তুমি রবে নীরবে পর্ব-৩১+৩২

0
21
তুমি রবে নীরবে

#তুমি_রবে_নীরবে (৩১)
~নাদিয়া সাউদ

সামনে বড়ো এক ঝিল। একমনে বসে আছে রিশা। আশেপাশে লোক সমাগম ভালোই। বিকেলের ফিকে হয়ে যাওয়া কমলা রঙা সূর্যের আলো ছুঁয়েছে রিশার চোখেমুখে।একদৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে সে। অন্যরকম এক ভাল লাগা কাজ করছে ভেতর জুড়ে। রাতিম ভাই দেখা করতে বলেছে। তার মানে আজ অবশ্যই কিছু বলার আছে তার! এটা চিন্তা করতেই সারারাত ঘুম হয়নি। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ঠিকই বুঝে নিয়েছে সব। আশ্চর্যজনক ভাবে রাতিম ভাইকে নিয়ে ভাবতে একটুও খারাপ লাগেনি রিশার। নিজেকে মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ প্রস্তুত করেই এসেছে। রাতিম ভাইকে শূন্য ফেরাবে না। এত সুন্দর মনের একটা পুরুষের জন্য এক তরফা ভালবাসার রোগ থেকে মুক্তি মিলেছে। আগের মতো আর টান টা ঠিক অনুভূত হয় না আশফিক ভাইয়ের জন্য। জীবনে যোগ্য একজন কেউ আসলে সবকিছু খুব সুন্দর হয়ে যায়। রিশার জীবনের যোগ্য পুরুষটা যে রাতিম ভাই এতে একচুলও সন্দেহ নেই। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই আপন মনে হেসে ফেলল রিশা। মন বুঝি আজ একটু বেশিই ভালো।হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিল।সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে একটু বেশিই দেরি করছেন রাতিম ভাই। ঢাকার জ্যাম ঠেলেঠুলে আসতে দেরি হচ্ছে বোধহয়।

“আইরিশ?

চিরচেনা ভরাট কন্ঠস্বরটুকু শুনে তড়িৎ গতিতে ঘুরে তাকাল রিশা। আকাশী রঙের শার্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে রাতিম। শার্টের উপরের বোতাম খোলা।কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো উদভ্রান্তের মতো উড়ছে। ফর্সা মুখশ্রী জুড়ে অপরাধীর ছাপ।রিশা তাকিয়ে রইল নিনির্মেষ। হঠাৎই তার হৃৎস্পন্দনের গতি বেড়ে গেল। তিরতির করে কাঁপলো চোখের পাতা। রাতিম এগিয়ে আসলো কয়েক পা। হাতে ছোট একটা বক্স।গিফট পেপার দিয়ে মোড়ানো। রিশার দিকে বাড়িয়ে ধরলো।মুহূর্তে রাস্তার ধারের নিয়নবাতি গুলো জ্বলে উঠল।আলোকিত করে দিল চারিপাশ।হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে রাতিম।জিগ্যেসু দৃষ্টি রিশার। তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল রাতিম,

” সামান্য একটা উপহার তোমার জন্য। আমার অসুস্থতার সময় অনেকটা সাহায্য করেছ তুমি। আমি কৃতজ্ঞ।

উপহার টা হাতে নিল না রিশা। অন্যপাশে দৃষ্টি রেখে বলল,

“আচ্ছা! সেবার বিনিময়ে দিতে চাচ্ছেন? এই জন্যই তবে ডেকেছেন আমাকে?

রিশার হাত টা টেনে ধরে উপহারটা হাতে ধরিয়ে দিল রাতিম।বেজায় চমকালো রিশা। সামনে দাঁড়ানো পুরুষটা এতখানি স্পর্ধা দেখাবে ভাবেনি।একগুচ্ছ ভালো লাগার দমকা হাওয়া ছুঁলো রিশাকে। পকেটে হাত পুরে নিল রাতিম।শান্ত জলের দিকে তাকিয়ে বলল,

” সবকিছুর বিনিময় চাইলেই কি পাওয়া যায় আইরিশ? মায়া, ভালোবাসার বিনিময় আশা করতে নেই। এমনটা ভাবতেও নেই। আমাদের ভাবনা মতো সরলরৈখিক ভাবে চলে না জীবন। সহজ কিছু বলতেও অনেক সময় কঠিনতম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।

“আমি আপনার মতো এত কঠিন কথা বুঝি না।

রিশার কণ্ঠে এখনো খানিক অভিমান। শব্দ করে হাসলো রাতিম।

” আমি তো সহজ করেই মেলে ধরলাম নিজে…….

