তুলির সংসার পর্ব-০৮

0
105

#তুলির_সংসার
পর্ব-৮

পর পর তিনবার বেল চাপার পরও পিয়ন ছেলেটার দেখা নেই। ছয় সাত বার বেল না বাজালে সে কোনো দিন ও আসবে না। মতিন সাহেবের মেজাজটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। এই অফিসে তাকে কেউ গুরুত্ব দেয় না বললে চলে। সবার ধারনা ওনাকে শুধু শুধু একটা রুম দিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু উনি যে এই কোম্পানী আর তার মালিকের জন্যে কি গুরুত্বপূর্ণ কাজ গুলো করেন সেটাতো এরা জানেনা। ওরা এতো বোকা এতোটুকুও বুঝেনা কোনো কাজ না করলে বড় সাহেবই বা ওনাকে এতো বড় একটা রুম দিয়ে রাখবেন কেনো। পিয়নটা এখোনো আসেনি ওনার খুব চা তেষ্টা পেয়েছে। প্রতি দু ঘন্টা পর পর বেনসনে টান দিয়ে এক কাপ হালকা লিকারের লেবু চা না খেলে ওনার অস্থির লাগে। মদের জন্যে আসক্তি কে যদি মাদকাসক্তি বলা হয় তাহলে চা এর আসক্তি কে কি বলবে। চাসক্তি নাকি চা পানাসক্তি..?

চা না খেলে আর কিছুক্ষনের মধ্যেই তীব্র মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে যাবে। হাজার ওষুধ খেলেও চিন চিন করে ব্যাথা করতেই থাকবে।আবার বেল বাজাবেন ,দরজা খুলে গেলো… ট্রে হাতে নিয়ে পিয়নটা ঢুকলো। স্যার আপনার চা…

জোড়ে একটা ধমক দিতে নিয়েও থেমে গেলেন। বহু বছর আগে উনিও পিয়নের পদেই কাজ শুরু করেছিলেন। তখন শুভ্রর বাবা সাধারন একজন ঠিকাদার। প্রথম অফিস ভাড়া নিয়েছিলেন দু কামরার ছোট্ট অফিস। মালিক কর্মচারী সর্বসাকুল্যে পাঁচজন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত চোখের সামনে তোবারক হোসেন চৌধুরীকে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হতে দেখলেন। সেই গাছে উনিও কম পানি ঢালেন নি। টেবিলের উপরের কাজ গুলো তোবারক সাহেব নিজেই করতেন কিন্তু টেবিলের নিচের কাজের দায়িত্ব ছিলো মতিনের। ঘুষ দিয়ে সরকারি টেন্ডার হাসিল করা থেকে শুরু করে। দুই নম্বর মাল সামান দিয়ে রাস্তা, ইমারত তৈরি করা, এগুলো সব মতিনই দেখতো। এখন চৌধুরী সাহেব অনেক গুলো প্রতিষ্ঠানের কর্নধার। অফিসই আছে ঢাকা শহরে কয়েকটা। এরই মধ্যে একটি অফিসে বিশাল এক রুম দিয়ে রেখেছেন মতিনকে।
এই অফিসের মানুষ যাই ভাবুক না কেনো। মতিন জানে নিজের বউ ছেলে থেকে তোবারক হোসেন মতিনকে বেশি বিশ্বাস করেন।

স্যার

হ্যা

আপনার সাথে একজন মানুষ দেখা করতে আইসে

তুমি বলোনি, আমি তিনটার পর কারো সাথে দেখা করিনা

বলসিলাম স্যার বলতেসে অনেক জরুরি

নাম কি?

জহির

মতিন সাহেব চায়ে চুমুক দিতে নিয়েছিলেন। চমকে গিয়ে ওনার চা ছলকে পরলো গায়ের সাদা শার্টে।

জহির এসেছে শুনে অবাক না হয়ে পারলোনা মতিন।

তোবারক হোসেন বলার পর পরই জহিরকে চাকরির অফার দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন তা প্রায় সাত আট মাস হতে চললো জহিরের কোনো জবাব পাননি।তবে তোবারক হোসেন বলেছিলেন, ধৈর্য্য ধরো মতিন আজ হোক কাল হোক সে আসবেই।

সে ছেলে হঠাৎ এসেছে ঘটনা কি?

