই।যেন কুহুর ঘাড়ে কোনো বদনামের বোজা না চাপে।এখন মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ দায়িত্বশীল একজন স্বামী সে!যেন সবকিছু স্বাভাবিক!তবে কি রওনক ভাই চায় কুহুর সঙ্গে সংসারটা টিকে থাকুক আজন্ম?

“এত মন দিয়ে কি ভাবছ? কিভাবে কিভাবে রওনক ভাইকে জ্বালানো যায়? তাই তো?

গম্ভীর পুরুষসুলভ কন্ঠস্বর পেয়ে চমকে উঠলো কুহু!বাইরে তখন ঘটা করে সন্ধ্যার আয়োজন!ক্লান্ত মুখে এক চিলতে হাসি রওনকের।হাতে একটা ব্যাগ।বোঝা যাচ্ছে এতে খাবার হবে হয়তো।ততক্ষণে প্যাকেট থেকে অনেকরকম চকোলেট,চিপ্স,স্নেক্স বের করলো রওনক।কুহু গভীর মগ্ন হয়ে দেখছিল বলিষ্ঠ দেহি পুরুষকে।অবশেষে কি সব মানিয়ে নেওয়ারই প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন রওনক ভাই?এভাবে টিকে সম্পর্ক?নিখুঁতভাবে অভিনয় করাও তো সম্ভব নয়!

রওনক এগিয়ে এসে কুহুর পায়ের সামনে বসলো।আলতো হাতে নিজের কোলে টেনে নিল আঘা’তযুক্ত পা’টা।বার কয়েক চোখের পাতা ঝাপটে নিয়ে অপ্রতিভ হলো কুহু।ঈষৎ লজ্জাভাব ঝেকে ধরলো তাকে।ব্যাথাযুক্ত স্থানে আঙ্গুল চালাচ্ছে রওনক।দৃষ্টি করুণ।মুখের আদল বলছে যেন আ’ঘাতটা সে পেয়েছে!আমতাআমতা করে বলল কুহু,

” আ,,আপনি তো মাত্র ফিরলেন।ফ্রেশ হয়ে নিন।আমি ভাবীকে বলছি খাবার দিতে।

দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে বলল রওনক,

“লাগবে না।বাড়ি চলে যাব।তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে এসেছি।এখানে দুজনের থাকতে কষ্ট হয়ে যায়।

রওনকের কথায় অবাক হয়ে তাকাল কুহু!এই ভাঙ্গা পা নিয়ে যাবে কি করে?এখানে তো তোহা ভাবী দেখাশোনা করে।ওখানে গেলে রিশার কষ্ট হয়ে যাবে!রওনককে চলে যাবার কথাও বলতে পারল না কুহু।মাথা নিচু করে মিনমিন করে জানাল,পা ভাল হওয়ার আগ অব্ধি এখানেই থাকবে সে।রওনক নাছোড়বান্দা।আগামীকাল তার ছুটি।সম্পূর্ণ সময়টা সে কুহুর জন্য বরাদ্দ করে দেবে।তা ছাড়া বারবার এভাবে শশুড় বাড়ি চলে আসাটা নিজের কাছেই দৃষ্টিকটু আর লজ্জাকর লাগছে।বাড়িতেও হয়তো বাবা,মা কত কিছু ভাবছে!কুহু পাল্টা আর কিছু বলল না।কেন জানি বলতে পারলো না।রওনক ভাই সম্মুখে আসলেই সব তালগোল পাকায়!মস্তিষ্ক তখন অকেজো হয়ে যায়!বুক ঢিপঢিপ করে!অদ্ভুত সে অনুভূতি!রওনকের ঠোঁটের কার্নিশে বিশ্ব জয় করা হাসি!কুহু এত সহজে মেনে যাবে ভাবেনি।মোটা মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি হচ্ছে বোধহয়!কুহু এক শর্ত দিয়ে বসলো।সে নিজে হেঁটে যাবে এলবো সাপোর্ট স্টিক দিয়ে।কিছুক্ষণ ভাবুক ভঙ্গিতে তাকিয়ে থেকে রাজি হলো রওনক।

