তুমি শুধু আমারই হও পর্ব-১৬+১৭

0
361

#তুমি_শুধু_আমারই_হও
লেখনীতে- অরনিশা সাথী

|১৬|

দুপুরের খাবার খেয়ে শুয়ে আছে অর্নি। ঘুম আসছে না। তাই শুধু এপাশ ওপাশ করছে। ভার্সিটি থেকে ফেরার পর নূর আর রুশান অনেক বার ফোন করেছে ওকে। কিন্তু ও রিসিভ করেনি। কোনো কিছুই ভালো লাগছে না ওর। দরজায় কড়াঘাতের শব্দে অর্নি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। টায়রা একপ্রকার হামলে পড়লো অর্নির উপর৷ অর্নিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
–“জানিস আমি অনেএএক অনেক খুশি।”

অর্নি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
–“কেন?”

–“তুই আমার ভাবী হবি অর্নি? নিহাল ভাইয়ের বউ? উফস্ আমার তো ভেবেই খুশিতে আকাশে উড়তে ইচ্ছে করছে রে।”

দৃষ্টি থমকে গেলো অর্নির। টায়রা আবারো বললো,
–“কাল তো তোদের এনগেজমেন্ট। জানিস, নিহাল ভাই নিজে তোর জন্য রিং চুজ করেছে।”

চমকালো অর্নি। এত তাড়াতাড়িই সব ঠিক হয়ে গেলো? সময় যত এগিয়ে আসছে অর্নির তত দম বন্ধ হয়ে আসছে। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে হাসি ফোঁটালো। টায়রা অর্নির গালে হাত রেখে বললো,
–“আচ্ছা তুই খুশি তো?”

অর্নি মেকি হাসলো। ভাবলো ওর খুশি হওয়া বা না হওয়াতে কি আসে যায়? যেখানে বাকী সব্বাই খুশি সেখানে ও নিজের একার খুশিটা কিভাবে ভাবতে পারে? অর্নিকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে টায়রা আবারো একই প্রশ্ন করলো। অর্নি হেসে বললো,
–“তোমাদের খুশিতেই আমার খুশি।”

টায়রা জড়িয়ে ধরলো অর্নিকে। অর্নিও মলিন হেসে টায়রার পিঠে আলতো করে হাত রাখলো।

নূরকে একের পর এক ফোন করেই যাচ্ছে অর্নি। কিন্তু নূর ফোন তুলছে না। অর্নি খুব ভালো করেই জানে নূর ওর উপর প্রচন্ড রেগে আছে, তাই ইচ্ছে করেই ফোন তুলছে না। অর্নি টেক্সট করলো নূরকে,
–“ইট’স আর্জেন্ট নূর, ফোন রিসিভ কর।”

এবার না চাওয়া স্বত্তেও নূর ফোন রিসিভ করলো। অর্নি কপাট রাগ দেখিয়ে বললো,
–“ফোনের কাছে থেকেও ফোন তুলছিস না কেন?”

–“ইচ্ছে হয়নি তাই।”

–“আচ্ছা ছাড় সেসব কথা। যার জন্য ফোন করেছিলাম___”

–“অর্নি ভাইয়া তোকে প্রচন্ড ভালোবাসে। কাল ভার্সিটি থেকে ফেরার পর আর রুম থেকে বের হয়নি__”

এসব কথা শুনে অর্নির খারাপ লাগলেও সেটাকে পাত্তা না দেওয়ার চেষ্টা করলো। উৎসবকে নিয়ে ভাবতে চায় না ও আর। যে ভাগ্যে নেই তাকে নিয়ে ভেবেই বা কি হবে? এই ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো অর্নি। তারপর বললো,
–“সন্ধ্যায় আমাদের বাসায় আসিস। রুশানকে জানিয়ে দিয়েছি আমি ও আসবে বলেছে।”

নূর কপাল কুঁচকায় অর্নির কথায়। হঠাৎ বাড়িতে ডাকছে কেন ভেবে পেলো না। কৌতুহল দমাতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো,
–“হটাৎ বাসায় কেন?”

