তৃষিত তরঙ্গ পর্ব-০৯

0
15

#তৃষিত_তরঙ্গ —০৯
প্রানেশা আহসান শীতল

আজকের পরিবেশ যেনো অন্যসব দিনের থেকে শীতল। সাবরিহা জীবনে এমন একটা সকাল বোধহয় আশাতীত ছিলো! সে জানে না এটা আসলেই সত্যি কিনা; তবে সে যাকে ভালোবেসেছে তাকে পেয়েছে! এটা যদি স্বপ্ন হয় তাতে সাবরিহা বাস্তবে ফিরতে চায় না। সব সময়ের জন্য এখানে এভাবে থাকতে চায়! সাবরিহা ঘুমের মাঝে নড়তে চাইলো, ব্যর্থ হয় সে তাই খানিকবাদে নড়েচড়ে উঠে চোখ মেলে তাকাতেই — চোখের সামনে মুসাওয়াদের দেখা পাওয়া যায়। যে কিনা মাথার নিচে হাত রেখে গভীর মনোযোগে সাবরিহাকে দেখছে। মুসাওয়াদের এমন চাহনি দেখে একটু ভীত হয় মেয়েটা তারপর ধীরে জিজ্ঞেস করে—

“ কি হয়েছে? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?”

“ ভাবছিলাম!”

কপাল কুঁচকায় সাবরিহা তারপর জিজ্ঞেস করে—-

“ কি ভাবছিলেন?”

“ ভাবছিলাম। নীল সমুদ্রের তরঙ্গ বেশি সুন্দর নাকি আমার তরঙ্গ!”

লজ্জায় চোখ মুক্ত রক্তাক্ত ভাব হয়ে এলো৷ সাবরিহা ঘুরে মুখ লুকাতে চাইলো তবে মুসাওয়াদের হাতের বন্ধন এতোই শক্ত যে সে নড়তে পর্যন্ত পারছে না। সাবরিহা চলে যেতে চাইছে তা বুঝতে পেরে মুসাওয়াদ সাবরিহাকে আরেকটু টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় তারপর ধীরে ফিসফিসিয়ে বলে—-

“ আমাকে উস্কে দিয়ে এখন পালাই পালাই করছেন কেনো? আপনি এখানেই থাকবেন৷ নো নড়চড়!”

“ উঠতে হবে। অনেক বেলা হয়েছে। আম্মু কি ভাববে?”

“ কিছুই না! মাই মম ইজ ভ্যারি স্মার্ট!”

“ তবুও! আজকে বিয়ের প্রথমদিন! এভাবে সারাদিন থাকলে আম্মুর সামনে যেতে আমার লজ্জা লাগবে!”

ঠোঁট চেপে হেসে এক ভ্রু উঁচিয়ে মুসাওয়াদ ব্যঙ্গ করে বলে—–

“ আপনার লজ্জাও আছে?”

মুহুর্তেই গাল গুলো রক্তাভ ধারণ করে। কানও গরম হয়ে উঠছে। কি বলবে? সে তো ইচ্ছে করেই মুসাওয়াদের সাথে রাত থেকে বেহায়াপনা করছে এখন মুসাওয়াদ তাকে নির্লজ্জ বলছে। তাতে সাবরিহা এমন গুটিয়ে যাচ্ছে! তবুও হার মানলে চলবে না। দুই হাত দিয়ে মুসাওয়াদকে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইলো সাবরিহা আর বললো—–

“ আচ্ছা, আমার লজ্জা নেই। এখন ছাড়ুন! উঠতে হবে!”

“ উহু!”

কথাটা বলেই আরো শক্ত করে ঝাপ্টে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো মুসাওয়াদ। সাবরিহা পড়েছে ভালোই দুরবস্থায়। বালিশের পাশ হাতরে ফোন তুলে ফোন তুলে সময় দেখলো পৌণে নয়টা। একটা শ্বাস ফেললো। সে ভেবেছিলো অনেক বেলা হয়ে গেছে! ফোন রাখতেই মুসাওয়াদ বলে—–

“ আপনি কি বিরক্ত?”

থতমত খায় সাবরিহা। তারপর ভরকানো মুখেই জবাব করে,

“ কো.. কোথায়.. না তো! কেনো কি হয়েছে?”