,

বাড়ির কাছে আসতেই রিকশা থেকে নেমে দাঁড়াল রিশা।ভাইয়ের কথা ভাবতেই তপ্ত শ্বাস বেরিয়ে আসলো।সে আসলেই বউ পাগল।জগৎ সংসার ভুলে একেবারে মজেছে ভালবাসায়!বাড়ির কথা বুঝি খেয়ালেই নেই!সোজা অন্য রাস্তা ধরে কুহুদের বাড়ি চলে গেছে।আচমকা দূরে দৃষ্টি পরতেই দেখল রাতিম হেঁটে আসছে।ঘাড় ঘুরিয়ে রিশাদের বাড়ির দিকে তাকাচ্ছে বার বার।বেশ জোড়াল স্বরেই ডাকলো রিশা।অনেকটা যেন হকচকিয়ে উঠলো রাতিম।হাসার চেষ্টা করে এগিয়ে আসলো।এই মুহূর্তে রিশাকে বোধহয় বাইরে আশা করেনি!

“কি রাতিম ভাই আপনি চোরের মতো আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে চুপিচুপি চলে যান,অথচ বাড়িতে যান না।এটা কেমন বিচার?

বহুকষ্টে হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করে বলল রাতিম,

” হ্যাঁ যেতাম।কিন্তু আমি তো এই সময়টাতে একজন স্টুডেন্ট কে পড়াই।এই তো এই গলির পরেই বাসা।তাই হুটহাট তোমার সঙ্গে কেমন দেখা হয়ে যাচ্ছে কয়দিন যাবৎ!

“দেখেছেন আপনি এখানেই পড়ান অথচ আমাদের বাড়িতে আসেন না।ভাইয়াও নিশ্চয়ই জানে না?নয়তো এত সহজে ছাড়তো আপনাকে?

” হ্যাঁ,মানে রওনক জানে।আমি এই গলিতেই টিউশন পড়াই।শুনেছি হুট করেই নাকি বিয়ে করে নিয়েছে সে।এখন হয়তো বিজি তাই বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করার সুযোগ পাচ্ছে না।

“হ্যাঁ আসলে হুট করেই ভাইয়ার বিয়েটা হয়েছে।সমস্যা নেই আপনি আসুন তো।আমি নিমন্ত্রণ করছি।

রাতিম যেন বিপত্তিতেই পড়লো।রওনক শালা যদি এত গন্ডগোল না বাঁধাতো তাহলে রিশা একবার বলতেই চলে যেত সে!এখন তো আর সে উপায়ও নেই!মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমলো রাতিমের।হাত ঘড়িতে তাকিয়ে নিয়ে ব্যস্ত স্বরে জানাল,সময় নেই তার হাতে।ছুটির পর অবশ্যই যাবে।আপাতত এখান থেকে পালাতে পারলেই বাঁচে যেন।অগত্যা আর কিছু বলল না রিশা।চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই হাত থেকে মোটা মোটা বইগুলো খসে পরল রাস্তায়।এতক্ষণ যাবৎ হাতে রাখা কষ্টকর হয়ে পরছিল!রাতিম দ্রুত ঝুঁকে বসলো বই নেওয়ার জন্য।বাঁধ সাধলো রিশা।ততক্ষণে বইগুলো তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল রাতিম। রিশার দিকে বাড়িয়ে ধরল।রিশা হাত বাড়াতেই চমকে উঠলো রাতিম!গোলাপি রঙা হাতের তালুতে র’ক্ত জমাট বেঁধে আছে যেন!হঠাৎই কেমন বিচলিত হয়ে উঠলো রাতিম।এদিক-সেদিক তাকিয়ে ঠান্ডা জলের বোতল কিনে নিয়ে আসলো।রিশা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।কি হচ্ছে কিছুই বুঝে উঠতে পারল না।রিশাকে হাতে পানি ঢালার জন্য বলল রাতিম।তক্ষুনি নিজের হাতের দিকে খেয়াল হলো রিশার।পরক্ষণে রাতিমের পানে তাকাল ও!কেমন চিন্তিত লাগছে!অচেনা একটা লোকের কাছে এরকম যত্ন পেয়ে খানিক অপ্রস্তুতই হলো রিশা।রাতিম ভাই সত্যিই চমৎকার ব্যাক্তিত্বের একজন পুরুষ!যত দেখছে তত মুগ্ধ করছে তাকে!বাধ্য মেয়ের মতো বোতল খুলে হাতে পানি ঢালল রিশা।এতক্ষণ যাবৎ জ্বালা করছিল।কিন্তু ততটা খেয়াল করেনি।রিশার হাতে এই ভারী বইগুলো তুলে দিতেও খারাপ লাগছে রাতিমের।তবে কিছু করার নেই!দীর্ঘস্বাস ফেলে বইগুলো দিয়ে একমুহূর্ত দাঁড়াল না সে।চলে গেল।রিশা অবাক হলো।ভেবেছিল রাতিম ভাই বুঝি ঘর অব্দি তাকে পৌঁছে দিবে!


