তুমি রবে নীরবে পর্ব-২৭+২৮

0
508
তুমি রবে নীরবে

#তুমি_রবে_নীরবে (২৭)
~নাদিয়া সাউদ

ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো রাতিম। কোথা থেকে, কিভাবে বলা আরম্ভ করবে সে? অন্যকেউ হলে না হয় বিষয়টা এড়িয়ে গিয়ে কিছু একটা বুঝিয়ে দেওয়া যেত। তবে রিশার সঙ্গে এরুপ কিছু বলা সম্ভব নয়। রাতিমের অনেক কিছুই জড়িয়ে আছে এখানে। তীরে এসে তরী ডুবে যেতে দিলে তো হবে না। বৃষ্টির সঙ্গে বাতাসটা গা কাটাকাটা করে তুলল রাতিমের। পরিবেশ কেমন মুহূর্তেই অস্থির হয়ে উঠেছে তার কাছে।বুক ঢিপঢিপ করছে। রিশা স্পষ্ট খেয়াল করলো ফর্সা নাক রক্তিম হয়ে গেছে! বৃষ্টি কি তবে সহ্য করতে পারেনা লোকটা? খানিক আমতাআমতা করে রাতিম জানাল, সবটা ফোনে বলবে রিশাকে। আপাতত তার মাথা ধরেছে খুব। পরিস্থিতি যাই হোক মানুষ নিজের কৌতূহল কখনো দমাতে পারে না। রহস্য উদঘাটন করা না অবধি মন অশান্ত হয়ে থাকে। রিশা বেশ বুঝতে পারছে এই মুহূর্তে রাতিমের পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। তবুও প্রশ্নের উত্তর চাই তার। কুহুকে বিয়ে করতে চাওয়া রাতিম ছেলেটা আর এই রাতিম ভাই যে একইজন সেটা এখন হলফ করে বলতে পারবে রিশা। রাতিমের হাতের পানে দৃষ্টি পরতেই দেখল আঙ্গুলের ডগাও লালচে হয়ে গেছে। ঠোঁট ফ্যাকাশে বর্ন হয়ে গেছে রাতিমের। কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে বলল রিশা,

“শুধু এইটুকু বলুন আপনিই কি কুহুর বিয়ে পাত্র ছিলেন রাতিম ভাই? এর বেশি জানবার প্রয়োজন নেই আমার।

রিশার ভাসা ভাসা চোখে দৃষ্টি রাখল রাতিম। কেমন চিন্তিত লাগছে মুখখানি! চট করেই মাথায় একটা কথা খেলে গেল রাতিমের। রিশা তো জানেই রাতিম শেষ মুহূর্তে বিয়ে করতে যায়নি। তবে এখন আবার জিগ্যেস করছে কেন রাতিমই পাত্র ছিল কিনা? উত্তর দেওয়ার একটা পথ পেতেই বলল রাতিম,

” তুমি কি কোনো কারণে আমাকে সন্দেহ করছো আইরিশ? তোমার যদি এই প্রশ্ন জানারই ছিল তাহলে আগে কেন জিগ্যেস করোনি?

চোখ বন্ধ করে প্রলম্বিত শ্বাস ফেলল রিশা। ফের তাকিয়ে বলল,

“কথা ঘোরাতে চেষ্টা করবেন না রাতিম ভাই। একটা ছেলের কথা বলার ধরণ, ভঙ্গিমা দেখলে মেয়েরা সহজেই সবকিছু আন্দাজ করে ফেলতে পারে। কাজেই আমার প্রশ্ন থেকে পালাতে পারবেন না আপনি।

” আমি কিন্তু অস্বীকার করিনি কিছু! আমি শুধু জিগ্যেস করেছি এতদিন পর এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়ার কারণ কি? তোমার বান্ধবী কি এখন সুখে নেই? ভাইয়ার বিয়ে হওয়াতে কি খুশি হওনি তুমি?

“আপনি কথার প্রসঙ্গ অন্যদিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন রাতিম ভাই।

রিশার চোখে স্পষ্ট রাগ দেখতে পাচ্ছে রাতিম। অভিমান করলে গালদুটো যেমন ফুলে যায় এই মুহূর্তে রিশাকেও তেমনি লাগছে! এই রাগ – অভিমানের কারণ কি? বান্ধবীর সঙ্গে প্রতারণা করেছে বলে? রিশার দৃষ্টি অন্যপাশে। একবার দৃষ্টি ঘোরালে বোধহয় দেখতে পেত সামনে থাকা যুবকটি তার সিক্ত রূপে মুগ্ধ! অন্য কেউ সামনে থাকলে বোধহয় এতক্ষণে অনর্গল সবকিছু বুঝিয়ে বলে ফেলতে পারতো রাতিম। বিপত্তি ঘটেছে সম্মুখে রিশা থাকায়। এই মেয়েটা সামনে এসে দাঁড়ালেই তো নিজের মধ্যে স্থির থাকতে পারে না রাতিম! অনুভূতিগুলো বুকের মধ্যে ধুমধুম ঢোল পেটাতে থাকে! শুকনো ঢোক গিলে বলল রাতিম,

“আমিই ছিলাম তোমার বান্ধবী কুহুর বিয়ের পাত্র। এর পেছনে অনেক কাহিনিও আছে।

কথাটুকু শুনতেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল রিশা। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাতিম। কেন জানি একটুও ভাল লাগলো না রিশার। মাথা ধরেছে বলে দ্রুত প্রস্থান করলো সে। রাতিম হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে রইল! পরক্ষণে রিশাকে পিছু ডাকল। কোনো সাড়া মিলল না। সামনে রিকশা পেয়েই উঠে গেল রিশা। রাতিম আর পাল্টা ডাকলো না। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল! এসব ইনফরমেশন কোথা থেকে পেল মেয়েটা? রওনক আবার বলে দেয়নি তো? নিজে মহান, ভাল সাজার চক্করে রাতিমকে ফাঁসিয়ে দেয়নি তো! নাকি কুহু কিছু বলেছে? এই মুহূর্তে রওনককে বিষয়টা জানানো উচিত হবে কিনা সেটাও বুঝতে পারছে না। তখন প্রশ্ন উঠবে রিশা তার দেখা পেল কি করে? শত ভাবনা মস্তিষ্ক এলোমেলো করে তুলল রাতিমের। অত্যল্পকালে বার কয়েক হাঁচি দিল সে। তবুও বাড়ি যাওয়ার তাগাদা নেই তার। ভাল লাগছে না কিছুই!

