#তৃষিত_তরঙ্গ —০২
#প্রানেশা_আহসান_শীতল
সতর্কতা — কপি নিষিদ্ধ
মুসাওয়াদ ঢোক গিললো। বাচ্চা মেয়েটা সবার নামের পিণ্ডি চটকাচ্ছে। তাহলে মুসাওয়াদের নাম কি বলবে? নিজের ভাবনায় বিভোর হয়ে জোর পূর্বক হাসতে চাইলো। এলো কিছুটা। মেয়েটা আবারো থামে তারপর নিজের আধো বুলিতে জিজ্ঞেস করে—–
“ টুমি হাচো তেনো?”
মুসাওয়াদের ঠোট আরেকটু প্রসারিত হলো। সাথে সুবাইতার জুটি ঠিক করে দিতে দিতে বলে—–
“ এমনি! আপনাকে মেরেছে কেনো?”
“ চিস্টার নিপিস্তক দেয় লি।”
এবার বুঝলো। বাচ্চা মেয়েদের এসব নিয়ে একটু আকটু আবদার থাকবেই তাই বলে মারতে হবে? মনে মনে আরো অনেক কিছু ভাবলো। এর মধ্যে সুবাইতা আবারো জিজ্ঞেস করে—-
“ টুমার লাম তি?”
হলো- যা ভেবেছিলো তাই হলো। তবুও ঢোক গিললে ছোট নামটা বললো—-
“ কায়ান!”
“ তায়াল?”
মুসাওয়াদ ঠোঁট চেপে নিজেকে সামলে মাথা নাড়িয়ে বলো—–
“ উহু; মুসাওয়াদ!
“ মুচাদ?”
খুব আগ্রহী হয়ে বললো সুবাইতা। মুসাওয়াদের চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে হলো; — ভাই তুই আমার নাম আর বলিস না; তবুও আমার আকিকা দেয়া নামটাকে ইন্না-লিল্লাহ পর্যায়ে নিস না। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারলো না। কিছুই না। বাচ্চা মানুষটাকে বলবেই বা কি? তার থেকে ভালো চুপ থাকা তাই চুপ হয়ে বসে রইলো মুসাওয়াদ। বাসায় থাকার দরুণ গালে কিছু খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি রাখা হয়েছিলো তাতে সুবাইতা নিজের ছোট্ট হাত বুলাতে বুলাতে আবারো বলে—-
“ টুমি আমাল তি অও?”
থমকালো মুসাওয়াদ! কি হয় এই ছোট্ট প্রাণটার? কি বলবে? আপনি আপনার হবু দুলাভাই? উডবি ব্রাদার ইন ল’? ছিহ্; মুসাওয়াদ ছোট বাচ্চাদের কাছে এসে এসব কি ভাবছিস তুই? কি সব আবোলতাবোল কথা। তবুও মুখে হাসি টেনে স্বাভাবিক গলায় বলে—–
“ ভাইয়া!”
