তৃষ্ণা তব নাহি মেটে পর্ব-০২

0
7

#তৃষ্ণা_তব_নাহি_মেটে
#পর্ব২
#রাউফুন
ইচ্ছে খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে ভার্সিটির পিছনের দিকে পুকুরপাড়ে চলে গেলো। পুকুরের কাছাকাছি গাছগাছালিতে ঠাসা জায়গাটা সাধারণত অনেকের কাছে অবহেলিত। অন্ধকার আসতে শুরু করেছে, সূর্য ডোবার সময়, আর এই সময়টাতে কেউ এখানে আসতে চায় না। সবাই তাদের নিজ নিজ কর্মব্যস্ততায়, কেউ এখানে আসবে না বলে, জায়গাটা একদম নির্জন। ইচ্ছে একা বসে খাবার খাচ্ছিলো, মনটা ভারাক্রান্ত, শরীরেও কোনো শক্তি ছিল না। খাবারটা তৃপ্তি সহকারে মুখে পুরে, সে সূর্য ডোবার অপেক্ষায় ছিল, যেন সব কিছু একসাথে চলে যায়, কিছু কিছু মুহূর্ত কখনো যেন না আসে।

হঠাৎ সে দুই হাতে মুখ ঢেকে কাঁন্না করতে শুরু করলো। তার হৃদয় ভেঙে গেছে, বেদনাগুলি একে একে হালকা বাতাসের মতো তার মধ্যে ঢুকে গেছে, সে যেন আর কোনো কিছুতেই স্থির থাকতে পারছে না। কিছুক্ষণ চুপচাপ কাঁন্নার পর, ইচ্ছে পুকুরে ঝাঁপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। সে নিজের জীবনের সংকট থেকে মুক্তি চাইল। পুকুরের পানিতে মিশে যেতে চাইল যেন নিজেকে তাতেই বিলীন করে দেবে।

তখন, দূরে দাঁড়িয়ে থাকা জুহাইর সেই দৃশ্য দেখলো। তার পিলেটা চমকে গেলো, ইচ্ছে পানিতে ঝাঁপ দিতে দেখে তার পক্ষে আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হলো না। কিন্তু ততক্ষণে ইচ্ছে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে ফেলেছে। ইচ্ছে তখন হাবুডুবু খাচ্ছিলো, পানির মধ্যে ডুবে যাচ্ছিলো। কোনো না ভেবে দ্রুত জুহাইরও ঝাপ দিলো। সাতরে গিয়ে তাকে তুলে নিয়ে এল পাড়ে। ঘটনা এতো দ্রুত ঘটেছে যে মনে হচ্ছে যেনো সে স্বপ্ন দেখছে। একটা ঘোরের মধ্যে সবটা ঘটছে৷ উপরে উঠানোর পর ইচ্ছের অল্প নড়াচড়া করছে। স্টোমাকে পানি ঢুকে গেছে। জুহাইর ভীষণ সংকোচে ইচ্ছের পেট চেপে পানি বের করার চেষ্টা করলো। ওর কালো কুচকুচে বোরখা শরীরের সঙ্গে চিপকে রয়েছে৷ পাঠকাঠির মতো শুকনো নাজুক দেহ মেয়েটার। বোরখা শুকনো থাকা অবস্থায় তা বোঝা যাই নি। মনে হয়নি সে এতোটা শুকনা।

“আপনি, আপনি ঠিক আছেন?” জুহাইর তার অস্থিরভাবে গলা খুলে কথা বললো। কিন্তু ইচ্ছে কোনো কথা বললো না, সে শুধু ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিলো।

জুহাইর আবারও চেষ্টা করলো, তার পেটে চাপ দিয়ে পানি বের করার জন্য। এবার, একটু কথা বলে উঠলো, “ও-ওয়াক!”

মুখ থেকে গলগল করে পানির ফোয়ারা বেরিয়ে এলো। ইচ্ছে পিটপিট করে চোখ মেলে অল্প।
“এখানে কি করছেন আপনি? আমাকে ছাড়ুন, আমার বাঁচার মতো শেষ অবলম্বন টুকুও হারিয়ে গেছে। আর বাঁচতে চাই না।”

ইচ্ছের একটু আধটু জ্ঞান ফিরে পেলো। যখন পুরো টা বুঝলো তখন সে ছিটকে সরে গেলো জুহাইরের থেকে। নিজেকে ধাতস্থ করে সেখানে থাকা গাছের হেলান দিয়ে ধীরে ধীরে মাথা তুলে জুহাইরের দিকে তাকালো।

