তেইশতম বসন্ত পর্ব-০৪

0
11

তেইশতম বসন্ত
পরিসংখ্যা ৪
লেখনীতে – Azyah(সূচনা)

কি ভয়ানক ব্যাপার-স্যাপার!সামনে দাঁড়ানো মানুষটা?যাকে এতদিন বখাটে বখাটে বলে বকাঝকা করে গেছে সেকিনা একজন আর্মির ক্যাপ্টেন। ফাহাদ বলে খুশবুর মস্তিষ্ক নাকি ছোট।এই ছোট মস্তিষ্কটা জানান না দিয়েই অচল হয়ে পড়লো।সামনে থাকা মানুষটার প্রতি রাগের বিপরীতে ভয় কাজ করতে শুরু করেছে।আরেকবার নজর তুলে তাকালো আফতাব এর দিকে।ছোটছোট আর্মি কাট চুল।মুখে দাঁড়ির পরিমাণ একদম স্বল্প।পেছনের বাড়ির আলোয় শ্যামলা তেলতেলে মুখটা চিকচিক করছে। দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ পকেটে হাত গুজে।বলিষ্ঠ দেহের গড়ন।এক সেকেন্ড সময় নেয় খুশবু।মনে মনে ‘ এক,দুই, তিন’ গুনে উল্টো ঘুরে নাকে মুখে দৌড় লাগিয়েছে।পিছনে ঘুরে দেখার সুযোগ নেই একদম!আকষ্মিক খুশবুর এমন কান্ড দেখে ভড়কে উঠে আফতাব।

পকেট থেকে হাত বের করে সতর্কতা অবলম্বন করার জন্য দ্রুত সুরে বললো, -“ধীরে যান….খুশবু!”

মেয়েটি ফিরেও চাইলো না।এক দৌড়ে ঘরের ভেতরে গিয়ে হাজির। জোরেশোরে ধাক্কা খায় জরিনা বেগমের সাথে। অকস্মাৎ গায়ের সাথে করো সংঘর্ষ হওয়ায় জরিনা বেগম বললেন,

-“ইয়া আল্লাহ…খুশবু!কিতা অইছে?এমন দৌড়ান দিলি কেনে?”

-“ভুত দেখেছি নানু”

কপালে হাত রাখলেন জরিনা বেগম।দুআ দুরূদ পড়ে খুশবু গায়ে ফু দিতে লাগলেন।বললেন,

-“আমরার ঘরের পেছনের জায়গাটা ভালা না।জ্বীন পরীর আছর আছে।কেন গেছিলি?”

খুশবু হেঁসে ফেলে।ঠোঁট টিপে নানীর ভীত মুখের দিয়ে চেয়ে বলে উঠলো,

-“ভুত দেখতেই গিয়েছিলাম।”

-“কি কয় এই ফুরি?মাথা গেছে নাকি?” অবাক সুরে বললেন জরিনা বেগম।

-“উফ নানি।কিছু হয় নি।দেখি সরো ঘরে যাবো আমি”

ঘরে এসে বিছানায় ধপ করে বসে পড়লো খুশবু। অভদ্র চিন্তা মস্তিষ্কে ঘুরপাক শুরু করলো।ছোটোবেলা থেকেই তার পছন্দ সেনাবাহিনী।নিজেও চেয়েছিলো এই পেশায় যোগ দিতে।তবে তার অলসতা তাকে সেই অনুমতি প্রদান করেনি।শেষমেশ কিনা আর্মি তার সাথে চোর পুলিশ খেললো?

ফোন বাজে। নাম্বারটা এখন আর অপরিচিত লাগছে না।ভয়ে ভয়ে ফোন রিসিভ করলো খুশবু।

আফতাব বলে উঠলো, -“এভাবে কেউ দৌড় দেয়?পড়ে গেলে কি হতো?”

কথার তালে তালে মনের কথা মুখ ফুটে বলে ফেললো, -“কি হতো?হাত পা ভেঙে যেতো”

-“কিহহ!” আফতাব এর বিস্মিত কন্ঠস্বর।

মিনমিনে গলায় খুশবু বলে, -“আপনি ডিফেন্সের লোক আগে বলবেন না?”

-“আগে বললে কি হতো খুশবু?”

-“ভয় পেতাম না আর একটু সম্মানও দিতাম।”

ঠোঁট প্রসারিত করে হাসির দেখা ফুটে।ঘরে এসে আরাম করে শুয়েছে। ঘাড়ের পেছনে এক হাত রেখে।বললো,

-“আপনি আমাকে বখাটে হিসেবেই জানুন সমস্যা নেই”

-“সরি” বলে উঠলো খুশবু।

-“কেনো?”