,

কোলের উপর সাইড ব্যাগ নিয়ে চলন্ত রিকশায় বসে আছে রিশা। হঠাৎ এমন আচরণ করা কি ঠিক হয়েছে তার? কেন রাতিম ভাইয়ের ডাকে সাড়া দিল না সে? কোথাও একটা তীব্র অভিমান কাজ করছে। কেন জানি মনে হয়েছিল রাতিম ভাই তাকে পছন্দ করে! কুহুর বিয়ের পাত্র ছিল শুনে বাকিটুকু আর শুনতে ইচ্ছে হলো না। পাহারসম কৌতুহল নিমেষেই ধূলিসাৎ হলো কি করে?


দুপুরের পর থেকে টানা বৃষ্টিপাত হয়েছে। বাড়ি পর্যন্ত আসতে আসতে কুহু আর রওনক একেবারে ভিজে চুপচুপ! রওনক বাইক রেখে আসতে আসতে কুহু কলিং বেল চেপে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টির কারণে বাইক দ্রুত চালিয়ে বাসায় চলে এসেছে রওনক ভাই। ভাল মতো ভিজতে পারেনি বলে মন খারাপ লাগছে কুহুর। কোথাও একটু দাঁড়িয়ে ভেজা যেত! এই কথা বেরসিক রওনক ভাইকে কে বোঝাবে? মিনিট এক পর রিশা এসে দরজা খুলে দিল। বেশ চমকে উঠলো কুহু! কিছু বলার পূর্বেই রিশা চলে গেল। অন্যদিনের তুলনায় আজকে কেমন মনমরা লাগছে রিশাকে। রওনক এগিয়ে এসে বলল,

“দরজা তো খোলাই আছে! এখনো ভেজা গায়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন?

ঘোর কাটতেই রওনকের দিকে তাকাল কুহু। লম্বা লম্বা পা ফেলে ভেতরে প্রবেশ করে বাম দিকে গেল। ওদিকটায় সিড়িঘর। ভ্রু কুঁচকে পিছু নিল রওনক। পেছনে তাকিয়ে বলল কুহু,

” এখনো বৃষ্টি একটুও কমেনি। আমি ভিজতে যাচ্ছি।

কথাটুকু বলেই প্রথম সিড়িতে পা রাখল কুহু। পেটে ধাক্কা খেল মনে হচ্ছে কিছুর সঙ্গে! নিচে তাকাতেই দেখলো রওনক ভাই পেছন থেকে শক্তপোক্ত হাতে আঁটকে দিয়েছে তাকে! অত্যল্পকালে সিনেমার ভিলেনদের মতো করে কুহুকে কোলে তুলে নিয়ে আশপাশে দৃষ্টি বুলালো একবার। পরক্ষণে একছুট লাগাল রুমে।দ্রুত যেন ঘটে গেল সব! রুমে আসতেই চেঁচিয়ে বলে উঠল কুহু,

“বাঁচাও, বাঁচা….

বাকিটুকু বলার আগেই কোল থেকে নামিয়ে মুখ চেপে ধরলো রওনক। চোখেমুখে তাঁর রাগ ঠিকর ঝরছে! চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে কুহু। দম আঁটকে যাচ্ছে তাঁর।কাঠিন্য স্বরে বলল রওনক,

” অসভ্যের মতো চেঁচাচ্ছ কেন? মা কিংবা রিশা যদি এসে যেত!

মুখের সামনে থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে বলল কুহু,

“হ্যাঁ এসে দেখুক তারা আপনি আমাকে নাকমুখ চেপে মেরে ফেলার পায়তারা করছেন। তারপর ওই শাহিনূর মাহি ম্যামকে বিয়ে করবেন।

কুহুর কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে আছে রওনক।এই মেয়ে কথা কোথা থেকে কোথায় টেনে নিয়ে গেল? নাকের পাটা ফুলিয়ে ফের বলল কুহু,

” আমার জীবনে আপনি হিরো নয় বরং ভিলেন। আচার-আচরণ তো ওইরকমই! কোন জনমে আপনার কি ক্ষতি করেছিলাম কে জানে!

কুহুর কথায় নিজকে মস্তিষ্ক শূন্য লাগছে রওনকের! ছোঁ মেরে পুনরায় কুহুকে কোলে তুলে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বলল,

“ভিলেন যখন মেনেছ তাহলে এটাও জেনে রাখ আমার অনুমতি ছাড়া কিছুই করতে পারবে না তুমি।আর ক্ষতি, সর্বনাশ যা করার তা বহু আগেই করে ফেলেছ, সর্বনাশী! এখন পাল্টা শোধবোধ না নিয়ে ছাড়ছি না মেয়ে!

