তেইশতম বসন্ত পর্ব-০৫

0
13

তেইশতম বসন্ত
পরিসংখ্যা ৫
লেখনীতে – Azyah(সূচনা)

স্নিগ্ধতায় ঘেরা এই মৌসুম।চঞ্চল সমীরণে হৃদ উদ্দীপিত।মাঘ মাসের অন্তিম লগ্নে ফাল্গুনী সুরভী হলুদ ফুলের ন্যায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে এই বাতাবরণে।আজ বাংলা মাসের প্রতি অতীব আগ্রহ জাগলো।ইংরেজিতে অভ্যস্ত বাংলা মাসের আগমনের দিন গুনছে।বসন্ত নামটাই আফতাব এর খুব পছন্দের।কেমন যেনো বিচিত্র ভালোলাগা বহে পবনে।এই বর্ষ আরো মোহিনী মায়ায় ঘেরা।নব কদম পড়েছে মনের খাঁচায়।ফুল এর ঘ্রাণের সাথেসাথে এক বিশেষ অঙ্গনা তার খুশবু ছড়াচ্ছে চতুর্দিকে।পছন্দের ক্যামেলিয়ার ঘ্রাণের সাথে মিলেমিশে মতোয়ারা করতে প্রস্তুত।

গতরাতে বিরক্ত করেনি আর খুশবুকে।দেখা হয়েছে।এটাই অনেক।যান্ত্রিক থেকে বাস্তব অনেক সুন্দর।আর তার চেয়ে সুন্দর অপেক্ষা।তবে যে এই অপেক্ষাটাও বেশি সময় করতে পারলো না আফতাব।সকাল সকাল ফোন মিলিয়েছে।প্রয়োজন তার প্রিয় ক্যামেলিয়ার সাথে কিছুক্ষনের বার্তালাপ।

-“শুভ সকাল”

মাত্র বিছানা ছেড়ে উঠেছিল।আবার তাল বাহানায় বসে পড়লো।বিছানার হার্ড বোর্ডে পিঠ ঠেকিয়ে।জবাব দিলো,

-“শুভ সকাল”

-“মাত্র উঠলেন বুঝি খুশবু?”

-“হুম।”

-“সকাল এগারোটা বাজে।এত বেলা করে উঠতে হয়না।”

মনেমনে খুশবু ভেবেই দিলো।শুরু হয়েছে আর্মিগীরি।সুযোগ পেলেই ডিসিপ্লিনের জ্ঞান দিতে ছাড়বে না।খুশবু জবাব দেয়,

-“রাতে দেরিতে ঘুমিয়েছিলাম।তাই উঠতে দেরি হয়েছে।”

-“রাত জাগাটাওতো ঠিক না।”

খুশবুর রাগ হলো।বললো,

-“আপনারা এমন কেনো বলেনতো?সব জায়গায় ডিসিপ্লিন,টাইম রেগুলেশন, রুলস অ্যান্ড অল!জীবন হতে হবে মুক্ত পাখির মতন।যখন যেভাবে উড়তে ইচ্ছে হবে উড়বে।কোনো বাঁধা নেই যেখানে”

খুশবুর কথা যৌক্তিক মনে হলো আফতাব এর।তবে সময়ের অপচয়ওতো ঠিক না। দোটানায় পড়ে কিছু সময় নীরব রয় আফতাব। খুশবু উত্তর না পেয়ে বললো,

-“দেখলেনতো!আমার কথা সঠিক তাই আমার কথার বিপরীতে কোনো উত্তর দিতে পারছেন না।”

আফতাব হেঁসে জবাব দেয়,

-“পাখিরা কঠোর পরিশ্রম করে।খাবারের সন্ধানে যায়,খড়কুটো তুলে এনে নিজের ঘর নিজে বানায়।ঠিক সন্ধ্যে বেলায় নিজের বাড়িতে ফেরে।এর বিনিময়ে স্বাধীনতা তাদের প্রাপ্য তাই না?”

-“বাব্বাহ! পুরো ডিটেইলিংএ চলে গেলেন আমাকে ভুল প্রমাণিত করতে?আমিও করি পরিশ্রম!”