-“প্রথমত বুকে ধাক্কা দিয়েছি আপনার। দ্বিতীয়ত বখাটে বলেছি।আবার হুমকি ধামকিও দিয়েছি।”

আফতাব ঠান্ডা গলায় বলে, -“সর্বপ্রথম আমি একজন মানুষ।তারপর আমার পেশা।অবশ্যই আমার আসল পরিচয় না জানলে আমাকে বখাটে হিসেবেই গণ্য করতেন।আমার জায়গায় অন্য পেশার কেউ হলে তাকে বকাঝকা করতেন…..আমি জানি আমার ওয়ে’টা ভুল ছিলো।এমন একটা পেশায় থেকে অপরিচিত একটা মেয়েকে কল করা বাজে দেখায়।…..কিন্তু ঐযে বললাম সর্বপ্রথম আমি একজন মানুষ।আর মানুষের মাথায় কোনো কিছুর ভুত চাপলে সে বখাটেও হতে প্রস্তুত”

আফতাব এর অতশত জ্ঞান মাথায় নিলো না খুশবু।তার মধ্যে যে প্রশ্নটা ঘুরছে সেরা মুখে এসে হাজির।আফতাবের কথা শেষ করার সঙ্গেসঙ্গে খুশবু বলে,

-“আপনি আমার বাড়ি চিনলেন কি করে?”

-“ঘরের পাশে মানুষ রেখে এদিক ওদিক খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম।কি অদ্ভুত না সৃষ্টিকর্তার কোইনসিডেন্স?”

-“আপনাকেতো কখনো দেখলাম না?”

-“আমি এখানে থাকলে না দেখবেন। ছুটিতে আসি বাসায়।তিনদিন আগে এসেছিলাম জানেন।সেদিন বাড়ি ফেরার পর এতটা সৌভাগ্য হবে আমি ভাবিনি।আচমকা আপনাকে দেখে কিছু সময়ের জন্য ক্লুলেস ছিলাম।সেদিন রাতেই ফিরে যাই ক্যাম্পে।ফোন করেছিলাম আপনাকে আপনিতো ফোনটাই রিসিভ করলেন না।”

খুশবু আনমনে মুখ বেঁকিয়ে বললো, -“একটা মেয়েকে কল করে বিরক্ত করলে কেই ফোন তুলবে?”

-“এখন বিরক্ত হচ্ছেন?”

চুপ বনে গেলো আকস্মাৎ। দ্বিধা দ্বন্দ ভুলে দিব্যি আলাপ চলছে তাদের।কই? আজতো এই বখাটের প্রতি বিরক্তির ‘ব’ ও আসলো না।নাকি মনের মধ্যে সেনাবাহিনীর ভয় এসে গেছে?

ভাবনায় ডুবে থাকা খুশবুর হুশ ফিরে আফতাব এর ডাকে।বলে,

-“খুশবু?”

-“জ্বি?”

-“কাল আবার আসবেন টিলায়?”

-“কেনো?”

মৃদু হেঁসে আফতাব জবাব দেয়, -“দেখা হলো কিন্তু কথাতো হলো না”

___

ফাহাদ বাড়ি ফিরেছিলো বেশ রাত করে।ঠিক এই খবর পৌঁছে গেছে লোকমান সাহেব এর কানে।ফোন করে খানিক রাগারাগি করেছেন।সকাল হতে না হতেই মেজাজ ত্যক্ত বিরক্ত।জানালার পাশে কাকের মধুর সুরে রেগে গেলো ফাহাদ।তেড়ে এসে ভাগিয়ে দিয়েছে সুরেলা কন্ঠের গায়ককে।এত সুরেলা আওয়াজ তার পছন্দ হচ্ছিলো না।ফোন হাতে নিয়ে হাই তুলতে তুলতে ফেসবুকে এসেই চোখে পড়ে নতুন ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট। নেহা জামান।ছবি দেখে ঠিক চিনে ফেলে মেয়েটিকে।এটা নোমানের বোন।তাকে রিকোয়েস্ট দিয়েছে?মনের সর্বপ্রথম প্রশ্ন এটাই।পরিচিত হিসেবে একসেপ্ট করে নেয় ফাহাদ।ঠিক তখনই মেসেজ আসে।

-“আসসালামু আলাইকুম”

ফাহাদ স্বাভাবিকভাবেই জবাব দিলো, -“ওয়ালাইকুম আসসালাম।”

-“আপনি কি ব্যস্ত?”