কুহুকে ওয়াশরুমে নামিয়ে দিয়ে ওয়ারড্রবের কাছে গেল রওনক।সমস্ত কথা কুহুর মাথার এক হাত উপর দিয়ে গেল!তবে শর্বনাশী শব্দটা কর্নপাত হতেই ভয়ানক রাগ উঠে গেল! রওনক ফিরে এসে কুহুর হাতে শুকনো নিপাট জামা ধরিয়ে দিয়ে বলল,

” জলদি চেইঞ্জ করো। নয়তো ঠান্ডা লেগে যাবে।

কাপড় সমেত রওনকের হাত টেনে ধরল কুহু।এহেন কান্ডে বেশ চমকাল রওনক।কুহুর চোখেমুখে রাগের আভা! মাথা ঈষৎ উঁচু করে রওনকের দিকে তাকিয়ে বলল সে,

“কি ক্ষতি, সর্বনাশ করেছি শুনি? ওই যে প্রথমদিন রিশার সঙ্গে যখন এবাড়িতে এসেছিলাম আপনার একটা নতুন টিশার্ট নিয়েছিলাম ওটাই অপরাধ ছিল আমার?

দু’হাতে কুহুকে টেনে নিজের ভেজা শরীরের সাথে মিশিয়ে নিল রওনক।নিভু স্বরে বলল,

” যদি বলি এরচেয়েও বড়ো ক্ষতি করেছ? যেটা পোষাতে তোমার আজন্ম কেটে যাবে!

রওনক এতটা কাছে আসায় অপ্রস্তুত হয়ে গেল কুহু৷ হাত সরিয়ে দিয়ে জানাল ঠান্ডা লাগছে তাঁর।কিছু বললেই লোকটা হুটহাট কাছে চলে আসে।কুহুর তখন হাত,পা কাঁপে।বুক ঢিপঢিপ করে! রওনক আর কিছু বলল না।বাইরে দাঁড়াল।এমনিতেও গা ভেজা তার।হেলমেট থাকার কারণে মাথা ভিজেনি।ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিল কুহু।মৃদু হাসলো রওনক।এই মেয়েকে আদৌ বোঝাতে সক্ষম হবে সে? তার ভেতর যে ভীষণ পোড়ায়! এই মুহূর্তে ডায়েরি লেখার খুব ইচ্ছে হলো রওনকের। কুহুর এই আর্দ্র, স্নিগ্ধ রূপে মোহিত হয়ে অনায়াসে লিখে ফেলা যেত কয়েক পাতা! খুঁটিয়ে দেখা লুকানো সৌন্দর্যটুকু কি কাগজে ব্যক্ত করতে পারতো রওনক? কুহুই যে তার কাছে জীবন্ত এক ডায়েরি! চোখের ভাষায় প্রতিনিয়ত লিখে যাবে সে।


ঘড়িতে রাত দেড়টা।বন্ধ রুমে হালকা হলদে রঙা ডিমলাইট জ্বালিয়ে শুয়ে আছে রিশা।জানালা গলিয়ে বাতাস আসছে ভালই।আকাশ গুমোট ভাব।বরিষার পূর্বাভাস।সাদা রঙা পর্দা গুলো উদভ্রান্তের মতো ভাসছে।ঠিক রিশার ভেতরকার অবস্থার মতো।এই প্রথম বাড়িতে মিথ্যা বলল সে।খাবার টেবিলে রওনক যখন জিগ্যেস করেছিল কোথায় ছিল রিশা তখন চট করেই বলেছিল কিছু কেনাকাটা করতে গিয়েছিল সে। কেন জানি রাতিম ভাইয়ের কথাটা সবার সামনে বলতে পারেনি সে। কুহুর বিয়ের পাত্র রাতিম ভাই ছিল ভাবতেই অন্যরকম এক পীড়া দিচ্ছে। তবে এই জন্যই কি কুহুর বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর ভাইয়ার কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না? শেষমুহুর্তে কি তবে ইচ্ছে করেই বিয়ে টা ভেঙ্গে দিয়েছে রওনক ভাইয়া? কিন্তু সে যে বলল কোনো অন্যায় করেনি! এমন কিছু করলে তো এটা ঘোর অপরাধ! নিজের বন্ধুর সাথে এটা কি করে করলো? রিশার ইচ্ছে হচ্ছে রওনককে সরাসরি গিয়ে বলতে, এতটা জঘন্য কাজ কি করে করলে ভাইয়া? কেন জানি বিষয়টা মানতে পারছে না রিশা।এখানে রাতিম ভাইয়ের কোনো দোষ নেই।বিছানায় পরে থাকা ফোনটা বেজে উঠতেই ভাবনার ঘোর কাটলো রিশার। স্ক্রিনে গোটা অক্ষরে রাতিম নামটা ভেসে আছে। মনে কোনোরকম দ্বন্দ্ব না রেখে রিসিভ করলো সে।

“আইরিশ তুমি হঠাৎ করে চলে গেলে! আসলে অনেক সময় আমাদের চোখের দেখা বা ভাবনাও ভুল হয়। আমার মনে হচ্ছে তুমি নীরবে একটা চাঁপা কষ্ট পাচ্ছ! নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে। আমি ঘুমাতে পারছি না কেন জানি।

রাতিমের অনর্গল বলা কথায় অপ্রতিভ হলো রিশা। লোকটা তাকে বুঝে ফেলল কি করে? কাঠ গলায় শুধাল সে,

” আপনার খারাপ লাগার কারণ?

কয়েক সেকেন্ড থেমে বলল রাতিম,

“তুমি ভাবছ তোমার বান্ধবীর সাথে খুব অন্যায় হয়েছে।এর জন্য আমাকেও দোষী ভাবছ।সব শুনলে তোমার ভুল ভেঙ্গে যাবে।

রাতিমের কন্ঠস্বর কেমন পাল্টে গেছে মনে হচ্ছে। ঠান্ডা লেগেছে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।গলার স্বরটাও ভারী লাগছে খুব। লোকটার বলা কথাগুলো খুব সুন্দর।শেষের কথাগুলো দোটানায় ফেলে দিল রিশাকে।কুহুর সঙ্গে অন্যায় হয়েছে বলেই কি তার খারাপ লাগছে? নাকি অন্য কোনো কারণ আছে? মন বুঝতে পারলো না।

ফোনের ওপাশে অনবরত কেঁশে যাচ্ছে রাতিম।

” আদা- তেজপাতা থাকলে লাল চা খান।কমে যাবে। তুলসীপাতা থাকলে আরো ভাল।

নিজেকে যতেষ্ট স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল রাতিম,

“সেই বিকেল থেকেই জ্বর। গা ম্যাজম্যাজে হয়ে আছে। বিছানা ছাড়তে পারছি না। আর চা করে খাব? রাতের খাবারটাও খেতে পারিনি।

” বৃষ্টির জল আপনার সহ্য হয় না জেনেও ভিজছিলেন কেন? এখন কি তাহলে নিজেকে দোষী ভাববো আমি?