কথা শেষ করতে পারলো না রাতিম।প্যান্টের পকেটে ফোন বেজে উঠলো। হাতড়ে ফোন নিয়ে রিসিভ করে কানে জড়ালো সে। বেখেয়ালি ফোনের সঙ্গে পকেট থেকে লাল টুকটুকে একটা গোলাপ পড়ে গেল মেঝেতে। সেটা দৃষ্টি গোচর হলো না রিশার। মুহূর্তে সমস্ত অভিমান দূরীভূত হয়ে গেল তার। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে রাতিম। রিশা ডেকে বলবে কিনা ভেবে পেল না। মিনিট একের মধ্যেই রাতিম একপ্রকার ছুটে এসে জানাল জরুরি ফোন এসেছে তার। এক্ষুনি যেতে হবে। রিশার উত্তর টা শোনার সময় হলো না। চলে গেল রাতিম। রিশা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কি এমন দরকারী কাজ পড়ে গেল যার জন্য বলে যাওয়া গেল না? মুহূর্তে আবারো মনটা ভীষণ ভার হয়ে গেল রিশার। মাটি থেকে ফুলটা কুড়িয়ে নিল সে। সযত্নে ব্যাগে নিয়ে হাঁটা ধরলো।

◼️
রওনক আর কুহুর ফিরতে রাত আটটা বেজেছে প্রায়। চোখেমুখে আঁধার শারমিন বেগমের। পাশেই টিভিতে মনোযোগী রাশেদ জামাল। স্ত্রীর কাছে সবই শুনেছেন। ছেলের এমন কাউকে না জানিয়ে চলে যাওয়াটা ভালো লাগেনি তারও। কুহু রুমের কাছাকাছি আসতেই রিশাকে দেখলো।রওনক রুমে চলে গেল। রিশা কুহুকে নিয়ে নিজের রুমে চলে আসলো। ক্লান্ত কুহুর পা চলতে চাইছে না।মলিন মুখে হাসলো একটু। রিশার চোখেমুখে আনন্দ আর খুশি!

“কিরে আমার কলহপ্রিয় ভাইকে মানতে পারবি না বলেছিলি এখন তো সোজা হানিমুনে চলে গেলি।

কুহু থতমত খেল। বার কয়েক চোখের পাতা ঝাপটে নিয়ে আমতাআমতা করে বলল,

” ক..কিসের হানিমুন? তুই জানিস কি হয়েছিল?

কুহুর চোখেমুখে স্পষ্ট লজ্জার লাল আভা ফুটে উঠলো। হানিমুনের কথা বলতেই কেমন দৃষ্টি লুকিয়ে নিল। বেশ সুক্ষ্ম ভাবে পর্যবেক্ষণ করলো রিশা। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

“কিভাবে জানবো? তুই আগেই ভালো ছিলি কুহু। কত কথা শেয়ার করতাম তোর সাথে। একসাথে কত সময় কাটাতাম! এখন তোকে ভাগে পাই আমি? আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের উপর এখন ভাইয়ার শতভাগ রাজত্ব চলে!

কথার প্রসঙ্গ পাল্টালো কুহু। ক্লান্ত গলায় সবকিছু খুলে বলল। তবে তাদের বিয়ের বিষয়টা সঙ্গোপনে লুকিয়ে গেল।সব শুনে হা হয়ে রইল রিশা। এদিকে বাবা, মা মন খারাপ করে আছে রওনক হুট করে চলে যাওয়ায়। আর এখন দেখা যাচ্ছে কাহিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন! কুহু ফ্রেশ হওয়ার জন্য তাড়া নিয়ে চলে গেল। রুমে আসতেই দেখে রওনক ভাই ঝটপট ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসেছে। পরনে কেবল তোয়ালে।উন্মুক্ত বক্ষস্থলে দৃষ্টি পরতেই তৎক্ষণাৎ ঘুরে গেল কুহু। বিষয়টা দৃষ্টিগোচর হলো না রওনকের। ঈষৎ হেসে চুলের মাঝে হাত চালিয়ে নিয়ে বলল সে,

“যে বই তোমার সম্পূর্ণ পড়া। যার প্রতিটা পৃষ্ঠা তোমার মুখস্থ সেটাকে না বোঝার মতো ভাবভঙ্গি দেখাতে পারো না মেয়ে।

রওনকের কথা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো কুহুর।কান দিয়ে রীতিমতো উত্তপ্ত ধোঁয়া ছুটে গেল। দাঁত কিরমিরিয়ে বলল,

” আপনার মতো নির্লজ্জ পুরুষ আমি আর দেখিনি।

দ্রুত পা চালিয়ে কুহুর সামনে এসে দাঁড়াল রওনক। দু’হাত দেওয়ালে রেখে বন্ধী করে নিল। কুহু পেছাতে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকলো তার। মাথা খানিক উঁচিয়ে তাকাল রওনকের চোখের দিকে। অদ্ভুত এক বাঁকা হাসি তার ওষ্ঠকোণে,

“আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি যে মাথামোটা একটা! এত সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার পরও রওনক ভাইকে পড়তে পারলে না? এক রাতেই ভুলে গেলে সব?

লজ্জায় চোখ নামালো কুহু। রওনকের শক্তপোক্ত বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলো। কালকের ঘটনা ইচ্ছাপূর্বক মনে করিয়ে দিতে চাইছে রওনক। কুহু লজ্জায় আরো নুইয়ে গেল। কোমড়ে হাত পেচিয়ে নিজের সাথে কুহুকে মিশিয়ে নিল রওনক। কুহুর গলার পাশে দৃষ্টি আঁটকাতেই ভ্রু কুঁচকে গেল তার। একপাশে রক্ত জমাট হয়ে গাঢ় দাগ বসে আছে। মুচকি হাসি ফুটে উঠলো ওষ্ঠকোণে। হাত বাড়িয়ে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ছুঁয়ে দিল রওনক। মৃদু কেঁপে উঠলো কুহু। অবুঝের মতো প্রশ্ন ছুঁড়লো রওনক,

” তোমার গলায় এটা কিসের দাগ কুহু?