–“সেটা আসলেই দেখতে পারবি, এখন রাখছি রে। সন্ধ্যায় দেখা হচ্ছে তাহলে।”

নূরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই লাইন কেটে দিলো অর্নি। ও নূরের সাথে বেশিক্ষণ কথা বলতে পারতো না। আর একটু হলেই হাউমাউ করে কেঁদে দিতো। পরে নূর হাজারটা প্রশ্ন করতো। তার থেকে ফোন রেখে দিলো এটাই ভালো।

নূর আর রুশান মাত্রই অর্নিদের বাসায় এলো। ওদের দুজনকে দেখে মিসেস অদিতি আর অর্নব ভীষণ খুশি হয়েছেন। এখানে নিহালের পুরো পরিবার উপস্থিত আছে। মিসেস অদিতি নূরকে বললেন,
–“অর্নি ওর ঘরেই আছে তোমরা যাও।”

নূর আর রুশান সম্মতি জানিয়ে অর্নির ঘরে চলে গেলো। সেখানে গিয়ে আরেক দফা অবাক হলো অর্নিকে লং চুড়িদার পড়া দেখে৷ অর্নি সচারাচর এসব চুড়িদার পড়ে না। নূর এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলো,
–“আজ কি বাসায় কোনো অকেশন আছে?”

অর্নি ছোট্ট করে ‘হুম’ বললো। নূর আবারো জিজ্ঞেস করলো,
–“কিসের?”

–“এসেছিস যেহেতু, তাহলে অবশ্যই জানতে পারবি ধৈর্য্য ধর একটু।”

রুশান অর্নির পাশে গিয়ে বসে বললো,
–“দোস্ত তোর কি হইছে রে? কয়েকদিন যাবত এমন বিহেভিয়ার করছিস কেন?”

অর্নি হাসলো রুশানের কথায়৷ নূর বললো,
–“তোকে একটা প্রশ্ন করা হয়েছে অর্নি, আর তুই হাসছিস?”

অর্নি কিছু বলে উঠার আগেই টায়রা এলো সেখানে। অর্নির সামনে গিয়ে ওকে দাঁড় করালো। অর্নির হাত ধরে রুশান আর নূরকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“তোমরাও এসো।”

কথাটা বলেই টায়রা অর্নিকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। রুশান আর নূর একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। তারপর ওরা দুজনেও বেরিয়ে এলো। ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখতে পেলো নিহালের পাশে অর্নিকে বসানো হয়েছে। নূর রুশান দুজনেই বেশ অবাক হলো। অর্নি মাথা নিচু করে বসে আছে। নূর আর রুশানের অবাকের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিতে নিহাল বক্স থেকে রিং বের করে অর্নির অনামিকা আঙুলে পড়িয়ে দিলো। অর্নির চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো৷ যা নূর বা রুশান কারো চোখই এড়ালো না। অর্নব অর্নিকে রিং এগিয়ে দিলো৷ অর্নির হাত কাঁপছে৷ টায়রা অর্নির হাত ধরে রিং পড়িয়ে দিলো নিহালের আঙুলে। নূর যেন ওর চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। নূর টায়রাকে বলে অর্নিকে নিয়ে ওর ঘরে চলে গেলো। মৃদু চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলো,
–“এসব কি অর্নি?”

অর্নি চুপ করে রইলো। নূর আবারো বললো,
–“এর জন্য তুই আমাদের এখানে ডেকেছিস?”

–“হুম।”

নূর অর্নির দুই বাহু ধরে ঝাকিয়ে বললো,
–“কি করে করতে পারলি তুই এটা? তুই জানিস না ভাইয়া তোকে কতটা ভালোবাসে? আর তুই? তুই নিজেও তো ভালোবাসিস ভাইয়াকে৷ তাহলে নিহালের সাথে এনগেজড কেন হলি অর্নি?”