“না না! একদম নয়। তুমি জানো আমি গ্রামের ছেলে।এরকম ভিজে অভ্যস্ত। জ্বর, ঠান্ডা হুটহাট সবারই হয়।

চুপ হয়ে গেল রিশা। একটা মানুষ এত সুন্দর করে কথা বলে কি করে? আবারও কয়েক সেকেন্ড কাঁশলো রাতিম। রিশা বলল,

” আজকে আর কিছু বলতে হবে না। যা বলার কালকে বলবেন। আমি অপেক্ষায় আছি।রাখছি ঘুমাব।


রুমে বসে ফোনে খুব ব্যস্ত দেখাচ্ছে কুহুকে। গভীর মনোযোগ নিয়ে কিছু দেখছে সে।কানে হেডফোন। অগত্যা একটা বই নিয়ে বেলকনিতে গিয়ে বসেছে রওনক। মন বইয়ে দিতে পারছে না কিছুতেই।চোখ বার বার কুহুকে দেখছে।অথচ এই মেয়েটা তাকে খেয়াল করেছে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশে মনোযোগ দিল রওনক।বৃষ্টি আসবে আসবে ভাব।ঘরের ভেতর থেকে গানের আওয়াজ পেতেই তৎক্ষনাৎ সেদিকে তাকাল সে। খাটের উপর ফোনে গান বাজছে,

‘সখী শিমুল তুলার বালিশে ঘুম পাড়াব আয়’
‘পুবাল হাওয়ার বাতাসে চুল উড়াব আয়’
‘কলমি শাকের ডগাতে ফুল ফুটাব আয়’
‘আমন ধানের জমিতে আউষ ফলাব আয়’

গানের তালে কুহু নাচার চেষ্টা করছে। রওনক দ্রুত রুমে চলে আসলো।থামলো না কুহু। খুব সিরিয়াস লাগছে তাকে।বোকার মতো তাকিয়ে থেকে বলল রওনক,

“এসব কি?

এবার নাচ থামিয়ে দিল কুহু। কোমড়ে হাত রেখে বলল,

” এসব কি মানে? চোখে দেখতে পাচ্ছেন না আমি নাচ করছি! বই রেখে এখানে এসেছেন কেন? আমি একটু রিহার্সাল করার চেষ্টা করছি আরকি। আরিয়ান মাত্র পাঠালো গানটা।কনক স্যার নাকি এই গানটাই আমাদের জন্য সিলেক্ট করেছে। উনার ইউটিউব চ্যানেলে এই গানের নাচ দেখলাম একটা।ওটাই চেষ্টা করছি।

শেষে কুহুর গলা নরম হয়ে গেল। এগিয়ে গিয়ে রওনকের হাত ধরে টেনে নিয়ে আসলো সে। দীর্ঘকায় পুরুষকে খাটে বসিয়ে দিয়ে চমৎকার করে একটু হাসলো। রওনক এখনো হতবুদ্ধি! নাকি কোনো অলীক জগৎ এটা?

“এখন আমি নাচব আর আপনি দেখবেন। কেমন হয়েছে জাজ করবেন।ঠিকাছে?

চলবে…….

#তুমি_রবে_নীরবে (২৮)
~নাদিয়া সাউদ

কথাটুকু বলেই রওনকের হাত ছেড়ে দাঁড়াল কুহু। ঠোঁটের হাসিটুকু ধরে রেখেই ফের নাচ আরম্ভ করলো গানের তালে তালে।

‘আয় আয় আয়রে সখী আমার সনে আয়’
‘এলো চুলে সিঁথি কেটে আদর দিব গায়’
‘দুই চোখেতে আষাঢ় শ্রাবণ ভিজবি যদি আয়’
‘বুকের ভেতর কাল বোশেখী কালো মেঘের ছায়’

রওনক স্তব্ধ হয়ে গেল কয়েক মুহুর্তের জন্য। কুহুর অত্যন্ত নিখুঁত ভঙ্গিমা তাকে বাকরুদ্ধ করলো। আলতো করে সরু কোমড় দুলিয়ে দু-হাত নাড়িয়ে খুব দক্ষতার সঙ্গে নাচছে মেয়েটা! গানের প্রতিটা লাইন তরঙ্গের মতো কানে বাজছে রওনকের।যেন তার মনের অব্যক্ত কথাগুলো সুরের সাথে গেয়ে চলছে কেউ! অদ্ভুত এক অনুভূতি তার পুরুষ সত্তাকে জাগিয়ে তুলল! আদুরে দৃষ্টি নিয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ায় সে। নাচে মনোযোগী কুহুর হাত চেপে ধরে। হঠাৎই থেমে যায় কুহু। জিগ্যাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকায়।গভূর ঘোরলাগা দৃষ্টি রওনকের।ফিনফিনে চুলগুলো বাতাসে দোল খাচ্ছে। পরিবেশ শীতল অনুভব হলো কুহুর।হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল!মন বোধহয় অনুভব করলো কিছু।ততক্ষণে কুহুকে টেনে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিল রওনক।যেন আষ্টেপৃষ্টে বক্ষপিঞ্জরের পুরে নিবে। কলেজে ঘটে যাওয়া কাহিনিটা বিদ্যুৎতের মতো মস্তিষ্কে খেলে গেল কুহুর।অত্যল্পকালে ভয়ংকর শিহরণ তুলল তনুময় জুড়ে।ততক্ষণে রওনক দু’হাত পেছনে নিয়ে কুহুর কোমড় জড়িয়ে নিল।দৃষ্টি নিচু করল কুহু।একহাতে কুহুর কোমড় বেঁধে রাখা ওড়নাটা খুলে নিল রওনক।খানিক কেঁপে উঠলো কুহু! আশ্চর্য ব্যাপার তার আজ কোনোই দ্বিধা কাজ করছে না! এই পুরুষের ছোঁয়া তার অতি আপন আপন লাগলো!মন জানে এই ছোঁয়ায় কোনোরকম হিংস্রতা নেই! কোনো জোরজবরদস্তিও না! এতদিনে রওনক ভাইকে এটুকু চেনা হয়ে গেছে।শক্ত বুকে নিশ্চুপ লেগে রইল কুহু।কিঞ্চিৎ লজ্জা কাজ করছে তার।যত্ন করে কাঁধের পাশ থেকে চুল সরিয়ে দিল। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,

