তেইশতম বসন্ত পর্ব-০৬

0
14

তেইশতম বসন্ত
পরিসংখ্যা ৬
লেখনীতে – Azyah(সূচনা)

রাতে আফতাব ছোট করে একটি মেসেজ লিখে খুশবুকে পাঠিয়েছিলো।জানিয়েছে সে আগামীকাল সকাল নয়টায় সে চলে যাবে। খুশবু ধরেই নিয়েছিলো আবারো আবদার করেই ফেলবে।যাওয়ার পূর্বে যেনো একবার সাক্ষাৎ হয়।কিন্তু করলো না। ব্যাপারটা বিশেষভাবে ভাবিয়েছে খুশবুকে।পাশে নাক ডাকতে থাকা নানীর দিকে একবার চাইলো। ঘড়িতে সকাল আটটা বাজে।রাতে ঘুমিয়ে আবারো হঠাৎ করে জেগে যায়।এরপর থেকেই বাকিটা রাত কেটেছে নির্ঘুম। ভোর খুব কমই দেখা হয় খুশবুর।হাজারো বকাঝকা তাকে নড়চড় করাতে পারেনি। কলেজ পাড় করার পর কোনোদিন নয়টার আগে ঘুম ভেঙেছে কিনা তাও মনে নেই।আজ সূর্য বোধহয় অন্যদিকে উঠেছে। ঘুমকাতর মেয়ের মধ্যে ঘুমের কোনো লক্ষণ নেই।

খুব সাবধানে বিছানা থেকে নেমে চোখে মুখে পানির ঝাঁপটা দিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো।চুলোয় চা বসিয়েছে।আজ হবে সে প্রকৃতি প্রেমী।চায়ের কাপ হাতে নিয়ে উঠোনে গিয়ে বসবে।উকি ঝুঁকি দিয়ে কফিটাও খুঁজে বের করে।চায়ের সাথে কফির মিশ্রণ অসাধারণ মনে হয় খুশবুর কাছে।যেমন পছন্দ তেমন কাজ।চা আর কফি একসাথে মগে নিয়ে।উঠোনে নিজের পায়ের মাপের চেয়ে বড় জুতো পায়ে দিয়ে ছটফট করতে থাকা মুরগিগুলোকে ছেড়ে দিয়ে বোকার মতোন বলে উঠলো,

-“যা উড়ে যা!”

নিজের এমন কর্মকাণ্ডে নিজেই আনমনে হেসে নেয়।উঠোনে পা গুটিয়ে জমিনে বসে মুরগিদের দৌড় ঝাঁপ দেখতে লাগলো।যেনো ছাড়া পেয়ে বেশ খুশি।তাদের পিছু পিছুই ছোটছোট বাচ্চাছানাগুলোও।শীতল ঠান্ডা হাওয়ায় মন ফুরফুরে হয়ে উঠছিলো ঠিক সেই মুহূর্তে মনে পড়লো আফতাবতো আজ চলে যাবে।পাশে রাখা ফোন হাতে নিয়ে দেখলো অনেকটা সময় হয়ে গেছে।নয়টা বাজতে আর দশ মিনিট বাকি। দীর্ঘশ্বাস ফেলার সাথেসাথে ছোটাছুটি করতে থাকা মুরগির মধ্যে একটি দরজা বেয়ে বাহিরে দৌড় লাগালো।

খুশবু ভরকে উঠে।একাকী বলে উঠলো,

-“আরেহ মুরগির বাচ্চা!আমার কথা সিরিয়াসলি নিতে বলিনি তো!”