“ এই যে জাপ্টে ধরছি! ছাড়তে চাইছি না!”

জবাব দিতে পারলো না সাবরিহা। মুসাওয়াদ সাবরিহার মুখের দিকে শীতল চোখে তাকালো। পড়তে চাইলো সাবরিহাকে, হয়তো বুঝতে পারলো। তাই ধীরে বলে—–

“ আপনি নিজে আমাকে লাগামছাড়া – অসভ্য বানিয়েন তরঙ্গ! তারপর আর লাগাম টানতে পাড়িনি!”

কথাটা বলেই সাবরিহার গ্রীবাদেশে মুখ ঢুবিয়ে দিলো। তারপর ধীরে বলতে শুরু করে—–

“ আমি আপনাকে মেনে নিয়েছি তরঙ্গ! ভালোবাসা কিভাবে হয় জানি না। তবে এতোটুকু সময়ে আমি বুঝে গেছি আপনি ছাড়া আমার চলবে না। বলুন তো কি জাদু করেছেন?”

“ আমি-জাদু? আমি কোনো জাদু জানি না!”

থতমত গলায় উত্তর এলো। এতে মুসাওয়াদ হেসে ফেলে নিঃশব্দে। তারপর আলতো ঠোঁট ছোঁয়ায় সাবরিহার গ্রীবাতে। শিরশির করে কেঁপে উঠে সাবরিহা সাথে তার রাখা হাতটা মুসাওয়াদের পিঠে কিছুটা খাবলে ধরে। উন্মুক্ত শরীরে এই একটা উস্কানি যেনো অনেকটা এলোমেলো করতে যথেষ্ট ছিলো মুসাওয়াদকে। মুসাওয়াদ আরো গভীর করলো গ্রীবাদেশের ছোঁয়া। হঠাৎ করে এমন ছোয়ায় যেনো সাবরিহা নিজের অজান্তে উন্মাদ। ছোঁয়া গভীর হতে শুরু করে। মুসাওয়াদ সাবরিহার এমন ছটফট দেখে যেনো আরো বেশি আসকারা পেলো তাই শাড়ির কুঁচিতে হাত রাখতেই, তড়াক করে উঠে সাবরিহা। ফট করে কুঁচিসহ মুসাওয়াদের হাত চেপে ধরতেই মুসাওয়াদ চোখ তুলে তাকায় সাবরিহার দিকে। মুসাওয়াদের চোখে গভীর কোনো চাওয়া, বড্ড নেশালো আর উন্মাদনা সে চোখে। সাবরিহা ঢোক গিললো তারপর মাথা নাড়লো দু’দিকে। মানে না! মুহুর্তেই মুসাওয়াদের হাত নরম হয়ে এলো। চোখের রক্ত শিরা গুলো ভাসমান হলো। সাথে হাতের রগ ও কপালের শিরা গুলো ফুলে ফেঁপে উঠলো। সাবরিহা এখনো শীতল চোখে তাকিয়ে আছে মুসাওয়াদের দিকে। মুসাওয়াদ ঢোক গিলে নিজেকে সামলাতে চাইলো। তাতেই তার গলার উঁচু এ্যাডাম অ্যপেলে চোখ পড়ে সাবরিহার। ভেতর থেকে এলোমেলো হয়ে ছটফটিয়ে উঠে মেয়েটা। তবুও খুব ধীরে বলে,

“ স্যারি লেফটেন্যান্ট! আ’ম নট রেডি ফর দিস!”

কথাটা বলতেই মুসাওয়াদ সাবরিহাকে ছেড়ে দেয়। উঠে বসে লম্বাশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলাতে চাইলো। পারলো কিনা কে জানে। উঠে ঘরে পড়া জুতাটা পড়ে বারান্দার দিকে যেতে যেতে বলে—–

“ আমি বারান্দায় আছি। কিছু প্রয়োজন হলে ডেকে নিয়েন!”

