#তৃষ্ণা_তব_নাহি_মেটে
#পর্ব৮
#রাউফুন
জুহাইর সিটকে সরে আসে। শীট, স্পর্শ করার আগে একটাবার অনুমতি নিলে কি খুব ক্ষতি হতো? এমন ভুল সে করলো কিভাবে? কিজানি হঠাৎই ওর কি হলো। অনুমতি বিহীন স্পর্শ করায় নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা? জুহাইর ইচ্ছে হলো নিজেই নিজেকে থাপ্পড় মা’রতে।
“আ’ম স্যরি ইচ্ছে, রিয়েলি স্যরি।”
ইচ্ছে মাথা নত করে কাঁন্না করছে। জুহাইরের দিকে তাকানোর সাহস পেলো না। কোনো মতে বললো,“আপনি প্লিজ আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি, আমি আসলে এখনই প্রস্তুত নয় এসবের জন্য। সময় দিন আমাকে প্লিজ। আমি আপনার হক নষ্ট করতে চাইনি৷ আমাকে ক্ষমা করুন!”
জুহাইর ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেলো। বললো,“আরেএ, পাগলী মেয়ে কাঁদছো কেন? আমার উচিত ছিলো তোমার অনুমতি নিয়ে স্পর্শ করার।”
“আসলে প্রথম স্পর্শ তো, আমি অজান্তেই ভয় পেয়ে কেঁদে ফেলেছি। স্যরি!”
“ইট’স ওকে বউ। প্লিজ,আমাকে অন্য রকম ভেবো না। আমি কিন্তু…!”
“প্লিজ, এতো ভাববেন না। আমার মানিয়ে নিতে একটু সময়ের প্রয়োজন। দেবেন একটু সময়? আসলে হুট করেই বিয়েটা হয়েছে তো। বিশ্বাস করুন, আমি আপনাকে বাঁধা দিতে এমন কিছু করিনি! হুট করেই আমার কি যে হলো! আমাকে ক্ষমা করবেন প্লিজ? স্বামীকে ফেরালে যে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হয়, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন! না হলে আল্লাহ্ও আমাকে ক্ষমা করবেন না। ”
জুহাইর বললো,“প্রথমে ভুল করার জন্য দুঃখিত!, এখন অনুমতি চাইছি, তোমার চোখের পানি মোছার, অনুমতি দেবে?”
ইচ্ছে অসহায় চোখে তাকালো। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতে দিতে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। জুহাইর ওর গাল দুই হাতের বৃদ্ধা আঙুলে মুছে দিলো। ইচ্ছের কি হলো কে জানে। আহ্লাদী হয়ে এবারে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। জুহাইর আবারও বিচলিত হলো৷ ব্যস্ত কন্ঠে বললো,“আবার কাঁদছো কেন? কি হলো? বলো আমায়?”
“এতো সুখ কি আমার কপালে আসলেই লেখা ছিলো? আমার ভালোবাসারা তো সব সময় আমার থেকে হারিয়ে যায়, যদি আপনাকেও হারিয়ে ফেলি? বড্ড ভয় হয়, ভালোবাসতে বড্ড ভয়৷ মনে হয় আপনিও হারিয়ে যাবেন।”
“ভয় নেই, জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও তোমাকে আমি সব সময় আগলে রাখবো ইচ্ছে। আই প্রমিস। কোনো কমতি রাখবো না।”
ইচ্ছে এবারে স্বেচ্ছায় জুহাইরকে আঁকড়ে ধরলো। জুহাইর দু-কদম পিছিয়ে গিয়ে ইচ্ছের মাথায় হাত রাখলো। অন্য হাত রাখলো ওর পিঠে। এই স্পর্শে নেই কোনো কামনা, কেবলই রয়েছে এক আকাশ সম ভরসা আর স্নেহ মেশানো। ইচ্ছের চোখ বন্ধ হতেই ভেসে উঠলো এক বিশ্রি বিকৃত স্মৃতি৷ জুহাইর কে ছেড়ে দিয়ে দৌঁড়ে চলে গেলো রুমে। জুহাইর কেবল অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো ওর যাওয়ার দিকে। মেয়েটা কি কিছু লুকাচ্ছে? ও তো খুব নরমাল ভাবেই জড়িয়ে ধরেছিলো৷ ওর স্পর্শ তো কোনো কামুকতা ছিলো না৷ তবে? ভাবনায় ফেলে দিলো ইচ্ছের এমন আচরণ।
•
জুহাইর ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে লাইব্রেরি রুমে প্রবেশ করতে যাবে সেসময় শিপা ওর পথ আগলে দাঁড়ালো। জুহাইর না এক পল তাকালো, এরপর দৃষ্টি সরিয়ে সম্পুর্ন ইগনোর করলো শিপাকে৷ সরে এসে অন্য দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো ক্লাসে। শিপা রেগে গেলো ওকে এভাবে ইগনোর করা। হনহনিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে দাঁত খিটমিট করে বললো,“তুমি আমাকে ইগনোর করো কোন সাহসে? আগে তো সমানে আমার আশেপাশে চিপকে থাকতে। বিয়ে করতেই তোমার সেসব প্রাণ দিয়ে ভালোবাসা ফুড়ুৎ করে উড়ে গেলো? নাকি সেসব অভিনয় করতে?”
