তৃষ্ণা তব নাহি মেটে পর্ব-১০+১১

0
18

#তৃষ্ণা_তব_নাহি_মেটে
#পর্ব১০
#রাউফুন
জুহাইর বাড়িতে এলো তখন রাত হয়ে গেছে। ইচ্ছের কেমন হাসফাস লাগছিলো একা একা। জুহাইরকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। পুরো বাড়িটাতে মেয়েটা একা। জুহাইর চেয়েছিলো দ্রুত ফিরতে কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনি। কারণ সে মাগরিবের নামাজ মসজিদে পড়েছে। এরপর ইচ্ছের জন্য ফোন কিনে এনেছে। সীম কিনেছে, এরপর বিকাশ খুলে দেনমোহরের সম্পুর্ন টাকাটাই ট্রান্সফার করেছে। এরপর ফোনটা সবকিছু ঠিক করে তবেই ইচ্ছের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

ইচ্ছে শুধালো,“ওদিকের কি খবর? সবকিছু ঠিকঠাক?”

জুহাইর মুচকি হাসে। ইচ্ছের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,“হ্যাঁ সবাই মেনে নিয়েছে।”

“আচ্ছা, আপনি ফ্রেশ হোন। আমি আপনার জন্য কফি বা চা করে আনছি!”

“আমি এখন কফি বা চা কিছুই খাবো না। একেবারে রাতের খাবার খেতে চাচ্ছি।”

“ঠিক আছে!”

ইচ্ছের কেমন যেন লাগছে। অযথা ঘামছে, অল্প সময়ের ই ব্যাপার তবুও ওর মন সাপটে অভিমান জমেছে। জুহাইর ড্রেসিং টেবিলের উপর বক্সটা রাখলো। এরপর ফ্রেশ হতে গেলো। ইচ্ছের ইচ্ছে হলো জিজ্ঞেস করতে,“এমন বেপরোয়া কেন আপনি? সারাদিন একটা মেয়েকে একা বাসায় রেখে গেছেন, কি করেছি, খেয়েছি না কি না এসব কোনো খোঁজ নিলেন না?”

এক পল ড্রেসিং টেবিলে রাখা বক্সটার দিকে তাকিয়ে রান্না ঘরে গেলো। রাতের সব খাবার রান্না করে রেখেছিলো বিকেলেই। তাই এখন কেবল পরিবেশন করবে। সব খাবার টেবিলে সাজালো ও৷

নিশ্চুপ হয়েই দুজনে খাবার খেলো। কেউ কোনো কথা বললো না।
খেতে বসে কথা বলে না ওরা কেউ-ই। খেতে বসে অবিরাম কথা বলা ইসলামে নিষেধ আছে। সেজন্য দুজনেই চুপচাপ কেবল খাবার খেলো। খাওয়া শেষে রুমে এসে জুহাইর বললো,”বক্সটা খুলে দেখো তো ইচ্ছে!”

“ওটা কি?”

“খুলেই দেখো!”

ইচ্ছে খুললো। জুহাইর বুকে হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে ইচ্ছের এক্সপ্রেশন দেখার জন্য। ইচ্ছে বক্সটা খুলেই চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায়। বলে,“এতো দামী ফোন কেন কিনেছেন? আমি ফোন দিয়ে কি করবো?”

“আমার সঙ্গে কথা বলবে আর কি!”

“কেন এতো টাকা নষ্ট করছেন? একটা কম দামী ফোন কিনে দিতেন।”

“আমার বউ কেন কম দামী ফোন ব্যবহার করবে? আমার কি কম আছে নাকি?”