ফাহাদ উত্তর দিলো, -“নাতো। কেনো?”

-“ভাইয়া বলেছে আপনি প্রফেশনাল এডিটর।যদি কিছু মনে না করেন একটা রিকোয়েস্ট করতাম?”

-“শিউর”

-“আমাদের সবার জাফলং এর ছবিগুলো এডিট করে দিবেন প্লিজ” নেহা জবাব দিলো।

ফাহাদ মুচকি হাসে। খাবার টেবিলের দিকে পা বাড়িয়ে লিখলো,

-“দুটোদিন সময় দিন?আমি পাঠিয়ে দেবো কেমন?”

-“থ্যাংক ইউ….আর হ্যাঁ!আমাদের বাড়িতে আপনার দাওয়াত। খুশবু আপুকে সাথে নিয়ে আসবেন।”

-“অবশ্যই ধন্যবাদ আপনাকে।”

ব্রাশ মুখে দিয়ে পেছনের দরজা বেয়ে টিলায় উঠে দাঁড়ায় ফাহাদ। দাঁত মঞ্জন আর কড়া রোদের মধ্যে ঠান্ডা বাতাস বেশ লাগছে।আনমনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে উপলদ্ধি করলো সেখানে সে ব্যতীত অন্য আরেকজনের উপস্থিতি আছে।কফির মগ দূর্বা ঘাসের উপর রেখে সেও আনমনে বসে।একে অপরকে দেখে বিনয়ের হাঁসি ছুড়লো।কিছু সময়ে নীরব থাকার পর আফতাব উঠে আসে।

বলে, -“আপনারা এখানে নতুন?”

ফাহাদ মুখ ভর্তি ফেনা নিয়ে উত্তর দিতে পারছে না। পাশে ফেলতে চাইলে আফতাব আটকায়।বলে,

-“নো!…আপনি মুখ ধুয়ে আসুন বাড়ি থেকে।আমার উত্তর দেওয়া মেন্ডেটরি নয়।”

লজ্জিতবোধ করলো ফাহাদ।এতবড় হয়েছে শালীনতায় তারপরও পিছিয়ে।হাতের ইশারায় আফতাবকে অপেক্ষা করতে বলে ঘরে চলে যায়।মুখ ধুয়ে তাওয়াল হাতে পূনরায় ফিরে আসলো।

বললো, -“সরি..”

-“ইটস ওকে।আপনি আমার কথায় কষ্ট পেয়েছেন?…আমি বললাম কারন সুন্দর পরিবেশটা অযথা নষ্ট হতো।”

ফাহাদ মাথা দুলিয়ে জবাব দিলো, -“না আমি কষ্ট পায়নি।বরং আমাকে শুধরে দিলেন ভালো লাগছে।আগামীবার থেকে আপনার বারণ মনে থাকবে।”

স্মিথ হাঁসে আফতাব।ফাহাদ আবার বললো,

-“আমরা এখানে নতুন না।বেড়াতে এসেছি এই বাড়িতে।নানি বাড়ি।ঢাকা থাকি আমরা।”

হাঁসিটা সরে যায় ঠোঁট থেকে।ফাহাদের মুখ ভালোভাবে দেখলো।এই বাড়িতেতো খুশবুও থাকে।সেই সূত্রে ফাহাদকে চেনার চেষ্টা করলো।মস্তিষ্কে চাপ দিয়ে মনে করতে লাগলো সেদিন সাদা পাথরের কথা।তবে কিছুই মনে পড়ছে না।সম্পূর্ণ খুশবুর মুখে মনোযোগ থাকলে আশপাশের মানুষের কথা মাথায় আসবে কি করে?

আফতাব প্রশ্ন করলো, -“ফ্যামিলিসহ এসেছেন?”

-“এসেছিলাম।আমার বাবা মা ফিরে গেছেন।আমি আর আমার ছোট বোন আছে এখন”

বুঝতে পারলো আফতাব।ফাহাদের দিকে চেয়ে বলল,

-“আমাকে চিনেছেন?”

-“আপনি?”

