তুমি_শুধু_গল্প_না_আমার_ভালোবাসা পর্ব-৫১+৫২

0
48

#তুমি_শুধু_গল্প_না_আমার_ভালোবাসা
#আমেনা_আক্তার
#পর্ব_৫১

তখনি হঠাৎ আব্রাহামের বুকের দিকে বন্দুক তাক করে রাখা গুন্ডার হাতে তীব্র বেগে একটি গুলি এসে লাগলো। গুলিটি লাগতেই বন্দুক টি পরে গেল গুন্ডা টির হাত থেকে। আব্রাহাম ও বাকি গুন্ডা গুলো সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো আদিত্য বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে গুন্ডা টির দিকে।ওর চোখ মুখে যেনো খেলা করছে হিংস্রতা। আদিত্যর সাথেই দাঁড়িয়ে আছে আদিত্যর বডিগার্ড। আদিত্য কে এই সময় এখানে উপস্থিত দেখে গুন্ডা গুলোর চোখ মুখে আতংক এসে হানা দিলো। গুন্ডা গুলোর মধ্যে কেউ আদিত্য কে এখানে আসা করে নি। আদিত্য কে চিনে না এমন কোনো গুন্ডা মাস্তান এই শহরে নেই।গুন্ডা ও মাস্তানদের কাছে আদিত্য চৌধুরী একটি আতংকের নাম।সেই আদিত্য কে এখানে দেখে তো ভয় পাওয়ারই কথা।

এদিকে আব্রাহাম আস্তে আস্তে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেল আয়নার কাছে। এবং ধপ করে বসে পড়লো আয়নার মাথার কাছে। আব্রাহাম বসেই একহাত দিয়ে আয়নার মাথা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলো। এবং আরেক হাত দিয়ে আয়নার মাথার রক্ত আটকানোর চেষ্টা করতে থাকলো।

আদিত্য ইশারা করতেই বডিগার্ড ঝাঁপিয়ে পড়লো গুন্ডা গুলোর উপর।গুন্ডা গুলো নিজের সর্বত্র দিয়ে চেষ্টা করার পরেও পেরে উঠলো না আদিত্যর শক্তিশালী বডিগার্ডদের সাথে।

রাজদের গাড়ি এসে থামলো মেলার সামনে। এবং সকলে দৌড়ে মেলার ভিতরে প্রবেশ করলো। মেলার ভিতর প্রবেশ করতেই ওরা দেখতে পেলো আদিত্যর বডিগার্ড ও গুন্ডা গুলোর মধ্যে সংঘর্ষ চলছে।আর একপাশেই আব্রাহাম আয়নার মাথা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে বসে আছে। আব্রাহাম ও আয়নার অবস্থা দেখে সকলের পা যেনো সেখানেই থেমে গেল।নিজেদের সামলে সকলে এগিয়ে গেল আব্রাহামের কাছে। তারপর ওদের সকলে মিলে ওদের হসপিটালে নিয়ে আসে।

রাজ এইটা খুব ভালোভাবে বুঝে গেছে নূর যে আব্রাহামের প্রিয়সির কথা বলেছে তা আর কেউ না আয়না। কারণ আব্রাহাম অনেক পাগলামো করছিল আয়না কে নিয়ে ওকে কিছুতেই ছেড়ে অপারেশন থিয়েটারে যেতে চাইছিল না।ও বারবার বলছিল যেই পর্যন্ত আয়নার অপারেশন সঠিক ভাবে না হয়ে যায় সেই পর্যন্ত ও ওর অপারেশন করাবে না। শেষ পর্যন্ত আব্রাহাম কে ইনজেকশন দিয়ে বেহুঁশ করে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

বর্তমান…

অপারেশন শেষ হতেই ডাক্তার বের হয়ে আসে অপারেশন থিয়েটার থেকে। ডাক্তার কে বের হতে দেখে সকলে উন্মাদের মতো ছুটে যায় ডাক্তারের কাছে। আব্রাহামের মা কাঁদতে কাঁদতে বলল।

ওরা এখন কেমন আছে, অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে তাই না।আয়না ও আব্রাহাম ঠিক আছে না। ওদের কোনো ক্ষতি হয়নি তো। প্লিজ বলুন।