দরজা ভালোভাবে বন্ধ করে ছুট লাগায় বেয়াদব মুরগির পেছনে।কিছু পথ এগিয়ে খপ করে ধরে ফেললো।দুহাতে জাপটে ধরে সামনে চাইলেই সেনাবাহিনীর গাড়ি দেখতে পায়।পাশেই লাগেজ রাখা।একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন।পরপর দুজন পুরুষ।একজনের গায়ে ইউনিফর্ম আরেকজন সাদাসিধে কাপড়ে। চিনতে এক মুহুর্ত দেরি করেনি খুশবু। ইউনিফর্ম গায়ে আফতাবই দাঁড়িয়ে।দূরত্ব বেশি নয়।স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।ইউনিফর্ম পড়া অবস্থায় ভালোভাবে আজই প্রথম দর্শন হলো।অন্যদিকে বাবা মা থেকে বিদায় নেওয়ার মাঝেই চোখ যায় সামনের দিকে।আফতাব খুশবুকে দেখে আশ্চর্য্য।তবে তার হাতে মুরগি দেখতে পেয়ে ফিক করে হেঁসে উঠল।

রফিকুজ্জামান প্রশ্ন করলেন ছেলের উদ্দেশ্যে,

-“হাসছো কেনো?”

-“নাহ কিছুনা বাবা।আসি ভালো থাকবে। আসসালামু আলাইকুম”

মাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে গাড়িতে চেপে বসে।তাদের সামনে খুশবুর সাথে কথা বলা অসম্ভব।গাড়ি চলতে লাগলেই পিছু হটে যায় খুশবু।এতখন হতবিহ্বল চোখে চেয়ে ছিলো।গাড়ি তাকে দ্রুত গতিতে অতিক্রম করে চলে গেছে।

লুকিং গ্লাসে বাবা মাকে বাড়ির ভেতরে চলে যেতে দেখে আফতাব ড্রাইভারকে বলে উঠলো,

-“আখতার গাড়ি ব্যাকে নিন একটু”

-“কেনো স্যার?”

-“দরকার আছে আপনি নিন।”

গাড়ি উল্টো ফিরে আসে।আফতাব জানতো খুশবু এখনও দাঁড়িয়ে। লুকিং গ্লাসে চেয়ে সেটা নিশ্চিতও হয়েছে।এখনও মুরগিটা তার হাতে।গাড়ি পেছনের দিকে আসতে দেখে বেশ আগ্রহ নিয়ে নড়েচড়ে দাঁড়ায়
ঠিক তার বরাবর এসে থেমেছে।আফতাব এর হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে খুশবু ঠোঁটের এক কোণে কিঞ্চিত হাঁসি টেনে নিলো।

আফতাব জানালার দিকে সামান্য ঝুঁকে প্রশ্ন করলো,

-“ও কি আপনার বন্ধু?”

খুশবু অবুঝ গলায় জানতে চায়, -“কে?”

আফতাব ঠোঁট কামড়ে হেঁসে জবাব দেয়, -“এই মুরগিটা”

কথার রসিকতা বুঝতে বেগ পেতে হলো না।নিজেও নিজের কান্ডে হাসতে লজ্জিত বোধ করছে না। চেঁচাতে থাকা মুরগিটিকে দরজা দিয়ে ভেতরে রেখে দরজা বন্ধ করে দেয়।বলে,

-“জনাব পালিয়ে যাচ্ছিলো।ধরে এনেছি।”

আফতাব এর তরফ থেকে জবাব আসে,

-“কিন্তু এটাতো মুরগি।মোরগ না।আপনি ওকে জনাব কেনো বলছেন খুশবু?”

ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আফতাব এর দিকে চাইলো খুশবু।তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো,

-“একটা হলেই হলো।এত ক্রিটিকাল কেনো আপনি?আমি বলেছি আপনি বুঝেছেন।শেষ কাহিনী!”

আফতাব বললো,

-“হুমমম! ভেজালমুক্ত নারী।”

খুশবু নরম গলায় প্রশ্ন করে,

-“চলে যাচ্ছেন?”

আফতাব এর মুখটা মিয়ে এলো।মন খারাপের সুরে বললো,

-“হ্যাঁ।”

-“ওকে টেক কেয়ার!”

