#তৃষ্ণা_তব_নাহি_মেটে
#পর্ব১৬
#রাউফুন
পুকুরপাড়ের নির্জনতা যেন ইচ্ছের মনকেও আরো ভারী করে তুলেছিল। বিকেলের আলো ম্লান হতে হতে সন্ধ্যার অন্ধকার সবটুকু জুড়ে বসতে শুরু করেছে। ইচ্ছে এখনো বসে আছে চুপচাপ পুকুর ঘাটে। জুহাইর ওকে একটি চিরকুটে লিখে জানিয়েছিল, পুকুরপাড়ে দেখা করবে, সেখানে কিছু চমক আছে। চমক তো ছিলো একটা, বড়ো জারুল গাছটার সঙ্গে একটা বড়ো দোলনা ফুল দিয়ে সাজানো। ইচ্ছে এমন কিছু ভাবেই নি। দোলনার উপর রাখা ফুল দেখে কতক্ষণ যে সেটা বুকে আঁকড়ে রেখেছিলো তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু সময় পার হচ্ছে, আর জুহাইরের দেখা মিলছে না। অপেক্ষার ক্লান্তি ও সন্দেহ মিশ্রিত এক অবস্থা নিয়ে সে পুকুরপাড়ের দোলনায় বসেছিল। দোলনায়পরাখা তাজা ফুল মিইয়ে গিয়েছে ঠিক তার মতোই, এগুলো জুহাইর রেখে গেছে ভাবতেই অদ্ভুত অনুভূতিতে শিউরে উঠে মেয়েটা।
ঠিক তখনই শিপার আগমন। তার উপস্থিতি ছিল ঝড়ের মতো, নীরব সন্ধ্যাকে হঠাৎ অস্বস্তিকর করে তোলে, গা ছমছমে একটা ভাইব পায় ইচ্ছে। শিপা একরকম রাগান্বিত তব এক পেশে হেসে শান্ত কণ্ঠে বলল, “জুহাইর এর জন্য অপেক্ষা করছো বুঝি?”
ইচ্ছে কোনো উত্তর দিল না। সে অনুভব করছিল, শিপার সঙ্গে কথার আদানপ্রদান এই মুহূর্তে কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না। তার চুপ থাকা যেন শিপাকে আরো ক্ষুব্ধ করে তোলে। শিপা জানে, ইচ্ছে এই মুহূর্তে জুহাইরের জন্য অপেক্ষা করছে, কিন্তু ওর আসার চিরকুট আসলে জুহাইরের লেখা নয়, বরং তার নিজের এক কৌশল। শিপা বুঝতে পেরেছে, ইচ্ছে এবং জুহাইর শিশিরের সত্যতা সামনে আনার চেষ্টা করছে। এটি তার এবং শিশিরের জন্য বড় একটি হুমকি।
জুহাইর ইতোমধ্যে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে, সে মফিজুর রহমান স্যারের টাকা নেয়নি, আর ফোনটি কুড়িয়ে পেয়েছে। এই ঘটনার সূত্র ধরে, শিশিরের আচরণ এবং ব্যাংক লেনদেন নিয়ে সন্দেহের দানা বেঁধেছে, পুলিশের কাছেও ব্যাপারটা যেতে সময় লাগবে না। শিপা বুঝতে পারছে, জুহাইর যদি সত্য উদঘাটন করে তবে তার স্বামী শিশির এবং সে দুজনই বড় ধরনের সমস্যায় পড়বে। শিপার মাথায় একটাই কথা ঘুরছিল—এই মুহূর্তে ইচ্ছেকে সরিয়ে দিতে পারলেই তাদের মানসম্মান রক্ষা হবে। এরপর ধীরে সুস্থে জুহাইরকেও সরিয়ে দেবে। কুটিল হাসে শিপা। ইচ্ছে হইতো ভাবতেও পারছে না কি কালো অধ্যায় এখন তার জীবনে ঘটতে চলেছে। ইচ্ছে খেয়াল করলো শিপা এখান থেকে যাচ্ছে না। সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুধালো,“আর কিছু বলবেন আপু?”