আফসানা বেগম নাছোরবান্দা।মেয়ের জামাইকে খাইয়ে তবেই ছাড়লেন।না খেয়ে গেলে শোভা পায় না এটা।তোহা বেশ অনেকবার থাকার জন্য বলল।রওনক রাজি নয়।সকলের মাঝে কুহু নিশ্চুপ ছিল।রওনকের পাগলামো যত দেখছে অবাক হচ্ছে তোহা।অবশেষে রাত আটটার পর কুহুকে নিয়ে বেরিয়ে গেল রওনক।সবার সামনে কুহু এলবো সাপোর্ট স্টিকে ভর দিয়ে হাঁটলেও সিঁড়ির কাছে আসতেই ধুপ করে কোলে তুলে নিল রওনক।দৃশ্যটা পেছন থেকে ঠিকই নজরে পড়লো তোহার।মুচকি হেসে উঠলো সে।

নিচে নেমে সিএনজি ডাকলো রওনক।কুহু অবাক হলো!এইটুকু জায়গা তো হেঁটেই চলে যাওয়া যায়!শুধু তিনটে গলি!সিএনজি আসতেই দরদাম করলো রওনক।এখান থেকে ভাড়া পঞ্চাশ টাকা চাইল সিএনজি চালক।শুনে কুহুর চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম!চোখেমুখে তেজ নিয়ে ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলল সে,

“এখান থেকে ওখানে বিশ টাকা দিলেও তো বেশি হয়ে যাবে।যেই দেখেছেন আমার পা ভাঙ্গা অমনি সুযোগে এত টাকা ভাড়া চেয়ে বসে আছেন তাই না?এটাই কি আপনাদের বিবেক?যাব না আপনার সিএনজিতে।এইটুখানি রাস্তা আমার বর কোলে তুলেই নিয়ে যেতে পারবে।

সিএনজি চালক ভুত দেখার মতো দেখছে কুহুকে।রওনক নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে কুহুর দিকে!এইটুকু রাস্তা কুহুকে কোলে তুলে নেবার মতো সামর্থ্য তার আছে।শুধু শর্তের কারণে সিএনজি ডেকেছিল সে।তবে কুহুর শেষের কথাটায় ঈষৎ হাসি পেয়ে গেল রওনকের।অনুমতি পেতেই রাস্তায় জনসম্মুখে কুহুকে কোলে তুলে নিল সে।সিএনজি চালক এবার দ্বিগুণ আশ্চর্য দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে রইল।লোকটার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটলো কুহু।হাসি চেপে রেখে কৃত্রিম হতাশা টেনে বলল রওনক,

” কিছু করার নেই মামা!বউ যখন কোলে চড়ার আবদার করে বসেছে কি করে অমান্য করি?ঘরে বউ থাকলে বুঝবেন কত জ্বালা!দিনের পর দিন এভাবেই পুরুষ জাতির উপর অত্যাচার হয়ে আসছে!অবলা শব্দটা বিবাহিত পুরুষদের জন্য হওয়া উচিত ছিল!

কথাটুকু বলেই হাঁটা ধরল রওনক।সিএনজি চালক হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়েই রইল।রওনকের প্রতিটা কথা মাথার এক হাত উপর দিয়ে গেল কুহুর!সে তো টাকা বাঁচিয়ে দিল!উল্টো রওনক ভাই বলছে কিনা অত্যাচার?এই জন্যই কারো ভাল করতে নেই!