“এই রূপে আমি বারংবার নিজেকে ভেঙ্গেচুরে গুড়িয়ে ফেলি!নিজের অস্তিত্ব ভুলে যাই! মিষ্টি এক যন্ত্রণা আমাকে কুঁড়ে খাচ্ছে প্রতিনিয়ত।মনের আত্নচিৎকার যদি শুনতে তবে দূরে সরে থাকতে পারতে না!তুমি কি গানের কথাগুলো শুনেছ কুহু? বুঝে থাকলে তুমি অবশ্যই এই মুহূর্তে আমার মনের অবস্থা বুঝতে সক্ষম হবে!

কথা বলার সময় রওনকের উষ্ণ নিশ্বাস গলার পাশ ছেঁয়ে যাচ্ছিল কুহুর।বরফের মতো জমে গেল সে।অজানা এক ভাললাগা ভেতরে জলোচ্ছ্বাস বইয়ে দিল! রওনক ভাই তাকে ভালবাসতে শুরু করেছে? এত সুন্দর করেও তবে মনের বৃত্তান্ত প্রকাশ করা যায়? বিয়ের পর থেকে একটু একটু টের পেয়েছে কুহু।রওনক ভাই আগের মতো তার পায়ে পা লাগিয়ে জগড়া করে না। বরং যত্ন নিয়ে আগলায়! কুহুর বোকা মন বোধহয় ভালবাসার সুন্দর অনুভূতিটুকু বুঝতে পারছে।খানিক মাথা উঁচু করে রওনকের চোখের দিকে তাকিয়ে সোজা প্রশ্ন ছুঁড়লো সে,

” এতগুলো কথা বলার মানে কি দাঁড়ায় রওনক ভাই? তাহলে বলতে চান আপনি আমায় ভালবাসেন?

কুহুর কথা শুনে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো রওনকের।এই বোকামোতে সে অভ্যস্ত।মেয়েটার নিষ্কলুষ, মায়াবী মুখটাই তো তাকে একেবারে নিঃস্ব করে দিয়েছে! কুহুর কপালে টুক করে একটা চুমু খেয়ে বলল রওনক,

“ভালোবাসা মুখে ব্যক্ত করা যায় না।তোমাকে অনুভব করে নিতে হবে বোকা মেয়ে! আমি মুখে লক্ষ, হাজারবার ভালবাসি বলতে পারবো।তবে সেটা বুঝে নিতে হবে তোমার।কোনটা পুরুষের প্রকৃত ভালবাসা আর লালসা সেটা একটা মেয়েই উপলব্ধি করতে পারে।

রওনকের চোখের দিকে স্থির তাকিয়ে আছে কুহু।সামনে থাকা পুরুষটা তাকে ভালবাসে এতে একচুলও সন্দেহ নেই!সেটা রওনক ভাইয়ের মুখ থেকে শুনে অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করছে তার।মোবাইলে গান শেষ হয়ে অন্য আরেকটা গান প্লে হলো।দুজনের মনোযোগ কেবল দু’জনাতে।আচমকা কুহুকে কোলে তুলে নিল রওনক।কুহু ডান হাত রাখলো রওনকের শক্তপোক্ত বুকে।অত্যল্পকালে বাইরে শুরু হলো তুমুল বষর্ণ।কুহুকে খাটে নামিয়ে দিয়ে জানালা বন্ধ করতে ছুটলো রওনক।খাটের পাশ ভিজে যাচ্ছে।পানির ছাঁট গায়ে লাগতেই শরীর শিরশির করে উঠলো কুহুর।হাঁটু তুলে তাকিয়ে রইল সে রওনকের দিকে।থাই লাগিয়ে দিয়ে পর্দা টেনে দিল রওনক।ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই কুহুর চোখে চোখ পরলো।ঈষৎ হেসে ফিরে আসলো রওনক।মাথা নিচু রেখেই বলল কুহু,

” আমার ভয় লাগছে রওনক ভাই।

কথাটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো রওনকের।কুহুর পায়ের দিকে দৃষ্টি পরতেই দেখলো নক দিয়ে বেড শিট খুঁটছে।মেয়েটার ভেতর ঠিক কি চলছে এই মুহূর্তে বুঝতে বাকি নেই রওনকের।কুহু কি তবে মন থেকে সম্পূর্ণই মেনেছে তাকে? ভাবতেই বিশ্ব জয় করা আনন্দানুভূতি হলো।মাথায় চট করেই একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল তার।কয়েক পা ফেলে কুহুর পাশে এসে বসলো রওনক।হঠাৎ ফোন খুঁজতে লাগলো কুহু।সামনে থেকে ফোন তুলে নিয়ে বলল রওনক,

