তুমি রবে নীরবে পর্ব-৩৫+৩৬

0
12
তুমি রবে নীরবে

#তুমি_রবে_নীরবে (৩৫)
~নাদিয়া সাউদ

সারাদিনে আজ কাজের ধকল কম যায়নি। শরীর যেন চলতেই চাইছে না কুহুর। তবুও মাথায় একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। আদনানকে খুব একটা মন্দ লাগেনি। চোখের ত্রুটি টা তো জন্মগত নয়। এইটুকু খুত অতটা চোখে লাগবার মতো নয়। রিশাকে তারা পছন্দ করলেই হয়। মেয়েটা নতুন ভাবে সবকিছু শুরু করলে আগের চিন্তা নেমে যাবে মাথা থেকে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ড্রয়ার থেকে সেলোয়ার-কামিজ বের করলো কুহু। এই শাড়ি পরে আর কতক্ষণ থাকবে? হাতের উপর কারো স্পর্শ পেতেই ভাবনার জাল ছিন্ন হলো। হাত থেকে কাপড়গুলো টেনে নিয়ে বলল রওনক,

“এই শাড়িটা এখন সম্পূর্ণ এলোমেলো করে দেওয়ার অধিকার রাখি আমি। কার অনুমতি নিয়ে চেইন্জ করতে যাচ্ছ শুনি?

রওনকের কথা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লাগলো না কুহুর। অপ্রতিভ হয়ে বার কয়েক চোখের পাতা ঝাপটালো। রওনককে এড়িয়ে যেতে যেতে বলল,

” আপনার অসভ্য কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না এখন।

ফের কুহুর সামনে এসে দাঁড়াল রওনক। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“কিন্তু আমার যে অসভ্য হতে ইচ্ছে হচ্ছে খুউব!

বেলকনির দিকে দৃষ্টি পরতেই চট করে বলল কুহু,

” আচ্ছা রওনক ভাই! ওই যে বারান্দায় দেখুন গোলাপ গাছে দু’টো ফুল ফুটেছে। লাল আর সাদা। আপনার মতে এটা কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে?

কুহুর কথা শুনে একপলক বারান্দায় তাকাল রওনক। সত্যিই দুইটা ফুল ফুটে আছে। তপ্ত শ্বাস ফেলে কুহুর শাড়ির কুচিগুলো টেনে খুলে নিল। ভয়ানক চমকে উঠলো কুহু। প্রশ্নের প্রতিত্তোরে এমন কিছু করবে রওনক ভাই কল্পনাতীত ছিল। আপনাআপনি কাঁধ থেকে আঁচল খসে পড়লো। কুহু জমে রইল বরফের মতো। রওনকের দৃষ্টি আঁটকে রইল কুহুর চোখে। কুহুকে টেনে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলল,

“সাদা গোলাপটা তোমার স্বচ্ছ মনেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে মেয়ে। যেখানে আগে আমার জন্য কেবল রাগ আর জেদ ছিল! আর লাল গোলাপটা ভালবাসার আগমনী বার্তা নিয়ে এসেছে। এই যে আমাকে তুমি ভালবাসো এখন!

রওনকের কথায় ভারী অবাক হলো কুহু। ভীষণ গোছানো কথা। মুচকি হাসি ফুটে উঠলো ওষ্ঠকোণে। সেটুকু দৃষ্টিগোচর হয়ে রইল রওনকের। কুহুর শুভ্র রঙা স্কন্দে দৃষ্টি আঁটকে গেল রওনকের। পেলব অধরোষ্ঠ মিলিয়ে নিল। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির স্পর্শ পেতেই সর্বাঙ্গ শিউরে উঠলো কুহুর। তাৎক্ষণিক জড়িয়ে নিল রওনককে। শক্তপোক্ত বুকে মাথা ঠেকাতেই স্পন্দন শুনতে পেল সুস্পষ্ট! কর্ণ লতিকায় ঈষৎ দন্তাঘাত করে ফিসফিস করে বলল রওনক,

” আমি জামা চেইন্জ করিয়ে দেই কুহু?

কথাটা কর্ণপাত হতেই ছিটকে সরে আসলো কুহু। একদৌড়ে ওয়াশরুমের দিকে ছুটলো। শব্দ করে হাসলো রওনক। পরক্ষণে গিয়ে পরীক্ষার খাতা নিয়ে বসলো। কুহুর ক্লান্তি মাখা চোখেমুখে লাজুক হাসি ভীষণ সুন্দর লাগছে। ভীষণ ভাবে আকৃষ্ট করছে। মাথা চুলকে খাতায় মনোনিবেশ করলো রওনক। মেয়েটাকে অযথা জ্বালানো উচিত হবে না। সারাদিন বড্ড খাটাখাটুনি করেছে। অত্যল্পকালে কুহুর চিন্তা রেখে স্বীয় কাজে মনোযোগ দিল।