-“আজ থেকে কিন্তু বখাটে রূপে ফিরে আসবো।চললাম”

খুশবুকে বিদায় জানিয়ে গাড়ি ছুটেছে তার উদ্দেশ্যে।আফতাব এর কথা বুঝতে কিছুটা সময় লাগলেও পরবর্তিতে ঠিক বুঝে নেয়।অর্থাৎ সে আবারও কল করবে। ক্যাম্প থেকে বখাটের বেশে জ্বালাবে তাকে। খুশবু গাড়িটির দিকে চেয়ে আছে।

ঠিক তখনই কেউ পেছন থেকে ভরাট গলায় প্রশ্ন করলো,

-“তুমি কি ওকে চেনো?”

খানিক ধড়ফড়িয়ে উঠে খুশবু।ঘুরে তাকিয়ে দেখলো একজন মধ্যবয়স্ক লোককে।প্রথমে না চিনলেও হুট করে মস্তিষ্কের বাতি জ্বলে উঠে।মনে পড়লো আকাশী রঙের ফতুয়া পড়া লোকটা।তার সামনে হাত পেছনে বেঁধে থমথমে মুখে চেয়ে আছেন।

খুশবু খানিক ভীত গলায় বললো, -“না মানে…কার কথা বলছেন?”

-“গাড়ি দিয়ে যে গেলো। যার সাথে কথা বললে?”

খুশবু তার পরিচয় না জেনেই উত্তর দেয়, -“চিনি”

রফিকুজ্জামান অনেকটা আশ্চর্য্য চোখে চাইলেন খুশবুর দিকে।পর্যবেক্ষণ করলেন তার ভীত মুখটা।প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন আবারো,

-“কোন বাসায় থাকো?”

খুশবু হাত তুলে বাড়ির দরজার দিকে ইশারা করে।বিনয়ের সুরে বললো,

-“এই বাড়িটায়।আমরা এখানে ঘুরতে এসেছি।ঢাকা থাকি”

সরল মনে বলে দিয়েছে খুশবু।আফতাব এর সাথে কথা বলতে দেখে অন্যরকম চিন্তা মাথায় আসলেও মেয়েটির মুখ দেখে কেনো জেনো তাকে খারাপভাবে নিতে ইচ্ছে হচ্ছে না।

আবার প্রশ্ন করলেন, -“কতদিন যাবৎ চেনো আফতাবকে?”

খুশবু স্বল্প সময় নিয়ে ফের প্রশ্ন করলো নিচু গলায়,

-“আপনার পরিচয়টা?”

-“আমি ওর বাবা”

সমস্ত কথাগুলো গলায় আটকে আসে।এবার না কোনো প্রশ্ন মুখ ফুটে আসবে না উত্তর। আকষ্মিক ভীত হয়ে উঠে খুশবু।তিনি দেখেছেন তাদের কথা বলতে।কি ভাববেন?যদি রেগে যান?একটা ছেলে ও মেয়ের একে ওপরের সাথে কথা বলা সমাজ এখনও ভালো চোখে দেখে না।খুশবু চুপ হয়ে গেলো।

-“বললে না যে কতদিন যাবৎ চেনো আফতাবকে?”

আমতা আমতা করে খুশবু জবাব দেয়,

-“অল্প কয়েকদিন।আসলে আংকেল আমরা সাদা পাথর গিয়েছিলাম।সেখানে…আসলে”

রফিকুজ্জামান উত্তর দেন,

-“ওহ আচ্ছা বুঝেছি।এমনেতেই প্রশ্ন করলাম তোমায়।কিছু মনে করবে না।আসি”

প্রাণ ফিরে পায় খুশবু। ঝটপট জবাব দেয়,

-“জ্বি। আসসালামু আলাইকুম”

সালামের জবাব দিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন রফিকুজ্জামান। পায়ের জুতো দেখে বোঝা গেলো সকালে হাঁটতে বেড়িয়েছেন ছেলেকে বিদায় দিয়েই।এক দৌড়ে ঘরে প্রবেশ করে ফোন হাতে নিলো।আফতাব এর নাম্বারটা ডায়াল লিস্টেই ছিলো।কল মেলায় তাকে।অর্ধেক রাস্তায় খুশবু এর নাম্বার থেকে ফোন পেয়ে খানিকটা চমকিত আফতাব।রিসিভ করে কিছু বলার পূর্বেই খুশবু হাঁপিয়ে বলতে লাগলো,

-“জানেন আপনার বাবা আমাদের কথা বলতে দেখেছেন। এতক্ষন আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন।উনি কি অনেক রাগী?মুখ দেখেতো মনে হলো রাগী।আমার ভয় করছে।আপনি কেনো ফিরে এলেন আবার?এখন কি হবে?আমাকে যদি খারাপ ভাবেন?”