তড়িৎ মাথা তুলে ইচ্ছে। অপলকভাবে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে জুহাইরের দিকে। জুহাইর আমতাআমতা করে বলে,“আমার তো টাকা পয়সার অভাব নেই ইচ্ছে। আমার বাবা আমার জন্য অঢেল সম্পত্তি রেখে গেছেন৷ কিন্তু আমি সব সময় সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত। টাকা উড়িয়ে শো অফ করার মতো ছেলে আমি না।”

ইচ্ছে যেনো অবাক হতেও ভুলে যায়। তবে যে লোকটা বলেছিলো একটা ওষুধের দোকানে কাজ করে। আট হাজার টাকা বেতন দেয় মাস শেষে! এটা কি মিথ্যা? ওর চাহনী দেখেই জুহাইর আন্দাজ করে,“দেখো ইচ্ছে, আমি একটা দোকানে কাজ করি এটা মিথ্যা না। জীবনের মূল্য বুঝতে হলে কষ্ট করে বেড়ে উঠা জরুরি। তাই আমি সব ক্ষেত্রে বিলাসিতা না করে কষ্ট করেই বেড়ে উঠেছি। তুমি আমার বউ, তুমি আমার ব্যাপারে সবকিছুই জানবে, কোনো কিছুই তোমার থেকে আড়াল হবে না। লোকের চোখে আমি কি তা দেখার ব্যাপার আমার না, কিন্তু আমি আমার বউয়ের কাছে কি সেটাই আসল ব্যাপার। আমার বাবা মা নেই তোমার মতোই কিন্তু আমার চাচা চাচি আছেন। উনারা অত্যন্ত ভালো মানুষ। আমাদের খানদানি বংশ হলেও পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষ খুবই সাধারণ আর সাদাসিধা ভাবে চলাচল করে। আমিও তেমনই।”

“লোকেরা যে টাকা যার আছে তাকেই সম্মান করে, তেল মাথায় মানুষ আরও তেল দেয়। আপনার লোকের বাকা দৃষ্টি দেখতে ভালো লাগে? যদি সবাই জানে আপনার অনেক টাকা পয়সা আছে তবে সবাই দেখবেন কেমন আপনাকে সম্মান করে, এইযে এতোদিন যারা আপনাকে হেনস্তা করেছে তারাই দেখবেন আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব করার জন্য মরিয়া হয়ে যাবে।”

জুহাইর খাটে গিয়ে বসলো। ইশারায় ইচ্ছেকেও বসতে বললো৷ ইচ্ছে নতুন ফোন হাতে জড়োসড়ো হয়ে বসলো বিছানায় পা তুলে৷ ইচ্ছে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে জুহাইরের দিকে।

জুহাইর কাষ্ঠ হেসে বললো,
“বন্ধুত্ব এমন একটা সম্পর্ক, যেটা রক্তের বন্ধন ছাড়াও হৃদয়ের গভীরতা দিয়ে গড়ে ওঠে। কিন্তু সব সম্পর্কের মতো এটাও সময় আর পরিস্থিতির পরীক্ষার মুখোমুখি হয়। টাকা-পয়সা, অবস্থান কিংবা পরিচয় দিয়ে যদি কেউ তোমার বন্ধু হয়, তবে সেটা সত্যিকারের বন্ধুত্ব নয়। কারণ এই সম্পর্কটা স্বার্থের। স্বার্থ যখন ফুরিয়ে যাবে, তখন সেই বন্ধুত্বও শেষ হয়ে যাবে।
আমাদের জীবনে এমন অনেক মানুষ আসবে যারা আমাদের টাকার সময় থাকবে, কিন্তু দেখা যাবে অভাবে তারা পালিয়েছে। আমি জানি, বন্ধুর সংখ্যা দিয়ে বন্ধুত্বের গভীরতা মাপা যায় না। হাজারটা লোকের সঙ্গে হাত মেলানোর চেয়ে একজন প্রকৃত বন্ধুর সঙ্গে হাত মেলানোই অনেক বড়। একজন সত্যিকারের বন্ধু, যে তোমার কষ্ট, অভাব, আর দুঃখেও পাশে থাকে, তার মূল্য কোটি টাকার থেকেও বেশি।
আমার বন্ধু দুজন, ওরা শুরু থেকেই জানে আমি গরীব। আমার কাছে বিলাসিতার কিছু নেই। কিন্তু ওরা কখনো আমার টাকাকে বন্ধুত্বের মানদণ্ড বানায়নি। আমার সুখে-দুঃখে, উঠা-নামায় সবসময় পাশে থেকেছে। আর এটাই বুঝিয়ে দেয়, কে তোমার প্রকৃত বন্ধু। বিপদের সময় পাশে থাকে না, এমন একশো জন বন্ধুর চেয়ে একজন সত্যিকারের বন্ধু ঢের ভালো।