অর্নি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
–“তোর ভাইকে বল আমায় ভুলে যেতে। আমি উনাকে ভালোবাসি না।”

নূর রেগে গিয়ে সপাটে চড় বসালো অর্নির গালে। অর্নি মাথা নিচু চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে৷ নূর চড় মারাতেও অর্নির কোনো হেলদোল নেই। নূর বললো,
–“কেন বারবার মিথ্যে বলছিস? আমি সেদিন ঘরের বাইরে থেকে সবটা শুনেছি অর্নি। তোদের মাঝে সবটা ঠিক হয়ে গেছিলো। সেদিন তাহলে এজন্যই তুই ওভাবে ছুটে__”

–“হ্যাঁ, এবার তো তোদের কাছে সবটা পরিষ্কার। নূর তুই উৎসব ভাইকে বোঝা গিয়ে। ভুলে যেতে বল আমাকে। এতে উনার জন্যই ভালো।”

–“আর তোর?”

নূরের প্রশ্নে চকিত তাকালো ওর দিকে৷ মেকি হেসে বললো,
–“আমারও ভালোই হবে। যেখানে ভাইয়া আম্মু খুশি সেখানে আমিও__”

রুশান অর্নিকে নিজের দিকে ঘুরালো। বললো,
–“তুই তো উৎসব ভাইকে ভালোবাসিস তাহলে__”

–“কি করতাম আমি? উৎসব ভাইয়ের দুদিনের ভালোবাসার জন্য আমি আমার আম্মু আর ভাইয়াকে কষ্ট দিতাম? পারতাম না আমি এটা। তাই উনারা যা চেয়েছে তাই করেছি আমি।”

অর্নি আর নিহালের এনগেজমেন্ট এর কথা শুনলে ওর ভাই পাগল হয়ে যাবে। যাচ্ছেতাই কান্ড করবে। কষ্ট পাবে ভীষণ। নূর ওর ভাইয়ের কষ্টটা এখন থেকেই উপলব্ধি করতে পারছে। ভাইয়ের কথা ভেবে কেঁদে দিলো নূর। অর্নি নূরকে কান্না থামাতে বললো। নূর হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে নিয়ে বললো,
–“তুই যে কষ্ট পাচ্ছিস সে বেলায়? আমার ভাইটা যে কষ্ট পাচ্ছে? তোর এনগেজমেন্ট এর কথা শুনলে ওদিকে আমার ভাই পাগল হয়ে যাবে অর্নি।”

–“হবে না পাগল। ইশা উৎসব ভাইকে ভালোবাসে। উৎসব ভাইয়ের সাথে ইশার বিয়ে দে। দেখবি উৎসব ভাইও ভালো থাকবে।”

রুশান বললো,
–“তুই বাসায় একবারো বলেছিস তুই উৎসব ভাইকে ভালোবাসিস?”

অর্নি চুপ করে রইলো। এতেই নূর আর রুশান বুঝে গেলো অর্নি বাসায় কিছুই বলেনি। নূর বললো,
–“এনগেজমেন্টই তো হইছে বিয়ে তো আর হয়নি। আমি এক্ষুনি গিয়ে অর্নব ভাইয়াকে জানাচ্ছি।”

কথাটা বলে নূর দরজার দিকে পা বাড়ালেই অর্নি হাত চেপে ধরে ওর। অর্নি বললো,
–“কিচ্ছু জানাবি না তুই ভাইয়াকে। ভাইয়া আর আম্মুর খুশিতেই আমি খুশি৷ এই দুটো মানুষের খুশি আমি নষ্ট হতে দিবো না।”

রুশান বললো,
–“আর তোর খুশি?”

–“আমিও খুশি আছি। নিহাল ভাইয়ের সাথেই আমি ভালো থাকবো৷”

নূরের রাগ তড়তড় করে বাড়ছে। অর্নির বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
–“তুই যদি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড না হতি তাহলে এতক্ষণে তোকে আমি জাস্ট খুন করে ফেলতাম আমার ভাইকে এভাবে কষ্ট দেওয়ার জন্য৷ আজকের পর থেকে চিনি না তোকে আমি। অর্নি নামের কোনো বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো না আমার আজ থেকে আমি এটাই মনে করবো।”

কথাগুলো বলে অর্নিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। নূর। তারপর হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। রুশান কি করবে বুঝতে পারলো না। অর্নিকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বললো,
–“তুই থাক, ওদিকে নূর রেগে আছে প্রচুর ওর মাথার ঠিক নেই। আর হ্যাঁ বিয়ে হয়নি এখনো বহুত সময় আছে অর্নি, তুই মাথা ঠান্ডা করে একবার ভেবে দেখ। আমি আসছি দোস্ত।”

