তৃষিত তরঙ্গ পর্ব-০৩

0
25

#তৃষিত_তরঙ্গ —০৩
#প্রানেশা_আহসান_শীতল
সতর্কতা — কপি নিষিদ্ধ

“ ওখানেই দাঁড়ান! “

সাথে সাথে দাড়িয়ে যায় মুসাওয়াদ। তারপর প্রশ্নবোধক চাহনি নিয়ে তাকাতেই সাবরিহা আয়নায় চোখ রেখেই ধীরে বলে—–

“ আপনার জন্য আমার এসএসসির রেজাল্ট যে খারাপ হয়েছে তা কি জানেন? —
কথাটা বলেই সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় তারপর ঘুরে মুসাওয়াদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে—–

“ কে বলেছিলো সেদিন ছুটির সময় গার্লস স্কুলের সামনে আসতে? ওই যে সর্বনাশ করলেন আমার – সেই সর্বনাশ হয়েই আমার জীবনে ঢুকলেন কেনো বলুন তো, আমার সর্বনাশ!?”

একটু অবাক হলো মুসাওয়াদ। মেয়েটা কে কি নির্লজ্জ বলে আখ্যা দেবে মুসাওয়াদ কিন্তু কোথাও যেনো একটা জড়তা কাজ করছে। ঢোক গিললো মুসাওয়াদ। সে এখনো বোকা চোখে সাবরিহার দিকে তাকিয়ে আছে। সাবরিহা বিরক্ত নিয়ে বাস ফেলে সুবাইতাকে উদ্দেশ্য করে বলে—–

“ সুবাই বাবু লিপি দেবে?”

“ ডিবুই!”

“ তাহলে এক কাজ করো; এখন ভাইয়ার কোল থেকে নেমে আম্মুর কাছে যাবে তারপর আমি ডাকলো আসবে তাহলে সিস্টারের সব লিপি দিয়ে দেবো!”

“ চত্যি?”

“ হু!”

আর অপেক্ষা করলো না; উল্টো মুসাওয়াদের কোল থেমে যেতে চাইলো। মুসাওয়াদও বোকার মতো নামিয়ে দেয়। সাবরিহা এখনো বোকা মুখে তাকিয়ে থাকা মুসাওয়াদকে দেখলো মৃদু হেসে এগিয়ে রুমের দরজা বন্ধ করতেই মুসাওয়াদ ভাবনা ভাঙ্গে। তবে সে কিছু বলার আগেই সাবরিহা বলে—

“ধন্যবাদ!”

“কেনো?”
কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে মুসাওয়াদ। তা দেখে সাবরিহা একটু হাসলো তারপর বলে—–

“এই যে দায়িত্ব নিলেন। যদিও আপনার একার উপর আমি সব কিছু একেবারে ছেড়ে দেবো না; তবে ওই যে আমি আছি তো; এই কথাটা বলার মানুষের অভাব ছিলো আমাদের। এখন আপনি তো তাও পূরণ করে দিলেন।”

মুসাওয়াদ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়েই সাবরিহার দিকে তাকালো। সাবরিহার গলায় একটা অদ্ভুত কোমলতা ছিল, যেন সে একেবারে নিঃশব্দে মুসাওয়াদকে পরবর্তী কিছু করতে প্ররোচিত করছিল। তবে তার চোখের মধ্যে সেও কিছুটা দ্বিধা অনুভব করছিলো।

” আমি জানি আপনি কিছু বুঝতে পারছেন না! তবে ধৈর্য ধরুন; আমি আপনার থেকে কিছু লুকাবো না! আপনার মায়ের বাছাইকৃত আপনার যোগ্য হবো; এ নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না।”