◼️
মাস পেরিয়েছে অনেকদিন। আদনানদের বাড়ি থেকে সেদিনের পর আর কোনো খবর আসেনি। রিশার জন্য ভালোই হয়েছে৷ ছেলেটার চোখের ব্যাপারটা নিয়ে কিছু বলতে হয়নি তাকে। রাশেদ জামালের মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এমন ভালো ছেলে সচরাচর মেলে আজকাল? নম্র, ভদ্র, শিক্ষাদীক্ষা সবদিকেই স্বয়ংসম্পূর্ণ! সামান্য ত্রুটি দিয়ে ছেলেটাকে বিচার করেননি। শারমিন বেগমের খানিক আপত্তিই ছিল আদনানের চোখের সমস্যা নিয়ে। তবে ছেলেটার ব্যবহার আর কথাবার্তার ধরণ তাকে মুগ্ধ করেছে। রিশাকে অপছন্দ করার কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। অবশ্য সবার রূচি তো এক নয়। এখনো পথ চেয়ে আছেন রাশেদ জামাল। যদিওবা ফিরে আসেন তারা। ভীষণ খুঁতখুঁতে স্বভাবের তিনি। অভদ্র ধাঁচের ছেলে একদমই পছন্দ নয়। শিক্ষক বলেই হয়তো। কোন ছেলেটার স্বভাব, চরিত্র ভালো সেটা তার জহুরি চোখ দিয়ে ঠিকই অনুধাবন করতে পারেন। কতশত ছেলেপেলেকে শিক্ষায় গড়ে তুলেছেন। ঘড়িতে চোখ বুলালেন রাশেদ জামাল। আজকে তার অবসরপ্রাপ্তের দিন। ছোটখাটো একটা আয়োজন হয়েছে স্কুলে। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে আছে কেন জানি। অর্ধাংশ চা রেখেই চলে গেলেন তিনি। পাল্টা আর কিছু বললেন না শারমিন বেগম৷ স্বামীর মনের অবস্থা ঠিক বুঝতে পারছেন। কিছুক্ষণের মাঝে রওনক আর কুহু তৈরি হয়ে আসলো। ভার্সিটিতে যেতে হবে। সময় বেশি নেই। ডাইনিং রুমে রিশাকে না দেখে খুব অবাক হলো কুহু। আজকে ইনকোর্স পরীক্ষা। অন্যসময় হলে সবার আগে তৈরি হয়ে চলে আসতো সে। মাস খানেক ধরে রিশাকে চিনতে কষ্ট হয় কুহুর। এমন ছন্নছাড়া স্বভাবের তো ছিল না মেয়েটা! ভালবাসার মানুষ কি জীবন এতটাও বদলে দিতে পারে? মাথায় একরাশ চিন্তা নিয়ে রিশার রুমের কাছে আসতেই দেখলো এখনো বিছানা ছাড়েনি। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তড়িঘড়ি করে এসে ডাকলো কুুহু। ভীষণ ভরকে গেল রিশা। উঠে বসলো। চোখ ডলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল কুহুর দিকে। ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য তাড়া দিল কুহু। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে রিশা জানালো সে একাই চলে যাবে। কুহুকে বলল চলে যেতে। কুহু নাছোরবান্দা। সে আজ রিশাকে নিয়েই যাবে। কয়েক সেকেন্ড কুহুর দিকে তাকিয়ে ভয়ানক রেগে গেল রিশা। চোখমুখ শক্ত করে বলল,

“আমি যখন বলছি চলে যাব তাহলে তোর বসে থাকতে হবে কেন? এত আধিখ্যেতা আমার ভালো লাগে না কুহু। কি ভেবেছিস এখন আমার ভাবী হয়েছিস বলে তোর দায়িত্ব বেড়ে গেছে? এসব ন্যাকামো আমার পছন্দ নয় জাস্ট! চলে যা তুই।

কথাগুলো বলেই উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল রিশা। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কুহু। আদৌ এটা রিশা তো? সর্বপ্রথম তাদের সম্পর্ক হচ্ছে খুব ভালো বন্ধুত্বের! অথচ অনায়াসে মুখের উপর কত কথা শুনিয়ে দিল। ননদ ভাবী সম্পর্কের কথা তো মনেও নেই কুহুর। অজান্তে চোখ গড়িয়ে জল পরলো। কন্ঠনালী শক্ত হয়ে এলো। শুকনো ঢোক গিলে চলে গেল।

,

কুহুর অপেক্ষায় আছে সবাই। আজকে বেশ কড়াকড়ি একটা প্ল্যান কষেছে সবাই। বুদ্ধিটা আরিয়ানের। কুহুর মুখ থেকে আজ সত্য বের করেই ছাড়বে সবাই। সকলের কথোপকথনের মাঝে কুহুকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। তার অনেকটা পেছনে রওনককে দেখা গেল অন্য দিকে তাকিয়ে হেঁটে যাচ্ছে অফিসকক্ষের দিকে। পরনে কালো রঙা শার্ট আর ফর্মাল প্যান্ট। রূপসা সেদিকে তাকিয়ে বলল,

” দ্যাখ, দ্যাখ এমন ভাব করে হাঁটছে যেন বউকে চেনেই না! কি অভিনয়রে! রওনক স্যারের উচিত ছিল টিচার না হয়ে অভিনেতা হওয়ার।

নয়ন বলল,

“তুই আসলেই মাথামোটা একটা। ভার্সিটিতে কি স্যার কুহুর হাত ধরে নিয়ে আসবে?