কথাটা বুঝতেই চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল কুহুর। শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে রওনককে ধাক্কা দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল সে।রওনক অবাক দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে। হঠাৎই কুহুর শরীরে যেন অসুরে শক্তি ভর করেছে!

◼️
ছেলের জন্য খাবার নিয়ে বসে আছেন শারমিন বেগম। পাশেই বসে খাচ্ছেন রাশেদ জামাল। ছেলেকে নিয়ে স্বামীর মুখে কোনো কথা নেই। এই নিয়ে একটু মনঃক্ষুণ্নই তিনি। বিয়ের পর ছেলের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে ভালোই। অন্যদিনের মতো ছেলেকে আর ডাকলেন না। কিছু সময়ের মধ্যে রিশা উপস্থিত হলো। মেয়েকে দেখেই নীরবতা ভঙ্গ করলেন রাশেদ জামাল। ছেলের অপেক্ষা করলেন না। খুব ভালো একটা বিয়ের সম্মন্ধ নিয়ে এসেছেন। রিশার চঞ্চল ভাবটা হঠাৎই উবে গেল। দৃষ্টি তুলল না সে। প্লেটে ভাত নাড়াচাড়া করে বাবার কথা শুনলো। তার দোটানা মন কি চায়? কদিন আগেও যেখানে আশফিক ভাইয়ের চিন্তা ছিল সেখানে এখন নতুন করে রাতিম ভাইয়ের নাম উদয় হয়েছে। আজকে তো লোকটা এসেছিলই মনের কথা বলতে। কি এমন তাড়া ছিল যে চলে গেল! অভিমানে আর পাল্টা ফোন করেনি রিশা। এই মুহূর্তে বাবাকে কিভাবে নিষেধ করবে? পরশু ছেলেপক্ষ আসবে জানালেন রাশেদ জামাল। খুশিতে গদগদ হয়ে গেলেন শারমিন বেগম। ছেলে ডাক্তার! সব শুনে ভালোই মনে হয়েছে। রিশার গলা দিয়ে খাবার নামলো না। অদ্ভুত এক অস্থিরতা কাজ করলো। ঠিক যেন গলায় বিঁধে যাওয়া কাঁটার মতো! রাতিম ভাই যতক্ষণ না নিজ থেকে কিছু বলছে ততক্ষণ আগ বাড়িয়ে রিশার কিছু বলা শোভা পায় না। এমন ধারালো ব্যাক্তিত্বের পুরুষের সঙ্গে বুঝেশুনে কথা বলতে হয়। কিছু সময়ের মাঝে রওনক আর কুহু উপস্থিত হলো। অন্যদিনের তুলনায় কুহু যেন আজ বড়োসরো ঘোমটাই টেনেছে। মুখ তুলে তাকাননি শারমিন বেগম। রাশেদ জামাল টুকিটাকি কথা বললেন পাত্রপক্ষ নিয়ে।প্রস্তাবটা ভীষণ ভালো লাগলো রওনকের। ঠোঁটে হাসি নিয়ে রিশার দিকে তাকাল কুহু। খাওয়ার মাঝে মায়ের সঙ্গে কথা বলল রওনক। একদিনের জন্য সাজেক গিয়েছে জানাল। এমন জলজ্যান্ত মিথ্যা শুনে খাওয়ার মাঝে বিষম খেল কুহু। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না শারমিন বেগমের। রওনক ব্যতিব্যস্ত হয়ে কুহুকে পানি খাইয়ে দিল। মাথার তালুতে ফুঁ দিয়ে দিল। ভীষণ চিন্তিত লাগলো তাকে। রিশা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। কুহু তাকে মিথ্যা বলল নাকি ভাইয়া মিথ্যা বলল বুঝতে পারলো না। বউয়ের প্রতি ছেলের এমন চিন্তা দেখে নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শারমিন বেগম। নীরবে প্রস্থান করলেন রাশেদ জামাল। ছেলে বোধহয় ভুলে গেছে এখানে তার বাবা, মা উপস্থিত আছেন। রওনকের পকেটে থাকা ফোনটা বেজে উঠলো। এতক্ষণে বোধহয় খেয়ালে এলো সে। পকেট থেকে ফোন বের করতেই দেখে রাতিম। একপলক কুহুর দিকে তাকিয়ে ছাদে চলে গেল সে। সিঁড়িঘরের কাছে এসে রিসিভ করে কানে জড়ালো। রাতিম জানাল পঞ্চাশ হাজার টাকা লাগবে তার। কেমন বিচলিতই লাগলো তাকে। পাল্টা আর প্রশ্ন করেনি রওনক। টাকা পাঠিয়ে দিবে বলল।

“ভালোবাসার মানুষটার জন্য সব সম্ভব তাই না ভাইয়া? যে কোনো উপায়ে মানুষটাকে নিজের করে পাওয়াই মূল লক্ষ্য থাকে। অনেকে বলে ভালোবাসলে পেতেই হবে এমন নয়।অপূর্ণতায়ও পূর্ণতা থাকে। তবে আমি বলবো এমন ভালবাসা জীবনে না আসুক! কুহুকে যদি তুই না পেতিস কোনো আক্ষেপ থাকতো তোর?