“হ্যাঁ বলার জন্যই তো এতোকিছু করলাম। শোনো, তোমাদের নাটক অনেক হয়েছে। তুমি হয়তো ভাবছো, জুহাইর তোমার মতো গরিব মেয়ে নিয়ে সুখে থাকবে? ও আমার মতো মেয়েকে এমনি পছন্দ করেছিলো ভেবেছো? আমার মতো সুন্দরী, এলিগেন্ট মেয়ে রেখে তোমার মধ্যে কি পেলো ঐ ভিখিরি টাই ভালো জানে। সে যাই হোক, ঐ ভিখিরি টা যা খুশি করুক, আই ডোন্ট কেয়ার। ওকে বলে দেবে ও যেনো আমাদের পেছনে তদন্ত করা বন্ধ করে। এতে করে তোমাদেরই ভালো হবে। ভালো ভাবে কথাটা শুনলে তো ভালোই, আনলেস…!” শিপা বলে।
“আনলেস? হোয়াট আপু?”
গা শিরশিরে বাতাস বইছে পুকুরের স্বচ্ছ পানিতে অল্প ঢেউ হচ্ছে বাতাসের তীব্রতায়। শিপা বাকে হেসে ফিসফিস করে ইচ্ছের কানের কাছে বললো,“জীবনের মায়া ত্যাগ করতে হবে মেয়ে!”
ইচ্ছে চুপ থাকে। ভেতরে ভেতরে ভয়ে তটস্থ হয়ে যায়। তার চোখে জ্বলজ্বল করছে সন্দেহ। শিপার এমন কথাবার্তা ওর মনে নানা প্রশ্ন জাগায়। শিপার আক্রমণাত্মক কণ্ঠ থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ওর মাথায় অন্য কোনো ষড়যন্ত্র খেলা করছে।
“আপনি এখান থেকে চলে যান আপু। নাহলে আমি লোক জড়ো করবো। ব্যাপারটা তখন আপনারই জন্যই হুমকিস্বরূপ হবে আপু!”
ইচ্ছের কালো হিজাবের উপর থেকেই শিপা মুঠ করে চেপে ধরলো ওর ঘন চুলে করে রাখা খোপা। কুকিয়ে উঠে ইচ্ছে। শিপা হিসহিসিয়ে বলে,“ভার্সিটিতে এখন কাকপক্ষীও নেই। যারা আছে হলের রুমে। এতো দূর থেকে তুই চেঁচিয়ে ম’রে গেলেও কেউ আসবে না।”
তবুও বাঁচার আসায় প্রাণপণে চিৎকার করে উঠলো ইচ্ছে। কিন্তু বেশি ফায়দা করে উঠতে পারলো না। কালো নেকাব দিয়ে ঠেসে ধরতে চাইলো ইচ্ছের মুখ। ইচ্ছে হাত পা দাপাদাপি করতে করতে শিপাকে আঘাত করতে চাইলো। কিন্তু প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিপা ঠিক নিজেকে বাঁচিয়ে নিচ্ছে। কোনো রকমে গোঙাতে গোঙাতে বললো,
“আপু, ছাড়ুন৷ আমি এখান থেকে চলে যাবো।”
ইচ্ছের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনতা পানি। নেকাবটা এক টানে সরাতে চাইলো শিপা। কিন্তু পারলো না। ইচ্ছে তা চেপে ধরলো দুইহাতে। অনুনয় বিনয় করে বললো,“যেতে দিন আপু!”
ভীতু মেয়েটা আরও মুষড়ে গেলো। শিপা ইচ্ছের ভয় টের পেয়ে হুহু করে মৃদু আওয়াজে হাসলো৷ ওর হাসিটাও কেমন যেনো গা ছমছমে। ইচ্ছের গা বেয়ে যেনো শীতল একটা স্রোত বয়ে গেলো। ভয়ের চোটে দরদর করে ঘামছে সর্বাঙ্গে। ততক্ষণে শক্তপোক্ত ভাবেই চেপে ধরেছে শিপা ওকে। ইচ্ছে সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়াতে চাইলো। কিন্তু শিপার শক্তির কাছে ও পেরে উঠলো না। শিপা আবারও পিড়াপীড়ি করতে করতে বললো,“আমার শক্তির সঙ্গে তুই পারবি? আমি ক্যারাটে শিখি, জীম করি। তোর মতো পাটকাঠি আমার সঙ্গে পেড়ে উঠবি ভাবছিস কেন?”
