#তৃষ্ণা_তব_নাহি_মেটে
#পর্ব১৮(অন্তিম পর্ব)
#রাউফুন
প্রান্তর মুখে খু’নের ঘটনা শুনেই মালিহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জুহাইর তার নিজের বড়ো চাচার ছেলে। তার ভাই, বুকের ভেতর একটা শূন্যতা ঘিরে ধরে মালিহার। বললো,“এই জন্য আপনি এসব হ’ত্যা করেছেন?”
প্রান্ত বলে,
“ইসলামে প্রাণের বদলে প্রাণ নেওয়া জায়েজ আছে। আমি সেটাই করেছি। আমার বন্ধু আর তার স্ত্রীকে এভাবে কেন মা’রলো ওরা? আমার বন্ধু তো নির্দোষ ছিলো সম্পুর্ন! ওরা টাকা নিয়ে অসহায়, সহজ সরল আমার বন্ধুকে ফাসিয়ে দিলো? আর যখন সত্যটা প্রকাশ করতে চাইলো তখন ওকে দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দিলো। ওঁদের জন্য মৃত্যুই শ্রেয়।”
“মিষ্টার প্রান্ত, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার জন্য আপনাকে গ্রেফতার করা হবে জানেন?”
“আইন মাই ফুট! যে আইন আমার ভাইয়ের মতো বন্ধুর হ’ত্যার সঠিক বিচার করতে পারে না সেই আইন আমি মানি না। আর রইলো আপনার কাছে স্বীকার করা, আমার কার্যসাধন হয়ে গেলে আমি স্বয়ং ধরা দিতাম!”
মালিহা কিছু বলে না। কেস সংক্রান্ত কথা বলতে বলতে ওরও ভেতরটা কেমন করে উঠে। একটা ভারী শ্বাস গলা চিড়ে বেরিয়ে আসে। প্রান্তকে সে যেদিন প্রথম নিজের বাড়িতে জুহাইরের লাশ হাতে পৌঁছায়, তখনই দেখে তাকে। তারপর প্রায়ই প্রান্ত তাদের বাড়িতে যেতো। আস্তে আস্তে মালিহা তাকে পছন্দ করে। মালিহা হচ্ছে জুহাইরের চাচার এক মাত্র মেয়ে। শিশির আর শিপার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে প্রান্তর যে হাত আছে সে তা টের পায়। সেজন্যই রেস্টুরেন্টে ডেকে আনে। মালিহা বলে,“আমি যদি বলি, আপনাকে আমি জেলে যেতে দেবো না, তাহলে?”
“একটা খু’নিকে কেনই বা বাঁচাবেন?”
“ভালোবাসি বলে!”
মালিহার অস্ফুটস্বরে খানিকটা ভ্রুকুটি হলো প্রান্তর। মালিহা ওর তীক্ষ্ণ চোখের চাহনী দেখে অপ্রস্তুত হাসে। পরপরই বলে,“মুখ ফসকে বলে ফেলেছি!”
“ঠিক আছে।”
নির্বিকার প্রান্ত উঠে দাঁড়ায়। একটা মেয়ের চোখের চাহনী ছেলে হয়ে বুঝবে না? ও জানে মালিহা ওকে পছন্দ করে। কিন্তু ওর জীবন এখন অন্য মোরে, তারপর ও কখনোই হারামে জড়াবে না। কেসের স্বার্থে মালিহার সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে। আর ও যদি বেঁচেও যায় তবুও ও কখনোই মালিহাকে বিয়ে করবে না। প্রথম কারণ মালিহার উচ্চ বিলাসিতা আর জুহাইরের কাজিন, আর দ্বিতীয় মালিহা পর্দাশীল নয়। প্রান্ত ঘড়ি দেখতে দেখতে বলে,“আমাকে যেতে হবে!”
“কোথায়?”
“আপনাকে বলবো কেন?”
“বলতে না চাইলে বলবেন না। কিন্তু আমি জানতে চাইলাম নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে তাই না? কোথায় যাচ্ছেন বলুন, শুনি।”
“কবরস্থানে, আপনি যাবেন?”