বোকার মতো তাকিয়ে থাকে সাবরিহা। হলো কি এই লোকের। অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ড। উঠে বসে সাবরিহা তারপর শাড়িটা ঠিক করে লাগেজ বের করে একটা শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় শাওয়ার নিতে।

মুসাওয়াদ বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। তারপর রেলিংয়ে হেলান দিয়ে এদিকসেদিক তাকালো। কি একটা ভুল করতে বসছিলো সে। তাকে দিয়ে মনটা হবে সে আশা করেনি! সাবরিহা না থামালে কতবড় একটা ব্ল্যন্ডার হতো ভাবতেই নিজের উপর রাগ লাগছে! লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলে বারবার রাগ দমন করতে চাইছে মুসাওয়াদ। তবে শরীরের ভেতর রাগ যেনো পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলছে এদিকসেদিক। তাই রাগ নিয়ন্ত্রণ করার সব থেকে সহজ পন্থা সে বেছে নিলো – ‘পুশআপ!’

শাওয়ার নিয়ে বের হতেই সাবরিহার চোখ মুখ ছানাবড়া! চোখ মুখে অদ্ভুত বিষ্ময় নিয়ে এগিয়ে এসেব বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। মুসাওয়াদ সাবরিহার পদচারণা শুনেই থেমে গিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে—

“ কি?”

“ কিছু না!”

কথাটা বলেই একধাপ এগিয়ে এসে সাবরিহা মুসাওয়াদকে ছুঁতে চাইলো তবে মুসাওয়াদ একটু ছিটকে সরে গেলো তারপর বলে—-

“ আমি ঘেমে গেছি সাবরিহা! ডোন্ট টাচ মি…!”

সাবরিহা শুনতে চাইলো না! এগিয়ে এসে পেটের দিতে একটা কালো কুন্ডুলির মতো জায়গায় হাত বুলায় তারপর ধীরে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে—-

“ রিসেন্ট?”

জবাব দেবার আগেই সাবরিহা ছলছল চোখে তাকায় মুসাওয়াদের মুখের দিকে। মুসাওয়াদ ভেতর থেকে ভেঙ্গে গেলো। সাবরিহা অকূল চোখে তাকিয়ে আছে। তাই ছোট করে জবাব করে—–

“ হুম!”

“ কবে হয়েছে এসব? সত্যি বলুন তো কি হয়েছে?”

ভীত সে মুখাবয়ব। মুসাওয়াদ নিজের দুহাতের আঁজলায় নিয়ে সাবরিহার চোখে চোখ রাখে তারপর ধীরে বলে—-

“ শান্তিতে সংগ্রামে সমুদ্রে দুর্জয়!”

কথাটা বলেই আরেকটু দূরত্ব কমিয়ে এনে সাবরিহার কপালে চুমু খায়। সাবরিহা চোখ বন্ধ করে ফেলে। মুসাওয়াদ সরে এসে বলে—-

“ আমি ছুটিতে আসিনি সাবরিহা। মাকে দেখতে এসেছি! আর আসায় আপনাকে পেয়ে গেছি! একটা দিনের পার্থক্য কিন্তু মনে হচ্ছে আমি আর আপনি এক সাথে অনেকদিন আছি।”

কথাটা বলেই লম্বা শ্বাস ফেলে ফের বলে—–

“ আপনি একজন দেশরক্ষা কর্তার স্ত্রী! আমরা সমুদ্র রক্ষা করি! সেখানে মনে হতে পারে সমুদ্রে এমন কি আছে? আছে অনেক কিছুই আছে! পানি… পানি এক নাম জীবন তো এক নাম কেড়ে নিয়ে দিতে পারে মৃত্যু! একজন ডিফেন্স অফিসারের অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে ভীষণ শক্ত থাকতে হবে, শক্ত রাখতে হবে যেকোনো খবর শোনার জন্য! এই চোখের পানি ভীষণ দামি সাবরিহা। যখন তখন যার তার সামনে দেখাবেন না। চোখের পানি মানুষের দুর্বলতা। আর দুর্বল মানুষকে অন্য মানুষরা ভাঙ্গতে বেশি ভালোবাসে।”

লম্বা শ্বাস ফেলে ঢোক গিললো তারপর আবারো বলে—–

“ লাস্ট মিশনে ওখানে একটা গুলি লেগেছিলো। অবস্থা অপ্রত্যাশিত ভাবে খারাপ ছিলো তাই আমাকে ঢাকাতে নিয়ে আসা হয়েছিলো সিএমএইচ ছিলাম উনিশ দিন। তারপর খুব প্যারা নিয়ে ছুটিতে আম্মুকে দেখতে এসেছি! আর এসে আপনাকেও পেয়ে গেলাম।”

কথাটা শেষ হতেই সাবরিহা আবারো শুধায়—–

“ আম্মু জানে না?”