-“তেমন কিছুই না।তা কেমন পরিশ্রম শুনি?” আফতাব জানতে চায়।

-“পাখিদের পড়ালেখা করতে হয়না।প্রতিদিন ঘুম নষ্ট করে ক্লাসে যেতে হয়না,শতশত এসাইনমেন্ট করতে হয়না।পরীক্ষার হলে যুদ্ধ করতে হয়না।চাকরির জন্য দৌঁড়াতে হয়না।আরো অনেককিছু আছে।”

মুখ ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে আফতাব।সে নিজেই এত এত পরিশ্রমের কথা শুনে হাঁপিয়ে উঠেছে। পরক্ষনেই বললো,

-“ওকে মিস পরিশ্রমী খুশবু।মেনে নিলাম। আমি ভুল আপনি সঠিক”

-“ঠিক আছে”

খুশবুর সহজ সরল বোকা উত্তরে হাঁসির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।শব্দ করে হেসে চলেছে আফতাব।আর খুশবু শুনছে। মনোযোগ সহকারে।পুরুষ মানুষের হাঁসির সুর এত সুন্দর হয়? কই তার ভাইওতো হাঁসে। তার হাঁসিকে রাক্ষসের হাঁসির সাথে তুলনা করা যায়।এখানে কেস পুরো উল্টো।নির্বাক হাস্য ধ্বনি শুনতে থাকা খুশবুকে জাগ্রত করে আফতাব।

বলে,

-“পরশু রাতে ক্যাম্পে চলে যাচ্ছি”

খুশবু খানিকটা নড়েচড়ে উঠে।কি উত্তর দিবে ভেবে পেলো না। নীরবতা তার ক্ষেত্রে বেমানান।তাই বললো,

-“ওহ”

-“আবারো আপনার সময় চাইছি।এবার পরিমাণ একটু বেশি।আগামীকাল বিকেলটা আমাকে দিন।”

-“কিভাবে?”

-“আমার পরিচিত আর আপনার অপরিচিত শান্তির শহরটা ঘুরে দেখি?”

সরাসরি না করার সাহস হচ্ছে না।কেমন দেখায়?এরমধ্যে ফাহাদ নেই।মামীর সাথে গিয়ে সেখানেই আটকা পড়েছে। মামাও সেখানেই। খুশবু বুঝে উঠতে পারলো না কি করবে!

-“কি হলো খুশবু?”

-“আমাকে একা বাহিরে যেতে দিবে না।”

-“একা?আমি আছিতো।”

-“আপনি বুঝতে পারছেন না।নতুন শহর।তার মধ্যে বাবা,মা,ভাই কেউই নেই।একা কি বলে বের হবো?বাড়ির মানুষ জানলে রাগ করবে।”

মেয়েদের কিছু বাধ্যবাধকতা থাকে।আফতাব জানে।এখন নিজের আবদারকে বাড়াবাড়ি মনে হলো।না জেনে বুঝে বলে বসেছে!

আফতাব বললো, – “সরি।আমার বিষয়টা মাথায় রাখা দরকার ছিলো”

খুশবু মুচকি হাসে।বলে, – “কিভাবে মাথায় রাখবেন? আপনিতো ছেলে।ছেলেদের এসবের সম্মুখীন হতে হয় নাকি?ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।”

-“ধন্যবাদ আপনাকে গিল্টি ফিল করা থেকে রক্ষা করার জন্য।…..তবে খুশবু?”

-“জ্বি?” নরম গলায় বললো খুশবু।

-“আমি কিন্তু বিকেলটা চাই।সেটা ওই টিলায়।ওকে?”

খুশবু ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ঘুরিয়ে জবাব দেয়,

-“দেখি।যদি ফ্রি সময় পাই”

__

সিলেটিরা অতিথি আপ্যায়নের ক্ষেত্রে কোনো রকম কার্পণ্য করেননা।তাদের আতিথেয়তায় ভুগছে ফাহাদ।মামীকে বাড়ি দিয়ে আসতে গিয়ে নিজে ফেঁসে গেলো এখানে।কিছুতেই যেতে দেওয়া হবেনা তাকে।মামী যতদিন আছেন ততদিন এখানেই তার অবস্থান।তার কেনো কোনো প্রকার সমস্যা না হয়?বিরক্তবোধ না করে সেই ব্যবস্থাও করা হলো। তারই সমবয়সী একজনকে তার সাথে রাখা হয়েছে।ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছে সে তাদের এলাকা।চেষ্টা করছে যেনো কোনোভাবে বোর ফিল না করে।বাড়িতে একজন রোগী থাকা স্বত্বেও তার প্রতি যে আন্তরিকতা দেখাচ্ছে সেটাই অনেক। মায়া হলো ফাহাদের।তাই কথা না বাড়িয়ে এখানেই রয়ে গেছে।

