#তৃষ্ণা_তব_নাহি_মেটে
#পর্ব১২
#রাউফুন
ফজরের নামাজ পড়ার পর ইচ্ছে সুর করে কোরআন তেলাওয়াত করছিলো। সেই স্নিগ্ধ কণ্ঠ যেন প্রশান্তির ঢেউ বইয়ে দিলো পুরো বাড়িতে। জুহাইর মসজিদ থেকে ফজরের নামাজ পড়ে ফিরছিলো। ফিরেই তেলাওয়াতের সেই অপার্থিব স্বর শুনে থমকে দাঁড়ায়। তার হৃদয়ে যেন এক অদ্ভুত প্রশান্তি নেমে এলো। মনটা কেমন শীতল হয়ে গেলো। মনে হচ্ছিল, সময় যেন থেমে গেছে। এই মেয়েটা তার স্ত্রী, তার অর্ধাঙ্গিনী। ভাবতেই এক অন্য রকম অনুভূতি হলো, এক অদ্ভুত পুলকে মনটা ভরে উঠলো।
জুহাইর কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এই স্নিগ্ধ সকাল আর ইচ্ছের কণ্ঠস্বর, তার ভেতরটা এক নতুন আনন্দে ভরিয়ে দিলো। ইচ্ছে তখনও খেয়াল করেনি, তার স্বামী দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখছে।
তেলাওয়াত শেষ করে ইচ্ছে পেছনে তাকিয়ে বললো, “নামাজ পড়ে কখন এলেন?”
জুহাইর হেসে বললো, “এই তো!”
“ডাকবেন তো!”
“তুমি পড়ছিলে। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। আমার বউটার তেলাওয়াত যে এত সুন্দর, ভাবিনি তো।”
ইচ্ছে একটু লাজুক হয়ে হেসে বললো, “আপনার কণ্ঠ তো অনেক সুন্দর। আমাকে শোনান তো!”
“তুমি শুনতে চাও?”
“অবশ্যই!”
জুহাইর হেসে বললো, “জানো, আমার কত শখ ছিলো, আমার বউকে আমার তেলাওয়াত শোনাবো।”
এরপর জুহাইর তেলাওয়াত শুরু করলো। সুন্দর, ইচ্ছের ইচ্ছে হলো সময়টা থেমে যাক, সবকিছুই থেমে যাক কেবল এই মূহুর্ত তা আঁটকে থাকুক। খুশিতে ইচ্ছের চোখে পানি চলে এলো। ও তো সব সময় আল্লাহর নিকট চাইতো একজন নেক্কার স্বামী, যার তেলাওয়াত শুনে রোজ ওর একটা মূহুর্ত কাটবে। যাকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসবে, মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকবে। আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেছেন। আর সেই খুশিতে চোখে পানি চলে এসেছে। মানুষটার কণ্ঠের গভীরতা আর সুরের মাধুর্য ইচ্ছের হৃদয় ভরিয়ে তুললো। মনে হচ্ছিল, এ মুহূর্ত কখনো শেষ না হোক। জুহাইরের প্রতিটি শব্দ যেন ইচ্ছের হৃদয়ে আলোর মতো ঝরে পড়ছিলো। ইচ্ছে মনে মনে বললো, “আল্লাহ! তুমি কতটা মহান, তুমি আমার জন্য এমন একজন জীবনসঙ্গী পাঠিয়েছো, যার সঙ্গে প্রতিটি মুহূর্তে তোমার স্মরণে থাকা যায়। তুমি আমার দোয়া কবুল করেছো।” তার চোখে আনন্দের অশ্রু জমে উঠলো। ইচ্ছে হুট করেই জুহাইরকে জড়িয়ে ধরলো। তার কণ্ঠে এমন আবেগ মিশে ছিলো যা একে অপরকে আরও কাছাকাছি নিয়ে এলো। জুহাইরও মুচকি হেসে ওকে বুকে আগলে নিলো। বুকে রেখেই কোর-আন তেলাওয়াত করলো। ইচ্ছে তার বুকের সঙ্গে লেপ্টে থেকে এই মূহুর্ত টাকে অনুভব করলো।
জুহাইরের তেলাওয়াত শেষে ইচ্ছে আবেগে বললো, “আমি সবসময় আল্লাহর কাছে চাইতাম এমন একজন নেককার জীবনসঙ্গী, যার তেলাওয়াত শুনে আমি প্রতিদিনের সকালটা শুরু করতে পারি। আল্লাহ আমাকে কিভাবে আপনাকে পাইয়ে দিলেন, দেখেছেন? আমার আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া!”
