#তৃষ্ণা_তব_নাহি_মেটে
#পর্ব৪
#রাউফুন
ইচ্ছে বসে বসে পড়ছিলো। এমন সময় খিলখিলিয়ে হাসির আওয়াজ পেলো সে। অনর্গল কথা বলায় ব্যাঘাত ঘটছে ওর পড়াতে। তুলি, শারমিন আর জাকিয়া, তারা তিনজনই নিজেদের বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে কথা বলছে। ইচ্ছের কেমন যেনো অসহনীয় লাগে। সে উঠে যায় সাহস করে বারান্দায়। নরম স্বরে বলে,“আপুরা, প্লিজ একটু আস্তে কথা বলবে? আমি পড়ছিলাম তো!”
তিনজনেই এক সঙ্গে ভ্রুকুটি করে তাকালো ওর দিকে। তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে মুখোমুখি হলো ইচ্ছের। ইচ্ছে ভয়ে চোখ বন্ধ করে দু কদম পিছিয়ে গেলো৷ আবার মা’র’বে নাকি ওকে? শুকনো ঢোক গিলে চুপসে দাঁড়িয়ে রইলো। শারমিন আলতো করে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে কটমট করে বললো,“কি যেনো বলছিলি? আবার বল দেখি!”
“দেখেছিস তুলি? কি সাহস ওর? আমাদের কে বলছে আস্তে কথা বলতে? ও কি পরশুদিনের মা’রের কথা ভুলে গেছে?”
শারমিনের কথায় মনে পড়লো ইচ্ছের পরশুদিনের কথা। সেদিন হলে দেরি করে আসায় ইচ্ছেকে বেদম মা’র মা’রে তিনজনেই। শুধু দেরি করে আসার জন্য যে মা’রেনি তা ও ভালো করেই জানে। সেদিন বিকেলের দামী খাবার খাওয়ার সময় যে চু’রির অপবাদ দেওয়া হয়েছিল ওকে সেই দায়ে অভিযুক্ত করে মে’রে’ছে। ইচ্ছে প্রতিবাদ করতে পারে না। প্রচন্ড ভীতু আর দূর্বল প্রকৃতির মেয়ে ও। তাই অনেক কিছু সহ্য করতে হয় ওকে। ওরাও পেয়ে বসে এতে করে। জাকিয়া দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,
“আমরা আমাদের বয়ফ্রেন্ড এর সঙ্গে কথা বলবো তাতে তোর কি? তোর কি গায়ে জ্বালা ধরে? নিজের এই রূপে তো পারিস নি একটাও ছেলে পটাতে। আমাদের যখন আছে তখন তোর খুব গায়ে ফোসকা পড়ছে না রে?”
ইচ্ছে মিনমিন করে বললো,“নাউজুবিল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ আপু। আমি ওসব হারাম সম্পর্কে কখনোই যাবো না। আপনারা জানেন না, যে ইসলামে বিয়ের আগে কোনো সম্পর্কে যাওয়া হারাম?
ইসলামে যেখানে বেগানা নারী পুরুষের পাশাপাশি বসার বৈধতা নেই, সেখানে এখনকার নারী পুরুষ অবাধ চলাফেরা, ফ্রী মিক্সিং, হারাম সম্পর্ক, তাকিয়ে থাকা, একে অপরকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা, চালচলন, দৃষ্টি ভঙ্গি, মেয়েদের হাঁটায় লজ্জার রেশ মাত্র নেই। আর সেসব মেয়েদেরকে স্মার্ট হিসেবে গন্য করে জড়িয়ে যায় হারাম সম্পর্কে। ইসলামে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা হারাম ঘোষণা করা হয়েছে, কারণ এটি মানুষের চরিত্রকে কলুষিত করে এবং পাপের দিকে টেনে নিয়ে যায়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “তোমরা মুমিন পুরুষদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এটি তাদের জন্য অধিক পবিত্র।” (সুরা আন-নূরঃ ২৪:৩০)। এখানে স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে যে, দৃষ্টি সংযত করা এবং শালীনতা বজায় রাখা মানুষের ইমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যদি কোনো নারী পুরুষ নিজেদের ভেবে প্রবৃত্তি বোধ করে, বা কামনা বাসনা জাগ্রত হয় তবে তা হবে অন্তরের জিনা। আর অন্তরের জিনা হচ্ছে ভয়াবহ আর বড়ো গুনাহ্। জিনাহ করা ব্যাক্তি মন থেকে ক্ষমা না চাওয়া অব্দি চল্লিশ দিন ইবাদত আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা কবুল করেন না।
নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার মাধ্যমে শয়তান খুব সহজেই মানুষকে পাপের পথে নিয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যখন এক পুরুষ এবং এক নারী নির্জনে মিলিত হয়, তখন তৃতীয় ব্যক্তি হয় শয়তান।” (তিরমিজি, হাদিস নং ২১৬৫)। একে অপরের প্রতি অপ্রয়োজনীয় আকর্ষণ সৃষ্টি হওয়া, ভুল বোঝাবুঝি, এবং বৈধ সম্পর্কের ক্ষতি হওয়া এর বড় কিছু ক্ষতিকর দিক। এসব কারণে ইসলামে ফ্রি মিক্সিং কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