“বললাম তো আপু, যেতে দিন আমাকে। আমি জুহাইরকে বলবো যেনো কাউকে আপনাদের ব্যাপারে কিছু না বলে!”
“তোকে বিশ্বাস করে পাছে আমাকেই ঠকতে হবে। কি গ্যারান্টি আছে, এখান থেকে যাওয়ার পথেই পুলিশের কাছে যাবি না?”
ইচ্ছের ফোনটা বন্ধ হয়ে ব্যাগের মধ্যে পড়ে আছে। ফোন যেহেতু সে ব্যবহার করে না তেমন তাই চার্জ দেওয়ার কথাও মাথায় থাকে না। দুদিন আগে চার্জ দিয়েছিলো, জুহাইর প্রয়োজন ব্যতীত বাইরেও যাইনি, গেলেও অল্প সময়ের জন্য গিয়েছে। এর মধ্যে ইচ্ছে ফোন চার্জ করতেই হবে ব্যাপারটা মাথায়ই আসেনি। ইচ্ছে আকুতিভরা কন্ঠে বললো,“কথা দিচ্ছি বলবো না কাউকে। ছেড়ে দিন! আল্লাহর দোহায় আপু। এমন কিছু করবেন না যেনো ইহকাল, পরকাল দুটোই হারাতে হয়!”
“নীতি জ্ঞান শুনতে চাইনি আমি! তাছাড়া তুই জুহাইরের সঙ্গে সুখে থাকবি এটাও আমার সহ্য হয় না। অনেক দিনের ক্ষোভ তোর উপর।”
ইচ্ছে চিৎকার করে উঠলো আবারও। শিপা ওকে আর চিৎকার করার সুযোগ দিলো না। মুখ চেপে ধরে হঠাৎ শিপা এক ঝটকায় ইচ্ছেকে পানিতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।
ইচ্ছে পুকুরের পানিতে পড়ে যায়। তীব্র শীতল পানি ওকে ঘিরে ধরলো এক লহমায়, শিপা কোনো সুযোগ না দিয়ে পুকুরে নেমে ইচ্ছেকে পানিতে চুবিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল। তার হাতের চাপে ইচ্ছের দম বন্ধ হতে শুরু করে। ইচ্ছে প্রাণপণ চেষ্টা করছিল বাঁচার, কিন্তু তার দুর্বল হাত-পা শিপার শক্তির সঙ্গে পেরে উঠছিল না। ইচ্ছে বাঁচার চেষ্টায় যেটুকু পারছিলো মাথা তুলে চিৎকার করছিল, কিন্তু আশেপাশে কেউ ছিল না যে শুনতে পাবে। তার কণ্ঠস্বর পানির খলবল শব্দের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছিল। সে জোরে জোরে পা হাত পানিতে আঘাত করে শব্দ তোলার চেষ্টা করছিলো। সে কি ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পেরেছিলো, একটা নারী এমন ভয়ং’কর হতে পারে? দু-চোখ বন্ধ হওয়ার আগে কি একটাবার মানুষ টার মুখটা দেখতে পাবে না? প্রতিটি মূহুর্তে মানুষটাকে দেখার তৃষ্ণায় চোখ দুটো কাতর হয়ে আসছিলো৷ অথচ তার দেখা নেই। কেবল আওড়ে গেলো,“জুহাইর, আপনি কোথায়? এক বুক তৃষ্ণা নিয়ে যে আমাকে চলে যেতে হচ্ছে। দেখা দিন, আমার দু চোখের তৃষ্ণা যে ম’রনের পরেও রয়ে যাবে।”
পরপরই বিড়বিড় করে পড়লো,“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ!”(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম!)