জুহাইর চুপচাপ শুনলো ইচ্ছের কথা। দুজনের মধ্যে চললো পিনপতন নীরবতা। কিছুক্ষণ পর জুহাইর বললো, “আমি আল্লাহর কাছে কি চাইতাম জানো ইচ্ছে?”
ইচ্ছে গভীর আগ্রহ নিয়ে বললো, “কি?”
“আমিও নেক্কার স্ত্রী চাইতাম, এতো কিছুর পরও আল্লাহ আমাকে ফেলে দেন নি। আমাকে ঠিকই একজন নেক স্ত্রী দিয়েছেন। এতো কিছুর পরেও এজন্য বলেছি, কারণ আল্লাহর সঙ্গে আমি যে নাফরমানী করেছি আল্লাহ চাইলেই আমাকে অনেক বড়ো বিপদে ফেলতে পারতেন৷ কিন্তু না, আমি একটা গভীর কুয়ায় আটকে গেছিলাম আর সেখান থেকে আল্লাহ কেমন আমায় তুলে এনে বাঁচিয়ে দিলেন৷ এসব ভাবলেই ভেতরটা অনুতাপে দগ্ধ হয় ইচ্ছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ছেলে মানুষ তো পারি না। হৃদয় টা বড্ড শক্ত। জানো, মাঝখানে তিনটা বছর আমার জীবনে এমন কিছু হলো, যা আমার জন্য পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। আল্লাহর প্রতি সবসময় তাওয়াক্কুল রাখা আমি কেমন করে যে হারামে লিপ্ত হয়ে পড়েছিলাম। নামাজ পড়তাম ঠিকই, কিন্তু কোনো আমলেই শান্তি অনুভব করতাম না। তোমাকে পাওয়ার পর ইদানীং, আবার আল্লাহর কাছে ফিরে এসেছি, প্রতিনিয়ত অনুতপ্ত হচ্ছি পূর্বের করা গুণাহর কথা স্মরণ করে। আল্লাহর রহমতে আগের মতো শান্তি ফিরে পেয়েছি, হৃদয় টা শীতল করে দিয়ছেন আমার আল্লাহ। এখন আমার একটাই চাওয়া, আল্লাহ্ আমাকে যেন শহীদ হিসেবে কবুল করেন। শহীদ হলে নাকি হাশরের ময়দানে আল্লাহ আমাকে আমার গোষ্ঠীর সত্তর জন মানুষের জন্য সুপারিশ করার সুযোগ দেবেন। যদি আমার গোষ্ঠীর কেউ জাহান্নামে যায়, তবে আমি তাদের জান্নাতে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবো।”
ইচ্ছে একটু অভিমানের সুরে বললো, “আর আমাকে বুঝি চান না? ওহ হ্যাঁ, শহীদদের জন্য তো আবার হুর আছে, একটা না, দুটো। হুরপরীদের রেখে আমাকে কেন চাইবেন? আমি তো আর হুর নয়!”
জুহাইর হেসে ফেললো। ইচ্ছের নাকে নাক ঘষলো। শিউরে উঠে ইচ্ছের শরীর অজানা অনুভূতিতে। হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে স্বামীর পড়নের শুভ্র রঙের পাঞ্জাবীটা৷ জুহাইর ওর কপালে চুম্বন করে, ইচ্ছে চোখ বন্ধ করে ফেলে আবেশে।
ইচ্ছে তারপরও নাক ফুলিয়ে বলে,“শুকনো কথায় চিড়ে ভিজবে না। সত্যিই তো হুরপরী পেলে আমাকে চাইবেন নাকি!”
