তুমি শুধু আমারই হও পর্ব-৩৬

0
350

#তুমি_শুধু_আমারই_হও
লেখনীতে- অরনিশা সাথী

|৩৬|

–“অর্নি? এই অর্নি উঠ মা। আর কত ঘুমাবি?”

অর্নি নড়েচড়ে আবারো শুয়ে পড়লো। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো,
–“উহুম আম্মু, ঘুমাতে দাও তো। এরকম শান্তির ঘুম ঘুমাই না অনেক দিন হয়।”

মেয়ের এমন জবাবে মিসেস অদিতি কি বলবেন ভেবে পেলেন না। তাই রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন উনি। নিজের রুমে গিয়ে উৎসবের নাম্বারে ডায়াল করলো। কিছুক্ষণ বাদে উৎসব রিসিভ করে সালাম জানালো। টুকটাক ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করলো। তারপর মিসেস অদিতি বললো,
–“বাবা অর্নিকে একটু ফোন দিয়ে জাগিয়ে তুলো তো। আমি এত করে ডাকছি উঠছেই না।”

–“আচ্ছা আমি দেখছি।”

এই বলে লাইন কেটে দিলো উৎসব। পরমূহুর্তেই রিংটোন বেজে উঠলো অর্নির ফোনে। অর্নি ফোন তুলছে না। তিনবারের সময় অর্নি বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে উৎসব বললো,
–“এদিকে আমাকে অশান্তিতে রেখে অন্যদিকে আমার বউ শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। দিস ইজ নট ডান বউ।”

অর্নি ঘুম জড়ানো কন্ঠেই বললো,
–“আমি আপনার কাছে থাকলে আপনি শান্তিতে ঘুমান কিন্তু আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারি না আপনার টর্চারে। তাই এখন আমি শান্তিতে ঘুমাবো আপনি একটু অশান্তিতে থাকুন।”

–“ওটাকে টর্চার বলে না বউ। আদর, ভালোবাসা বলে। যদি লাভ-টর্চার বলতে তাহলেও চলতো৷ বাট টর্চার? নাহ বউ এটা ঠিক না।”

–“সব ঠিক, আপনি এখন ফোন রাখুন। আমি ঘুমাবো।”

–“আটটা নাগাদ আমাদের রিসোর্টে যাওয়ার জন্য বের হতে হবে বউ। পরে দেখা যাবে তোমাকে রেখেই সবাই রঙ খেলা শুরু করে দিয়েছে।”

রঙ খেলার কথা শুনে অর্নির ঘুম উড়ে গেলো। লাফিয়ে উঠে বসলো। কান থেকে ফোন নামিয়ে সময় দেখলো সাড়ে ছয়টা বাজে। দ্রুত ফোন কানে নিয়ে বললো,
–“রাখুন তো। আপনার জন্য আমার লেট হয়ে গেলো।”

কথাটা বলেই খট করে লাইন কেটে দিলো অর্নি। ওদিকে অর্নির কান্ডে ক্ষানিকটা শব্দ করেই হেসে দিলো উৎসব।

শহর থেকে বেশ ক্ষানিকটা দূরে বিরাট বড় একটা রিসোর্টের সামনে এসে গাড়ি থামলো। শহর ছাড়িয়ে রিসোর্টে যাওয়ার পথিমধ্যে বেশ বড় বড় পাহাড় পড়েছে কয়েকটা৷ পাহাড়ের কিনার ঘেঁষে আঁকাবাঁকা রাস্তা দূর দূরান্তে চলে গেছে। রিসোর্টের এরিয়ায় প্রবেশ করার আগে অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা দেখেছে সকলে। অর্নির ইচ্ছে ছিলো পাহাড়ের ওখানে নেমে ক্ষানিকটা সময় কাটানোর জন্য। কিন্তু এমনিতেই লেট ওরা তাই আর নামেনি গাড়ি থেকে। উৎসব নূর শান্ত টায়রা ওরা সকলেই চলে এসেছে। অর্নিরা’ই লেট। অর্নি গাড়ি থেকে নেমে গেলো। নূর দৌড়ে এসে অর্নিকে জাপ্টে ধরে বললো,
–“একদিন তোকে দেখিনি তাই মনে হচ্ছে কত যুগ হলো দেখি না তোকে।”