মানুষের মনকে শুদ্ধ রাখতে এবং সমাজকে পাপমুক্ত করতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হওয়াকেও নিষিদ্ধ করেছেন। “তোমরা ব্যভিচারের ধারে কাছেও যেও না। এটি একটি অশ্লীল কাজ এবং নিকৃষ্ট পথ।” (সুরা আল-ইসরাঃ ১৭:৩২)। তাই মুসলিমদের উচিত নিজেকে এসব থেকে দূরে রাখা এবং আল্লাহর পথে অবিচল থাকা।
কোনো মুসলিম নারী-পুরুষ যখন অবাধ মেলামেশার পরিবর্তে আল্লাহর আদেশ মেনে চলে, তখন সে নিজের ইমানকে মজবুত করে। শালীনতা রক্ষা করা শুধু ব্যক্তিগত ইবাদত নয়, বরং এটি একটি সামাজিক দায়িত্বও। এটি পরিবার, সমাজ এবং পুরো জাতিকে মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করায়। সেই জন্যই প্রকৃত সফলতা হলো আল্লাহর বিধান মানা এবং তাঁর নিষেধাজ্ঞাগুলো থেকে নিজেকে দূরে রাখা।”
ইচ্ছের পুরো কথা শুনে ঠাস করে এক চ’ড় বসালো ওর গালে জাকিয়া। ইচ্ছে অবাক হলো, পুরো কথা শুনে এখন গা’য়ে হাত তুলছে? অথচ সে কথা বলার সময় তিনজনই কেমন হা করে গিলছিলো ওর কথা। দেখে মনে হচ্ছিলো ওর কথা গুলো শুনতে ভালো লাগছে, বা এমন কথা ওরা প্রথম শুনছে। ইচ্ছে গালে হাত দিয়ে গিয়ে টেবিলের কাছে যেতে নিলে শারমিন পা বাড়ালো, ওমনি পায়ের সঙ্গে পা লেগে পড়ে গেলো ইচ্ছে। মুখ থুবড়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনজন সমস্বরে হেসে উঠলো। ইচ্ছে অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালো। চোখের পানি মুছে বললো,“আজকের রাতটাই জ্বালিয়ে নাও আপুরা। এরপর আমাকে জ্বালাতে পারবে না!”
“বড়ো সেয়ানা হয়েছিস যে? তা মুখপুড়ী ঘোমটাওয়ালি যাবি কই?”
শারমিন তুলির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাধ উঁচিয়ে, চোখ কোণা করে ইশারা করে বললো,“ওসব জায়গায় যাবি নাকি? শরীর টরীর’ বেইচা খাওয়ার জন্য?”
ইচ্ছের গায়ে যেনো কেউ আ’গু’ন ধরিয়ে দিয়েছে। শান্ত হরিনী কেমন হঠাৎই অশান্ত হয়ে উঠে। নিশপিশ করে উঠে হাত। ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দেয় সিনিয়রের গালে। জাকিয়া, তুলি হতচকিত, হতভম্ব হয়ে তাকায় শারমিনের দিকে আবার ইচ্ছের দিকে। চ’ড় টা ইচ্ছে মে’রেছে তা যেনো ওরা বিশ্বাস করতে পারছে না। ইচ্ছে ফোসফাস করে বলে,“খবরদার একটা মেয়ে হয়ে অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে এতো নোংরা কথা বলো না। আল্লাহর কসম খু’ন করে ফেলবো। আমাকে সব সময় অবলা ভেবে ভুল করবে না। আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলার অধিকার আমি কাউকে দিইনি। ফারদার যদি তোমরা আমার চরিত্রের দিকে আঙুল তুলেছো তো দেখে নেবো! এতোদিন চুপ থেকেছি তার মানে এই না যে তোমরা আমার চরিত্র নিয়ে বলবে আর তা আমি সহ্য করবো।”
তুলি আর শারমিন এগিয়ে এসে গলা চেপে ধরে ইচ্ছের। ইচ্ছের হাসফাস লাগে। ও নিজেকে বাঁচাতে হাঁটু দিয়ে আঘাত করে তুলির তলপেটে। কু’কিয়ে উঠে মেয়েটা। জাকিয়াও রাগে ওকে মা’রতে আসলে ইচ্ছে হাত মুচড়ে ধরে। হঠাৎ করেই এমন হিংস্র হবে ইচ্ছে ওরা বোধহয় কল্পনাও করেনি। শান্তশিষ্ট মেয়েটার আজ অন্য রকম রূপে ওরা বিস্ময় প্রকাশ করতেও যেনো ভুলে গেছে। তিনজনেই পিছিয়ে যায়। ইচ্ছে খানিকটা ঠোঁট কোণা করে এক পেশে হাসে। বলে,“গ্রামের মেয়ে, হাত পা তোমাদের মতো ননীর পুতুল নয়। আমি তোমাদের এতো অত্যাচার সহ্য করেছিলাম আমি ভীতু বলে। কিন্তু গায়ে তো জোর কম না আমার। আমার চরিত্র নিয়ে কেউ বললে আমার গায়ে আ’গু’ন ধরে যায়। আমি সহ্য করতে পারি না। এরপর থেকে সাবধান থেকো আপুরা। আর শোনো আমার বিয়ে হয়ে গেছে, তাই আগামীকাল ই আমি হল ছেড়ে দেবো। শান্তিতে থেকো!”
