#তৃষিত_তরঙ্গ —০১
#প্রানেশা_আহসান_শীতল
“ আমি লেফটেন্যান্ট কমান্ডার “মুসাওয়াদ কায়ান” – কিনা এখন নিজের হাটুর বয়সী এক মেয়েকে বিয়ে করবো? অসম্ভব আম্মা…!”
আমেনা বেগম একটু বিচলিত হলো ছেলের প্রত্যাঙ্খানে। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে দৃঢ় গলায় বলে—–
” আমি তোর মা মুসাওয়াদ; আমি তোর ভালো মন্দ বুঝি—!”
” ভালো মন্দ বোঝো সেটা আমিও জানি তাই বলে, অসমবয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে — অসম্ভব আম্মা; আমার বয়স দেখো আর মেয়েটার বয়স দেখো; এটা কখনোই সম্ভব না আম্মু।”
আমেনা বেগম ঢোক গিলে নিজের বিচলিত ভঙ্গি লুকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে—–
” আমি সাবরিহা’র বাবা সফিউলের কাছে কথা দিয়েছিলাম; লোকটা বেঁচে নেই; তাই বলে আমি আমার দেয়া কথা রাখবো না? তুই কি চাস আমি নিমোক হা*রামের কাতারে পড়ি? কথা দিয়ে কথা না রাখার শাস্তি আমাদের ধর্মে কি, তা নিশ্চয়ই বলা লাগবে না!”
মুসাওয়াদ একটু থমকালো; তারপর বলে——– ” কি বলতে চাইছো আম্মা?”
” আমি,, আমি অনেক আগে-ই তোর আর সাবরিহা’র বিয়ে ঠিক করে রেখেছিলাম! হুট করেই সফিউল ভাই মারা যাওয়াতে আমি চাইছি না; কথার কোনো খেলাফ হোক। তুই ক্যাম্প থেকে এসেছিস তিন বছর পর। চলে যাবার পর আবার কবে আসবি তার ঠিক নেই। এখানে আমি একা থাকি এর থেকে যদি তোর উছিলায় আমি একটা সঙ্গি পাই – মানে সাবরিহাকে আমার নিজের কাছে রাখি তাহলে তো খারাপ হয় না।”
” মা তুমি ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করছো!”
” তুই যদি ভাবিস, তাহলে তাই-ই করছি। নিজে তো ক্যাম্পে গেলে খবরই থাকে না। আমারও খবর নিস না। আমার বয়স হয়েছে; আমার কথা বলার জন্যও একটা মানুষ লাগে পাশে! আমার মুখে দিকে তাকিয়ে না হয়—”
” আবারো একই কথা আম্মা।”
আমেনা বেগম থমকালেন তারপর অভিমানে মুসাওয়াদের রুম থেকে উঠে চলে গেলেন। মুসাওয়াদ তাকিয়ে রইলো মায়ের চলে যাওয়া দিকে! মুসাওয়াদের বাবা এয়ারফোর্সে ছিলেন; ও যখন ক্লাস এইটে পড়তো তখন একটা প্লেন দুর্ঘটনায় বাবা মুরসালিন শহিদ হয়েছিলেন। তারপর তো — !
তারপর মা-ই মুসাওয়াদকে আগলে রেখেছে। মুসাওয়াদ যখন প্রথম আর্মিতে এপ্লাই করেছিলো তখন লুকিয়েছিলো আমেনা বেগমের কাছ থেকে। এবং হুট করে অসুস্থ হয়ে যাবার কারণে আইএসএসবি (ISSB) পরীক্ষা দিতে যেতে পারে নি মুসাওয়াদ তারপর অনিচ্ছা সত্ত্বেও নেভীতে এপ্লাই করলো। কারো রেফারেন্স ছাড়াই নেভীতে জব হয়ে গেলো মুসাওয়াদের। প্রথমে যখন আমেনা বেগমকে জানানো হলো – আমেনা বেগমের সে কি কান্নাকাটি।
সে বারবার একই কথা বলছিলো, বাবাকে যেভাবে হারিয়েছে বাবার একমাত্র চিহ্ন হিসেবে মুসাওয়াদকে আমেনা বেগম হারাতে পারবে না। তখন মুসাওয়াদ মাকে অনেক বুঝিয়েছে। মায়ের মন শক্ত প্রকৃতি হলেও ছেলের দিকটায় তিনি ভীষণ নরম। মুসাওয়াদ নেভীতে জয়েন করার প্রায় সাত মাসের মতো মুসাওয়াদের সাথে কথা বলে নি আমেনা বেগম। তারপর মুসাওয়াদ ছুটিতে এসে মাফ চেয়ে বলেছিলো মা যা বলবে তাই করবে শুধু নেভীতে যাতে থাকতে দেয়। আমেনা বেগম তখনও অভিমানে চুপ করে ছিলেন। আর তখন থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় অনেক গুলো বছর এখনো মায়ের আর্তনাদ চোখে ফুটে উঠে। মায়ের কথা চিন্তা একটা একটা সিদ্ধান্ত নেয় মুসাওয়াদ। তারপর লম্বা শ্বাস ফেলে উঠে মায়ের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুটা জড়তা নিয়ে রুমের দরজায় নক করে। দরজায় নক হতেই চোখের পানি মুছে ভারী গলায় আমেনা বেগম বলে—–
” এসো।”
মুসাওয়াদ একটু ঠোঁট চেপে হাসলো। তার মা টাও না; কথায় না মানলে একটুতেই কিশোরীর ন্যায় অভিমান করে গাল ফুলিয়ে কান্নাকাটি করে বসে থাকে। মুসাওয়াদ আর কিছু ভাবলো না; ধীরে এসে মায়ের কোলে মাথা রেখে বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে। এটা মুসাওয়াদের সুন্দর একটা দিক; যদি সে মা’কে কিছু বলতে চায় বা কিছু চাওয়ার থাকে তাহলে সে অনুমতি ছাড়াই আগে মায়ের কোলে শুয়ে পড়ে। আমেনা বেগম ছেলের কান্ডে মনে মনে হাসলেন সেই রাজি হলোই তবে কেনো এতো প্যাঁচায় ছেলেটা!?