স্যার টিস্যু নেন আপনার গায়ে চা পরসে

লাগবে না তুমি যাও তাড়াতাড়ি ওই ছেলেকে পাঠাও

আসসালামু আলাইকুম

ওয়ালাইকুম আসসালাম

সরি আমি এপয়ন্টমেন্ট না নিয়ে এসেছি।
আমার সাথে দেখা করার জন্যে ধন্যবাদ

না ঠিক আছে
বলুন কি বলবেন

জ্বী স্যার
বেশ কিছুদিন আগে আপনার অফিস থেকে চাকরির অফারের একটা লেটার পেয়েছিলাম। লেটারটা পেয়ে একটু অবাক হই। আমার মনে পরছিলো না, ঠিক কবে আপনাদের কোম্পানীতে এপ্লাই করেছিলাম।

এতো ভালো চাকরির অফার গ্রহন করেন নি কেনো?

কোনো একটা কারণে ঢাকায় আর আসতে চাচ্ছিলাম না। তাই অফারটা একসেপ্ট করিনি।

আপনি কি ভেবেছেন ভ্যাকেন্সিটা এতোদিন পরেও থাকবে..?

সেরকম না স্যার তবে যদি সম্ভব হয় অন্য কোনো ভ্যাকেন্সি থেকে থাকলে…। আসলে আমার একটা চাকরির খুব দরকার।

কিছু মনে না করলে, আমি কি জানতে পারি এখন হঠাৎ কি দরকার পরলো যে আপনি আপনার মন পরিবর্তন করলেন

আমার বাবা অতিশয় বৃদ্ধ। কয়েকদিন আগে হার্ট এ্যাটাক করেন। ময়মনসিংহ মেডিকেলের ডাক্তার সাহেব বললেন ঢাকায় এনে এনজিওগ্রাম করাতে। সে জন্যেই ঢাকায় এসেছিলাম। এখন ডাক্তাররা বলছেন ইমিডিয়েট ওপেন হার্ট সার্জারি করাতে হবে।

স্যার আমার শুধু চাকরিটাই দরকার নয়, পসিবল হলে কয়েক মাসের বেতনের এডভান্সও দরকার। খুব বিপদে না পরলে বলতাম না স্যার

জহিরের বোকামিতে মনে মনে হাসলেন মতিন।সব কিছু কি এতো সহজ নাকি। তোবারক হোসেন না বললে তো এমন ছেলেকে উনি চাকরিও দিতেন না।

তবে মুখে বললেন অন্য কথা,
আপনার বাবার অপারেশনের জন্যে কত টাকা দরকার?

হসপিটালের বিল টিল সব মিলিয়ে বললো লাখ পাঁচেক নাকি লাগবে।

ধরুন কথার কথা আপনাকে আমি চাকরি দিলাম, এক বছরের এডভান্সও দিলাম তাও তো আপনার অপারেশনের টাকা যোগাড় হবেনা।

মতিন সাহেব ড্রয়ার খুলে চেক বইটা বের করলেন কলম নিয়ে পাঁচ লিখে কেটে দশ লিখলেন পাশে শূন্য গুলো বসিয়ে সাইন করে চেকটা বাড়িয়ে দিলেন জহিরের দিকে

স্যার এতো টাকা আপনি আমাকে কেনো দিবেন

ছোট্ট একটা কাজ করার জন্যে

মানে বুঝলাম না স্যার

আপনি তুলিকে বলবেন আপনি ওনাকে এখোনো ভালবাসেন। ওনাকে ফিরিয়ে দিয়ে আপনি ভুল করেছেন।

এটা কি শুভ্রর বাবার অফিস..?

জ্বী

আপনার কেনো মনে হলো আমার কথা শুনে তুলি শুভ্রকে ছেড়ে চলে আসবে। ওরাতো এখন সুখে সংসার করছে।

আমার মনে হওয়া না হওয়ায় কিছু যায় আসেনা
আমি যা হুকুম পেয়েছি তাই করছি কাজ হলে হবে না হলে সেটা চৌধুরী সাহেব বুঝবেন।

চাকরির অফারটা পেয়ে আমার একটু খটকা লেগেছিলো।

জহির চেকটা ফিরিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছিলো,
না আমি এটা নিতে পারবোনা
ধন্যবাদ

আরে আরে যাচ্ছেন কোথায় কথা শেষ করি

আমার তাড়া আছে সন্ধ্যার ট্রেনে ফিরে যাবো। টাকার ব্যবস্থা করতে হবে।

আরে মিয়া দেশে গিয়ে এতো অল্প সময় এতো গুলো টাকার ব্যবস্থা করবেন কোথা থেকে।

বাড়ি বিক্রি করে দিবো

আপনাদের বাড়ি বন্ধক দেয়া। বন্ধকের সুদও দিতে পারেনি আপনার বাবা অনেক দিন যাবত। যেকোনো সময় সে বাড়ি ব্যাংক নিলামে উঠাবে

কি বলছেন এসব… আপনি জানলেন কি করে..?