“যাবো। আমার ভাইয়ের কবরস্থান আর আমি যাবো না?” কোনো কিছু না ভেবে মালিহা বললো। মালিহা ভীষণ শক্ত ধাতুর মেয়ে। ওর সহজে কাঁন্না আসে না৷ এই যে প্রান্তর মুখে জুহাইরের মর্মান্তিক মৃ’ত্যুর ঘটনা শুনলো, অথচ চোখে এক ফোঁটা অশ্রু ঝিলিক দিয়ে উঠলো না। নিষ্ঠুরতার প্রমাণ নয় এটা? হৃদয়টা পাথরে গড়া যে তার।
প্রান্ত হাঁটা ধরলো, পেছনে মালিহা৷ তুলির তোলা ছবি দেখে শিশিরকে শনাক্ত করা হয়। পুলিশ শিশিরের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, লেনদেন এবং গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করা হয়। তবে এসব প্রমাণ ধোপে টেকে নি। জুহাইরের চাচা নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করতে চাইলেও প্রান্ত আর দেয়নি। যেহেতু একবার শিশির আইনের হাত থেকে ফসকে গেছে তবে থাক। জুহাইরের চাচা চাইলেই কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারতেন কিন্তু প্রান্তর বাঁধায় আর করেন নি। কেবল প্রান্ত যা বলেছে সে নির্দেশনা মোতাবেক কাজ করেছে। যত টাকা লাগবে এর একটা বিহিত করতে চেয়েছিলেন । নিজের রক্তের, নিজের ভাইয়ের ছেলের এমন পরিণতি তিনি মানতে পারেননি। কোথাও না কোথাও নিজেকে দায়ী করেন। জুহাইরের তখন বয়স কত? আঠারো বয়সি ছেলেটা। এসএসসি দিয়ে কিছুতেই সে আর ইন্টার মিডিয়েট ভর্তি হতে চাইলো না। গড়িমসি করে দু বছর কাটালো। পড়াশোনা সে করবে না। সে করবে ব্যবসা। তার বাবার এতো সম্পত্তি আছে তবে সে এতো কষ্ট কর পড়াশোনা কেন করবে? এসব নিয়ে একদিন অনেক ঝামেলা হলো৷ বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে ছেলেটা। আর ফেরেনি। সাত বছর পর যখন ফিরলো একেবারে লা’শ হয়ে? প্রান্ত স্বয়ং গিয়ে জানালো এসব৷ তখন কেউ-ই মানতে পারে নি। পুলিশ সমস্ত প্রমাণের ভিত্তিতে শিশিরকে ধরলেও নিজের অর্জিত সমস্ত টাকায় শিশিরের বাবা তাকে ছাড়িয়ে নিলেন। এতে জুহাইরের চাচা কেন কিছু বলেনি?অর্থ, ক্ষমতা সবকিছু থেকেই তিনি এগিয়ে তবে কেন কিছু করেন নি? কারণ টা অবশ্যই প্রান্ত। প্রান্ত ওদের তিলে তিলে শেষ করতে চেয়েছিলো৷ মালিহা আর শিশির কবরস্থান পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হলো। মালিহা একটু ভয় পেলো। প্রান্তর হাত চেপে ধরলে প্রান্ত ধারালো চো’খে তাকালো। মালিহা কবরস্থানের নির্জনতার চাইতে প্রান্তর চাহনীতে ভয় পেলো৷ ভীত স্বরে বললো,“এভাবে তাকাচ্ছেন কেন?”
“আমার হাত স্পর্শ করেছেন কেন? আমি আপনার জন্য সম্পুর্ন নিষিদ্ধ, পরপুরুষ এর সঙ্গে যেখানে কথা বলা নিষেধ সেখানে এতো দূর অব্দি এসেছেন? শুনেছি আপনারা ধর্মে অগাধ আস্হা। তা সবাই ভালো হলে আপনি এমন কেন?”
মালিহা একেবারে বেপর্দায় থাকে তা বলা ভুল হবে। সে হিজাব পড়ে তবে একেবারে খাস পর্দায় সে থাকেনি। বাবা মায়ের অবাধ্যই বলা চলে মেয়েটা। বলে,“আমি এভাবেই চলাচল করি। যদি আপনি আমায় বিয়ে করেন তবে আমি কথা দিচ্ছি আমি খুব ভালো বউ হবো!”