বাড়ির কাছে আসতেই কুহু জানাল এইটুকু পথ এলবো সাপোর্ট স্টিকে ভর করে যাবে।অগত্যা আর কিছু বলল না রওনক।নামিয়ে দিল।বসার ঘরে বসে আছেন রাশেদ জামাল আর শারমিন বেগম।কুহুকে এই অবস্থায় দেখে দুজনে চমকে উঠলেন!রওনক জানাল সিঁড়ি থেকে পরে গিয়ে পায়ের এই অবস্থা হয়েছে কুহুর।তীর্যক দৃষ্টি ফেলে রওনকের দিকে তাকাল কুহু।কি সুন্দর মিথ্যা সাজিয়ে নিল!শারমিন বেগম তপ্ত শ্বাস ফেললেন।এই মেয়ের চলাফেরা কোনো কালেই পছন্দ ছিল না তার।প্রতিনিয়ত এমন কিছু ঘটতেই থাকবে এটাই স্বাভাবিক!অস্বাভাবিক তো কুহু!খানিকটা আফসোস করলেন রাশেদ জামাল।পরক্ষণে কুহুকে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল রওনক।বাবা-মায়ের চোখের আড়াল হতেই ফের কোলে তুলে নিল কুহুকে।ভয়ানক চমকে উঠলো কুহু!এতক্ষণ তো কি ভদ্র ছিল!আড়ালেই সব অভদ্রতা শুরু হয়ে যায় এই ছেলের!রুমে এসে কুহুকে খাটে বসিয়ে দিল রওনক।উঠতে নিলেই কলার চেপে ধরলো কুহু।খানিকটা ঝুঁকে গেল রওনক।ভুরু কুঁচকে তাকাল কুহুর রাগত চোখে।নাকের পাটা ফুলিয়ে বলল কুহু,

“মিথ্যা বলা যে গুনাহ জানেন না?আপনি ফেলে দিয়েছেন আমাকে।আর বললেন সিঁড়ি থেকে পরেছি?সত্যটা কেন চেপে গেলেন?

রওনক ইচ্ছে করে কুহুর আরো অনেকটা কাছে এলিয়ে গেল।পেছাতে গিয়ে বালিশে ঠাস করে শুয়ে পরলো কুহু।চেপে রাখা কলার আলগা করে দিল।নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে বার কয়েক চোখের পাতা ঝাপটালো।অন্যপাশ দৃষ্টি সরিয়ে নিল।এই মুহূর্তে কুহুর অবস্থা বেশ বুঝতে পারছে রওনক।ঠোঁটের কোণে ঈষৎ মৃদু হাসি তার।এক হাতে কুহুর দুই গাল চেপে ধরে নিজের মুখোমুখি করলো।এতটা কাছে রওনক ভাইকে দেখে অসস্থিতে পরে গেল কুহু।ফিসফিস করে ভরাট স্বরে বলল রওনক,

” আচ্ছা!সত্যিটা বললে খুশি হতে তুমি?কিভাবে পড়েছ সেটা বাবা-মায়ের সামনে বলার মতো?

আমতাআমতা করে বলল কুহু,

“না,মানে আপনি যে ফেলে দিয়েছেন বলবেন না?

” এটা বিশ্বাসযোগ্য?আমি কি ছোট বাচ্চা ছেলে নাকি পাগল যে তোমাকে ফেলে দিব?

“সরুন।দরজা খোলা।

“তো?কেন কোনো সমস্যা হচ্ছে?আমরা তো কিছু করছি না!

রওনকের চওড়া বক্ষস্থল ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইল কুহু।হেলাতে পারলো না একচুলও!উল্টো আরো অনেকটা কাছে চলে আসলো রওনক।কুহুর গলার পাশে মুখ গুঁজে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

” তখন তো দিব্যি বর কে নিয়ে বাহাদুরি করলে!আমার শক্তপোক্ত পেটানো শরীর দেখে কি মনে হয়?তোমাকে কোলে তুলতে কষ্ট হয় না?সামান্য নিচ থেকে উপর পর্যন্ত একটা চালের বস্তা তোলার জন্য কুলিকে পঞ্চাশ টাকা দিতে হয়।সেখানে এতটা পথ একটা সত্তর কেজি আটার বস্তা বয়ে নিয়ে এসেছি।এখন আমার পারিশ্রমিক দিবে কে?

চলবে…….