শান্ত হোন আপনারা অপারেশন হয়ে গিয়েছে এবং দুজনেরই জীবন বেঁচে গিয়েছে।

ডাক্তারের কথা শুনে সকলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিন্তু তখনি আবার ডাক্তার বলে উঠলো।

কিন্তু,

কিন্তু কি,

কিন্তু আব্রাহামের এখনো পা পুরোপুরি ঠিক হয়নি।ওর যেই পায়ে গুলি লেগেছে সেই পায়ে কিছু সমস্যা হয়েছে।তাই আব্রাহামের আরো ভালো ট্রিটমেন্ট দরকার যা এখানে হবে না।ওর ট্রিটমেন্ট করার জন্য বিদেশ নিয়ে যেতে হবে।আর আয়না। ওর মাথায় অনেক গভীর ভাবে আঘাত লাগার কারনে ওর শরীর প্রায় প্যারালাইজ হয়ে গিয়েছে।ও আপনাদের কথা শুনতে পারবে। আপনাদের দেখতে পারবে কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া করতে পারবে না।

ডাক্তারের কথা শুনে সকলের মাথায় যেনো বজ্রপাত ঘটলো। রাজের মা ডাক্তারের কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতে বলল।

আমার মেয়ে কি সারাজীবন এমন থাকবে।ও কি কখনো ঠিক হবে না।

জ্বী ও অবশ্যই ঠিক হবে কিন্তু কবে কখন তা আমি বলতে পারব না।এমন ও হতে পারে ও আজই সুস্থ হয়ে যায়। আবার এমনও হতে পারে ও সারাজীবন এমনি থাকবে।

ডাক্তারের কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়লো আয়নার বাবা মা।রাজ যেনো পাথর হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।কোনো ভাই কি সহ্য করতে পারে নিজের আদরের বোনের এমন পরিনতি। আরশাদ এসে রাজকে কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আরশাদ জড়িয়ে ধরতেই শক্ত পোক্ত খোলশ ছেড়ে বেড়িয়ে রাজ হু হু করে কেঁদে উঠলো।ও কিভাবে মেনে নিবে ওর বোন ওকে আর ভাই বলে ডাকবে না।ওর কাছে আর আবদার করবে না।আদৌ কি আয়না সুস্থ হবে নাকি সারাজীবন রাজ নিজের বোনের মুখে ভাইয়া ডাক শোনার জন্য জ্বলতে থাকবে।এই উত্তর কারও জানা নেই।
___________________________________
আস্তে আস্তে আব্রাহাম নিজের চোখ মেলে তাকাতেই নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিস্কার করল। হঠাৎ নিজেকে হসপিটালের বেডে দেখে আব্রাহাম কিছুই মনে করতে পারে না যে ওর সাথে কি ঘটে ছিল। আব্রাহাম ঠিক ভাবে নড়াচড়া ও করতে পারছে না। ওষুধের প্রভাবে আব্রাহামের তীব্র মাথা ব্যথা করছে। একজন নার্স আব্রাহাম কে চোখ মেলে তাকাতে দেখে বাইরে আব্রাহামের বাবা মা আর ওর বন্ধুদের খবর দেয়।

আব্রাহামের বাবা মা ও ওর বন্ধুরা ছুটে আসলো আব্রাহামের কাছে। আব্রাহাম নিজের বাবা মা ও বন্ধুদের দেখে দুর্বল কন্ঠে প্রশ্ন করলো।

আ..আমি এখানে কি করছি?

আব্রাহামের প্রশ্নে সকলে কিছুটা অবাক হয়। কিন্তু পরের মুহূর্তে সকলে বুঝতে পারে ওষুধের প্রভাবের জন্য হয়তো আব্রাহামের কিছু মনে নেই। আব্রাহামের কথা শেষ হতেই আব্রাহামের মা বলল।

তুই এখন ঠিক আছিস বাবা, তুই জানিস আমরা কত ভয় পেয়ে গেছিলাম। আল্লাহর রহমতে তুই সুস্থ হয়ে গেছিস।

কিন্তু আ.. আমার কি হয়েছে আমি তো মেলা..

