তৃষ্ণা তব নাহি মেটে পর্ব-০৭

0
20

#তৃষ্ণা_তব_নাহি_মেটে
#পর্ব ৭
#রাউফুন
ইচ্ছে ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছিলো। আজ হল ছেড়ে দেবে৷ জুহাইর ওর জন্য নিচে অপেক্ষা করছিলো। ওঁদের বিয়ের ব্যাপারে নিজ দায়িত্বে সবাইকে জানিয়েছে জুহাইর। ওকে ব্যাগ গুছাতে দেখে তুলি ওর কাছে এলো। বললো,“খুব তো আমাদেরকে সেদিন হাদিস শুনাচ্ছিলি, তলে তলে নিজেই তো হারাম সম্পর্ক করে বিয়ে করেছিস।”

ইচ্ছে চোখ তুলে এক পল তাকালো। আজ এখান থেকে চলে যাবে তাই কারোর সঙ্গে ও আর খারাপ ভাবে কথা বলতে চাইছে না। এক সঙ্গে অনেক গুলো দিন এই হলে থেকেছে, এই তিনজন ওকে নানান ভাবে হেনস্তা করলেও ওর আলাদা একটা মায়া কাজ করে এদেএ প্রতি। এটা কেন সে জানে না। হইতো ও অত্যাধিক নরম মনের বলেই এমনটা হয়েছে,এতো কিছুর পরেও ওদের প্রতি ওর কখনোই ক্ষোভ জাগে নি।

“কি হলো উত্তর দে, নিজের বেলায় সব ঠিক না? কি মনে করিস নিজেকে?”

“আমি জানি আমি কি আপু৷ জুহাইরের সঙ্গে আমার কখনোই কিছু ছিলো না৷ ইভেন যেদিন তোমরা আমাকে ক্যান্টিনে অপমান করছিলে সেদিনই জুহাইরের সঙ্গে আমার পরিচয়। আর সেদিনই লোকটা আমাকে বিয়ে করেছে৷ অনেক কিছুই তোমাদের অজানা আপু। না জেনে কারোর সম্পর্কে এমন কিছু বলো না আপু।”

ইচ্ছের ব্যাগ গোছানো শেষ। ততক্ষণে জাকিয়া আর শারমিন এসে দাঁড়িয়েছে। তুলি বললো,“তোদের বিয়েটা কিভাবে হলো? জুহাইর তোকে না দেখেই বিয়ে করেছে? চেহেরা টেহেরা ভালো ছিলো, চাইলেই একটা রিচ ম্যানকে বিয়ে করতে পারতি ভুলিয়ে ভালিয়ে৷ ঐ ভিখিরকে কেন বিয়ে করতে হলো তোর?”

মুচকি হাসে ইচ্ছে। ফিচেল হেসে বললো,“টাকা পয়সা দিয়ে কি সুখ কেনা যাই আপু? সবাইকে টাকা কেন বিচার করে মানুষ? তাকে কেন বিয়ে করেছি জানো? দিনের পর দিন তোমাদের অপমান সহ্য করতে আমি একটা ভুল স্টেপ নিয়েছিলাম। সেদিন ঐ মানুষ টা আমাকে আত্ম’হত্যার হাত থেকে বাঁচিয়েছে। এরপর আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে আমি না করিনি। পরিস্থিতি টাই অন্য রকম ছিলো। আমার তো এই দুনিয়ায় আপন বলতে কেউ নেই আপু, ভাবলাম দেখিনা রাজি হয়ে৷ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা আমার কপালে হইতো সুখ দেবেন।”

“তোরা কি রকম বাসায় উঠবি? নিশ্চয়ই খুব ছোটো আর নোংরা বস্তিতে সেই ঘর?”

শারমিনের কটাক্ষের বানী। ইচ্ছে আবারও হাসলো।

“না আপু, একটা এক তলা বাড়ি৷ দুটো রুম, একটা ডাইনিং রুম!”

“বাবাহ, ভালোই তো। তোর ঐ ভিখিরি বর ঐ বাসা প্রেফার করতে পারবে? কি করে লোকটা?”
এতক্ষণে জাকিয়া কথা বললো। ফোনে কি যেনো করছে মেয়েটা। মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। ইচ্ছে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে জবাব দিলো,

“জানি না আপু কি হবে৷ আমি চেয়েছিলাম সস্তা একটা বাসায় উঠতে কিন্তু জুহাইর উঠেন নি৷ সেসব নিয়ে আমাকে ভাবতেও না করেছে।”

ইচ্ছে ব্যাগ টা নিয়ে হাঁটা ধরলো৷ পরক্ষণেই কি যেনো মনে করে ব্যাগটা রেখে জড়িয়ে ধরলো তুলিকে। ক্রন্দনর‍ত কন্ঠে বললো,