রিশার কথায় ঘুরে তাকাল রওনক। কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,

” বেঁচে থাকার অর্থই হারিয়ে ফেলতাম। সত্যিকারের ভালবাসার মানুষকে হারালে তার আক্ষেপ কোনো কিছু দিয়ে মেটানোর নয়।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রিশা। হাত ভাজ করে দূরে দৃষ্টি রেখে বলল,

“ভালবাসা নীরবে বয়ে বেড়ানো টা খুব কষ্টকর ভাইয়া। একটা মানুষের জন্য আকাশসম অনুভূতি জমিয়ে যখন সেটা তাকে জানানোর উপায় থাকে না সে অনুভূতিটা আরো বেশি কষ্টদায়ক! তোর খুব ধৈর্য্য! কুহুকে সেই কবে থেকে ভালোবেসে গিয়েছিস অথচ এতদিনে তাকে জানালি!

ঈষৎ হাসলো রওনক।

“এই অনুভূতি আমাকে বড্ড পুড়িয়েছে। আর কুহুর মতো নির্বোধ মেয়েকে তো বোঝাতেই পারিনি কখনো। অথচ এই বোকামোই আকৃষ্ট করতো আমাকে। কুহুকে বহু আগে থেকেই ভালবাসতাম সেটা এখনো বলিনি।

তড়িৎ গতিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল রিশা,

” মানে? বিয়ে হয়ে গেছে তোদের আর এখনো বলিসনি? এটা তো অবশ্যই অন্যায় করছিস ভাইয়া।

শব্দ করে হাসলো রওনক,

“নির্বোধ মেয়ে যখন বোঝেনি সেটা আর প্রকাশ করিনি। তবে কুহুকে আমি ভালবাসি এটুকু জানিয়ে দিয়েছি। তবে তার জন্য যে বহু আগে থেকেই নীরবে অনুভূতি পুষেছি সেটা এখনো জানাইনি। এটা একান্ত আমার নিজের মধ্যে থাকুক।

” মানে কি? অনেক আগে থেকে ভালবাসতি সেটা বলবি না?

“বলতাম রিশ।কিন্তু এখানে অনেক ঝামেলা আছে।কুহু যদি প্রশ্ন করে, ভালবাসতেন তাহলে অন্য ছেলের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার সময়ও বাঁধা দেননি কেন? তখন কি বলবো? কিছু জিনিস একান্ত নিজের মাঝে রাখতে হয়। কুহু বহু আগে থেকেই নীরবে আমার মনের গহীনে আছে সেভাবেই থাকুক। তবে কাপুরুষের মতো পিছিয়ে নেই আমি। ভালবাসি ঠিকই জানিয়ে দিয়েছি।

সিঁড়ির কাছাকাছি শব্দ হলো। রওনক আর রিশা একত্রে তাকাল। কুহু উঠে এলো। হাসিমুখে চলে গেল রিশা। কুহু পিছু ডাকলো। কোথায় সেও আসলো আড্ডা দিতে এদিকে রিশা চলেই গেল! রওনকের দিকে দৃষ্টি পরতেই দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে এসে বলল কুহু,

” খাবার টেবিলে সত্য বললে কি হতো শুনি? আমি তো রিশাকে বলে দিয়েছি সব সত্য কথা। আর আপনি বললেন সাজেক! রিশা ভাবছিল আমরা হানিমুনে গিয়েছি। এখন তো বাবা, মাও ভাববে আমর হানিমুনে গিয়েছি!

কোনো উত্তর দিল না রওনক। কুহুকে কোলে তুলে নিল। চমকে উঠলো কুহু। অপ্রস্তুত হলো। আশেপাশে দ্রুত দৃষ্টি বুলালো। পাশের বিল্ডিং থেকে কেউ দেখে না ফেলে! রওনকের কপালে পড়ে থাকা চুল গুলো বাতাসে উড়ছে। গভীর দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে সে।

চলবে………….

#তুমি_রবে_নীরবে (৩২)
~নাদিয়া সাউদ

কুহুকে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে নামতে নামতে বলল রওনক,
“এই কথাটা তো আমার মাথাতেই ছিল না। আমাদের তো এখনো হানিমুনই হয়নি! কবে যাওয়া যায় বলো তো বউ?

কুহুর চোখদুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেল। রওনকের টি-শার্ট মুচড়ে ধরে বলল,

“হ্যাঁ, প্রতিদিনই আপনার সাথে হানিমুনে চলে যাব।

” উহুম। হানিমুনে গিয়ে কয়েকদিন থাকলেই হবে। অবশ্য এই কয়েকদিনে আমার পোষাবে কিনা! সব বিপত্তি ঘটে এই কাজের জন্য। আমার তো ইচ্ছে করে তোমাকে নিয়ে দূর কোনো অজানায় হারিয়ে যাই! যেখানে শুধু ভালবাসা আর ভালবা……

রওনক পুরো কথা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই কুহু তার পেলব হাতখানা নিয়ে মুখ চেপে ধরলো। বাকি আর কথা বাড়ালো না রওনক। সামনে তাকিয়ে হাঁটা ধরলো। দাঁত চিবিয়ে বলল কুহু,

“দুনিয়ার সব ভালবাসা আপনার ভেতরেই! যারা প্রেমের ইতিহাস করে গেছে তারাও বোধহয় এত ভালবাসেনি।