“এই তো ফোন! চোখের সামনেই ছিল।

” ও, হ্যাঁ।আরিয়ান তো বলেছিল তাকে ফোন দিতে। আমি কথা বলে আসি।

কুহু নামার জন্য উদ্যত হতেই বাঁধ সাধলো রওনক।কুহুকে চেপে ধরে বালিশে শুইয়ে দিয়ে হাত দিয়ে আঁটকে রাখলো।সটান হয়ে শুয়ে রইল কুহু।ড্যাবড্যাবে দৃষ্টি নিয়ে তাকাল রওনকের চোখে।মুখের কাছে ঝুঁকে আছে সে।গম্ভীর ভরাট স্বরে বলল রওনক,

“ভয় কেন পাচ্ছ বললে না তো।

এরুপ প্রশ্নে থতমত খেল কুহু।অপ্রস্তুত হয়ে বার কয়েক চোখের পাতা ঝাপটালো।আমতাআমতা করে বলল,

” মা…মানে ওই যে বাইরে ঝড়তুফান হচ্ছে না? আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে! কখন জানি বজ্রপাত হয়! তা…তাই ভয় লাগছে আরকি।

কথাগুলো বলে চোরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল কুহু।বুকে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে কেউ! বেশ বুঝতে পারছে রওনক ভাই ইচ্ছে করে এই প্রশ্নটা করেছে তাকে জব্দ করতে।মনে মনে খুব রাগ হলো কুহু।আচমকা বজ্রপাত হলো।চিৎকার দিয়ে চোখমুখ খিঁচিয়ে নিল কুহু।তৎক্ষনাৎ দু’হাতে জড়িয়ে নিল দীর্ঘকায় পুরুষকে।কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত হওয়ার পর বলল রওনক,

“ভয় কিসের? আমি তো আছি।

রওনকের বুকে মুখ রেখেই সঙ্গে সঙ্গে বলল কুহু,

” আপনাকেই তো ভয়!

“কেন? আমি কি বাঘ নাকি ভাল্লুক? খেয়ে ফেলবো তোমাকে?

সরে আসতে চাইলো কুহু।অনুভব হলো দু’টো শক্ত হাতে আবদ্ধ সে।বেফাঁস কি বলে ফেলল এখন বুঝতে পারছে।চোখমুখ কুঁচকে নিয়ে বলল,

” আপনি খুব অসভ্য! মিনমিনে শয়তান।

হতাশার স্বরে বলল রওনক,

“আমার মতো সভ্য পুরুষকে তুমি অসভ্যের তকমা দিচ্ছ! সভ্যতা বজায় রাখতে নিজের অনুভূতির সঙ্গে যুদ্ধ করি, নয়তো এই রণক্ষেত্র তোমার সঙ্গে ঘটে যেত নির্বোধ মেয়ে!

রওনককে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইল।চোখমুখ কুঁচকে বলল,

” সরুন, আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করার ইচ্ছা নেই আমার।

মুহূর্তে শব্দ করে হেসে ফেলল রওনক।তার হাসি যেন থামছেই না।কুহু বোকার মতো তাকিয়ে রইল।তবে এই পুরুষের হাসি তাকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য মুগ্ধ করে দিল।নিজেকে ধাতস্থ করে কুহুকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে নিল রওনক।কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদু আওয়াজে বলল,

“নির্ভয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারো তুমি।কথা দিচ্ছি আমি সেচ্ছায় হেরে যাব! নিজের সমস্ত আবেগ, অনুভূতি লুটিয়ে দিব তোমার পায়ের কাছে!

রওনকের কৌশলগত কথা বুঝতে বাকি নেই কুহুর।এই ছেলে আসলেই একটা নির্লজ্জ, অসভ্য।বার বার কথা দিয়ে কুহুকে লজ্জায় ফেলছে।চুপ করে রইল কুহু।আচমকা গলার পাশে পেলব ওষ্ঠের ছোঁয়া পেতেই কেঁপে উঠলো সে! সমস্ত তনুময় জুড়ে লোমকূপ গুলো গুঞ্জন তুলল!ভারী নিশ্বাসের শব্দ কানে বেজে উঠলো।পুরুষালি প্রগাঢ় স্পর্শে নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না কুহু।জড়িয়ে ধরলো রওনককে।অত্যল্পকালে কুহুর মাঝে উন্মাদের মতো ডুবে গেল রওনক।কোনোরকম বাঁধা, নিষেধাজ্ঞা জারি না দেখে মন বুঝে নিল মেয়েটা আজ সম্পূর্ণই নিজেকে উজার করেছে তার জন্য! অন্যরকম এক ভালো লাগার আবেশ ছুঁয়ে গেল রওনককে।শক্তপোক্ত হাতের স্পর্শে ক্রমেই কেঁপে উঠছিল কুহু। মুখ তুলে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থেকে কুহুর অধরোষ্ঠে গভীর ভাবে ওষ্ঠ দ্বারা ছুঁয়ে দিল।তাৎক্ষণিক চোখ বুজে ফেলল কুহু।হৃৎস্পন্দন থেমে গেল তার।গভীর স্পর্শের যে খুব ভয়ংকর অনুভূতি হয়! শরীর মৃদু কাঁপতে লাগলো কুহুর।রওনকের হাত অবাধ্যের মতো ছুঁটলো কুহুর তনুময় জুড়ে! ওষ্ঠে দন্তাঘাত পেতেই দ্রুত চোখ মেলে তাকাল কুহু।রওনকের চোখে চোখ পরলো।অন্যরকম এক ঘোর লাগা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে সে।কপালে পরে আছে এলোমেলো চুল।অসম্ভব মায়া মায়া কাজ করছে!ঠোঁটে ব্যাথা অনুভব করতেই দৃষ্টি কাতর হলো কুহুর।চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনা জল।ছেড়ে দিয়ে ঘনঘন দম ফেলল রওনক।কুহুর কপালে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুজে প্রশ্ন ছুঁড়লো,

“আমি কি তোমার ভয় কে বাড়িয়ে দিচ্ছি কুহু? অতিরিক্ত বেসামাল হয়ে গেছি?