এক নিঃশ্বাসে খুশবুর কথা শুনে হতবাক আফতাব।মুখ থেকে কথার ফোয়ারা ফুটছে। একসঙ্গে ভীত গলায় কত কথা বলে ফেললো।কোনটার উত্তর দেবে?বাবার সাথে তার দেখাটাও সম্পূর্ণ কাকতালীয়।

আফতাব বললো, -“রিলাক্স খুশবু”

-“কিসের রিল্যাক্স!আপনাকে দেখে নিবে দেখিয়েন। অপরিচিত মেয়েদের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলেন।”

কিঞ্চিৎ হাঁসি ফুটে আফতাব এর মুখে।অদ্ভুতভাবে খুশবুর অস্থির চরিত্রটাও বিশেষভাবে ভালো লাগছে।ইচ্ছে হলো একটা জ্বালাতন করা যাক। গাড়ীর সিটে পিঠ এলিয়ে বললো,

-“আমার বাবা খুবই স্ট্রিকড।আমারই ভুল হয়েছে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আপনার সাথে কথা বলা।কি করবো বুঝতে পারছি না।আমি সেখানে নেই।তাই বাবা আমাকে কিছু বলতেও পারবে না। আপনি সাবধানে থাকবেন বুজেছেন।বাবা যদি আপনাদের বাড়িতে বিচার নিয়ে আসে ভয় পাবেন না একদম।”

খুশবু শঙ্কিত;আড়ষ্ট।সাথেসাথে রাগান্বিত ভাবটা ফুটে উঠে।কিভাবে তাকে বাঘের খাঁচায় একা ফেলে দিব্যি পাড় হয়ে গেছে।সহজেই বিশ্বাস করে নেওয়ার স্বভাবটা চড়ে বসে মস্তিষ্কে। দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠলো,

-“কি স্বাভাবিকভাবেই কথাটি বলছেন!যদি সে বিচার নিয়ে আসে আমি আরো বিচার দিবো আপনার নামে”

-“আচ্ছা?কি বলবেন শুনি?”

-“এইযে! বখাটেদের মতন আমাকে রাতে দিনে বিরক্ত করেন।”

খুশবুর কন্ঠস্বরে অস্থিরতা।বেশিবেশি বোধহয় ঠিক হবে না।তাই কদম ফিরিয়ে নিলো আফতাব।বললো,

-“শুনুন!মজা করছিলাম।এমন কিছুই হবে না।আপনি শান্ত হয়ে একটা নিঃশ্বাস নিন”

সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে খুশবু জবাব দেয়,

-“এমন মজা কেউ করে?”

-“আমি করি।চিন্তার কোনো কারণ নেই।বাবা হয়তো কথা বলতে দেখেছেন তাই আগ বাড়িয়ে এসে জানতে চেয়েছেন। দ্যাটস ইট”

___

মামা ও মামীসহ বাড়ি ফিরেছে ফাহাদ।বোন আর নানীকে ঠিকঠাক দেখতে পেয়ে মনেমনে স্বস্তিটাও অনুভব করে।এসেই চা নাস্তা নিয়ে লেগে পড়লো কাজে।কথা দিয়েছে আজই ছবিগুলো এডিট করে দিবে।একহাতে চায়ের কাপ আর অন্যহাতে টোস্ট বিস্কুট নিয়ে ফাহাদ এর পাশে পা গুটিয়ে বসলো খুশবু। ল্যাপটপে উকি ঝুঁকি দেওয়াতে চোখ রাঙানির শিকারও হয়েছে ফাহাদের কাছে।তারপরও থেমে থাকলো না।ইচ্ছে হলো কাজে একটু বাঁধা দেওয়া যাক। বিস্কুট এর ঝুরো মাখা হাত ফাহাদের শার্টে ঝেড়ে নেয় নির্ভয়ে।এসব স্বভাব পুরোনো। রাগাতে কার না ভালো লাগে।অপরাধের শাস্তিও তৎক্ষনাৎ পেয়েছে।ফাহাদ হাত মুঠ করে খুশবুর মাথায় গাট্টি দিয়ে বললো,

-“বেয়াদব হচ্ছিস!”