রুমে এসে কুহুকে খাটে নামিয়ে দিয়ে একটুখানি সুর তুলে বলল রওনক,

” এ বুকে বইছে যুমনা নিয়ে অথৈ প্রেমের জল। তার তীরে গড়বো আমি আমার প্রেমের তাজমহল।

কুহু বোকার মতো তাকিয়ে রইল। এ কোন রওনক ভাইকে দেখছে? যার মুখ দিয়ে সবসময় ঝাঁঝালো কথা ছাড়া কিছু আসতো না! মনে হচ্ছে এই প্রেম শতবছর ধরে লালিত তার অন্তঃকরণে! পাশেই ধপাশ করে খাটে শুয়ে পরলো রওনক। দৃষ্টি রাখলো সিলিং ফ্যানের দিকে। বুকের বা পাশে ডান হাতটা চেপে ধরে বলল,

“সম্রাট শাহজাহানের তাজমহলের থেকেও বিরাট বড়ো তাজমহল তোমার জন্য বানিয়েছি কুহেলিকা! ঠিক আমার বুকের এখানটায়!

চোখ সরুসরু করে রওনককে পর্যবেক্ষণ করলো কুহু। দিনদিন বেরসিক, কলহপ্রিয় রওনক ভাই যেন রোমান্টিক হয়ে যাচ্ছে! সবকিছু ঠিক হজম হচ্ছে না! কুহুর ভাবুক মুখের দিকে তাকাল রওনক। পরক্ষণে হাত টেনে ধরে টেনে নিল স্বীয় বক্ষস্থলে। টাল সামলাতে পারলো না কুহু।তার অধরোষ্ঠ ঠেকলো রওনকের গলার পাশে। জড়িয়ে নিয়ে কানের পাশে ফিসফিস করে বলল রওনক,

” ভালবাসাতে কোনো খাঁদ হয় না, নির্বোধ মেয়ে। অহেতুক সন্দেহ একটা সুন্দর সম্পর্কের জোড়া কে আলগা করে দিতে সক্ষম। আমি প্রতি মুহূর্তে, প্রতিনিয়ত ভালবাসি জানান দিয়ে যাব। তুমি শুধু অনুভব করে যাবে।

কথা বলা শেষে কুহুর কানে ছোট্ট একটা চুমু খেল রওনক। মৃদু কেঁপে উঠলো কুহু। দ্রুত মাথা তুলে রওনকের দিকে তাকাল। একমুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছে রওনক ভাই তাকে পড়ে নিয়েছে! মন অবধি হদিস করে নিয়েছে। রওনকের মুখের উপর ঝুঁকে আছে কুহু। চোখে একরাশ মায়া নিয়ে তাকিয়ে আছে রওনক। হাত বাড়িয়ে কুহুর পাতলা ঠোঁট জোড়া আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে দিল। অপ্রতিভ হয়ে বার কয়েক চোখের পাতা ঝাপটালো কুহু। কোনোরকম কপালে হাত রেখে বলল,

“দু’দিন ধরে ঠিকঠাক ঘুম হচ্ছে না। মাথাটা ব্যাথা করছে।

রওনকের কপালে চিন্তার ভাঁজ পরলো। উঠে বসলো সে। বিছানার পাশ টেবিলের ড্রয়ার হাতড়ে মাথা ব্যাথার মলম বের করলো। কুহুকে টেনে নিজের কোলে শুইয়ে দিল। চুলে হাত বুলিয়ে দিল খানিক। কুহু অবাক দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে। এরুপ কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিল না। কুহুর মাথায় মলম লাগিয়ে আলতো করে টিপে দিল। চোখ বুজে রাখলো কুহু। বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে ঈষৎ হাসলো রওনক। মুখের আদল বলছে স্বস্তি পাচ্ছে মেয়েটা।

” ঘুম হলে ঠিক হয়ে যাবে দেখো। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি চুপচাপ ঘুমিয়ে যাবে।

কুহু চোখ মেলে তাকালো। রওনকের কোমড় জড়িয়ে নিয়ে আরেকটু গুটিসুটি হয়ে গেল। এই স্পর্শে কোনো স্বার্থ নেই! আছে অফুরন্ত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। ভেবেছিল রওনকের ভাইয়ের মনে হয়তো অন্য বাসনা চেপেছে। অথচ কুহুর সামান্য মাথা ব্যাথার কথা শুনে কেমন চিন্তিত হয়ে গেল লোকটা! হঠাৎই কুহুর ভেতর থেকে কেউ বলে উঠলো, তুমি খুব সৌভাগ্যবতী মেয়ে! পুরুষের এমন যত্ন আর নিটোল ভালবাসা কি সহজে মেলে? তবুও যদি সন্দেহ পুষে রাখো তবে সত্যিই নারী বোকা তুমি! কুহুর মাথায় ছোট্ট একটা চুমু খেল রওনক। মেয়েটা শান্তিতে ঘুমালেই নিশ্চিন্ত। সম্ভব হলে এইটুকু ব্যাথা নিজেই শুষে নিতো। কুহুর বন্ধ চোখের কার্নিশ বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। অসুস্থ হলে ঠিক মায়ের কোলে এভাবে শান্তিতে চোখ বুজতো। বাবার আদর তো জোটেইনি কপালে। খুব ছোট বেলায় হারিয়েছে। ঠিকঠাক সুন্দর একটা স্মৃতিও তার মানসপটে নেই! শুনেছিল একটা মেয়েকে তার বাবার চেয়ে অধিক ভালবাসতে পারে না কেউ।সে সৌভাগ্য তার হয়নি। রওনক ভাইকে পাবার পর মনে হচ্ছে দূর্ভাগ্যও নয় তার। কুহুর শরীর মৃদু কাঁপছে কান্নার দাপটে। হঠাৎই যেন টনক নড়লো রওনকের। বিচলিত হয়ে কুহুর গালে হাত রাখতেই দেখলো ভেজা!