কথাটা বলে রুশানও দ্রুত বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।

রাত দশটা বাজে। সকলে ডিনার করছে। কিন্তু অর্নি নেই এখানে। ও খাবে না জানিয়েছে। তবুও সবাই বেশ ক’বার ডেকেছিলো ওর ভালো লাগছে না বলে বের হয়নি রুম থেকে। জানিয়েছে ইচ্ছে হলে পরে খেয়ে নিবে।

বিছানার এক কোনে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে অর্নি। চোখদুটো বন্ধ করে আছে। চোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। সন্ধ্যায় নূরের বলা কথাগুলো ভাবছে ও। বেশ কয়েকবার নূরকে ফোন করেছে কিন্তু নূর ওর নাম্বার ব্লক করে রেখেছে। এফবিতে ম্যাসেজ করেছে সেটাও সিন করে রেখে দিয়েছে। বুঝলো বেশ ভালোভাবেই রেগেছে ওর উপর। এত সহজে এই রাগ ভাঙবে না। এমন সময় দরজায় কড়া নেড়ে নিহাল বললো,
–“অর্নি আসবো?”

অর্নি দ্রুত উঠে বসলো। গায়ে উড়নাটা ভালোভাবে পেঁচিয়ে চোখ মুছে নিলো। নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,
–“আসো।”

অর্নির অনুমতি পেয়ে নিহাল ভিতরে এসে বিছানায় বসলো। নিহাল বেশ কিছুক্ষণ অর্নির দিকে দৃষ্টি স্থির করে রাখলো। তারপর বললো,
–“সবাই এত করে বলার পরও খেতে এলি না কেন?”

–“ভালো লাগছে না।”

–“খাবার নিয়ে আসি আমি?”

–“খেতে ইচ্ছে করছে না নিহাল ভাই, ইচ্ছে হলে পরে খেয়ে নিবো।”

মেয়েটা এখনো আগের মতোই ভাই ডাকছে, সময়ের সাথে সাথে হয়তো ভাই ডাকটা মুছে যাবে। এতদিনকার অভ্যাস বদলাতে তো সময় লাগবেই। আর নিহালেরও উচিত সবটা মানিয়ে নেওয়ার জন্য অর্নিকে সময় দেওয়া। কথাগুলো আপন মনে ভেবেই তপ্ত শ্বাস ফেললো নিহাল। বেশ কিছুক্ষণ দুজনেই নিরব থাকলো। নিরবতা ভেঙে নিহাল বললো,
–“তুই কি কোনো কারনে আপসেট অর্নি?”

–“নাহ তো, কেন?”

নিহাল সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো অর্নির দিকে। তারপর বললো,
–“ঠিক লাগছে না তোকে।”

–“ভালো লাগছে না। ঘুমালেই ঠিক হয়ে যাবে।”

দুজনের মাঝে আবারো নিরবতা বিরাজমান। আগের ন্যায় এবারেও নিহাল নিরবতা ভেঙে বললো,
–“কাল ক্লাস আছে না তোর?”

অর্নি মাথা নাড়ালো। নিহাল বললো,
–“তোর যদি আপত্তি না থাকে আমি পৌঁছে দিবো?”

শান্ত দৃষ্টিতে অর্নি তাকালো নিহালের দিকে। নিহাল ওর জবাবের আশায় চেয়ে আছে। অর্নি লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বললো,
–“এর আগেও তো আমায় কলেজ ভার্সিটি দিয়ে এসেছো তখন তো অনুমতি নাওনি। তাহলে আজ অনুমতি নিচ্ছো কেন নিহাল ভাই?”