মৃদু আওয়াজে কেবল বলল কুহু ,’হু’

মাথা তুলে ফের কুহুর দিকে তাকাল রওনক।সর্ব মুখে ছোট ছোট আদুরে চুমু খেয়ে বলল,

” আমি যদি ভয় টা আজ ভাঙ্গিয়ে দিতে চাই তুমি কি নিজেকে সামলে নিতে পারবে? নাকি ভুল বুঝে আরো দূরে সরিয়ে দেবে আমাকে?

কুহু কোনোরকম জবাব দিল না।রওনককে আলতো হাতে জড়িয়ে বক্ষস্থলে মাথা রাখলো নিশ্চুপ।সম্মোহনী কোনো আভাস পেল না রওনক।তবে মনে হলো তার বক্ষপিঞ্জিরায় মেয়েটা আশ্রয় খুঁজছে।দু’হাতে আগলে নিল রওনক।কপালে ওষ্ঠ ছোঁয়াল।ইচ্ছে করলো এভাবেই আজন্ম বুকের মধ্যিখানে ধরে রাখুক মেয়েটাকে! তবুও কোনো দূরত্বের সৃষ্টি না করুক! তাহলে রওনক একেবারে ম*রেই যাবে!কুহু নড়লো না একটুও।এই অদ্ভুত অনুভূতিটুকু সামাল দেওয়া দুষ্কর হয়ে যাচ্ছিল তার জন্য! তনুময় জুড়ে অস্বাভাবিক কম্পন সৃষ্টি হয়েছে।আরেকটুখানি সময় পেরোলে বোধহয় হৃদপিণ্ড থমকে যেত! রওনক ভাইয়ের প্রকৃতিবিরুদ্ধ হৃৎস্পন্দনের শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে।ওভাবে ঘাপটি মেরেই প্রশ্ন ছুঁড়লো সে,

“আপনি আমার উপর সম্পূর্ণ অধিকার রাখেন রওনক ভাই।আমি কি আপনাকে কষ্ট দিয়ে ফেলছি? এই ভয় যদি আমার আজন্মও না কাটে?

কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ থেকে উত্তর দিল রওনক,

“একজন পুরুষের নারী শরীরের প্রতি আকর্ষণ থাকবে এটা স্বাভাবিক।চাইলেই যখন তখন তোমাকে কাছে টেনে নিতে পারি আমি।এতে আমার দেহজ তৃষ্ণা নিবারন হবে ঠিকই কিন্তু যখন তোমার মনে ভালবাসার সৃষ্টি করতে পারব, তখন আমার জন্য মানসিক তৃপ্তিও হবে সেটা! আর ভালবাসা সাহসী হতে শেখায়।যখন সম্পূর্ণরূপে আমাকে গ্রহণ করার ইচ্ছে হবে তোমার, তখন ভীতুর মতো ভালবাসার যুদ্ধের ময়দান থেকে চাইলেও ফিরে যেতে পারবে না তুমি। আমি অপেক্ষায় সেদিনটার!

খুব মনোযোগ নিয়ে রওনকের কথা শুনলো কুহু। চট করেই তার মাথায় একটা প্রশ্নের উদয় হলো, সে কি রওনক ভাইকে ভালবাসে? তাকে এতটা এলোমেলো করে দিয়ে নিশ্চুপ থাকাতেও মন, মস্তিষ্ক তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে! তবে রওনক ভাইয়ের আচরণ দিন দিন ভাল লাগার পরশ দিয়েই যাচ্ছে! কুহু যদি রওনক ভাইকে ভালোও বাসে সেটা মুখে বলবে কি করে? ভাবতেই লজ্জায় ককিয়ে গেল।আরেকটা আষ্টেপৃষ্ট জড়িয়ে নিল দীর্ঘকায় পুরুষকে।শক্তপোক্ত বুকে নাক ঠেকলো কুহুর।রওনকের টিশার্ট থেকে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ নাসিকা রন্ধ্রে ধাক্কা খাচ্ছে।ইচ্ছে করে নাকটা আরেকটু ডুবিয়ে দিল কুহু।কেন ভীষণ ভাল লাগছে তার! রওনক বারান্দার দরজা গলিয়ে দৃষ্টি বাইরে রাখল।বৃষ্টির তেজ একেবারেই নেই বললেই চলে। পরিবেশ বেশ শীতল, নির্মল! কুহুর নড়াচড়া দেখে বোঝা যাচ্ছে শীত করছে মেয়েটার।অগত্যা কুহুকে আরেকটুখানি শক্ত করে জড়িয়ে নিল রওনক। উষ্ণতার পরশ পেতে ঘুমে চোখ লেগে আসলো কুহুর।


কলিং বেল বেজে যাচ্ছে অনবরত। রান্নাঘরে নাশতা তৈরিতে ব্যস্ত শারমিন বেগম। এত সকালে কলিং বেলের শব্দ অবাকই করেছে তাকে। বাড়িতে সবাই-ই আছে। তবে কে আসলো? রাশেদ জামাল প্রভাতকালের নাশতা সেরে বেরিয়ে যাবেন কিছুক্ষণের মাঝে।একেবারে তৈরি হয়ে ডাইনিং রুমে আসলেন তিনি। ততক্ষণে শারমিন বেগম গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। মাঝ বয়সী একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে কটকটে হলুদ রঙা সুতির থ্রিপিস। লাল ওড়নায় মাথায় ঘোমটা টেনে দেওয়া। পান চিবুচ্ছে মেয়েটা। হাতে একটা পুঁটলির মতো ছোট ব্যাগ। এই মেয়েকে চিনতে পারলেন না শারমিন বেগম।আপাদমস্তক দেখে নিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে রইলেন। মেয়েটি হাসিমুখে বলল,

“এইটা রওনাক স্যারের বাড়ি না?