আরিয়ান বলল,

” তোরা চুপ থাক কুহু এসে গেছে।

কুহুকে অন্যদিনের তুলনায় আজ বেশ অন্যমনস্ক লাগলো। চেহারা জুড়ে মলিনতার ছাপ। সোহা সোজা প্রশ্ন করেই বসলো মন খারাপ কিনা কুহুর? মাথা ঝাঁকিয়ে না বলল কুহু। কৃত্রিম হাসলো একটু। আরিয়ান জিগ্যেস করলো রিশা এসেছে কিনা। কুহু কথার প্রসঙ্গ টা এড়িয়ে গেল। আজকের পরীক্ষা নিয়ে কথা আরম্ভ করলো। কথামতো সবাই অভিনয় করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। প্রথমে সোহা বলল,

“ভাগ্যিস রিশা এখনো আসনি। রূপসা তো বিশাল প্ল্যান করে এসেছে আজ। সাকসেস হলেই হয়। আর আমরা আছি না।

সোহার কথা শুনে রূপসার দিকে তাকাল কুহু। আজকে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে যেন মেয়েটাকে। মুখে লাজুক হাসি। হাতে ছোট্ট একটা খাম। সেটা সামনে ধরে নিয়ে বলল,

” জীবনের প্রথম কোনো পুরুষের জন্য লাভ লোটার লিখেছি দোস্ত! আমার তো হাতপা কাঁপছে রীতিমতো। রওনক স্যার আমাকে ফিরিয়ে দেবে না তো? কিন্তু চিঠিতে প্রেম নিবেদনটা অন্যরকম এক অনুভূতি দিচ্ছে।

কুহু বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। মাস খানেক ধরেই রূপসা এটাসেটা উল্টাপাল্টা বলে যাচ্ছে রওনক ভাইকে নিয়ে। ভীষণ খারাপ লাগলেও মুখে কিছুই বলতে পারেনি কুহু। দিনদিন সবাই যদি এভাবে তার স্বামীর দিকে কুদৃষ্টি দেয় তাহলে তো ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাবে। কুহুর রিয়াকশন দেখে মনে মনে পৈচাশিক আনন্দ পেল সবাই। নয়ন বলল,

“এই এক রওনক স্যারকে নিয়ে কি পেয়েছিস তোরা? জানিস না শাহিনূর মাহি ম্যাম আগেই দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে।

মুখ বাঁকিয়ে বলল রূপসা,

” যার ইচ্ছে হয় নজর দিক। রওনক শুধু আমার হিরো! তাছাড়া ওই মাহির থেকে সবদিকেই সুন্দর আমি। ভার্সিটিতে কত ছেলে আমার পেছনে ঘুরে সেটা তো জানিসই! আমি এও সিউর রওনক স্যার আমাকে ফেরাবে না।

কুহুর দিকে তাকিয়ে রূপসার উদ্দেশ্যে বলল আরিয়ান,

“তোর সাহস আছে বলতেই হয়। স্যারকে দেখলেই তো ভয় লাগে। কি জানি হয় আজ কে জানে। তবে আমরা মনেপ্রাণে চাই তোদের মিল হোক। কি বলিস কুহু?

কুহু কোনোরকম উত্তর দিল না। মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে তার। সকালে রিশার সঙ্গে কথা বলার পর মনটা প্রচন্ড খারাপ হয়ে আছে। তারউপর রূপসার এসব কথা শুনে কষ্ট দ্বিগুণ হলো। এলোমেলো পা ফেলে পাঁচ তলা ভবনের দিকে ছুঁটলো। কুহুর এরুপ আচরণে সবাই চমকে গেল। শব্দ করে হেসে ফেলল সবাই। এতদিনে কাজ হয়েছে বলে মনে হলো। তৎক্ষনাৎ সবাই কুহুর পেছনে ছুটলো। দরকার হয় আরো রাগিয়ে দেবে। তবুও মুখ থেকে আজ কথা বের করে ছাড়বে। খানিক্ষনের মাঝেই পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে। হুড়োহুড়ি করে যে যার ডিপার্টমেন্টে চলে গেল। কুহু উপরে উঠছে ধুপধাপ সিড়ি ভেঙ্গে। পেছনে রূপসা’রা অনুসরণ করছে। তাদের পরীক্ষা হবে অন্য ভবনে। তবে কুহু কোথায় যাচ্ছে? সুইসাইড করতে নয় তো? চারতলায় উঠতেই রওনককে দেখতে পেল কুহু। হাত ভর্তি খাতা নিয়ে তাতে দৃষ্টি বুলিয়ে যাচ্ছিল। দূর থেকেই জোড়ালো স্বরে ডাকলো,

” রওনক ভাই?

চেনা কন্ঠস্বর পেয়েই দৃষ্টি তুলে তাকাল রওনক। ততক্ষণে কুহু এগিয়ে গিয়ে জাপ্টে ধরলো রওনককে। আশেপাশে কিছুই খেয়ালে নেই তার। এরুপ কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিল না রওনক। পেছনে দৃষ্টি আটঁকে রইল তার। কারণ ঠিক পেছনেই আট জোড়া চোখ অবাক দৃষ্টি নিয়ে দেখছে তাদের। কুহু হুহু করে কেঁদে ফেলল। শরীর মৃদু কাঁপছে কান্নার দাপটে। সকাল থেকেই মন তীব্র খারাপ হয়ে আছে তার। রওনক অপ্রস্তুত হলো। কিরুপ প্রতিক্রিয়া জানাবে বুঝতে পারলো না। পেছনে ছাত্রছাত্রীদের চোখে তাকাতে পারছিল না। পেছনে খালি ক্লাসরুম দেখতেই রওনককে টেনে নিয়ে গেল কুহু। রওনক হতভম্ব! রূপসা অবাক কন্ঠে বলল,

“ওরা ফাঁকা ক্লাসরুমে কেন গেল?