খানিক শব্দ করে হেসে বললো, -“সাদা পাথর গিয়েছিলেন?আপনার বোন সেখানে কি কান্ড ঘটিয়েছিলো মনে আছে?আপনারাই ছিলেন।”

সাদা পাথরের ঘটনা মনে পড়ছে কিন্তু আফতাবকে চিনলো না।ফাহাদ বললো,

-“ঠিক চিনছি না।”

আফতাব হাত এগিয়ে দেয় হ্যান্ড শেক করার উদ্দেশ্যে।বলে, -“আমি আফতাব।সেদিন সাদা পাথরে ডিউটিরত অফিসারদের মধ্যে আমিও ছিলাম”

ভ্রুদ্বয় উচু করে ফেলে ফাহাদ।বুঝতে পারলো সেদিন তার বোন আর্মিদের সাথে ছোটোখাটো ভয়ানক কান্ড ঘটিয়েছিল।অবাকের চরম পর্যায়ে এসে ফাহাদ হাত এগোয়।

বলে, -“হোয়াট আ কোইনসিডেন্স!আমি ফাহাদ চৌধুরী”

-“দেখা হয়ে ভালো লাগলো।”

-“আপনি এখানেই থাকেন?”

আফতাব তার ঠিক পেছনের বাড়িটা দেখিয়ে বললো,

-“ওটা আমাদের বাড়ি।অফ ডিউটিতে আসি।”

ফাহাদ হেঁসে বলে উঠলো, -“আমার বোনের কাজে কিছু মনে করবেন না।একটু ছটফটে স্বভাবের মেয়ে।”

-“ইটস ওকে।”

-“আসি তাহলে।ফ্রি থাকলে আমাদের বাড়িতে আসবেন।আমার বোন আবার আর্মির বিশাল বড় ভক্ত।”

আফতাব আলগোছে হাসে।আর্মির ভক্ত?কই গতকালতো কিছু বললো না।ভয়েই অর্ধেক শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিলো সেই মেয়ে। অন্যদিক জানালায় উকি দিয়ে শুকনো ঢোক গিলছে খুশবু।এই বখাটে ক্যাপ্টেন এর সাথে ওর ভাই কি করে?তাদের এত কথা হচ্ছে কেনো?আবার বলে দিলো নাতো কিছু?এমনেতেই সাহিরের ব্যাপারে ভীষণ ক্ষেপে ফাহাদ।তারমধ্যে উদয় হয়েছেন এই মহোদয়।

খুশবু কোনোকিছু না ভেবেই ফোন মেলায় আফতাব এর নাম্বারে।ফোন রিসিভ হওয়ার সাথে সাথে ভয় ভীতি সরিয়ে বলে উঠলো,

-“আপনি কি ভাইয়াকে সব বলে দিয়েছেন?কি কথা বলছিলেন তার সাথে?”

-“বলার মতন কিছু আছে খুশবু?”

-“আছে না এইযে?আমরা একে অপরকে চিনি।আপনি আমাকে বিরক্ত করেন।”

-“বিরক্ত করি?”

-“না মানে…”

-“কিছু বলেছি কিছু বলিনি। নিশ্চিন্তে থাকুন।আপনার ভাই আমাকে আপনাদের বাড়িতে দাওয়াত করেছে জানেন?”

চক্ষু চড়কগাছ খুশবু।অল্প সময়ের বার্তা বিনিময়ে নিমন্ত্রণ আদান প্রদানও হয়ে গেলো?খুশবু প্রশ্ন করলো,

-“আর?”

-“আর সে বললো আপনি নাকি আমার বিশাল ভক্ত”

-“মিথ্যে কথা!আমি আপনার ভক্ত হতে যাবো কেনো?” চেঁচিয়ে বলে খুশবু।

ঠোঁট কামড়ে ধরে আফতাব।অস্থির খুশবুকে সময় দিলো।পরপর বলে উঠলো,

-“আপনার ভাই-ই বললো আপনি নাকি বোকা,নির্বোধ, ছটফটে।আর্মিদের খুব পছন্দ করেন।তাহলে আমিও আপনার পছন্দের তালিকায় তাই না?”

-“না না আপনি ভালো আর্মি না।”

কি অবলীলায় বলে ফেললো!মুখের উপর। ভয়ভীতি সব পাশ কাটিয়ে গেছে বোধহয়। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললো,

-“আমার ছুটি আছে দুইদিন।আপনার ব্যস্ততম সময় থেকে আমাকে পাঁচ দশ মিনিট দিতে পারবেন?”

নারীদের বুঝশক্তি নাকি প্রখর হয়।খুব দ্রুতই বুঝে উঠতে পারে বাস্তবিকতা।উপলদ্ধি করতে পারে।তবে স্বীকার করেনা। আফতাবের গলার আওয়াজ ঠিক তার হৃদয় বেয়ে আসছে।শান্ত ঠান্ডা স্বভাবের মনে হলো।সেতো নিজেও পরিষ্কার কিছু বলছে না।তবে?