সাবরিহা খুব সাবধানে, ধীরে কথা গুলো বললো। তার কণ্ঠে কোনো রুক্ষতা ছিল না, বরং এক ধরনের মিনতি ছিল, একটা অদ্ভুত আনন্দ ছিলো; যেন সে নিজের অবস্থান জানাতে চায়, কিন্তু কখনোই চাপ প্রয়োগ করতে চায় না। তবে মুসাওয়াদের সাথে মিশে থাকতে চায়। মুসাওয়াদ কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করলো, তবে তার মুখে কোনো জবাব ছিল না। সাবরিহা তীব্রতা ছাড়া, একধরনের স্থিতিশীল শান্তির সঙ্গে এগিয়ে এসে একদম মুসাওয়াদের সামনে দাঁড়ায় তারপর মুসাওয়াদ মুখ তুলে মুসাওয়াদের চোখে চোখ রাখে। মুসাওয়াদ সাবরিহার থেকে ভালোই লম্বা চওড়া। আর সাবরিহা মুসাওয়াদের বুক সমান তাই তার সাথে কথা বলতে হলে এভাবে মুখ তুলেই তাকাতে হবে। সাবরিহা মুসাওয়াদের চোখে চোখ রেখে একটা ঢোক গিলে মুসাওয়াদের বাম ভ্রুর ওখানে একটা ছোট কাটা দাগ; আর চোখ গুলো, গাঢ় বাদামী; যা দূর থেকে না বোঝা গেলেও এতো কাছে থেকে সাবরিহা বুঝতে পারলো। এই চোখ এই কাঠিন্যে শক্ত গম্ভীর মুখ দেখে সে প্রেমে পড়েছিলো। মুসাওয়াদকে সাবরিহা দেখেছিলো – তাদের স্কুলের সামনে কালো শার্ট পরিহিত শার্টের হাতা ফোল্ড করে একটা সানগ্লাস পড়ে তার কালো গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো খুবই ব্যক্তিত্বের সাথে! সাবরিহার স্কুল জীবনের শেষ ক্লাস ছিলো ওইদিন আর। ছুটির সময় ছিলো – সাবরিহা মুসাওয়াদকে দেখে হাবার মতো তাকিয়ে ছিলো অনেকটা সময়; তারপর যখন দেখলো আমেনা ম্যাডাম এসে মুসাওয়াদের সাথে কথা বলে গাড়িতে উঠেছে তখন আর বুঝতে বাকি নেই এটাই আমেনা ম্যাডামের শক্তপোক্ত কাঠখোট্টা নেভীম্যান ছেলে। আমেনা ম্যাডাম আগে থেকেই সাবরিহার ভীষণ পছন্দ ছিলো। সাথে আমেনা মিসও সাবরিহাকে দারুণ পছন্দ করতো। তারপর তো পরীক্ষা আর পরীক্ষার পর বড় কলেজে চান্স পেয়েও এই কলেজে থেকে গেছে সাবরিহা। মাঝে সামিউল সাহেবের সাথে আমেনা বেগমের একটা পরিচিতি ছিলো তা জানত-ই না সাবরিহা। কিন্তু ততদিনে সাবরিহাও আমেনা বেগমের মন শক্তপোক্ত ভাবে জয় করে নিয়েছিলো আর এরপর হুট করেই সামিউল সাহেবকে আমেনা বেগম নিজে থেকেই বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। বাবা একটু গড়িমসি করেছিলো মুসাওয়াদের বয়স একটু বেশি গহওয়ায় কিন্তু সাবরিহা এদিকে বেহায়ার মতো এসব শুনে জেদ ধরেছে আর বাবাকে বলেছে——

“ আমি বিয়ে করলে ওই পোড়া-খাওয়া ব্যক্তিত্বের নেভী অফিসারকেই করবো।”

বাবা একটু সময় নিয়েছিলো তারপর সুমি বেগম আর আমপনা বেগম এতো বোঝাতে সবাই রাজি হয়ে যায়৷ আর তারপর শুরু হয়; অপেক্ষা – কিসের অপেক্ষা? মুসাওয়াদের ফেরার অপেক্ষা! মাঝে হুট করেই বাবা মারা গেলো। এই সময় টা আমেনা বেগম সাবরিহাকে সাপোর্ট দিয়েছে। তারপর – তারপর তো মুসাওয়াদ আসতেই বিয়ের কেনাকাটা থেকে শুরু করে সব প্রস্তুতি শুরু হয় আর তারপর সময় বুঝে মুসাওয়াদকে ঠিক রাজি করে নেয় আমেনা বেগম! দম ফেললো সাবরিহা তারপর ধীর স্বরে বলে—–

“আমি জানি, আপনি একজন কঠিন মানুষ। কিন্তু আপনি যে দায়িত্ব নিয়েছেন, সেটা আমাকে কিছুটা আশ্বস্ত করেছে। আমি জানি, হয়তো আপনি পুরোপুরি একা সামলে উঠতে পারবেন না, কিন্তু… যতটুকু বলেছেন এতেই আমি কৃতজ্ঞ। সব থেকে বড় কৃতজ্ঞা এই যে আপনি আমার জীবনে এসে আমায় পূর্ণ করে দিলেন!”