নয়ন উত্তর দিল,

” হয়তো ব্যাক্তিগত কোনো কথা বলতে। বাদ দে। চল আমরা ক্লাসে চলে যাই। পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে।

রূপসা পাশ থেকে সোহার হাত টেনে নিয়ে উপরে যেতে যেতে বলল,

“এ অবধি যখন এসেছি তখন দেখে যাব তারা দুইজন ফাঁকা ক্লাসরুমে কি করছে।

নয়ন পা বাড়াতে গেলে আরিয়ান থামিয়ে দিয়ে বলল,

” এমনি স্যার আমাদের দেখে নিয়েছে। যদি এখন ধরা খাই না তাহলে বিচ্ছিরি অবস্থা হয়ে যাবে। চল আমরা ক্লাসে চলে যাই। কুহুকে পরে আঁটসাঁট বেঁধে ধরবো। অগত্যা আরিয়ানের সঙ্গে চলে গেল নয়ন।

,

রওনকের শার্টের কলারে দু’হাত চেপে নিয়ে কান্নারত স্বরে বলল কুহু,

“শাহিনূর মাহি ম্যাম তো কবে থেকেই নজর দিচ্ছে আপনার দিকে। এখন রূপসাও, কতশত ছাত্রী আড়ালে কত কিছু বলে আপনাকে নিয়ে। আমার কষ্ট হয়। খারাপ লাগে। আমাদের বিয়ের সম্পর্ক টা কেন লুকিয়ে যাচ্ছেন আপনি? আমি আর এসব শুনতে পারছি না। ধৈর্য্যে কুলচ্ছে না আমার। আমি আপনাকে ভালবাসি রওনক ভাই। বুঝেন সেটা আপনি?

প্রচন্ড মন খারাপ থেকে অনর্গল কথাগুলো বলে গেল কুহু। রওনক নিষ্পলক তাকিয়ে দেখছিল কুহুর কান্না। এই কান্নামাখা মুখ তাকে কষ্ট দিচ্ছে না। বরং অন্যরকম এক প্রশান্তি দিচ্ছে বক্ষস্থলে। এত রাগ দেখিয়েও ভালবাসা বলা যায় সেটা এই মাথামোটা মেয়েকে না দেখলে বোধহয় জানতোই না! রওনককে চুপ থাকতে দেখে খানিক উঁচু হয়ে রওনকের কানের পাশে ভাঙ্গা স্বরে বলল কুহু,

” আপনি শুধু আমার। শুধুই আমার।

কথাটুকু বলেই এক অপ্রত্যাশিত কাজ করে বসলো। রওনকের ওষ্ঠযুগলে নিজের ঠোঁট জোড়া মিলিয়ে নিল। তৎক্ষনাৎ কুহুর কোমড়ে হাত রেখে খানিক উঁচু করে ধরলো রওনক। সাড়া দিল নিজেও। রূপসা আর সোহার চোখ ছানাবড়া! মুখ আপনাআপনি হা হয়ে গেল দু’জনের। চোখের চশমা ঠিক করে নিয়ে ফিসফিস করে বলল সোহা,

“আমি কি ঠিক দেখছি রে রূপসা? মানে আমাদের লাজুক আর ভদ্র কুহু নিজ থেকে চুমু খাচ্ছে রওনক স্যারকে? তাও ঠোঁট চুমু?

” তাই তো দেখছি! এখানে না আসলে তো বিশাল কিছু মিস করে ফেলতাম। এতদিন সিনেমাতেই দেখেছি। আজ বাস্তবে দেখছি। রওনককে স্যারকে দ্যাখ কি সুন্দর করে কুহুকে জড়িয়ে ধরে আছে!

রূপসার চোখের সামনে হাত রেখে বলল সোহা,

“অনেক দেখেছিস। চল এবার। পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। কখন না ধরা পড়ে যাই!

,

বেশ অনেকটা সময় নিয়ে ছাড়লো কুহু। আবারো কান্না পাচ্ছে তার। আজকের দিনটাই তার জন্য খারাপ মনে হচ্ছে। সকালের ঘটনাটা রওনককে বলল না। কুহুর দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল রওনক,

” আমাদের বিয়ের বিষয়টা আর বোধহয় লুকানো থাকবে না কুহু। তখন যেভাবে জড়িয়ে ধরেছ আমাকে পেছনে তোমার বন্ধুরা ছিল। কি ভাবছে তারা কে জানে! হয়তো ভাবছে স্যারের আর স্যারের ছাত্রী দু’টোর একটারও চরিত্রের ঠিক নেই! এমন বোকামো কেউ করে?

হঠাৎ যেন হুঁশ ফিরলো কুহুর। খারাপ লাগার সঙ্গে ঈষৎ লজ্জাও লাগলো। কোনো প্রতিউত্তর করলো না সে। দ্রুত চলে গেল।

◼️
রিকশায় আমনা হয়ে বসে আছে রিশা। সময় বলছে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। অথচ বইটাও ছুঁয়ে দেখেনি। সবকিছুতে বিতৃষ্ণা এসে যাচ্ছে। কুহুর সঙ্গে আজকে খুব বাজে ব্যবহার করে ফেলেছে। সেটা মনে হতেই অপরাধবোধ হচ্ছে। রিকশা সিগন্যালে পরতেই ভাবনার ঘোর কাটলো রিশার। আচমকা দূরে দৃষ্টি পরতেই দেখলো ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে রাতিম। বক্ষস্থল ধ্বক করে উঠলো রিশার। ব্যাগ থেকে টাকা বের করে কোনোরকম রিকশাওয়ালার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সেদিকে ছুটলো। পেছন থেকেই জোড়ালো স্বরে ডাকলো। চলন্ত পা দু’টো থেমে গেল রাতিমের।ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল সে। ছুঁটতে ছুঁটতে আসলো রিশা। রাতিমের সামনে দাঁড়িয়ে ঘনঘন শ্বাস ফেলল। হাসিমুখেই জিগ্যেস করলো রাতিম,

“কেমন আছ আইরিশ? পড়াশোনা কেমন চলছে?