–“তখনকার ব্যাপার আর এখনকার ব্যাপারটা এক না অর্নি।”

থমকালো অর্নি। নিহালের সাথে যে এখন ওর অন্যরকম একটা সম্পর্ক তৈরী হয়েছে। মেকি হাসলো অর্নি। তারপর বললো,
–“আপত্তি নেই আমার৷”

–“আচ্ছা, তাহলে আমি সকালে আসবো। এখন ঘুমিয়ে পড়।”

অর্নি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই নিহাল ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো৷ অর্নি কয়েক সেকেন্ড নিহালের যাওয়ার পানে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেললো।

চলবে~

#তুমি_শুধু_আমারই_হও
লেখনীতে- অরনিশা সাথী

|১৭|

ভার্সিটির সামনে বাইক থামাতেই অর্নি নেমে পড়লো। নিহাল বাইক ঘুরিয়ে বললো,
–“ক্লাস শেষ হবে কয়টায়?”

–“তোমার আসতে হবে না, আমি চলে যেতে পারবো।”

–“আচ্ছা তো সাবধানে থাকিস।”

কথাটা বলে নিহাল চলে গেলো নিজ গন্তব্যে। অর্নি পুরো মাঠে চোখ বুলালো কোথাও নূর বা রুশানকে দেখতে পেলো না। ক্যান্টিনে যেতেই দেখলো নূর আর রুশান বসে আছে। অর্নি গিয়ে চেয়ার টেনে বসতেই নূর উঠে দাঁড়ালো। ওখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই অর্নি নূরকে আটকে দেয়। বলে,
–“কেন এমন করছিস আমার সাথে? আমাদের এত বছরের বন্ধুত্ব এভাবে শেষ করে দিতে পারিস না তুই।”

নূর অর্নির হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
–“পারি, তোর জন্য আজ আমার ভাই কষ্ট পাচ্ছে অর্নি। আমার ভাইয়ের কষ্ট আমি সহ্য করতে পারবো না। তুই আমার ভাইকে যেই পরিমান কষ্ট দিচ্ছিস সেটা কক্ষনো ভুলবো না আমি। ক্ষমা করবো না তোকে কোনোদিনও।”

–“আমার দিকটা বুঝার চেষ্টা করবি না একবারো?”

–“কি বুঝবো তোর দিক? তুই যদি বাসায় জানাতি দ্যান যদি কেউ মেনে না নিতো তাহলে একটা কথা ছিলো। কিন্তু তুই সেরকম টা করিস নাই। বাসায় জানাস নি। নিজের মর্জিতে আমার ভাইকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছিস তুই।”

–“আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে___”

–“অর্নি বাচ্চা না আমি, আমিও শান্তকে ভালোবাসি। আমি শান্তর সাথে রিলেশনে যাওয়ার আগে আমার পরিবারকে ম্যানেজ করেছি। তারপর পারিবারিক ভাবেই আংটিবদল হয়েছে আমাদের। তুই পারতি না বাসায় একবারের জন্যও জানাতে? হ্যাঁ আমার আর তোর সিচুয়েশনটা আলাদা আমি মানছি অর্নব ভাই আর আন্টি হয়তো প্রথমে রাজি হতো না৷ একটু কষ্ট হতো উনাদের মানাতে৷ তুই অন্তত একটা বার বলে তো দেখতি পরে না মানলে ভাইয়ার উপর ছেড়ে দিতি সবটা। ভাইয়া সবটা ঠিক করে নিতো। ঠিক মানিয়ে নিতো অর্নব ভাইয়া আর আন্টিকে।”

–“নূর তুই___”

–“একদম কথা বলবি না তুই।”

কথাটা বলে রেগে ক্যানটিন থেকে বেরিয়ে গেলো নূর৷ অর্নি একটা চেয়ারে বসে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে। কাঁধে স্পর্শ পেয়ে পাশে তাকিয়ে রুশানকে দেখলো৷ রুশানকে জাপ্টে ধরে কাঁদতে শুরু করে দিলো। রুশান অর্নির মাথায় হাত বুলালো ক্ষানিক সময়। তারপর অর্নির সামনে বসে ওর হাতদুটো ধরে বললো,
–“কাঁদিস না, এখন কেঁদে কি হবে বল?”