“ নাহ্! আপনিও বলবেন না।”

“ আমি আপনার সাথে যেতে চাই মুসাওয়াদ!”

থমকায় মুসাওয়াদ। তারপর ঢোক গিলে জবাব করে—–

“ আমি বলেছি তো তরঙ্গ; আমায় একটু সময় দিন! একটু ধৈর্য ধরুন!”

কথাটা বলেই সাবরিহাকে ছেড়ে মুসাওয়াদ ওয়াশরুমের দিকে চলে যায়। রেখে যায় হতবাক সাবরিহাকে। শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে বিছানায় যেয়ে থম মেরে বসে।

মুসাওয়াদ কেবল গোসল করে বেড়িয়েছে। সাবরিহা বিছানার উপর গোলাপী রংয়ের একটা শাড়ি পড়ে বসে লাগেজ থেকে কিছু বই পত্র নামাচ্ছে। এদিক থেকে সাদা রংয়ের ব্লাউজটা চুলের পানিতে ভিজে একাকার সেদিকে ম্যাডামের খেয়াল নেই। মুসাওয়াদ চোখ সরিয়ে আয়নার সামনে যেয়ে দাঁড়িয়ে চুলে হাত ঢুবিয়ে এদিক সেদিক ঠেলে দেয় তারপর আয়নায় চোখ রেখেই গম্ভীর কণ্ঠে বলে——-

‘ তরঙ্গ?’

সাবরিহা ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে মিষ্টি গলায় বলে,

” বলুন!”

” আমার চুল গুলো মুছে দিন।”

মুখে হাসি ফুটলো সাবরিহার। সে ঘুরে বসে বলে—-

” আপনি বিছানায় এসে বসুন। আপনি যে লম্বা আমি নাগাল পাবো না। এর থেকে ভালো আপনি এখানে এসে বসুন।”

থুঁতনিতে একটু চুলকে পিছনে ফিরে তাকায় মুসাওয়াদ। তা দেখে সাবরিহা আবারো বলে,

” কি হলো? এদিকে আসুন!”

মুসাওয়াদ এগিয়ে এসে বিছানায় বসতেই সাবরিহা টাওয়াল তুলে মুসাওয়াদের চুল মুছতে শুরু করে। মুসাওয়াদ ঠোঁট চেপে হাসে। ভালোই লাগছে। হুট করেই মুসাওয়াদ চোখ খুলে তাকিয়ে বলে,

” এডমিশন কোথায় নেবেন ভেবেছেন কিছু?”

” না!”

” প্রস্তুতি নিচ্ছেন?”

” না!”

“ তাহলে এই বই গুলো কিসের? যা লাগেজ থেকে বের করলেন? আমি তো ভাবলাম ভর্তি পরীক্ষার হয়তো—!”

কথাটা বলে মুসাওয়াদ বই নেবার আগেই সাবরিহা ঝাপিয়ে বইগুলো নিজের সাথে আড়াল করে নেয়! এতে মুসাওয়াদ কপাল কুঁচকায় তারপর বলে—-

“ কিসের বই ওটা? কি লুকাচ্ছেন? দেখি?”

সাবরিহা মাথা নাড়ালো। অর্থাৎ সে দেখাবে না। তাই মুসাওয়াদ কপাল কুঁচকে গম্ভীর গলায় ডেকে উঠে —–

” তরঙ্গ?”

সাথে সাথেই সুরসুর করে হাতের দুটো বই মুসাওয়াদের দিকে এগিয়ে দেয়। মুসাওয়াদ বইটা হাতে নিয়ে কিছু সময় তাকিয়ে বলে—–

” পড়ালেখা বাদ দিয়ে তাহলে এসব পড়ছেন, ছিহ্; অশ্লীল মেয়ে!”

চলবে!
[রিচেক দেই নি]