তৃষিত তরঙ্গ পর্ব-০৮

0
14

#তৃষিত_তরঙ্গ—০৮
#প্রানেশা_আহসান_শীতল
সতর্কতা — কপি নিষিদ্ধ।

“ কাছে আসুন!”

সাবরিহা থমকায় তবুও এগিয়ে আসতেই মুসাওয়াদ সাবরিহার পিঠের দিক থেকে টেনে এনে তার বক্ষে জায়গা করে দেয় ছোট মেয়েটাকে। সাবরিহা প্রথমে ভরকালেও আনন্দে যেনো চোখ থেকে পানি পড়তে চাইলো। মুসাওয়াদ ধীরে সাবরিহার কপালে ঠোঁট ছুইয়ে দিয়ে বলে—– “ আমি আপনার পাশে থাকবো তরঙ্গ! একটু ধৈর্য ধরুন!”

মুসাওয়াদের জবাবে সাবরিহা একদম শান্ত হয়ে যায়। চুপটি করে বুকের মাঝেই নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখে। সময় গড়ায় অনেকটা। মুসাওয়াদ কিছু একটা মনে করতেই ধীরে সাবরিহাকে ডাক দেয়—– “ তরঙ্গ?”

“ উম?” — বলেই বক্ষ থেকে মাথা তুলে শীতল চোখে তাকায় সাবরিহা। মুসাওয়াদ সাবরিহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সাবরিহাকে তাকাতে দেখে নরম গলায় শুধায়—–“ ঘুমচ্ছেন না কেনো? ”

“ আসছে না! ” — মিনমিনে স্বরে এতোটুকু বলে চুপ থাকে সাবরিহা তারপর ফের বলে—– “ আসছে না বললে মিথ্যে হবে, আমার আসলে ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে যতটা সময় আপনি আমার সামনে আছেন ততটা সময় তাকিয়ে থেকে নিজের চোখের তৃষ্ণা মেটাই! তিন-বছর পর এভাবে পাঁচ দিনের জন্য নিজের কাছে রেখে, ঠিক কতটা সময়ের জন্য তৃষিত করে যাবেন কে জানে!”

মুসাওয়াদ মেয়েটাকে যতটা দেখছে ততটা অবাক হচ্ছে! কিন্তু মুখে একটা শব্দ উচ্চারণ করতে পারছে না। সে আসলে ভয় পাচ্ছে, মেয়েটা তাকে এতো ভালোবাসে, সে না হয় সব মানিয়ে নিয়ে নিজের সাথে এই যে মিশিয়ে নিলো; কিন্তু মেয়েটার মতো ভালোবাসতে পারবে তো? নাকি মেয়েটার এতো পাগলামো করা ভালোবাসার সামনে সে হেরে যাবে?

মুসাওয়াদের ভাবনার মাঝে সাবরিহা হাত তুলে মুসাওয়াদের টিশার্টের উপর কেমন ছোট ছোট আকিঁবুকিঁ করতে করতে আদুরে গলায় ডাকে—– “ লেফট্যানান্ট?”

“ হুম! বলুন মিসেস কায়ান?” — ভাবনা থেকে বের হয়ে সাথে সাথেই সহজ গলায় জবাব করে মুসাওয়াদ। তাই সাবরিহা একটু থামে তারপর ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করে——- “ আপনি চাইলে আপনি আমাকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করতে পারেন, আমি আপনার থেকে বয়সে অনেক ছোট!”

ঠোঁট কোণে আলতো হাসি ফুটিয়ে সাবরিহাকে নিজপর সাথে আরেকটু মিশিয়ে নেয় কায়ান! আশ্চর্য বিষয় সাবরিহা এতো সহজ থাকার কারণে মুসাওয়াদের প্রথমে যেমন জড়তা ছিলো তেমন কোনো জড়তা কাজ করছে না। মনে হচ্ছে দুজন দুজনকে কতটা আগে থেকে চেনে! এটাই ভবিতব্য ছিলো। তাই দুইজনই এভাবে মিলেমিশে এতো নরম ও সহজে সব কথা বলতে পারছে! শ্বাস ফেললো মুসাওয়াদ তারপর হাত উঠিয়ে সাবরিহার মুখের সামনে পড়ে থাকা ছোট ছোট চুল গুলো সরিয়ে দিয়ে ধীর গলায় শুধায়—–