বন্ধুত্ব মানুষকে বিচার-বিবেচনা করে গড়তে হয়, ইচ্ছে। একজন মানুষ তার সততা, মনুষ্যত্ব আর ভালোবাসার গভীরতায় বন্ধু হয়ে ওঠে, তার ব্যাংক ব্যালেন্স বা গাড়ি-বাড়ির কারণে নয়। সত্যিকারের বন্ধু কখনো তোমার টাকায় আসে না। সে তোমার কষ্টের গল্প শুনে, তোমার চোখের পানি মুছে।

তাই আমি বলি, বন্ধু নির্বাচন করতে হয় হৃদয় দিয়ে। টাকা পয়সার জন্য নয়, গুণের জন্য। আর সবসময় এমন বন্ধু রাখো, যাকে দেখে তোমার ঈমান আর ভালো কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়ে। কারণ একজন সৎ বন্ধু শুধু জীবনের সুখে নয়, পরকালের পথেও তোমার সহযাত্রী হতে পারে।”

ইচ্ছে মুগ্ধ হয়ে গেছে জুহাইরের কথা শুনে। মানুষ টা এতো সুন্দর কথা বলতে জানে? ও আনমনেই বললো,

“আপনি অনেক কথা জানেন। আপনার কন্ঠ সুন্দর!”

“কি?”

ইচ্ছে ঘাবড়ালো। হাসার চেষ্টা করে অপ্রস্তুত হয়ে বললো,“কিছু না।”

“শুধু কন্ঠ সুন্দর? আর কিছু না?”

চোখমুখ খিচে বন্ধ করে ফেলে ইচ্ছে। লোকটা শুনেও ওকে কেমন জ্বালাচ্ছে। জুহাইরের চোখ মুখে দুষ্টুমির আভাস। ইচ্ছে খয়েরী রঙের একটা জামা পড়েছে, সাদা প্লাজো আর সাদা উড়না মাথায় জড়ানো৷ উড়নার পাড়ে খয়েরী রঙের সুতা দিয়ে কাজ করা। বেশ সুন্দর লাগছে ঘোমটা দেওয়াই। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে জুহাইর। ইচ্ছে সেই দৃষ্টি বুঝে আমতাআমতা করে বলে,“শুয়ে পড়ুন।”

“বললে না তো!”

”কি বলবো?”

“এই যে আমার আর কি কি সুন্দর সেটা!”

দাঁতে নিম্নষ্ঠ চেপে ধরে ইচ্ছে। জুহাইর তখনো তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে আজ ইচ্ছের মুখ থেকে না শুনে ওকে ছাড় দেবে না। ইচ্ছে প্রসঙ্গ চেঞ্জ করতে বললো,“ফোনের দাম কত?”

“উঁহু আগে উত্তর চাই!”

“সবই সুন্দর!” দু চোখ বন্ধ করে ফেলে ইচ্ছে। জুহাইর হাসলো। গলায় দুষ্টুমির রেশ ধরেই বললো,“সব তো দেখাইনি। তাহলে জানলে কেমন করে।”

ইচ্ছের ইচ্ছে হলো মাটির সঙ্গে মিশে যেতে। এই লোকটা এমন জ্বালাচ্ছে কেন? দেখে তো মনে হয় এমন বেফাঁস কথা বলতে জানে! কথা বলার মতো অবস্থা নেই ইচ্ছের। দরাম দরাম করছে বুকের ভেতরটা। জুহাইর পরিস্থিতি সামাল দিলো৷ বউকে আর জ্বালালো না৷ বললো,“তোমার দেনমোহরের টাকা টা ট্রান্সফার করা আছে। সীম কিনে বিকাশ খুলে ট্রান্সফার করে দিয়েছি।”

ইচ্ছে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো। দশ লক্ষ্য টাকা কাবিন করেছিলো জুহাইর। পুরো টাকাটায় দিয়েছে? এমনও হয়? জুহাইর তো দেনমোহরের টাকা শোধ করেছে, এখন যদি মানুষ টা ওর কাছে স্বামীর অধিকার নিয়ে কাছে আসে তবে তো সে মানুষ টাকে ফেরাতে পারবে না।