কথাটি বলতেই থেকে গেল আব্রাহাম ওর যেনো মুহূর্তের মধ্যে সব কিছু মনে পরে গেল।সব কিছু মনে পরতেই আব্রাহাম যেনো পাগলের মতো হয়ে গেল। এবং উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল।

মা আয়..য়না কোথায়,আয়না কোথায় মা ও ঠিক আছে তো বলো মা ও ঠিক আছে না।

ছেলের কথায় কি জবাব দিবে আব্রাহামের মা বুঝতে পারছেন না। এখন আব্রাহামের শরীরের যেই অবস্থা এতে আয়নার কথা আব্রাহাম কে জানানো ঠিক হবে না। আব্রাহামের মা আব্রাহাম কে কিছু বলবে তার আগেই পিছন থেকে রাজ বলে উঠলো।

আয়না একদম ঠিক আছে।

আব্রাহাম দূর্বল চোখে সামনে তাকাতেই দেখতে পায় রাজ দাঁড়িয়ে আছে। রাজ কে দেখে আব্রাহামের মুখে হাঁসি ফুটে উঠলো। এখন আব্রাহাম আর কারও কথা বিশ্বাস না করলেও রাজের কথা বিশ্বাস করে নিলো ও নিশ্চয়ই মিথ্যা কথা বলবে না।

আব্রাহাম রাজের উদ্দেশ্যে বলল।

আমি কি ওকে একবার দেখতে পারবো।

না তোর আর ওর শরীর এখনো অসুস্থ, ডাক্তার আমাদের এখন তোর সাথেও দেখা করতে না করেছিল। কিন্তু আমরা জোড় করে এসেছি। এখন ওর সাথে কেউ দেখা করলে ওর শরীর আরো অসুস্থ হয়ে যেতে পারে তাই ওর সাথে এখন দেখা না করাই শ্রেয়।

রাজ আব্রাহাম কে কথাগুলো স্বাভাবিক ভাবে বললেও ওর মনে কি ঝড় বয়ে চলেছে তা কেবল রাজ জানে। কিন্তু এখন এ ছাড়া আর কোনো উপায় ও নেই। আব্রাহাম কে এই মুহূর্তে সত্য কথা জানালে ওর শরীর আরো খারাপ হয়ে যাবে তাই ওকে কিছুদিন পর জানানোর কথা ভেবেছে ওরা।
___________________________________
কেটে গিয়েছে দুদিন,এই দুদিনে সকলের বাড়ি হয়ে গিয়েছে যেনো হসপিটাল। রুদ্র ও নিজের বাড়ি ঘর ছেড়ে এখন হসপিটালে পরে থাকে।এতে সিরাতের অবশ্য কোনো সমস্যা নেই।সিরাত খুব ভালোভাবে জানে রুদ্রের জন্য ওর বন্ধুরা ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ।সিরাত ও অবশ্য অনেকবার হসপিটালে যেয়ে এসেছে। কিন্তু মূল সমস্যা হচ্ছে রুদ্রের দাদি।

রুদ্রের দাদি যেনো সিরাত উঠতে বসতে কথা শুনাতে ছাড়ছে না।সিরাতের সকল বিষয়ে ওনার নাক গলানো বোধহয় প্রয়োজন হয়ে পরেছে।সিরাত এখন কিছু বলতেও পারছেনা কারণ রুদ্রের দাদি নাকি দু বার হার্ট অ্যাটাক করেছেন।তাই রুবেল মির্জা সিরাত কে রিকোয়েস্ট করেছেন যেনো সালেহা মির্জা কিছু বললে চুপ করে থাকতে।সিরাত এখন এখান থেকে যেতেও পারছেনা কেননা রুদ্র ওর বন্ধুদের সামনে থেকে ওদের সাহস বাড়ালেও দিন শেষে ওদের অবস্থা দেখে নিজেই যেনো দিন শেষে ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। তখন সিরাত রুদ্রকে সামলায়। নিজের স্ত্রী হওয়ার দায়িত্ব পালন করছে।

কিন্তু এখন যেনো সালেহা মির্জা নিজের সকল সীমা পার করে ফেলেছে।আজ যখন সিরাত এর ক্ষুধা লাগার কারনে সকলের আগে খেতে বসেছিল তখনি সালেহা মির্জা সিরাতের সামনে থেকে খাবার সরিয়ে ফেলে।

সিরাত অবাক হয়ে তাকায় সালেহা মির্জার দিকে। সালেহা মির্জা সিরাতের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলল।