কিন্তু ভাগ্যের ইশারায়, শারমিন, জাকিয়া, আর তুলি—তিনজন হল থেকে বেরিয়েছিলো। তাদের গন্তব্য ছিল পাশের বাজার। পুকুরের পানির অস্বাভাবিক খলবল আওয়াজ তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রথমে তারা কিছু বুঝতে পারেনি। ভয় পেয়েছিলো এমন অস্বাভাবিক শব্দে। কখনোই তো এমন শব্দ হয় না। তিনজনেই ভয়ে ভয়ে সামনে এগিয়ে গেলো। গিয়ে তারা দেখতে পায়, কেউ একজন কাউকে পানিতে ডুবাচ্ছে, আবার তুলছে। যেহেতু এখানে ঘুপচির মতো, গাছ পালা। সেজন্য খুব পরিষ্কার করে দেখা যায় না। তিনজনেই পানিতে নিজেদের ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বেলে ধরলো। লাইটেএ আলো পড়তেই শিপা চোখ মুখ কুচকে ফেললো। তুলি ভয়ার্ত গলায় বললো,
“শিপা আপা! আপনি কী করছেন?”
তুলি চিৎকার করে উঠল। সাথে জাকিয়া আর শারমিনও। তিনজনই নিজেদের হাত চেপে ধরলো।
শিপা মুহূর্তের মধ্যে থমকে গেল। তার চোখে একপলক ভয় আর বিস্ময় খেলে গেল। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে এটা বুঝতে পেরে সে দ্রুত পুকুর থেকে সরে দাঁড়াল। ওরা ভেসে উঠা দেহের দিকে দৌঁড়ে গেলো। তখনো ওরা জানে না আসলে কাকে এভাবে পানিতে ডোবানো হচ্ছে। টেনে তুললো তারা তিনজন সেই নিথর দেহটাকে। তিনজনেই রীতিমতো ভিজে গেছে। বোরখা পড়া দেখেই ওরা হতভম্ব হয়ে গেলো। জাকিয়া ক্রন্দনরত কন্ঠে বললো,“এটাতো ইচ্ছে, ওকে কেন মা’রছিলেন শিপা আপু?”
“ও বেঁচে আছে তো?” শারমিন জিজ্ঞাসা করল।
“জুহাইর ভাইকে ফোন দাও!” জাকিয়া বলল।
তুলি ইতোমধ্যে জুহাইরের ফোন নম্বর ডায়াল করছিল। একদিন ইচ্ছেকে নিয়ে হাসাহাসি করার জন্যই সে জুহাইরের নম্বর সংরক্ষণ করেছিল। কিন্তু আজ তা যে এভাবে কাজে লাগবে, সে স্বপ্নেও ভাবেনি। ফোনটি সংযোগের সঙ্গে সঙ্গে তুলি চিৎকার করে বলে উঠল, “জুহাইর ভাই, দ্রুত পুকুরপাড়ে আসুন! ইচ্ছেকে বাঁচান!”
এটুকু বলা হতেই শিপা তড়িঘড়ি করে ওর ফোনটা কে’ড়ে নিলো। জুহাইর ওপাশ থেকে হ্যালো হ্যালো করতেই শিপা ফোনটা ছুড়ে মা’রলো পুকুরের মধ্যে। হতচকিত হয়ে গেলো তিনজনই।
ততক্ষণে শিশিরের সব লোক এখানে এসে পড়েছে। প্রত্যেকের হলের সামনে গিয়ে শিশিরের লোকজন স্লিপিং স্প্রে করে এসেছে। সবাই এখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে বোধহয়। এসবই পূর্বপরিকল্পিত। শিপা বাকা হেসে বললো,“এই মেয়ে তিনটে দেখে ফেলেছে আমায়৷ ওঁদের আগে ধরো।”
“কি করেছো তুমি?”
শিশিরের প্রশ্নে শিপা বলল,“খুব,দাপাচ্ছিলো৷”
“মে’রে দিয়েছো? কাউকে মা-রার প্ল্যান কিন্তু আমাদের ছিলো না।”
“বেশি, ফটর ফটর করছিলো। মাথা ঠিক ছিলো না আমার।”
“এমনি সর্বক্ষণ পুলিশ আমাদের উপর নজরদারি করছে, তারপর তুমি এরকম বড়ো একটা ম্যাসাকার করে ফেললে? একবারও ভাবলে না এরপর কি হবে? জেলে পঁচে ম’র’তে হবে!”
শিপা ঘামতে লাগলো এমূহুর্তে। ইচ্ছের নিথর দেহখানা মাটির সঙ্গে একদম মিশে আছে। দুটো চোখ এখনো বন্ধ হয়নি, দেখে মনে হচ্ছে কাউকে দেখার আকুলতা সেই খোলা চোখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
#চলবে