শারমিন বেগম মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যা বললেন।

মেয়েটি এবার হাসি চওড়া করে বলল,

” তাইলে সঠিক ঠিকানায়ই আইছি। আমি জুলেখা। আজ থিকা এই বাড়িতে কাম করুম। রান্নাবান্না থিকা শুরু কইরা ঘরমোছা, প্রতিদিনের কাপড় কাঁচা সব দায়িত্ব আমার। সকাল থিকা বিকাল পর্যন্ত সব কাম কইরা দিয়া যামু। তা ভাই সাহেব কি রুমে আছে?

শারমিন বেগম বললেন,

“তুমি এখানে দাঁড়াও আমি রওনককে ডেকে নিয়ে আসছি।

শারমিন বেগম ঘুরে তাকাতেই দেখলেন কুহু খাবার বেড়ে দিচ্ছে রাশেদ জামালকে।চোখমুখ শক্ত করে তাকিয়ে থেকে চলে গেলেন তিনি।তক্ষুনি রুম থেকে বেরুলো রওনক।দরজা খোলা আর বাইরে জুলেখাকে দেখে এগিয়ে গেল সে।পরক্ষণে ভেতরে আসতে বলল।শারমিন বেগম অবাক দৃষ্টি নিয়ে ছেলের কান্ড দেখছেন।জুলেখার সাথে শারমিন বেগমকে পরিচয় করিয়ে দিল রওনক। নতুন পরিচারিকা সে। মায়ের দিকে তাকিয়ে মুখে হাসি টেনে বলল রওনক,

” আজ থেকে তোমার সব কষ্ট শেষ মা। সব কাজ জুলেখা করবে। কিছু করতে হবে না তোমাকে।

শারমিন বেগম ঘুরে তাকিয়ে কুহুকে বললেন জুলেখাকে রান্নাঘর দেখিয়ে দিতে।বাধ্য মেয়ের মতো চলে গেল কুহু।আশপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে এগিয়ে গেল জুলেখা। ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন শারমিন বেগম,

“এতদিন মায়ের এই কষ্ট চোখে পড়েনি বাবা? সোজা বললেই পারিস বউয়ের কষ্ট কমাতে কাজের লোক রেখেছিস। আর রাখার আগে আমার থেকে একটাবার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করিসনি!

” বউয়ের কষ্ট কমানোর কথা নয় মা।বাড়ির বউ হিসেবে কুহু সংসার সামলাবে এটাই নিয়ম।যেমনটা তুমি করে আসছো। কিন্তু কুহু তো এখন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। সবদিক বিবেচনা করে আমি জুলেখাকে নিয়ে এসেছি।

ছেলের কথার উত্তর দিলেন না শারমিন বেগম। স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,

“দেখো, শেখো ছেলের থেকে। কখনো বউয়ের চিন্তা হয়েছিল? আমার কাজ করা দেখে কষ্ট হয়েছিল? সারাদিন কতটুকু খেটে কাজ করি তদারকি করেছ কখনো?

কথাটুকু বলেই চলে গেলেন শারমিন বেগম। রাশেদ জামাল ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

” কাজের মেয়ে এনেছ ভাল করেছ কিন্তু একবার তোমার মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করা দরকার ছিল। বিয়ে তুমি একা করোনি। শতশত মেয়ে ডাক্তার হচ্ছে, কত রকম জব করছে তারা সংসার সামলাচ্ছে না?

রওনক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মাকে ইচ্ছে করেই জুলেখার বলেনি রওনক। বললে তিনি কখনই রাজি হতেন না। আর কুহু মাকে সাহায্য না করলেও বিষয়টা দৃষ্টিকটু লাগে। এটা নিয়েও রওনের দিকেই আঙ্গুল উঠতো।রাশেদ জামাল অর্ধেক খাবার রেখে বেরিয়ে গেলেন।দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমে চলে গেল রওনক।

,

কুহু তৈরি হয়ে আসলো রিশার রুমে। জানালার ধারে বসে আছে রিশা।গভীর মনোযোগী দৃষ্টি বাইরে। আজকাল রিশাকে কেমন জানি লাগে কুহুর। কিছু নিয়ে চিন্তিত মনে হয়। আশফিক ভাইয়ের ঘটনাটার পর থেকেই রিশার এই পরিবর্তন। কি বলে সান্ত্বনা দিবে জানা নেই কুহুর। রিশার এমন গম্ভীর ভাব ভাল লাগে না কুহুর। ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য তাড়া দিল কুহু।ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল রিশা। মলিন হেসে বলল, যাবে না সে। এখন তো ক্লাস হয় না৷ সামনের প্রোগ্রামের জন্য ব্যস্ত সবাই। রিশা যেহেতু কিছুতেই অংশগ্রহণ করেনি তাই যাবে না সে। এগিয়ে এসে রিশার শরীরের হাত বুলাল কুহু। গা হালকা গরম লাগছে। রিশা জানাল মাথা ধরে আছে তার। জ্বর ভাব। অগত্যা আর জোড় করলো না কুহু। চলে গেল। রিশা অন্য চিন্তায় মগ্ন। সকাল থেকে অনেকবার রাতিম ভাইকে ফোন করার পর একটু আগে রিসিভ করেছে সে। জ্বরের প্রকোপে কথা বলতে পারছে না। মন কেমন অশান্ত, অস্থির লাগছে রিশার। সকাল থেকে কিছু খেয়েছে তো লোকটা? কথা বলার শেষ মুহূর্তে রাতিমের ফ্ল্যাটের ঠিকানা চেয়েছিল সে। তক্ষুনি লাইন কেটে গেছে। কুহু আসায় আর ফোন করা হলো না। ফোনে শব্দ হতেই ভাবনার ঘোর কাটলো রিশার।স্ক্রিনে তাকাতেই দেখলো রাতিম ম্যাসেজ পাঠিয়েছে।

চলবে……