“ক…কেন এমন করলেন আপনি?” জুহাইর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, সারা শরীর থেকে পানি চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। দুজনেই ভেজা অবস্থায় সোজা হয়ে বসলো।

ইচ্ছে ধীরে ধীরে মুখ খুললো, হালকা শ্বাস নিয়ে বললো, “আমি… আমি আর পারছিলাম না সহ্য করতে। ভার্সিটিতে সবাই আমাকে গরীব বলে অপমান করে। আমি ফার্স্ট ইয়ারে নতুন, কাউকেই চিনতাম না, কিছুই জানতাম না। তারপরেও খরচ কমানোর জন্য টিউশন করায়, দাদির চিকিৎসা করতে টাকা পাঠাই। ছোটো বেলায় আমার বাবা মা এক্সিডেন্টে মা’রা যায়। এরপর দাদির কাছেই মানুষ আমি। অনেক কষ্টে পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েছি। কিন্তু আমাকে এখানে কেউ-ই টিকতে দেবে না বুঝতে পেরেছি। হলে সীট পেয়েও আমি কোনো রকম সুবিধা ভোগ করতে পারিনি। বিকেলে যারা আমাকে তিনজন অপমান করছিলো ওরা আমার রুমমেট। শুরু থেকেই তারা আমাকে পছন্দ করে না। কথায় কথায় অপমান, লাঞ্ছনা সহ্য করে আসছি। খাবারটা অব্দি ওরা আমাকে ঠিক ভাবে খেতে দেয় না। ইভেন গায়ে হাত অব্দি উঠিয়েছে ওরা। সবকিছুর সঙ্গে লড়াই করে হলেও আমি মানিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু, এক সপ্তাহ আগে আমার বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন আমার দাদিও মারা গেলেন। এখন আমি একদম একা, কেউ নেই, না পরিবার, না বন্ধু।”

ইচ্ছে এবার তার চোখে জমে থাকা অশ্রু মুছে দিয়ে আরো বললো, “আমি মনে করেছিলাম, আমার আর কোনো আশা নেই। সবাই আমাকে অবজ্ঞা করে, একে একে সবাই চলে যাচ্ছে… আমার কাছে জীবনের কোনো মানে নেই। কখনো তো ভালো খাবার কপালে জোটেনি তাই, আমি ভেবেছিলাম, শেষবারের মতো ভালো খাবার খেয়ে শেষ করে দেবো নিজেকে।”

জুহাইরের চোখে এক ধরনের সহানুভূতি ফুটে উঠলো। সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইচ্ছের দিকে তাকাল। তারপর হালকা স্বরে বললো, “আপনি যখন এত কষ্টেই আছেন, স্যারদের জানালেন কেন?”

“আমার কথা স্যাররা বিশ্বাস করবে কেন? ওরা আমাকে বলেছে যদি আমি স্যারকে কমপ্লেইন করি তবে ওরা আমাকে ভার্সিটিতে টিকতে দেবে না। ওরা বড়লোক বাপের পয়সাওয়ালা মেয়ে। ওরা একটা আলাদা পাওয়ারে চলে। সেখানে আমার মতো চুনোপুঁটিকে ওরা গলা টিপে শেষ করে ফেলার ক্ষমতা রাখে। তাই ওদের সঙ্গে লাগতে যাইনি।”

জুহাইর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনে পড়ে যায় নিজের শুরুর দিকের লড়াই। কিভাবে ওরা মাথা ন্যা’রা করে দিয়েছিলো সিনিয়ররা। ওকে কিভাবে র‍্যাগ করেছিলো। কি অসহনীয় ছিলো সেসব। ও বিপদে পড়লেই শিপা ওকে বাঁচাতো সিনিয়রদেএ হাত থেকে। সেসবের জন্যই মূলত জুহাইর শিপাকে মন দিয়েছিলো। কিন্তু আজ যখন জানলো শিপা ওকে জাষ্ট ইউস করেছে তখন হৃদয় টাই ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। কই এতো ব্যথা বুকে চেপে রেখেও তো ও এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। জীবন থেকে পালাতে চায়নি। অবশ্য মেয়েরা দূর্বল প্রকৃতির হয়। সহজেই ভেঙে পড়ে। সে শ্লোথ পায়ে এগিয়ে গেলো ইচ্ছে নিকট। বললো,

“ম’রে গিয়ে নিজের জীবনকে হারিয়ে দিচ্ছিলেন? নিজেকে, নিজের জীবনকে আরও একটা সুযোগ দেওয়ার কথা মাথায় আসেনি? সবার জীবনে কষ্ট থাকে, আপনার চাইতেও অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করছে মানুষ। তারা কি নিজের কাছে হেরে গিয়ে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে? তারা বাঁচার জন্য কতটা তীব্র ভাবে লড়াই করছে জানেন? জীবনটাই তো লড়াই করার জন্য তৈরি। তাছাড়া আপনাকে দেখে তো মনে হয় আপনি বেশ পরহেজগার নারী! আত্ম’হত্যা যে মহাপাপ তা কি জানেন না?”