শারমিন ধারালো, অথচ অবাক কন্ঠে শুধালো,“তোর মতো ভিখিরিকে কে বিয়ে করলো?”
“তা তো তোমাদের জেনে কাজ নেই আপু!”
ইচ্ছের ইচ্ছে করছে এখনি বেরিয়ে যেতে। কিন্তু এতো রাতে হল থেকে বেরোনোর অনুমতি নেয়। ও ফোস করে শ্বাস ফেলে। পড়াশোনায় মনোযোগী হয়। এশারের নামাজ পড়ে ঘুমানোর আগে সূরা মুলক আর বাকারাহ’র শেষ তিন আয়াত পড়ে নেয়। এরপর ঘুমিয়ে পড়ে। সূরা মুলক পড়লে কবরের আজাব হবে না মৃত্যুর পর, আর বাকারাহ’র শেষ তিন আয়াত পড়লে সারারাত ঘুমিয়েও নফল নামাজের সওয়াব পাওয়া যায়। জানা অনুযায়ী আমল কারী বান্দাকে আল্লাহ তায়ালা ভালোবাসেন। ইচ্ছে সব সময় যতটা জানে সে অনুযায়ী আমল করার চেষ্টা করে। কিন্তু ঘুমানোর আগে ও বুঝতেও পারলো না তিনটি প্রাণনাশ কারী নারী মূর্তি সাপের নজরে ওকে দেখছিলো৷
জুহাইরের কেমন যেনো অস্থির লাগে। ইচ্ছের কি ফোন আছে? মেয়ে টাকে এতো মনে পড়ছে। গতকাল জেনে নিয়েছে কত নম্বর হলে ইচ্ছে থাকে। কিন্তু সবার সামনে কোনো ভাবেই ও মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে পারেনি। সবাই খারাপ ভাবতে পারে ইচ্ছেকে। ছটফট করছে রীতিমতো জুহাইর। প্রান্ত জুহাইরের পাশেই সিগারেট ধরিয়ে ফোসফাস করে সিগারেট টানছে। জুহাইর বিরক্ত হয়। প্রান্তকে বলেও ওর সিগারেটের নেশা ছাড়াতে পারেনি। সিগারেট যে হারাম তা বোঝাতে বোঝাতে ক্লান্ত জুহাইর। জুহাইর বিরক্ত হয়ে বলে,“তুই জানিস না, সিগারেটের গন্ধ আমার সহ্য হয় না? কতবার বলব এসব খাস না৷ এটা হারাম৷ ইসলামে ঘোর নিষিদ্ধ।”
“তুই কি মেয়ে মানুষ যে সিগারেটের গন্ধ সহ্য হয় না? আমি জানি সিগারেট খাওয়া নিষেধ। কিন্তু আমি ছাড়তে পারছি না। আস্তে আস্তে ছেড়ে দেবো।”
“প্লিজ ভাই, দয়া করে বাইরে যা। এটা শেষ করে রুমে আসবি!”
“কিরে তোর দেখি মেজাজ ভালো না। কি হইছে ব্রো? বউকে মনে পড়ছে? আহারে, বিয়ে করেও বেচারা সিঙ্গেল জীবনযাপন করছে। সো স্যাড!”
জুহাইর বিরক্ত হয়ে উলটো দিক মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়ে। এমনি ইচ্ছের কথা মাথা থেকে সরাতে পারছে না তারপর এই ছেলের খোচা মা’রা কথা। চোখ বন্ধ করে ঘুমালো৷ মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে জুহাইর। ভয়ংকর এক স্বপ্ন দেখেছে। তড়িঘড়ি করে হল থেকে বের হয় জুহাইর। ইচ্ছেকে একটা নজর দেখার তৃষ্ণা জাগে ওর। বিয়ে করা বউকে একটা নজর দেখার সৌভাগ্য বেচারর হয়নি৷ ইচ্ছেকে দেখার কি যে আকুলতা এই মূহুর্তে হচ্ছে, তা কেবল সেই জানে। মেয়েটা ঠিক আছে তো? জুহাইর দৌঁড়াচ্ছে কেবলই।
#চলবে