স্বামী কাজ করে না,আর বসেছিস আমাদের আগে খেতে। লজ্জা করে না তোর এভাবে বসে বসে শ্বশুড়ের ঘাড়ের উপর খাচ্ছিস।

সালেহা মির্জার কথা শুনে সাহানারা মির্জা এগিয়ে এসে বলল।

মা কি বলছেন আপনি,সিরাত খাবার খাচ্ছে ওর প্লেট আপনি সরালেন কেনো।সিরাত কে খেতে দিন।আর রুদ্রের বাবার কষ্টে উপার্জন করা খাবার সিরাত খাবে না তো কে খাবে।

তুমি চুপ করো বউমা, রুবেল তোমার স্বামী হওয়ার আগে আমার ছেলে।তাই আমি সিদ্ধান্ত নিবো ওর করা উপার্জন কে খাবে আর কে খাবে না।

সাহানারা মির্জা আর কিছু বলার আগেই সিরাত শক্ত গলায় বলল।

থাক মা আমার জন্য আপনার কিছু বলতে হবে না। দাদির যখন এতই সমস্যা ওনার ছেলের উপার্জিত খাবার খেলে,তাহলে আমি খাবো না।

কথাটি বলেই সিরাত রুমে চলে যায়। সাহানারা মির্জা এত ডাকার পরেও সিরাত আর রুম থেকে বের হয়নি।আর না সারাদিন এক ফোঁটা পানিও নিজের গলা দিয়ে নামিয়েছে।

রুদ্র সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বাড়িতে ফিরেছে। আব্রাহাম কে সামলানো আজ অনেক কঠিন হয়ে পরেছিল। আব্রাহাম শুধু আয়নাকে এক নজর দেখতে চায়। এখন ওকে কি করে আয়নার কথা বলবে ওরা,ওরা তো জানে আয়নাকে কত ভালোবাসে আব্রাহাম।তাই এত মানুষ মিলেও আব্রাহাম কে সামলাতে হিমশিম খেতে হয়।

আজ রুদ্র বাড়িতে ফেরার পর রুমে প্রবেশ করলো।রুমে প্রবেশ করতেই রুদ্রের ভ্রু কুঁচকে উঠলো। কারণ সিরাত এই কদিন রুদ্রের বাসায় ফিরার অপেক্ষা করেছে। এবং রুদ্রের সাথে খাবার খেয়েছে কিন্তু আজ সিরাতের আগে শুয়ে পরা রুদ্রের হজম হলো না।সিরাতের শরীর খারাপ করলো নাকি কথাটি ভেবে রুদ্র এগিয়ে গেল সিরাতের কাছে এবং ওকে ডেকে বলল।

তোমার কি শরীর খারাপ,

সিরাত চোখ বন্ধ করেই বলল।

না ঠিক আছি, তুমি ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে আসো।

সিরাতের কথা শুনে রুদ্র কিছু না বলে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলে চলে যায় খাবার খেতে। রুদ্রের প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে এই দৌড় ঝাপটায় ঠিক ভাবে খাবার খাওয়া ও হয়নি।মাথাও যেনো কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে ওর। রুদ্রের মা ওর জন্য খাবার আনতেই রুদ্র একে বাড়ির সকলের কথা জিজ্ঞেস করলো খেয়েছে কিনা। সাহানারা মির্জা প্রতি উত্তরে বলল।

খেয়েছে,

সবার শেষে রুদ্র সিরাতের খাবারের কথা জিজ্ঞেস করলো।তখন রুদ্রের মা বলল।

ও সকাল থেকে এক ফোঁটা পানিও খায়নি।

রুদ্র খাবার মুখে তুলছিল, মায়ের কথা শুনে ওর হাত থেমে গেল। রুদ্র অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

ও খায়নি কোনো?