“ আমি কোনো বয়স বিবেচনা করে আপনাকে আপনি বলে সম্বোধন করছি না তরঙ্গ। আমার কাছে ‘আপনি’ সম্বোধনটা একদম অন্য রকমের! আর কোথাও যেনো শুনেছিলাম – পৃথিবীতে সম্ভবত সবচেয়ে সুন্দর সম্বোধন হচ্ছে ‘আপনি’! আপানকে আপনি করে ডাকতেই আমি কেমন একটা তৃপ্তি পাচ্ছি! সাথে আপনার প্রতি আমার দেয়া প্রাপ্য সম্মানটাও না হয় বজায় থাকলো!”

অবাক ও মুগ্ধতার মোহজালে বোধহয় পেঁচিয়ে গেলো সাবরিহা তারপর ঢোক গিলে নিজের জড়তা কমিয়ে এনে ফের প্রশ্ন করে—– “ আচ্ছা, আপনি আমাকে তরঙ্গ বলে সম্বোধন ডাকেন কেনো?”

মুসাওয়াদ এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। সাবরিহার চোখে চোখ রাখে গভীরভাবে। তারপর খুব ধীরে, একেবারে মৃদু কণ্ঠে বলে— “ আমরা নীল সমুদ্র রাজ করি – তরঙ্গ! সমুদ্র, তরঙ্গ, ঝড়, অথবা যেকোনো আবহাওয়ার অবনতির পর আঘাতের জন্য আমরা তৈরি থাকি। এসবের মাঝে থেকে সব থেকে আমার প্রতিকূলতার স্রোত ভীষণ পছন্দ। সমুদ্রকে কোথা থেকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়! আর আপনি কি জানেন তরঙ্গ কাকে বলে?”

এতোটুকু বলে থামে মুসাওয়াদ। তারপর হুট করে সাবরিহাকে ছেড়ে ঘুরি উল্টে এসে সাবরিহার মুখোমুখি তাকায়। সাবরিহা ভরকে যায়, মুসাওয়াদের দুই হাত দুপাশে বন্ধী হয়ে আছে সাবরিহা। সাবরিহাকে ঘাবড়াতে দেখে শীতল গলায় ফের বলে—–

“ তরঙ্গ হয় সমুদ্রে। আর সমুদ্রে থাকতে থাকতে, সমুদ্র মানেই আমার অস্তিত্ব— আমার নীলতা, আমার বিশালতা, আমার অস্থিরতা…
তরঙ্গ মানেই সেই নীরব স্পর্শ, যে নাড়ায়, ভাসায়, ডুবায়— আবার জাগিয়েও তোলে।
আপনিও আমার এই নীলচে সমুদ্র জীবনে তেমন এক তরঙ্গ— যে প্রতিবার আমাকে ভিজিয়ে দেবে ভালোবাসায়। আপনি আসবেন, ছুঁয়ে যাবেন… আবার হুট করেই জড়তা নিয়ে ভয়ে কোথাও লুকিয়ে যাবেন। আপনার অভিমানে, আপনার আদরে, আপনার হাসিতে আমি প্রতিবার নতুন করে বাঁচতে শিখবো।
তাই, আপনি ‘তরঙ্গ’। কারণ আপনি আমাকে যেভাবে ভালোবাসেন, এভাবে আমি পারবো কি-না জানি না, তবে এই তরঙ্গ থেমে গেলে, এই সমুদ্রও নিস্তব্ধ হয়ে যাবে…”