কথাটা শুনে সুন্দর মতো আঙ্গুল নাড়িয়ে নিজের মতো করে মুসাওয়াদের মুখটা নিজের দুই হাতে নেয় সুবাইতা তারপর বলে—–
“ উহু; টুমি আমাল ব্রাডার।”
হাসি পেলো তবুও মাথা নাড়িয়ে বলে—– “ জ্বি; আপনার ব্রাদার।”
এর মধ্যে সাবরিহার চাচা বাসায় ঢুকলো। বয়স্ক লোক দেখে মুসাওয়াদ সুবাইতাকে নিয়েই দাঁড়িয়ে সালাম দেন। লোকটা গম্ভীর মুখে সালাম নিয়ে মুসাওয়াদকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেমন চোখে পর্যবেক্ষণ করে পাশের সোফায় বসলো। তিনি বসতেই একজন বৃদ্ধ হুযুর রুমে প্রবেশ করলো। সাথে সাবরিহার কাজিন আরো কিছু মানুষ। মুসাওয়াদ বুঝলো এখন বিয়ে পড়ানো হবে। তবে বাসাটা এমন শান্ত ও গম্ভীর! তবুও মুখে কিছু না বলে সুবাইতাকে কোলে নিয়েই বসে রইলো। সুবাইতা এটা ওটা বলছে আর কিছুক্ষণ পর পর মুসাওয়াদের গালে হাত দিচ্ছে, দাঁড়ি ধরে টানও পড়েছে কয়েকটা। যদিও একটু অস্বস্তি লাগছিলো তবে বাচ্চাটার সামনে এটা আর এমন কি? মুসাওয়াদ এমন বাচ্চাদের সংস্পর্শে খুব একটা আসে নি তাই আরো বেশি হেজিটেড লাগছে।
ধীর ভঙ্গিতে লাল শাড়ি ও দোপাট্টা পড়া সাবরিহা এগিয়ে এলো। তার চুড়ির, নুপুরের শব্দ সারা রুমে বারংবার ঝংকার তুলছে সারা রুমে সাথে একটা মিষ্টি রজনীগন্ধা ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়লো। মুসাওয়াদ টের পেলো ওই হাটুর বয়সী মেয়েটা রুমে প্রবেশ করেছে তবে কোনো একটা অদৃশ্য জড়তার কারণে সে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। সাবরিহাকে ধীরে তার চাচার পাশে বসানো হলো। মেয়েটা জড়তা অস্বস্তিতে মাথা নিচু করে আছে। সাবরিহা বসাতেই সবাই নড়েচড়ে ওঠে। আর সাবরিহার চাচা হুযুরকে দোয়া পড়তে বলে। সাবরিহা দম আটকে বসে আছে। এক হাতে ওড়না পেঁচিয়ে অনেকটা জড়তা নিয়ে তিরতির পল্লবে চোখ তুলে মুসাওয়াদের দিকে তাকায়। মুসাওয়াদও কি মনে হুট করে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ে যায়। দুজনই কিছুটা ভরকে যায়। সাবরিহা লজ্জিত মুখে আবারো চোখ নামিয়ে নিলো কিন্তু মুসাওয়াদ বোকার মতো সাবরিহার শ্যামবর্ণের মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো। সাথে অবাক হলো — সে মেয়েটাকে অস্বস্তিতে ফেলতে চায় নি। তবে কেনো এমন হলো; কেনো একই সাথে তাকাতে হলো তাদের? ঢোক গিললো! এমন ভাবে কখনোই মুসাওয়াদ ভরকায় নি তাহলে কি হলো? হুযুর নিজের দোয়া পড়ে কণের উদ্দেশ্য বলে—–
“ আপনি মৃত, মুরসালিন কাদির এর একমাত্র পুত্র মুসাওয়াদ কায়ানকে — পনেরো লক্ষ পনেরো হাজার একশো পাঁচ টাকায় বিবাহ করতি রাজি?”
বোকা হয়ে যায় বাসার সবাই। মনে মনে হেসে ফেললো সাবরিহা। ম্যাডামকে মজা করে এই এমাউন্টের কথা বলেছিলো আর ম্যাডামও এটাকে সাংঘাতিক ভাবে সত্যি বিয়ের কাবিন দিয়ে দিলো। আমেনা বেগম এগিয়ে এসে সাবরিহার মাথায় হাত রাখে। সাবরিহা ধীরে মাথা তুলে আমপনা বেগমের দিকে তাকায়; তবে মা সুমি বেগমকে দেখা গেলো না। ঢোক গিললো তাই আমেনা বেগম সাবরিহার মাথায় আলতো হাতে হাত বুলিয়ে বলে—–
“ আমি জানি কাবিনের কথাটা তুই মজায় বলেছিস। কিন্তু আমি মনে রেখেছি; তাই অবাক হবি না। আপাকে খুঁজছিস? আমায় ভরসা রাখ আপা না থাকলেও আজকের পর থেকে তোকে আগলে রাখবো। আমার ছেলে কিন্তু দায়িত্ব নিতে জানে; ঠকবি না। বিশ্বাস করে দেখ একবার…
কথা শেষ করার পূর্বেই মাথা নিচু করে ঢোক গিললো সাবরিহা তারপর চোখ বন্ধ করে আলতো বড় শ্বাস টেনে ধীর গলায় বলে—–
“ জ্বি; কবুল! আমি তাকে আমার স্বামী রূপে কবুল করলাম!”