–“তুইও বন্ধুত্ব শেষ করে দিবি তাই না? দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তোরও যা যা বলার আছে বল, বলে চলে যা আমায় ছেড়ে।”

রুশান অর্নির চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
–“ধুর! আমি কেন বন্ধুত্ব শেষ করবো? তোদের ছাড়া আমার চলবে নাকি? নূরের কথা ধরিস না তো৷ ওর মন মেজাজ ঠিক নেই তাই এরকম বলেছে। রাগ কমলে দেখবি সবার আগে তোর কাছে ছুটে আসবে। তুই কান্না অফ কর।”

অর্নি কিছু বললো না। রুশান আবারো বললো,
–“এখনো সময় আছে অর্নি, সবটা তোর হাতে। তুই একবার বাসায় জানা উৎসবের ভাইয়ের কথা৷”

অর্নি তখনো নিশ্চুপ। রুশান বললো,
–“আমি উৎসব ভাইকে ডাকছি এখানে। কথা বল দুজনে। তুই একা না পারলে উৎসব ভাইকে নিয়ে গিয়ে তারপর কথা বল অর্নব ভাই আর আন্টির সাথে৷ আই হোপ উনারা বুঝবেন।”

কথাগুলো বলে রুশান ফোন বের করলো উৎসবকে ফোন করার জন্য৷ অর্নি বললো,
–“ডাকিস না উনাকে৷ আমি দাঁড়াতে পারবো না উনার সামনে।”

–“সমস্যা থেকে পালিয়ে বেড়ালেই সমস্যা সমাধান হয় না অর্নি৷ শক্ত ভাবে দাঁড়িয়ে সেটার মোকাবেলা করতে হয়৷ এতদিন তো পালিয়ে বেরিয়েছিস, কোনো সমাধান হইছে? হয়নি৷ উলটো আরো কষ্ট পাচ্ছিস এখনো। উৎসব ভাইকে টেক্সট করে দিয়েছি, উনি দশ মিনিটের মাঝেই ক্যাম্পাসে ঢুকছে। কথা বল দুজনে৷”

অর্নি নির্বিকার ভাবে বসে রইলো৷ রুশান বললো,
–“তুই এখানেই বোস, আমি দেখছি নূর আবার কোথায় গেলো? ওকে নিয়েই আসছি আমি।”

অর্নি সম্মতি জানাতেই রুশান উঠে গেলো৷ ওখানেই চুপচাপ বসে রইলো অর্নি। এমন সময় কেউ একজন বসে অর্নির সামনে৷ অর্নি মাথা তুলে মাহিরকে দেখতে পেয়ে বিরক্ত হলো বেশ। উঠে চলে যেতে চাইলে মাহির বললো,
–“ভালোই তো ছেলে জুটিয়েছো। একদিন উৎসব তো একদিন আজকের ওই ছেলেটা। তা আমাকেও একটু সময় দিতে পারতে। ওদের থেকে খারাপ হতো না আমার পারফরম্যান্স___”

পেছনে ঘুরে সপাটে চ/ড় বসালো অর্নি মাহিরের গালে। রাগে গাঁ জ্বলে যাচ্ছে৷ কিসব উল্টাপাল্টা বলছে৷ মাহির দাঁড়িয়ে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো অর্নির দিকে। অর্নি ওর দিকে আঙুল তাক করে বললো,
–“একদম উল্টাপাল্টা বলবেন না__”

মাহির অর্নির বা-হাত ধরে দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বললো,
–“আমি যখন ভালোভাবে ভালোবাসি বলছিলাম তখন তো খুব সতীসাধ্বী সেজেছিলে। রিলেশন করবেন না ভালোবাসবে না। তাহলে দু দুটো ছেলে নিয়ে এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছো কেন? নাকি একজনে পোষায় না? না পোষালে আমায় বলো আমি একদম পুষিয়ে___”

অর্নির ঘৃণায় চোখ বন্ধ করে নিলো। চ/ড় মারার জন্য আবারো ডান হাত তুলতেই উৎসব এসে মাহিরের ঘাড় ধরে মুখ টেবিলের সাথে চেপে ধরলো। মাহির ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। উৎসব ঠেসে ধরে রেখেছে মাহিরকে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবি না অর্নির সম্বন্ধে___জানে মেরে ফেলবো।”

রুশান আর নূর এসে উৎসবকে ছাড়িয়ে নিলো। মাহির উঠে গিয়ে নিজের শার্ট ঠিক করে নিয়ে অর্নির দিকে রাগ চোখে তাকিয়ে বললো,
–“পার পাবে না একদম____”

উৎসব মাহিরের কলার টেনে ধরে বললো,
–“তোর চোখ একদম উপড়ে ফেলবো আমি। কোন সাহসে আবার অর্নির দিকে চোখ তুলে তাকাস তুই?”