রুদ্রের প্রশ্ন শুনে, সাহানারা মির্জা ওর দাদির করা আচরণের কথা রুদ্র কে খুলে বলল।

রুদ্র রাগে কাঁপছে মায়ের কথা শুনে। এবং ওর মাকে উদ্দেশ্যে করে বলল।

এই খাবার যখন আমার স্ত্রীর গলা দিয়ে নামেনি তখন আমারও এই খাবার গলা দিয়ে নামবে না।

কথাটি বলেই রুদ্র হনহনিয়ে বের হয়ে গেল বাড়ি থেকে। রুদ্র বেড়িয়ে যেতেই সাহানারা মির্জা একটি লম্বা শ্বাস ফেলল।উনি জানেন না ছেলের খাবারের সময় কথা গুলো বলে ঠিক করেছেন কিনা। কিন্তু সাহানারা মির্জা এটা খুব ভালোভাবে জানেন রুদ্র যদি সিরাত কে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। তাহলে সিরাতের আত্মসম্মান কারও সামনে কমতে দিবে না।

#চলবে…

#তুমি_শুধু_গল্প_না_আমার_ভালোবাসা
#আমেনা_আক্তার
#পর্ব_৫২

দীর্ঘ এক রাত পেড়িয়ে সকালের সূচনা ঘটলো। আলোকিত হয়ে উঠল চারপাশ।সিরাতের মুখে এসে আলো পড়তেই ও ভ্রু কুঁচকে ফেললো। নিজের দূর্বল শরীর কে টেনে যখনি উঠতে যাবে তখন অনুভব করলো পেটে প্রচণ্ড যন্ত্রণা। ক্ষিদের চটে যে এই যন্ত্রনা হচ্ছে তা বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারছে সিরাত।সিরাত পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখতে পেলো রুদ্র বিছানায় নেই।

সিরাত ভাবলো হয়তো রুদ্র হসপিটালে চলে গিয়েছে।কাল রাতে ক্ষুধার চটে ঘুমিয়ে যাওয়ার কারণে সিরাত বুঝতেও পারলো না রুদ্র যে কাল সারারাত আর রুম আসেনি এবং ও বাড়িতেও ছিল না।

সিরাত দূর্বল শরীর টেনে বিছানা থেকে উঠার চেষ্টা করলো।ওর এখন এখানে বসে থেকে কাজ নেই।আর না সিরাত এত দূর্বল যে ওর উপর হওয়া অন্যায় ও মেনে নিবে।কাল রাগের বসে ও কিছু খায়নি কারন কাল সালেহা মির্জা সিরাতের আত্মসম্মানে আঘাত হেনে কথাগুলো বলেছিল।কাল সিরাত সব চুপচাপ সহ্য করলেও এখন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে আর ও চুপ থাকবে না। যদি প্রতি উত্তর করার পর ওই বুড়ি হার্ট অ্যাটাক এ মরেও যায় তবুও কিছু যায় আসবে না সিরাতের। সিরাতের মানুষের ধার ধারা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছে। শুধু এই বাড়িতে এসে নিজের শশুর শাশুড়ির আদর স্নেহ পেয়ে ওর মন কিছুটা নরম হয়ে উঠেছিল।

এই জন্য আবেগে প্রবণ হয়ে রুবেল মির্জার কথা অনুযায়ী সকল কিছু চুপচাপ সহ্য করে গিয়েছে।সিরাত কখনো নিজের অধিকার না ছেড়েছে না ছাড়বে। প্রয়োজন পরলে ও যুদ্ধ করে হলেও নিজের অধিকার আদায় করে নিবে।এর মানে এই নয় সিরাত বড়োদের সাথে বেয়াদবি করবে বেয়াদবি বিহীন কিভাবে শিক্ষা দিতে হয় সিরাত বেশ ভালোভাবে জানে। কিন্তু এখন মূলত কিছু খাওয়া প্রয়োজন তাও নিজের টাকায় কিনা খাবার।

কথাগুলো ভেবে সিরাত বিছানা থেকে উঠতেই দরজা ঠেলে রুমে প্রবেশ করল কেউ।সিরাত দরজার দিকে তাকাতেই রুদ্র কে বিধ্বস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে যায় সিরাত। এবং ওর মনে খেয়াল আসে কারও কিছু হয়ে যায়নি তো।সিরাত উত্তেজনায় নিজের শরীরের অবস্থা ভুলে আগে বাড়তে নিলেই দূর্বল শরীর নিয়ে পরে যেতে নেই সিরাত তখনি রুদ্র এসে সিরাত কে নিজের বাহু ধরে আগলে নিলো। এবং সিরাত কে হঠাৎ পাজা কোলো নিয়ে বসিয়ে দিল বিছানায়।