“কুহু? মাথা বেশি ব্যাথা করছে? খারাপ লাগছে? বলো আমাকে? এই কুহু?

রওনকের কোল থেকে মাথা তুলো উঠে বসলো কুহু। ভেজা চোখে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে রইল চিন্তিত রওনকের মুখে। পরক্ষণে বক্ষস্থলে ঝাপিয়ে পরলো। কান্নার বেগ বাড়লো। রওনকের ভেতর অস্থির হয়ে উঠলো! হঠাৎ কি হয়ে গেল মেয়েটার? কুহুর কান্না তার বুক ক্রমেই ভারী করে তুলল। নিশ্বাস রোধ হয়ে রইল। বুকের সঙ্গে শক্ত করে জড়িয়ে নিল সে। কান্নারত স্বরে থেমে থেমে বলল কুহু,

” আপনি আমায় এত কেন ভালবাসেন রওনক ভাই?

কুহুর কান্নার কারণ এতক্ষণে বোধহয় ঠাওর করতে পারলো রওনক। একটুখানি যত্ন পেতেই মেয়েটা আবেগপ্রবণ হয়ে গেছে। মাথায় অনেকগুলো চুমু খেয়ে বলল রওনক,

“ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে! এতখানি ভালবাসি কেন সেটা তো নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না। ভালবাসার কোনো সংজ্ঞা হয় না। তবে আমি কিন্তু ভালবাসার বিনিময়ে ভালবাসা আদায় করে নিতে জানি। একচুলও ছাড় দেই না।

মিনমিনে গলায় বলল কুহু,

” আমি ঋণ রাখি না। অবশ্যই শোধবোধ করে দিব।

রওনকের ওষ্ঠকোণে হাসি ফুঁটে উঠলো। বোকা মেয়েটা ভালোই উত্তর দিতে জানে তবে!

◼️
ঘড়িতে সকাল নয়টা। নাশতা তৈরি করছেন শারমিন বেগম। হাতে হাতে এগিয়ে দিচ্ছে জুলেখা। কুহু আজকে এখনো জাগেনি। ব্যাপারটা অবাক করেছে শারমিন বেগমকে। অন্যদিন ঠিক সকালেই জেগে যায় মেয়েটা। হয়তো জুলেখাকে রাখা হয়েছে বলেই মেয়েটা আশকারা পেয়ে বসে আছে। বেশ বিরক্ত নিয়েই কাজ করছেন শারমিন বেগম। টেবিলে খবরের কাগজ হাতে অপেক্ষায় বসে আছেন রাশেদ জামাল। কিছুক্ষণের মাঝে রিশা উপস্থিত হলো। তক্ষুনি কলিং বেল বেজে উঠলো। এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল রিশা। তোহা আর আফসানা বেগম দাঁড়িয়ে আছেন হাসিমুখে। বেশ খুশিমনেই অভিবাদন জানালো রিশা। তোহা হাত থেকে ফলমূল আর মিষ্টির প্যাকেট ধরিয়ে দিল। ভেতরের রুমে গিয়ে মাকে ডাকলো রিশা। মেয়ের মুখে কুটুম আসার খবর ঠিকই পেয়েছেন শারমিন বেগম। বাহিরে যেতে ইচ্ছে হলো না তার। হাতের কাজ পড়ে আছে। এক্ষুনি স্বামীকে খাইয়ে বিদেয় দিতে হবে। জুলেখার উদ্দেশ্যে বললেন বেশি করে চা বসিয়ে দিতে। আর ফলমূল কাঁ-টতে। রিশার বদৌলতে এতক্ষণে জুলেখার জানা হয়ে গেছে বাড়িতে কুহুর মা আর ভাবী এসেছে।

রাশেদ জামাল বেশ হাসিখুশিই কুশল বিনিময় করছেন। কিছু সময়ের মাঝে জুলেখা এসে পরোটা আর আলুভাজি দিয়ে গেল। আর কুহুর বাড়ির লোকদের জন্য কাঁ-টা ফলমূল। দৃষ্টি ঘুরিয়ে কুহুকে খুঁজছিল তোহা। জুলেখা দাঁড়িয়ে ফটাফট নিজের পরিচয় দিতে শুরু করলো। এই বাড়ির নতুন কাজের লোক সে। রওনক স্যার নিয়ে এসেছে তার বউয়ের কষ্ট কমাতে। বউ যেন সংসারের কাজের চিন্তায় পড়াশোনার ক্ষতি না করে। জুলেখার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে তোহা। মনে হচ্ছে কথা একটু বেশিই বলে এই মেয়ে। জুলেখার কথাগুলো বেশ ভালো লাগলো আফসানা বেগমের। জামাই তবে এত চিন্তা করে তার মেয়ের জন্য? খাওয়া শেষ হতেই তাড়া নিয়ে চলে গেলেন রাশেদ জামাল। রওনকের দরজা ভেতর থেকে লক করা দেখে আর ডাকলো না রিশা। ফিরে আসলো। হাত মুছতে মুছতে প্রবেশ করলেন শারমিন বেগম। ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি নিয়ে বললেন,