মুসাওয়াদ অনেকটা সময় শুয়ে থেকে ধীর গলায় জিজ্ঞেস করে—
” মেয়েটার নাম কি আম্মা?”
” সাবরিহা ইনায়াত।”
শ্বাস ফেললো মুসাওয়াদ তারপর বলে—–
” বাচ্চা একটা মেয়ে!”
” পেলে বড় করে নিবি!”
চোখ বড় করে মায়ের দিকে তাকিয়ে মুসাওয়াদ অবাক গলায় বলে—–
” বাই এ্যনি চান্স তুমি কি ওকে আমার সাথে পাঠানোর পরিকল্পনা করছো?”
” না – না! আমিই পালবো!”
” কিসে পড়ে?”
” এইবার এইচএসসি দিয়েছে। উজ্জল ছাত্রী! ”
গম্ভীর হয়ে যায় মুসাওয়াদের মুখ তারপর বলে —–
” ওর আর আমার বয়স ডিফারেন্স জানো আম্মা?”
” বেশি না বাবা মাত্র তেরো! তোর বাবা আর আমার – ষোলো বছর ছিলো। এটা এমন কিছুই না! মেয়েটা তোর জন্য পার্ফেক্ট আমার উপর ভরসা রাখ বাবা।”
চুপ রইলো মুসাওয়াদ তারপর আবারো সময় নেয়। ততক্ষণে আমেনা ছেলের চুলে হাত বুলাচ্ছিলো। তাতে একটু চোখ বন্ধ রেখে মুসাওয়াদ কিছু একটা ভাবে; যতটা জড়তা ছিলো বাবা আর মায়ের বয়সের ব্যপারে শুনে একটু কমেছে। কিন্তু সাবরিহাকে কখনোই ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাবে না মুসাওয়াদ। এই পুঁচকে মেয়েকে নিয়ে গেলে তার মানসম্মান যাচ্ছে তাই হবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনেকটা সময় চোখ বন্ধ করে জিজ্ঞেস করে—
” বিয়ে কবে?”
আমেনা বেগমের মুখে হাসি ফুটলো। তাই কোনো মতে নিজের হাসি চেপে নিয়ে বলে—–
” আজকে রাতে ঘরোয়া ভাবে; একদম তুলে আনবো! ”
” কিইই—!” —— চেঁচিয়ে লাফ দিয়ে উঠে বসে মুসাওয়াদ; তার চোখ কোটর দিয়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। তারপর হতভম্ব গলায় বলে—–
” তুমি আগে থেকেই সব ঠিক করে রেখেছিলে তাই না মা? তুমি জানে আমাকে কোনো না কোনো ভাবে রাজি করিয়েই ছাড়বে। আম্মা তোমার এই জেদ —!”
আর কিছু বলতে পারলো না মুসাওয়াদ। উঠে বেড়িয়ে গেলো মায়ের রুম থেকে। ছেলের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলেন আমেনা। ছেলেটা যদি একটু মায়ের মন বুঝতো। মেয়েটার প্রতি একটু মায়া হলে, কয়েক মাস পর পর হলেও ছেলে বাসায় ফিরবে, তখন নাহল এক ছেলেটাকে দেখতে পারবেন৷ আর এমন চলতে থাকলে; ছেলের বিয়ে তো দূর তাকে দেখাও আমাবস্যার চাঁদের মতো ব্যপার হবে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো আমেনা। বিয়েটা শুধু হয়ে গেলেই আমেনা বেগম একদম নিশ্চিন্ত!
————
ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই বিছানার উপর একটা সাদা পাঞ্জাবি দেখে মুসাওয়াদ একটু থমকায়। তারপর বুঝতে পারে মা দিয়ে গেছে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তা পড়ে নিয়ে রেডি হয়। এর মধ্যে আমেনা বেগমও সবুজ ও সোনালী মিশেলের একটা শাড়ি পড়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মুসাওয়াদকে ডেকে বলে—–
” এই বাবু হয়েছে তোর! দ্রুত আয়!”