সিরাত প্রশ্ন বিদ্ধ নজরে রুদ্রের দিকে তাকাতেই রুদ্র জাপটে ধরলো সিরাত কে এবং অপরাধী গলায় বলল।

সরি বউ, আমাকে মাফ করে দাও।আমি নিজের স্বামী হওয়ার দায়িত্ব ঠিক ভাবে পূর্ণ করতে পারিনি।আমার ব্যর্থতার জন্য তোমার কথা শুনতে হয়েছে। খাবার সামনে নিয়ে অপমানিত হতে হয়েছে। তোমার মুখের থেকে খাবার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।এই সকল কিছু আমার ব্যর্থতা। আমার জন্য তোমাকে কালকে সারাদিন না খেয়ে কাটাতে হয়েছে আর আমি এমন স্বামী তোমার খোঁজ খবর নেওয়ার ও প্রয়োজন বোধ করিনি।

কথাগুলো বলেই রুদ্র সিরাতের দিকে তাকায়।তখনি সিরাত নিজের দূর্বল কন্ঠে রুদ্র কে বলল।

তুমি তোমার বন্ধুদের জন্য চিন্তিত তাই আমার খবর নিতে পারও নি। এবং তাই বাবার সাথে আফিসেও যেতে পারছ না।এতে তোমার কোনো দোষ নেই।

না এতে আমার দোষ আছে,আমি যতই ব্যস্ত থাকিনা কেনো। আমার উচিত ছিল তোমার খোঁজ খবর নেওয়া। আমার উচিত ছিল যেই মেয়ে আমাকে সামলাচ্ছে সেই মেয়ে কেমন আছে সেই সম্পর্কে জানা। আমার উচিত ছিল তোমার সুবিধা অসুবিধা সম্পর্কে খেয়াল রাখা।

কথাগুলো বলে রুদ্র কিছুক্ষণ সিরাতের দিকে তাকিয়ে থেকে সিরাতের উদ্দেশ্যে বলল।

তুমি বসো আমি আসছি,

কথাটি বলেই রুদ্র রুম থেকে বাইরে চলে যায়। এবং ফিরে আসে প্লেটে কিছু খাবার নিয়ে।

রুদ্র খাবারের প্লেট নিয়ে সিরাতের সামনে বসতেই সিরাত নিজের মুখ ঘুরিয়ে নেই। এবং কঠোর কন্ঠে বলল।

আমি খাবো না এই খাবার,

রুদ্র সিরাতের কথায় মুচকি হেসে বলল।

এই খাবার সালেহা মির্জার ছেলের টাকাই কিনা খাবার না।এই খাবার তোমার স্বামীর সারারাত ভোর কষ্ট করে কাজ করার টাকায় কিনা খাবার।এই খাবার খাওয়ার কারণে তোমার কারো কাছ থেকে কথা শুনতে হবে না। এবং আমি ওয়াদা করছি আজকের পর যদি আমার রিকশা চালিয়েও টাকা উপার্জন করে তোমাকে খাবার খাওয়াতে হয় এবং তোমার ভরণ পোষণ করতে হয়। তবুও তুমি তোমার স্বামীর করা রোজগারের খাবার খাবে। এবং তোমার স্বামীর দেওয়া কাপড় পরবে।

রুদ্রের কথা শুনে সিরাত অবাক হয়ে বলল।

তুমি পুরো রাত বাড়িতে ছিলে না, তুমি সারারাত বাড়ির বাইরে কাজ করে আমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছ।তাই তোমার এই অবস্থা। তুমি কিছু খেয়েছ।

সিরাতের কথায় রুদ্র আবার মুচকি হেসে বলল।

আমি এখনো এতটা অপদার্থ হয়নি যে, আমার কাজ না করার কারনে আমার স্ত্রীর সামনে থেকে খাবারের প্লেট সরিয়ে ফেলবে আর আমি বসে বসে খাবার খাবো। যেখানে আমার স্ত্রীর গলা দিয়ে খাবার নামেনি সেখানে আমার গলা দিয়ে কি করে খাবার নামবে।