“অনেক্ক্ষণ যাবৎ বসিয়ে রাখলাম। আসলে একা হাতে সব কাজ দেখতে হয় তো। কাজের লোক দিয়ে কি আর রান্না বান্না হয়? তা কুহু কি এখনো আসেনি আপনাদের খবর পেয়ে?

রিশা কিছু বলতে গিয়েও চুপ হয়ে গেল। আফসানা বেগম কথার প্রসঙ্গ পাল্টালেন। মেয়ের শশুড় বাড়িতে দাওয়াত দিতে এসেছেন জানালেন। শারমিন বেগম হাসিমুখেই দাওয়াত গ্রহণ করলেন। পরক্ষণে রিশাকে আদেশ করলেন কুহুকে ডাকার জন্য। খানিক থতমত খেল রিশা। তোহাকে ডেকে নিয়ে গেল সঙ্গে। নিজের রুমে এসে বলল রিশা,

” কুহুরা এক জায়গায় গিয়েছিল। ফিরেছে কাল রাতে। ডাকতে গিয়ে দেখি দরজা ভেতর থেকে লক। তাদের ডাকা কি ঠিক হবে ভাবী?

মুখ টিপে হাসলো তোহা।

“মনে হচ্ছে হানিমুন থেকে ফিরেছে আমার ননদী। ঠিকঠাক ঘুমায়নি তাই হয়তো জাগতে পারেনি এখনো। ডাকা অবশ্যই ঠিক হবে না তবে এটা যে তার শশুড় বাড়ি সেটা ভুলে গেলেও চলবে না।

” তাহলে তুমিই গিয়ে ডাকো। আমি পারবো না।

,

কলেজ যাওয়ার জন্য একেবারে তৈরি রওনক। আয়নায় দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। খাটে শুয়ে তাকিয়ে আছে কুহু। শেষ রাতে গায়ে জ্বর উঠেছিল। সেসময় থেকে রওনক একটুখানিও ঘুমায়নি। যত্ন নিয়েছে কুহুর। গা মুছিয়ে দিয়ে ঔষধ দিয়ে দিয়েছে। কড়াকড়ি নির্দেশ জানিয়েছে কুহু যেন চুপচাপ শুয়ে থাকে। বাকিটা সে সামলাবে। এভাবে শুয়ে থাকতে ভাল লাগছে না কুহুর। বাইরে সবাই কি ভাবছে কে জানে। শরীর ভীষণ দূর্বল লাগছে। রওনক ভাই বেরিয়ে গেলে ওঠে বাইরে যেতে হবে তাকে। আয়নায় তাকিয়ে বলল কুহু,

“আপনি এত সেজেগুজে বের কেন হচ্ছেন রওনক ভাই? ওই শাহিনূর মাহি ম্যামের জন্য? আজকে তো আমি যাচ্ছি না তাই একটু বেশিই পরিপাটি হয়ে যাচ্ছেন আপনি।

কুহুর কথা শুনে ঘুরে তাকাল রওনক। এমন কিছু শুনবে ভাবতে পারেনি। গলা খাকাড়ি দিয়ে বলল,

” রোজ তো এভাবেই যাই। তাছাড়া তোমার বর কি দেখতে সুন্দর নাকি? সেজেগুজে গেলেই বা কি?

“কে বলেছে সুন্দর না? আপনি তো…..

কথাটুকু বলেই থেমে গেল কুহু। রওনক ভাই কথার জালে ফাঁসিয়ে দিয়েছে তাকে। আমতাআমতা করলো। রওনক উৎসুক দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে। শোয়া থেকে উঠে বসলো কুহু। হতাশার শ্বাস ফেলে বলল রওনক,

” হাজার রমনী দৃষ্টি দিলেই কি! নিজের বউয়ের মুখেই এখনো প্রশংসা শুনতে পেলাম না। অবশ্য হট লুক দিলে সে আমার দিকে তাকায়ই না লাজে!

কুহু উত্তর দেওয়ার আগেই দরজায় টোকা পরলো। রওনক এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলো তোহা হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সালাম জানাল সে।কুশল বিনিময় করলো হাসিমুখে। দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে বলল। কলেজ যাওয়ার সময় হয়েছে জানিয়ে চলে গেল। কুহু ততক্ষণে বিছানা ছাড়লো। তোহা এগিয়ে এসেই কুহুর দিকে একটা পলিথিন ব্যাগ ধরিয়ে দিল। এতে কুহুর সেই লাল আর সাদা গোলাপের গাছ দুটো। ভীষণ খুশিমনে সেগুলো হাতে নিল কুহু। আচমকা কুহুর গলার পাশে দৃষ্টি আঁটকে গেল তোহার। মৃদু হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটের কোণে। গলা ঝেড়ে বলল,

“তা ননদী, হানিমুন কেমন কাঁটলো? অবশ্য ভালোই কেটেছে মনে হচ্ছে। গলায় ভালবাসার চিহ্ন একেবারে জ্বলজ্বল করছে!