রাতিমের এমন প্রশ্নে ভীষণ অবাক হলো রিশা। কেমন স্বাভাবিক লাগছে লোকটাকে। রিশাকে কষ্ট দিয়ে কি একটুও খারাপ বা অনুশোচনা হয়নি তার? সরাসরি প্রশ্ন ছুড়লো,

” গত একমাস যাবৎ আপনার ফোন বন্ধ কেন?

কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল রাতিম,

“আমার আগের ফোনটা হারিয়ে গেছে। সিম আর উঠাইনি। নতুন সিম কিনেছি। তাই হয়তো যোগাযোগ হয়নি তোমার সাথে।

” আমি আপনার ফ্ল্যাটে অনেকবার গিয়েছি। পাইনি।

“আমার চাকরি টা চলে গেছে। গ্রামে চলে গিয়েছিলাম।

রাতিমের কথায় স্তব্ধ হয়ে গেল রিশা। চাকরি হারানোর কারণেই কি রিশার মুখোমুখি হয়নি সে? রিশার পাঠানো বার্তাটা কি তবে পায়নি? শক্ত চোখেমুখে বলল,

” শেষবার আমাকে কেন ডেকেছিলেন? কি বলতে চেয়েছিলেন আমায়? আশা করি নির্দ্বিধায় বলবেন। কোনো সংকোচ রাখবেন না।

চলবে……

#তুমি_রবে_নীরবে (৩৬)
~নাদিয়া সাউদ

রাতিম হাত ঘড়ির দিকে তাকাল। মাথায় ঘাম জমলো তার। যতেষ্ট স্বাভাবিক হয়ে বলল,

“সেটা তো আগেই বলেছিলাম। আমার অসুস্থতার সময় তুমি সাহায্য করেছ তাই ভেবেছিলাম তোমাকে একটা ট্রিট দিই। এই আরকি।

” আপনি কথা ঘোরাচ্ছেন রাতিম ভাই।

আশেপাশে তাকিয়ে নিয়ে বলল রাতিম,
” আমার সময় নেই আইরিশ। কাজ আছে। আসছি।

চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো রাতিম। কোমল হাতে রাতিমের হাত চেপে ধরলো রিশা। আশ্চর্য হয়ে গেল রাতিম! এমন কিছু ঘটবে বোধহয় আশা করেনি। রিশার চোখ দু’টোতে জলেরা ভীড় জমিয়েছে। নাকের ডগায় জমেছে ঘাম। পাতলা ঠোঁট জোড়া মৃদু কাঁপছে। প্রখর রোদ্দুর এসে ছুঁয়েছ কপাল। রাতিমের ভেতর জুড়ে বয়ে গেল প্রলয়ঙ্কারী ঝড়! নিমেষে গুড়িয়ে দিল তার অন্তঃকরণ! ভাগ্যিস ভেতরের অবস্থা প্রকাশ্যে দেখা যায় না! শুকনো ঢোক গিলে নিয়ে বলল রিশা,

“কেন মিথ্যে বলছেন রাতিম ভাই? আমার পাঠানো সেদিনের ম্যাসেজ কি আপনি দেখেননি? আমি আপনাকে ভীষণ ভালবাসি। এই কয়টা দিন আমার কিভাবে গিয়েছে আপনি ধারণাও করতে পারবেন না! আমি জানি আপনিও আমায় ভালোবাসেন। সেদিন আপনার পকেট থেকে পড়ে যাওয়া গোলাপটা আমি এখনো সযত্নে রেখে দিয়েছি। বুঝেছি, চাকরি চলে গেছে বলে এমন করছেন তাই তো? আপনি তো শিক্ষিত ছেলে। যে কোনো সময় চাকরি হয়েই যাবে।

রিশার হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিয়ে কাঠিন্য স্বরে বলল রাতিম,

” কি আবোলতাবোল বলছো? আমি কখনো এমন কিছু বলেছি তোমাকে? নাকি ইঙ্গিতে বুঝিয়েছি? রওনকের বোন তুমি। আমার ছোট বোনের মতোই! এসব বলার আগে মুখে বাঁধলো না তোমার?

রিশার গলা ধরে এলো। পৃথিবী তাকে কেন্দ্র করে ঘুরতে লাগলো। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো অনর্গল। রাতিমের কপালে ঘাম ছুটে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে অপ্রত্যাশিত এক কাজ করে বসলো রিশা। দ্রুত ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো রাতিমকে। চোখ বন্ধ করে ফেলল রাতিম। নিশ্বাস আঁটকে আসতে চাইলো। এই মুহূর্তে মৃত্যু চলে আসলেও বোধহয় তাকে আলিঙ্গন করা সহজ হতো তার জন্য। রিশার শরীর মৃদু কাঁপছে। জড়িয়ে নিতে পারলো না রাতিম। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। চোখদুটো বুঝি জ্বালা করছে তার। কান্নার দাপটে গলার স্বর ভেঙ্গে গেল রিশার। থেমে থেমে বলল,

“আপনার ভালোবাসা আমাকে কতটা বেহায়া, নির্লজ্জ করে দিয়েছে দেখুন! জানি না কেন এমন করছেন। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রাতিম ভাই।

জোরপূর্বক রিশাকে ছাড়িয়ে দাঁড় করাল রাতিম। আশেপাশে অনেকে তাকিয়ে আছে। রিশার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিজের নাম্বারটা তুলে দিল। কোনোরকম বলল,