শিশির ধীরে ধীরে নিজের ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিল। শিপার আর্থিক অসচেতনতা এবং তার জীবনের উদ্দেশ্যহীন ব্যবহারে সে রাগ চেপে রাখতে পারছিল না। বাড়ি ফিরে প্রতিবারই তাকে টাকার কোনো না কোনো অযথা খরচের হিসাব শুনতে হচ্ছিল। এটা যেন একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। মেক-আপ, অর্নামেন্টস, জুয়েলারি, শাড়ী এতো টাকা নষ্ট করছে যে শিশির হাঁপিয়ে উঠছে। কিভাবে কেউ এতো টাকা নষ্ট করতে পারে? কি একটা ঝামেলা সে কাধে নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছে। এমন ভাবে টাকা উড়াচ্ছে যেনো তার কাছে একটা টাকার মেশিন আছে, কাগজ দিলো আর সেটা টাকায় রূপান্তর হয়ে বেরিয়ে এলো। ক্ষিপ্ত হয়ে গেছে শিশির। এক মাস ও হয়নি বিয়ের এখনি মনে হচ্ছে গলায় কাঁটার মতো বেজে আছে শিপা। যাকে না উপড়ালে গলা ব্যথা বেড়েই যাবে।
আজকের খরচ দেখে তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। বাসায় শিপার রান্নার হাত এতো জঘন্য যে সে আজ রেস্ট্রন্ট খেতে গেছিলো। বিল পে করতে গিয়ে দেখে কার্ড একদম ফাকা। হাতেও তেমন কেশ নেই। শেষ ওকে রেস্ট্রন্টে কাজ করে টাকা শোধ করতে হয়েছে। সে বাসায় এসে শিপার দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে বলল, “আমার কার্ডের টাকা শেষ হলো কিভাবে?”

শিশির নেইল কাটার দিয়ে নখ ঘষতে ঘষতে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো,“শপিং করার ছিলো। খরচ হয়ে গেছে।”

“আশ্চর্য একটু হিসেব করে চলতে পারো না? তুমি কি বুঝতে পারছ না, এভাবে চলতে থাকলে আমাদের সম্পর্ক আর টিকবে না? টাকা-পয়সা এমন ভাবে উড়াচ্ছো যেনো আমি কোনো টাকার কারখানা চালাই। একটু হিসেব করে চলতে পারো না?”

শিপা সেভাবেই বসে রইলো, যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু শিশির থেমে থাকল না। তার গলায় রাগের সঙ্গে ঝরে পড়ল হতাশাও।

“তুমি কি জানো, প্রতিদিন এসব অপ্রয়োজনীয় খরচ আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কখনো ভেবেছ? আমি আমার বাবা-মাকে ছেড়ে তোমার সঙ্গে আছি, কারণ আমি ভেবেছিলাম, তুমি আমার জীবনকে অর্থবহ করবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমি একটা ভুল করেছি। তুমি শুধু নিজের আরাম-আয়েশে মগ্ন। ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই তোমার,আমাকে নিয়ে কোনো রকম ফিকির করো না। কি খাচ্ছি না খাচ্ছি সেসবের ধার ধারো না। কেবল কিভাবে শপিং করে টাকা নষ্ট করবে তার পায়তারা করো।”

শিপা কিছু বলতে চাইল, কিন্তু শিশির তার হাত তুলে থামিয়ে দিল। “না, আজ আমি শুনব না। আমি চাই তুমি একটু ভেবে দেখো। আমি আর কতদিন এভাবে সহ্য করব? আমি কি কেবল টাকার যোগান দিতেই থাকব? আমরা যদি এইভাবে চলতে থাকি, তাহলে আমাদের সম্পর্ক টিকে থাকা সম্ভব নয়।”

শিপা চুপ হয়ে গেল। তার মনের গভীরে কোথাও একটা খোঁচা লাগল, একে বিগড়ানো যাবে না। এখন যাও একটু পাচ্ছে সেটাও হাত ছাড়া হবে। শিশিরের এসব কথা কি তাকে বদলাতে সাহায্য করবে, নাকি সবকিছু আরও জটিল করে তুলবে, এই প্রশ্নই যেন বাতাসে ঝুলে রইল। শিশির গটগট করে হেঁটে রুমে গিয়ে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলো। শিপা ব্যস্ত হলো রাগান্বিত শিশিরকে শান্ত করতে