-“ওয়েদার ফরকাস্টএ দেখলাম আজ সন্ধ্যার পরিবেশ শীতল থাকবে।আর টিলার উপরে যে জোরালো বাতাস বয় সেটা সত্যিই উপভোগ করার মতন।”

-“তো?”

-“হিম অমত্ত সন্ধ্যায় আমাকে অপেক্ষারত পাবেন সেখানে”

__

মামীকে কিছুটা চিন্তিত দেখাচ্ছে।ছোট কাঁধ ব্যাগে কাপড় নিচ্ছেন। কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতি হয়তো। খুশবু এগিয়ে গিয়ে তার পাশে বসলো।মুখ পর্যবেক্ষণ করলো কিছু সময়।তার চিন্তার কারণ জানার জন্য মন উসখুস করে উঠে।

বলে, -“কি হয়েছে মামী?”

-“আব্বার শরীর ভালো না।কিছুই ভালো লাগছে না খুশবু”

-“আপনি বাড়ি যাচ্ছেন?মামা কোথায়?”

-“তোমার মামা উপশহর গেছেন।আজ নাকি ফিরতে পারবেন না।কিন্তু বাবা আমাকে দেখতে চাচ্ছেন বারবার।”

খুশবু প্রশ্ন করলো, -“সন্ধ্যা নামছে মামী একা যাবেন?”

-“কি করবো আর বলো?”

-“ভাইয়াকে নিয়ে যান মামী।একা যাওয়ার দরকার নেই।”

রূপার বুদ্ধি খেললো।এটাই ভালো উপায়।ফাহাদকে সাথে নিয়ে যাওয়া।সে নিজে রাস্তা চেনে। ফাহাদ একজন ছেলে মানুষ।সাথে থাকলে আর কোনো সমস্যা হবে না।

তারপরও বললেন, -“তোমরা একা থাকবে?”

-“সমস্যা নেই মামী।আপনি গিয়ে ভাইয়াকে পাঠিয়ে দেবেন।তাহলেও হলো।”

-“আচ্ছা।তুমি একটু ফাহাদকে বলো গিয়ে।”

-“ঠিক আছে মামী।”

খুশবু গিয়ে ফাহাদ আর জরিনা বেগমকে সবটা জানায়।জরিনা বেগম রেগে গেলেন।বাবা অসুস্থ এটা আগে কেনো জানানো হয়নি।ব্যাগ থেকে জমানো কিছু টাকা বের করে বউয়ের হাতে তুলে দেন। ফাহাদও রাজি হয় তাকে দিয়ে আসতে।দুজনে একত্রে বেরিয়ে গেলো।

খুশবু জরিনা বেগমের সামনে কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে বললো,

-“ক্ষিদে পেয়েছে বুড়ি?”

-“ওয়”

-“নুডুলস খাবে?আমি রান্না করি?”

-“এহহে!আমি খাই না নুডুলস। পাপড় ভাজ গিয়ে।”

খুশবু বললো, -“বুড়ির যত ঢং! দাঁত অবশিষ্ট নেই কুটুর কুটুর করে আবার পাপড় খাবে….দিচ্ছি দাড়াও”

রান্নায় হাত দেয় খুশবু।একপাশে নুডুলস এর জন্য পানি বসিয়ে অন্য চুলোয় পাপড় ভাজতে শুরু করলো। ভাজা শেষে তার বুড়িকে দিয়ে এসেছে।সেও আজকাল স্টার জলসার নাটকে মগ্ন।টিভির দিকে মনোযোগ দিয়ে খেতে শুরু করেন জরিনা বেগম।খুশবু ফিরে যায়। পেঁয়াজ মরিচ কুচি করতে করতে চোখ যায় টিলার উপরে।নাহ! নেই কেউ সেখানে।ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে রান্নায় মনোযোগী হলো।মিনিট পাঁচেক বাদে ফোন বেজে উঠলো।ফোন হাতে নিয়ে খুশবু টিলার দিকে নজর দেয় আরো একবার।শূন্য স্থানে পুরুষের ছায়া দেখা যাচ্ছে।রিসিভ করে কল।

-“অপেক্ষায় আছি”

-“আর কাজ করছি” সোজাসুজি জবাব দেয় খুশবু।

-“কি কাজ করছেন?”