“তোমাদের মিস করবো আপু। তোমাদের দেখে মনে হতো তোমরা আমার তিনটা বড়ো আপু। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি আমি তোমাদের চক্ষুশূল হবো। আমার প্রতি ক্ষোভ রেখো না। যদি কখনো কষ্ট দিয়ে থাকি তবে ছোটো বোন মনে করে ক্ষমা করে দিও। ”

তুলি খানিকটা স্তব্ধ হয়ে গেছে৷ শারমিন আর জাকিয়াও উঠে দাঁড়িয়ে রইলো। ইচ্ছে ওদের দুজনকে এক সঙ্গে জড়িয়ে ধরলো।

“তোমাদেরকে ভালোবাসি আপু৷ যাই কেমন? ভালো থেকো হ্যাঁ? তোমাদের বিরক্তির কারণ আজকে থেকে বিদায় নিচ্ছি।”

ওরা তিনজনই কেমন অদ্ভুত ভাবে থেমে গেছে। বুকের ভেতর কেমন যেনো নিঃসঙ্গতা ধরা দিয়েছে। নীরবতার মাঝেই ইচ্ছে ওদের ছেড়ে দিয়ে বিদায় নিলো। ইচ্ছের চোখে টলমল করছে পানি। গড়িয়ে পড়লো বাধ ভাঙা অশ্রু। ওদের তিনজনের চোখেও পানি কি? ওরা দাঁড়িয়ে থাকতেই ইচ্ছে বেরিয়ে গেছে। তিনজন খেয়াল করলো ওদের চোখ ভেজা। ইচ্ছে যেখানে থাকতো সেখানে তাকিয়ে থাকলো তিনজনই। এই প্রথম ওরা উপলব্ধি করলো ওঁদের মনও নরম। এর আগে যতজন ওদের সঙ্গে রুম মেট হিসেবে থেকেছে তারা কেউ-ই ইচ্ছের মতো এতো আপন ভাবেনি ওদের। বরং হল ছাড়ার আগে রাগ ঝেড়ে না হলে বিরক্ত মুখেই বিদায় নিয়েছে। কিন্তু ইচ্ছে তার সম্পুর্ন বিপরীতে। মেয়েটা একদম আলাদা। ওদের কেমন কাঁদিয়ে ছাড়লো। সত্যিই ভালোবাসা দিয়ে সবকিছুই জয় করা সম্ভব।

জুহাইর দেখলো ইচ্ছে হেলেদুলে হাঁটছে। এগিয়ে গিয়ে ব্যাগটা হাতে নিলো। বললো,“কাদছিলে কেন?”

“কই না তো!”
আমতাআমতা করে জবাব দিলো ইচ্ছে। জুহাইর বললো,“যারা তোমাকে সব সময় হেনস্তা করেছে তাদের জন্য কেঁদে বুক ভাসাচ্ছো কেন মেয়ে? আসার সময় রাগ ঝেড়ে আসতে পারতে!”

“কি যে বলেন আপনি। ওরা আমার বড়ো বোনের মতো। ওদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবো? চলেই তো এলাম, আসার সময় কষ্ট দিয়ে আসবো কেন? ওরা ওতোটাও খারাপ না, আর যদিও খারাপ হয়ে থাকে, আমার তাতে কোনো সমস্যা নেই। আমিও যদি খারাপ ব্যবহার করি তবে ওদের আর আমার মাঝে পার্থক্য কোথায় থাকলো?”

জুহাইর কেমন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। ইচ্ছে কি যেনো মনে করে দোতালায় তাকালো। দেখলো তুলি, শারমিন, জাকিয়া এদিকেই তাকিয়ে আছে। জুহাইরও তাকালো। ইচ্ছের কেন যেনো কষ্ট হচ্ছিলো। এক সঙ্গে থাকতে থাকতে বোধহয় একটা টান তৈরি হয়েছে। তাই ওদের ফেলে রেখে যেতে কষ্ট হচ্ছে। ইচ্ছেরা হাঁটা ধরলো। পিছনে না ফিরেও বুঝলো ওরা তিনজন ওকেই দেখছে।

রিকসা করে সোজা চলে এলো এক তলা বিশিষ্ট সেই বাড়িতে। আসার সময় টুকটাক কথোপকথন হচ্ছিলো দুজনের মধ্যে। ইচ্ছে দুদিন টানা এসেছে এই বাড়িতে। এসে এসে সবকিছু গুছিয়ে রেখে গেছে। জুহাইর দুটো খাট কিনেছে, ডাইনিং টেবিল, ড্রেসিং টেবিল, ফ্রীজ কিনেছে, এসব ইচ্ছেকে না জানিয়েই কিনেছে ও। এতো টাকা খরচ করতে দেখলে অনেক গুলো প্রশ্ন করতো। ঘরে ঢুকে ইচ্ছে অবাক হয়। খাট, ফ্রীজ,ড্রেসিং টেবিল, ডাইনিং টেবিল। ও অবাক হয়ে তাকাতেই জুহাইর ভ্রু চুলকে অপ্রস্তুত হয়ে বলে,“সবকিছুই কিস্তিতে কিনেছি।”

“সেটাও তো অনেক টাকা। আপনি এতো টাকা কোথায় পেলেন?”