জুহাইর একবারও তাকালো না শিপার দিকে। শিপা রাগে ফোসফাস করছে না তাকিয়েও বুঝতে পারছে সে। শান্ত কন্ঠে বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললো,
“অভিনয় করা আপনাদের মতো মেয়েদের নেশা হলেও জুহাইর সিকান্দারের নয়। আপনি আমার জন্য পরস্ত্রী। আমার থেকে দূরত্ব রেখে চলুন। আমি আমার বউয়ের হক নষ্ট করতে চাই না অন্য নারীর সঙ্গে কথা বলে।”
“তোমার কি মনে হচ্ছে না তুমি এবারে বারাবাড়ি করছো? সাধু সাজছো? এতো সাধু সাজলেই না তুমি সাধু হয়ে যাবে না। আড়াই বছর প্রেম ছিলো তোমার আর আমার। এতোদিনে এরকম সাধুপুরুষ চরিত্র কই ছিলো? বড়ো বড়ো বুলি আউড়ানো হচ্ছে এখন তাই না?”
জুহাইর জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না৷ নিজের প্রয়োজনীয় বই নিয়ে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে আসার সময় চিৎকার করে উঠে শিপা। লাইব্রেরির সবার নজর এবারে ওদের দিকে পড়লো। তামাশা দেখার জন্য যেনো সবাই প্রস্তুত। শিপা হিসহিসিয়ে বললো,
“দেখো তোমরা সবাই, তোমরা মোটামুটি সবাই জানতে এই ছেলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিলো, অথচ এখন আমাকে রেখে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে। ঠকিয়েছে আমাকে। এই জন্যই বলি, ছেলেদের বিশ্বাস নেই৷ বেটার অপশন পেলে প্রেমিকাকে ইউজ করা টিস্যুর ন্যায় ছুড়ে মারতে দু দন্ডও ভাবে না। ঠকবাজ, জোচ্চর কোথাকার!”