ইচ্ছে কিছু বললো না, চোখ তুলে তাকানোর মতো সাহস হলো না৷ অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছিলো হৃদয়। আল্লাহর কাছে মনে মনে ক্ষমা চাইতে লাগলো৷ সে জীবনের কাছে আর কখনোই হেরে যাবে না। সত্যিই তো সে বিরাট একটা ভুল করতে যাচ্ছিলো। যখন ও মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখছিলো তখন অনুভূত হচ্ছিলো বাঁচার জন্য আর একটা সুযোগ যদি সে পায় তবে আর কখনোই এমন কিছু করবে না। বাঁচার জন্য ছটফট করছিলো কেবল। বেঁচে যাওয়াই নতুন কিছুর চমক অনুভূত হচ্ছিলো হৃদয়ে, যেন কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছে। তার মনে জুহাইরের কথা গেঁথে গেলো, সেই অনুকম্পা, সেই মনোযোগ—যা সে কখনো প্রত্যাশা করেনি।

“দয়া করে, আর এমন কিছু করবেন না। আপনার জন্য তো পৃথিবীটা শেষ হয়ে যাবে না, পৃথিবী চলবে নিজ গতিতে, নিজ নিয়মে। মনে রাখবেন, কোথাও না কোথাও, কেউ না কেউ নিশ্চয়ই আপনার জন্য আছে। দুঃখের পরেই তো সুখের দেখা মিলবে। শুধু আল্লাহর উপর ভরসা হারাবেন না৷ ধৈর্য্য ধরুন। আর যদি প্রয়োজন হয়, আমি আপনার পাশে আছি। যেকোনো প্রব্লেমে আমাকে স্মরণ করবেন। এই অধম হাজির হয়ে যাবো।”

ইচ্ছে একবার চুপ থেকে মাথা নেড়ে জবাব দিলো, “জ্বী, আচ্ছা।”

“নাম কি আপনার?”

জুহাইরের প্রশ্নে অল্প তাকালো ইচ্ছে। বললো,“ ইচ্ছে খন্দকার! আর আপনার?”

“জুহাইর, জুহাইর সিকান্দার!”

এরপর ঘিরে ধরলো একরাশ নিরবতা। ইচ্ছে মাথা নিচু করে উঠে দাঁড়ালো, তার চোখে আরেকবার অশ্রু জমে আসছিলো। চারপাশে অন্ধকারে ছেঁয়ে আসছে। চারপাশে ঝিঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। অপরিচিত একটা লোক তাকে এভাবে সাহায্য করলো? ইচ্ছে অবাক হয়। ভার্সিটিতে ভর্তির পর তো কেউ-ই কখনো ওকে সাহায্য করেনি। না একটা বন্ধু জুটেছে ক্লাসে, আর না ভালো ব্যবহার। জুহাইরের কথা গুলোর মাঝে এক ধরনের সান্ত্বনা ছিল, কিন্তু তার ভেতরে এত দীর্ঘ সময়ের যন্ত্রণার দরুণ কোনো শান্তি আসছিলো না। সে যেন আকাশের নিচে একা, মেঘের মতো ঘুরপাক খাচ্ছিলো এদিক থেকে সেদিক। একবার ভাসছিলো তো একবার মিলিয়ে যাচ্ছিলো।

“আপনি বললেন না আমাকে দেখে পরহেজগার মনে হয়? আমি কিন্তু তা নয়। আমার ইমান বড্ড দূর্বল। তা না হলে এতো অল্পতে ভেঙে পড়তাম না। এই যে আপনার সঙ্গে এতো কথা বলছি এটাও তো না জায়েজ। কিন্তু কথা বলতে হচ্ছে। আপনি আমার জন্য গায়রে মাহরাম। আমার একটা মনোবাসনা ছিলো যে আমি কখনোই কোনো পুরুষ মানুষের সঙ্গে কথা বলবো না। এমন কাছে অব্দি ঘেঁষবো না। অথচ আজ, একটা অপরিচিত, গায়রে মাহরাম আমাকে স্পর্শ করেছে, পানি থেকে তুলেছে। এমন এমন স্থানে স্পর্শ লেগেছে যার হকদার কেবলই আমার স্বামীর ছিলো। নিজের প্রতি এতো ঘেন্না হচ্ছে। আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুন।”