তোহার কথা কর্নপাত হতেই কুহুর ডানহানটা চলে গেল গলায়। অপ্রতিভ হয়ে গেল সে। বারকয়েক চোখের পাতা ঝাপটে নিয়ে ওড়না খুঁজতে লাগলো খাটে। লজ্জায় যেন পালাতে চাইছে মেয়েটা। শব্দ করে হাসলো তোহা। গায়ে কোনোরকম ওড়না জড়িয়ে নিয়ে গাছ দুটো নিয়ে বেলকনিতে চলে গেল কুহু। গাছদুটোতে সাদা আর লাল দু’টো গোলাপই ফুটে আছে। এর মানে তবে কি দাঁড়ায়? রওনক ভাই ফিরলে আজ অবশ্যই জিগ্যেস করবে। এসব যুক্তি সে ছাড়া আর কে বলতে পারবে? তোহা বেলকনিতে চলে আসলো। কুহুর মাথায় বড়োসরো ঘোমটা দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,

” তোমার এই লাজুকতাই বলে দিচ্ছে তুমি ঠিক কতটা সুখে আছ কুহু! জীবনে একটা সঠিক মানুষ পেলে আনন্দময় হয়ে ওঠে প্রতিটা মুহূর্ত, ক্ষণ। ভালবাসা এমন একটা জিনিস যেটা ভালবাসা দিয়েই অর্জন করতে হয়। অন্য কিছু দিয়ে পরিমাপযোগ্য নয়। রওনক তোমাকে খুব ভালবাসে সেটা বাইরের মানুষকে আচার-আচরণের মাধ্যমে বুঝতে দিও না। শুনেছি তোমার জন্য নাকি রওনক কাজের মেয়ে এনেছে। এতে তোমার শাশুড়ি খুব একটা খুশি হয়েছে মনে হয়নি। সংসারটা তোমার কুহু। সবার মন জুগিয়ে চলা তোমার কাজ। একতরফা স্বামীর ভালবাসা পেয়ে সব ভুলে যেয়ো না। রওনকের যা ইচ্ছে হয় করুক। বাঁধা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে তুমি তোমার সর্বোচ্চ দিয়ে সবাইকে খুশি রাখবে। এই যে রান্নার কাজটা সেটা তুমি দেখতে পারো কুহু। যেচে শাশুড়ির কাছ থেকে সব শিখে নেবে।

কুহু একদৃষ্টিতে ভাবীর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছিল। চমৎকার ভাবনার মেয়ে তোহা। নিজের সংসারটা সত্যিই খুব সুন্দর ভাবে আগলে নিয়েছে। কখনো কোনো অভিযোগ বা রাগ হতে দেখেনি। কাজ বেশি হলেও কোনোদিন উচ্চ শব্দে ভাইয়ের মুখের উপর কিছু বলতে দেখেনি। এই জন্যই বোধহয় ভাইয়া এত মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসে ভাবীকে। কুহুর গালে হাত বুলিয়ে নিয়ে বলল তোহা,

“বিয়ে একটা মেয়ের জীবনের সবচেয়ে বড়ো পরিবর্তন কুহু। দায়িত্ব বেড়ে যায়। তুমি পড়াশোনা করছো, স্বামীর সাপোর্ট পাচ্ছ খুব ভালো, তবে নিজের দায়িত্ব আর কর্তব্য থেকে সরে যেও না।

রিশা ডাকতে ডাকতে চলে আসলো। কুহু আর তোহা রুমে চলে আসলো। রিশাকে তৈরি দেখে বলল কুহু,

” কিরে তুই ভার্সিটিতে যাচ্ছিস নাকি রিশু?

রিশা যেন একটু থতমত খেল। আমতাআমতা করে বলল,

“হ্যাঁ,,মানে যাচ্ছি তো ভার্সিটিতে। তুই জানিসনা আজ নবীন বরণ? সবাই ফোন করছে যাওয়ার জন্য। একটু ঘুরে আসি। আমি তো দু’দিন যেতেই পারিনি।

আফসোসের স্বরে বলল কুহু,

” ইশশ, আমারও যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু তোর ভাই তো নিষেধ করে গেল। একটু জ্বর এসেছিল তাই।

“ভাইয়া যখন নিষেধ করেছে তাহলে আর যাবার দরকার নেই তোর। বাসায় আরাম কর। নয়তো চিনিসই তো আমার ভাইকে। আচ্ছা আমি বেরুচ্ছি। তোকে আর ভাবীকে বসার রুমে ডাকছে। তাড়াতাড়ি যা।

কথাটুকু বলেই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে আসলো রিশা। দরজার বাইরে এসে সঙ্গোপনে স্বস্তির শ্বাস ফেলল। সে তো এখন রাতিম ভাইয়ের ফ্ল্যাটে যাবে। কাল থেকে লোকটাকে ফোন করে বন্ধই পাচ্ছে। কোনো বিপদ হলো কিনা কে জানে। দুশ্চিন্তায় রাতে একটও ঘুম হয়নি। যে পর্যন্ত চোখের দেখা না দেখবে দুদণ্ড শান্তি মিলবে না।

চলবে…….