মুসাওয়াদ অনেকটা সময় মেয়েটার মুখে তাকিয়ে রইলো; মেয়েটার মুখে ভয় নেই আছে আত্মবিশ্বাস! এতো ছোট বয়সে এতো আত্মবিশ্বাস! একটুখানি হাসলো, কিছুটা অজান্তেই। সে মুখ খুলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু সাবরিহা ফের বললো—–

“ আমি চাই আপনি আমাকে সাহায্য করুন, যেন আমি আপনার যোগ্য স্ত্রী হতে পারি; সাথে সব কিছুইআপনার সামনে প্রকাশ করতে পারি। আমি চাই না যে আপনি কোনো সময় আমার জন্য কোথাও অস্বস্তিতে পড়েন।”

এবার মুসাওয়াদ দৃষ্টি আরেকটু গভীরভাবে হলো। তার চোখে এক ধরনের সম্মান ছিল, তবে সে বুঝতে পারছিলো, সাবরিহা একেবারে অযথা কোন চাপ সৃষ্টি করছে না। বরং সাবরিহা খুব নরম এবং ভদ্রভাবে তার পাশে থাকতে চায়, আর তার কাছে সাহায্য চাচ্ছে। মুসাওয়াদ খানিকটা নরম গলায় বললো——-

“আমার কাছ থেকে আপনাকে যতটুকু সম্ভব সহায়তা করা যায় আমি করবো। আম্মাকে কথা দিয়েছি আমি! তবে, আমারও কিছু প্রশ্ন আছে!”

সাবরিহা একটু হেসে, তাতে যেন তার চোখের কোণে কিছুটা অস্বস্তি ছিল, বললো—–

“ধন্যবাদ। আমি সত্যি আশা করি, আপনি পাশে থাকবেন। আর আপনার সব প্রশ্নের জবাব ধীরে ধীরে পেয়ে যাবেন; একটু ধৈর্য রাখতে হবে! তবে আম্মুর জন্য আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। আম্মু যথেষ্ট সুন্দর একটা মানুষ; তাকে আমি ভীষণ পছন্দ করি। সে আমার মায়ের মতো! এবং আপনার মা; অর্ধাঙ্গ আপনি আমার ভরসা করুন – আপনার মাকে দেখে রাখার দায়িত্ব আমার; আমার পরিবারের দায়িত্ব নিলেন! আমি না নিয়ে যাই কোথায়? আর ওই বাসা, আম্মু আর আপনি – এখম সব আমার! একটা কবুলে আমি সব জিতে নিয়েছি! ছিনিয়ে নিতে পারবেন না।”

সেই মুহূর্তে মুসাওয়াদ যেন উপলব্ধি করলো, যে সাবরিহার মৃদু আর নরম দৃষ্টিভঙ্গি, তার জীবনের কঠিন প্রেক্ষাপটের মাঝে এক অদ্ভুত শান্তি এনে দিতে পারে। তবে সাবরিহা তাকে ধোঁয়াশায় রাখছে। সাবরিহা আগে থেকেই তাকে চিনতো? এখন যদি মেয়েটা ইন্টার কমপ্লিট করে তাহলে তাকে মেয়েটা আরো দুই থেকে তিন বছর আগে দেখেছে। কোন গার্ল স্কুলের কথা বলছে মেয়েটা? মা কি আগে থেকেই মেয়েটাকে চিনতো? বা এমন কিছু যা মা মুসাওয়াদ থেকে লুকিয়েছে?

সাবরিহা এখনো মুসাওয়াদের দিকে তাকিয়ে আছে। হুট করেই সে আবদার করার কণ্ঠে বলে—–

“ আপনার ওই ভ্রুর ওখানের ওই কাটা দাগটা কি আমি একটু ছুঁয়ে দেখতে পারি? একট্টু?”