মুসাওয়াদের কথা শেষ হয়েছে। সাবরিহার কথার অপেক্ষা করে মুসাওয়াদ। সাবরিহা অবাক ও বিষ্ময়ে নীরবে চেয়ে থাকে মুসাওয়াদের ধূসর জ্বলজ্বলে চোখে। সাবরিহার বুকের ভেতর কেমন এক অদ্ভুত ঢেউ খেলে যায়। ঠোঁট নাড়িয়ে ছোট গলায় কেবল একটা কথাই বলে— “ তাহলে আমিও আপনার নীলে হারিয়ে যেতে চাই লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মুসাওয়াদ কায়ান… আজীবনের জন্য।”

শরীর ভারী হয়ে বিবষ হয়ে এলো মুসাওয়াদের। এই একটা কথায় ঠিক কি ছিলো মুসাওয়াদ জানে না। শরীর ভেঙ্গে নিজের শক্তপোক্ত পুরুষালী শরীরের ভারটা ছেড়ে দিলো ছোট মেয়েটার উপর! সাবরিহার গলায় মুখ রেখে একটা লম্বা শ্বাস টেনে মিনমিনে গলায় মুসাওয়াদ বিরবির করে বলে—– “ আমার এখন মনেই হচ্ছে না, আমাদের আজকে সন্ধ্যায় প্রথম দেখা!”

সাবরিহা এতোসময় উশখুশ করলেও এই কথা শুনে শরীর ছেড়ে দিয়ে মুসাওয়াদের চুলে হাত ঢোবায়। এতোদিন বাসায় থাকায় কিছুটা চাপ দাঁড়ি ছিল তা যেনো গ্রীবাদেশে ভালো মতো বিঁধছে সাবরিহার। তবুও সে ঠোঁট কামড়ে সহ্য করে নিয়ে খুব সাহস নিয়ে মাথায় চুমু খায় সাবরিহা তারপর ধীরে বলে—– “ আপনি আমাকে হয়তো প্রথম দেখেছেন, কিন্তু আমার দিক থেকে প্রথম নয় কায়ান! সহজ হতে চাই আমি যাতে এই পাঁচ দিনে আপনার সাথে মিশে থেকে আপনি ফিরে আসার আগ পর্যন্ত নিজেকে শক্ত রাখতে পারি। এবার আর কাঁদবো না! এবার আপনি আমার। এবার শুধু হাত তুলে দোয়া করবো দ্রুত সসহিহ সালামতে আমার কাছে ফিরে আসুন। এছাড়া আমার আর কিছু চাই না!”

মুসাওয়াদ জবাব করলো না। গ্রীবাদেশে নাক ঘষলো। রজনীগন্ধার মিষ্টি একটা সুবাস আসছে সাবরিহার শরীর থেকে। কেনো যেনো ঘ্রাণটা অকারণেই মুসাওয়াদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে উঠে এলো। সাবরিহাও নীরব হয়ে রইলো বিপরীতে! তবে তার হাত থেমে নেই! আলতো হাতে চুলের ভাঁজে ভেসে বেড়াচ্ছে সে। মুসাওয়াদ চোখ বন্ধ করে রইলো! ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ভারী হতেই সাবরিহা বুঝলো মুসাওয়াদ ঘুমিয়ে গেছে! ঠোঁটে মিষ্টি এক তৃপ্তির হাসি ফুটলো।