খানিক থেমে ইচ্ছে বললো,“আমি সবসময় নিজেকে বলতাম যে, সব কিছু সামলে নিতে হবে, আমাকে শক্ত হতে হবে। কিন্তু আমি তো কোনো শক্তি পাচ্ছিলাম না। কোথাও না কোথাও নিজের কাছে, নিজের মনোবলের কাছে হেরে যাচ্ছিলাম। বিশ্বাস করুন, এমন কিছু করার কথা ভাবিওনি কখনো। কি যে হলো আমার।“

এখনো কাঁপছিলো ইচ্ছের গলা। কন্ঠে এক ধরনের হতাশা, এক ধরনের অনিশ্চয়তা নিয়ে বললো,“ রোজ, রোজ অপমান, দাদির ওষুধের টেনশন, দিনের পর দিন খাবার দাবারের কষ্ট, এমন সব কিছু, একে একে আমার কাছে বড় হয়ে উঠছিলো, দূর্বল হয়ে পড়ছিলাম। কত দিন আমি নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে, আমার মতো ছোটখাটো একটা জীবনে কিছু না কিছু একটা ঘটবে, বহু লড়াই আমাকে একা পাড় করতে হবে। কিন্তু এক সময় হাপিয়ে উঠলাম। আমি শুধু ঘুরে ঘুরে একই জায়গায় হারিয়ে যাচ্ছিলাম।”

জুহাইর অপলক তাকিয়ে রইলো ইচ্ছের দিকে। অন্ধকারে ইচ্ছের মুখ দেখা যাচ্ছে না। কেবল তার কথা শোনা যাচ্ছে। ইচ্ছের থেকে ওর দূরত্ব বেড়ে ছয় হাতের উপরে হয়েছে। মেয়েটা কতটা বোঝদার, অথচ শয়তানের ধোকায় পড়ে একটা ভুল স্টেপ নিয়েছিলো। ওর একবার মনে হলো ও নিজেও একটা সময় এমন মনোভাব পোষণ করতো অথচ সমকালীন ফেতনায় পড়ে, জড়িয়ে পড়েছিলো হারামে। সে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলো, “জীবন এমনটাই, ইচ্ছে। কখনো কখনো খুব কষ্ট হয়, কিন্তু সেই কষ্ট থেকেই আমরা শক্তি পাই। আপনি যদি একবার নিজের জীবনকে আরেকটু অন্যভাবে দেখেন, তাহলে দেখতে পাবেন যে আপনার থেকেও কত দুঃখী মানুষ এই পৃথিবীতে আছে। যাদের রাস্তায় রাস্তায় দিন কাটছে, তারাও কি সুন্দর কোনো অভিযোগ ছাড়ায় সৃষ্টি কর্তার নিকট শুকরিয়া আদায় করছে।”

হুহু করে কেঁদে উঠে ইচ্ছে। দাদির কথা মনে পড়ছে ওর। জুহাইর অপলক তাকিয়ে থাকে ইচ্ছের অন্ধকার অবয়বের দিকে। একদম হুট করেই, হুট করেই সে একটা প্রস্তাব রাখলো ইচ্ছের নিকট৷ বললো,“আমাকে বিয়ে করবেন ইচ্ছে?”

ইচ্ছে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় জুহাইরের পানে। কি বলছে মানুষ টা?আজই তো লোকটার সঙ্গে ওর পরিচয়!

“কি বলছেন এসব?”

“আমি একটা হারাম রিলেশনশীপে ছিলাম। তবে কখনোই আমি সেই মেয়েটাকে স্পর্শ করিনি। প্রথম কোনো মেয়েকে স্পর্শ করেছি, সে আপনি, সেটা হোক অনিচ্ছায়। কিন্তু করেছি তো। আপনি রাজি থাকলে আমি আজ রাতেই আপনাকে বিয়ে করবো।”

টু শব্দ করে না ইচ্ছে। এটাই যদি সৃষ্টি কর্তার ইচ্ছে হয় তবে ইচ্ছে এই প্রস্তাব ফেরাবে না। মেনে নেবে নিজের ভবিতব্য।

#চলবে