রুদ্রের কথা শুনে সিরাত আশ্চর্য হয়ে তাকায় ওর দিকে।সিরাত কখনো ভাবেনি রুদ্র ওকে এতটা গুরুত্ব দিবে নিজের জীবনে। রুদ্র ও সিরাত একজন আরেকজনকে খাবার খাওয়াতে লাগলো। রুদ্র ও সিরাত কে একজন আরেকজনকে খাবার খাওয়াতে দেখে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সাহানারা মির্জা।
___________________________________
আব্রাহাম ওর মায়ের পায়ের উপর মাথা রেখে হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে। আব্রাহাম খুব ভালোভাবেই জানে নিজের পায়ের অবস্থার কথা। কিন্তু এ নিয়ে আব্রাহামের সামান্য পরিমাণও কষ্ট হচ্ছে না। আব্রাহামের কষ্ট হচ্ছে আয়নাকে এখন পর্যন্ত না দেখতে পাওয়ার কারনে।ওর ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছে একটু খানি আয়নাকে দেখার আশায়। কিন্তু আব্রাহাম এই কথাটি কাওকে বুঝাতে পারছে না।আর বুঝাবেই বা কি করে আব্রাহাম তো আর জানে না আয়নার অবস্থার কথা।

আব্রাহাম ওর মাকে আবদারের স্বরে বলল।

মা আমাকে এক নজরের জন্য একটু আয়নাকে দেখতে দিও না।আই প্রমিস আমি শুধু ওকে দূর থেকে দেখে চলে আসবো।আমি ওকে একটুও বিরক্ত করব না। শুধু একবার দেখতে দাও না মা। আমার ভালো লাগছে না মা ওকে একবার দেখতে দাও মা একবার।

কথাগুলো বলতে বলতেই ফুঁপিয়ে উঠলো আব্রাহাম।

আব্রাহামের মায়ের আব্রাহামের এই অবস্থা সহ্য হচ্ছে না। আব্রাহামের মা প্রথমে বুঝতে পারছিলেন না কেনো আব্রাহামের বন্ধুরা আয়নার অবস্থার কথা আব্রাহাম কে বলতে না করেছে। কিন্তু এখন আব্রাহামের অবস্থা দেখে খুব ভালো ভাবে বুঝতে পেরেছেন কেনো ওরা আব্রাহাম কে আয়নার অবস্থার সম্পর্কে বলতে মানা করেছেন। আব্রাহাম আয়নাকে প্রচুর পরিমাণে ভালোবাসে এইটা খুব ভালোভাবে ওনি বুঝতে পেরেছেন। সাথে এটাও বুঝতে পেরেছে ওইদিন রাতে আব্রাহাম নেশাগ্রস্ত অবস্থায় আয়নার কাছে মাফ চাওয়ার কথা বলছিলো।

এবং নিশ্চয় আব্রাহাম ও আয়নার মাঝে এমন কিছু ঘটেছে যার কারণে আয়না ওদের বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিয়েছে।ও আব্রাহাম কে নিজের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে।
___________________________________
রাজ বসে আছে আয়নার সামনে আয়নার হাত ধরে।আয়না ওপরের দিকে চেয়ে আছে। আয়নার দৃষ্টি ওপরের দিকে স্থির।রাজ বোনের হাত ধরে আকুল কন্ঠে বলল।

আমার সাথে কথা বলবি না তুই,আমার ওপর এত রাগ তোর।আমি খুব খারাপ ভাই তাই না, আমি তোকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারিনি।আজ আমি যদি তোকে মেলায় একা যাওয়ার অনুমতি না দিতাম তাহলে হয়তো তোর সাথে এরকম কিছুই হতো না। আমার সাথে কথা বল না বোন। আমাকে ভাই বলে ডাক।

রাজ কথাগুলো আয়নার উদ্দেশ্যে বলছে ও রাজের চোখে পানি চিকচিক করছে। কিন্তু ভাইয়ের ব্যাধিত কন্ঠ শুনেও ওর ভিতর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না।রাজ ওর বোনের কাছে যখন আকুল আবেদন করছে তখনি রাজের কাঁধে কেউ আলতো করে হাত রাখলো।রাজ পিছন ফিরতেই সাইরা কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।

সাইরা রাজের কাছে বসে পরে এবং রাজের হাতে হাত রেখে রাজের উদ্দেশ্যে বলল।

তুমি চিন্তা করো না, আল্লাহ চাইলে আয়না খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে। আমাদের আয়নাকে এখন সাহস জোগাতে হবে যেনো আয়না ওর অসুস্থতার সাথে লড়াই করে সুস্থ হতে পারে।