মাত্রই ফিরলো বাড়িতে।রাত করে।খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে তার জন্য।মামা মামীও এখানে উপস্থিত।একই সঙ্গে এতবড় ফ্যামিলির সাথে কোনোদিন ভোজন গ্রহণ করা হয়নি। ছোট পরিবার তাদের।বাবা,মা,বোন ছাড়া ঢাকা শহরে তেমন আত্মীয়ও নেই।খাওয়া দাওয়া শেষ করে ফাহাদ মামার কাছে গিয়ে বলল,

-“খুশবু আর নানী একা ওখানে।চিন্তা হচ্ছে তাদের জন্য।”

জিতু ফাহাদের কাঁধে হাত রেখে বললেন,- “কোনো টেনশন নাই মামা। আমাদের বাড়ির পাশেই কর্নেলের বাড়ি। তাছাড়াও আশপাশে কয়েকজন সেনা সদস্য দের বাড়িঘর আছে তাই পুলিশী টহল থাকে।আর আমরা বাড়িতে না থাকলে আম্মার সাথে স্বর্ণা থাকে।”

ফাহাদ অবাক হলো।পাশের বাড়িটা চিনেছে সে।কিন্তু কর্নেল?সেদিন যার সাথে দেখা হলো সেতো কর্নেল নয়।ফাহাদ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ছুঁড়ে,

-“ক্যাপ্টেনতো মামা”

-“তুমি চিনো?”

-“হ্যাঁ সেদিন সকালে দেখা হয়েছিল। ক্যাপ্টেন আফতাব ছিলেন মেবি নাম।”

-“ওহ! কর্নেল রফিকুজ্জামান মির্জার ছেলে হবে।বাপ ছেলে দুজনই সেনাবাহিনীর।…..তোমার চিন্তার কোনো কারণ নেই।ঘুমিয়ে পড়ো”

বিছানায় পিঠ ঠেকেছে ফাহাদের।ডাবল বেড। পাশের বেডে তার কয়েকদিনের সঙ্গী।মামীর ভাই হয় সে। খুশবুকে মেসেজ করলো।জানতে চাইলো ঠিক আছে কিনা। খুশবুর বুলেট ট্রেনের মতন উত্তর সস্তি দিলো।তাকে যাবতীয় ইনস্ট্রাকশন দিয়ে ফোন রেখে ঘুমোতে যাবে ঠিক তখনই আরো একটি মেসেজ আসে।

নেহা মেসেজ করেছে।লিখেছে,

-“ছবিগুলো?”

ফাহাদের মস্তিষ্ক জ্বলে উঠলো।এই কথাটা ভুলতে বসেছিলো।সে জবাব দিলো,

-“আই এম রিয়েলি সরি।আসলে আমি একটা জায়গায় আটকা পরে গেছি।তাই ছবিগুলোর কথা মাথায় ছিলো না।”

নেহার তরফ থেকে ফিরতি জবাব আসে,- “আমিও দুঃখিত।”

-“কেনো?”

-“সামান্য ছবির জন্য আপনাকে এত রাতে জালাচ্ছি।আপনি নিশ্চয়ই কোনো কাজে ব্যস্ত।”

ফাহাদ ফোনের অন্যপ্রান্তে থেকে হেঁসে উত্তর দেয়,

-“আমি ব্যস্ত না।তবে যে কাজে এসেছি সেটা গুরুত্বপূর্ণ। ল্যাপটপটাও সাথে নেই।”

-“সমস্যা নেই। আই কেন আন্ডারস্যান্ড”

-“ধন্যবাদ বুঝার জন্য। তা তুমি কি এতরাতে ছবির জন্য জেগে ছিলেন?”