#চলবে

#তৃষ্ণা_তব_নাহি_মেটে
#পর্ব১১
#রাউফুন
গভীর রাত। চারপাশ নিস্তব্ধ, কেবল জানালার বাইরে দূর থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝি পোকার ডাক যেন নীরবতাকে আরও গভীর করে তুলেছে। ঘরের ভেতরে নরম আলোয় জুহাইর আর ইচ্ছে পাশাপাশি শুয়ে আছে। কারোর চোখে ঘুম নেই, দু’জনই নিজ নিজ ভাবনায় ডুবে আছে। ইচ্ছে জুহাইরের পাশে শুলেই কেমন জানি বুক ধরফড় করে। এই অনুভূতিটা নতুন, অজানা, তবু মধুর। সে চেষ্টা করছে স্বাভাবিক থাকতে, কিন্তু হৃদয়ের স্পন্দন যেন কানে বেজে ওঠে। তার শ্বাস ভারী হয়ে আসছে।

জুহাইর অন্যদিকে অন্যরকম এক লড়াইয়ে লিপ্ত। তার বুকের ভেতর থেকে তীব্র আকাঙ্ক্ষার ঢেউ আছড়ে পড়ছে। ইচ্ছে তার পাশে শুয়ে আছে, তার নিজের স্ত্রী, তার নিজের মানুষ। তবু সে যেন কিছু বলতে পারছে না। পুরুষালী অহংকারে বাধা পাচ্ছে সে। ইচ্ছে তার খুব কাছে, তবু দূরের। ইচ্ছের বাহু তার বাহু স্পর্শ করেছে, কিন্তু এই স্পর্শ কি শুধুই অসাবধানতা, নাকি অন্যকিছু? জুহাইর নিজেকে সামলাতে পারছে না। তার ভেতরের উত্তাপ তীব্র হচ্ছে, অথচ শব্দ করে কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না।

ইচ্ছে তার অস্বস্তি টের পায়। সে বুঝতে পারে, জুহাইর তার কাছে কিছু বলতে পারছে না। হয়তো লজ্জা, হয়তো দ্বিধা। এই প্রথমবারের মতো ইচ্ছে উপলব্ধি করে, এ ঘনিষ্ঠতাকে সে নিজেও চায়, হয়তো আরও গভীরভাবে। তার মন দোলাচলে পড়ে যায়। সে কি নিজে থেকেই একটু এগিয়ে যাবে? এই ভাবনা ভাবতেই তার বাহু অসাবধানতাবশত জুহাইরের হাত ছুঁয়ে যায়।

এতেই যেন জুহাইর তড়িৎ হয়ে ওঠে। ইচ্ছে একটু সরতে গিয়েছিল, কিন্তু জুহাইর শক্ত হাতে তাকে নিজের কাছে টেনে নেয়। আকস্মিক ভাবে ওর খানিকটা উপরে চলে আসে জুহাইর। ওর ঘন শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ ইচ্ছে শুনতে পাচ্ছে। তার নিজেরও শ্বাস ভারী হয়। দুজনেরই মনের অবস্থা যেন একই। এই টান যেন শুধু শারীরিক নয়, মানসিকও। জুহাইরের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ইচ্ছের কপালে লাগছে। ইচ্ছে থমকে যায়, তার মুখে কোনো শব্দ নেই। কিন্তু এই মৌনতাও যেন সব কথা বলে দিচ্ছে।

জুহাইর তার স্ত্রীর চোখের গভীরতায় হারিয়ে যায়। ইচ্ছের চোখে এক ধরনের ভীতি, কিন্তু সেই ভীতির আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক অপরিচিত মায়া। সে বুঝতে পারে, ইচ্ছে দ্বিধাগ্রস্ত হলেও বিরূপ নয়। এই কাছাকাছি আসা, এই মুহূর্ত, সবকিছু যেন নিখুঁত।