আমেনা বেগম যুগের ন্যায় দারুণ স্মার্ট। সাবরিহা যে মুসাওয়াদকে আগে থেকে পছন্দ করতো তা ঠিক মতো বুঝতে না পারলেও শেষের দিকে বুঝতে পারে সে। সাথে মুসাওয়াদ যে জড়তায় ভুগবে তা নিয়েও আমেনা বেগম সাবরিহার সাথে সরাসরি কথা বলে। সাবরিহা প্রথমে একটু লজ্জার আস্তরণে গুটিয়ে গেছিলো পরে ভাবলো, এই লোককে পেতে হলে একটু বেহায়া হতে হবে। নাহলে দুইজন দু’দিকে ভেসে যাবে! সংসারের স ও হবে না। তাই সাবরিহাকেই নিজের স্বভাব থেকে বেড়িয়ে বেহায়া হতে হয়েছে! অনুভূতি জানাতে হয়েছে। তবে মুসাওয়াদ নরম হওয়ায় কেনো যেনো খুব একটা কষ্ট পোহাতে হয় নি। আল্লাহর কাছে অনেক অনেক শুকোরিয়া মুসাওয়াদ নরম ও সহজ হয়েছে। যদিও এমন ঘটনা হয় না। তবে এই দিক থেকে সাবরিহা নিজেকে ভাগ্যবতী ভাবছে! মুসাওয়াদ ঠিক মতো ভালোবাসার স্বীকারোক্তি না দিলেও চলবে… মুসাওয়াদ যতটুকু বলেছে তাতেই সব বলা হয়ে গেছে সাবরিহার কাছে! পুরুষ মানুষ এতো নরম খুব কম দেখা যায়! আসেই মুসাওয়াদকে পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার তার সাথে মুসাওয়াদের এতো সহজ সরল ভাবাবেগে সাবরিয়া নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করছে! এই ভাবেই চলুক, এক সমুদ্রে বিরাজ করা নির্ভীক পুরুষ আর তার প্রিয় তরঙ্গের বোঝাপড়া! ভাবতে ভাবতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় সাবরিহা।

———-

ভোরের মৃদু নরম আলো মুখে পড়তেই চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে সাবরিহা। এতো সকালে আবারো আম্মা পর্দা খুলে দিয়েছে তাই বিরক্ত নিয়ে চোখ বন্ধ অবস্থায়ই নড়তে যেয়ে ভারী কিছুর অনুভব হতেই স্নায়ু টানটান করে, কয়েক ন্যানো সোকেন্ডে ধুপ করে চোখ মেলে তাকায় সাথে মনে পরে যায় সব কিছু! ইশশ! কি একটা অবস্থা। শ্বাস ফেললো, তারপর ঢোক গিলে সারারুমে চোখ বুলায়। রুমের জানলা তাহলে বন্ধ করা ছিলো না তাই বাতাসে পর্দা নড়ছিলো সাথে মৃদু আলোরা এসে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলো এখানে। মুখে হাসি ফুটলো তারপর ধীরে নিজের পানে তাকায়। মুসাওয়াদ সাবরিহাকে ঝাপটে ধরে ঘুমিয়ে আছে। তবে মুসাওয়াদকে দেখে ভরকায় সাবরিহা। এলোমেলো করে আশেপাশে তাকাতেই চোখ যায় বিছানার শেষে এলটা সাদা টিশার্টে, ওখানে অবহেলায় পড়ে আছে। আর মুসাওয়াদ অর্ধ উন্মুক্ত হয়ে সাবরিহাকে চেপে ধরে ঘুমিয়ে আছে! সাবরিহা ভাবলো,
“বাই এ্যানি চান্স সে কি আমায় কোলবালিশ ভাবছে?”

নড়তে চাইলো সাবরিহা সাথে সাথেই মুসাওয়াদ আরেকটু উষ্ণতা খুঁজে ঘুমুঘুমু গলায় বলে—– “ হোয়াই আর ইউ মুভিং সো মাচ? বি ক্লেম তরঙ্গ! ”

ঢোক গিললো সাবরিহা তারপর ধীরে বলে—– “ আপনি যেভাবে ধরে আছেন মনে হচ্ছে আমি পালিয়ে যাচ্ছি!”

মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে ব্যঙ্গ করে মুসাওয়াদ বলে—– ” যদি যান!”

চোখ মুখ কুঁচকায় সাবরিহা তারপর আবারো বলে—– ” যাবো না। ”

” কে জানে! ”

” কোথায় যাবো? আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না মিস্টার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার! ”

আর জবাব এলো না উল্টো আরেকটু উষ্ণতা খুঁজে সাবরিহার ছোটো তনুতে আরেকটু মিশে গেলো মুসাওয়াদ। সাবরিহা ভাবলো থাক একটু মিশে, আছেই কদিন, এসব ভাবতে নিজেও ঘাপটি দিতে নিজেও একই ভঙ্গিতে পরে রইলো মুসাওয়াদের শরীরের সাথে মিশে।

—-
চলবে…
[রিচেক দেই নি]