জুহাইর ইচ্ছের নাক টেনে দিলো। বললো,
“আমার প্রাণের স্ত্রী, তোমাকে যেন আমি জান্নাতে আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে পাই। কোনো হুর লাগবে না। আমার তুমি হলেই হবে।”
ইচ্ছে মিষ্টি করে হাসলো, আর এই মুহূর্তে তাদের ভালোবাসার গভীরতা আরও একটু বেড়ে গেলো।
•
শিশির আজকের দিনটা অন্যরকম করে তোলার পরিকল্পনা করেছে। তার মুখে চওড়া হাসি, মনে প্রশান্তি। শিপা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, চোখে খুশির ঝিলিক। শিশির বলে উঠলো, “আজকে যত খুশি খরচ করো, কেউ তোমাকে বাঁধা দেবে না।” তার কণ্ঠে আত্মবিশ্বাসের ঝলক, যেনো সে আজ কিছুই আটকাতে দেবে না।
শিপার চোখ বড় হয়ে গেলো। তার মুখে খুশির আলো। সে এগিয়ে এসে শিশিরকে জড়িয়ে ধরলো। “সত্যি? এত টাকা কোথায় পেলে জানি?” তার কণ্ঠে মুগ্ধতা আর কৌতূহল।
শিশির মৃদু হাসলো। “আম দিয়েছি খাবে, আটি গুনে কি করবে?” তার ঠোঁটের কোণে খেলা করা হাসিটা রহস্যময়।
শিপা মাথা নেড়ে বললো, “হ্যাঁ, তাই তো। আমি এসব জেনে কী করবো। তোমার দেওয়া আনন্দই আমার জন্য যথেষ্ট।” তার গলায় ছিলো প্রশান্তি আর শিশিরের প্রতি গভীর আস্থা।
শিশির একটু থেমে বললো, “চলো আজ ঘুরতে নিয়ে যাবো তোমাকে। আজকের দিনটা কেবল আমাদের জন্য।” তার কণ্ঠে একটা প্রতিশ্রুতির সুর।
শিপা খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। “আমি এক্ষুনি তৈরি হয়ে আসছি।” বলেই সে ঘরের দিকে দৌড়ে গেলো।
শিশির দাঁড়িয়ে রইলো। তার চোখে এক ধরনের গর্ব আর আত্মবিশ্বাস। মনে হচ্ছিলো, সে যেনো সোনার পাহাড় পেয়েছে। রোজ রোজ টাকা নিয়ে অশান্তি করা ছেলেটা হঠাৎই এতো টাকা কোথায় পেলো খুশিতে থাকা শিপা একবারও জানতেও চাইলো না। অবাধ খরচা করতে চাইছে সে-সব নিয়েও প্রশ্ন তুললো না, কেবল মস্তিষ্ক লোভী হয়ে ঠিক ভুলের চিন্তা চেতনা চৈতন্য হারিয়ে গেছে।
•
বিকেল বেলার শান্ত পরিবেশে জুহাইর আর ইচ্ছে পাশাপাশি বসে আছে ভার্সিটির সেই পুকুর ঘাটে। বাতাসে ভেসে আসা হালকা শব্দ, পুকুরের জলে পড়ন্ত সূর্যের প্রতিফলন আর চারপাশের নিস্তব্ধতা, এক অদ্ভুত শান্তি এনে দিয়েছে তাদের মনে। ইচ্ছে দু’চোখ বন্ধ করে গভীরভাবে শ্বাস নিয়ে বললো,
“সবকিছু কী অপূর্ব লাগছে!”
জুহাইর মুচকি হেসে বলল, “তোমার থেকে কম!”