তারপর, জুহাইর ধীরে ধীরে ইচ্ছের চুলে হাত বুলায়। ইচ্ছে একটুও বাঁধা দেয় না। তাদের হৃদয়স্পন্দন একত্রিত হয়ে যায়। সময় থমকে দাঁড়ায়। দুজনের মাঝে কোনো কথা নেই, শুধু অনুভূতির গভীরতা। স্ত্রীর প্রতি জুহাইরের মুগ্ধতা আরও বাড়ে। ইচ্ছে তার স্বামীর প্রতি যে সম্মতি জানাচ্ছে, তা তার মৌনতায় স্পষ্ট। দুটি চঞ্চল হৃদয়ের গোপন কথা যেনো নীরবে চলতে থাকে। ইচ্ছেকে কাছে পেয়ে আরও বেপরোয়া হয় জুহাইর৷ পুরুষালী ইচ্ছেরা বেসামাল হয়৷ নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাও সে করে না৷ ওর ভালো লাগছে, ভীষণ আদুরে লাগছে ইচ্ছেকে। ড্রিম লাইটের হলদেটে আলোয় ওর মুখ যেনো স্নিগ্ধ লাগছে।

এই রাতে দুজনের মন খুলে যায়। কোনো বাধা থাকে না, কোনো লজ্জা থাকে না। এই নীরবতা, এই অন্তরঙ্গতা, এই মুহূর্ত যেন এক অনন্ত বন্ধনের সূচনা করে। ঘরের পরিবেশে ঘন হয়ে উঠেছিল এক ধরনের নীরব উত্তাপ। জুহাইর ধীরে ধীরে ইচ্ছের চুলে হাত বুলিয়ে তার মুখের কাছে ঝুঁকলো। ইচ্ছের হৃদস্পন্দন দ্রুততর হতে লাগলো। তার মনে একদিকে ভালোবাসার টান, অন্যদিকে অদ্ভুত ভয়। অন্তরঙ্গতার প্রথম ধাপে, অর্থাৎ জুহাইর যখন ইচ্ছের ওষ্ঠ ছোঁয়াবে, তখনই অপ্রত্যাশিত, অপ্রতুল এক ঘটনা ঘটে। তখনই ইচ্ছের চোখে ভেসে উঠলো বাবার অমানবিকতায় মায়ের অসহায় চেহারা, সেই কান্না, সেই ভীতিকর রাতগুলো।

ইচ্ছে হঠাৎ করে জুহাইরকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়। বিছানা ছেড়ে নেমে যায়, গিয়ে এক কোণে মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে। তার পুরো শরীর কাঁপছে। মুখে হাত চেপে ধরে সে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে। জুহাইর হতভম্ব হয়ে বসে থাকে কয়েক সেকেন্ড। নিজের এই পরিস্থিতি বুঝতে না পেরে, নিজের একটু আগের বেসামাল অবস্থার জন্য নিজের প্রতি রাগও হতে থাকে।

সে দ্রুত ইচ্ছের কাছে গিয়ে নিচু হয়ে বসে। নরম স্বরে বলে,
“ইচ্ছে, কী হয়েছে? আমি কিছু ভুল করলাম? প্লিজ আমাকে বলো।”

ইচ্ছে কিছু বলতে পারে না। কান্নার দমকে তার গলা আটকে গেছে। মাথা নাড়ায় যেন সে কথা বলতে পারছে না। জুহাইর আরও চিন্তিত হয়ে পড়ে।
“তুমি ভয় পেয়েছো? আমি তোমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছি?”

ইচ্ছে এবার ফুঁপিয়ে বলে, “না… না, আপনি কিছু করেননি। সমস্যা আমার। আমার মাথায় সবসময় সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলো ঘুরে বেড়ায়। আমি… আমি পারি না, জুহাইর।”

জুহাইর তার কাঁধে হাত রেখে বলে, “কোন দিনগুলো, ইচ্ছে? আমাকে বলো। আমি তোমার পাশে আছি। আমি জানি তুমি কষ্ট পেয়েছো। কিন্তু আমি তো তোমার মতো করে বুঝতে পারব না, যদি তুমি আমাকে না বলো। প্লিজ, একটু বলো।”