” এটা আমার নতুন সিমের নাম্বার। পরে কথা হবে তোমার সাথে। আসছি।

কথাটুকু বলেই লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেল রাতিম। সামনে রিকশা পেতেই উঠে বসলো। নিজের কান্নাটা আর ধরে রাখতে পারলো না। ফুপিয়ে কেঁদে ফেলল। আর কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থাকলে নিজের শক্ত খোলসটা আর ধরে রাখতে পারতো না। ইচ্ছে করেই আগের নাম্বার থেকে রিশাকে ব্লক করে রেখেছিল। আজকে কাকতালীয় ভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবেনি। বাধ্য হয়েই অন্য সিমের নাম্বার টা দিয়ে এসেছে। নয়তো আজ সহজে নিস্তার মিলতো না এখান থেকে। এদিকে বাড়ি থেকে রূপা ফোন করছে। দ্রুত যেতে হবে।

,

পরীক্ষা শেষ হয়েছে অনেক্ষণ আগেই। অস্থির হয়ে বের হয়েই রিশাকে ফোন করেছে কুহু। পরীক্ষা মিস দেওয়ার মতো মেয়ে নয় রিশা। কি চলছে মেয়েটার মনে? অনেকদিন যাবৎ মনে হচ্ছে কিছু ঠিক নেই! কয়েকবার রিং বাজতেই রিসিভ হলো। কুহুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলল রিশা,

“আমি জানি তুই কেন ফোন করেছিস। পরীক্ষা দেওয়ার জন্য গিয়েছিলাম। মাঝরাস্তায় এক্সিডেন্ট হই। বাইকের সাথে ধাক্কা লাগে। পায়ের আঙ্গুলে চোট পেয়েছি খুব। ভাইয়াকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি পরীক্ষা দিতে পারবো না।

অস্থির কন্ঠে শুধালো কুহু,
” এখন কেমন আছিস? বেশি ক্ষতি হয়নি তো?

” আরে না। চিন্তা করিস না। বাসায় আয় জলদি।

“আচ্ছা।

চিন্তা সম্পূর্ণ দূরীভূত হলো কুহুর। স্বস্তির শ্বাস ফেলল। এই রওনক স্যারটাও না, রিশা যে তাকে ফোন করেছে একবার জানাবে না? নিজেকে আবার জ্ঞানী ভাবে।

” তা এই প্রেম কবে থেকে চলছে ম্যাডাম?

আরিয়ানের কথা শুনে ঘুরে তাকাল কুহু। সবাই দাঁড়িয়ে আছে একত্রে। অপ্রস্তুত হলো কুহু। তখন মাথা এতটাই বিগড়ে ছিল যে আশপাশ না দেখেই রওনক ভাইকে জড়িয়ে ধরেছিল। এখন লজ্জাও লাগছে খুব। অবশ্য জবাবটা ভেবেই নিয়েছে। লম্বা দম নিয়ে সবকিছু খুলে বলল কুহু। কিভাবে তাদের বিয়ে হয়েছে। সব শুনে রূপসা বলল,

“আমাদের কি তোর বোকা মনে হয়? যে কোনো একটা গল্প বানিয়ে বলে দিবি আর আমরা সেটা বিশ্বাস করে নেব? ক’বছর ধরে প্রেম চলছিল বল? রিশার খাতিরে স্যারের বাসায় তোর প্রায়ই যাতায়াত ছিল।

কপালে ঈষৎ বিরক্তির ভাজ ফেলে বলল কুহু,

” আরে সব সত্যি বলছি! রওনক ভাই তো দু’চোখে সহ্য করতে পারতো না আমাকে।

ফুস করে দম ফেলে বলল সোহা,

“তাই? তা কে একটা অসহ্যকর মানুষকে বিয়ে করতে চায় বল? তোর বিয়েতে ঝামেলা হোক তাতে রওনক স্যারের কি আসে যায়? এমনি এমনিই বিয়ে করে নিল তোর মতো বিরক্তিকর মানুষকে?

কুহু যেন এক ভাবনায় মগ্ন হয়ে গেল। রওনক ভাই তাকে বিয়ে করবে এটা তো সেসময় অবাস্তব ছিল তার কাছে। ভেবেছিল সম্মান বাঁচাতে হয়তো বিয়েটা করছে। পরে হয়তো সব স্বীকার করে পথ আলাদা করে নেবেন। তবে সব তো উল্টো ঘটলো! রওনক ভাইয়ের চোখে বিরক্তিকর কুহুটা এখন সবচেয়ে বেশি ভালবাসার কেউ হয়ে গেল! মানব মন কি এতই বিচিত্র? কুহু নিজেও তো রওনক ভাইকে সহ্য করতে পারেনি। আজ এই সময় এই লোকটাই তার সমস্তটা দখল করে নিয়েছে! কুহুকে চুপ থাকতে দেখে সবার সন্দেহ গাঢ় হলো। নয়ন বলল,

” হতে পারে কুহুকে স্যার দয়া করেছেন। বদনাম হবে বলেই বিয়ে করে নিয়েছেন। এখন সব ঝগড়া ভুলে হয়তো ভাব হয়ে গেছে দু’জনের মাঝে!