ইচ্ছে অবাক হয়ে তাকাল তার দিকে।
“হু?” কপাল ভাঁজ করে জিজ্ঞেস করল সে।
জুহাইর ঠোঁটে দুষ্টু হাসি নিয়ে উত্তর দিল, “আমার বউয়ের কাছে এই সব সৌন্দর্য তো নেহাতই ফিকে!”
ইচ্ছে ভ্রু কুঁচকে মুখ ভেংচি দিয়ে বলল, “ঢং!”
তার এই অভিব্যক্তি দেখে জুহাইর হেসে উঠল। ইচ্ছেও লজ্জায় চোখ নামিয়ে আনল। কিছুক্ষণ এভাবে কাটল তাদের মিষ্টি মুহূর্ত।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে শুরু করলে তারা উঠে দাঁড়াল। হাঁটতে হাঁটতে ইচ্ছে হঠাৎই পা হড়কে পড়ে যাচ্ছিল। জুহাইর দ্রুত হাত বাড়িয়ে তাকে ধরে ফেলল। আর একটু হলেই মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ত মেয়েটা। ইচ্ছে তখনো আঁকড়ে ধরে আছে তার বাহু।
“সাবধান!” বলল জুহাইর।
ইচ্ছে একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “ধন্যবাদ! কি যে হতো আপনি না থাকলে।”
“নিষ্ঠুর রমনীকে বাঁচানোর জন্য সে স্বামীকে ভালোও বাসলো,না।দিলো শুকনো ধন্যবাদ, হায় কপাল!”
“ভালোবাসা কিভাবে দিতে হয় মশাই?” এক চিলতে হাসি মেয়েটার ঠোঁটে।
ইচ্ছের কথা কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জুহাইরের নিচের দিকে নজর গেল। তার পায়ের কাছে একটা ফোন পড়ে ছিল। ফোনটা তুলে নিয়ে সে অবাক হয়ে বলল, “এই ফোনটা কার? এখানে এল কীভাবে?”
ফোনটা উল্টে-পাল্টে দেখতে লাগল জুহাইর। চোখে এক অদ্ভুত সন্দেহের ছাপ ফুটে উঠল। ইচ্ছে তার কাঁধে হাত রাখল, যেন জানতে চায়, “কিছু বুঝতে পারছি না। এখানে তো তেমন কেউ আসে না। তবে কার ফোন এখানে?”
জুহাইর তার দিকে তাকিয়ে বলল, “একদম নতুন ফোন মনে হচ্ছে । রিফ্রেশ করা। এখানে এমনভাবে পড়ে থাকা খুব অস্বাভাবিক। কী যেন একটা গড়বড় আছে।”
তার চোখে জিজ্ঞাসা, আর ইচ্ছের মুখে একটা অদ্ভুত অস্বস্তি। দু’জনের মধ্যে আবার নীরবতা নেমে এলো, যেন চারপাশের শান্ত পরিবেশের আড়ালে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে। জুহাইর ফোনটা উলটে পালটে দেখে ফেলে দিতে যাচ্ছিলো। ইচ্ছে তাকে থামালো। বললো,“স্যারদের কাছে জমা দিলে কেমন হয়?দেখি যদি কারোর ফোন হারিয়ে গিয়ে থাকে। হতে পারে সেখানে থেকে পেলো তারা!”
“কথাটা মন্দ বলোনি। তোমার ব্যাগে রাখো তবে!”
ইচ্ছে ওর ব্যাগে ভরে ফেললো ফোনটা। তখনই জুহাইরের ফোনে একটা কল এলো। জুহাইর ফোনটা ধরেই স্তব্ধ হয়ে খানিক দাঁড়িয়ে রইলো। ইচ্ছে ওর ভড়কানো চেহারা দেখে বুঝলো নিশ্চয়ই বড়ো কিছু হয়েছে। ইচ্ছে শুধালো,“কি হয়েছে জুহাইর?”
“ইচ্ছে, আমার প্রিয় স্যার হসপিটালে!”
#চলবে……