শুভ্রর বাবার নির্দেশে আপনার সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিতে হয়েছিলো।
দেখেন জহির সাহেব আপনাকে আমি সোজা সাপ্টা কথা বলি। এতো দ্রুত পাঁচ লাখ টাকা আপনি কোনো ভাবেই যোগাড় করতে পারবেন না। এটা আপনিও জানেন, আমিও জানি। তার থেকে এই দশ লাখ টাকা নেন, আপনার বাবার চিকিৎসা করান বাকি টাকা দিয়ে বাড়ির বন্ধক ছাড়ান।

আর তুলিকে তো আপনি মিথ্যা কিছু বলছেন না। আপনি তো তাকে এখোনো ভালবাসেন তাইনা..?

এখন চিন্তা করে দেখেন বাবাকে বাঁচাবেন না বাবার আদর্শ নিয়ে পরে থাকবেন। কথাটা বলতে বলতে চেকটা জহিরের হাতে আবার গুজে দিলেন মতিন সাহেব।

#
হাসপাতালে ফিরে এসে তুলিকে দেখে চমকে গেলো জহির। বাবা অনেক দিন পর উঠে বসে হেসে হেসে কথা বলছেন তুলির সাথে।

তুলিকে খুব অন্যরকম লাগছে। অনেক দিন পর দেখেছে এজন্য হতে পারে। পরিবর্তনটা ধরতে পারছে না জহির। বেশ মুটিয়ে গেছে। চুল কেটেছে মনে হয়। চুল কাটলে মেয়েদের অন্যরকম লাগে। চেহারার লাবন্য আরো বেড়েছে। ওর ছোট্ট মুখটাতেও বেশ ফোলা ফোলা ভাব এসেছে। কি অপরুপ ভঙ্গিতেই না হাত নাড়িয়ে চুড়ির রিনঝিন শব্দ করে কথা বলছে। ওর কথা জহিরের কানে ঝর্নার শব্দের মতো প্রশান্তি দিলো। টিয়া পাখি সবুজ রংয়ের একটা শাড়ি পরেছে। এইতো কিছুদিন আগের কিশোরী চন্চল মেয়েটাকে বিয়ের পর খুব সংসারী লক্ষ্মী বউ বলে মনে হচ্ছে।

আসসালামু আলাইকুম
এতোক্ষনে দরজায় দাড়িয়ে থাকা জহিরকে খেয়াল করে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই সালাম দিলো তুলি

বাবার থেকে বিদায় নিয়ে জহির কে বললো।আমাকে কি একটু এগিয়ে দিবেন।

তুমি জানলে কি করে?

বাহ আপনি আপনার ভাল মন্দের কথা বলবেন না বলে কি আমি খোঁজ রাখতে পারবোনা।

তুমি ভালো আছো

হুম অনেক ভালো আছি। শুভ্র খুব ভালো ছেলে। ওর মতো স্বামী পাওয়া ভাগ্যের বিষয়।

আসলেই শুভ্র খুব ভালো ছেলে।

আপনাকে ধন্যবাদ আপনি তোয়াকে বুঝিয়ে বাড়ি ফেরত পাঠিয়েছিলেন।

তোয়ার কি খবর?

ভালো আছে। ওর শশুর শাশুরী আমাদের বাড়িতে এসে কথা বলেছে। এখন ওরা যার যার বাড়িতে থাকবে গ্র্যাজুয়েশনের পর অনুষ্ঠান করে তুলে দিবে।

সেটাই ভালো।

তুমি কি সত্যি ভেবেছিলে তোয়া আমার জন্যে সূবর্ণপুর গিয়েছিলো।

হুম, আমি অনেক বোকা তাইনা?

আমি যখন আপনার সামনে শাড়ী পরে ঘুরে বেড়াতাম, একটু পর পর নানা বাহানায় আপনার রুমে যেতাম। আমি ভাবতাম আপনি বুঝি বুঝতে পারছেন না। আসলে তো আপনি সবই বুঝতেন।

এখন আর এসব বলে কি লাভ তুলি..?

কোনো লাভ নেই তবু আমার খুব কৌতুহল হয় শুধু একটা কথা জানার জন্যে…
ঐ সময়টাতে আপনি কি আমাকে অনেক খারাপ ভাবতেন?