ইচ্ছে কান্নার মধ্যে থেকে বলে, “মায়ের কথা মনে পড়ে। বাবা মাকে যে অমানবিকভাবে ব্যবহার করতেন… যে কষ্টে মা বেঁচে থেকেও মরছিলেন, আমি সেই দৃশ্য ভুলতে পারি না। আমার মনে হয়… আপনার সঙ্গে এমনটা হবে না, তবু আমার ভেতর থেকে সেই ভয় যায় না। আমি যখনই কাছে আসতে চাই, মনে হয়… আমি যেন মায়ের মতো অসহায় হয়ে যাবো।”

জুহাইর ইচ্ছের কথা শুনে থমকে যায়। সে বুঝতে পারে, ইচ্ছের এই ভীতি তার গভীর ক্ষত থেকে জন্মেছে। তার মনের গভীর থেকে উঠে আসা এই ভয় এত সহজে যাবে না।

জুহাইর ইচ্ছের হাত ধরে বলে, “ইচ্ছে, আমি তোমার স্বামী। আমি তোমার জীবনের সেই জায়গায় কখনোই দাঁড়াতে চাই না, যেখানে তোমার বাবার মতো একজন দাঁড়িয়েছিল। তুমি আমার কাছে শুধু আমার স্ত্রী নও, তুমি আমার জীবনের অংশ, তুমি আমার বুকে বা পাজর। আমি তোমাকে কষ্ট দেওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারি না। আমি তোমাকে সম্মান করি, ভালোবাসি। তোমার এই ভয়টা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু একটাই অনুরোধ, আমাকে বিশ্বাস করার একটা সুযোগ দাও। আমি তোমার পাশে আছি। এই ভয়টাকে আমরা একসঙ্গে কাটিয়ে উঠবো। তোমাকে সময় দেবো, যতটা সময় তুমি চাও। কিন্তু আমাকে দূরে ঠেলে দিও না। প্লিজ।”

জুহাইর ধীরে ধীরে ইচ্ছের মাথায় হাত বুলায়। তার কণ্ঠে ছিলো গভীর আন্তরিকতা, আর চোখে ছিলো ইচ্ছেকে নিরাপত্তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। ইচ্ছে ধীরে ধীরে জুহাইরের দিকে তাকায়। তার চোখে জল জমে আছে, কিন্তু সেই জলে একটু আশা যেন ফুটে উঠেছে। ভরসা পেয়ে আহ্লাদী হয়ে উঠলো ইচ্ছে। ঝাপিয়ে পড়লো তার এক মাত্র অবলম্বন, তার স্বামীর বক্ষ মাঝে। ইচ্ছে জুহাইরের শার্ট আঁকড়ে পড়ে রইলো একটা অদ্ভুত শান্তির আশায়৷ জুহাইরের হৃদস্পন্দন ওর কর্নদ্বয় প্রবেশ করছে৷ জুহাইর ওর চুলে স্নেহের বিলি কাটে। ইচ্ছে শান্ত হয়ে নিজে থেকেই বললো,

“ছোটোবেলা থেকেই এমন কিছু ভয়াবহ অভিজ্ঞতা দেখে বড়ো হয়েছি যে আমার মনে একটা গভীর ফোবিয়া তৈরি হয়ে গেছে। আপনি আমার স্বামী, সেই হিসেবে আমাকে ছোঁয়ার, কাছে আসার অধিকার আপনার আছে, আমি এটা মানি। কিন্তু আপনি যখনই আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করেন, তখনই আমার মাথায় একটা বিভৎস স্মৃতি ভেসে ওঠে। আমার বাবা আর মায়ের সম্পর্কের স্মৃতি।

অনেক রাত আমি মায়ের কান্নার আওয়াজে ঘুম থেকে উঠে বসে থাকতাম। আমার বাবা মাকে কোনো মানুষ হিসেবে দেখতেন না, দেখতেন ভোগের বস্তু হিসেবে। মাকে শারীরিকভাবে এমন অমানবিক নির্যাতন করতেন যে সেটা সহ্য করার মতো ছিল না। মায়ের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় দাগ থাকত, ঠোঁট ফুলে যেত, গলা আর ঘাড়ে ছিল জখমের চিহ্ন। মা বাইরে বেরোলে সেসব ঢেকে রাখতেন। ছোটো আমি তখন বুঝতাম না, কিন্তু এখন বুঝি। আমার বাবার প্রতি আমার এতটাই ঘৃণা জমেছিল যে তখন থেকেই আমি প্রতিটি ছেলেকে বাবার মতোই পিশাচ মনে করতাম।