জুহাইর না চাইতেও থমকে দাঁড়ালো। কি বলছে এই মেয়েটা? ও ঠকিয়েছে? এর একটা বিহিত করতেই হয়। অনেক হয়েছে চুপ থাকা। লাইব্রেরিতে মোটামুটি ভালোই স্টুডেন্ট ছিলো৷ ওর কথা শুনে আরও অনেকেই জড়ো হলো সেখানে। জুহাইর তখনই বোমটা ফাঁটালো। বললো,
“ঠিক বলেছেন আপনি, ব্যাটার অপশন পেলে মানুষ এমন ভাবেই ছুড়ে মে’রে ফেলে। যেমন আপনি আমাকে ছুড়ে ফেলেছেন। আর বলে রাখা ভালো, বিয়েটা আপনি আগে করেছেন, আমি নয়। বিয়ে কি শুধু আপনি একাই করতে পারেন? আমি পারি না? এক দিনের মধ্যে আমিও দেখিয়ে দিয়েছি বিয়ে করে। আপনি কি ভেবেছিলেন, আপনি বিয়ে করাই আমি সেই শোকে দেবদাস হয়ে ঘুরে বেড়াবো? চিরকুমার থেকে যাবো আপনার বিরহে? আপনি বিয়ে করতে পারলে আমিও পারি! কি পারি না, আর করে দেখিয়েও দিয়েছি। আশা করি আর বেহায়াপনা করবেন না৷ অসহ্য লাগে আপনার এসব অশ্লীলতা। নিজের স্বামীর কাছে যান, না পোষালে আরও অনেক জায়গা আছে যাওয়ার, যেতে পারেন। কেউ বাঁধা দেবে না।”
এক নাগাড়ে এসব বলেই হনহনিয়ে বেরিয়ে এলো। রাগে শরীর রীতিমতো কাঁপছে ওর। যাওয়ার আগে খেয়াল করলো না ওর সব কথায় ইচ্ছে ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছে৷ শিপাকে ছিঃ শিৎকার করছে সবাই৷ ইচ্ছের চোখ কেবলই ঝাপসা হচ্ছিলো। তার মানে নিজের প্রেমিকাকে দেখানোর জন্যই ওকে এভাবে বিয়ে করেছে? দয়া করেছে ওকে? হইতো তখনই ওর জেদ চেপে বসেছিলো। ইচ্ছে আর কিছু ভাবলো না৷ কারণ এখন এসব ভেবে লাভ নেই। জুহাইরের মনে এখন আর এই মেয়ে নেই। এক মূহুর্তের মধ্যে ও কি সব ভাবছিলো৷ ইচ্ছে চটজলদি ‘আউজুবিল্লাহি মিন-আশ শায়তানির রজিম’ পড়লো। ভুলভাল কথা মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেওয়াই শয়তানের কাজ৷ শয়তান সবচেয়ে খুশি হয় তখন যখন স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া বিবাদ হয়। ইচ্ছে মাথা ঝাকিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলো লাইব্রেরী থেকে। ও কোণায় ছিলো বলে জুহাইর ওকে দেখতে পায়নি।
জুহাইর হেঁটে সোজা ইচ্ছের ক্লাসের দিকে যাচ্ছিলো। যাওয়ার পথে প্রান্তর সঙ্গে দেখা। প্রান্ত ওর দিকে এসে বললো,“কিরে ব্যাটা, বউ পেয়ে বন্ধুদের ভুললে চলবে? খোঁজ খবর নেই।”
“মাহিন কই?”
“গার্লফ্রেন্ড কে নিয়ে ডেটে গেছে!”
“বিয়ে কবে করবে ঐ লুচুটা? আর কত হারামে থাকবে? হারামে যে স্বস্তি নেই ও কি সেটা আমাকে দেখে বুঝলো না?”
“বিয়ের জন্য ওকে প্যারা দিচ্ছে ওর গার্লফ্রেন্ড। মেয়েকে অন্য পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিলো। তাই আজ নাকি শেষবার দেখা করতে এসেছে।”
“কি বলিস? এতো কিছু হলো জানলামই না?”
“তোর কি আর আমাদের কথা মনে থাকার কথা? নতুন বিয়ে করে সব ভুলে গেছিস। ফোন করেও পাইনা আমরা!”
জুহাইর ফোন চেক করলো। ওর ফোন বন্ধ হয়ে গেছে। ছোটো করে শ্বাস ফেলে ও৷ দুজনে ততক্ষনে ইচ্ছের ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়েছে। উকি দিয়ে দেখলো বোরখা পড়া কেউ-ই নেই ক্লাসে। তার মানে ইচ্ছে ক্লাসে নেই এখন। কোথায় গেলো মেয়েটা?
“মনে তো হচ্ছে ভাবি নেই ক্লাসে।”
“হুম, কালো বোরখা কেবল ঐ পড়ে ওদের ক্লাসে। গেলো কোথায়? ক্লাস থেকে তো খুব একটা বের হয় না।”
“ফোন কর একটা!”
“ওর ফোন নেই।”
“ধুর, কি বলিস? একটা ফোন কিনে দিবি না ভাবিকে?”
“মনে ছিলো না৷ আজ দেবো৷ এখন চল দেখি খুঁজে।”
ওরা ঘুরে হাঁটা ধরলো৷ জুহাইরের বুকের মধ্যে কেমন যেনো দামামা বাজছে। অস্থির লাগছে খুব ইচ্ছেকে না দেখতে পেয়ে।
#চলবে