চট করেই কুহু বলল,

“হ্যাঁ, হ্যাঁ। নয়ন বুঝতে পেরেছে বিষয়টা। ঝামেলা হয়েই বিয়েটা হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে আমাদের মাঝে ভাব হয়ে গেছে বুঝলি।

কুহুর এই উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারলো না কেউই। কিছু তো একটা পূর্বসূত্র আছেই! সকলের কথার মাঝে রওনক উপস্থিত হলো ক্যাম্পাসে। সবাই বেশ ভদ্র ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে গেল। সালাম জানালো। কুহুর দিকে তাকিয়ে জবাব দিল রওনক। ভরাট স্বরে বলল,

” বাসায় যেতে হবে চলো। আমি বাইকে অপেক্ষা করছি।

কথাটুকু বলে’ই হাঁটা ধরলো রওনক। উপস্থিত সবাই আশ্চর্যের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেল। রওনক স্যার তাদের সামনে এমন কিছু বলবে এটা অকল্পনীয় ছিল! কুহু অপ্রস্তুত হয়ে আশপাশে তাকাল। ক্যাম্পাস একেবারে খালি বললেই চলে। সবাই বেরিয়ে গেছে এতক্ষণে। কিছুদূর যেতেই ফের ফিরে আসলো রওনক। কুহুর হাত ধরে বলল,
” যেতে বললাম তো! এখনো দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করছো কেন?

ঠিক কি উত্তর দিবে ভেবে পেল না কুহু। বাকি সবার দিকে তাকাল। ভুত দেখার মতো চমকে তাকিয়ে আছে সবাই। একপলক সেদিকে তাকিয়ে বলল রওনক,

“কুহু এতক্ষণ যাবৎ তোমাদের যা যা বলেছে সব সত্য। নয়তো এই গর্দভ মেয়েকে যেচে বিয়ে করার কোনো প্রশ্নই আসে না।

কথাটুকু বলেই কুহুকে নিয়ে চলে গেল রওনক। ইচ্ছে করেই ওদের এই কথাটা বলল। নয়তো সবকয়টা গোয়েন্দাগিরি শুরু করে দিত। আর ঠিক কুহুর ব্রেইন ওয়াশ করে দিত। সবাই কুহু আর রওনকের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল আরিয়ান,

” দেখলি কেমন আচরণ করলো স্যার! অপমানও তো করলো কুহুকে। মনে দয়া, মায়া, ভালোবাসা আছে নাকি কে জানে।

রূপসা বলল,
“আমি আর সোহা তো ভাবলাম ওদের মাঝে আগে থেকেই কিছু চলছে! ফাঁকা ক্লাসরুমে কি হয়েছে তা তো আর তোরা দেখিসনি। এখন আফসোস হচ্ছে, এই রগচটা স্যারের সঙ্গে সারাদিন থাকবে কি করে কুহু?

নয়ন বলল,
” টিকবে না। এই সম্পর্ক বেশিদিন যাবে না। দেখলি না কিভাবে খোঁটা দিয়ে গেল? এই জন্যই স্যার হয়তো ভার্সিটিতে সবার থেকে বিয়ের ব্যাপারটা লুকিয়ে গেছেন।

নয়নের কথা শুনে অত্যল্পকালে বাকি তিনজনের মুখে আঁধার নামলো। কুহুর জন্য খারাপ লাগলো।

◼️
সারারাস্তায় রওনকের সাথে একটা কথাও বলেনি কুহু। রাগে গা ফেটে পড়ছে। বন্ধুদের সামনে কতবড় অপমানটাই না হলো সে। অথচ বড় মুখ করে বলেছিল তাদের মধ্যে ভাব হয়ে গেছে। এই তার নমুনা? আড় চোখ কুহুকে পর্যবেক্ষণ করছে রওনক। লুকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। ভয়ানক রাগলে দারুণ লাগে কুহুকে। গাল দুটো বেলুনের মতো ফুলে যায় কেমন! ড্রেসিং টেবিলের কাছে আসতেই নীল রঙা ছোট্ট একটা চিরকুট দেখতে পেল কুহু। কপালে ভাজ পরলো তার। তৎক্ষনাৎ হাতে তুলে নিয়ে খুলে পড়তে লাগলো।

“মানুষের মনটা হয় বিশাল আকাশের মতো! মাঝেমধ্যে কষ্টগুলো মেঘ হয়ে নেমে আসে। বৃষ্টি শেষে আবারও তো হাসে ঝলমলে আকাশ। তেমনি কষ্ট পেলেও কি মানুষ সেটা মনের ভেতর পুষে রাখে? ক্ষমা করে দিয়ে হাসতেও তো পারে। ”

আমার রুমে আয়তো একটু কুহু। তোর জল্লাদ ননদী তোর অপেক্ষায় তৃষ্ণার্ত কাকের মতো ছটফট করছে। এসে তাকে ক্ষমা করে দিয়ে ধন্য কর।

ইতি
কুহুর প্রিয় রিশা

চিরকুটটা পড়তেই ওষ্ঠকোণে হাসি খেলে গেল কুহুর। একদৌড়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। রওনক অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। মুহূর্তে হাসিমুখে কোথায় ছুটে গেল! রিশার রুমে এসে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো কুহু। চমকে উঠলো! অন্ধকার রুমে টেবিলের উপর মোটা মোটা মোমবাতি জ্বলছে। পাশেই ছোট্ট একটা কেক। রিশাকে ডাকলো কুহু। এগিয়ে গেল কেকের দিকে। কেকের উপর বড় করে স্যরি লেখা। খুশিতে চোখে পানি চলে আসলো কুহুর। হঠাৎ করে রুমের লাইট জ্বলে উঠল। ঘাড় ঘুরিয়ে রিশাকে দেখতে পেয়েই জড়িয়ে ধরলো কুহু। কেঁদে ফেলল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল রিশা। চোখ ঝাপসা হয়ে উঠলো। কুহু তার উপর কখনই অভিমান করে থাকতে পারবে না জানে। ভাঙ্গা গলায় বলল,