আয়নার কথা শুনে রাজ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে আয়নার কথার প্রতি উত্তরে কিছু বলে না চুপচাপ বসে থাকে। তখনি দরজা খোলার আওয়াজ আসায় সাইরা রাজের হাত ছেড়ে দেয় ও দরজার দিকে তাকিয়ে আয়না ও সাইরার মাকে একসাথে ভিতরে ঢুকতে দেখে।

আয়নার মা সাইরার মায়ের কাছে নিজের দুঃখ প্রকাশ করছে। আয়নার অবস্থায় যে ওর মা কতটা আঘাত পেয়েছে তা ওনার চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
___________________________________
কেটে গিয়েছে একটি সপ্তাহ, আব্রাহামের সকল বন্ধুরা এখন আব্রাহামের কেবিনে মধ্যে আছে। ওদের উদ্দেশ্যে হলো আব্রাহাম কে আয়নার অবস্থার সম্পর্কে অবগত করা।ওরা জানে না আব্রাহাম কি করবে আয়নার অবস্থা সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর। তবুও তো আব্রাহাম কে জানানো প্রয়োজন। কেননা আব্রাহামের শরীর এখন অনেকটাই সুস্থ। আব্রাহাম কে দেশের বাইরে পাঠাতে হবে ওর পায়ের ট্রিটমেন্ট করানোর জন্য।রাজ ও ওর বন্ধুরা এটি খুব ভালোভাবেই জানে আব্রাহাম যেই পর্যন্ত আয়নাকে সুস্থ না দেখবে সেই পর্যন্ত ও কোথাও ট্রিটমেন্ট করতে যাবে না।তাই ওরা এক প্রকার বাধ্য হয়েই আব্রাহাম কে আয়নার কথা জানাতে এসেছে।

রাজ এসে আব্রাহামের কাছে বসে পরে এবং রাজ আব্রাহামের উদ্দেশ্যে বলল।

তুই কি সত্যি আয়নাকে ভালোবাসিস?

রাজের কথায় আব্রাহাম মাথা নিচু করে হ্যাঁ তে মাথা নাড়ে।

আব্রাহামের সম্মতি পেয়ে রাজ আব্রাহাম কে আবার বলল।

আমি সবই জানি আয়না কেনো তোর থেকে দূরে থাকতো। তুই কিভাবে আমার বোনের মন ভেঙ্গে ছিলি।তোর জন্য আমার বোন কত কষ্ট পেয়েছে।

রাজের কথা শুনে আব্রাহাম নিজের চোখ নিচু করে বলল।

ওকে দেওয়া আঘাতের জন্য,আমি আজ পর্যন্ত জ্বলছি।ওর কাছে অনেকবার মাফ চাওয়ার পরেও আমি মাফ পাইনি।ও আমার কথায় এত আঘাত পেয়েছে যে ও আমার চেহারা পর্যন্ত দেখতে চায়না এখন।আমি কি করবো কি করলে ও আমাকে মাফ করবে আমি কিছু জানিনা না।আমি শুধু এতটুকুই জানি যত দিন যাচ্ছে ওকে না পেয়ে আমার শ্বাস নেওয়া ও কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।আমি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি।আমি সত্যি নিজের করা ভুলের জন্য অনেক অনুতপ্ত।আমি চাই আয়না শুধু আমাকে একটি সুযোগ দিয়ে দেখুক। একবার আমাকে মাফ করুক।আমি সত্যি আমার জীবন দিয়ে চেষ্টা করব ওকে ভালো রাখার। ওকে আর ভুল না বুঝার।ওর খেয়াল রাখার।ব্যস শুধু একবার।

আব্রাহামের কথা শুনে রাজ কাঁপা কন্ঠে বলল।

আয়না চাইলেও এখন তোকে আর সুযোগ দিতে পারবে।

রাজের কথা শুনে আব্রাহামের হৃদয় ধক করে উঠলো। এবং আব্রাহাম অবাক কন্ঠে বলল।

কি বলছিস তুই,ও চাইলেও আমাকে সুযোগ দিতে পারবে না কেনো?

কারণ..

#চলবে…