অর্নি মুচকি হাসলো। নূর অর্নির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
–“তাহলে ভাইয়ার কি অবস্থা ভাব একবার।”

অর্নি চোখ রাঙিয়ে তাকালো। নূর মুচকি হেসে অর্নিকে নিয়ে এগিয়ে গেলো রিসোর্টের ভিতর। ওদের বিয়ের জন্য এই পুরো রিসোর্ট বুকড্ করা হয়েছে। ভিতরে গিয়ে অর্নির চোখ জুড়িয়ে গেলো। কি সুন্দর করে ডেকোরেশন করা পুরো রিসোর্ট-টা। দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। সকল আত্নীয় স্বজনও চলে এসেছে ইতিমধ্যে। একদল মেয়েরা এসে অর্নি নূরকে টেনে ভিতরে নিয়ে গেলো। রঙ খেলার জন্য রেডি হতে হবে এখনই। অর্নি এদিক সেদিক চোখ বুলালো একবার। উৎসবের দেখা মিললো না। তাই হতাশ হয়ে মেয়েগুলোর সাথে ভিতরে চলে গেলো রেডি হতে৷

সব মেয়েরা রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। যেখানে রঙ খেলা হবে সেখানেই গেছে সকলে। টায়রা, তরী, ইশা বেরিয়ে গেলো। অর্নি তখন চুল ঠিক করছিলো। নূর অর্নিকে বললো,
–“তুই রেডি হয়ে চলে আয়, আমি যাচ্ছি?”

অর্নি সম্মতি জানালো। নূর ঘর থেকে বের হতেই এক-জোড়া হাত নূরকে টেনে কিছুটা আড়ালে নিয়ে গেলো। নূর চোখ তুলে তাকিয়ে শান্তকে দেখতে পেয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। শান্ত একগাল হেসে নূরের গালে গোলাপি রঙ লাগিয়ে দিলো। নূর মুচকি হেসে কিছুটা উচু হয়ে শান্তর মাথা ধরে টেনে কিছুটা নিচু করালো। তারপর নিজের গাল ঘঁষে শান্ত’র গালে রঙ মাখিয়ে দিলো নূর। তারপর দৌড়ে চলে গেলো ওখান থেকে।

খট করে দরজা লাগানোর শব্দে পেছন ফিরে তাকালো অর্নি। দরজায় হেলান দিয়ে উৎসব দাঁড়িয়ে আছে। পরণে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি’তে অসম্ভব সুন্দর লাগছে ছেলেটাকে দেখতে। অর্নি উৎসবের চোখের দিকেই পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে। উৎসব মুচকি হেসে অর্নির দিকে এগিয়ে গেলো। উৎসবকে এগিয়ে আসতে দেখে অর্নি জামা খামচে ধরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। উৎসব অর্নির একদম নিকটে গিয়ে দাঁড়ালো। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে তিনটে সাদা গোলাপ বের করে অর্নির কানের পিঠে গুজে দিলো। অর্নির কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে বললো,
–“আমার বউকে একদম সাদা গোলাপের মতো লাগছে। গাছে ফোঁটা সাদা গোলাপের থেকেও বেশি সুন্দর, আকর্ষণীয়, সতেজ লাগছে।”

অর্নি চোখ তুলে তাকালো উৎসবের দিকে। উৎসব বাঁকা হেসে অর্নির চোখের দিকে তাকালো। অর্নি চোখ নামিয়ে নিলো আবার। পকেট থেকে ছোট্ট একটা পলিব্যাগ বের করলো। ব্যাগে লাল রঙ। উৎসব হাতে রঙ মাখিয়ে অর্নির গলায় লাগিয়ে দিলো। অর্নি কেঁপে উঠে চোখ বন্ধ করে নিলো। উৎসব মুচকি হেসে অর্নির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
–“আমার বউয়ের গায়ে প্রথম রংটা আমিই লাগালাম।”

অর্নি কিছু বললো না। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো উৎসব দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো।