না একদমই না, তোমাকে আমি কোনোদিন ও খারাপ ভাবিনি, ভাবতে পারবোওনা। তুমি আমার দেখা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মেয়ে।

শুভ্রর মতো স্বামী পেয়েও যে তার প্রথম ভালবাসা ভুলতে পারেনা সে শ্রেষ্ঠতো দূরের কথা, ভালো মেয়েও না।

আমার সেরকম মনে হয়না। আমার মনে হয় তুমি শুভ্রকে ভালবাসো। হয়তো ও তোমার সামনা সামনি থাকে দেখে সেভাবে উপলব্ধি করোনা।

উত্তরে চুপ হয়ে গেলো তুলি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো…

মানুষ নামের প্রানীটা খুব অদ্ভুত। জীবন তাকে সহজে যা দেয় তাকে সে দূরে ঠেলে রাখে আর যা পেতে পারেনা তার জন্যেই চোখের পানি ফেলে।

জহির ভেবেছিলো তুলির বিয়ে হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ভুলে যাবে ও পুরোনো সব কিছু। আজ যখন জানতে পারলো বিয়ের এতোদিন পরেও তুলি জহিরকে ভুলতে পারেনি প্রচন্ড অপরাধ বোধ আকড়ে ধরলো ওকে। কেনো যেনো মনে হচ্ছে তুলির ভালবাসা গ্রহন না করে খুব বড় ভুল হয়ে গিয়েছে। ওর ভুলের জন্যে আজ তিনটা মানুষ কষ্ট পাচ্ছে।

কি ভাবছেন এতো গম্ভীর হয়ে। আপনার বাবা বললেন অপারেশনের টাকা যোগাড় করতে গিয়েছিলেন। যোগাড় হলো…?

একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে

আপনি যে নীতিবান, কারো কাছে হাত পাততেও পারবেন না।

যদি কোনোদিন আপন মনে করেন কিছু লাগলে আমাকে বলবেন।

সত্যি কিছু লাগবে না তুলি।

আমাকে কথা দিন যদি শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থা না হয় আমাকে বলবেন

সরি তুলি আমি সে কথা দিতে পারবোনা তবে তুমি চিন্তা করোনা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

আমার তোমার জন্যে চিন্তা হচ্ছে তোমার আর শুভ্রর মধ্যে সব ঠিক আছেতো।

হঠাৎ হেসে উঠলো তুলি।
কেনো আপনার কি মনে হচ্ছে, ইশ তুলিকে ফিরিয়ে দিয়ে ভুল হয়ে গেছে।

আপনি কি ভাবেন আপনি একাই চালাক। এতক্ষন আমি আপনার সাথে মজা করছিলাম। শুভ্র আর আমি খুব ভাল আছি।
আমিতো শুধু, ‘আমি ভালো নেই’ শুনে আপনার রিয়্যাকশন টা কেমন হয় সেটা দেখতে চাচ্ছিলাম

কি দেখলে

আপনি খুব ঘাবড়ে গেছেন। মনে হয় ভাবছেন আমি যদি তোয়ার মতো শুভ্রকে ডিভোর্স দিয়ে আপনার বাড়িতে যেয়ে হাজির হই কি করবেন তখন…
চিন্তা করবেন না সেরকম কিছু করবো না।

জহির তুলিকে বোঝার চেষ্টা করছে আগে মেয়েটাকে সহজেই পড়তে পারতো। এখন ধরতে পারছে না ওর কোন কথাটা সত্যি আর কোনটা নিছক অভিমানে বানানো…
জহিরের কাছে মনে হয় নারীদের মন আসলে মরিচীকার মতন যতই মনে হবে এর কাছাকাছি পৌছে গিয়েছি ততই তা দূরে সরে যায়। এতোদিন ধরে চেনা তুলিকেও আজ বড়ই অচেনা মনে হচ্ছে জহিরের।

রিক্সায় উঠে চলে যাবার সময় হাসতে হাসতে বললো তুলি…

আমি জানি আমার সাথে কথা বলে আপনি ধাঁধায় পরে গেছেন। আমি সত্যি খুব ভালো আছি। আপনার চিন্তা দূর করার জন্যে আপনাকে একটা সুসংবাদ দেই। আমি মা হতে চলেছি। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আর কিছুদিন পর আমার কোল আলো করে আসবে ফুটফুটে এক মেয়ে।

কেনো যেনো তুলির প্রতিটি কথায় বিষন্নতার সুর খুঁজে পেলো জহির।

চলবে…