এসব দেখতে দেখতে আমি মানসিকভাবে একেবারে ভেঙে পড়েছিলাম। স্কুলেও আমি কারো সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মিশতে পারতাম না। এক কোণে চুপচাপ বসে থাকতাম। ক্লাস শেষ হলে বাসায় ফিরতাম আর রাতে মায়ের অসহ্য কান্নার আওয়াজ শুনতাম। আমার বাবা রাত নামলেই যেন একটা ভয়ঙ্কর জানোয়ারে পরিণত হতেন। দিনের পর দিন এমনটা চলতে থাকল। একদিন আমার মা, আমার সবকিছু, আমাকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন।

আমার মনে তখন একটা কথাই ঘুরছিল, আমার মাকে আমার বাবাই মেরে ফেলেছেন। কিন্তু আমি কিছু বলতে পারিনি। ভীতু আর অসহায় আমি তখন চুপ হয়ে গিয়েছিলাম। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে আমি মানসিকভাবে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিলাম। সেই ভয় এখনও আমার মনের গভীরে বাসা বেঁধে আছে। আমি ভাবতাম, বিয়ের পর আমার সঙ্গেও হয়তো এমনটাই হবে।

আপনার কাছে এসব বলার সাহস হয়নি। কিন্তু সত্যি বলতে, আজও মায়ের মৃত্যুর স্মৃতি আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। সবাই মায়ের মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিল, কিন্তু আমি জানি সত্যিটা কী। আমার মা কোনো রোগে মারা যাননি, তাকে আমার বাবার নিষ্ঠুরতার বলি হতে হয়েছে। আর সেই ভয়, সেই যন্ত্রণা এখনও আমাকে তাড়া করে, আপনাকে কাছে আসতে দিতে বাধা দেয়।”

“ভয় পেও না, আ’ম অলওয়েজ দেওয়ার ফর ইউ। আসো, ঘুমাবে চলো!”

ইচ্ছের কেমন যেনো লাগছে৷ ওর কি ইচ্ছে করে না স্বামী সোহাগে নিজেকে মোড়াতে? ইচ্ছে করে তো,কিন্তু সেই শংকা থেকে বেরোতে পারে না৷

“আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য ক্ষমা করবেন!”

“কোনো কষ্ট না বউ, আমার কেবল তুমি হলেই হবে। আর কিছু চাই না।”

“এমনটা হয় না জুহাইর, আমরা মানুষ, আমাদের সবরকম চাহিদা আছে, শারিরীক, মানসিক, এসব আঁটকানো যাই না। আমি বুঝি, আপনার কি পরিমাণ কষ্ট হচ্ছে। আমি এখন প্রস্তুত!”

“আসলেই?”

জুহাইর চোখ সরু করে তাকালো। ইচ্ছের নত মুখ, চোখ দেখে বুঝলো, ওকে কষ্ট পেতে দেখতে চাই না বলেই মেয়েটা জোর করে বলছে এসব৷ সব দূর্বিষহ স্মৃতি দূরে রাখা গেলেও, শৈশবের কিছু স্মৃতি কখনোই আমাদের পিছু ছাড়ে না। চাইলেও ভোলা যাই না, যদি না সঠিক মানুষ এসে কাউন্সিলিং করে। জুহাইর সময় দেবে ইচ্ছেকে। যতটা ইচ্ছে চাইবে ততটা৷ জুহাইরের বুকের মাছে ছোটো বাচ্চার মতো বুকে লেপ্টে থাকে ইচ্ছে। ওভাবেই ওকে বুকে রেখে শুয়ে পড়ে বিছানায়৷ ইচ্ছের লম্বা চুল গুলো পড়ে ওর গলায়। মেয়েটার এতো লম্বা চুল খেয়াল করেনি তো এতোদিন।

#চলবে