কলিজা ধরফর করে উঠলো মুসাওয়াদের। কেনো হলো মুসাওয়াদ জানে না। তবে কলিজাটা কেমন নিজের জায়গায় নেই! মেয়েটা তাকে আজকেই সরাসরি প্রথমবার দেখলো অথচ এতো দৃঢ় তার গলার স্বর! সাবরিহা বিয়ে কবুল করতেই সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠে। সাথে সবারিহার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আমেনা বেগম এতো সময়ের বন্ধ রাখা শ্বাস ছাড়লো। এর পর ছেলের দিকে তাকালো। হুযুর এবার মুসাওয়াদকে জিজ্ঞেস করলেন—–
“ আপনি কি সফিউল সাহেবের প্রথম কন্যাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে কবুল করেছেন?
ঢোক গিললো মুসাওয়াদ। তার কোলে এখনো সুবাইতা বসে আছে। কেনো যেনো একটা বড় দায়িত্ব তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার মা, মেয়েটা! মেয়েটার অভিভাবক বলতে বাবার অবর্তমানে স্বামী হিসেবে সে থাকবে আর – এই পরিবারের কিছু হয়ে গেলে তার কোলে সুবাইতা! একটা শ্বাস ফেললো। তারপর ধীর গলায় শুধালো—–
“ আমি তাকে আমার স্ত্রী রুপে কবুল করলাম; সাথে এই পরিবারের আমার স্ত্রীর মৃত বাবার অবর্তমানে তার মা এবং বোনের দায়িত্ব আমি গ্রহণ করলাম।”
গ্রহণ; দায়িত্ব; কর্তব্য! কে ভেবেছিলো সে এটা বলবে? কেনো বলেছে? কিসের কারণে? মুসাওয়াদ জানে না। সে জানে এতো মানুষের সামনে এতো বড় কথা বলা উচিত হয় নি! কিন্তু সাবরিহার চাচার অবিভক্তি মুসাওয়াদের পছন্দ হয় নি; তার তীক্ষ্ণ চোখ তাকে অন্যকিছু ঈঙ্গিত করেছিলো ওই লোকের চাহনী। ঘরের সবাই একটু অবাক হলো। এই কথা শুনে সাবরিহা কান্নায় ভেঙে পড়লো। আহ্; একটা কবুল? একটা কবুলে কতটা শক্তি? সে একটা অভিভাবক পেয়েছে। মাথায় হাত রাখার মানুষ পেয়েছে সাথে নিজের পরিবারের জন্য একটা নিশ্চিন্ত ছায়া। আমেনা বেগমের মুখে হাসি ফুটলো সাথে মনে মনে বললো — মুরসালিন কাদির এর যোগ্য পুত্র; কোনো দায়িত্ব থেকে সে পালায় না। এখন কেমন গর্বিতবোধ হচ্ছে এই রত্নকে নিজের গর্ভে ধরে। ঘরের কোনায় কোনায় ফিসফাস উঠলেও কাজি সাহেব ধীরে বলেন — “ আলহামদুলিল্লাহ বিবাহ্ সম্পন্ন হলো।”
সবাই আলহামদুলিল্লাহ বললো। সাবরিহার চাচা আর বসলেন না। চোখ মুখ কুঁচকে চলে গেলো। মুসাওয়াদ তাকিয়ে তার প্রস্থান দেখলো। অদ্ভুত মানুষ; ভাইয়ের মেয়ে আর নিজের মেয়ের মাঝে পার্থক্য ঠিক কত টুকু হতে পারে? ঠিক কতটা পার্থক্য থাকার কারণে এতোটা হিংসা অথবা অহংকার ও একটা বিয়েতে অথবা একটা কথায় অখুশি হতে পারে মানুষ? মুসাওয়াদ জানে না। তবে এতো দিনের মিলিটারি জীবনে মানুষ চেনার একটা সুক্ষ্ম ধারণা মুসাওয়াদের হয়েছে তাই হয়তো প্রথম ঝলকেই মুসাওয়াদের আগে থেকেই এমন ভাবনা এলো। জীবন — আহ্; তবুও জীবন সুন্দর!