“আমার রোজগারের একটা অংশ সেভিংস হিসেবে সরিয়ে রাখতাম সেগুলো দিয়েই। এতো ভেবো না তো। এগুলো লাগবে না? আমার বউ কি ফ্লোরে ঘুমাবে নাকি?”

ঘুমোনোর কথা মাথায় আসতেই ইচ্ছের অদ্ভুত একটা শিহরণ হলো। ওরা দুজন বিয়ের পর হাতটাও এখনো স্পর্শ করেনি জুহাইর। রাতে তো এক সঙ্গে থাকতে হবে দুজনকে। স্বামী হিসেবে জুহাইরের পূর্ন অধিকার আছে ওকে স্পর্শ করার। এতোদিন তো দুজন আলাদা ছিলো কিন্তু এখন তো এক সঙ্গে থাকবে। কেমন যেনো গা শিরশিরে এক অনুভূতি।

“বোরখা খুলে ফ্রেশ হও বউ!”

ইচ্ছের চিবুকে লজ্জারা এসে ভর করলো। জুহাইর যখনই ওকে বউ সম্বোধন করে প্রতিবারই ওর এমন হয়। লজ্জায় রাঙা হয় দুই কপোল। জুহাইর ইচ্ছের দিকে একটু ঝুকে হাস্কি স্বরে বললো,

“লজ্জা গুলো রাতের জন্য তুলে রাখো।”

জুহাইর হেলেদুলে হেঁটে ওয়াশরুমে গেলো। ইচ্ছের লজ্জায় ম’রে যাওয়ার উপক্রম হলো। ইশ, লোকটা ওকে জ্বালাচ্ছে কেন এভাবে? মনে মনে ঠিক করলো সামনেই যাবে না ও আর লোকটার। কিন্তু সামনে না গিয়ে যাবে কোথায়? পালানোর পথ তো বন্ধ।

জুহাইর ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো রুমে নেই ইচ্ছে। রান্না ঘর থেকে টুংটাং আওয়াজ পেলো ও। ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে দেখলো ইচ্ছে চা করছে। চামচ দিয়ে চায়ে চিনি দিয়ে নাড়াচাড়া করছিলো তারই শব্দ হচ্ছিলো এতক্ষণ। রান্না ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে বুকে হাত ভাজ করে ইচ্ছেকে অবলোকন করলো সে। ইচ্ছের চা করা হতেই ঘুরলো। আকস্মিক ভাবে জুহাইরকে দেখে চমকে দু কদম পিছিয়ে গেলো ও। এক হাত বুকে দিয়ে বললো,“মাগো, ভয় পেয়েছিলাম তো। কখন এসে দাঁড়িয়েছেন?”

“বউ দেখি কাজ করলে আর কোনো দিকে নজর থাকে না৷ এমন হ্যান্ডসাম, চার্মিং, ম্যানলি বরের উপস্থিতি বুঝলেই না? দুঃখ!”

“আপনি বিড়াল পায়ে হেঁটেছেন বুঝবো কেমন করে?”

“কেমন পায়ে?”

“বিড়ালের মতো নিঃশব্দে।”

“ওহ আচ্ছা।“

ইচ্ছে ওর সামনে চা ধরলো। জুহাইর চা হাতে নিলে ইচ্ছে আরেকটা কাপে চা ঢাললো। পুরো টা সময় জুহাইর ওকে অপলক দেখে যাচ্ছিলো আর চায়ে চুমুক দিচ্ছিলো।

“সুন্দর!”

“হু?”

হকচকিয়ে তাকায় ইচ্ছে। জুহাইর কথা ঘুরিয়ে বলে,“চা, চা সুন্দর করেছো।”

“ধন্যবাদ।” মৃদু কন্ঠে বলে ইচ্ছে। চা হাতে বারান্দায় যায় যে। বারান্দা থেকে রাস্তা দেখা যায়। অসংখ্য গাড়ির ভীর রাস্তায়। চায়ে আয়েশী ভঙ্গিতে চুমুক দিতে দিতে অনুভব করলো ওর পেছনে একটা ছায়া এসে দাঁড়িয়েছে। আস্তে আস্তে দূরত্ব কেবল কমাচ্ছে মানুষটা। ইচ্ছে স্পষ্ট টের পাচ্ছে ওর গতিবিধি। ওর শ্বাস ভারী হলো অদ্ভুত অনুভূতিতে। জুহাইর যদি ওকে স্পর্শ করে তবে এটা হবে ওর করা প্রথম স্পর্শ। ও দু-চোখ বন্ধ করে বারান্দা সিটিয়ে রইলো। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো জুহাইর। ইচ্ছে কেঁদে উঠে আচমকা স্পর্শে। জুহাইর ভড়কায়।

#চলবে