সাউন্ড বক্সে ফুল ভলিউমে গান বাজছে। গানের তালে তাল মিলিয়ে রঙ খেলছে ছেলে-মেয়েরা। সাথে নাচছেও অনেকে। অর্নি নূর তরী টায়রা ইশা ওরা একসাথে এক সাইডে নাচ করছে৷ অন্যদিকে রুশান অর্নব উৎসব শান্ত নিহাল ওরা আছে। প্রত্যেকের চেহারার নাজেহাল অবস্থা। রঙ চং মেখে একেবারে ভূত হয়ে গেছে। খুব ভালোভাবে লক্ষ্য না করলে কাউকে তেমন একটা চেনার জোঁ নেই। সাউন্ড বক্সে ‘কালা চশমা’ গান বেজে উঠতেই রঙ খেলায় উপস্থিত সকলে ছেলে মেয়ে একসাথে জড়ো হয়ে নাচতে শুরু করলো।

ভীরের মাঝে হঠাৎই কেউ একজন অর্নির হাত ধরে টেনে একটা নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে গিয়ে হাত ছেড়ে দিলো। অর্নি চোখ তুলে তাকাতেই কেউ একজন রঙ ছুঁড়ে মারলো ওর চোখে। দুহাতে চোখমুখ আটকে নিলো অর্নি। সামনে থাকা মানুষটি অর্নির দুই গাল ভর্তি করে নীল রঙে রাঙিয়ে দিয়ে গেলো অর্নিকে। অর্নি চোখ মেলে সামনে কাউকে দেখতে পেলো না। খটকা লাগলো মনে। পরমূহুর্তেই ভাবলো হয়তো উৎসবই ছিলো। কেননা উৎসব ছাড়া আর কারো সাধ্য নেই উৎসবের নাগালের মধ্যে এসেই অর্নিকে রঙ লাগিয়ে যাবে। তাই এসব নিয়ে আর তেমন একটা মাথা ঘামালো না অর্নি। ওখান থেকে সরে আসার জন্য পা বাড়ালো।

রিসোর্টের গার্ডেনের কাছাকাছি আসতেই উৎসব এসে পথ আটকে দাঁড়ালো অর্নির। উৎসব বললো,
–“ওদিকে কোথায় গিয়েছিলে তুমি?”

অর্নি ভ্রু কুঁচকে ফেললো। ভাবলো নিজেই নিয়ে গিয়ে এখন নিজেই বলছে ওখানে কেন গিয়েছিলো? ভারী আশ্চর্য হলো অর্নি। তবে সেটা মুখে প্রকাশ করলো না। কথা ঘুরিয়ে বলল,
–“এমনি।”

উৎসব সন্দিহান দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর অর্নির হাত ধরে আবারো গার্ডেনে নিয়ে গেলো।

রং খেলা শেষ হয়ে গেলো। আজ সন্ধ্যায় প্রথমে সঙ্গীত তারপর মেহেন্দীর অনুষ্ঠান করা হবে। প্রথমে আলাদা আলাদা দিনে সঙ্গীত আর মেহেন্দি করার কথা ছিলো। কিন্তু পরে চিন্তা ভাবনা করে দুটো একই দিনে করা হয়েছে। অর্নি আজকের অনুষ্ঠানের জন্য গাঢ় পিত্তি রঙের লেহেঙ্গা পড়েছে৷ ওর সাথে ম্যাচ করে উৎসবও সেম কালারের শেরওয়ানী টাইপ শর্ট পাঞ্জবী পড়েছে। উৎসবের পিত্তি কালার পাঞ্জাবীটাতে গোল্ডেন সুতার কাজ করা। অন্যদিকে নূর গাঢ় গোলাপী লেহেঙ্গা আর ওর সাথে ম্যাচ করে শান্ত গাঢ় গোলাপী শেরওয়ানী পড়েছে। আর অর্নব টায়রা পড়েছে নীল রঙা লেহেঙ্গা শেরওয়ানী।

সঙ্গীতের অনুষ্ঠান শুরুই হয় রুশান আর তরীর পারফরম্যান্স এর মধ্য দিয়ে৷ এরপর একে একে সকল কাপলস পারফর্ম করে। সন্ধ্যা থেকে রাত এগারোটা অব্দি সঙ্গীতের অনুষ্ঠান চলতে থাকে। অর্নব এসে সকলকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“এখন সবাই খাবারের ওখানে যাও। ডিনার করার পর মেহেন্দি অনুষ্ঠান শুরু হবে।”

অর্নবের কথায় সায় জানিয়ে সকলেই খাবারের ওখানে চলে গেলো। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে, হাতে মেহেন্দি পড়ে খেতে পারতো না কেউ-ই তাই মেহেন্দি পড়ার আগেই ডিনার কমপ্লিট করাটা বেটার।