সাবরিহাকে নিজের রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অনেকটা সময়। মুসাওয়াদ এখনো ড্রইরুমে বসে আছে তার কোল থেকে সুবাইতা নামছেই না তবে বিয়ের আগে আর বিয়ের পরে – একটা অদ্ভুত অনুভব হচ্ছে মুসাওয়াদের। এই নিষ্পাপ মুখটায় কিছু একটা আছে! সাথে হুট করেই চোখে ভেসে উঠলো এক শ্যামবর্ণের লাল শাড়ি পড়া জড়তায় মুড়ানো মুখ। আমেনা বেগম এলেন ঠিক তখন সাথে সুমি বেগম। তাকে কোথা থেকে আমেনা বেগম ধরে এনেছে কে জানে। সুমি বেগম এসে মুসাওয়াদকে দেখে হাসলো মুসাওয়াদও তাকে দেখে উঠে দাড়িয়ে সালাম দিলো সুমি বেগম সন্তুষ্ট হলেন বুঝি হাস্যজ্জল গলায় ধীরে বলে—-
“ বাবা; তুমি এখানে না বসে সাবরিহার রুমে যাও। আর সুবাইতাকে আমার কাছে দেও!”
মুসাওয়াদ মৃদু হেসে বলে—–
“ না মা; ও আমার কাছেই থাক।”
বাকিটা বলতে কেমন জড়তা লাগছে। সুমি বেগম হাসলেন। ছেলেটা কি সুন্দর তাকে মা বলে ডাকলো। মনে হচ্ছে কত আগের থেকে পরিচয়। তাই নিজে থেকেই বলে—–
“ ওই যে বাম দিকের রুমটা সাবরিহার। যাও!”
কথাটা বলেই সুমি বেগম আমেনা বেগমকে টেনে নিয়ে গেলো কথা বলার সময়টা পর্যন্ত দিলো না। মুসাওয়াদ একটু অস্বস্তিতে পড়লো তবে সুবাইতাই নিজে থেকে আঙ্গুল দিয়ে একটা রুম দেখিয়ে বলে—-
” ব্রাডার – ওতা চিস্টারের লুম।”
মুসাওয়াদ জড়তা নিয়ে হেসে পা বাড়াল সাবরিহার রুমের দিকে তারপর রুমেসামনে দাড়িয়ে নক করতেই ভেতর থেকে জবাব এলো —–
“ আসুন!”
ধীরে দরজাটা খুলে মুসাওয়াদ ধীর পায়ে রুমে ঢুকলো। সাবরিহা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে আয়নায় তাকিয়ে মুসাওয়াদের রুমে প্রবেশ করতেই গম্ভীর অথচ ভাঙ্গা গলায় বলে—–
“ ওখানেই দাঁড়ান! “
সাথে সাথে দাড়িয়ে যায় মুসাওয়াদ। তারপর প্রশ্নবোধক চাহনি নিয়ে তাকাতেই সাবরিহা আয়না চোখ রেখেই ধীরে বলে—–
“ আপনার জন্য আমার এসএসসির রেজাল্ট যে খারাপ হয়েছি তা কি জানেন? —
কথাটা বলেই সে চেয়ার টা থেকে উঠে দাঁড়ায় তারপর ঘুরে মুসাওয়াদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে—–
“ কে বলেছিলো সেদিন ছুটির সময় গার্লস স্কুলের সামনে আসতে? ওই যে সর্বনাশ করলেন আমার – সেই সর্বনাশ হয়েই আমার জীবনে ঢুকলেন কেনো বলুন তো, আমার সর্বনাশ!?”
—–—
চলবে?
[রিচেক দেই নি ]