ভরকায় ছেলেটা। মেয়েটা এতো স্বাভাবিক হচ্ছে কিভাবে? জবাব দিতে পারলো না মুসাওয়াদ তবে সাবরিহা অনুমতির প্রয়োজনবোধ না করেই পায়ে ভর দিয়ে হাত উঠিয়ে মুসাওয়াদের ভ্রুর সেই আকর্ষণীয় কাটা দাগটায় আলতো হাত ছোঁয়ায় তারপর আবার শান্ত মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মুসাওয়াদের দিকে তাকিয়ে আবারো বলে—–

“ আরেকটা আবদার করি? আসলে আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আপনি আমার – মানে আপনাকে আমি বিয়ে করে নিয়েছি!”

মুসাওয়াদের কেনো যেনো হাসি পেলো। এই মেয়েটা কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত খুব বুঝদার এর মতো কথা বলে তো এই বাচ্চাদের মতো আবদার করছে! তাই ধীর স্বরে বলে—–

“ বলুন; চেষ্টা করবো!”

সাবরিহার হাসি চওড়া হলো। সে বললো না হুট করেই মুসাওয়াদ কে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ লুকিয়ে কান্না করে দেয়। হুট করে এমন করায় ভরকে যায় মুসাওয়াদ। সে কি বলবে? কি করবে? মেয়েটা হুট করে কাঁদছে কেনো? ভরকানো গলায় বলে—–

“ এই কাঁদছেন কেনো আপনি? কি হয়েছে? বলুন আমাকে!”

নাক টানার শব্দ শোনা যায় শুধু সাথে মাথা নাড়ায় সাবরিহা তারপর আরেকটু শক্ত করে সেই বাঁধণ যেনো মুসাওয়াদকে ছেড়ে দিলেই মুসাওয়াদ হারিয়ে যাবে। সাবরিহা জানে এইটা একটা হাবলা ও বেহায়ার মতো কাজ তবে মুসাওয়াদকে নিজের করে পাওয়ার আনন্দে যেনো সব হুঁশ জ্ঞান হারিয়েছে। সাবরিহা জানে তবুও আবদারের গলায় বলে—–

“ জড়িয়ে ধরলে এমন ভাবে ধরতে হয় যেনো কেউ পালিয়ে যেতে না পারে! তাই আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরুন তো! যাতে আপনি বা আমি কেউই আর পালাতে না পারি!”

মুসাওয়াদের কি হলো সে জানে না। ওই হাটুর বয়সী মেয়েটার কথাটা বলার সাথে সাথেই নিজের অজান্তে জড়িয়ে ধরে মেয়েটাকে। মেয়েটা কি বেহায়া, বে-লাজ? এসব বলে কি আসলেই আখ্যা দেবে মেয়েটাকে? কিন্তু সে যে রকমের, মেয়েটা এতোটা সহজ না হলে সে কখনোই তার খোলশ ছেড়ে বেড়তে পারতো না। একটা সম্পর্ক সহজ করতে একজন না একজন কে আগে বাড়তে হয়; সহজ হতে হয়। সেখানে মেয়েটা চাইছে সব সহজ করতে তাহলে মুসাওয়াদ একটু সময় দিলে কি আর এমন হবে? একটা চান্স দিয়ে দেখাই যাক! বয়স তো হয়েছে! সাথের সব অফিসাররা বিয়ে করে বাবা হয়ে গেছে সেখানে মুসাওয়াদ? ভাবতে পারলো না মুসাওয়াদ! নিজের ভাবনায় নিজেই বোকা হলো সাথে লজ্জিত হলো ভীষণ; বিয়ে করতে না করতে এসব চিন্তা কেনো আসছে তার মাথায়?! সে তো এতো অভদ্র অসভ্য ছিলো না, হলো কবে থেকে যে এভাবে চিন্তা করছে সে? ঢোক গিললো ছেলেটা। এর মধ্যে কানে এলো সাবরিহার বলা ধীরে স্বরে এক ভয়ংকর অকূল আবেদন—–

“ উইল ইউ গিভ মি এ্য কিস অন মাই ফরহেড?”

——

চলবে?