প্রান্ত চ বর্গীয় শব্দ করে বিরক্তিতে। জুহাইরের মৃত্যুর আজ আট মাস। গতকাল শিশির শিপার পর্ব ইতি ঘটেছে। তিলে তিলে ওদের শেষ করেছে প্রান্ত৷ ও এর জন্য এতোটুকুও রিগ্রেট ফিল করছে না। বরং আলাদা একটা শান্তি ওর মনে কাজ করছে। প্রান্ত কবর জিয়ারত করছে। মনে বলছে,“জুহাইর, আমার ভাই তোকে খু’ন করা ব্যাক্তিদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছি। আমি কথা রেখেছি। ওদের বাঁচতে দেখলে আমার কলিজা কামড়ে ধরতো৷ সারাজীবন মৃ’ত্যু যন্ত্রণা দিলেও তো ওরা বেঁচে থাকতো, তাই না? সেটা আমার সহ্য হতো না। তাই একেবারে চ্যাপ্টার ক্লোজ করে দিয়েছি। খুশি তো তুই?”
জুহাইরের কবরটা ইচ্ছের কবরের পাশেই দেওয়া হয়েছে। প্রান্তর চোখ জ্বালা করছে। কেবল নিজের নরম সত্তাকে বাইরে আসতে দিতে চাইছে না মালিহার সামনে। কবির জিয়ারত শেষ হলে ওরা ফিরে আসছে। মালিহার সঙ্গে গাড়ি আছে। প্রান্ত গাড়িতে যাবে না আর। হাঁটা ধরে উল্টো পথে।
“কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”
মালিহা তড়িঘড়ি করে পথ রোধ করে প্রান্তর। প্রান্ত জবাব দেয় না। হাঁটতে থাকে কেবল। মালিহা আবারও নির্লজ্জের মতো শুধায়,“বলুন কোথায় যাবেন? আমি পৌঁছে দিই?”
“নো নীড!”
“প্লিজ প্রান্ত, রাতের বেলা একা একা যাবেন না। বিপদ হতে পারে আপনার।”
বিপদ আর তার? এখন বিপদরাই তাকে ভয় পায়। প্রান্ত হাসে কেমন অদ্ভুত ভাবে। মেয়েটা কি জানে? তার হারানোর মতো আর কিছু নেই? প্রান্তর বাবা মা বাইরে থাকে। ওর বয়স যখন বারো কি তেরো, তখন থেকেই সেপারেশনে আছে। দুজন দুজনের প্রতি বিরক্তি থেকে নাকি এই আলাদা থাকা। অথচ তাদের মধ্যে ডিভোর্স হয়নি। তাদের এই সেপারেশনে জীবনটা নষ্ট হলো ছোট্ট কিশোর প্রান্তর। নানা বাড়িতে মানুষ হয় সে। তার কালো অন্ধকারে ঢাকা জীবনে জুহাইর ছিলো এক টুকরো আলো। যার জন্য প্রান্ত সব করতে পারতো। জুহাইরের নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় প্রান্তর জীবনটা কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়। ভাইয়ের মতো ভালোবাসার এই বন্ধুকে অকালে হারিয়ে প্রান্ত এখন নিঃস্ব। মালিহা সমানে প্রশ্ন করছে অথচ প্রান্তর মাঝে কোনো হেলদোল নেই। মালিহা বললো,“চলুন না বিয়ে করে ফেলি? আমি নিজেকে বদলাবো প্রমিস!”
মালিহার কথায় প্রান্ত বলে,“সেই সৃষ্টিকর্তার জন্য বদলান যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন, নিজের জন্য বদলান, পরকালের স্বার্থে বদলান। ইহকালীন স্বার্থ আছে তাতে না জড়িয়ে পরকালের স্বার্থে বদলান। আমি, আমরা, সকলেই তো কয়েকদিনের অতিথি এই দুনিয়ার। দুনিয়াবি কোনো চিন্তায় আমি করি না।”
“আমি আপনার অপেক্ষায় থাকবো।” মালিহা করুণ স্বরে বলে। প্রান্ত শুনতে পেয়েও পিছু ফিরে না। কেবল অস্ফুটস্বরে খানিকটা সময় নিয়ে বলে,
“আপনার অপেক্ষারা কেবলই বৃথা। আমি কারোর মায়ায় জড়াই না, হইতো মায়া বাড়াই কেবল!”
মালিহা কেবল তাকিয়ে থাকে হেলেদুলে যাওয়া প্রান্তর পাণে৷ ওর চোখ ছলছল করে, চোখে হাত দিয়ে দেখে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তার হৃদয় শক্ত নয় তবে? না হলে কয়েকদিনের পরিচিত একজনের জন্য চোখে কেন পানি আসবে? এই অশ্রুর নাম কি? ভালোবাসা?
#সমাপ্ত