কথাটা বলে উৎসব মাহিরের নাক বরাবর ঘুঁষি মারলো। এত জোরে মেরেছে যে নাক ফেঁটে রক্ত বেরিয়ে এলো ক্ষানিকটা। মাহির ঝাড়া মেরে উৎসবের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নাকের রক্ত মুছে নিয়ে তাকালো দুজনের দিকে। তারপর চলে গেলো সেখান থেকে৷ নূর অর্নির কাছে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বললো,
–“তুই ঠিক আছিস অর্নি?”

অর্নি কিছু না বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
–“আমি খারাপ আর বাজে একটা মেয়ে তাই না রে নূর?”

নূর অর্নির চোখের পানি মুছে দিলো। রুশান অর্নির কাঁধে হাত রেখে বললো,
–“কিসব ভুলভাল বলছিস? তুই খারাপ হতে যাবি কেন?”

–“আমি যদি বাজে না হই তাহলে মাহির আমাকে এতো গুলো নোংরা নোংরা কথা শোনানোর স্কোপ পায় কোথায় বল?”

–“হ্যাঁ খারাপ তুমি, ভীষণ রকমের খারাপ। তোমদের মতো মেয়েদের জন্য যারা সত্যিকারের অর্থে ভালোবাসে তাদেরও বদনাম হয়। ছেলেরা খারাপ হয়, ভালোবাসা হারায়। তোমার মতো মেয়েরাই একটা ছেলের জীবন নষ্ট করে দিতে দুবার ভাবে না। এতই যদি পরিবারের উপর দরদ তাহলে শুরুতে সবটা ক্লিয়ার করোনি কেন? পেছন পেছন ঘুরাবা তারপর নিজের অনূভুতিও প্রকাশ করবা তারপর একটা টাইমে এসে সেই ছেলেটার ভালোবাসার কথা বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে পরিবারের দোহাই দিয়ে চলে যাও। পেছন ফিরে একবারো তাকাও সেই ছেলেটার দিকে? যদি তাকাতে তাহলে অবশ্যই দেখতে পেতে সেই ছেলেটার তোমাকে হারানোর আহাজারি। দেখতে পেতে সেই ছেলেটার চোখে তোমার জন্য এক আকাস সম ভালোবাসা। কিন্তু না তুমি, তোমরা পেছন ফিরে তাকাও না। তোমরা নিজেদের মন মর্জি মতো কাছে টেনে নেবে আবার তোমাদের মর্জি মতোই দূরে ঠেলে দিতে দু’বার ভাবো না। এতই যখন পরিবার নিয়ে চিন্তা তাহলে সেদিন তোমার মনের অনূভুতি গুলো ব্যক্ত করেছিলে কেন আমার সামনে? একেবারে দূরে সরে যেতে পারোনি? আমার সামনে থেকেই কেন তোমার প্রতি আমার ভালোবাসাটা আরো গভীর থেকে গভীর করেছো?”

উৎসবের এমন সব কথায় অর্নি এবার শব্দ করেই কেঁদে দিলো৷ নূর ওর ভাইকে বললো,
–“ভাইয়া কি বলছো এসব? এমনিতেই মাহিরের ওরকম বিহেভিয়ার তার উপর আবার তুমি এসব বলছো।”

উৎসব অন্যদিকে ঘুরে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। রাগ নিয়ন্ত্রণের সব রকম কৌশল অবলম্বন করতে লাগলো। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে অর্নির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। অর্নির দু গালে হাত রেখে বললো,
–“অর্নি প্লিজ এরকমটা করো না। জাস্ট এনগেজমেন্ট হয়েছে, এটা কোনো ফ্যাক্টই না। প্লিজ, প্লিজ একটাবার অন্তত নিজের কথা ভাবো, আমার কথা ভাবো? এই বিয়েটা তে তুমি হ্যাপি থাকবে না অর্নি। পাগলেও তো নিজের ভালোটা বুঝে অর্নি। আর তুমি___”