তিন-জোড়া ব্রাইডের জন্য তিন জন মেহেন্দি আর্টিস্ট এবং এক্সট্রা দুজন মেহেন্দি আর্টিস্ট আনা হয়েছে। অর্নি নূর টায়রা তরী ইশা পাঁচ জনে পাঁচ মেহেন্দি আর্টিস্ট এর কাছে বসেছে হাতে মেহেন্দি পড়ার জন্য। তিন ব্রাইড নিজেদের হাতে তাদের বরের নামের অক্ষর লিখেছে ছোট্ট করে। অর্নির জোড়াজুড়িতে উৎসবও মেহেদী পড়েছে হাতে। মেহেন্দি দিতে দিতে রাত প্রায় দুটো নাগাদ বেজে যায়। তারপর আরো বেশ কিছুক্ষণ হুই হুল্লোড় করে একে একে ঘুমাতে যায় সকলে।

অর্নি আর উৎসব স্টেজের এক কোনে বসে আছে। অর্নির ডান হাতের তালুতে উৎসব খুব যত্নসহকারে মেহেন্দি পড়িয়ে দিচ্ছে। উৎসব আগে থেকেই বলে রেখেছিলো একহাত যাতে ওর জন্য খালি রাখা হয়। সেই মোতাবেক অর্নি মেহেন্দি আর্টিস্টকে দিয়ে বা হাতের দুই পিঠ এবং ডান হাতের উলটো পিঠে মেহেন্দি পড়ে উৎসবের জন্য ডান হাতের তালু ফাঁকা রাখে। সেখানেই যত্নসহকারে মেহেন্দি লাগাচ্ছে উৎসব। আর অর্নি এক ধ্যানে উৎসবের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

হাই তুলতে তুলতে রিসোর্টে বরাদ্দকৃত নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিলো নূর। এমন সময় ওর পথ আটকে দাঁড়ায় শান্ত। নূর ভ্রু কুঁচকে তাকালো। নূরের হাত ধরে টেনে রুমে গিয়ে দরজা লক করে দিলো শান্ত। নূর অবাক হলো। পিছিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
–“আপনি এখানে কেন? আর দরজা লক করলেন কেন?”

–“হাফ-বউ’কে দেখতে আসলাম।”

–“কাল থেকে সারাদিনই তো দেখেছেন। চোখের সামনেই তো ছিলাম।”

–“মাঝে আরো দুই দিন অপেক্ষা করতে হবে হাফ-বউ।”

–“কিসের জন্য?”

–“তোমাকে ফুল-বউ করার জন্য।”

নূর লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিলো৷ শান্ত আচমকাই জড়িয়ে ধরলো নূরকে। নূর ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। ছেলেটার হলো কি? হঠাৎ করে এভাবে জড়িয়ে ধরার কারণ খুঁজে পেলো না নূর। আলতো করে শান্ত’র পিঠে হাত রেখে বললো,
–“শান্ত? কি হয়েছে আপনার?”

শান্ত বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো,
–“এমনি কিছু না।”

বলেই শান্ত নূরকে ছেড়ে দিলো। নূর ভালোভাবে পরখ করলো শান্তকে। লোকটাকে ঠিক লাগছে না ওর কাছে। সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
–“আপনি ঠিক আছেন? কি হয়েছে আপনার?”

–“আ’ম ফাইন নূর। কিছু হয়নি আমার।”

–“তাহলে এমন দেখাচ্ছে কেন আপনাকে? অন্য রকম লাগছে আজ আপনাকে।”

শান্ত মৃদু হাসলো। নূরের কপালে গভীর ভাবে চুমু খেয়ে বললো,
–“সবটা ঠিকঠাক হবে তো নূর? কোনো ঝামেলা হবে না তো?”

শান্ত’র কথায় ভ্রু কুঁচকালো নূর। বললো,
–“অবশ্যই সব ঠিকঠাক হবে। আপনি অযথায় চিন্তা করছেন। রুমে গিয়ে ঘুমান এখন।”

শান্ত যাওয়ার আগে আরো কিছুক্ষণ নূরকে জড়িয়ে ধরে রাখলো। তারপর আচমকাই আবার নূরকে ছেড়ে দিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। নূর শান্ত’র যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,
–“পাগল একটা।”

চলবে~