“তুই খুউব ভালো কুহু। খুব বোকাও! তোর উপর যে রাগ, জেদ দেখাবে সে নিজেই দ্বিগুণ কষ্ট পাবে। সকালে তোর সাথে খুব বাজে আচরণ করে ফেলেছি।

কান্নার দাপটে কিছু বলতে পারলো না কুহু। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখলো রওনক। পরক্ষণে নিশ্চুপ প্রস্থান করলো। কুহুকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে কেক কাটলো রিশা। খাইয়ে দিল যত্ন নিয়ে। খানিকটা কেক রিশাকে খাইয়ে দিয়ে বলল কুহু,

” মানুষের যখন মনমেজাজ ঠিক থাকে না তখন সে নিজের মাঝে থাকে না। আমি কয়েকদিন ধরে খেয়াল করছি তুই ঠিক নেই। কি হয়েছে বল আমাকে?

কুহুর দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল রিশা। আবারো খুব কান্না পাচ্ছে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, আমি ভালো নেই কুহু। ভেতর থেকে ভেঙ্গে নিঃশেষ হয়ে গেছি। চাইলেও রাতিম ভাইয়ের বিষয়টা কুহুকে বলা সম্ভব নয়। নাক টেনে বলল,

” আমরা যে জিনিসটা নিয়ে বেশি আশা করে ফেলি, স্বপ্ন দেখি সেটা যখন পাই না তখন মন মানতে চায় না। চাইলেও নিজেকে মানানো যায় না। তবুও চলতে হয়। এতসব ভাবলে হয় না। আমিও জানি সব একদিন হয়তো ঠিক হয়ে যাবে।

“তুই আশফিক ভাইয়ার জন্য এখনো কষ্ট পাচ্ছিস?

রিশা কোনো উত্তর দিল না। কুহুকে বলল গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে। মাথা ব্যাথা করছে তার। রিশার পায়ের ব্যান্ডেজ করা আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেল কুহু। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা এঁটে দিল। শরীর কাঁপছে। আজকের ঘটনাটা মস্তিষ্ক থেকে বেরোতে চাচ্ছে না। কেন রাতিম ভাই এমন ব্যবহার করলো? রিশার ভাবনা কি এতটাই ভুল ছিল? স্পষ্ট রাতিম ভাইয়ের চোখে ভালবাসা দেখেছিল নিজের জন্য! তাহলে কেন দূরে ঠেলে দিচ্ছে এখন?

,

রুমে এসে ফোন হাতে নিল কুহু৷ ফেসবুকে আশফিকের আইডিটা খুঁজে বের করলো। কিছুটা স্ক্রল করতেই দেখলো বেশ কয়েকটা পোস্ট করা। কেমন বিরহের আভাস মিলল! তবে কি সম্পর্ক ঠিক নেই তার? শত চিন্তা মাথায় নিয়ে আশফিকে ছোট্ট একটা ম্যাসেজ পাঠালো। অপেক্ষা করতে লাগলো উত্তরের।

” সেই কখন ফিরেছ! ফ্রেশ হওনি কেন এখনো?

ভরাট পুরুষালি স্বর শুনে আৎকে উঠলো কুহু। কোনোরকম ফোনটা খাটে রাখলো। রওনকের হাতে দুইমগ কফি। হঠাৎই রাগের কথা মনে পড়ে গেল কুহুর। আজকে তাকে অপদস্ত করেছে রওনক ভাই। টেবিলের উপর মগ দু’টি রাখলো রওনক। কুহু চলে যেতে নিলেই হাত চেপে ধরলো। ছাড়াতে চেষ্টা করলো কুহু। চোখেমুখে এখনো তীব্র অভিমান। হাত টেনে ধরে কাছে দাড় করাল রওনক। দু’হাতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিল। একটুও নড়ার শক্তি পেল না কুহু। লেপ্টে রইল শক্তপোক্ত বুকে। হাত বাড়িয়ে কুহুর কপাল থেকে কাটা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিল রওনক। শীতল কন্ঠে বলল,

“দেখো বাচ্চাদের মতো ঠোঁটের কোণায় কেকের ক্রিম লেগে আছে তোমার।

কথাটুকু শুনতেই ঘাড় ঘুরিয়ে আয়নার দিকে তাকাল কুহু। সত্যিই লেগে আছে ঠোঁটের পাশে।

” ছাড়ুন। মুছে নিচ্ছি আমি।

কুহুর কথা তোয়াক্কা করলো না রওনক। মাথা খানিকটা নিচু করে কুহুর ঠোঁটে লেগে থাকা ক্রিমটুকু খেয়ে নিল। কাঠের পুতুলের মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কুহু। ভারী নিশ্বাস সারা মুখে ছড়িয়ে গেল তার। হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। চোখ তুলে তাকাল না। গালে আদুরে ভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল রওনক। মেরুদণ্ড বরাবর শীতল স্রোত বইয়ে গেল কুহুর। অভিমানের বরফ গলল না। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল রওনক,
“বোকা মেয়ে, তোমার অভিমানের পাহাড় কিভাবে গুড়িয়ে দিতে হয় সেটা রওনকের খুব ভালো করেই জানা আছে। একবার জড়িয়ে নাও আমাকে। দেখবে অভিমান গলে জল!

চলবে…….