-“হিহি। জ্বি না।আমি এমনেতেই রাত জাগি।আমাকে বাড়ির সকলে রাত জাগা পাখি বলে। ভাইয়াতো পাহারাদারও বলে বসে।”

-“তোমার ভাইতো যা-তা!শুধু রাজনীতি আর রাজনীতি।”

নেহা তাল মেলায় ফাহাদের কথার।সেও এই জিনিসটা অপছন্দ করে।মনের মতন কথা শুনে নিজেও বদনাম এর ঝুড়ি খুলে বসলো। জানালো তার আর তার মায়েরও রাজনীতি পছন্দ না।বাবা আর চাচার ছায়াতলে এই রাজনীতিতে আগমন তার।মায়ের কোনো বারণ শুনে না।ফাহাদ মনোযোগ দিয়ে মেয়েটির বকবকানি দেখে যাচ্ছে মেসেজে।বেগ পেতে লাগলো তাদের কথোপকথন।চললো ভোর চারটে অব্দি।

___

আসবে না আসবে না বলে জ্বালিয়েছে আফতাবকে।তারপর ঠিক বিকেলের স্নিগ্ধতায় এসে হাজির আফতাবকে স্নিগ্ধতায় ভরাতে।পা গুটিয়ে বসে থাকা ঘাসের উপর। খুশবুকে দেখলো রান্না ঘরের জানালাটা বাহির থেকে বন্ধ করে তার দিকেই আসছে। মুচকি হাঁসে আফতাব এমন কাণ্ডে।পাশে এসে দাঁড়াতেই ইশারা করলো বসতে।কিছুটা দূরত্ব নিয়েই বসলো নির্বিকার ভাবে।

পকেট থেকে কয়েকটি লজেন্স বের করে খুশবুর দিকে এগিয়ে দিলো। খুশবুর চোখ পড়তেই দ্রুত কুড়িয়ে নেয়।ভালোভাবে দেখতে থাকে লজেন্সের প্যাকেটগুলোকে।উৎসাহী গলায় বলে উঠলো,

-“এগুলো কোথায় পেলেন?…ছোটবেলায় স্কুল থেকে ফেরার পথে কিনে খেতাম।এক টাকায় পাঁচটা দিতো।ওল্ড মেমোরিস।”

আফতাব উত্তর দিলো, -“আমার শহরে সব পাওয়া যায়।”

কাব্যিক কথা শুনে নাক ছিটকায় খুশবু।পূনরায় প্রশ্ন করে,

-“বলেন না কোথায় পেলেন?”

আফতাব ঘুরে বসলো খুশবুর দিকে।বললো,

-“সাদা পাথরে চকোলেট শপগুলোতে পেয়েছি।আমারও পুরোনো স্মৃতি।তাই কিনে এনেছিলাম”

-“আমাকে দিচ্ছেন এগুলো?”

-“হুম।আপনি আমাকে নুডুলস খাইয়েছেন তার বিনিময়ে রিটার্ন গিফট….তবে একটা বিষয়ের রিটার্ন গিফট পেলাম না।মনে আছে আঘাত হেনেছিলেন?সেটার মাশুল দিচ্ছেন না কেনো?”

অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে খুশবু।কই পুরোনো লজেন্সগুলো পেয়ে খুশি হবে তা না পুরোনো আঘাত ধরে বসে আছে।আচ্ছা অভদ্র ক্যাপ্টেনতো এই লোক! খুশবুও জবাব দেয়,

-“আর্মিদের দেহ হতে হয় লোহার দেহ।এত সহজেই দুর্বল হয়ে পড়লেন ক্যাপ্টেন?”

আফতাব এর গভীর নেত্র আড়ালে খুশবুর।শুনলো শুধু গভীর কন্ঠস্বর,

-“কারণ পীড়াটাতো বাহ্যিক না অভ্যন্তরীণ।”

লজেন্সের প্যাকেট ছাড়িয়ে নিচ্ছে।সাথে আফতাব এর দিকে না চেয়েই খুশবু প্রশ্ন করলো,

-“তাহলে কি আপনার ব্যথা সারানোর জন্য চিকিৎসক হতে হবে আমার?”

-“নাহ…শুধু একটা বিশেষ ঔষধী হলেই চলবে।”

-“আচ্ছা?” আড়চোখে চেয়ে বলে উঠে।

-“ঔষধ দিয়ে ব্যাথা নাশের দায়িত্ব আমি আপনাকে দিতে চাচ্ছি।আপনি কি রাজি?”

খুশবু হেসে ফেলে।পাশে বসা মানুষটির কথার অর্থ বোধগম্যতার বাহিরে নয়।বেশ বুঝছে সে।কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই কাটকাট করে খুশবু বলে উঠে,

-“অল্প সময়ে প্রেম হয়না অফিসার।আপনার কম্পাস দিক হারাচ্ছে”

জবাব আসে হিমশীতল গলায়।ঠিক পরিবেশের মতন ঠান্ডা,

-“ভালোবাসা তৎক্ষনাৎ হয়।”

চলবে…