-“রান্না করছি”

প্রশ্নের পৃষ্টে আবার প্রশ্ন এলো, -“কি রান্না করছেন?”

-“নুডুলস”

আফতাব এর নজর ঘুরতে ঘুরতে রান্না ঘরের দিকে পড়লো।ছোট্ট একটা জানালার মধ্যে দিয়ে ফোন কানে দাঁড়িয়ে থাকা খুশবুকে চিনতে ভুল করেনি। দুষ্টু বুদ্ধি আটে মাথায়।

খানিক অসহায় গলায় বললো, -“আমিও ক্ষুধার্থ।যদি নুডুলস খাওয়ার সৌভাগ্য হতো তাহলে সন্ধ্যাটা জমে যেত।”

-“বাড়ি গিয়ে কাউকে বলুন বানিয়ে দিতে।”

-“সেটাই ভাবছি।কিন্তু কি করবো মা বাড়িতে নেই।বাবা রান্না জানে না।”

কথার অর্থ ভালোভাবেই বুঝেছে খুশবু।আকার ইঙ্গিতে তার হাতের নুডলস খাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করছে।আফতাব আবার বলে উঠে,

-“আপনিও নুডুলস রান্না করছেন।এক কাজ করুন আমার জন্য নিয়ে আসুন একটু।চেখে দেখি কেমন”

মনেমনে ছোচা বলে যাচ্ছে আফতাবকে। খুশবু একটার বিপরীতে দুটো পাত্র বের করে নেয়। সার্ভ শেষে লাইনে অপেক্ষা করা আফতাবকে বললো,

-“নেমে আসুন।নিয়ে যান।না দিয়ে খেলে আমার আবার পেটে ব্যথা করবে”

-“আপনি আসুন।আমার পায়ে ব্যাথা”

গতকালকের মতন তেমন ভয় কাজ করছে না। সহজভাবেই আফতাব এর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।তবে সাবধানে। নুডুলস এর বাটি আফতাব এর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

-“যাই আমি?”

-“কেনো?বসুন।খেয়ে রিভিউ দেই”

খুশবু দাঁড়িয়ে রইলো।আফতাব নগ্ন জমিনে পা ভাঁজ করে বসেছে।আজও সেই সাধারণ বেশভূষা।শুধু টি শার্টের রঙে পরিবর্তন।কালো রঙের টি শার্ট গায়ে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিলো খাবারে। দ্রুততম খাওয়ার গতি।খাচ্ছে আর নাক টানছে।খাওয়া শেষে খুশবুর দিকে চেয়ে হেঁসে বললো,

-“খুব সুস্বাদু।”

আবারো গুরুত্বহীনতায় পড়ে যায় আফতাব এর বাক্যযুগল।তার মুখের অবস্থা দেখে হাসি পাচ্ছে। খুশবু নিজের আন্দাজে ঝাল দিয়ে তৈরি করেছে।ঝালে নাক টানতে লাগলো বারেবারে।

-“আমি পানি আনছি।নাহয় আজ আপনার রক্ষে নেই”

পানির বোতল হাতে নিয়ে ফিরে এসেছে।আফতাব বসেই গটগট করে গিলে।অর্ধেক বোতল শেষ করেছে প্রায়।ঝালে কপালে জমতে থাকা ঘাম হাতের তালু দিয়ে মুছে উঠে দাঁড়ায়।

খুশবু জানতে চাইলো, -“ঠিক আছেন?”

আফতাব মাথা দোলায়। বৃদ্ধাঙ্গুলে থামস আপ দেখিয়ে বোঝালো সে ঠিক আছে।নিজেকে দোষী করতে গিয়েও করলো না খুশবু।তার কি দোষ এখানে? স্বেচ্ছায়তো আর ঝাল খাওয়ায়নি।সে নিজে চেয়েছে।

আফতাব নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে খুশবুর দিকে দৃষ্টি তুলে তাকালো।ঠোঁটের কোণে লেগে আছে দুষ্টু হাসি।যেনো আফতাবকে ঝাল খাইয়ে আনন্দিত সে।

সন্ধ্যার শীতল হাওয়া মৃদু শব্দে গায়ে এসে মেখে যাচ্ছে।আফতাব বললো,

-“সময়টা সুন্দর না খুশবু?”

-“হুম?কি?”

-“আপনাকে যে বিয়ে করবে সে সত্যিই সৌভাগ্যবান।সেই সৌভাগ্যের পৃষ্ঠায় কার নাম উঠে সেটাই দেখার বিষয়”

চলবে…