মাথায় হাত বুলিয়ে খুশবু জবাব দেয়, -“তোমার দেখানো পথেই চলছি।”

-“বিরক্ত করিস না কাজ করতে দে।”

-“ভাইয়া বাবা মা কি আসবে না?দুই দিন পরই আমার জন্মদিন।”

ফাহাদ খুশবুর লটকে থাকা মুখের দিকে চায়।জন্মদিন পালন করে না তেমন আহামরিভাবে।তবে এই বিশেষদিনে পরিবার একসাথে বসে আড্ডা দেয়।রাত বারোটার পর চারজনে মিলে পুরোনো গল্পের ঝুড়ি খুলে বসে।প্রতি বছর শুনতে পাওয়া যায় নতুন গল্প।সাথে পুরোনো এলবাম। স্মৃতি বিজড়িত অধ্যায়গুলোর পুনঃঅধ্যয়ন।এটা তাদের পারিবারিক নীতি।অনেক সময় হতে চলে আসছে।ছোটোবেলা থেকে অভ্যাসটা এক পর্যায়ে নিয়মে পরিণত হয়।এবার সেটা হচ্ছে না।বাবার কাজ শেষ হয়নি।তাই সিলেটে আসার প্ল্যান আপাদত পিছিয়ে গেছে।

ফাহাদ চোখ টিপে বললো,

-“এবার নানীকে রাত জাগাবো। উঠোনে বসে নানা নানীর সময়কার গল্প শুনবো।”

ভাবুক ভঙ্গিতে খুশবু বললো,

-“এই আইডিয়াও খারাপ না।”

রফিকুজ্জামান নিজের স্বাস্থ্যের দিকে অতীব সচেতন।তার মতে বয়সের দোহাই দিয়ে কোনোকিছুই থেমে থাকবে না। হেঁটে এসে কাপড় বদলে গোসল সেরেছেন।নাস্তা করবেন ঠিক সময়মতো।তার গিন্নিকেও ধীরেধীরে নিয়মানুবর্তিতা শিখিয়েছেন।অতিরিক্ত বিলাসিতা নেই তাদের মধ্যে।তবে নিয়ম নীতির পাকা।বাবার দিয়ে যাওয়া এই বাড়িটাকে অনেক বছরের কষ্টে তৈরি করেছিলেন।একজন সৎ সেনা সদস্য হওয়ায় কাঠখড় পোহাতে হয়েছে অনেকটাই।সম্মানের চাকরি ছিলো কিন্তু সম্মানী আহামরি ছিলো না যে আরাম আয়েশে জীবন পাড় করবে।বাড়ির কিছু অংশ ছেলের জন্য রেখেছেন।তার অল্পস্বল্প চেষ্টায় চার দেয়ালের বাড়িতে প্রাণ এসেছে।

রুমানা মির্জার মন ভালো নেই আজ।খাবার টেবিলে মুখে হাসিটুকু নেই।প্রতিবার এমন হয়।ছেলেকে বিদায় দিয়ে মুখ গোমড়া করে রাখেন প্রায় এক সপ্তাহ।রফিকুজ্জামান মির্জা বলে উঠলেন,

-“বুঝেছো রুমানা তোমার ছেলের ভাবসাবে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করছি আমি”

কাপে চা দিতে দিতে স্বামীর কথার বিপরীতে জানতে চাইলেন,

– “মানে?”