অর্নি তখনো চুপচাপ চোখের জল ফেলছে৷ নূর অর্নিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,
–“প্লিজ দোস্ত একটা বার ভেবে দেখ না। এখানে তুইও কষ্ট পাচ্ছিস আর আমার ভাইটাকেও কষ্ট দিচ্ছিস৷ এরকমটা করিস না অর্নি। এখনো হাতে অনেক সময় আছে তুই একবার অর্নব ভাইয়াকে বুঝিয়ে বল। আ’ম সিওর অর্নব ভাইয়া দ্বিমত করবে না। প্লিজ দোস্ত আমার ভাইটাকে এভাবে কষ্ট দিস না। একবার কথা বলে___”

অর্নি কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
–“আমি পারবো না রে___”

অর্নির কথায় উৎসবের মেজাজ আরো গরম হলো। অর্নির হাত শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
–“ওকে ফাইন, তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। যা করার আমিই করবো।”

কথাগুলো বলে উৎসব টেনে হিঁচড়ে অর্নিকে নিয়ে গাড়িতে বসালো। তারপর নিজেও বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। নূর আর রুশানও ছুটলো ওদের পেছনে।

অর্নিদের বাসার সামনে এসে উৎসব গাড়ি থামায়। নিজে নেমে অর্নিকে টেনে বার করে গাড়ি থেকে। অর্নি বললো,
–“প্লিজ উৎসব ভাই এরকমটা করবেন না আপনি।”

উৎসব অর্নির দিকে ঘুরে লাল লাল চোখে তাকায়। উৎসবের চোখদুটো রক্তবর্ন ধারন করেছে৷ অর্নির দিকে ঝুঁকে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললো,
–“হুশশশ! একদম কথা বলবে না তুমি। এবার যা বলার আর করার আমি করবো।”

কথাটা বলে উৎসব অর্নিকে টেনে বাসার ভিতরে নিয়ে গেলো। অর্নিকে এভাবে একটা ছেলে টেনে আনায় মিসেস অদিতি কিচেন থেকে দ্রুত বেড়িয়ে এলেন। এমন সময় নূর আর রুশানও উপস্থিত হলে সেখানে। অর্নির এরুপ অবস্থা দেখে মিসেস অদিতি জিজ্ঞেস করলেন,
–“কি হইছে অর্নি? আর ছেলেটা কে?”

নূর এগিয়ে এসে বললো,
–“আন্টি এটা আমার ভাই, তুমি একটু অর্নব ভাইয়াকে ডেকে দিবে?”

মিসেস অদিতি উৎসবের দিকে তাকালেন একবার। তারপর আবারো তাকালেন অর্নির হাতের দিকে যে হাতটা উৎসব শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে। মিসেস অদিতি দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে অর্নবের রুমে গেলেন ওকে ডাকার জন্য। অর্নবকে ডেকে মিসেস অদিতি আবারো সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। নূরকে বললো,
–“নূর কিছু হইছে? অর্নিকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”

–“রিল্যাক্স আন্টি কিচ্ছু হয়নি।”

কথাটা যেন বিশ্বাস হলো না মিসেস অদিতির। কিছু তো গন্ডগোল আছে৷ নয়তো হুট করেই নূরের ভাই এ বাসায় আসবে কেন? উনি আবারো সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালেন উৎসবের দিকে। তারপর নূরকে বললো,
–“তোমার ভাইকে নিয়ে বসো, আমি চা-নাস্তার ব্যবস্থা করছি।”

রুশান বললো,
–“তার কোনো দরকার নেই আন্টি।”

এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলো অর্নব। উৎসবকে দেখে চিনতে পারলো না। নূর পরিচয় বলতেই বেশ অবাক হলো ও। হঠাৎ উৎসবের ওর সাথে কি কাজ থাকতে পারে ভেবে পেলো না অর্নব। উৎসব তখনো শক্ত করে অর্নির হাত ধরে রেখেছিলো। তা দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো অর্নব।

চলবে~