হুট করেই কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে মুসাওয়াদের। ঢোক গিলে কথা বলতে চাইলো তবে গলা দিয়ে একটা শব্দ বের হলো না মুসাওয়াদের। তাই মাথা নিচু করে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো। আত্মীয় স্বজন বলতে তেমন একটা মানুষ নেই আমেনা বেগমের তাই কাউকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলেন না তিনি! মুসাওয়াদ বের হতেই ব্যস্ত গলায় বলে—–
” এই বাবু তুই ড্রাইভ করতে পারবি নাকি আমি উবার ডাকবো!”
মুসাওয়াদ মাথা নাড়িয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে যেতে যেতে গম্ভীর গলায় বলে বলে—–
” আমার হাতে কিছু হয় নি আম্মা; আমিই পারবো, আসো!”
আমেনা বেগম হাসলেন। ছেলেটা ছোট ছোট অভিমান তার ভালোই লাগে। তখন মনে হয় সেই ছোট বেলায় ফিরে গেছেন। আমেনা বেগম হাসলেন তারপর নিজের রুমে যেয়ে মুসাওয়াদের বাবা মুরসালিন সাহেবের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আলতো হাসলো তারপর ধীর গলায় বলে—–
” আমদের মুসাওয়াদ কত বড় হয়েছে গো মুসাওয়াদের বাবা; আজকে ওর বিয়ে। আমি আগে থেকেই সব ঠিক করে রেখেছিলাম। কারণ ছেলেটা বদের হাড্ডি হয়েছে তাই নিজেই সব ঠিকঠাক করে তারপর বলে এখন ধরে বেঁধে বিয়ে করাতে নিয়ে যাচ্ছি। সাবরিহা মেয়েটা ভারী মিষ্টি জানো। মুসাওয়াদকে নাকানিচুবানি খাওয়াবে। ও বলতে তো ভুলে গেছি, মেয়েটা কিন্তু আমার কলেজের স্টুডেন্ট ছিলো আর আমার প্রিয় ছাত্রী। দোয়া করো ছেলেটা একটু শান্তিতে যাতে থাকে। এখন চলি; দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার!”
কথাটা বলেই সালাম দিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে আসে। তারপর বাসা লক করে নিচে নেমে আসে আমেনা বেগম। মুসাওয়াদ গাড়িতে বসে ফোনে থাকা বাবার ছবির সাথেই টুকিটাকি কথা বলছিলো। মাকে আসতে দেখে দ্রুত ফোন লক করে গম্ভীর মুখে বসে থাকে। আমেনা বেগম ধীরে গাড়িতে উঠে বসে। আমেনা বেগম শান্ত ভাবে গাড়িতে উঠে সাবরিহাদের বাসার ঠিকানা বলতেই গাড়ি চলতে শুরু করে সাবরিহাদের বাসার দিকে…।
————
সাবরিহাদের বাসার ড্রইংরুমে চুপচাপ বসে আছে মুসাওয়াদ। ভীষণ নার্ভাস লাগছে মুসাওয়াদের৷ কেমন একটা থমথমে পরিস্থিত! মা যে সেই কখন রুমের ভেতরে ঢুকলো তার আর কোনো খবর নেই; পাশের রুমের পর্দা ধরে কয়েকটা মেয়ে উঁকিঝুকি দিয়ে শুধু মুসাওয়াদকে দেখছে, এতোটা অস্বস্তিতে বোধহয় মুসাওয়াদ আর কখনোই পড়ে নি। এর মধ্যে ছোট একটা মেয়ে দৌড়ে এসে মুসাওয়াদের পাশে বসে। মুসাওয়াদ মাথা তুলে পাশে তাকায়। ছোট্ট মেয়েটা লাল ফ্রক পড়া সাথে তার মাথায় দুটো জুটি বাঁধা একদম পুতুলের মতো দেখতে, মেয়েটা অনেকটা সময় গোলগোল চোখে মুসাওয়াদের দিকে তাকিয়ে থেকে হুট করেই কান্না করে বলে—–” চিস্টার মাচ্চে!”
ভরকে যায় মুসাওয়াদ। আশেপাশে তাকায়৷ কেউই এগিয়ে আসছে না তাই ঢোক গিলে মেয়েটাকে নিজের কোলে তুলে জিজ্ঞেস করে —–
” কি হয়েছে? কাঁদছেন কেনো? কে মেরেছে?”
” চিস্টার।”
চোখ বড় বড় করে পবন তারপর বলে—–
” নাম কি আপনার?”
” চুবাইতা!”
চোখে পলক ফেলে আবারো মাথা তুলে তাকায়। মেয়ে গুলো এখনো পর্দায় ঝুলে আছে অথচ বাচ্চাটা কাঁদছে কেউ আসছে না! বিরক্ত শ্বাস ফেললো পবন তারপর জিজ্ঞেস করে——-
” আপনার সিস্টারের নাম কি?”
” চাবরিয়া!”
— –
চলবে…