রফিকুজ্জামান মির্জা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

-“আজ দেখলাম পাশের বাড়ির মেয়ের সাথে যাওয়ার পথে কথা বলেছে।এর আগেও আমি দেখেছি তাকে টিলায়।আজ মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম। সে এখানে অতিথি।ঢাকার মেয়ে।প্রশ্ন করে জানলাম তারা একে অপরকে চেনে।”

আশ্চর্য্য সুরে রুমানা মির্জা প্রশ্ন করেন,

-“আমাকেতো কখনো এই মেয়ের কথা বললো না?”

-“ব্যাপারটা ভিন্ন তাই হয়তো বলেনি। পৌঁছে ফোন করলে তুমি একবার সরাসরি জিজ্ঞেস করোতো”

-“আচ্ছা করবো” মাথা দুলিয়ে সম্মতি দেন রুমানা মির্জা।

__

সময় পাল্লা দিয়ে দু’দিনের আটচল্লিশ ঘণ্টা নিয়ে চলে গেছে।এক বিচিত্র মন খারাপ খুশবুর মাঝে বিরাজমান।এই দুইদিনে টিলায় একবারের জন্যে যাওয়া হয়নি।ফিরে তাকানো হয়েছে কয়েকবার।তত্সত্ত্বেত্ত অভিলাষ জাগ্রত হয়নি।আগামীকাল পহেলা ফাল্গুন।ভাবতে বসলে এবার কেমন জেনো সবটা এলোমেলো। হৃদ গহ্বরের এক কোণে ধামাচাপা পড়তে থাকা ‘সাহির’ নামটার কথা স্মরণ হলো। স্বল্পমাত্রার ঘৃণার অনুভূতি হলো। খুশবু পরিতৃপ্ত।এটাই চেয়েছিলো সে।তাকে ফোন করার ইচ্ছেও হয়না।মন খারাপের কারণ আফতাব।লোকটা মনে হয় ব্যস্ত।দুদিন যাবত নিরুদ্দেশ।একবার চেয়েছিলো খুশবু কল করবে।তবে সাহস হলো না।

ফাহাদ এসেছে।রাত এগারোটা পঞ্চাশ মিনিট।এসেই বলল,

-“আয়।বাহিরে আগুন জ্বালিয়েছি।ফিশ বার্বিকিউ করবো।”

মন লটকিয়ে বললো, -“আসছি।”

-“বাবা মায়ের সাথে কথা বলেছিস?”

-“হ্যাঁ”

বহুদিন বাঁচবে এই লোক।ফাহাদের রুম ত্যাগ করার সাথেসাথে পরিচিত নাম্বার থেকে কল এসেছে।অন্যদিকে সেই মুহূর্তে ফাহাদ ডেকে উঠলো।খুশবু ফোন রিসিভ করে।

আফতাব শুরুতেই বলে উঠে, -“ব্যস্ত ছিলাম।”

-“বুঝেছি” সহজ উত্তর খুশবুর।

ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে উঠে ফাহাদ আরেক দফা।খুশবু বিরক্ত হয় সাথে শঙ্কিত।এভাবে কথা বলতে দেখলে ফাহাদ নির্ঘাত সাহির ভেবে সন্দেহ করবে। সুপ্ত অভিমান আর তাড়াহুড়োয় খুশবু বলে উঠে,

-“আজ আমিও একটু ব্যস্ত।”

আফতাব ফটাফট প্রশ্ন করে, -“কি কাজে?”

-“বিশেষ কোনো কাজ না।তারপরও আমি ব্যস্ত।”

-“আপনি রেগে আছেন আমার উপর খুশবু?”

-“নাহ!”

-“তাহলে?”

ফাহাদ এসে হাজির।ধৈর্য্য সহ্য বলতে কিছুই নেই এই লোকটার।খুশবু কান থেকে ফোন সরিয়ে নিলো। অসাবধানতাবশত ফোনটা কাটতে ভুলে গিয়েছে।ফাহাদ বলে উঠে,

-“জন্মদিন কি আমার না তোর?বুঝলাম না এতবার ডাকতে হয় কেনো?দেখেছিস বারোটা বাজতে আর পাঁচ মিনিট বাকি।আয় দ্রুত আয়।”

চলবে…